পুলওয়ামার হত্যাকাণ্ড এবং কিছু বামমার্গী ভ্রান্ত ধারণার মৃত্যু

ভ্রান্ত ধারণা এক: কাশ্মীরের সমস্যার কারণ অর্থনৈতিক

ছোটবেলা থেকে বামপন্থীদের কাছে শুনে আসছি যে মানুষ অপরাধ করে অভাবের তাড়না থেকে। হাতে হাতে কাজ থাকলে মানুষ অপরাধী হয় না। অপরাধ  দমন করতে তাই চাই বেকার সমস্যার সমাধান, ক্ষুধার সমাধান ইত্যাদি ইত্যাদি। কাশ্মীরের ব্যাপারেও সেই কথাই বামেরা বলে থাকেন। কাশ্মীরের আসল সমস্যা নাকি অর্থনৈতিক, একথাই বিদ্বৎ বাম মহল সচরাচর বলে থাকেন।

কিন্তু এখন কি দেখা গেল? যে আত্মঘাতী জঙ্গী আদিল আহমেদ দার এই হামলা করেছে, তার বাবা গোলাম হাসান দারের আছে ব্যবসা। আদিল একটি কাঠচেরাই কলে কাজ করত। আদিলের না ছিল অন্নের অভাব, না ছিল কাজের। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কাজ ছেড়ে দিয়ে ঘাতক হতে এগিয়ে গেছে। তাহলে কাশ্মীরের সমস্যাটি অর্থনৈতিক কি ভাবে বলা যায়?

এবার কেউ হয়ত বলে বসবেন, একটিমাত্র  ঘটনার উপর  ভিত্তি করে আপনি সর্বশক্তিমান মার্ক্সবাদের নিন্দা করছেন। কি আস্পর্ধা! আরে না মশাই, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যালান ক্রুগার বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদীদের জীবনপঞ্জী পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন যে সারা বিশ্ব জুড়েই সন্ত্রাসবাদীরা সমাজের শিক্ষিততর অংশ থেকে আসে। তাদের সন্ত্রাসী হবার কারণ কোনমতেই অর্থনৈতিক বলা যায় না। আর সর্বশক্তিমান বৈজ্ঞানিক মার্ক্সবাদের মতে নাকি আইনষ্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং কৃষ্ণগহ্বর ভুল!  তাহলে বিজ্ঞান আর মার্ক্সবাদকে বোধহয় এক বাক্যে উচ্চারণ করা যায় না।

ভ্রান্ত ধারণা দুই: কাশ্মীরের মানুষ চায় কেবল স্বশাসন

আদিল জানিয়েছে যে ভারতের মানুষ গোমূত্রসেবী এবং মূর্তিপূজক (মুশরিক)।  তাই তাদের সে মোটেই পছন্দ করে না। তাদের সেই ধৃষ্টতার শাস্তি দিতেই সে এগিয়ে এসেছে। এ তো কোন সহিষ্ণুতার বাণী নয়, বরং অত্যাচারীর অজুহাত মাত্র। এ কথার মধ্যে কাশ্মীর কোথায়? এ তো সেই ১৯৮০র দশকে কাশ্মীর উপত্যকায় শোনা শ্লোগান মাত্র, “কাশ্মীরিয়ৎ  কা মতলব ক্যা, লা ইলাহা ইলাল্লা। তখন হাজার হাজার কাশ্মীরী পণ্ডিতের মৃত্যুর কারণে তিন লাখ পণ্ডিত ভয়ে কাশ্মীর ছেড়ে পালিয়েছিলেন, আর ঘরে ফেরেন নাই।

যা বাব্বা! এতদিন সব জায়গায় বলা হয় কাশ্মীরের মানুষ নাকি ভীষণভাবেই পরমতসহিষ্ণু। তাদের উপর নাকি ভারতের সেনারা অত্যাচার চালাচ্ছে। আসলে কাশ্মীরের মানুষ নাকি স্বশাসন ছাড়া  অন্য কিছু চায় না। কাশ্মীরের হিন্দুদের তথা কাশ্মীরী পণ্ডিতদের নাকি সবাই ওখানে চায়। কিন্তু যদি মূর্তিপূজা না করা যায়, তবে শৈববাদী কাশ্মীরী পণ্ডিতরা কেমন করে ওখানে থাকবেন? ১৯৮০র  দশকের ঘটনা নাকি কিছু দুষ্ট লোকের কাজ। কিন্তু আদিলের পক্ষে কাশ্মীরে সমর্থন যে নেই তাও নয়। 

আদিল তার বাণীর  মাধ্যমে জানিয়েছে যে ভারতীয় সংসদের উপর ২০০১ এ করা হামলার জন্য সে গর্বিত। আরে কেয়া বাত। তোমরা চাও স্বশাসন, কিন্তু তোমরা কি বিশ্বাস কর জনগণের শাসনে? তাহলে এত গর্বের সাথে কখনই বলতে পারতে না যে লোকসভায় জনগণের শাসনতন্ত্রের পীঠস্থানের উপর আঘাতের জন্য তোমরা গর্বিত।

আদিল নিজে কি চায়? সে নিজে কি মনে করছে? ভারতের সামরিক বাহিনীর উপর আঘাতের মাধ্যমে কিভাবে কাশ্মীর স্বশাসনের দিকে অগ্রসর হল? আদিল তার আপন প্রেরণা জানিয়েছে। সে বেহেস্তে যেতে চায় এই আত্মঘাতী হামলায় মৃত্যুর মাধ্যমে। তার ধারণায়, আমরা যখন তাকে নিয়ে আলোচনা করছি, সে তখন বেহেস্তে উল্লাসে মত্ত হয়েছে। এমন কথা তো ক্ষুদিরাম, ভগৎ  সিং, মাষ্টারদা এঁদের কাছে শুনিনি। এনারা তো কেবল ভারতের জন্য ত্যাগ করার কথাই ভেবেছিলেন। “তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা” এর বাইরে অন্য কোনরকম আনন্দের কথা তো ভাবেননি।

তাহলে বামমার্গীদের কাশ্মীরীদের পক্ষে কথা কি নিজেদের বোকা বানানোর জন্য নাকি অন্যদের বোকা বানানোর জন্য?

ভ্রান্ত ধারণা তিন: কেবল সামরিক শক্তির জোরে ভারত জিতবে

অনেকেরই ধারণা যে কাশ্মীরের মানুষ অতি সহিষ্ণু। কেবল কিছু দুষ্ট লোক বা দুষ্ট দেশ প্ররোচনা দিয়ে জঙ্গীদের পাঠায়। কাশ্মীরে জঙ্গী অভিযানের পিছনে অর্থবল বা অস্ত্রবল পাকিস্তান থেকে আসে, তাতে সন্দেহর কোন অবকাশ আছে কি? কিন্তু শুধু অর্থবল বা অস্ত্রবল আদিলের মত লোকের জন্ম দেয় না, যারা সুখী জীবন চায় না, যারা পার্থিব  জীবনের মধুরতা কামনা করে না, যারা চায় মুশরিকদের হত্যা এবং বেহেস্তের জীবন। আদিলের প্রেরণা অর্থ নয়, মতবাদ। এই মতবাদের জন্য তার কাছে ধন, জীবন, যৌবন তুচ্ছ।

ভারত যদি মনে করে যে কেবল উরির সামরিক ছাউনিতে হামলার প্রতিশোধ হিসাবে সার্জিকাল ষ্ট্রাইক করে জিতবে, তবে সে মূর্খের স্বর্গে আছে। ভারত যদি মনে করে যে কেবল লক্ষ লক্ষ সামরিক বাহিনীর দ্বারা এই লড়াই জিতবে, তাহলে ভারত নাবালকোচিত ভুল করছে। মতবাদের সঙ্গে টক্কর দিতে গেলে লাগে অধিক যুক্তিপূর্ণ মতবাদ। কিছু ছেলে ভোলানো শ্লোগানে কাজ চলে না।

আমরা যদি বিশ্বাস করি বহুত্বে, তবে কাশ্মীরে কেন বহুত্ব আনতে পারব না? কেন আমরা কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করে ভারতের সর্বপ্রান্তের মানুষকে কাশ্মীরে থাকার অধিকার দেব না? কেন কাশ্মীরীদের অন্যায় বিদ্বেষমূলক আব্দারগুলিকে মেনে নেব? যেমন জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী কাশ্মীর থেকেই হবে। কেন কাশ্মীরের শিক্ষায় পাণিনি, অভিনব গুপ্ত প্রভৃতিদের কথা পড়ানো হবে না?

সারা পৃথিবীর বিপরীতে হেঁটে কাশ্মীরের মুসলমান শিশুজন্মের হার বিপুলভাবে বাড়ছে। কেন জিজ্ঞেস করব না, কাশ্মীরের মানুষের এই কাজের প্রেরণা কি? তা কি কোন উগ্র মতবাদে? তাহলে সেই মতবাদকে কেন প্রশ্ন করব না যাতে যুক্তিবাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রকাশিত হয় যে সে দুর্বল। উন্নত অর্থনৈতিক সুবিধা নয়, কাশ্মীরের মানুষের চাই উন্নত মতবাদ। অর্থনৈতিক বিকাশ নয় জ্ঞানের প্রকাশ।