ওয়াইসীর বিহারে পদার্পণের জাদু পেটকোওয়াস্তে বুদ্ধিজীবীদের ভণ্ডামি উন্মুক্ত করল

0
1427

পুষ্যমিত্র

 

আসাদুদ্দীন  আর তাঁর রাজনৈতিক দল বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে রূপকথার গল্পের মতো উঠে এসেছে। ওয়াইসী সাহেবের মজলিসে – মুসলিমিন পেয়েছে পাঁচখানা আসন। মহাগঠবন্ধনের জন্য তা মোতেই আশাব্যঞ্জক হয়নি। মহাগঠবন্ধন বলছে, ওয়াইসীর প্রার্থীরা তাঁদের আরও ছয়জন বিধায়কের ভোটে কেটেছে। ওয়াইসী সাহেব সীমাঞ্চলের মুসলিমবহুল এলাকার ভোটে সিঁদ কেটেছেন। পূর্ণিয়া, কিষাণগঞ্জ, আরারিয়ার মোট পাঁচটি সিটে। বলাই বাহুল্য যে এই পাঁচজন প্রার্থীই মুসলিম। মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে ওয়াইসী সাহেব যেভাবে জাদু দেখিয়েছেন, তা কিন্তু চমকপ্রদ ব্যাপার।

এখন খবরের কাগজে, ওয়েব পোর্টালে, নিউজ চ্যানেলে শুধু ওয়াইসী নামক মহারথীকে নিয়ে আলোচনা চলছে। চারদিকে একই গল্প। সবাই মাথা চুলকে ভাবছে, তাহলে কি আগামী সব ভোটে সেকুলার ভোট ছতিছন্ন হতে চলেছে। এনডিটিভি ডট কমের মুকুল কেশবন লিখছেন, ভারত -ভাগের পরে একটি মুসলিম দলের সঙ্গে জোট করতে গিয়ে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। লেখা যত এগিয়েছে, ততই তিনি নিজের কথার পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি সাজিয়েছেন। বলেছেন যে, কেরলে এমন ঘটনা অবশ্য ঘটেনি। কিন্তু তার পরেই তিনি আবার নিজেকে নিরস্ত করেছেন। কেরলে এমন কিছু ঘটেনি, কিন্তু কেরল তো হিন্দি হার্ট – ল্যান্ডও নয়। হয়তো হিন্দি হার্ট – ল্যান্ড না-লিখে কাউবেল্ট বা গোবলয় লিখলে আরও ভালো করে বোঝানো যেত। যাই হোক, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। এবং বাস্তবিক পক্ষে তাঁর চিন্তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। নিজের লেখার শুরুটা তিনি কী দিয়ে করেছেন? –বিহারে ট্রাম্প জিতে গেছে! অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবে বলতে হয় যে, পরে যদি পশ্চিম বাংলা, উত্তর প্রদেশ এবং কালান্তরে দিল্লিতে ট্রাম্পের জয়কে আটকাতে হয়, তাহলে জোট গঠন করতে হবে। কিন্তু কীভাবে?

কলামিস্ট মুকুল কেশবনের এই চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা বিচার করা যাক। সীমাঞ্চলের ভোটাররা ঘরের পার্টিগুলোকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুদূর তেলেঙ্গানার একটি আঞ্চলিক দলকে আপন করে নিয়েছেন। আর এই থেকেই মনে পড়ে যাচ্ছে অতীতের কথা। মুসলিম লীগের কথা। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভারতের বুকের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কেউই কোনও দুর্বল বিন্দুতে চাপ দিতে চাইবেন না।

দ্য প্রিন্টের শেখর গুপ্তা একটা মজার কথা বলেছেন। তিনি লিখছেন, জিন্নাহর পরে কিন্তু ভারতীয় মুসলমানরা অপর কোনও মুসলমান ব্যক্তিকে লার্জ স্কেল ইমেজে নিজেদের নেতা বলে মানেননি। ব্যাপারটা খুব ভালো করে বোঝা উচিত। এমন নয় যে কোনও মুসলিম নেতা আসেননি। এসেছেন। জিতেছেন। কিন্তু তিনি লার্জার দ্যান লাইফ হতে পারেননি। কেউ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন, কেউ বিদেশমন্ত্রীর পদে। কেউ উপ রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। কেউ রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাননীয় মৌলানা আজাদ একজন মুসলিম ছিলেন, কিন্তু মুসলিমবর্গের কাছে তিনি জনপ্রিয় হতে পারেননি। এমনকি মুসলিম লীগের নেতারাও কেউ জনপ্রিয় ছিলেন না। দীর্ঘ একটা সময় ধরে ভারতীয় মুসলিমরা কংগ্রেসের বাঁধা ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করেছেন। এটা প্যান ইন্ডিয়া ফেনোমেনন ছিল। পরে আঞ্চলিক দলের দিকে ঝুঁকেছেন এই ভোটাররাই। বিহারে লালুপ্রসাদ যাদব। ইউ পি –তে মুলায়ম সিংহ যাদব। বাংলার বুকে কখনও বাম আবার কখনও বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং এই চয়নক্রমের লেটেস্ট ফলাফল ছিল দিল্লির আম আদমি পার্টি। নতুন একটা দলকে দিল্লির মুসলিম ভোটাররা পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু এই দলের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যেও কোনও মুসলিম মুখ নেই। আর এখন ওয়াইসী সাহেবের মাধ্যমে মুসলিমবর্গ একজন মুসলমান নেতাকে পেলেন, যার দল মুসলিম – হিতের কথা বলে এবং রাখঢাক না – করে বলে। ওয়াইসী সাহেব চারবারের সাংসদ। ইনি নিজে প্রখর বক্তা। নানা কারণে বিবাদে থেকেছেন। ওয়াইসীর দল এর আগে মহারাষ্ট্র আর কর্ণাটকের মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে ভালো চেষ্টা চালিয়েছে। হায়দ্রাবাদ তো ওয়াইসীর দুর্গ বলা চলে। কিন্তু কিন্তু কিন্তু যেটা মনে রাখতেই হবে তা হল এগুলোর কোনওটাই কাউবেল্টের জায়গা নয়। তাই ম্যাপ পয়েন্টিং – এর নিরিখে দক্ষিণ থেকে উঠে এসে বিহারে পাঁচটা সিট জেতা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। আর সেজন্যেই হইচই পড়ে গেছে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার জন্য লিখতে বসে রমাশঙ্কর প্রায় বিলাপের সুরে বলেছেন, চিরাগ পাশোয়ান জনতা দল ইউনাইটেডের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছেন, সেই একই ভূমিকা ওয়াইসী পালন করেছেন তেজস্বী যাদবের জন্য। দুটো ক্ষেত্রেই ক্ষতি হয়েছে। শ্লেষ অলংকার দিয়ে বলেছেন, খোলাখুলি ভোট কাটার কথাটা লেখেননি। এবার পশ্চিম বাংলা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। কী হয়, কী হয়? আর ভারতীয় জনতা পার্টির জন্য এটাই শাপে বর। বিহার সীমাঞ্চলের মুসলিম বহুল এলাকার মানুষেরা একটি ইসলামিক পার্টিকে ভোট দিয়েছেন। এই নিয়ে যত আলোচনা হবে, ততই শতাব্দীর প্রেতের মতো জেগে উঠবে মুসলিম লীগ এবং দেশভাগের ক্ষত। কেউ – না – কেউ মজলিসে –মুসলিমিনের অতীত খুঁড়ে বের করে আনবে। ১৯২৭ সালে নিজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রথম দিন থেকেই এই দলটি পৃথক মুসলিম ডমিনিয়নের জন্য তর্ক পেশ করেছে। নিজেকে প্রো – নিজাম পার্টি বলেছে। মজলিসের নেতা কাসিম রিজভি পূর্ব পাকিস্তানের ছায়া অনুসরণ করে হায়দ্রাবাদকে দক্ষিণ পাকিস্তান বানাতে চেয়েছেন। ১৯৪৮ সালে সর্দার পটেলের দুর্দম্য মনোভাবের কাছে নত হয়ে হায়দ্রাবাদ যখন ভারত দেশে যুক্ত হতে বাধ্য হল, তখন মজলিসের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারী হয়। ভারতের তথাকথিত সকল সেকুলার দলের মহাবোদ্ধারা কিন্তু এইসব ইতিহাস জানেন। আর তাই তাঁরা আজ ভীত। বা বলা ভালো মহাভীত। বিজেপি স্মাপ্রদায়িক দল, উগ্র হিন্দু রাষ্ট্রবাদী দল ইত্যাদি বলে তাঁদের চমক ধমক যতই দেখা যাক না কেন, মজলিসের বেলায় মুখে কুলুপ এঁটেছেন। না পারছেন মজলিসকে নিয়ে জোট করার কথাটি বলতে, না পারছেন তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক তকমা লাগাতে। সুতীব্র মেরুকরণের মহাজটিল সমীকরণে আজ তাঁরা পাস করতে পারবেন কিনা তাই নিয়েই চিন্তা।

হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে –ওয়াইসীর উদয়। সেখানে বলা হয়েছে, দেশভাগের আঘাত পাওয়ার পর থেকে ভারতীয় মুসলমানেরা মুসলিম পরিচিতির রাজনীতি করার বদলে সেকুলার এবং গণতান্ত্রিক মুখ্যধারার রাজনীতির সঙ্গ দিয়েছেন, কিন্তু এখন বিজেপির মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সেকুলার দলগুলোর অসফলতা দেখে তাঁরা ওয়াইসীর দিকে ঝুঁকেছেন। কথাটা এমনভাবে বলা হয়েছে যেন দেশভাগের পর ভারতীয় মুসলিমদের কাছে আর কোনও উপায় ছিল না, সেকুলার দলকে এবং গণতান্ত্রিক মুখ্যধারার দলকে ভোট দেওয়াই ছিল একমাত্র নৈতিক বিকল্প। হয়তো এটা সত্য। কিন্তু এই নিয়েও প্রশ্ন রাখা উচিত। আজ, ভারতে জনমানসে হিন্দু – মুসলিম সংঘর্ষ এবং পারস্পরিক সম্ভ্রম নিয়ে যে স্থিতি বিরাজ করছে, তার পিছনে কিন্তু দেশভাগের ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যাই দায়ী। ইতিহাসের যে সমস্ত শক্তি দেশভাগকে সম্ভব করে তুলেছিল, তাদের শত – শত ন্যক্কার জানিয়েও ক্ষত ভুলতে পারা সম্ভব নয়, ক্ষতি পূরণ করতে পারা সম্ভব নয়। ভারতের বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় দেশভাগ নিয়ে এমন এমন কথা বলেন, এমন গল্প লেখেন, এমন সিনেমা বানান যে তা দেখলে মনে হবে যে এসবের জন্য ভগবান দায়ী। যেমন ভূমিকম্প হয়, বন্যা হয়, ঠিক তেমন। হঠাৎ করে শিয়ালদা স্টেশনে রিফিউজিদের নিয়ে গল্প শুরু হয়, তাঁরা কেন শরণার্থী হলেন সেটা কিন্তু বলা হয় না। যেন এই নিয়ে কাউকে কিছু বলার নেই। কাউকে দোষ দেওয়াই যায় না। দোষ দেওয়ার খুব ইচ্ছা হলে ইংরেজদের বিভাজন নীতিকে দেওয়া চলে। আমরাও সেটাই দিই। কী করব, স্যার? ক্লাস নাইন – টেনের ইতিহাস বইতে এই গল্পই তো পড়ানো হয়েছে আমাদের। আজ মজলিসের এই জয়ের পর ভারতের বৌদ্ধিক মেধা কিন্তু একটি অত্যন্ত অস্বস্তিকর প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম লীগের সেই বিভাজন নীতির কথা তাঁদের মনে পড়ছে। সেই বিভাজন নীতি, যার জন্য বাংলা ভাগ হয়েছে, পঞ্জাব বিভাজিত হয়েছে, হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় আর ভোপাল নিয়ে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ধন – জন – সম্মান হারাতে হয়েছে।

প্রশ্নটা বিজেপির বিরোধ করতে গিয়ে মজলিসকে আহ্বান করা নিয়ে নয়, প্রশ্ন হল রাষ্ট্রের হিতের। ভাতের বুদ্ধিজীবী সমাজের অমেরুদন্ডীরা যতদিন না বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ব নীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার মতো মজলিসের সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্ন তুলতে পারছেন, ততদিন রাষ্ট্রবাদের আঙিনায় তাঁরা পা রাখতে পারবেন না। যতদিন না তাঁদের চোখের পর্দায় সমস্ত সাম্প্রদায়িক শক্তির অস্মিতা ধরা পড়বে, ততদিন মজলিসের মতো শক্তির উত্থান দেখলে তাঁদের বুক কাঁপবে। সংখ্যালঘু তোষণের নামে দেশভর নিজেদের বেইজ্জতি করানোর পরেও যতদিন বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক দল সুদূর দক্ষিণের একটি ক্ষুদ্র পার্টির প্রতাপে কাঁদবে, ভোট কাটছে বলে বিধবা বিলাপ করবে, ততদিন তারা সংখ্যাগুরুর মন জয় করতে পারবেন না।