কুমারসম্ভবম্
অধ্যায় ১: মহাভারত ও পলান্ন
একবিংশ শতাব্দীর সময়ের নিরিখে ন্যূনতম ৭ থেকে ১০ হাজার বছর পূর্বে, মহাভারতে উল্লেখিত হস্তিনাপুর তথা ইন্দ্রপ্রস্থের চন্দ্রবংশীয় পাণ্ডব তথা কৌরব রাজপরিবার নির্বিশেষে ‘পলান্ন’ আহার করতেন।
তাই ‘পলান্ন’ বিলক্ষণ বৈদিক যুগের খাদ্য বলেই বিবেচিত হয়।
এবারে জানা যাক পলান্ন আসলে কী?
পলল বা পল (অর্থাৎ মাংস) মিশ্রিত অন্ন হল — ‘পলান্ন’।
(palānna) ‘পলান্ন’ শব্দের সমাস — মধ্যপদলোপী কর্মধারয়।
দ্বিতীয়তঃ, ‘পল’ শব্দ আরও বিবিধ অর্থ বহন করে — ‘পল’ শব্দ, সময়ের একককেও বোঝায়। দণ্ডের ষষ্টিতম অংশকে অর্থাৎ ১/৬০ দন্ড বা ২৪ সেকেন্ড, ক্ষণকাল; ৪ তোলা ওজন এবং ধান্য বা সমগোত্রীয় কৃষিজাত উদ্ভিদের খড়কেও ‘পল’ বলা হয়।
অধ্যায় ২: নলান্ন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত মহাভারতের সভাপর্বে তদানীন্তন হস্তিনাপুর নরেশ ধৃতরাষ্ট্র যুবরাজ দুর্যোধনকে বলছেন, “তুমি মূল্যবান প্রাবার (উত্তরীয়) পরিধান করো, সুস্বাদু পলান্ন (বিরিয়ানি) আহার কর, তা সত্ত্বেও তুমি এত কৃশকায় হচ্ছ কেন?”
অর্থাৎ সুস্বাদু এবং পুষ্টিদায়ী পলান্ন নিয়মিত গ্রহণ করা সত্ত্বেও তার জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন কেন ক্রমশ কৃশকায় হয়ে যাচ্ছে তাই নিয়ে পিতা হিসাবে হস্তিনাপুর নরেশ ধৃতরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
মহাভারতের বনপর্বে ৫২ থেকে ৭৯ তম অধ্যায় জুড়ে সুবিশাল অক্ষৌহিনী সৈন্যের অধিপতি, অশ্বতত্ত্বজ্ঞ, দ্যূতক্রীড়া বা অক্ষক্রীড়ায় দক্ষ এবং কন্দর্পকান্তি নিষধরাজ্ নল তথা তাঁর প্রেয়সী এবং অতঃপর পত্নী বিদর্ভনন্দিনী দময়ন্তীর উল্লেখ রয়েছে।
শকুনি তার পিতা তথা গান্ধাররাজ্ সুবলের অস্থি দিয়ে তৈরী দিব্যশক্তি সম্পন্ন দ্যূতক্রীড়ার ঘুঁটির সাহায্যে যুধিষ্ঠিরকে অক্ষক্রীড়ায় পরাজিত করার পরে, পাণ্ডবদের বনবাসকালে মহর্ষি বৃহদশ্ব তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তাঁদের কষ্ট লাঘব কল্পে নল দময়ন্তীর জীবনের চরম দুঃখের এবং বিরহে ঘটনা উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।
নিষধরাজ্ নল ও বিদর্ভনন্দিনী দময়ন্তীর মিলনে ঈর্ষান্বিত দেবতা ‘কলির’ চক্রান্তে নল অক্ষক্রীড়ায় নিজের ভাই পুষ্করের কাছে রাজ্য-সম্পদ হারিয়ে পুত্র ও কন্যা ইন্দ্রসেন তথা ইন্দ্রসেনাকে দময়ন্তীর মাতা-পিতার দেশ বিদর্ভরাজ্যে পাঠিয়ে সপত্নী বনবাসী হয়েছিলেন।
অতঃপর ভাগ্যের নিদারুন পরিহাসে এবং ‘কলির’ চক্রান্তে প্রথমে রাজ্যচ্যুত এবং তদপরবর্তী পত্নীচ্যুত হয়ে, নিষধরাজ্ ‘নল’ তদানীন্তন অযোধ্যা নরেশ ঋতুপর্ণের ‘বাহুক’ নামক কদাকার দর্শন সারথি হতে বাধ্য হন এবং দুই সন্তানের জননী হওয়া সত্ত্বেও প্রবল পতি প্রেমে অনুরক্তা দময়ন্তী কৌশলে তাঁর স্বামীকে অন্বেষণ কল্পে পুনরায় তাঁর নিজের জন্য স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করেন।
সেই স্বয়ম্বর উপলক্ষে দময়ন্তী অযোধ্যা নরেশ ঋতুপর্ণের রথ চালক ‘বাহুক’ রুপি নলের পরিপাক কৃত ‘পলল’ রান্না গ্রহণ করে নিশ্চিত হন যে ‘বাহুক’ রুপি সারথিই আদতে নিষধরাজ্ নল।
মহাভারতে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় যে কন্দর্পকান্তি নিষধরাজ্ নল, দ্যূতক্রীড়া বা অক্ষক্রীড়ায় দক্ষ এবং অশ্বতত্ত্বজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি একজন অতি সুদক্ষ তথা সূদ পাচকও ছিলেন।
নিষধরাজ্ নল অতীব উৎকৃষ্ট পলান্ন (যা কিনা বর্তমানের বিরিয়ানি বলে প্রচলিত) রন্ধনে বিশেষ পটু ছিলেন। তিনি পাকশাস্ত্র তথা রান্ধন শিল্প নিয়ে এক ঐতিহাসিক পুস্তক রচনা করেছিলেন এবং তাঁর রচিত সেই সুবিখ্যাত পুস্তকের নাম হল ‘পাকদর্পণ’।
তাঁর রচিত সেই অতি প্রাচীন পাকদর্পণ পুস্তকে তিনি সেই ত্রেতা তথা দ্বাপর যুগের প্রাচীন সমস্ত বিবিধ সমৃদ্ধ রন্ধনপ্রণালীর কৌশল লিপিবদ্ধ করে গেছেন। সেই পুস্তকে তিনি বিভিন্ন ভারতীয় মশলা তথা দুষ্প্রাপ্য অনুপান সহযোগে ‘পলল’ এবং ‘পলান্ন’ (বিরিয়ানি) রন্ধনের অতি উৎকৃষ্ট বিবিধ কৌশলও লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
সত্যি, সুস্বাদু রান্না বা বিশেষ শৈলীতে রান্না কি না করতে পারে!
চলবে