“মুসলমান বা হিন্দু উগ্রবাদ নয়, দেশের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক মার্কসবাদীয় উগ্রবাদই:” কে কে মুহম্মদ – পর্ব – ২


কে. কে. মুহম্মদ আর্কিওলজিকাল সোসাইটি অফ ইণ্ডিয়াতে সাফল্যের সঙ্গে কর্মজীবন যাপন করে শেষে রিজিওনাল ডিরেক্টরের পদে থেকে অবসর নেন। তিনি বাবরি মসজিদ নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন মালয়ালম ভাষায় লিখিত তাঁর আত্মজীবনী ন্যান্ এন্না ভারতীয়ন্ (আমি ভারতীয়) গ্রন্থতে। এই গ্রন্থের হিন্দী অনুবাদ থেকে বর্তমান লেখাটি বাংলায় তর্জমা করেছেন শ্রী কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)……………

বিহারের সাসারামে এ এস আই শের শাহ সূরীর কবরের দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করে। ১৬ বৎসর পূর্বে (১৯৯৯ সাল নাগাদ), এই কবরখানা চত্বরের সীমার মাঝে জমি দখল করে এক মন্দির নির্মিত হয়। শ্রী জওহরপ্রসাদ নামে বিজেপির এক বিধানসভা সদস্য এই মন্দিরটিকে বড়ো করার প্রচেষ্টা করে।তার সাথে ছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। অযোধ্যার রাম মন্দির আন্দোলনের সূত্রেই সে বিজেপিতে এসেছিল। জওহরের শিক্ষাদীক্ষা তেমন বেশি ছিল না। তার মনে হয়েছিল যে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আছে বলে কেউই তাঁর এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবেনা। তার উপর এ এস আইয়ের বিহারের উচ্চ পদাধিকারীটি হল মুসলমান। তাই সেই ব্যাক্তিটিকে, অর্থাৎ এই শর্মাকে, চুপ থাকতেই হবে। এইরকমই কিছু সে ভেবেছিল। আমি ব্যবস্থা নিতে এগিয়ে গেলাম এবং তাঁর সমস্ত যুক্তিকে অসার প্রমাণ করে দিলাম। সে শ্রী শ্রাবণকুমার নামে এই স্থাপত্যের সংরক্ষণ আধিকারিককে মারধর করে। প্রসাদের কাছে আইনকানুনের কোন দাম ছিল না, পুলিশও তাকে সমীহ করেই চলত, তার নামে মামলা দায়ের করতে গররাজী হত। আমি দৃঢ়ভাবে এগুলাম এবং প্রসাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পুলিশকে বাধ্য করলাম।

ঐ জেলার জেলাশাসক (ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট) আমাকে ফোনে বললেন যে শ্রাবণ কুমার সাসারামে থাকা অবধি ঐ জেলায় যে কোন দিন দাঙ্গা ঘটতে পারে। তিনি বললেন, দ্রুত শ্রাবণ কুমারের বদলি করে দেওয়া হোক। আমি জবাব দিলাম যে শ্রাবণকুমার তাঁর দায়িত্ব যথেষ্ট দক্ষতার সাথে নির্বাহ করছেন।আমি আরও বললাম যে স্থানীয় বিধায়কই সমস্ত গোলমালের জন্য দায়ী। আমি বুঝলাম যে জেলাশাসক আর সমস্ত সরকারী অফিসাররা জওহর প্রসাদের সাথে হাত মিলিয়েই আছেন। আমি সরাসরি হাইকোর্টকে আবেদন করলাম। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে, হাইকোর্ট প্রসাদকে যে কোন রকম নির্মাণকার্য থেকে বিরত থাকতে আদেশ দিল। প্রসাদ এবং জেলাশাসকের উপর হাইকোর্টের এই আদেশ ছিল এক শক্তিশালী আঘাত। তার উপর, শ্রাবণ কুমার ছিলেন তফশিলী জাতিভুক্ত। তাই তফশিলী জাতির জন্য নির্ধারিত কমিশনে প্রসাদের বিরুদ্ধেতাঁর তরফ থেকে একটি অভিযোগ দায়ের করা হল।পরের বিধানসভা নির্বাচনে প্রসাদ বিপুল ভোটে হেরে গেল। যখন প্রসাদ আমার বিরুদ্ধে বিষেদ্গার ছড়াচ্ছিল, আমার পরিচিত কিছু ব্যক্তি আর এস এসের মুখপত্র “পাঞ্চজন্য” তে অযোধ্যা মামলার উপর প্রকাশিত আমার বক্তব্য বিলি করে বেড়াচ্ছিল! তাই প্রসাদের প্রত্যেকটি প্রয়াসই ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়ে গেল।

বিজেপি শাসনে কেন্দ্রীয় সরকারী এক কর্মচারী মন্দির নির্মাণ বন্ধ করেছে! এইরকম এক খবর তো দ্রুত ছড়াবেই। বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির প্রধান সৈয়দসাহবুদ্দিন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনন্ত কুমারকে এএস আইয়ের কাজের প্রশংসা করে চিঠি লিখলেন। এই চিঠিটি আমাকে এ এসআইয়ের কমিশনার শ্রীমতী কোমল আনন্দ পড়ার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। আমিও সাহবুদ্দিন সাহেবকে তাঁর সমর্থনসূচক পত্রের জন্য তাঁকে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চিঠি দিলাম। আমি আমার চিঠিতে অযোধ্যা নিয়েও কথা তুললাম। বিশেষ করে বললাম যে আমি অধ্যাপক বিবি লালের নেতৃত্বে অযোধ্যার প্রত্নতাত্ত্বিক খননে অংশ নিয়েছিলাম এবং সেখানে মসজিদের নীচে মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলাম। আমি আমার চিঠিতে তাঁকে বাস্তব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে বললাম এবং অযোধ্যা বিবাদের সমাধানের পথ প্রশস্ত করতে বললাম।

আমি তাঁর কাছ থেকে দিন কয়েক বাদে জবাবী পত্র পেলাম যেখানে তিনি লিখলেন যে মুসলমান সমাজের নেতাদের এক ভবিতব্য মিটিংয়ে অযোধ্যা নিয়ে আলোচনা হবে এবং উচিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যথাসময়ে এই মিটিং হল।সাহবুদ্দিন সাহেব লিখে পাঠালেন যে সেই মিটিংয়ে কেউ বিতর্কিত জমির স্বত্বাধিকার হিন্দুদের দেবার ব্যাপারে এতটুকু নরমপন্থা নিতে রাজী ছিলেন না। একদিন তাঁর কাছ থেকে এক ফোন এল, “পাটনায় এসেছি।আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।” আমি তাঁর বাড়িতে গেলাম। দীর্ঘ সময় ধরে কথাবার্তা হল। বাবরি মসজিদ নিয়ে পিছপা হবার আমার প্রস্তাবে তিনি রাজী হলেন না। বিদায় নেওয়ার সময় বললাম, “প্রসাদ যখন সাসারামে শের সাহ সূরীর কবরের সৌধে মন্দির নির্মাণে ব্যাপৃত ছিল, এ এস আইয়ের যে সব কর্মচারী আমার সঙ্গে খাড়া ছিলেন, তাঁরা সকলেই হিন্দু।” এরপর আমার পাটনার বাসায় ফেরার সময় এ বিষয়ে ভাবছিলাম। “যদি ভারত এক মুসলমান সংখ্যাগুরু কিন্তু সেকুলার দেশ হত (সাধারণতঃ মুসলমান সংখ্যাগুরু দেশ তো সেকুলার হয় না), তবে কয়জন মুসলমান কর্মচারী কোন হিন্দু সৌধের জায়গায় মসজিদ হতে দেখলে, আইনী পন্থা নিতেন? এ নিয়ে আরও বিশদ ভাবনার প্রয়োজন আছে। ভারতের সেকুলারিজমের মাহাত্ম্য এ থেকেই অনুমান করা সম্ভব।”

কালপ্রবাহের নিয়মে বহু কিছু হয়েছে – সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মুসলমানদের গণহত্যা, তাদের গৃহে অগ্নিসংযোগ।এসব তো অতীতে হয়েইছে আর ভবিষ্যতেও যে হবেনা তা কিন্তু নিশ্চিত করে বলাও যায় না। গুডরাতে মুসলমানদের গণহত্যা তো এক বাস্তবিকতা, কিন্তু নিষ্ঠুরতর ঘটনা ঘটেছে মধ্যযুগে মুসলমান শাসনেই। আমি একটা কথা পরিষ্কার বলতে চাই যে, হিন্দু মৌলবাদ বলে কিছুনেই, যা আছে তাহল বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া।  গুজরাটের কথাই ধরা যাক।গোধরাতে শবরমতী এক্সপ্রেসে ভ্রমণরত তীর্থযাত্রীদের জীবন্ত পোড়ানো না হলে তো আর গুজরাট দাঙ্গা শুরুই হত না, নয় কি? গোধরার পরে যে সব হৃদয়বিদারক ঘটনাবলী ঘটেছে তার প্রতিবাদে এগিয়েগেছেন হিন্দু সমাজকর্মীরাই যেমন শ্রীমতী তিস্তা শীতলাবাদ, উচ্চপদস্থ হিন্দু পুলিশ অফিসাররা যেমন শ্রী সঞ্জীব ভাট। পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল শ্রী আর বিশ্রীকুমার শাসক বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে নানাবতী কমিশনে তাঁর সাক্ষ্য দিয়েছেন। বিচারাধীন বিষয় বলে আজ অবধি তিনি তাঁর পেনশনটুকু পান নি। এই সব প্রতিবাদী পুলিশ কর্মচারীরা তাঁদের সম্পত্তির অধিকার খুইয়েছেন, সঞ্জীব ভাট তাঁর চাকরি খুইয়েছেন, শীতলাবাদের উপর আক্রমণ আসে অহরহ। ভারত মুসলমান দেশ হলে কয়জন মুসলমান অফিসার তাঁদের জীবিকা এবং প্রতিপত্তিকে বিপন্ন করে হিন্দুদের পাশে দাঁড়াতেন? মুসলমানদের এইগুলি নিয়ে ভাবা ভীষণ প্রয়োজন।

একবার ওমান মুলুকের সালালাবলে এক স্থানে গিয়েছিলাম এক আন্তর্জাতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের দলের অংশ হিসাবে। অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীনআল-বালীদ নগরীর প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কার্যে রত ছিলাম।সেখানে কিছু মালয়ালির সাথে দেখা হয়ে গেল। এরা ছিল সিমির (স্টুডেণ্টস্ ইসলামিকমুভমেণ্ট অফ ইণ্ডিয়া) সাথে জড়িত। তারা আমাকে একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে অনুরোধ করল। তাদের কারুর কারুর রাম-জন্মভূমি-বাবরি-মসজিদ বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কিছু ধারণা ছিল। আমি বললাম যে আমার আসতে কোন অসুবিধা নেই, বরং কোন প্রশ্নোত্তর পর্ব তারা রাখতে পারে।আমার তাদের কাছে একটাই দাবী যে কোনরকম বিশৃঙ্খলা যেন সৃষ্টি না হয়।আমি এখানে এক জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কাজে এসেছি।আমি তাদের কোনরকম বিড়ম্বনায় ফেলতে চাই না, তাই তারা আমাকে শৃঙ্খলা এবং অন্য পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি সহিষ্ণুতার আশ্বাস দিলে তবেই আমি যেতে পারি। ওরা আমাকে কথা দিল যে তাই হবে।

আমার বক্তৃতায় রাম-জন্মভূমি-বাবরি-মসজিদ বিষয় নিয়েই মূলতঃ বললাম। শুরুটা করলাম মুসলমানদের অন্যান্য মতাবলম্বীদের প্রতি সহিষ্ণুতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। আলকুরআন থেকে অনুরূপ উদ্ধৃতি দিলাম। শ্রোতারা আমাকে রাম-জন্মভূমি-পন্থী মনে করেছিল, তাই আমার কাছে কুরআনের আয়াৎ আশা করে নি।আমার এই সব কথায় পরিবেশ কিঞ্চিৎ আমার অনুরূপ হতে লাগল। আমি তারপর প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় অযোধ্যায় আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম। শ্রোতারা আমার প্রত্যেকটি কথা অবিমিশ্র মনোযোগ সহকারে শুনছিল। আমি আমার বক্তব্য এইভাবে শেষ করলাম, “একজন মুসলমানের কাছে মক্কা বা মদিনা যেরকম, কোন হিন্দুর কাছে অযোধ্যা তাই। মুসলমানরা কখনও কল্পনাও করতে পারে নাযে মক্কা বা মদিনা অমুসলমানদের কবলে থাকে। হিন্দুরা সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও তাদের পুণ্যতীর্থগুলি আজও অন্য ধর্মের মানুষের কবলে আছে। হিন্দুরা মনে করে যে বাবরি মসজিদ তাদের ভগবান রামের জন্মভূমি। এই স্থানটির সাথে পয়গম্বর মুহম্মদের, সাহাবাদের (পয়গম্বরের অনুচরদের), খুলাফা-এ-রাশিদীন (প্রথম চার খলিফাদের) বা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কোন সম্বন্ধ নেই।এর সাথে কেবলমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের সম্পর্ক আছে। এরকম একটি গুরুত্বহীন মসজিদের জন্য মুসলমানেরা কেন জেদাজেদী করছে?”

আমি আমার ছেলেবেলার গল্প বলতে লাগলাম। “একবার খবর এল যে জেরুজালেমের আল-মসজিদ-আল-আকসা ইহুদীরা দখল করে নিয়েছে। তখনই আমরা আমাদের গ্রাম কোড়ুভেল্লীর জুম্মা মসজিদে জমায়েত হলাম। আমরা কাঁদতে কাঁদতে প্রার্থনা করলাম যে এইস্থান যেন মুসলমানদের হাতে ফিরে আসে (জেরুজালেমের এই স্থানটি ইহুদী, খ্রীষ্টান বা মুসলমানদের কাছে সমানভাবেই পবিত্র।) আমরা যেমন সেদিন দুঃখ করেছিলাম সেরকম দুঃখই হিন্দুদের প্রতিনিয়তই হচ্ছে। শিক্ষিত প্রগতিশীল হিন্দুদের কথা আমি বলছি না, বলছি উত্তর ভারতের সাধারণ হিন্দুদের কথা যাঁরা তীব্র শীতে মাইলের পর মাইল হেঁটে যান। তাঁদের পায়ে থাকে না জুতো, গায়ে থাকে না উষ্ণ কোন বস্ত্র। তাঁরা শুধু রামের একবার দর্শনের অভিলাষী। তাঁদের ব্যথা এবং ধর্মীয় ভাবনা অনুভব করা কি অন্যায়?”

পুরো সভা আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মানুসন্ধানে মগ্ন হল। আমি আমার বক্তৃতা জারি রাখলাম, “স্বাধীনতার পর মুসলমানদের একটা পৃথক রাষ্ট্র দেওয়া হয়েছে। সে সময় ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণা করা কোন কঠিন কাজ ছিল না।কিন্তু উচ্চ-মননশীল কিছু নেতা যেমন গান্ধী, নেহরু বা প্যাটেল তা হতে দেননি।” তাই মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র দেওয়া সত্ত্বেও ভারতকে সেকুলার দেশ বলা হল।হয়ত এরকম আর একটি নজিরও বিশ্ব ইতিহাসে নেই।এর জন্য আমরা প্রভূত মূল্যও দিয়েছি। অর্ধনগ্ন ফকিরকে তাঁর জীবন সেকুলারিজমের জন্য ত্যাগ করতে হল।

আমি একটু ছোট বিরতি নিলাম। তারপর আবার বলতে থাকলাম, “ভাবুন তো, যদি ভারতে মুসলমানেরা সংখ্যাগুরু হত, তবে ভারতকি সেকুলার রাষ্ট্র থাকত?” আমি সভাস্থ মানুষের কাছ থেকে কোন উত্তর পেলাম না।

“কখনই হত না, নয় কি?  যদি ভারতে মুসলমানেরা সংখ্যাগুরু হতেন এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের একটি পৃথক রাষ্ট্র দেওয়া হত, তবে ভারত কখনই সেকুলার রাষ্ট্র হত না। এ হল হিন্দু সংস্কৃতির অন্তঃস্থ মহত্ত্ব। এটাই সহিষ্ণুতা। আমাদের এই মানসিকতাকে স্বীকার তো করতেই হবে, শ্রদ্ধাও জানাতে হবে। যদি হিন্দু না হয়ে অন্য কোন সম্প্রদায়ের মানুষ সংখ্যাগুরু হতেন, তবেই বা মুসলমানদের সংখ্যালঘু হিসাবে কতটা ভালো জীবন থাকত? সমস্ত জীবিকার মানুষকে ঐতিহাসিক বাস্তবিকতা মেনে নিয়ে সমঝোতার পথে চলা উচিত। যদিতা বাস্তবায়িত হয়, তবেই ভারত এক প্রকৃত সেকুলার রাষ্ট্র হবে।

“এই রকম যুক্তি দিয়ে ভাবাকে বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গীর দর্শন বলা যেতে পারে। হিন্দুরা মুসলমানদের দৃষ্টি ভঙ্গী দেখুক আর মুসলমানরাও হিন্দুদের। উভয়পক্ষকেই সমাধানের লক্ষ্যে একসাথে কাজ করতে হবে। জন্ম হউক যথা তথা, কর্ম হউক ভালো।”

এই সময় সভা থেকে একটি প্রশ্ন এল। “যদি আমরা এই তিনটি জায়গা ছেড়েও দিই, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কি তিন হাজার মসজিদের উপর দাবী ছেড়ে দেবে? ওদের তো সব কিছুই চাই!”

আমি জবাব দিলাম, “আমি সমঝোতার রাস্তায় হাঁটার কথা বলছি।অহেতুক দাবীগুলি নিয়ে জেদ করা কোন পক্ষেরই সমীচীন নয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল এবং শিব সেনার মত হিন্দু সংগঠনগুলিকে হিন্দু সমাজ সার্বজনিকভাবে সমর্থন করে না। তাদের অহেতুক দাবীগুলির বিরোধিতা হিন্দুরাই করবে। মুসলমানদের এনিয়ে ভাবতেও হবে না।এটাই তো হিন্দু সংস্কৃতির বিশেষত্ব।” আমার বক্তৃতার শেষে মনে হচ্ছিল যে শ্রোতারা বাবরি মসজিদের অধিকার ছেড়ে দিয়ে সমঝোতা করার প্রস্তাবটিতে রাজী।কিন্তু তারা খোলাখুলি তা বলতে পারছিল না। বেশীরভাগ শ্রোতাই ছিল তরুণ যাদের মনোভাব আমি আঁচ করতে পারছিলাম।

মিটিংয়ের শেষে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন আমার কাছে এলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি এ সব কথা সৈয়দ সাহবুদ্দিনের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জানালেন না কেন?”

“সে সময় তো আমি তাঁকে জানতাম না। শেরশাহ সূরীর কবরখানা নিয়ে যখন গোলমাল হয়, তখন আমার সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তখন আমি তাঁকে এই বিষয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম।”

জামাত-ই-ইসলামীর সাথে জড়িত ওয়েলফেয়ার পার্টির কয়েকজন তরুণ কার্যকর্তা গরীবদেরকে গৃহপ্রদানের এক কর্মসূচী রাখেন।আমি দেখলাম গৃহপ্রাপকদের তালিকায়এক হিন্দু মহিলা সুষমার নাম আছে। তাই দেখে আমি তাঁদের অভিনন্দন জানালাম এবং তাঁদের কর্মসূচীর জন্য কিছু টাকাও দিলাম। ওয়েলফেয়ার পার্টির কয়েকজন সদস্য আমাকে তাঁদের পার্টির মিটিংয়ে বক্তব্য রাখতে বললেন। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল “ইসলামে ধর্মমতসহিষ্ণুতা” এবং “অযোধ্যার বাস্তবিকতা”। আমি আমার বক্তৃতা কুরআন থেকে আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করলাম এবং মোটামুটি ওমানের সালালাতে যা বলেছিলাম তাই আবার বললাম। এবার কোন প্রশ্নোত্তর পর্বছিল না। কিন্তু মানুষ ভাবতে লাগল। এই মিটিঁংয়ে আমার বহু আত্মীয় বন্ধু উপস্থিত ছিল। তাই আমি জানতাম যে যদি শ্রোতারা আমার মতের সাথে সমভাব পোষণ নাও করেন, তাহলেও কোন সমস্যা হবে না।

আজ আমাদের প্রয়োজন উদার চিন্তাধারার। আমরা হিন্দু হই, মুসলমান হই বা খ্রীষ্টান,আমরা আমাদের ধর্মমত আপন পিতামাতার থেকেই পেয়েছি। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মমতের জন্য আমাদের কোন কৃতিত্ব নেই। এজন্য গর্ববোধ করা বা কাউকে ছোট করা কোনটাই সাজে না।জিও অউর জিনে দো,  এর বাইরে কোন সিদ্ধান্ত হতেই পারে না।

ভারতে ধর্মমতের ভাবনাগুলি শক্তিশালী। ইউরোপের দেশগুলিতে ধর্মমতের ভাবনাগুলি পশ্চাৎপদ বলে জ্ঞাত।  সেখানে ধর্মমত নিজেদের বংশের পরিচায়ক মাত্র ,তার অতিরিক্ত কিছু নয়। সেখানকার সংস্কৃতিতে ধর্মমতের প্রভাব ক্ষীণ। ভারতেও যেখানে যেখানে হিন্দু অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছে, যেমন দাদরিতে, তার প্রতিবাদে হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা সর্বাগ্রে খাড়া থেকেছেন। তাঁরা তাঁদের পুরষ্কার ইত্যাদি প্রত্যাবর্তন করে সমাজে অসহিষ্ণুতার প্রসারকে প্রতিহত করেছেন। পদস্থ ব্যক্তিরা যেমন ইনফোসিসের শ্রী নারায়ণ মূর্তিএবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার গভর্নর শ্রী রঘুরাম রাজন, এই অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে তাঁদের মত ব্যক্ত করেছেন।

ভারত হচ্ছে সমস্ত সংস্কৃতির মিশ্রণের দেশ। আমাদের জীবনশৈলীর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল ধর্মমত।প্রত্যেক ধর্মমতের গৃহ নির্মাণের নিজস্ব স্থাপত্যরীতি আছে। হিন্দু সংস্কৃতি আমাদের মিশ্র সংস্কৃতির ভিত্তিস্বরূপ।বৌদ্ধ এবং জৈন সংস্কৃতি হিন্দু সংস্কৃতির শাখারূপে উদ্গত হয়েছে। ভারতের বাইরে বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভূত প্রভাব। এই হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন সাংস্কৃতিক ধারা সম্বৃদ্ধ হয়েছে মুসলমান ভাস্কর্যের দ্বারা। খ্রীষ্টীয় ভাস্কর্য একে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। এই মিশ্র সংস্কৃতির দুই প্রকৃষ্ট উদাহরণ তাজ মহলএবং কুতুব মিনার। ইরান, ইরাক, তুরস্ক আদি যে দেশগুলি মিনার, খিলান এবং গম্বুজের দেশ নামে প্রখ্যাত, সেখানে কুতুব মিনারের মত সুউচ্চ মিনার নেই। কেন? কারণ তাদের নেই আমাদের মিশ্র সংস্কৃতি। এইরকম বিস্ময়কর স্থাপত্য শৈলী ভারতে এসেছে কারণ বৃহৎ স্থাপত্যের ইসলামীয় কল্পনার সাথে ভারতের প্রশিক্ষিত কলাকৌশলের সংমিশ্রণ হয়েছে।

আমরা সামাজিক সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে বাঁচি।আমাদের দায়িত্ব আছে ভারতকে এমন এক স্থান বানানোর যেখানে প্রত্যেকের মুহম্মদের মধ্যে এক ব্রহ্মদত্ত এবং প্রত্যেক ব্রহ্মদত্তের মধ্যে এক মুহম্মদ বিরাজ করবে। অতীব আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে মৌলানা ডঃ কালবে সাদিক যিনি পণ্ডিত এবং শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা, তিনি শান্তির দিকে এক পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি অযোধ্যা নিয়ে যে বক্তব্য রেখেছেন তা মুসলমান সম্প্রদায়ের পূর্ববর্তী দাবীগুলির থেকে আলাদা। তাঁর এই কাজ শুধু প্রশংসার্হও নয় বরং এটাই আল্লাহর পয়গম্বরের প্রদর্শিত সত্য পন্থা। হুদায়বিয়াহের সমঝোতাতে পয়গম্বর মুহম্মদ এই একই পথ অনুসরণ করেছিলেন মক্কার পৌত্তলিকদের সাথে তাঁর আচরণে। ডঃ কালবেসাদিকের মত উদার হৃদয় নেতা এবং পণ্ডিতদের জন্যই মুসলমান সম্প্রদায় এবং দেশ প্রগতির পথে অগ্রসর হবে।

(সমাপ্ত)………………….