কোমায় আচ্ছন্ন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা এবং নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি

0
2215

সুভাষ বিশ্বাস

অভিযোজন। সেই কবে থেকে স্কুলস্তরের জীবন বিজ্ঞানে পড়ানো হচ্ছে যে, কোনো প্রজাতির প্রাণীকুল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলে, অর্থাৎ পরিবেশের সঙ্গে নিজের অভিযোজন ঘটাতে না পারলে সেই প্রজাতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। খুবই বাস্তব কথা। কিন্তু যে শিক্ষাব্যবস্থার সূত্রে আমরা অভিযোজনের পাঠ পেলাম, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দীর্ঘ ৭০ বছর অতিক্রম করে ভারতের সেই শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমান সময়ের সঙ্গে নিজের অভিযোজন কতটা ঘটাতে পেরেছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুসকিল।

স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা যুগোপযোগী হতে পেরেছে তা নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলে বিতর্ক চলতে পারে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ খাপে খাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় নিজেদের মাথা গুঁজে রেখেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার পট-পরিবর্তন ঘটলে তাঁরাও ছাতা পালটে অন্য ছাতার তলায় মাথা গোঁজেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার যে স্থবিরতা কাটে না, তা নিয়ে নিরপেক্ষ বিচার-বিশ্লেষণ করতে তাঁদের দ্বিধা থেকেই যায়। বিগত ৭০ বছরে কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতাসীন ছিল কংগ্রেস সরকার। এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে কংগ্রেস সরকার ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে বদলে তার আধুনিকীকরণ ঘটাতে পারত, শিক্ষাকাঠামো যুগোপযোগী হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু অজানা কোনো কারণে তাদের তা করা হয়ে উঠল না। অথচ এই সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষাকাঠামো ক্রমাগত আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়ে চলেছে।

বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ভারতের প্রতিবেশী চীনের শিক্ষাব্যবস্থার কথাই ধরা যাক। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। আর আমাদের প্রতিবেশী আধুনিক চীনের পথ চলা শুরু হয় ১৯৪৯ সালে। কিন্তু চীন বিগত সাত দশকে শিক্ষাকাঠামোকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে নিয়েছে। এর সুফল তারা পাচ্ছে কারিগরি, বিজ্ঞান প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে। বৃত্তিমুখী শিক্ষাকে তারা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। তাই চীনে শিক্ষাব্যবস্থা ‘বেকার তৈরীর কল’ নয়। আর বিগত ৭০ বছরে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা শম্বুকগতিতে এগিয়ে চলেছে। এর ফলস্বরূপ এদেশে উচ্চ ডিগ্রিধারী লাখো লাখো বেকার তৈরি হয়েছে। দেশে উচ্চশিক্ষিতদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ চাকরি ক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়ে শিক্ষাকে কাজে লাগাচ্ছে। বাকিরা উচ্চশিক্ষার ভার নিয়ে অশিক্ষার পেশা-সাগরে ঝাঁপ দিয়েছে। উচ্চ ডিগ্রিধারীকে তার ডিগ্রির সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে চোখের জল মুছতে হচ্ছে। “তাহার একমাত্র আশাভরসা কন্যার পিতার কাছে।” তাই এদেশে এত মেধা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা এবং শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য পরিকাঠামোর অভাবে ভারতের মেধা ক্রমাগত বিদেশে চলে যাচ্ছে। এই মেধা ভারতে থাকলে আমাদের দেশের অনেক উন্নতি হতে পারত।

পরাধীন ভারতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
“বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীটাই যে আমাদের ব্যর্থতার কারণ, অভ্যাসগত অন্ধ মমতার মোহে সেটা আমরা কিছুতেই মনে ভাবিতে পারি না। ঘুরিয়া ফিরিয়া নূতন বিশ্ববিদ্যালয় গড়িবার বেলাতেও প্রণালী বদল করিবার কথা মনেই আসে না; তাই, নূতনের ঢালাই করিতেছি সেই পুরাতনের ছাঁচে। নূতনের জন্য ইচ্ছা খুবই হইতেছে অথচ ভরসা কিছুই হইতেছে না। কেননা ঐটেই যে রোগ, এতদিনের শিক্ষা-বোঝার চাপে সেই ভরসাটাই যে সমূলে মরিয়াছে। অনেককাল এমনি করিয়া কাটিল, আর সময় নষ্ট করা চলিবে না। এখন মনুষ্যত্বের দিকে তাকাইয়া লক্ষ্যেরও পরিবর্তন করিতে হইবে। সাহস করিয়া বলিতে হইবে, যে শিক্ষা বাহিরের উপকরণ তাহা বোঝাই করিয়া আমরা বাঁচিব না, যে শিক্ষা অন্তরের অমৃত তাহার সাহায্যেই আমরা মৃত্যুর হাত এড়াইব।”

তিনি আরও বলেছেন— “যদি আমাদের দেশের শিক্ষায় ছাত্রদিগকে চাকরি ছাড়া অন্যান্য জীবিকার সংস্থানে পটু করিয়া তুলিত তাহা হইলে এই সম্বন্ধে নালিশের কথা থাকিত না। কিন্তু পটু না করিয়া সর্বপ্রকারে অপটুই করিতেছে, এ কথা আমরা নিজের প্রতি তাকাইলে বুঝিতে পারি। . . . শিক্ষার এই শক্তিহীনতা আমরা স্পষ্টই বুঝিতেছি। আমাদের শিক্ষাকে আমাদের বাহন করিলাম না, শিক্ষাকে আমরা বহন করিয়াই চলিলাম, ইহারই পরম দুঃখ গোচরে অগোচরে আমাদের মনের মধ্যে জমিয়া উঠিতেছে।”

কত দূরদর্শী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ! অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী আমাদের দেশনেতাগণ কবিগুরুর মতকে মোটেই পাত্তা দিলেন না। আর বামপন্থীদের কাছ থেকে তো রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব পাওয়ার আশা করা বাতুলতা মাত্র। কারণ, তারা রবি ঠাকুরকে ‘বুর্জোয়া কবি’র বাইরে আর কিছু ভাবতেই পারেননি। অবশ্য ঠেলায় পড়ে তারাও আজকাল রবি ঠাকুরকে আঁকড়ে ধরে কুলে উঠতে চান বইকি! যেমন সম্প্রতি অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপুজোর পরিপ্রেক্ষিতে তারা রবি ঠাকুরকে বারবার উদ্ধৃত করতে ব্যস্ত— ‘সে মন্দিরে দেব নাই।’ বামপন্থীদের এভাবে রবীন্দ্রানুরাগী করে তোলার কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করতেই পারেন।

স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন ভারতে শিক্ষানীতি এবং শিক্ষার পরিকাঠামো— উভয় ক্ষেত্রেই আধুনিকতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সময় ও চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা। উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি প্রদানের প্রসার ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু সেই ডিগ্রিকে যথার্থ কাজে লাগানোর সুযোগ হয়েছে খুবই কম। এদিকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশের বেকার যুবক-যুবতীরা পড়েছেন ফাঁপড়ে। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় যুবক-যুবতী তাদের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করতে পারলেও দেশের অধিকাংশই তা পারেননি। ব্যর্থ এই বেকারগণ তাদের উচ্চ ডিগ্রির ভারে আবার পেশাগত পিরামিডের নিচের দিকে থাকা সাধারণ মানুষের মতো চাষের, মজুরের, ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের কাজে যুক্ত হতেও লজ্জা বোধ করতেন। ফলে উচ্চ ডিগ্রিধারী এই ‘উদ্বৃত্ত’ যুবক-যুবতীরা দেশের প্রকৃত ‘মানব-সম্পদ’ হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার সঠিক দিশা দেখাতে পারলে তাঁরা প্রকৃতই ‘মানব-সম্পদ’ হয়ে উঠতে পারতেন। এই সম্পদ দেশ গঠনে কাজে লাগত, দেশ আরও শক্তিশালী হত।

এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অনুমোদন পেল। এর আগে শেষবার জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়েছিল ১৯৮৬ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে। এরপর প্রায় ৩৪ বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু সেই শিক্ষানীতি দেশের সার্বিক অগ্রগতির সহায়ক হয়ে উঠতে পারেনি। তা কেবল একটি ক্ষুদ্র অংশের মানুষের বাহন হয়েছে। ইতিমধ্যে বিগত ৩৪ বছরে সারা বিশ্বের শিক্ষা, সমাজ, অর্থনীতি— প্রভৃতি সবক্ষেত্রেই ব্যাপক পরিবর্তনের ঢেউ এসে লেগেছে। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্র নিজেদের শিক্ষানীতির আধুনিকীকরণ ঘটিয়েছে। কিন্তু এতদিন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা একইভাবে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ যেন সেল্ফিস্ জায়ান্টের গল্পের সেই বাগান, চারিদিকে তীব্র শীত পেড়িয়ে বসন্ত এলেও যে বাগানে বসন্ত আসে না।

ভারতীয় শিক্ষা-কাঠামোর এই ত্রুটির জন্য এতদিন গণশিক্ষার অবস্থাও ছিল তথৈবচ। কোনো একটি দেশের সার্বিক সাক্ষরতার হারের উপর সেই দেশের সার্বিক বিকাশ নির্ভর করে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের ৭০ বছর পেরিয়েও ভারতে গণশিক্ষার প্রসার মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ইতিপূর্বে দেশ জুড়ে ‘সর্বশিক্ষা অভিযান’ নামে সুবিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু তা যে বাস্তবে পর্বতের মুষিক প্রসব তা বর্তমান সময়ের গণশিক্ষার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ভারতে অন্তত ৩০ কোটি মানুষ এখনও নিরক্ষর যা ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার অন্তত চারগুণ। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী, ভারতের সাক্ষরতার হার ৭৪.০৪ শতাংশ। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এখনও পর্যন্ত অর্থনৈতিক, সামরিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতের তুলনায় অনুন্নত। কিন্তু উন্নত বিশ্ব এবং এই অনুন্নত দেশগুলির সমন্বয়ে বিশ্বের গড় সাক্ষরতার হার যেখানে ৮৪ শতাংশ, সেখানে ভারতের এই হার নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক। এদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাক্ষরতার হার অনেকটা কম বলে সার্বিক সাক্ষরতার হারেও তার প্রভাব পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হল এই যে, ৭ বছর পর্যন্ত বয়সীদের মধ্যেও সাক্ষরতার হার মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ২০০৮ সালে এন.এস.এস.ও. পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৬৬ শতাংশ এবং ৭ বছর পর্যন্ত বয়স্কদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৭২ শতাংশ। ভারতের গণশিক্ষার লজ্জাজনক পরিস্থিতির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক সাক্ষরতা এবং শিক্ষার গুণগত মান যে আরও লজ্জাজনক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১১ সালের তথ্য অনুসারে, সাক্ষরতার হারে রাজ্যগুলির নামের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান ২০ নম্বরে। এ রাজ্যে বাম আমল থেকে শিক্ষার গুণগত মানের দ্রুত পতনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এই ধারা বাম-পরবর্তী বর্তমান সরকারের আমলে আরও গতিশীল হয়ে তা ক্রমে কোমায় আচ্ছন্ন হতে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলার শিক্ষার পরিমাণ এবং গুণগত মানের উন্নয়নে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ধন্বন্তরী ঔষধ হিসেবে কাজ করে কিনা তা দেখার বিষয়।

স্বাধীনতার এত বছর পরও যে আমাদের দেশে সার্বিক সাক্ষরতার প্রসার ঘটল না, তা নিঃসন্দেহে আমাদের এক বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার কারণ যে অনেক গভীরে প্রোথিত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যে দেশে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাদান করেও একটি বিশাল জনসমষ্টিকে সাক্ষর করা যায়নি, সেখানে অরুণাচল প্রদেশের মতো কোনো কোনো রাজ্যে কেন স্থানীয় ভাষার পরিবর্তে সদ্য-সাক্ষরদের জন্য ইংরেজি ভাষায় পাঠ্য পুস্তক দেওয়া হয়, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ স্বভাবতই প্রশ্ন তুলতে পারেন। কেন্দ্রে একের পর এক সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু এসব সমস্যার সুরাহা হয় না। প্রতিবারই ঘটা করে নানা প্রচারের মাধ্যমে দেশবাসীকে খুশি করার চেষ্টা চলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখে যায় যে, সরকারের সেই উদ্যোগ বিজ্ঞাপনে, বক্তৃতায় বাগাড়ম্বর হয়েই থেকে যায়। সেসব উদ্যোগের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে সীমাহীন দুর্নীতির বাসা শিক্ষার প্রসারে সমস্যা সৃষ্টি করছে, তা সরকার আন্তরিক উদ্যোগ নিয়ে দূর করার চেষ্টা করেনি। সরকার বহু গুরুত্বহীন ক্ষেত্রে বিপুল অর্থব্যয় করলেও শিক্ষাক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অর্থ-বরাদ্দ করেনি। এরূপ নানাবিধ কারণে ভারতের গণশিক্ষার বিকাশ অত্যন্ত হতাশাজনক।

কয়েক বছর আগে জাতিপুঞ্জের সংস্থা ইউনেস্কোর ডিরেক্টর শিগেরু আওয়াগি দিল্লিতে বলেন, ভারতে সাক্ষরতা অভিযানের চ্যালেঞ্জটা খুবই জটিল। এতে সন্দেহ নেই যে, ভারতকে অনেকগুলি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু এরপরও তিনি বিশ্বাস করেন যে, ‘অদূর ভবিষ্যতে ভারতে একদিন পূর্ণসাক্ষর একটি সমাজ তৈরি হবে, যেখানে সবাই সমান মর্যাদা পাবেন।’ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার প্রবর্তিত নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি শিগেরু আওয়াগি-র বিশ্বাসের বাস্তবায়নে এক কার্যকর পদক্ষেপ হবে বলে আমার বিশ্বাস। ১৯৯০ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছিল যে, ভারতের সার্বিক সাক্ষরতা অর্জনে ২০৬০ সাল লেগে যাবে। এই গবেষণাপত্রের বক্তব্য যে, একেবারে অমূলক নয় তা বিগত ৩০ বছরের শিক্ষার প্রসারের হারই প্রমাণ করে। ২০৬০ সাল আসতে এখনও ৪০ বছর বাকি। কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি এই ৪০ বছরের মধ্যে যত কম সময়ে সার্বিক সাক্ষরতার প্রসার ঘটাতে পারে, ততই আমাদের মঙ্গল।

যাই হোক, শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা ভারত দীর্ঘদিন বহন করে চলেছে। তাই এত বিপুল মানব সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দেশের প্রকৃত অগ্রগতি ব্যহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের এন.ডি.এ.-র নির্বাচনী ইস্তেহারে শিক্ষাসংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হল। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক অবশ্যই চোখে পড়ার মতো—

১। আগেকার ১০+২ কাঠামোর পরিবর্তে নতুন ব্যবস্থায় স্কুলশিক্ষায় ৫+৩+৩+৪ কাঠামো গঠন করে প্রচলিত শিক্ষা-কাঠামোর খোলনলচে বদলানোর গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পূর্বেকার ১২ বছরের পরিবর্তে বর্তমানে ১৫ বছরের স্কুলশিক্ষার কথা বলা হয়েছে। এই কাঠামোয় প্রথম শ্রেণীতে পৌঁছানোর আগে শিশু শিক্ষার্থী প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ৩ বছর শিক্ষালাভ করবে। এই তিন বছরের শিক্ষা ইতিপূর্বে সরকারিভাবে স্বীকৃত ছিল না বলে সরকারি খরচে এই শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল না। নতুন ব্যবস্থার ফলে গ্রামাঞ্চলের এবং পিছিয়ে-পড়া পরিবারগুলির সন্তানরা সরকারিভাবে প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষালাভ করতে পারবে।

২। প্রাক-প্রাথমিকের ৩ বছরের সঙ্গে পরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ২ বছর যুক্ত হয়ে মোট ৫ বছর হ’ল শিক্ষার্থীর ভিত্তিমূলক স্তর। এই শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত মানের উপর বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। এর পরের তৃতীয় শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ৩ বছরকে প্রস্তুতিমূলক স্তরে এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ৩ বছরকে রাখা হয়েছে মধ্যবর্তী স্তরে।

৩। এরপর মাধ্যমিক স্তরে রাখা হয়েছে নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত ৪ বছরকে। এই স্তরে প্রতিটি বছরকে দুটি করে সেমিস্টার ভাগ করে ৪ বছরের পড়াশোনাকে মোট ৮টি সেমিস্টারে বিভক্ত করা হয়েছে। পড়ুয়ারা প্রতিটি সেমিস্টারে ৫/৬টি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে। ইতিপূর্বে শিক্ষার অধিকার অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতিতে তা দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়েছে।

৪। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত নিজের মাতৃভাষা বা স্থানীয় ভাষায় শিক্ষাদানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এরপরও অষ্টম শ্রেণী, এমনকি এরপরও যাতে মাতৃভাষাই শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হয় সেবিষয়ে নতুন ব্যবস্থায় যত্ন নেওয়া হয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এই ব্যবস্থা কার্যকর হবে। এই ভাষায় উচ্চমানের পাঠ্যবইও প্রকাশিত হবে। এর ফলে একদিকে যেমন গণশিক্ষার প্রসারের পথ আরও প্রশস্ত হল, অন্যদিকে তেমনি শিক্ষার্থী সুশিক্ষা লাভের সুযোগ পেল। পাশাপাশি ত্রিভাষা শিক্ষানীতির কথা বলা হয়েছে যেখানে মাতৃভাষার পরেই ইংরেজি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এরপর তৃতীয় ভাষা হিসেবে সংস্কৃত ভাষার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংস্কৃত ভাষার শিক্ষা ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চার ভিতকে আরও মজবুত করবে। সংস্কৃত ভাষার বিকল্প হিসেবে তৃতীয় ভাষা হিসেবে অন্যান্য ভাষাও পড়া যাবে।

৫। ইতিপূর্বে কেরানী তৈরিই শিক্ষানীতির মূল হয়ে উঠেছিল। শিক্ষা ক্ষেত্রে বৃত্তিমুখী শিক্ষার উপর গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই এই বৃত্তিমুখী বা ভোকেশনাল ট্রেনিং দেওয়া হবে। শিক্ষান্তে যুবক-যুবতীরা যাতে নিজের পায়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে কথা মাথায় রেখেই এরূপ পদক্ষেপ। নতুন শিক্ষানীতি একমাত্র কেরানী তৈরির প্রবণতা থেকে শিক্ষাকে মুক্ত করবে বলে আশা করা যায়। বৃত্তিমুখী শিক্ষার এই উদ্যোগকে বামপন্থী নেতারা ‘শিশুশ্রমিক’ বানানোর কৌশল হিসেবে দেখলে তাদের ‘বন্ধু’ চীনের দিকে একবার ফিরে তাকানোর অনুরোধ জানাই।

৬। পাঠ্যসূচি যাতে শিক্ষার্থীর কাছে বোঝা না হয়ে ওঠে, সেদিকে নজর রেখে শিক্ষার্থীর বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পাঠক্রম তৈরির উপর ‍গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া আঞ্চলিক ভাষায় অনলাইন শিক্ষার প্রসার, ই-ভার্সান বইপত্র প্রকাশ, শিক্ষাদানে ভিডিওর ব্যবহার, ইলেকট্রনিক শিক্ষাসামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধি, বয়স্কদের মধ্যে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে নৈশ বিদ্যালয়, বিদেশের সেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়কে এদেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া প্রভৃতি বিষয়েও শিক্ষানীতিতে জোর দেওয়া হয়েছে।

৭। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পড়ুয়াকে নিজের পছন্দ মতো বিষয় গ্রহণের সুযোগ দেওয়া নিঃসন্দেহে এই শিক্ষানীতির এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। বিজ্ঞান শাখার কোনো পড়ুয়া সাহিত্য বা ইতিহাসের মতো বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী থাকলে সে সঙ্গে ইতিহাস নিয়েও পড়াশোনা করতে পারবে। গণিতের ছাত্র ডি.ডি. কোশাম্বী যেমন পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদ হিসেবে, ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র নারায়ণ সান্ন্যাল যেমন পরবর্তীকালে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছেন, নতুন শিক্ষানীতিতে পড়ুয়ারা যে-কোনো একটি শাখায় পড়াশোনা করেও সে অন্য শাখায় ভবিষ্যতে সুপ্রতিষ্ঠত হওয়ার সুযোগ পাবে। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৭৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অনুরাগ ব্যাহত হয়নি। নতুন শিক্ষানীতিতেও কোনো পড়ুয়া স্নাতকে কলা বিভাগে পড়াশোনা করেও জীববিদ্যা বা রসায়নশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য দেখাতে পারলে আমাদের শিক্ষানীতি তাঁকে সহায়তা করবে না কেন?

৮। গবেষণার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। এই সংস্থা গবেষণার উৎকর্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে অর্থসাহায্য করবে। এম.ফিল কোর্স তুলে দিয়ে শিক্ষার্থীর কেরিয়ার তৈরির মূল্যবান সময়ের অপচয় রোধ করার চেষ্টা হয়েছে। কেননা, এম.ফিলের পর যখন পি.এইচ.ডি.-র বড়ো গবেষণার কাজ করতেই হয়, তখন আর দু’বছরের এম.ফিলের গুরুত্ব থাকে না। তাই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এম.ফিলের মতো গবেষণার পাঠ আংশিক পেয়ে গেলে তারা সরাসরি পি.এইচ.ডি. করে এম.ফিলের দু’বছর সময় সাশ্রয় করতে পারবে।

৯। শিক্ষার্থী মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও ফিরে এসে যাতে আবার সেখান থেকে শুরু করতে পারে, সেই সংস্থান এই শিক্ষানীতির এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। ২০১৪ সালের হিসেব অনুসারে, দেশের শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ উচ্চশিক্ষায় পা রেখেছিল। বর্তমান সরকার চায় সেই সংখ্যা ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে পৌঁছে দিতে।

১০। ইউজিসি-র মতো ছোটবড়ো বিভিন্ন সংস্থা তুলে দিয়ে সরকার চাইছে মেডিকেল ও ল কলেজ ছাড়া উচ্চশিক্ষার অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানগুলিকে একই ছাতার তলায় নিয়ে আসতে। এতে শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি, দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাস পাবে। এতদিন যেখানে জিডিপি-র মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করা হত, নতুন নীতিতে তা বাড়িয়ে ৬ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। এও এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে। অস্ত্র ছাড়া যেমন যুদ্ধজয় সম্ভব নয়, তেমনি ভারতের মতো দারিদ্র্য-পীড়িত শিক্ষার্থীদের যদি প্রকৃতই সহায়তা করতে হয়, তবে এই বৃদ্ধি একান্তই অপরিহার্য ছিল। কিন্তু পূর্বতন সরকারগুলি সেদিকে নজর না দিয়ে শুধু গাল-ভরা কথা বলে সময় কাটিয়েছে।

সার্বিক বিচারে নতুন এই জাতীয় শিক্ষানীতি এতদিনকার গতিহীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল করবে, এতে সন্দেহ নেই। বিগত বাম শাসন থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবে যেভাবে তলানিতে এসে পৌঁছেছে, তা থেকে মুক্ত হতে গেলে এই রাজ্যের জন্য নতুন শিক্ষানীতি একান্ত অপরিচার্য। উচ্চশিক্ষা তথা সর্বভারতীয় স্তরের জন্য ইংরেজির অপরিহার্যতা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি তুলে দিয়ে বলেছে— ‘আমাদের ভোট দাও।’ আবার পরে ইংরেজি ফিরিয়ে এনে বলেছে— ‘আমাদের ভোট দাও।’ আজ বাংলার শহরাঞ্চলে সার্বিকভাবে এবং গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মূলে যে বামফ্রন্টের ইংরেজি তুলে দেওয়ার ভুলটিই যথেষ্ট ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ, অদ্ভুত বিষয় হল, বাম সরকার রাজ্যের শিক্ষার উৎকর্ষতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার পরও এখন তাদের নেতা-মন্ত্রী ও মেকী বুদ্ধিজীবীরা আবার নতুন উদ্যমে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পরেছেন। শিক্ষার অগ্রগতিকে রুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তাঁরা গলা চড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার খেলায় নেমে পড়েছেন। তাঁদের কেউ নতুন শিক্ষানীতির রূপকারদের ‘মূর্খ’ বা ‘নির্বোধ’ বলছেন, কেউ বা এই নীতি বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন। কেউ যখন অন্য কাউকে ‘মূর্খ’ বা ‘নির্বোধ’ বলেন, তখন আসলে তিনি নিজেকে ‘পণ্ডিত’ বলে প্রমাণের অদম্য চেষ্টা করেন।

এমন কিছু ‘পণ্ডিত’দের সম্পর্কে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. নিশীথ কুমার দাশের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি ‘সাধু সাবধান!’ শিরোনামে লিখেছেন— “পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচিত কিছু মানুষ এখনও গড্ডালিকাপ্রবাহে ভেসে বেড়াচ্ছেন। যেমন ডাক্তার অভিজিৎ চৌধুরী, যিনি তুড়ি মেরে করোনাকে উড়িয়ে দিয়ে ট্রাম্পকে মহামূর্খ বলেছিলেন। একই সুরে সুর মিলিয়েছেন নৃসিংহ ভাদুড়ী ও পবিত্র সরকার। উনারাও জাতীয় শিক্ষানীতির প্রণেতাদের কখনো মূর্খ কখনো নির্বোধ বলে চলেছেন। আমার জানতে ইচ্ছা করে, এইসব মহাপণ্ডিতের দল সারাজীবনে শিক্ষার মান উন্নয়নে কি দায়িত্ব পালন করেছেন? শিক্ষার জগতে চলমান অনিয়ম দুর্নীতি ও অপসংস্কৃতি নিয়ে এনাদের কিছু বলতে শুনেছেন? অন্যদিকে, যাঁরা নয়া শিক্ষানীতির নীল নকশা তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কিংবা দক্ষতার আশেপাশে এরাজ্যের মহাপণ্ডিতেরা কি কোনদিন আসতে পারবেন? তাহলে কেন এই ভণ্ডামি? এনাদের লেখা পড়লেই দেখা যাচ্ছে নেতিবাচক ভাবনার তিমিরে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন। কারণ দুটো হতে পারে, হয়, এনারা চূড়ান্ত শিক্ষানীতিটা ভাল করে পড়েননি, নতুবা, রাজনৈতিক অনুপ্রেরণার শিকার। বাস্তব যাই হোক, আমাদের সচেতন থাকতে হবে। ইতিবাচক নতুন সম্ভাবনা সবসময় স্বাগত। তাই, আমরা অপেক্ষা করছি সোনালি ভোরের আশায়!”