“মুসলমান বা হিন্দু উগ্রবাদ নয়, দেশের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক মার্কসবাদীয় উগ্রবাদই:” কে কে মুহম্মদ

কে. কে. মুহম্মদ আর্কিওলজিকাল সোসাইটি অফ ইণ্ডিয়াতে সাফল্যের সঙ্গে কর্মজীবন যাপন করে শেষে রিজিওনাল ডিরেক্টরের পদে থেকে অবসর নেন। তিনি বাবরি মসজিদ নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন মালয়ালম ভাষায় লিখিত তাঁর আত্মজীবনী ন্যান্ এন্না ভারতীয়ন্ (আমি ভারতীয়) গ্রন্থতে। এই গ্রন্থের হিন্দী অনুবাদ থেকে বর্তমান লেখাটি বাংলায় তর্জমা করেছেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।

আমার জীবনকাহিনী এই বিষয়টির আলোচনা না করলে অধুরা থেকে যাবে। এই ঘটনা আমি কারুর অনুভূতিকে আঘাত করতে বা কারুর অনুভূতিকে প্রোৎসাহন করতে লিখছি না। তাই আমার সনিবদ্ধ নিবেদন এই যে কেউ যেন সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমার লেখাকে ব্যবহার না করেন।

ভারতের সঙ্গে অযোধ্যার পরিচয় হয় ১৯৯০ সালে। অযোধ্যার বিতর্কিত জমির স্বত্বাধিকার নিয়ে জাতীয় বিতর্ক তখন তুঙ্গে। আমার সঙ্গে অযোধ্যার পরিচয় কিন্তু এর অনেক আগেই। ১৯৭৬-৭৭ সালে আমার সুযোগ এসেছিল অযোধ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করার। সে সময় আমি দিল্লী স্কুল অফ আর্কিওলোজিতে এক ছাত্র ছিলাম। অধ্যাপক বি. বি. লালের নেতৃত্বে অযোধ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের জন্য এক গবেষকদল প্রেরিত হয়েছিল। দিল্লী স্কুল অফ আর্কিওলোজির ১২ জন ছাত্র সেই দলে সামিল হয়েছিল। আমি ছিলাম তার মধ্যে একজন। আমরা অযোধ্যায় সে সময় প্রায় দুইমাস ছিলাম।

সেই সময়ই, মন্দিরের স্তম্ভের নীচে আমি ইঁটের এক প্লাটফর্ম দেখেছিলাম। তখন আমরা এই আবিষ্কারকে এক প্রত্নতাত্ত্বিকের ইতিহাস সমীক্ষা হিসাবেই নির্মোহ দৃষ্টিতেই দেখেছিলাম। যখন আমরা সেখানে গেলাম, দেখলাম বাবরি মসজিদের দেওয়ালে মন্দিরের স্তম্ভ আছে। এই স্তম্ভগুলি কালো আগ্নেয় শিলানির্মিত। স্তম্ভের নীচের দিকে পূর্ণকলস খোদাই করা ছিল। মন্দিরের স্থাপত্যরীতিতে পূর্ণকলস সম্বৃদ্ধি সূচিত করার আটটি উপায়ের একটি। এই ভাবে খোদাই করা পূর্ণকলস সাধারণ ভাবে খ্রীষ্টীয় একাদশ এবং দ্বাদশ শতকের ভাস্কর্যেই দৃষ্ট হত। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার আগে, আমরা এরকম একটি দুটি নয় চৌদ্দটি স্তম্ভ দেখেছিলাম। মসজিদ তখন পুলিশের কড়া প্রহরায় ছিল এবং সাধারণ মানুষের জন্য প্রবেশ ছিল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। আমাদের উপর অবশ্য কোন বিধিনিষেধ ছিল না। আমি সতর্কভাবে কাছ থেকে বহুবার এই স্তম্ভগুলিকে পরীক্ষা করে দেখেছিলাম।

বাবরের  সেনাপতি মীর বাকি যে মন্দিরটি ধ্বংস করেন সেটির মশলা দিয়েই বাবরি মসজিদ নির্মিত। উপরিভাগে বর্ণিত কালো আগ্নেয় শিলানির্মিত স্তম্ভগুলি এবং স্তম্ভের নিম্নভাগে প্রাপ্ত ইঁটের কাঠামোগুলি মসজিদের কাছে এবং মসজিদের পিছনে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় দৃষ্ট হয়েছিল। এই প্রমাণের ভিত্তিতে আমি বাবরি মসজিদের নীচে পূর্বতন একটি মন্দিরের অস্তিত্বকে সাব্যস্ত করেছিলাম। আমার এই বয়ান এক উত্তপ্ত সামাজিক পরিস্থিতির পটভূমিকায় ১৯৯০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর বেরিয়েছিল। তখন হিন্দু এবং মুসলমান ছিল দুই বিবাদমান প্রতিপক্ষ। কতিপয় নরমপন্থী হিন্দু সমঝোতার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম জন্মভূমির উপর তাদের দাবী জানাচ্ছিল। নরমপন্থী মুসলমানেরা হিন্দুদের  হাতে ঐ জমি হস্তান্তরের পক্ষে ছিল কিন্তু এই কথা প্রকাশ্যে বলার তখন কারুরই হিম্মত ছিল না। কতিপয় মুসলমান ভেবেছিলেন যদি মুসলমানেরা ঐ জমির উপর তাঁদের দাবী থেকে সরে আসেন, তাহলে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ তাদের বাড়বৃদ্ধির সমস্ত সূত্রই হারিয়ে ফেলবে। এই রকম ভাবনাগুলিকে যদি অগ্রসর করা যেত, তাহলে হয়ত সমস্যার সমাধান অনায়াসে এসে যেত।

দুঃখের সঙ্গে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা চরমপন্থী মুসলমান গোষ্ঠীগুলির সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তাঁরা মুসলমানদের বাবরি মসজিদের উপর আপন স্বত্বাধিকারের আন্দোলন থেকে পিছু না হটতে বলেন। বাস্তবে এই ঐতিহাসিকরা অবিমৃষ্যকারী যাঁরা আপন দুষ্কর্মের ফল নিয়েও অনবহিত ছিলেন। ঐতিহাসিক এস. গোপাল, রোমিলা থাপার এবং বিপান চন্দ্র  রামায়ণের ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন যে ঊনবিংশ শতকের পূর্বে কোন মন্দির ধ্বংসের কোন প্রমাণ নেই। তাঁরা অযোধ্যাকে বৌদ্ধ-জৈন মতাবলম্বীদের কেন্দ্র বলে বর্ণনা করেন। তাঁদের সমর্থন করেন অধ্যাপক আর এস শর্মা, আনোয়ার আলি, ডি. এন. ঝা, সুরজ ভান এবং ইরফান হাবিব। এরপরেই বাবরি মসজিদের পক্ষে সমর্থনের ঢল নামে। এঁদের মধ্যে কেবল সুরজ ভান ছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক। অধ্যাপক আর. এস. শর্মার মতো কোন কোন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির পক্ষে বিশেষজ্ঞ হিসাবে বিভিন্ন মিটিংয়ে গিয়েছিলেন।

বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির অনেক মিটিংই হয়েছিল অধ্যাপক ইরফান হাবিবের সভাপতিত্বে। ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চের (আই সি এইচ আর) তৎকালীন সদস্য-সচিব অধ্যাপক এম. জি. এস. নারায়ণ বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির জন্য সরকারী সংস্থাটির অফিস ব্যবহারের বিরোধিতা করেন। তথাপি অধ্যাপক ইরফান হাবিব অফিস ব্যবহার করতেই থাকেন। মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের সঙ্গে সংবাদপত্রগুলির ছিল গভীর সম্পর্ক। তাঁরা ক্রমাগত সংবাগপত্রগুলিতে অযোধ্যার বাস্তবিকতা নিয়ে প্রশ্ন করে লেখা লিখে যেতে থাকেন। এইভাবে তাঁরা মানুষকে প্রতারিত এবং বিপথগামী করেন। এই মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা এবং এঁদের সমর্থক কাগজ টাইমস অফ ইণ্ডিয়া নরমপন্থী সমস্ত মুসলমান বুদ্ধিজীবীকে সমঝোতার রাস্তা ছেড়ে লড়াইয়ের পথে যেতে প্ররোচিত করেন। আরও দুঃখের কথা এই যে তাঁরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের ইচ্ছার জন্ম দিয়েছিল। ফলে সাধারণ মুসলমানেরা এই জমি হিন্দুদের হাতে হস্তান্তরিত করার মনোভাব থেকে সরে আসেন। সমঝোতার মনোভাব  এবং রাস্তা বন্ধ হবার জন্য একমাত্র দায়ী মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা। যদি সমঝোতার মাধ্যমে এই বিবাদের মীমাংসা হত, তবে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে দৃঢ়তম হত। দেশের বহু সমস্যার সমাধান হতে পারত। এর থেকে বোঝা যায় যে মুসলমান বা হিন্দু উগ্রবাদ দেশের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক নয়, এই শিরোপা প্রাপ্য মার্কসবাদীয় উগ্রবাদেরই। এই সমস্যাকে টাইমস অফ ইণ্ডিয়া সেকুলার দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিল। এই অপরাধের মূল্য আজও দেশকে দিতে হচ্ছে।

আজও,  ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ (আই সি এইচ আর) অযোধ্যা সমস্যা সমাধানের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। অধ্যাপক ইরফান হাবিব এখনও চালান ঐ সংস্থাকে। আই সি এইচ আরে যাঁরা বিষয়টির মীমাংসা চান, তাঁদেরকে বাধা দেন অধ্যাপক ইরফান হাবিব। সত্যি বলতে যে কোন স্বাধীন গবেষককে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয়। আই সি এইচ আরে অনেকেই আছেন যাঁরা ইরাকের আইসিসের অসহিষ্ণুতার সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের তুলনাকে অলীক মনে করেন। কিন্তু তাঁরা অধ্যাপক ইরফান হাবিবের সঙ্গে লড়াইয়ে যেতে প্রস্তুত নন। সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামী অধ্যাপক ইরফান হাবিবের দ্বিচারিতাকে প্রশ্ন করতে সাহস করেছেন। এ নিঃসন্দেহে সাংবাদিক মহলে মানসিকতার পরিবর্তনের এক স্বাগত সূচনা।

অযোধ্যা বিতর্ক যখন তুঙ্গে, যখন ঐতিহাসিকগণ এবং প্রত্নতাত্ত্বিকগণও দুই বিপরীত শিবিরে বিভক্ত ছিলেন, সেই সময়, আরও সঠিকভাবে বললে ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৯০, আমি প্রকাশ্যে নিজেকে বাবরি মসজিদের নীচে থাকা এক পূর্বতন মন্দিরের সাক্ষী হিসাবে নিবেদন করেছিলাম। আমি তখন চেন্নাইতে উপ অধীক্ষক প্রত্নতাত্ত্বিক হিসাবে আর্কিওলজিকাল সোসাইটি অফ ইণ্ডিয়াতে (এ এস আই) ছিলাম। শ্রী ঐরাবতম মহাদেবন, যিনি ছিলেন এক আই এ এস অফিসার, অযোধ্যার উপর একটি উৎকৃষ্ট বক্তব্য পেশ করেন। তিনি এক সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ ছিলেন, বিশেষতঃ সিন্ধু সভ্যতার লিপির উপর কিছু পুস্তকও লিখেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি প্রখ্যাত তামিল দৈনিক দিনমণির সম্পাদক হয়েছিলেন। তাঁর মতানুসারে, “বাবরি মসজিদের নীচে মন্দির আছে কিনা তা নিয়ে দুইটি পৃথক পৃথক অভিমত আছে। তাই সমাধান নিহিত আছে প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার মাধ্যমে একটি অভিমতের মিথ্যাত্ব প্রমাণে। কিন্তু কোন ঐতিহাসিক ভুলের প্রতিকার হিসাবে একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে (বাবরি মসজিদ) ভঙ্গ করা অনুচিত।”

আমি মহাদেবনের নিরপেক্ষ মত পাঠ করেছিলাম। আমি আমার তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা তাঁকে একটা চিঠির মাধ্যমে জানাই। আমি আমার চিঠিতে লিখলাম যে আমি ১৯৭৬-৭৭ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেছিলাম। আমি লিখলাম, “আপনি মনে করেন যে ঐতিহাসিক কোন ভুলের জন্য একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে ভেঙ্গে ফেলা অন্যায়। আমি আপনাকে আপনার মতের জন্য অভিনন্দন জানাতে চাই। আপনি পাঠকদের চিন্তাভাবনার প্রসারকল্পে আপনার অভিমত লিখেছেন।”

পত্র পেয়ে তিনি আমার অফিসে এলেন। আমার অফিস ছিল তামিল নাড়ু সেক্রেটারিয়েটের ক্লাইভ বিল্ডিংয়ে। তিনি আমাকে আমার পত্রটি প্রকাশ করার অনুমতি চাইলেন। এক সরকারী কর্মচারী স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকারের অগ্রিম অনুমতি ছাড়া মত প্রকাশ করতে পারে না। আমি এটাও জানতাম যে চাইলেও সেই অনুমতি আমি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কখনই পাব না। কিন্তু সত্যকে তো প্রকাশ করতেই হবে। আমাকে তার জন্য ঠিক সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। আমরা তিন জন আলোচনায় বসলাম। মহাদেবন ছাড়াও আমাকে পরামর্শ দিলেন অধীক্ষক প্রত্নতাত্ত্বিক ডঃ নরসিম্হা, যিনি অযোধ্যায় অধ্যাপক বি. বি. লালের নেতৃত্বাধীন প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় সমীক্ষক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। আমরা কোন হিন্দু সংগঠনের ঘুঁটি হিসাবে চলতে রাজী ছিলাম না, বরং সব রকম সাম্প্রদায়িকতা থেকে সমদূরত্বে থাকতে চেয়েছিলাম।

দি ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস আমার চিন্তা সম্পাদকের উদ্দেশ্যে আসা চিঠির বিভাগে প্রকাশ করল। পরে অন্য কিছু সংবাদপত্রও তার অনুবাদ প্রকাশ করেছিল। কেউ কেউ আমাকে অভিনন্দন জানালেন। আমি ফোনে কিছু হুমকিও পেলাম। আমি সমস্ত দল থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করে চললাম। আমার বক্তব্য প্রকাশিত হবার পর কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের সংযুক্ত সচিব শ্রী আর. সি. ত্রিপাঠী এবং এ এস আইয়ের কমিশনার শ্রী এম. সি. যোশী চেন্নাইতে ইউনেস্কোর সিল্ক রুট গোষ্ঠীর কাজে এলেন। ডঃ নরসিমা ছিলেন এই গোষ্ঠীন কাজের জন্য নির্দিষ্ট, তাঁকে কাম্বোডিয়া যেতে হল। বিদেশী প্রতিনিধিদের আতিথ্য, দেখাশুনা এবং মিটিংয়ের বন্দোবস্তের ভার পড়ল ডঃ কে টি নরসিংহম্ নামক এক পদাধিকারী আর এই অধমের ঘাড়ে। সমস্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আমাদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। ডঃ যোশী বললেন, “যদি আলিগড়ের সেই অধ্যাপক (ইরফান হাবিব) যিনি আপনার কেরিয়ারের ক্ষতি করেছিলেন, আজ এখানে হাজির থাকতেন, তবে নিশ্চয়ই লজ্জিত হতেন।” তিনি ত্রিপাঠীকে আমার ব্যাপারে বিস্তারিত বললেন।

কিছুক্ষণ পরে ডঃ যোশী আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, “আমরা দু’জন আপনার সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবৃতিটির ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে চাই। এইরকম জটিল বিষয়ে সরকারী অনুমতি ছাড়া আপনি কিভাবে সংবাদপত্রে বিবৃতি পাঠাতে পারেন? আমাদের অনুসন্ধানের পরে আপনাকে সাসপেণ্ড করা হবে।”

“স্যার, আমি জানতাম যে অনুমতি চাইলে আমাকে তা কখনও দেওয়া হত না। আমাকে দেশের কল্যাণের জন্য সত্যকে প্রকাশ করতেই হত।” আমি আমার অভিব্যক্তি বোঝাতে একটি সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করলাম, “লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্তুমর্হসি।”

“আপনি আমাকে সংস্কৃত শেখাচ্ছেন!” এলাহাবাদী ব্রাহ্মণ ত্রিপাঠী রেগে উঠে বললেন, “আমি এই মুহূর্তেই আপনাকে সাসপেণ্ড করব।”

আমি শান্তভাবে জবাব দিলাম, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ।” গীতার এই শ্লোকাংশটির অর্থ হল, আপন কর্তব্যের জন্য মৃত্যুবরণেও ক্ষতি নেই।

এটি বলার পরপরই, ত্রিপাঠীর মধ্যে পরিবর্তন দেখা গেল।

“মিষ্টার মুহম্মদ, আপনার নিষ্ঠা প্রশংসনীয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যা একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের করা উচিৎ, আপনি ঠিক তাই করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক হিসাবে আপনার সততা অবিস্মরণীয়। কিন্তু উপর মহলের চাপ আছে যে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

“স্যার, তা আমি জানি। আমি লেখাটা লেখার আগে অনেক ভেবেচিন্তেই লিখেছিলাম।”

“আপনার নিজের ঠিকানা আর সরকারী পদটি উদ্ধৃত করার কি দরকার ছিল?,” যোশি জিজ্ঞাসা করলেন।

“স্যার, ঠিকানা ইত্যাদি ছাড়া, আমার বিবৃতির প্রামাণিকতা কি থাকত? কোন মুহম্মদ? সে কোত্থেকে? আমার বিবৃতি পুরোদস্তুর প্রামাণিকতার সঙ্গে উক্ত হওয়া দরকার ছিল। তাই আমি আমার পুরো ঠিকানা দিয়েছিলাম।“

আমার বিরুদ্ধে আশু ব্যবস্থার কথা শুনে শ্রী মহাদেবন দুই আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলেন। শেষ অবধি সাসপেণ্ড আমাকে হতে হল না, পেলাম চেন্নাই থেকে গোয়াতে বদলির আদেশ। সেখানে আমার পরিবারের সঙ্গে সেণ্ট আসিসি কনভেণ্টের একটি কক্ষে আমার পরিবারের সঙ্গে থাকতাম। সেণ্ট জেভিয়ার্সের পার্থিব শরীরটি সংরক্ষিত আছে বোম জিসাস ব্যাসিলিকাতে। কথা হচ্ছিল এই গির্জার রেক্টর পাদ্রী রিগোর সাথে। দিনটি ছিল ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২। আমরা দুজনেই একসাথে শুনলাম বাবরি মসজিদ ধ্বংসের খবর। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর হিন্দু উগ্রবাদীর শাণিত দৃষ্টি ছিল গোয়ার পুরানো সব গির্জার উপর। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রথম বার্ষিকীতে, ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯৩, আমরা দুজন দুটি দলের অধিনায়ক হলাম। পাদ্রী ফিগোর দলটি সতর্ক বিনিদ্র প্রহরা দিতে লাগল বোম জিসাস ব্যাসিলিকাতে আর আমার দলটি সেণ্ট আসিসি এবং সেণ্ট ক্যাথিড্রালে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার এ এক অকল্পনীয় সৌন্দর্য যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টানরা সবাই সজাগ রইলেন এক জাতীয় সৌধকে রক্ষা করার জন্য।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে বিষ্ণু হরিশিলা পাটল  নামে এক অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান আবিষ্কৃত হয়। একাদশ বা দ্বাদশ শতকের দেবনাগরী লিপিতে এর উপরে কিছু কথা উৎকীর্ণ করা আছে। সংস্কৃতে লেখা সেই লিপিতে বলা হয়েছে যে এই মন্দিরটি বালী এবং রাবণের হন্তা বিষ্ণুকে (রাম হলেন বিষ্ণুর অবতার) উৎসর্গ করা হল। ডঃ ওয়াই ডি শর্মা এবং ডঃ কে এন শ্রীবাস্তবের ১৯৯২ সালে করা প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষায় আবিষ্কৃত হয় বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের মৃৎপ্রতিমা এবং কুষাণ যুগের (১০০ থেকে ৩০০ খ্রীষ্টাব্দ) শিব-পার্বতী মূর্তি। এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনৌ বেঞ্চের আদেশে ২০০৩ সালে আর একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার আয়োজন করা হয়। এইসময় বাবরি মসজিদের নীচে থাকা হিন্দু মন্দিরটির পঞ্চাশটি স্তম্ভের নীচভাগে ইঁটের উন্নত মঞ্চের হদিশ পাওয়া যায়। তাছাড়াও দেখা যায় যে মন্দিরের শীর্ষে খোদাই করা আছে আমলকী বৃক্ষ। মন্দিরের মধ্যে এক মকর প্রণালী পরিলক্ষিত হয়। এই প্রণালীর কাজ ছিল অভিষেকের সময় ব্যবহৃত জল মন্দিরের বাইরে বার করে দেওয়া। এ এস আইয়ের উত্তর প্রদেশের ডিরেক্টর ডঃ রাকেশ তিওয়ারি জানিয়েছেন যে বাবরি মসজিদের সামনের চত্বরটি সমতল করা কালীন ২৬৯ টি মন্দির সম্পর্কিত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান পাওয়া যায়।

এই সমস্ত প্রমাণ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে এ এস আই সিদ্ধান্ত নেয় যে বাবরি মসজিদের নীচে এক পুরাতন মন্দির নিঃসন্দেহে আছে। এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনৌ বেঞ্চ সেই একই সিদ্ধান্ত বহান রাখে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা যাতে আদর্শগতভাবে পক্ষপাতী না হয়, তাই জন্য এই প্রকল্পের জন্য বাছাই করা ১৩৭ জন শ্রমিকের মধ্যে ৫২ জনই ছিলেন মুসলমান। তাছাড়াও প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় সমীক্ষক হিসাবে হাজির ছিলেন সুরজ ভান মণ্ডল, সুপ্রিয় বর্মা, জয় মেনন। এঁনারা সব বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিত্ব করা প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিক। আরও ছিলেন এলাবাদ হাইকোর্টের একজন ম্যাজিষ্ট্রেট। প্রত্নতাত্ত্বিক খননটি কি আর কোনভাবে আদর্শগতভাবে আরও বেশি নিরপেক্ষ হতে পারত?

এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায়ের পরেও, মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা তাঁদের ভ্রান্তি স্বীকার করার কথা ভাবেনও নি। তাঁরা তাঁদের কথা বারংবারই সুবিধামাফিক পরিবর্তন করতেন। তাঁদের এই মনোভাবের উৎস ছিল তাঁদের বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধি হিসাবে মনোনয়ন। তাঁরা ছিলেন কেবলই তাত্ত্বিক জ্ঞানসম্পন্ন ঐতিহাসিক। তাঁদের তিন-চারজনের মাত্র প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কিছু বিষয়গত জ্ঞান ছিল কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে তাঁদের প্রায়োগিক জ্ঞান ছিল শূন্য। ডঃ বি আর মণি ছিলেন এ এস আইয়ের তরফে পরীক্ষক। তাঁর ধারেকাছে এই সব মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা ছিলেন না। মণির পাশে তাঁদের শিক্ষানবীশ বললেই মানানসই হয়। জওহরলাল নেহরু আর আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা এই সব অধ্যাপকদের, বাবরি মসজিদ অ্যাকশিন কমিটির প্রতিনিধিদের এ এস আইয়ের প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুব একটা গুরুত্ব দিতেন না। আমি এ এস আইয়ের অংশ হিসাবে গর্ব অনুভব করি। এ এস আইয়ের সত্যনিষ্ঠা, বাস্তববোধ আর পক্ষপাতহীনতার জুড়ি মেলা ভার।

 

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)…….