সরকারী না বেসরকারী

0
588

১৯৯১ সালে ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর যে কটি সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা প্রায় প্রত্যেকেই সরকারী কোম্পানীর বেসরকারীকরণ করেছে। এই লেখাটি  কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারগুলির বিভিন্ন সময়ে নেওয়া বেসরকারীকরণ নীতির সমালোচনা বা প্রশংসা করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং  অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ তা থেকে বিশ্লেষণ করাই উদ্দেশ্য। এ ক্ষেত্রে বোঝা প্রয়োজন যে কোন কোন ক্ষেত্রে বেসরকারীকরণ সম্ভব, কোন কোন ক্ষেত্রে নয়। বর্তমান বিশ্বে কয়েকটি দেশ বাদ দিলে বেসরকারীকরণের ব্যাপারে প্রায় সব দেশেরই নীতি অনেকটাই একইরকম; শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণের মাত্রা নিয়ে তফাত থাকে। মাত্রা নিয়ে আমাদের দেশেও বিতর্ক চলমান।  এই উপলক্ষে দেখা প্রয়োজন -এই মাত্রাটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলির ভূমিকা থাকে বা থাকা উচিত।

প্রথমে দেখা যাক সরকার কি? সরকার একটি প্রতিষ্ঠান যা প্রতিটি দেশেই আছে, কখনও তা গণতান্ত্রিক, কখনও একনায়কতান্ত্রিক, কখনও সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট। কিন্তু যে ধরণের সরকারই হোক, সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বগুলি মোটামুটি একই ধরনের হয়ে থাকে অথবা সমগোত্রের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। তা হল দেশে আইন প্রতিষ্ঠা, নাগরিকরা আইন মানছে কিনা দেখা, নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদান ইত্যাদি। এর বাইরে পরিষেবা আর পণ্য সঙ্ক্রান্ত কিছু ক্ষেত্রে সরকারী ভূমিকা থাকে –  তার মূল কারণ হল এই ক্ষেত্রগুলিতে বাজার অর্থনীতির ব্যর্থতা।  বাজার অর্থনীতি একটি আধুনিক সামাজিক ব্যবস্থা যার দ্বারা বাজারে পণ্য ও পরিষেবার ক্রয় বিক্রয় হয়। বাজার অর্থনীতি মোটামুটি সমস্ত পরিষেবা ও পণ্য সরবরাহ করতে সফল হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতির মূল স্বতঃসিদ্ধগুলি কাজ করে না, ফলে সেখানে সরকারের ভূমিকা এসে পড়ে।

এই আলোচনায় ধরে নিচ্ছি সরকারও বেসরকারী কোম্পানীর মতো সমমানের পরিষেবা দিতে সক্ষম। যদিও সেটা বাস্তবে হয় না কোনও দেশেই, এমনকি খোদ আমেরিকাতেও সরকারী পরিষেবা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে লোকসানে চলে। তাও এই কারণে ধরে নিলাম, যাতে বুঝতে সুবিধে হয়। যদি প্রথমেই ধরে নিই সরকারী পরিষেবা মানেই নিম্নমানের সেক্ষেত্রে তাত্ত্বিক আলোচনার মানেই হয় না যে কখন সরকারী আর কখন বেসরকারী।

দেখা যাক কোন ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতি ব্যর্থ ? বাজার অর্থনীতি সেখানে ব্যর্থ যেখানে একটা পরিষেবা, একজন উপভোক্তার জন্য নির্দিষ্ট নয়।  যেমন ধরুন যখন দূরদর্শন অ্যান্টেনা দিয়ে দেখতাম, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি আসেনি, তখন আপনি একটা টিভিসেট আর অ্যান্টেনা কিনে বসিয়ে দিলেই  দূরদর্শন  দেখতে পেতেন।  আপনাকে টিভি দেখার জন্য কোনও মাসিক ফি দিতে হত না। ফলে এই পরিষেবাটি আপনার জন্য exclusive নয়। যেখানে আপনার জন্য আলাদা করে বিল বানানো যাবে না, সেই পরিষেবাটি বাজার অর্থনীতি দিতে পারবে না।  যখন  স্যাটেলাইট টিভি এসে গেল  তখন কেবল  অপারেটরের মাধ্যমে কিংবা ডাইরেক্ট টু হোম উপায়ে আপনার জন্য আলাদা ফি ধার্য্য করার উপায় এসে গেল। ফলে টিভি ইন্ডাস্ট্রির বেসরকারীকরণ সম্ভব হল। এখানে দেখুন, প্রযুক্তি কিভাবে বাজার অর্থনীতিকে মজবুত করছে। এই নিয়ে বিস্তৃত লেখা যায়, তবে এখানে সেই নিয়ে আলোচনা করছি না। এখানে আরো একটা প্রশ্ন উঠবে, তাহলে কি সরকারের দূরদর্শন পরিষেবা  বন্ধ করা উচিত? এর উত্তর পরে দিচ্ছি। তার আগে আরো একটা উদাহরণ দিই এই ধরণের পরিষেবার, যাতে বুঝতে সুবিধে হয়।

দৃষ্টিপাত করা যাক প্রতিরক্ষার ওপর। প্রতিরক্ষা এমন একটা পরিষেবা, যেখানে একাধিক সংস্থা বাজারে থাকতে পারে না। বাজার অর্থনীতির মূল বিষয় প্রতিযোগিতা। যদি একটি মাত্র সংস্থা কোনও পরিষেবা দেয় তাহলে সেটি মনোপলি হয়ে যায় ফলে সে প্রফিট করবে নিজের ইচ্ছে মতো। এদিকে প্রতিরক্ষা এমন একটি বিষয় যা দুটি সংস্থা দিতে পারে না। কিভাবে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে? আর আপনি এই প্রতিরক্ষার জন্য ফি ই বা কত দেবেন প্রতিমাসে? কোনও উপায় আছে কি আপনার নিরাপত্তার মূল্য মাসে কত হওয়া উচিত? আপনার আর আমার নিরাপত্তার চাহিদা কি এক না আলাদা? এই সব প্রশ্নের উত্তর নেই ফলে বাজার অর্থনীতি প্রতিরক্ষা পরিষেবা দিতে পারবে না।

এবার আসা যাক আর এক ধরনের পরিষেবার আলোচনায়। একে বলা হয় স্বাভাবিক মনোপলি। যেমন ধরুন জল সরবরাহ কিংবা বিদ্যুৎ সরবরাহ, স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, রেলওয়ে, গণপরিবহন, পোস্টাল সার্ভিস, টেলিফোন ইত্যাদি। এই বিষয়গুলিতে সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য আছে যদিও বাজার অর্থনীতি আর সরকার দুজনেই অংশ নিতে পারে। রেলওয়ে পরিষেবার জন্য রেল লাইন পাততে বিশাল খরচ। ধরা যাক আমাদের দেশে কোনও রেললাইন নেই। বাজারকে যদি জমি কিনে রেললাইন পেতে ট্রেন চালাতে হয়, তার খরচ বিশাল হবে। সেই টাকার ফেরত আসা মুশকিল। যদি ভারতের মতো গরীব দেশের কথা ভাবি তাহলে অসম্ভব। ফলে এখানে বাজার অর্থনীতি ব্যর্থ। যদি সরকার রেললাইন পেতে বেসরকারী কোম্পানিকে ট্রেন চালাতে দেয়, তাহলে সে ট্রেন চালাবে লাভজনক রুটে, যেখানে মানুষের আয় কম সেখানে চালাবে না। যেখানে লাভজনক রুট, সেখানে সরকার আর বেসরকারী কোম্পানী একই সাথে চালালে প্রতিযোগিতার জন্য সরকারের আয় কমবে, ফলে সরকার অলাভজনক রুটে যে ভর্তুকি দিচ্ছিল সেটা আর দিতে পারবে না। যদি এমন হত ভারতের আর্থিক অবস্থা সর্বত্র সমান এবং ভালো, তাহলে রেল পরিষেবার একটা অংশ অর্থাৎ ট্রেন চালানোটা বেসরকারী কোম্পানীর হাতে তুলে দেওয়া যেত  রেললাইন পাতা আর রক্ষণাবেক্ষণ সরকারের হাতে রেখে। ফলে এখানে দেখতে পাচ্ছি, তত্ত্বগতভাবে বাজার অর্থনীতি ব্যর্থ না হলেও, ভারতের বাস্তব অবস্থার কথা ধরলে সম্ভব হচ্ছে না।

এখানে তাহলে প্রশ্ন উঠবে কলকাতায় একটি বেসরকারী কোম্পানী কিভাবে বিদ্যুৎ পরিষেবা দিচ্ছে। তত্বগত ভাবে কলকাতায় যে ব্যবস্থা চলে তা সরকারী যেমন নয় আবার বাজার অর্থনীতির নিয়মও মানে না। বাজার অর্থনীতির নিয়মে বাজারে একটি পরিষেবার জন্য একাধিক প্রদানকারী থাকবে, উপভোক্তাদের কাছে পছন্দের সুযোগ থাকবে, এবং ডিমান্ড সাপ্লাই নীতিতে মূল্য নিয়ন্ত্রন হবে। কিন্তু এখানে বিদ্যুতের দাম সরকার নির্ধারণ করে। আর পরিষেবা দেয় একটিমাত্র কোম্পানী। যদি পুরোপুরি বেসরকারীকরণ করতে হয় সেক্ষেত্রে কমপক্ষে আরো একটি কোম্পানীকে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করে পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে। যেহেতু এখনকার উপভোক্তারা দুটি কোম্পানীর মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, ফলে আর একটি কোম্পানী বিনিয়োগ করবে না যতক্ষন না মূল্য অনিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। কারন অর্ধেক সংখ্যক উপভোক্তার জন্য এই পরিমান বিনিয়োগ থেকে খরচ উঠিয়ে লাভ করতে হবে বিদ্যুতের দাম এখন যা আছে তার কয়েকগুন বেশী হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা আরএকটি বিষয় যেটি ভারতে বেসরকারী ব্যবস্থার দ্বারা দেওয়া সম্ভব নয়।  এখানেও বাজার অর্থনীতি ব্যর্থ। কারণ ভারতের গ্রামাঞ্চলে যা আর্থিক অবস্থা তাতে বেসরকারী স্কুলে ফি দিয়ে পড়তে পারবে না।  ফলে একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ নিরক্ষর হিসাবে থেকে যাবে যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য খারাপ। ফলে এখানে সরকার কে নিজের খরচে স্কুল চালাতেই হবে।

স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও অবস্থা প্রাথমিক শিক্ষার মতোই। এখানে কিছুটা ব্যক্তিগত মতামত দিচ্ছি।  স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে শুধু গ্রামাঞ্চলে নয়, শহরেও বেসরকারীকরণ করা উচিত নয়। তত্ত্বগতভাবে বাজার অর্থনীতি বেসরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে সফল হলেও, ভারতে পরিকাঠামো, ডাক্তার ইত্যাদির অভাব আর জনসংখ্যা বেশী হওয়ার কারণে সরকারী আর বেসরকারী সমান্তরাল ভাবে চললে সরকারী পরিষেবা দুর্বল হয়ে পড়বে। যে পরিমান টাকা মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্ত আয়ের জনগন বীমার  পেছনে খরচ করে সরকার সেই টাকা নিজে নিয়ে কেন পরিষেবা দিতে পারবে না, এটা আমার বোধগম্যের বাইরে। একটা কথা বোঝার চেষ্টা করা যাক। বেসরকারী হাসপাতাল চলছে বেশিরভাগটাই বীমার ওপর। যারা বীমা ছাড়াই বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান তারাও বীমা করালে আমাদের গড় বীমার পরিমাণ আরো কমবে। সরকারী প্রকল্পের বীমার মাধ্যমে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাই একমাত্র কাম্য হওয়া উচিত। প্রতিরক্ষার মতোই, স্বাস্থ্যও প্রতিটি মানুষের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। একজন গরীব আর একজন বিত্তবানের নিরাপত্তার (প্রতিরক্ষার) যেমন আলাদা মূল্য হয় না, সেরকম স্বাস্থ্যেরও আলাদা মূল্য হয় না। গণতান্ত্রিকএবং বাজার অর্থনীতি মেনে চলা অনেক দেশে চিকিৎসাব্যবস্থা পুরোপুরি সরকারী।

দূরদর্শন, ডাক বিভাগ, টেলিফোন ইত্যাদি পরিষেবাগুলির বেসরকারীকরণ হয়েছে। বেসরকারী টিভি চ্যানেল থাকলেও সরকারী প্রকল্পের ব্যাপারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের কাছে পৌছানোর জন্য, দেশে জরুরী অবস্থা চলাকালীন এর প্রয়োজনীয়তা আছে। বেসরকারী কুরিয়ার সংস্থা থাকলেও, প্রত্যন্ত অঞ্চলে কম টাকায় পরিষেবার দেওয়ার জন্য সরকারী ডাক বিভাগের দরকার। টেলিফোনের ক্ষেত্রেও বিএসএনএল একই ভূমিকা পালন করে, ফলে এগুলির কোনওটিরই ভারতে পুরোপুরি বেসরকারীকরণ সম্ভব নয়।

বিমান পরিষেবার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে সরকারী পরিকাঠামোয়  কেন বেসরকারী কোম্পানী বিমান চালাবে। এখানে একটা মাথায় রাখতে হবে, বিমানের ক্ষেত্রে পরিকাঠামোর খরচ, রেল বা অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় অনেক কম। সিকিমে নবনির্মিত বিমানবন্দরটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে মাত্র ছশো কোটি টাকা। যেখানে যদি শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক রেললাইন পাততে হয় সেক্ষেত্রে খরচ হবে  ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যন্ত এলাকায় যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য সরকারকে এই ধরণের বিনিয়োগ করতেই হবে পর্যটন, চীন সীমান্ত, আপৎকালীন চিকিৎসা ইত্যাদির কথা মাথায় রেখে। কিন্তু এর সাথে এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারীকরণের কোনও সম্পর্ক নেই। এয়ার ইন্ডিয়ার চেয়ে কম পয়সাতেই যেহেতু মানুষ ভালো পরিষেবা পাচ্ছে।  প্রত্যন্ত এলাকার জন্য সরকার টিকিটের দামের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ এনেছে, ফলে বেসরকারী কোম্পানী চাইলেই দাম বাড়াতে পারবে না।

এবার আসবে কিছু ক্ষেত্র যেখানে বেসরকারীকরণ থাকবে কিন্তু সরকার কে নিজের ভূমিকা পালন করতে হবে। যেমন মদ, সিগারেট, বড় গাড়ির জন্য স্পেশাল ট্যাক্স।  সারের জন্য ভর্তুকি ইত্যাদি। বৃহত্তর উদ্দেশ্যের কথা মাথায় রেখে সরকার  এই ধরনের নীতি নির্ধারণ করে। এর বাইরে যা কিছু আছে, সব কিছুরই বেসরকারীকরণ করা যায়। ফলে অতীতে ভারত সরকার পাউরুটি থেকে হাতঘড়ি, হোটেল থেকে বিমান পরিষেবা সব কিছুর জন্যই কোম্পানী খুলেছিল, বর্তমানে সেগুলির বেসরকারীকরণে কোনও সমস্যা আছে বলে মনে করা যায়না।

বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক নীতি মিশ্র নীতি, চূড়ান্ত পুঁজিবাদী দেশও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করছে। ফলে এখন বিষয় ভিত্তিক, পরিষেবাভিত্তিক আলোচনা হওয়া উচিত। বেসরকারীকরণ শুনলেই যেমন গেল গেল রব ওঠার কারণ নেই, তেমনই আগাপাশতলা না ভেবে বেসরকারীকরণ করাও উচিত নয়।