সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে তিতুমীর সরলেও ভোটব্যাঙ্কের মূল্য দিতে হল রবীন্দ্রনাথকে

0
1107

বঙ্গদেশ ডেস্ক: পশ্চিমবঙ্গে নবনির্মিত মেট্রো লাইনে একটি স্টেশনের নামকরণ করা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলে এসেছে৷ “পশ্চিমবঙ্গের জন্য” সংগঠনটির উদ্যোগে দীর্ঘদিন ধরে মেট্রো স্টেশনের নাম “তিতুমীর ” নামকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিল রাজ্যের সাধারণ মানুষ। এবার অবশেষে রাজ্য সরকার এই বিষয়ে মাথা নোয়াতে বাধ্য হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে মেট্রো স্টেশনটির প্রস্তাবিত নাম তিতুমীর এর বদলে সিটি সেন্টার নামকরণ করা হবে। এই আন্দোলনে সফলতা অর্জন শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য নয়, সারা ভারতবাসীর জন্য গর্বের৷ কারণ ভারতের বুকে একজন জিহাদীর নামে সরকারি স্থাপনার নামকরণ করা রোধ করা গিয়েছে।

তিতুমীরের নামে স্টেশনের নামকরণের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হলেও বিতর্ক এখানেই শেষ হয়নি। অন্যদিকে প্রস্তাবিত রবীন্দ্র তীর্থ স্টেশনের নামও পরিবর্তন করায় আবারও তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্কের। পূর্বে প্রস্তাবিত রবীন্দ্র তীর্থ নাম পরিবর্তন করে স্টেশনটির নাম চিনার পার্ক নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর স্বাভাবিকভাবেই এই সিদ্ধান্তে বেজায় চটেছে বাঙ্গালী সমাজ। অনেক নেটিজেন এমনও মন্তব্য করেছেন যে জিহাদী তিতুমীরের নামে মেট্রো স্টেশনের নামকরণ না করায় মুসলিম সমাজকে তুষ্ট রাখার জন্যেই প্রস্তাবিত রবীন্দ্র তীর্থ নামটিও পরিবর্তন করেছে রাজ্য সরকার।

উল্লেখ্য, তিতুমীরকে যেভাবে দেশপ্রেমিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয় বাস্তবে ততোটা নন। সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে শায়খ আহম্মদ শিরহিন্দি নামের এক ইসলামি কট্টরপন্থী মুসলিমের উত্থান হয় যিনি নিজেকে ‘মুজাদ্দিদে আলফে সানি’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। ভারতে ইসলাম আসার পর তা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মিশে গিয়ে তার আসল আদি রূপ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় এবং ইসলামিক সংস্কৃতির সাথে অনেক হিন্দুয়ানি সংস্কৃতিও মিশে যায়। শায়খ আহম্মদ শিরহিন্দি আরব থেকে আগত আসল ইসলামিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করতেন আর তাই তিনি ভারতের ইসলামকে ইসলাম বলে মানতেন না।

শিরহিন্দির মৃত্যুর পর মোঘল আমলের শেষ দিকে, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির উত্থান হয় যিনি হিন্দুদের দমন করে ভারতকে ‘দারুল ইসলাম’ বানাতে চাইতেন। তার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর পর সায়িদ আহমদ এর উত্থান হয় যিনি জিহাদের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিশ্বজুড়ে আল্লার রাজত্ব তৈরি করায় বিশ্বাসী ছিলেন। সায়িদ আহমদ ‘তরিকায়ে মুহম্মদিয়া’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করে যা ‘ভারতীয় ওয়াহাবি আন্দোলন’ নামে পরিচিত। ‘দারুল ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় বালাকোটের যুদ্ধে তার মৃত্যু হয়। সায়িদ আহমদ যখন কলকাতায় এসেছিলেন তখন অনেক বাংলাভাষী মুসলমান তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মীর নিসার আলী, যাকে আমরা তিতুমীর বলেই চিনি। বারাসাতের মীর নিসার আলি ওরফে তিতুমীর। পেশাদার কুস্তিগীর ছিল তিতুমীর। যৌবনে নদীয়ায় এক হিন্দু জমিদারের অধীনে লাঠিয়ালদের সর্দারি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয় এবং বিচারে কারাদণ্ড ভোগ করে। কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষে যশোহর জেল থেকে বেরিয়ে সে ‘তরিকায়ে মুহম্মদিয়া’-য় যোগ দেয়।

ঊনিশ শতকের শুরু, প্রান্তিক মুসলমানদের মধ্যে জেহাদি তত্ত্বের প্রচলন তখনও হয়নি। তাদের নাম, বেশভূষা, জীবনাচরণে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব ছিল স্পষ্ট। তিতুমীরের উত্থানের তিনি ওয়াহাবিদের নিয়ে একটি দল তৈরী করে এবং স্থানীয় মুসলমানদের আরবী নাম পরিবর্তন করতে, আরবীয়দের ন্যায় জোব্বা পরিধান করতে ও দাড়ি রাখতে বাধ্য করা শুরু করে। ধুতি ত্যাগ করে ‘তাহ্‌বান্দ’ নামে এক ধরনের বস্ত্র পরিধান করার নির্দেশ জারি করে। স্থানীয় মুসলমাদের দরগার অনুসরণ করতে বাধা দেওয়া শুরু করেছিল তিতুমীরের জিহাদী অনুসারীরা। তারাগুনিয়া গ্রামে মহরম অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাধা দেয় এবং দরগায় লাথি মারে। ফলে স্থানীয় মুসলমানরা নালিশ করে জমিদারের কাছে এবং জমিদারের সাথে তিতুমীরের বিবাদ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। মামলা হলো তিতুমীর ও তার জিহাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে। মূলত তিতুমীরের শত্রু ছিল পুঁড়োর জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, গোবরডাঙার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তারাগোনিয়ার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গৌরীপ্রসাদ চৌধুরী এবং গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়। এই মামলার পর তার শত্রুর তালিকায় ইংরেজরাও চলে আসে। এরপরই তিতুমীর শরিয়ত রক্ষায় ইংরেজ ও হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে এবং তাদেরকে উচ্ছেদ করারঘোষণা করে।

তিতুমীর এই জিহাদে নামার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান করেছিলেন এবং তাদেরকে জিহাদে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান। তিনি কোনভাবেই ভারতের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেননি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা নিয়ে বাস্তবে তিতুমীরের কোন মাথাব্যথা ছিল না। তাদের জিহাদী কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ায় হিন্দু জমিদাররা তার চোখে ইসলামের শত্রু হিসেবে পরিণত হয়৷ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় ইংরেজ সরকারও তার শত্রুতে পরিণত হয়, ইংরেজদের হাতে ভারতবর্ষ পরাধীন সেই কারণে নয়। আর তাই তিতুমীরের নামে মেট্রো স্টেশনের নামকরণের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল বঙ্গের মানুষ। ফলশ্রুতিতে রাজ্য সরকার তিতুমীরের নামে মেট্রো স্টেশনের নামকরণের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ভোট বড় বালাই। আর অন্যদিকে ভারতের মুসলিম সমাজের একটি অংশের কাছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাত্য ও বর্জনীয়। কারণ কবিগুরু তাঁর সময়ে হিন্দু-মুসলিম অলীক ঐক্যের বিষয়ে সরাসরি কিছু মন্তব্য করেছিলেন।

” হিন্দুতে মুসলমানে কেবল যে এই ধর্মগত ভেদ তা নয়, তাদের উভয়ের মধ্যে একটা সামাজিক শক্তির অসক্ষমতা ঘটেছে৷ মুসলমান ধর্ম সমাজের চিরাগত নিয়মের জোরেই তার আপনার মধ্যে একটা নিবিড় ঐক্য জমে উঠেছে, আর হিন্দুর ধর্মসমাজের সনাতন অনুশাসনের প্রভাবেই তআর মধ্যে একটা প্রবল অনীক্য ব্যপ্ত হয়ে পড়েছে। এর ফল এই যে, কোন বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্র‍য়োজন থাকলেও অন্যকে হিন্দু মারতে পারে না। আর মুসলমান কোন বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন ঘটলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে। ” – (কালান্তর – পৃষ্ঠা ২৩৮)

কবিগুরুর এহেন সোজাসাপ্টা মন্তব্য ভারতের মুসলমান সমাজের একটি বড় অংশের পছন্দ নয়। আর তাই তিতুমীরের নামে মেট্রো স্টেশনের নামকরণের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেও ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতির মূল্য দিতে হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তুষ্টিকরণের রাজনীতির জন্য তিতুমীরের ন্যায় জিহাদীর নাম বাদ দিলেও একই সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র তুষ্টিকরণের রাজনীতির জন্য। বঙ্গের ভূমিপুত্র ও দেশপ্রেমিকের নামে সামান্য একটি মেট্রো স্টেশনের নামকরণ করতে না পারাটা বাঙ্গালী হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। এই বিষয়ে এখনই যদি জনমত তৈরি করা না হয়, তাহলে আগামীতে বঙ্গের ভূমিপুত্র ও দেশপ্রেমিকদের নাম আমাদের আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে না এবং বাঙ্গালী হিসেবে তা আমাদের বিফলতা ব্যতীত কিছুই নয়।