প্রণমি তোমারে

0
912

২০১৬ সালের দুর্গাপূজা। মা দুর্গার বাপের বাড়ি আসার সাথে সাথে সবার বাড়ি ফেরার পালা। পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে ছেলে মেয়েরা এই উৎসব উদযাপন করতে, আনন্দে মেতে উঠতে আপনজনের কাছে ফিরে আসে এই সময়। আমিও এসেছিলাম কলকাতায় আমার মায়ের কাছে ব্যাঙ্গালোর থেকে। আর ফিরেছিল একটি ছেলে – আমাদের সোনার বাংলার আদরের ছেলে তার মায়ের কোলে, শেষ বারের মত।

২০১৬ সালে পঞ্চমীর দিন আমি আমার দুর্গাপুজা শুরু করেছিলাম সেই বীর মাতাকে প্রণাম জানিয়ে। পথ চেনা নেই। শুধু জানি হাওড়া জেলার যমুনাবালিয়ার নিজবালিয়া গ্রামে তিনি থাকেন। সেখানেই আজ থেকে ঠিক দুবছর আগে ১৯শে সেপ্টেম্বর জাতীয় পতাকায় ঢেকে তার বীর পুত্র সিপাই গঙ্গাধর দলুই, আমাদের স্নেহের গঙ্গাধর তার মায়ের কোলে শেষবারের মত ফিরেছিল। রাস্তা জানিনা। তাই রাস্তার মানুষকে গঙ্গাধরের নাম জিজ্ঞাসা করতেই প্রত্যেকের সসম্মানে দেখিয়ে দিয়েছিলেন পথ। কদিন আগেই যে সেই পথ দিয়ে সকলের স্নেহের গঙ্গা বাড়ি ফিরেছে। সেই পথে তার প্রতি ছড়ানো ফুল তখনো শুকায়নি। বন্দেমাতরম আর জয়হিন্দ ধ্বনি কানে নিয়েই সেই পথে মানুষ পূজার প্যান্ডেল গড়ে তুলেছে – সেই সব মানুষ যাদের রক্ষা করতে দেশমাতৃকার জন্য গঙ্গাধর এত কম বয়সে তার প্রাণাহুতি দিয়েছে। 

অবশেষে পৌছালাম সেই ভগ্নপ্রায় কুটিরে। আজ যে তা আমাদের মন্দির। দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি গঙ্গাধরের মা, আজ আমার অতি আদরের মাসিমা মাটিতে বসে।প্রথম দেখা, আমি তাকে চিনিনা, আগে কখনো দেখিনি, কথা বলিনি, তিনিও আমাকে চেনেন না। আমি গিয়ে শুধু বলেছিলাম, “আপনি কি সিপাই গঙ্গাধর দলের মা?” উনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। প্রায় 10 মিনিট বিনা বাক্যব্যায়ে তিনি শুধু অঝোরে কেঁদে গেলেন। ভগ্নপ্রায় চেহারায় তার কান্নার ধকল টুকু সহ্য করার ক্ষমতাও নেই শরীরে। এক ধাক্কায় শরীর, মন ও জীবন সবকিছু চুরমার হয়ে গেছে।

১৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৬। উরি আর্মি ক্যাম্প। রাত হয়েছে অনেক। বেশিরভাগ সবাই ঘুমে মগ্ন। গঙ্গাধর তখন তাঁবুতে ঢুকে সবে চা বসিয়েছে। হঠাৎ সে শুনতে পায় গুলির আওয়াজ। দৌড়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে দেখে অন্ধকারকে আড়াল করে ৪ আতঙ্কবাদী ঢুকে পড়েছে তাদের ক্যাম্পে, এবং সেই কাপুরুষ আতঙ্কবাদীরা নিরস্ত্র ঘুমন্ত সেনাদের এক এক করে হত্যা করছে। গঙ্গাধর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তার দু’বছরের চাকরিতে যা শিখেছে, সমস্ত কাজে লাগিয়ে, তার সমস্ত শক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন সহযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য। একা হাতে একটি বন্দুকের সাহায্যে অনেক্ষণ আটকে রাখে আতঙ্কবাদীদের। কিন্তু অবশেষে শহীদ হন সেদিন আমাদের অত্যন্ত সাহসী গঙ্গাধর দলুই। সেদিন গঙ্গাধরের সাথেই শহীদ হন তার বন্ধু ও আমাদের পশ্চিমবঙ্গের আর এক বীর পুত্র সিপাই বিশ্বজিৎ ঘড়াই। সেই রাতে ১৭ জন সেনা শহীদ হন ও আরো অনেকে গুরুতর আহত হন।

ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য গঙ্গাধর রোজ তার নিজের গ্রামে দৌড়াত। তাই নিয়ে গ্রামবাসীদের কত হাসি ঠাট্টা। গঙ্গাধরের মা গঙ্গাধরকে শেখাতেন সেসব কটাক্ষকে উপেক্ষা করতে। ছোটবেলা থেকে মা’ই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন ছেলেকে সেনাতে যোগ দেওয়ার জন্য। যোগ দেওয়ার পর ছুটিতে যখন গঙ্গাধর বাড়ি ফিরত মা-মামীদের দক্ষিণেশ্বরে নিয়ে যেত। ছোট ভাইদের সাথে খেলা করতো। আর্মিতে  যোগ  দেওয়ার  পরে আমিষ হঠাত ছেড়ে দেয় গঙ্গা।  সবাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে গঙ্গা বলতো “সেনাতে ভর্তি হওয়ার সময় যে প্রতিজ্ঞা নিতে হয় আমাদের, তাতে আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হয় সকলের প্রাণ রক্ষা করার জন্য। শুধু মানুষ না, পশু পাখী সকলের প্রাণ রক্ষা করা আমার ধর্ম। তাই আমি আমিষ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।” 

অনেক স্বপ্ন ছিল গঙ্গাধরের। আস্তে আস্তে বাড়িটা মেরামত করা, মাকে ভালো শাড়ি কিনে দেওয়া, আরো কত কি। কিন্তু সে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা, স্বপ্নগুলোর থেকেও দেশের সুরক্ষাকে বরাবর গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। তাই নিজের স্বপ্নগুলোকে অপূর্ণ রেখেই আমাদের ও দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে গঙ্গাধর দলুই। আমরা চির কৃতজ্ঞ তার কাছে। তাই আজ আমাদের কর্তব্য গঙ্গার অপূর্ণ স্বপ্ন সফল করার। গঙ্গাধর ও বিশ্বজিতের মা বাবার পাশের দাঁড়ানো আজ প্রতিটি কৃতজ্ঞ ভারতবাসীর কর্তব্য।

দু-তিন দিন আগেই কথা হচ্ছিল মাসীমার সাথে। ফোনে জানতে চাইছিলাম কেমন করে এমন এক বীরের মা হওয়া যায়। খুব সহজ কিন্তু অত্যন্ত জরুরী কিছু পরামর্শ দিলেন তিনি সেদিন আমায়। প্রথমত পড়াশোনার সাথে সাথে খেলাধুলাও মন দিয়ে ভালো করে করতে দিতে হবে ছেলে মেয়েদের কে। তবেই গায়ে শক্তি হবে। দ্বিতীয়ত তিনি এক অদ্ভুত কথা বললেন যা শুধু এক  বীরের মা বলতে পারেন। তিনি বললেন যতদিন না আমরা শুধু নিজের সন্তানের কথা ছেড়ে দেশের প্রতিটি সন্তানের কথা ভাবা শুরু করব, ততদিন এদেশে উন্নতি সম্ভব না। প্রতিটি মা যদি সাহসের সাথে তাদের নিজেদের সন্তানকে দেশমাতৃকার জন্য উৎসর্গ করতে পারেন, তাহলে ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। আজ সেই বীর মায়ের সন্তান হারানোর দিনে তাকে শতকোটি  প্রণাম।