রেল ব্যবস্থার সংস্কার

প্রকৃত প্রতিবাদ না কি খড়গপুর উপনির্বাচন মডেল

0
1170

যে খবরকে রেল বেসরকারীকরণ বলে প্রচার চালানো হচ্ছে, তা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপে (পিপিপি) ট্রেন চালানো মাত্র। যদিও রেলকে বাচাতে কঠোর আর্থিক ও প্রশাসনিক  সংস্কার ছাড়া আর কোন পথ নেই, (370, 35A বিলোপ কিংবা তিন তালাক বিলোপের মত), তবু সরকার আপাতত সংস্কারের গতি পিপিপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছে। অটলজি যেমন অসামরিক বিমান, শক্তি, ব্যাঙ্কিং টেলিকম, মেট্রো রেল কিংবা সড়ক পরিবহনে কঠোর সংস্কারের রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন কিংবা মোদীজি GST, IBC বা RERA চালু করতে কঠোর হয়েছেন, তেমনই রেলকে ন্যূনতম তিনটি ভাগে ভাগ করে কর্পোরেশন গঠন করা ছাড়া কোন উপায় নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি WBSEB কে তিন ভাগে ভাগ করে WBPDCL, WBSEDCL এবং WBSETCL এ ভাগ করে বেসরকারী বিদ্যুৎ গ্রামে বিক্রি করতে পারে, তবে রেলের ব্যাপারে দ্বিচারিতা কেন? পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি হলদিয়া পেট্রোকেমিকালকে বেঁচে দিতে পারে, তবে কেন্দ্র শুধুমাত্র কিছু পিপিপি মডেলে রেল চালালে গেল গেল রব কেন?

প্রথমে আসি পিপিপি মডেল ব্যাবহারে ইতিহাসে কংগ্রেস,  সিপিএম ও তৃণমূলের ইতিহাস। পিপিপি মডেলের উপর অর্থ মন্ত্রকের যে পুস্তিকা তৈরি হয়, তার পৌরোহিত্য করেন মনমোহন সিং ও পি চিদাম্বরম। আর সেই সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করেছে প্রথমে সিপিএম পরে তৃণমূল। ওই পুস্তিকাকে বাইবেল মানত দেশের সব সরকার ও স্বশাসিত সংস্থা। অথচ সেই মনমোহন সিং, চিদাম্বরম, মোহাম্মদ সেলিম (তৎকালীন উত্তর কলকাতার সিপিএম সাংসদ) ও মমতা ব্যানার্জী ( UPA 2 এর রেলমন্ত্রী) আজ এর বিরোধিতা করছে।

সিপিএম? বাস স্ট্যান্ড, পুরোনো কারখানা, পুরোনো বাজার থেকে সরকারি বাস পিপিপি মডেলে বেচে দিয়ে গেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য, নিরুপম সেন ও অশোক ভট্টাচাৰ্যরা। এমনকি,  2005এ যখন UPA 1 সরকার JNNURM প্রকল্পে সব রাজ্যকে পাশ্চাত্য দেশের মত আধুনিক নিচু ফ্লোর বাস কেনার জন্য অনুদান দিচ্ছিলো, তখন রাজ্যে সরকার ছোট সাদা রংএর JNNURM বাস কিনে পিপিপি মডেলে ক্যাডারদের লুটের রাস্তা খুলে দেন। অথচ সেলিম সাহেব আজ তার বিরোধিতা করছেন নিজের অতীত ভুলে।

আর তৃণমূল? 2009 তে রেলমন্ত্রী হবার পর ডঃ অমিত মিত্রকে এই রেলেরই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পিপিপি কমিটির চেয়ারম্যান করেন মমতা ব্যানার্জী। রেল মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে এখনো তা লেখা আছে। ফলে রেলে পিপিপি উদ্যোগে পীযুষ গোয়েলের নয়। আজ থেকে এগারো বছর আগেই তৃণমূল রেলে এই ব্যবস্থা চালু করে গেছে।

আর তৃণমূল? 2009 তে রেলমন্ত্রী হবার পর ডঃ অমিত মিত্রকে এই রেলেরই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পিপিপি কমিটির চেয়ারম্যান করেন মমতা ব্যানার্জী। রেল মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে এখনো তা লেখা আছে। ফলে রেলে পিপিপি উদ্যোগে পীযুষ গোয়েলের নয়। আজ থেকে এগারো বছর আগেই তৃণমূল রেলে এই ব্যবস্থা চালু করে গেছে।

কিন্তু পিপিপি কি যথেষ্ট? একেবারেই না। বরং আরও বেশী সংস্কারের প্রয়োজন। কৃষি ও MSME র মত. রেলের ব্যাপারেও আইনগত ও প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন। প্রয়োজন বেসরকারী ও বিদেশী বিনিয়োগ। প্রয়োজন পুঁজি, প্রয়োজন আধুনিক পাশ্চাত্য প্রযুক্তি, যা মেট্রো রেলে করা হয়েছে এবং সারা দেশ তার ফল পেয়েছে।  তবে একটা রাজ্যে বাদে। তার নাম পশ্চিমবঙ্গ। কিভাবে? দেখা যাক।

কলকাতা মেট্রো 1972 এ রেল মন্ত্রক বানায় (যেখানে তথাগত রায় অন্যতম চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন)। এরপর অটলজি 2000 এ দিল্লি মেট্রো চালু করলেন। কিন্তু ভবিষ্যৎদ্রষ্টা অটলজি রেলের অধীনে তা রাখেন নি বাকি মেট্রো গুলোকে। 2000 সালে উনি কেন্দ্রীয় নাগরোন্নয়ন মন্ত্রক ও রাজের নাগারান্নায়ন দপ্তরের 50-50 অংশীদারিত্বে কর্পোরেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন লাল ফিতের হাত থেকে ভবিস্বতের মেট্রো ব্যাবস্থাকে বাঁচতে। একে একে ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা, চেন্নাই, লখনৌ ভোপাল মুম্বাই সহ সব কটি শহর এই ধারণের মেট্রো কর্পোরেশন মানায়। 2007 এ বুদ্ধদেব ভট্টাচাৰ্য হাওড়া থেকে সল্টলেকের মেট্রো বানাতে KMRCL গঠন করেন এই 50-50 অংশীদারিত্ব ফর্মুলায়। কিন্তু 2009 তে মমতা ব্যানার্জী রেলমন্ত্রী হলে এই কর্পোরেশনকে রেলমন্ত্রক অধিগ্রহণ করে। তার সঙ্গে তিনি রেলের অধীনে বারাকপুর, বারাসাত, জোকা, দক্ষিণেশ্বর, গড়িয়া নিয়ে প্রায় 100 কিলোমিটার মেট্রোর ঘোষণা করেন রেল মন্ত্রকের অধীনে। কিন্তু 2020 তে আমরা তার কতটা পেয়েছি?

KMRCL সেক্টর 5 থেকে স্টেডিয়াম মেট্রো চালু করেছে। আর রেলের অধীনের 100 কিলোমিটার মেট্রোর মধ্যে একটি মাত্র স্টেশন গত এগারো বছরে  তৈরি হয়েছে। তা হল নোয়াপাড়া। যেখানে দিল্লি মেট্রো কর্পোরেশন 100 টার বেশী স্টেশন বানিয়ে তাদের রেল যোগাযোগ বিস্তৃত করেছে বহুদূর।

এবার আসি কর্মী সংকোচনের বিষয়ে।

আজ থেকে 30 বছর আগের DoT ভেঙে BSNL, MTNL হয়েছিল। করো চাকরি গেছে? কিন্তু লাভ হয়েছে সাধারণ মানুষের। 30 বছর আগে পাড়ার  দুই এক জন হোমরাচোমরা ছাড়া কেউ বাড়িতে টেলিফোন রাখতো না। আজ বহুতলের দারোয়ানও স্মার্ট ফোন রাখে।

অথচ, একটি মুখরোচক খবর এবিপি আনন্দ বলার পর বিরোধীরা আবার লোক ক্ষেপাতে নেমে পড়েছে। খবরটি হল, রেলের 50% শুন্য পদে কেন্দ্র আর নিয়োগ করবে না। কিন্তু কোন পদগুলি বিপুপ্ত হল?  একটা উদাহরণ দি। গত কয়েক বছরে বহু লেভেলে ক্রসিং তুলে দেয়া হয়েছে। সেখানে সরকার ব্রিজ বানিয়ে দিয়েছে। যেমন বেলঘরিয়া, সোদপুর বা ব্যারাকপুর। যাঁরা সেখানে কাজ করতেন তাঁদের কাউকে ছাটাই করা হয় নি।. বদলি হয়েছে। এঁরা যখন অবসর নেবেন, তখন কি সরকারকে এঁদের পদ অবলুপ্ত করতে হবে নাকি এই পদেই লোক নিতে হবে? লেভেলে ক্রসিং না থাকলে এদের দিয়ে কি কাজ করানো হবে? বাবুদের বাংলো পরিষ্কার করানো?

যে পদ অবলুপ্ত হল, সেই পদের কর্মীরা যখন আজ থেকে 30 বছর আগে কাজে যোগ দিয়েছিলেন, তখন কি সিগন্যাল অটোমেশন, স্কাডা বা কম্পিউটার রিজারভেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে  রেল লোক নিতো? এই সব পদে যে লাখ লাখ লোক নেওয়া হয়েছে সেই খবর আনন্দবাজারে কোথায়? লোক নেবার জন্য বিজ্ঞাপন তো আপনার কাগজেও দেওয়া হয়েছিল l তাহলে এক সময় যারা পতাকা উড়িয়ে রেলের সিগন্যাল দিতো সেই পদগুলো বিলোপ হয়ে আধুনিক প্রযুক্তি জানা কর্মীদের যে নেওয়া হচ্ছে সেটা চেপে যাচ্ছেন কেন? সরকার তো ছাঁটাই করছে না।

যে পদ অবলুপ্ত হল, সেই পদের কর্মীরা যখন আজ থেকে 30 বছর আগে কাজে যোগ দিয়েছিলেন, তখন কি সিগন্যাল অটোমেশন, স্কাডা বা কম্পিউটার রিজারভেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে  রেল লোক নিতো? এই সব পদে যে লাখ লাখ লোক নেওয়া হয়েছে সেই খবর আনন্দবাজারে কোথায়? লোক নেবার জন্য বিজ্ঞাপন তো আপনার কাগজেও দেওয়া হয়েছিল  তাহলে এক সময় যারা পতাকা উড়িয়ে রেলের সিগন্যাল দিতো সেই পদগুলো বিলোপ হয়ে আধুনিক প্রযুক্তি জানা কর্মীদের যে নেওয়া হচ্ছে সেটা চেপে যাচ্ছেন কেন? সরকার তো ছাঁটাই করছে না।

 

প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পদ অবলুপ্তি স্বাভাবিক নিয়ম। একসময় হেমন্তবাবুর ‘রানার’ গান  আপামর বাঙালীকে কাঁদিয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেট বা কুরিয়ার এর যুগে রানারের কোন গুরুত্ব আছে। বিরোধীরা রানার পদে পুনর্নিয়োগের দাবী করছে না কেন?  কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার কতজন রানার নিয়োগ করেছে গত 50 বছরে।ওই পদ অবলুপ্ত করলো কে? ইমেইল, হোয়াটস্যাপ তুলে রানার নিয়োগ শুরু করা সম্ভব?

আসলে এটা খড়্গপুর উপনির্বাচন মডেল। গত বছর খড়্গপুরের রেল কর্মীদের বেসরকারিকরণের ভয় দেখিয়ে ওই আসনটা জেতার পর থেকে এই মডেল চালু।

সবশেষে, তৃণমূল সরকারকে অনুরোধ গত কয়েকদিন তো বাস চালানো নিয়ে বাস মালিকদের সঙ্গে আপনাদের ঝামেলা হচ্ছে। বেসরকারি বাসগুলোকে ‘জাতীয়করণ’ করে রাজ্যের সড়ক পরিবহন নিজের হাতে তুলে নিন না। বাস কন্ডাকটর বা ড্রাইভারদের সরকারি চাকরি দিন না। এঁরাও বাঁচবেন, জনগণও বাঁচবে। গত নয় বছরে তো হলদিয়া পেট্রো থেকে হরিণঘাটা ডেয়ারি সব বেচে দিয়েছেন। তাহলে কোন মুখে অন্যের সমালোচনা করছেন?