কলকাতায়, দেশে এবং বিদেশে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন শাণিত করল প্রত্যয়

পশ্চিমবঙ্গ দিবস – পশ্চিমবঙ্গের উৎপত্তি হয়েছিল ২০ শে জুন, ১৯৪৭ এ অবিভক্ত বঙ্গের এক রক্তাক্ত অঙ্গচ্ছেদনেই মধ্য দিয়ে যেক্ষণে ধর্মীয় identity বা পরিচিতিই প্রধান বিষয় হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছিল। যখন এই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন তৎকালীন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ, বিশেষত প্রখ্যাত হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা ও শিক্ষাবিদ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যে পাকিস্তানী দুই-জাতি তত্বের সর্বনাশা তত্ব আর তার প্রভাবকে নিয়ে এক সাথে পথ চলা সম্ভব নয় তখন সেই পাকিস্তান আন্দোলনের সম্পূর্ণ বিপরীত বৃত্তে দাঁড়িয়ে বাঙ্গালী হিন্দুর অস্তিত্বরক্ষার প্রচেষ্টা হেতু এক ভয়াবহ, মরণপণ সংগ্রামের মাধম্যেই Bengali Homeland Movement র ফলশ্ৰুতি হিসেবে সৃষ্ট হয় পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্য ২০ শে জুন। কিন্তু তথাকথিত “ধর্মনিরপেক্ষ” বৈরী রাজনৈটিক সংগঠন ও পরবর্তী দশকগুলিতে রাজনৈতিক ঝঞ্ঝা বাঙ্গালী হিন্দুকে এই বিশেষ দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্মৃত করেছিল। কিন্তু অসীম অন্ধকারের মধ্যেও প্রত্যক্ষ হয় ঊষাকে। রক্তাক্ত বাঙ্গালী হিন্দুর অন্ধকার পথের শেষে এসে সেই মুগ্ধকর আলো দেখার সময় এখন। পশ্চিমবঙ্গ দিবস ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাঙ্গালী হিন্দু জনজাতির মধ্যে।

এই উপলক্ষে গত ২২ শে জুন কলকাতা মহানগরের প্রসিদ্ধ রামমোহন লাইব্রেরীতে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হল পশ্চিমবঙ্গ দিবস। অনুষ্ঠানে বক্তা রূপে উপস্থিত ছিলেন মেঘালয়ের রাজ্যপাল ডঃ তথাগত রায়, বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও অধ্যাপক ডঃ মোহিত রায়, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাস ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রী রন্তিদেব সেনগুপ্ত।

রামমোহন লাইব্রেরীতে পশ্চিমবঙ্গ দিবসের অনুষ্ঠানে সভাকক্ষে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। বক্তাদের মধ্যে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাস বলেন পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশের সাথে মিশিয়ে ফেলার চক্রান্ত চলছে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের স্লোগান “জয় বাংলা” পশ্চিমবঙ্গে চালানো হচ্ছে। এসব সরকারি উদ্যোগেই হচ্ছে। জনৈকা প্রভাবশালীর কলকাতা বিমানবন্দরে সোনা সহ ধরা পড়ার ঘটনাকে কটাক্ষ করেন তিনি। বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রী রন্তিদেব সেনগুপ্ত বলেন, পশ্চিমবঙ্গের জন্মদাতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা হতে দেওয়া যায় না। জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতাকে সম্মান দেওয়া বিজেপির জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব। ১৮ জন সাংসদকে দায়িত্ব নিতে হবে শিয়ালদহ স্টেশনের নাম ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নামে নামাঙ্কিত করার জন্য।

মেঘালয়ের রাজ্যপাল শ্রী তথাগত রায় বলেন ইতিহাসকে যে ভুলে যায়, ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা নেয় না, ইতিহাস তাকে ধ্বংস করে। বাঙ্গালী হিন্দু ভুলে গেছে আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠন, সর্বত্র হিন্দু বাঙ্গালী চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে। কিন্তু তারাই এখন অত্যাচারিত। আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে হবে বাঙ্গালী হিন্দুকে। ডঃ মোহিত রায় বাঙ্গালী হিন্দুর সংরক্ষণ দাবি করেন। নাগাল্যান্ড, মণিপুর সহ বহু রাজ্যে সংখ্যাগুরুদের কৃষ্টি রক্ষার জন্য যেমন সংবিধানের ৩৭১ ধারা প্রয়োগ করা হয়, পশ্চিমবঙ্গেও বাঙ্গালী হিন্দুর জন্য তেমন চাই। ডঃ রায় দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের “বঙ্গ আমার জননী আমার” গানটিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সঙ্গীত করার দাবি করেন।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, দুর্দমনীয় ও বিশিষ্ট অরাজনৈতিক হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন “হিন্দু সংহতি” র উদ্যোগে ২০ শে জুন দিনটিকে কেন্দ্র করে এক বিশাল মিছিলের আয়োজন করা হয় শহর কলকাতায়। প্রায় ৩০, ০০০ সক্রিয় হিন্দু যোদ্ধা তাতে অংশগ্রহণ করে প্রত্যেক পদক্ষেপ ও প্রত্যয়ের সাথে পশ্চিমবঙ্গ ও বাঙ্গালী হিন্দু জাতির ধর্ম-ভাষা-অর্থনৈতিক স্বার্থ ও স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করার শপথ নেন। হিন্দু সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত মেলবন্ধন ও তার আগ্নেয় প্রকাশ স্মরণ করিয়ে দেয় শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অমর গীতি “বঙ্গ আমার জননী আমার” –

“একদা যাহার বিজয়-সেনানি হেলায় লঙ্কা করিল জয়,
একদা যাহার অর্ণব-পোত ভ্রমিল ভারত-সাগরময়;
সন্তান যার তিব্বত-চিন-জাপানে গঠিল উপনিবেশ,
তার কিনা ধুলায় আসন, তার কি না এই ছিন্ন বেশ!

উদিল যেখানে মুরজ-মন্ত্রে নিমাই-কন্ঠে মধুর তান,
ন্যায়ের বিধান দিল রঘুমণি, চন্ডীদাস যেথা গাহিল গান।
যুদ্ধ করিল প্রতাপাদিত্য, তুই তো মা সেই ধন্য দেশ!
ধন্য আমরা, যদি এ শিরায় থাকে তাদের রক্তলেশ!”

“হিন্দু সংহতি” র সভাপতি শ্রী দেবতনু ভট্টাচার্যের কথায় – এই প্রাণের তরঙ্গকে রাখা যাবে না। নব ইতিহাস গড়বেই এই ইস্পাত-কঠিন স্পর্ধা।

শুধু কলকাতা, তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ও জেলাশহরগুলিই নয়, একই দিনে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালিত হয়েছে কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরু শহরেও।

গত ২২-এ জুন, বেঙ্গালুরু শহরের প্রবাসী বাঙ্গালীরা মহাসমাগ্রহে ‘পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠা দিবস- ২০ এ জুন’ পালন করলেন ঐতিহ্যবাহী মিথিক সোসাইটি সভাঘর-এ। এই প্রথম বাংলার বাইরে বেঙ্গালুরু শহরে ‘পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠা দিবস’এত বিশেষভাবে উদযাপন করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও রাজ্যসভার সাংসদ শ্রী স্বপন দাসগুপ্ত মহাশয়। দক্ষিণী চলচিত্র জগতের বহু পরিচিত অভিনেত্রী ও সমাজসেবী শ্রীমতী মালবিকা অবিনাশ এবং হিন্দু ধর্মের বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক শ্রী সন্দীপ বালাকৃষ্ণান ও মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে। অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ হয় শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারা রচিত জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ দিয়ে। দেশভক্তির আদর্শ প্রকাশ হল যখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সমস্ত গুণীজন, আয়োজক ও গায়িকা একই কন্ঠে গেয়ে ওঠেন দেশমাতার জয়গান।

স্বপন দাসগুপ্ত মহাশয় ওনার বক্তব্যের মাধ্যমে সকলের কাছে বহু অজানা ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরেন।উনি ব্যাখ্যা করেন তৎকালীন অর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন যার মধ্যে শুরু হয় ‘বাঙ্গালী হিন্দু হোমল্যান্ড’ আন্দোলন এবং কিভাবে তা পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে পরিসমাপ্তি লাভ করে। উনি আরো তুলে ধরেন দেশভাগের আগে অধুনা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের ওপর হয়ে যাওয়া অমানুষিক, মর্মস্পর্শী অত্যাচারের সব অজানা ইতিহাস। ভারতকেশরী শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্ব ও অবদানের কথা ওনার বক্তব্যে বারবার উঠে আসে। এই সমস্ত তথ্য সভায় উপস্থিত সমস্ত গুণীজনকে বিচলিত করে তোলে।উপস্থিত বিদ্দজনের মুখে শোনা যায় এইসব সত্য ইতিহাস জনসমক্ষে না আসতে দেওয়ার পেছনে দেশের কিছু গুটিকতক ঐতিহাসিক চক্রান্তের কথা। স্বপন দাসগুপ্ত বলেন আরো বলেন, আত্ম বিস্মৃত বাঙ্গালী জাতি নিজের ইতিহাস জানতে ও সম্মান না করতে পারলে কিছুতেই নিজেদের মানরক্ষা করতে সমর্থ হবে না !

এরপর শুরু হয় মালবিকা অবিনাশ, সন্দীপ বালাকৃষ্ণান ও স্বপন দাসগুপ্ত মহাশয়ের সাথে আলোচনা চক্র। দর্শকা আসন থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়ও অতিথিরা তার সদুত্তর তাঁদের সামনে তুলে ধরেন। বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ভগ্নদশার কথা, উঠে আসে রাজ্যে আসীন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু জনমানসে তৈরি হওয়া ক্ষোভের কথা। পশ্চিমবঙ্গের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রায়োজনীয়তার ওপরও বক্তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মালবিকা অবিনাশ, সন্দীপ বালাকৃষ্ণান যুবক যুবতীদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পরম গৌরবান্বিত সোনার বাংলা গড়তে আহ্বান জানান।

মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানটি শেষ হয় ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যের লেখা কালজয়ী ‘বন্দেমাতরম’ দিয়ে। অনুষ্ঠানে যুবক যুবতীদের অংশগ্রহন করার আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বৈদিক সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট লেখক ড: দ্বৈতা গোস্বামী। অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল প্রবাসী বাঙ্গালীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘Awakened Bengal’ নামক একটি স্বয়ংসেবী সংগঠন যাঁরা বাঙ্গালী জাতির কাছে জাতীয়তাবাদের মন্ত্র নতুন ভাবে পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিজেদের সমর্পিত করেছে।

২৩ শে জুন, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিনে, সুদূর আমেরিকার সানফ্রাসন্সিসকো শহরেও গাম্ভীর্য্য সহকারে পালিত হয় পশ্চিমবঙ্গ দিবস। অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় Festival of Globe, Bengal নামক সংগঠনের দ্বারা।  সমগ্র ইন্দো-আমেরিকান সমাজের অকুন্ঠ সহযোগিতায় সুচারুভাবে অনুষ্ঠিত হয় কার্যক্রম। অনুষ্ঠানে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন যাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন NASA র বিজ্ঞানীরা, Google, Amazon ও Facebook র সাথে জড়িত ইঞ্জিনিয়াররা, লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তার ও ব্যবসায়ীরা। স্মরণ করা হয় ১৯৪৭ র দাঙ্গা, দেশভাগজনিত ভয়াবহ লগ্ন, বাঙ্গালী হিন্দুর অস্তিত্বসঙ্কট ও ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অসামান্য ভূমিকা বাঙ্গালী হিন্দুদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যের সৃষ্টিতে। সুদূর আমেরিকায় বসেও যে দেশপ্রেমের প্রবাহ কিরূপে কাজ করে অনাবাসী ভারতীয়দের মধ্যে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। প্রত্যেকেই একমত হন যে পশ্চিমবঙ্গ তথা বাঙ্গালী হিন্দু জাতি আজ অস্তিত্বজনিত সঙ্কটের খাদের সামনে দাঁড়িয়ে এবং আর এক পা অগ্রসর হওয়া মানেই চিরপতন।

ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও Festival of Globe র প্রতিষ্ঠাতা ডঃ রমেশ জাপরা, শ্রী চান্দু ভাম্বরা (সভাপতি, BJP NCA), হিন্দু স্বয়মসেবক সংঘের জ্যেষ্ঠ কার্যকর্তা শ্রী চন্দ্রশেখর ওয়াঘ, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দক্ষিণ বঙ্গ থেকে যুক্ত হন ডঃ জিষ্ণু বসু (রাষ্ট্রীয় স্বয়মসেবক সংঘের বরিষ্ঠ ভাবাদর্শী ও ক্ষেত্রপ্রচারক) এবং শ্রী শিশির বাজোরিয়া (চেয়্যারম্যান, IIM Shillong এবং বঙ্গ বিজেপির core committee র সদস্য)।