অসমের নাগরিক-পঞ্জী

0
619

স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালেই প্রথম জনগণনার কাজ হয়। এই জনগণনাকে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল অসমের প্রথম নাগরিক-পঞ্জী। তবে বর্তমান অসমের সঙ্গে তৎকালীন অসমের ভৌগলিক ক্ষেত্রের কোন মিল নেই। কারণ ওই সময়ে উত্তর পূর্বাঞ্চলের আরো কয়েকটি বর্তমান রাজ্য নিয়ে ছিল অসম প্রদেশ। পরবর্তী কালে অসম প্রদেশকে খণ্ডিত করে কতকগুলো অন্য রাজ্যের জন্ম হয় এবং অসম রাজ্যের ভৌগলিক চেহারা অনেকটাই সংকোচিত হয়ে পড়ে।

১৯৭৩ সালে অসম রাজ্যটি জনসংখ্যা ও আয়তনে ছোট হয়ে গেলেও ১৯৭৮ সালে মঙ্গলদই লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ হীরালাল পাটোয়ারির মৃত্যু পর ওই কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনের সময় স্থানীয়রা লক্ষ্য করেন যে এই কেন্দ্রে ভোটদাতাদের সংখ্যা অভাবনীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। এই অতিরিক্ত জনগণ কোথা থেকে আসলেন এই নিয়ে অনুমান করা হলো যে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ভাবে নাগরিকরা অসমে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন এবং এতে করে স্থানীয় অসমীয়ারা নিজেদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষায় বিপন্ন বলে মনে করতে থাকেন। এর ফলে অসম ছাত্র সংস্থা এই কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিল করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং এর থেকেই অসম আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।

এই আন্দোলন ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত চলতে থাকে। এই আন্দোলনের কারণে ১৯৮১ সালে অসমে জনগণনার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজকেই আটকে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে অসম থেকে বহিরাগত বিদেশী নাগরিকদের বিতাড়নের জন্য স্থানীয় জনগণের এই আন্দোলনের ফলে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৫ সালের ১৪ আগস্ট অসম ছাত্র সংস্থা ও ভারত সরকারের মধ্যে ‘আসাম অ্যাকর্ড’ নামে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। এরপর থেকেই এই অসম আন্দোলনে ভাটা পড়ে যায়। এছাড়া অসম আন্দোলনের নেতারা ‘অসম গণ পরিষদ’ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসেন। তবে ক্ষমতায় আসলেও অসম চুক্তির বাস্তবায়নে তাদের সদিচ্ছার অভাব লক্ষ্য করে পাঁচ বছর পরই জনগণ এই দলকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন। তবে অসম চুক্তির বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় অধিবাসীদের লাগাতার প্রয়াস চলতেই থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এটাকে রাজনৈতিক ইস্যু করে নির্বাচনে জয়লাভের প্রয়াসও সমান তালে চলতে থাকে কিন্তু বাস্তবে কোন সরকারই প্রকৃত বিদেশি নাগরিকদের শনাক্তকরণের কাজে বড় ধরণের কোন প্রয়াস দেখাতে সাহস করে নি। তাই অসমে একটি প্রকৃত নাগরিক-পঞ্জী তৈরির কাজে শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানির ভিত্তিতে অসমে নাগরিক-পঞ্জী তৈরির নির্দেশ দেয়। এরই ভিত্তিতে অসম সরকার এই নাগরিক-পঞ্জী তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করে। এই হলো অসমে নাগরিক-পঞ্জী তৈরির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখতে হলো কারণ অসমের বাইরে অনেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না অথচ ফেসবুকে নিয়মিত পোস্ট দেখছেন।

এই নাগরিক-পঞ্জী তৈরির কাজটা এতটা সহজ নয়। এর মধ্যে জটিলতা আছে অনেক। প্রথমেই যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় তা হলো কোন সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে একজন নাগরিককে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হবে। এই নিয়ে অসম ছাত্র সংস্থার মত ছিল ১৯৫১ সালে যে লোকগণনা হয়েছিল তারই ভিত্তিতে অসমে কারা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক তা নির্ধারণ করা হোক। অন্যদের মত ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যরাত্রি পর্যন্ত যারা অসমের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ-পত্র দাখিল করতে পারবেন তাদের প্রত্যেককে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হোক। অনেক বাকবিতণ্ডার পর ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখটিই সরকারি ভাবে এবং সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই ২৪ মার্চ তারিখটি কেন ধরা হলো এটা আমার জানা নেই কারণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে বাঙালীদের দ্বারা বিহারী মুসলমানদের নির্যাতনের কারণ দেখিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আর্মি অপারেশন চালায় এবং পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে শরণার্থীদের ঢল নামতে থাকে ভারতের দিকে। অনেকের ধারণা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন হলেও অনেকেই ভারত থেকে স্বদেশে ফিরে যান নি এবং তারা অসমে অবৈধ ভাবে বসবাস করছেন। এছাড়াও বাংলাদেশে পরবর্তীকালে জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকায় অসমবাসীরা অনুমান করেন যে জীবিকার সন্ধানে বাংলাদেশীরা ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন তাই তাদের মনে নানা ধরণের দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত  স্থানীয় জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশানুক্রমে একটি নাগরিক-পঞ্জী তৈরির কাজকে বাস্তবায়িত করার মতো দুঃসাহসিক কাজ হাতে নেয় অসম সরকার।

এই নাগরিক পঞ্জী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ধরণের সমস্যা আছে। একটি সঠিক নাগরিক-পঞ্জি তৈরির কাজে কি ধরণের সমস্যা দেখা দিয়ে পারে তা নিয়ে অতি সংক্ষেপে ব্যক্ত করার চেষ্টা করব। তবে তার আগে আমরা দেখব যে কাদেরকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হবে।

১) ১৯৫১ সালের জনগণনার তালিকায় যাদের নাম আছে।

২) ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখ পর্যন্ত যাদের নাম ভোটার তালিকায় আছে।

৩) উপরোক্তদের সন্তান-সন্ততিরা।

৪) যে সমস্ত বিদেশীরা ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে ভারতে এসে বৈধভাবে এদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।

৫) এ যাবত যাদের নাম ‘ডি’ ভোটার অর্থাৎ সন্দেহজনক ভোটার হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম আছে তারা তাদের কাগজপত্র জমা দিয়ে বৈধ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন।

এখন আসি এই নাগরিক-পঞ্জী তৈরির কাজে জটিলতার প্রসঙ্গে।

১৯৫১ সালে যে জনগণনা হয়েছিল সেখানে যাদের নাম আছে তাদের সন্তান সন্ততিরা কিভাবে প্রমাণ করবেন যে ওই ব্যক্তিই তাদের পূর্ব পুরুষ। কারণ অনেকেই স্কুলে দাখিল হোন নি এবং মেট্রিক পরীক্ষাও দেন নি। এখানে মেট্রিক বলতে আমি হাই স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট পরীক্ষার কথাই বলছি। তাই তাদের পক্ষে এটা প্রমাণ করা কঠিন হবে যে তারা ওই ব্যক্তির সন্তান। আবার মেট্রিক পরীক্ষার প্রবেশপত্রে এক সময়ে পিতার নাম থাকত না। তাদেরও এই সমস্যা আছে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যাদের বয়স ২১ বছর হয় নি তাদের নাম ভোটার তালিকায় আসে নি। এছাড়া কেউ হয়ত মিথ্যা উপায়ে ১৯৫১ সালের নাগরিক পঞ্জিতে থাকা কোন ব্যক্তিকে তার পূর্ব-পুরুষ হিসেবে দেখিয়ে নাগরিকত্ব হাসিল করে নিতে পারে সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির পরিবারের লোকেরা এই ব্যক্তির নাম তাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখাচ্ছেন কি না তা যাচাই করতে হবে। তাই এই মিথ্যাচারকে শনাক্ত করতে হলে ব্যাপক উপায়ে লিগেসি ডাটায় থাকা ব্যক্তির বংশলতিকাকে জোড়ো করে তবেই এই মিথ্যাচারকে শনাক্ত করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারি আধিকারিকদের সময় ও শ্রম একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। এছাড়াও অনেকের পূর্বজ হলেন অন্য রাজ্যের নাগরিক। তাদের নাগরিকত্বের জন্য সেই সব রাজ্যের উপর ভরসা করতে হবে। কিন্তু যেহেতু এই কাজটা তাদের রাজ্যের নয় তাই সেই রাজ্যগুলির  সরকারি আধিকারিকরা এই কাজে গুরুত্ব দেবেন না। এছাড়া সরকারি ভাবে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও অনেক ধরণের ভুল ছিল তাই অসম সরকার এই ব্যবস্থাকে নিজে থেকেই কিছুটা জটিল করে ফেলেছে।

প্রথম সরকারি ভুলটি ছিল এই যে ১৯৫১ সালের পর অসম প্রদেশ ভেঙ্গে অন্য কয়েকটি নতুন রাজ্যের জন্ম হয়েছে। সেক্ষেত্রে লিগেসি ডাটায় বর্তমানে যে সব রাজ্য অসম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে তাদের নামও লিগেসি ডাটায় থাকার কথা ছিল কিন্তু তা থাকে নি। ১৯৫১ সালে আমার বাবার নাম অসমের নাগরিক পঞ্জিতে থাকার কথা। কিন্তু শিলং যেহেতু মেঘালয়ের রাজ্যের মধ্যে পড়ে গেছে তাই অসম সরকার দ্বারা যে লিগেসি ডাটার লিস্ট বের করা হয়েছিল সেখানে আমার বাবার নাম ছিল না। এটা অসম সরকারের একটি বড় ধরণের ভুল যার ফলে আমাকে ওই সময়ের এজি অফিসের কর্মচারীদের যে তালিকা পুস্তিকা আছে সেখান থেকে লিস্ট বের করে ঐ পৃষ্ঠাটি আমার ও আমার মা ও বোনের জন্য জেরক্স করে দাখিল করতে হয়েছে। যাদের বাবা সরকারি চাকুরী করেন নি তাদের এই নিয়ে সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে ১৯৫১ সালের অবিভক্ত অসমের সকলের নামই লিগেসি ডাটায় অন্তর্ভুক্ত হলে বিষয়টি সহজ হতো। কিন্তু কি বুদ্ধিতে যে অসম সরকার অন্য রাজ্যের নাগরিকদের নাম লিগেসি ডাটা থেকে বাদ দিল তা আমার বোধগম্য হয় নি। এটা ছিল একটা মারাত্মক ভুল যার জন্য অনেকেরই সমস্যা হয়েছে।

সরকারের দ্বিতীয় ভুলটি ছিল যে সমস্ত পদবী শুনলে পরেই মনে হয় যে এরা এই অঞ্চলেরই মানুষ তাদেরকে সরাসরি নাগরিকত্ব দিয়ে দিলে প্রাথমিক ভাবে যাচাইয়ের কাজটি সরল হয়ে যেতো। কারণ অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ মানুষকে যাচাইয়ের কাজ কমে গেলে বাকিদের যাচাইয়ের কাজটা কিছুটা সহজ হতো বিশেষ করে সংখ্যা যখন কমে আসে তখন সময় ও শ্রম বাঁচে এবং অন্যদের যাচাইয়ের কাজ সহজতর হয়। তাই বলতে চাই যে অসম সরকার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যাদের উপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিল তারা নিজেদের কাজ সঠিক ভাবে করেন নি। অন্যথায় এই ৩০ জুলাইয়ে যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে ৪০ লক্ষ লোকের নাম বাদ পড়ত না। দেখা যাচ্ছে যাদের বৈধ কাগজপত্র আছে তাদের নামও বাদ পড়েছে। এমন কি স্থানীয় অধিবাসীদের নামও বাদ পড়েছে যা অবাঞ্ছিত। তাই পূর্ব পরিকল্পনা যে সঠিকভাবে হয় নি তা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।

এই নাগরিক পঞ্জী তৈরির সময়ে বারম্বার অসমে বসবাসকারী বাঙালীদের নাম ওঠে এসেছে। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় যে অসমে বসবাসকারী বাঙালীদের মধ্যে অধিকাংশই শ্রীহট্টের লোক অর্থাৎ সিলেটি। এই সিলেটিরা কেন সংখ্যায় বেশি তার কারণ ব্রিটিশ আমলে শ্রীহট্ট জেলাটি ঐতিহাসিক কারণেই অসমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ইয়াণ্ডাবু চুক্তির মাধ্যমে অসম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৭৪ সালে একজন চিফ কমিশনারের অধীনে সিলেট জেলাটিকে বেঙ্গল প্রভিন্স থেকে বিচ্ছিন্ন করে অসমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এর মুখ্য কারণ ছিল তৎকালীন অসম থেকে যতটা রাজস্ব আদায় হতো তাতে এই প্রভিন্সকে চালানো মুস্কিল ছিল। তাই রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যই কৃষিজ সম্পদে ভরপুর সিলেটকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৯০৫ খিস্টাব্দে যখন বঙ্গভঙ্গ হলো অর্থাৎ বেঙ্গল প্রভিন্সকে পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করে দেওয়া হলো তখন সমগ্র সিলেট ও অবিভক্ত অসমকে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯১২ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রোধ হয়ে যায় তখন পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে গেলেও সিলেটকে আবার অসমের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এই সিলেটকে বেঙ্গল থেকে বিচ্ছিন্ন করা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতাও আছে। এরপর ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগ হয়ে যায় তখন গণভোটের মাধ্যমে করিমগঞ্জ সাব ডিভিশনের তিনটি পুলিশ স্টেশনকে বাদ দিয়ে সিলেটের বাকি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই অংশটি বাদ দেওয়ার মূল কারণ ছিল যে এই অঞ্চলকে ভারতের মধ্যে না রাখলে ত্রিপুরার সঙ্গে ভারতের স্থলপথে যোগাযোগ থাকে না। তাই স্বাধীন ভারতেও সিলেটের একটি অঞ্চল অসমের যুক্ত থাকে। এই সব কারণে এখানের বাঙালীদের মধ্যে সিলেটের লোকের সংখ্যাই বেশি।

ব্রিটিশ রাজত্বের সময় যে সমস্ত বাঙালীরা ব্রিটিশ সরকারের চাকুরী নিয়ে বর্তমান উত্তর পূর্বাঞ্চলে এসেছিলেন তাদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি। তবে বাঙালী মুসলমানরা বিশেষত অসমে এসে বৈধভাবে বসবাস করেন ব্রিটিশ আমলেই। ওই সময়ে অনাবাদী জমিতে চাষাবাদের জন্যই তাদের নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ৪০ লক্ষ বাঙালী মুসলমানকে অসমে নিয়ে আসা হয় অনাবাদী জমিতে চাষাবাদের জন্য। এর উদ্দেশ্য ছিল অসমে সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি। ১৮৭১ সালের জনগণনার রিপোর্টে দেখা যায় পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ, ঢাকা ও পাবনা জেলার বহু মানুষ গোয়ালপাড়া, দরং, নগাও ও কামরূপ জেলায় বসতি স্থাপন করেছেন। তবে ১৯৩০ সালে তৎকালীন প্রভিন্সিয়াল সরকারের শাহদুল্লা ও গোপীনাথ বরদলৈ চেষ্টা করেন যে উপজাতি এলাকার জমিতে যেন কোন বাইরে থেকে আসা লোকেরা বসতি না করেন। তাই উপজাতি অঞ্চলকে চিহ্নিত করে বহিরাগতদের সেখানে বসতি স্থাপন করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ এতে আপত্তি জানায় এবং ব্রিটিশ সরকার আরো বেশি খাদ্য উৎপাদনের নিমিত্তে এই বিভাজন লাইনকে খতম করে দেয়। সেই সময়ে বিশেষত বাঙালী মুসলিমদের সংখ্যা অসমে বাড়তে থাকে বিশেষত অনাবাদী জমিতে অধিক ফলনের জন্যই। এর পেছনে ব্রিটিশ সরকারের সম্পূর্ণ মদত ছিল। তাই অসমের অর্থনীতি বিকাশের ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালীদের অবদান অনস্বীকার্য। তবে মুসলিম জনসংখ্যা অধিক বৃদ্ধির কারণ মূলত অশিক্ষা ও দারিদ্র্য। এই একই কারণে অসমে তপশিলী জাতি ও উপজাতিদেরও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হা্র অত্যন্ত বেশি এবং অনেক ক্ষেত্রে মুসলমানদের চাইতেও বেশি। তাই জনসংখ্যা রোধ করতে হলে শিক্ষার প্রসার ও অন্যান্য কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ব্যাপারে বাংলাদেশ মডেলকেও কাজে লাগানো যেতে পারে কারণ সেখানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য এসেছে। তবে এই যে বাঙালীরা বিভিন্ন কারণে অসমে এসে বসতি করেছেন তারা কিন্তু অবৈধ নাগরিক নন। পৃথিবীর সমস্ত দেশেই এই ধরণের ইমিগ্রেশন হয়।  এই ইমিগ্রেশোন না হলে কোন অঞ্চলের আর্থিক উন্নতি হওয়াও সম্ভব নয়। এই ইমিগ্রেশন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং চাহিদা ও জোগানের কারণেই এই ধরণের ইমিগ্রেশন হয়ে থাকে। এর জন্য খুব বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

এবারে ফিরে আসি নাগরিক-পঞ্জীর প্রসঙ্গে। এই নাগরিক-পঞ্জী তৈরির ক্ষেত্রে যে বিষয়টি নিয়ে কিছুটা জল ঘোলা হয়ে গেল তার কারণ হলো বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুরা যারা ১৯৭১ এর পর ভারতে এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে কি না তাই নিয়ে। এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হলো যে প্রথমে একটি সুষ্ঠু নাগরিক-পঞ্জী তৈরি হোক। এমনিতেই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হবে কারণ বিদেশী শনাক্তকরণের কাজ এতো সহজ নয়। এর মধ্যে যদি হিন্দু বাঙালীর প্রসঙ্গ চলে আসে তাহলে বিষয়টা আরো জটিল হয়ে পড়বে কারণ স্থানীয় মানুষদের এতে আপত্তি থাকতেই পারে। তাই একটি সফল নাগরিক-পঞ্জী তৈরি হওয়ার পর এই নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আমি নিজে একজন হিন্দু বাঙালী তাই এই ব্যাপারে আমার বক্তব্য পক্ষপাতদুষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি কোন আগমার্কা বামপন্থী নই। আমার মধ্যে মনুষ্যজনিত সীমাবদ্ধতা আছে।

পরিশেষে বলব যে আমি দেখেছি অনেকের কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও নাগরিক-পঞ্জিতে নাম ওঠেনি। অনেকের লিগেসি অন্য রাজ্যে তাই তাদেরও নাম ওঠেনি। এতে এতটা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আবেদন পত্র সংগ্রহ করে জমা করে দিন। আমার বিশ্বাস কাগজ পত্র ঠিকঠাক থাকলে নাম না ওঠার কারণ নেই। তবে অনেক বৈধ নাগরিকেরও সঠিক কাগজ পত্র নাও থাকতে পারে। তাদের কি হবে তা এই মূহুর্তে বলা মুস্কিল। তবে একটি সুষ্ঠু নাগরিক-পঞ্জী তৈরি হওয়াটা জরুরি। এই কাজে অযথা আতঙ্ক সৃষ্টি করাটা সুনাগরিকের লক্ষণ নয়। প্রয়োজনে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলাদলি অবশ্যই কাম্য নয়। যারা আমার এই লেখাটি পড়বেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।

ফীচার: The Assam Times; ছবি প্রতীকী।