শুধু ভাষা দিয়ে হয় না জাতি, আগে ধর্ম ঐতিহ্য সংস্কৃতি

0
2368

অর্ণব কুমার দাস


“একটি জাতি বলতে একটি গোষ্ঠী অথবা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে বোঝায় যাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে একটি বিশেষ অঞ্চলে বাস করছেন, যাঁদের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আছে এবং যাঁরা নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির উৎকর্ষতার গুণে বিশ্বের অন্যান্যদের থেকে পৃথক একটি পরিচিতি লাভ করেছেন। একটি জাতির সংস্কৃতিগত বিশিষ্টতা নির্ভর করে তার বর্ণ, অথবা ধর্ম, অথবা ভাষা অথবা এই সকল বিষয়ের একটি সমন্বয়ের উপর, কিন্তু সর্বোপরি তাদের অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি থাকতে হবে যা তাদের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করবে। তৃতীয়ত, একই সংস্কৃতির হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ বিভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু এই সকল বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানগুলি তাঁদের মধ্যে মোটের উপর একটি ঐক্যতান সৃষ্টি করে, এবং তাঁদের হৃদয়ে গর্বের অনুভূতি সৃষ্টি হয় যা তাঁদের সমগ্র বিশ্বের থেকে একটি পৃথক পরিচিতি বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে অনুপ্রাণিত করে। সবশেষে, এই সকল বিষয়ের অন্তিম ফলাফলস্বরূপ, এই গোষ্ঠীর মানুষের তাদের ঐতিহ্যবাহী বাসস্থানের ইতিহাস সম্পর্কে একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে; এর নিজস্ব নায়ক ও খলনায়ক আছে, এর নিজস্ব গৌরব ও লজ্জার দৃষ্টিভঙ্গি আছে, সাফল্য ও ব্যর্থতা আছে, জয় ও পরাজয় আছে।”

―আভাস চ্যাটার্জী, দি কনসেপ্ট অফ হিন্দু নেশন।

আচ্ছা, “আইডেন্টিটি চুরি” বোঝেন? ওয়েট, একটু খোলসা করি। কাশ্মীরে কী হয়েছিল? অত্যাচার। মুসলিম উগ্রবাদীদের ভয়ঙ্কর অত্যাচারে ঘরছাড়া হয়েছিলেন কিছু মানুষ। দীর্ঘদিনের অবিচারের পর বর্তমান সরকারের কাছে তাঁরা একটু আশার আলো দেখেছেন। কিন্তু, আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমরা এড়িয়ে যাই। কারা অত্যাচারিত হয়েছিলেন? কাশ্মীরি পণ্ডিতরা? শুধুই ‘কাশ্মীরি’ নন কেন তাঁরা? ‘পণ্ডিত’ যোগ করতে হয়েছে কেন?

এর পেছনেই লুকিয়ে আছে কৌশলী আইডেন্টিটি জেহাদ। ‘হিন্দু কাশ্মীরি’রা তখন শুধুই ‘কাশ্মীরি’ নন; তাঁরা ‘কাশ্মীরি পণ্ডিত’। অর্থাৎ কেমন যেন তাঁরা ইউনিভার্সাল সেট কাশ্মীরের নগণ্য একটি সাবসেট! আর আসল ‘কাশ্মীরি’ নাকি সেখানকার মুসলিমরাই!!

ঠিক একই উদ্যেশ্যে দীর্ঘদিন ধরে বাঙ্গালায়ও একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র চলছে। জ্ঞানত বা অজ্ঞানত আমরা অনেকেই কোনো না কোনো সময়ে এই বিশেষ প্রোপাগান্ডার হাত শক্ত করেছি।

কী সেই প্রোপাগান্ডা? নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একটি সহজ সরল বক্তব্য। “বাংলাভাষায় কথা বললেই তারা বাঙ্গালী।”। এই বক্তব্যটি শুনতে খুবই ভালো। অধিকাংশ ‘পলিটিক্যালি লেফট লিনিং’ (যেকোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের একাংশ এখনও ‘লেফট’ই।) ইয়ং জেনের কাছে এটা একটা ক্যাচি লাইন। কুলনেস দেখানোর উপায়। কোনো যুক্তিবাদী বন্ধু ‘সাহেবুল’ ও ‘রাজীব’-এর মধ্যে পার্থক্য করলে তার মতকে এই তথাকথিত ‘বাঙ্গালী সেন্টিমেন্ট’ দিয়ে চেপে দেওয়ার সুবিধা হয় তখন!

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই “বাংলাভাষী মাত্রেই বাঙ্গালী” স্টেটমেন্টের প্রচুর ফল্ট।

এই বিষয়ে প্রথমেই ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।

“বাঙ্গালা দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি আলােচনা করিতে গেলে, তিনটি কথা আমাদের ভুলিলে চলিবে না। সে তিনটি কথা এই―

[১] বাঙ্গালা-দেশ ভারতেরই অংশ।
[২] বাঙ্গালী জাতি ভারতীয় জাতি-মণ্ডলীরই অন্তভুক্ত, ভারত বহিভূত স্বতন্ত্র সত্তা তাহার নাই।
[৩] বাঙ্গালার সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতিরই অংশ—ভারত বিরােধী পৃথক বাঙ্গালী সংস্কৃতি নাই।

এইরূপে ভারতের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন যােগ-সুত্রে সংযুক্ত হইলেও, বাঙ্গালা-দেশের সংস্কৃতিতে দুই-একটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য বা স্বাতন্ত্র্য আসিয়া গিয়াছে। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য বা স্বাতন্ত্র্যকে আশ্রয় করিয়া, সংস্কৃতি-বিষয়ে, “বাঙ্গালা-বনাম-ভারত” এইরূপ প্রশ্ন উঠিতেই পারে না।”

এবার একটি বৃহৎ বাংলাভাষী দেশের জনগণ, যা সর্বতোভাবে স্বেচ্ছায় ভারত বিরোধী ও ভারতীয় সংস্কৃতি বিদ্বেষী, তারা ঠিক কীভাবে বাঙ্গালী হয়?

যাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরের নাম ভারতীয় উপমহাদেশে তরবারীর জোরে ধর্ম পরিবর্তন করতে আসা শাহ জালালের নামে, তারা ঠিক কোন যুক্তিতে বাঙ্গালী হয়?

বুঝতে হবে, ভারত ছাড়া (ভারতীয় সংস্কৃতি ছাড়া) বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্ব নেই। কারণ শুধু ভাষা দিয়েই জাতির গঠন হয় না।

আমাদের বঙ্গ সংস্কৃতির গুরুদেব, যিনি বাংলাভাষী দেশটির বৃহৎ একটি অংশের কাছে অপ্রিয়, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
“ভাষার ঐক্যে ন্যাশনাল ঐক্যবন্ধনের সহায়তা করে, সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহাতে এক করিবেই, এমন কোনো জবরদস্তি নাই। য়ুনাইটেড স্টেটস ও ইংলণ্ডের ভাষা এক, স্পেন ও ম্পানীয় আমেরিকার ভাষা এক, কিন্তু তাহারা এক নেশন নহে।…
তাহা ছাড়া, ভাষায় জাতির পরিচয় পাওয়া যায়, এ-কথাও ঠিক নয়। প্রুসিয়া আজ জর্মান বলে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে স্লাভোনিক বলিত, ওয়েল্‌স্‌ ইংরেজি ব্যবহার করে, ইজিপ্ট আরবি ভাষায় কথা কহিয়া থাকে।”

তাহলে নিছকই দায়ে পড়ে বাংলাভাষী এক অংশের মানুষকে কেন বাঙ্গালী জাতির অংশ করা হচ্ছে? সরকারি চাকুরির জন্য হওয়া ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে কেন বাঙ্গালী জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে?

এর উত্তরগুলো পরিস্কার। অপ্রিয় সত্য শুনতে ভালো না লাগলেও এটাই ফ্যাক্ট যে আপনার আইডেন্টিটি কাশ্মীরিদের মতোই চুরি হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সুচারুভাবে ভূমিপুত্রদের থেকে কাশ্মীরি আইডেন্টিটি চুরি করার পর জেহাদীদের নজরে এবার বাঙ্গালী হিন্দু হোমল্যান্ড। একবার তো ভূমি ছাড়তে হয়েছে। এবার ভূমি ছাড়তে হলে ‘কাশ্মীরি পন্ডিত’দের মতো হয়তো আমাদেরও হতে হবে ‘বাঙ্গালী বামুন’ বা ‘বাঙ্গালী মতুয়া’!

এই লড়াইকে শুধুই তত্ত্বের যুদ্ধ ভাবলে ভুল করবেন। এই লড়াই আমাদের ভূমি রক্ষার লড়াই। এই যুদ্ধ আমাদের আইডেন্টিটি রক্ষার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হেরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই আমাদের।

তাই কারোর কোনো তির্যক মন্তব্য উপেক্ষা করেই, তথ্যের আশ্রয় নিয়ে, দৃঢ়ভাবে আমাদের বলে যেতেই হবে,
“শুধু ভাষা দিয়ে হয় না জাতি,
আগে ধর্ম ঐতিহ্য সংস্কৃতি।”

তথ্যসূত্র:
The Concept of Hindu Nation, Abhas Chatterjee
রবীন্দ্র রচনাবলী
জাতি সংস্কৃতি ও সাহিত্য, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়

বিশেষ কৃতজ্ঞতা:
পশ্চিমবঙ্গের জন্য
আমাগো একখান দ্যাশ আসিলো