আরব নাৎজি যুগলবন্দি

0
615

And I will give unto thee, and to thy seed after thee, the land wherein thou art a stranger, all the land of Canaan, for an everlasting possession; and I will be their God. (জেনেসিস, ১৭:৮)

ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের একটি ছোট্ট ভূখন্ড, যেখানকার বর্তমানের বাসিন্দাদের বিশ্বাস অনুযায়ী সেটা তাঁদের প্রমিস্ড ল্যান্ড বা ঈশ্বর প্রতিশ্রুত ভূমি। অনেকের মতে এই ধারণা রাজনৈতিক ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় এর কোনো ভিত্তি নাকি নেই। ইহুদিরা সেই ভূখন্ড দখল করার পূর্বে বহু জাতের মানুষ সেখানে বসবাস করত। প্রতিশ্রুত ভূমি – ধারণা প্রচার পায় ১৯৬৭ সালের পর। ইসরায়েলে বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের বেশির ভাগই বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে। ঈশ্বর প্রতিশ্রুত ইহুদি সন্তানদের বেশির ভাগই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ধর্মযুদ্ধে মারা গেছে। অনেকে নির্বাসনে চলে যায়। বেঁচে যাওয়া ইহুদিরা আরবদের সঙ্গে মিশে গেছে এবং তারা কখনোই পৃথক রাষ্ট্র চায়নি। তাই কুরআনে তাদের অভিশপ্ত জাতি বলা হয়েছে! পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান জনগণ তাই মনে করে। 

হিটলার কি ব্যতিক্রম ছিল?  থার্ড রাইখ বা হিটলারের সময়ে আরব সাম্রাজ্যের সাথে নাৎজিদের কেমন সম্পর্ক ছিল তা একটু তলিয়ে দেখার সময় এসেছে। এ নিয়ে ইংরাজি মাধ্যমে প্রচুর লেখা বেড়িয়েছে, তার মধ্যে সবথেকে উল্ল্যেখযোগ্য হল ক্লস মাইকেল মলমান ও মার্টিন কাপ্পার্সের লেখা – Nazi Palestine: The Plans for the Extermination of the Jews in Palestine.

 ১৯৪১-৪২ এর কথা, পালেস্তাইনে বসবাসকারি ইহুদীদের মুছে ফেলার প্ল্যান প্রায় শেষ, কার্যকর করতে আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি, নাৎজি বাহিনি উত্তর আফ্রিকা প্রায় দখল করে এনেছে, ঠিক এমনই সময়, আরব সাম্রাজ্যবাদিরা হজ আমিন আল হুসেইনি বা জেরুজালেমের গ্রান্ড মুফতির সাহায্য প্রার্থনা করে। সেই মুফতি তারপর দফায় দফায় হিটলারের সাথে আলোচনায় বসে।

দুই পক্ষই পালেস্তাইনে বসবাসকারি ইহুদীদের সমূলে উৎপাটন করতে যেহেতু বদ্ধ পরিকর ছিল তাই দু’পক্ষই সমোৎসাহে একখানি প্ল্যান ছকে ফেলে। সেই মত নিজেদের সেনাবাহিনিদের গ্রীসে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। ২,৫০০এর ওপর ইহুদীদের মেরে ফেলার চক্রান্ত শেষমেষ কমনওয়েলথ বাহিনীর সিরিয়াতে ও লেবাননে সফল হামলার চোটে নাৎজি বাহিনি আর করে উঠতে পারেনি। অথচ ইহুদীদের প্রতি তীব্র জাতিবিদ্বেষ এবং ধামা ধরা আরব জাতির কান্নানের ওই ছোট্ট ভূখন্ডের প্রতি বিজিগীষা, আমাদের চিরকাল অন্য কথাই শুনিয়ে আসছে – ইহুদীরাই আক্রমণকারী ছিল, তারাই যত নষ্টের মূল।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে হিটলারের সামরিক কার্যকলাপে আরব ও জেরুজালেমের গ্রান্ড মুফতির প্রবল প্রভাব ছিল। হিটলারকে গাছে তুলতে আরবরা তাকে দ্বাদশতম ও অন্তিম ইমাম বলেও ভূষিত করেছিল, এমনকি হিটলারকে তারা পয়গম্বরের সাথে তুলনা করতেও ছাড়েনি! নাৎজি প্রীতি তখন আরবজগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

পূর্বে ইহুদীদের বিরুদ্ধে পয়গম্বরের সংগ্রাম ও তৎকালীন সময়ে হিটলারের সংগ্রাম, মাপদন্ডে সমান বিবেচিত হত। আলেপ্পোতে এক গণসঙ্গীতে একখানি ছত্র বারবার গাওয়া হয়েছিল –

No more monsieur, No more Mister

In heaven Allah, In earth Hitler !

এমনকি ১৯৪১এ সাউদি আরবের তৎকালীন শাসক ইবন সাউদ জানিয়েছিল –

I have the greatest respect and admiration for Germany’s Führer!

 মিশরের শাসক রাজা ফারুকও একই ভাষায় হিটলারের গুণগান করেছিল। নানান স্থানে হিটলারের প্রতিচ্ছবি লাগানো হত এবং এক ফরাসী সাংবাদিকের কথায়

Führer was credited with supernatural powers… and a prophet who opposes the Jews!

 কিন্তু হিটলারের মাইন কাম্ফ গ্রন্থে জিহাদের বিরুদ্ধে লিখিত একখানি ছত্র আরব সাম্রাজ্য বিনাদ্বিধায় উপেক্ষা করেছিল। হিটলারের মতে জিহাদ ছিল – a coalition of cripples!

তাঁর মতে –

I am prevented by the recognition of the racial inferiority of these co called ‘oppressed nations’ from linking the fate of my own people to them!

এই ধরনের বিদ্বেষমূলক অংশ বাদ দিয়ে ততদিনে মাইন কাম্ফ আংশিক অনুবাদ হত মিশরে, মরক্কো, ইরাক, লেবানন ছাড়াও অনেক জায়গায়। জার্মানরা যদিও মাইন কাম্ফের কখনো আরবী অনুবাদ করেনি, কিন্তু আরবদের জন্য ১৯৩৬ সালে হিটলার নিজের মাইন কাম্ফের ওই বিশেষ জায়গাগুলো কেটে ছেঁটে অনুবাদে রাজি হয়েছিল। যদিও ১৯৬০ সালের আগে সম্পুর্ণ মাইন কাম্ফের আরব অনুবাদ সম্ভব হয়নি! এন্টি-সেমিটিজম বা সেমিটীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যা ইহুদিদের প্রতি বৈরিতা ও সংঘবদ্ধ জাতি-নিধনকেই বোঝানো হত, সেই এন্টি-সেমিটিজম শব্দ ব্যবহারের ওপর আরবদের বিশেষ আপত্তি (কারণ আরবরাও সেমেটিয় সম্প্রদায়ভুক্ত) থাকা সত্ত্বেও হিটলারের প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি! আরো আছে। মুসলিম ব্রাদারহুড যখন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৮ সালে, হিটলারের উত্থানের পূর্বে তার সদস্য সংখ্যা মাত্র ৮০০ ছিল, ১৯৩৬এ সদস্য সংখ্যা হয় দুই লক্ষ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ লক্ষ!

এর পেছনে কুরআনের ইহুদীবিরোধী লেখনী ও জিহাদ এবং হিটলারের ইহুদীবিরোধী কার্যকলাপ – দুইয়ের সমন্বয়সাধন ইন্ধন যুগিয়েছিল। নানান ইহুদীবিরোধী সংগঠন তখন মাথা চাড়া দিয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ইসলামিক ন্যাশনালিস্ট পার্টি, তারা প্রচার করত যে ইহুদীরা ধর্মীয় ও নৈতিক ভাবে অধঃপতিত, প্রতিটি বিকৃতি ও ন্যায়ভ্রষ্টতার পেছনে ইহুদীরা থাকবেই! এইরকম অনেক সংগঠন হিটলারের নাৎজি বাহিনির অনুকরণ করত। ইহুদীদের গণনিধন বা হলোকষ্টে লক্ষ লক্ষ ইহুদি মেরে ফেলাতে আরবজগতে হিটলার সবিশেষ প্রীতিভাজন হতে পেরেছিল। ইহুদীনিধন ও বহিষ্কারের পেছনে তারা বলতো, হিটলার যা করেছে ঠিক করেছে, নাহলে আমাদের পিতৃভূমি ইহুদিরা কেড়ে নিত!

 নাৎজি প্রজ্ঞাপন করতে আরবদের ভূমিকা অতুলনীয়! ‘ইহুদীরা শাইলক, টাকার কুমীর… তাদের মেরে ফেলা প্রয়োজন, মানুষকে ভীতিপ্রদর্শন করে ইহুদিরা প্রভাব খাটাতো, হিটলার এসে সব বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের জাতিলোপ করে দেখিয়ে দিল তারা আসলে কাপুরুষ এবং ভন্ড! কোন আরব কখনো জার্মানীর এই অনুগ্রহ ভুলবেনা।’ 

হিটলারের সবিশেষ প্রভাব স্কুলের ছাত্রদের ওপরেও ছিল। তারাও নাৎজি বাহিনিকে অভিনন্দন জানাত। ফিলিস্তিনের সাধারণ চাষীরাও হিটলারের নাম জপ করতো ইহুদি নিধন করতে। সাধারণ আরবদের মধ্যে হিটলার ও তার ফ্যাসিজমের চুড়ান্ত জনপ্রিয়তা দেখা যেত যত্রতত্র।

১৯৩৬ এ পয়গম্বর মুহম্মদের জন্মদিনে হিটলার ও মুসোলীনির বিশাল পোষ্টার টাঙানো হল সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে!

 হেইল হিটলার তাদের পছন্দের বাণী ছিল তখন! এবং হিটলারও তাদের প্রতি নিজের সমবেদনা জানাতে ভুলতো না! জেরুজালেমের গ্রান্ড মুফতি একবার হিটলারের কাছে আবেদন করেছিল ইহুদিদের ইসলামীয় রীতিতে গণহত্যা করার, তাতে হিটলার নাকি বলেছিল – Jews are yours! আরবদের এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ভারতীয় মুসলমানরাও কিন্তু পিছিয়ে ছিল না, Chuck Morse-এর লেখা The Nazi Connection to Islamic Terrorism: Adolf Hitler and Haj Amin Al-Husseini তে পাওয়া যায় যে শওকত আলি, যে খিলাফত আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল ভারত থেকে এবং যে মহাত্মা গান্ধী ও জিন্নার অনুচর ছিল, সেও ১৯৩১ সালে জেরুজালেমের গ্রান্ড মুফতির ডাকা এক অধিবেশনে ইহুদীদের গণনিধনের পক্ষে সায় দিয়েছিল।

মনে করবেন না কখনো যে ইহুদিদের প্রতি নাৎজি বা আরবদের বিদ্বেষ, হিটলারের পতনের পর কোন অংশে কমেছে। ফতহ, পিএল ও, হামাস, নানান সংগঠন এখনো হিটলারের অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাতে যারা ইন্ধন যোগায় তারা প্রকারান্তরে আরবদের ক্রীতদাস ছাড়া আর কিছুই নয়।  বিশ্ব রাজনীতিতে এই বিদ্বেষ নানান স্তরে কাজ করে। আমাদের ভারতবর্ষেও হয়, সনাতন ধর্মীদের ওপর, বামপন্থী, মৌলবাদী মুসলমান, এনজিও, মিডিয়া, সব হিন্দু বিরোধী প্রজ্ঞাপন চালায় কেউ প্রকট ভাবে, কেউ স্তরে স্তরে। চিনে নিতে হবে তাদের, তারপর সঙ্ঘবদ্ধ লড়াই।