সৌদি সংবাদ মাধ্যমের প্রবন্ধসমূহে কুরআনের হাজার হাজার লিখিত ত্রুটি সংশোধন ও ইসলামী পাঠ্যকে আধুনিকতার আলোতে পুনর্বিবেচনা করার আবেদন

0
1360

এ বছর সৌদি ওয়েবসাইটে দুটি বিরল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় কুরআনের লিখিত কিছু ত্রুটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে এবং কুরআনের ধর্মীয় পাঠ্যাংশকে বর্তমান সময়ে আরও বেশি পাঠ্যযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য আধুনিকভাবে পুনর্বিবেচনার উদ্দেশ্যে। এই প্রবন্ধগুলি ব্যতিক্রমী যেহেতু মুসলিম সম্প্রদায় কোরানের পাঠ্যকে ঐশ্বরিক বলে মনে করেন এবং তাই তাদের কাছে কুরআন ত্রুটিশূণ্য। ফলস্বরূপ, কুরআনের স্পষ্টভাবে চোখে পড়া লিখিত ত্রুটিগুলি কোনোদিন সংশোধিত হয়নি।

 

২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি, এক সৌদি সাংবাদিক আহমেদ হাশেম ‘সৌদি ওপিনিয়ন’ ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে যা কুরআন নামে পরিচিত, সেটি লেখা হয় তৃতীয় খলিফা উসমান ইবন আফ্ফানের (৬৪৪-৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্বকাল) সময়কালে, তাঁর নামাঙ্কিত ‘উসমানি লিপি’ ব্যবহার করে। হাশেমের মতে, এই লেখার পদ্ধতি যেহেতু মনুষ্যসৃষ্ট, তাই এটিকে পবিত্র জ্ঞান করে চলার কোনো প্রয়োজন নেই। যদিও বেশিরভাগ মুসলিমই তাই করেন। তাঁর মতে ঐ সময়ে লেখকরা কুরআন লেখার সময় যে প্রায় ২৫০০ বানান এবং ব্যাকরণ ভুল করেছিলেন, তা এখন সংশোধন করতে হবে। এই ভুলত্রুটি এখনো পর্যন্ত কুরআনের অংশ। তিনি অসংখ্য বানান ভুলের উদাহরণ তুলে ধরেছেন এবং সেই শব্দগুলিকে বর্তমান সময়ের উপযুক্ত আকারে আবার লিখতে বলেছেন, যাতে এই পাঠ্য আজকের দিনের মুসলিমদের কাছে আরও পাঠ্যযোগ্য এবং ভাষাগতভাবে আরও নির্ভুল হয়ে ওঠে।

 

কুর্দি-ইরাকি বংশোদ্ভূত লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইরাকি পত্রিকায় বাগদাদের সম্পাদক জারজিস গুলিজাদা ২০২০ সালের ২০শে জুলাই দ্বিতীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত করেন অসাম্প্রদায়িক সৌদি আরব ওয়েবসাইট ইলাফে। তিনি উল্লেখ করেন যে, করোনাভাইরাস অতিমারী পর্বে, ইসলামী ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিয়মকানুনে কিছু বদল আনা হয়। কুরআনের নির্দেশ অনুসারে, ঘেঁষাঘেঁষি করে প্রার্থনার নিয়ম বদল করে, প্রার্থনার সময় মুসলিমদের পারস্পরিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এই নিয়ম পরিবর্তন প্রমাণ করে যে, ইসলামে নমনীয়তার সুযোগ রয়েছে। এই নমনীয়তা ইসলামী পাঠ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে সেটিকে পুনর্বিবেচনা করে আজকের দিনের উপযুক্ত করে তুলতে হবে এবং তাতে মুসলিম সম্প্রদায় ও বৃহৎ অর্থে সমগ্র মানবজাতি উপকৃত হবে।

 

আহমেদ হাশেমের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলা যায়, তিনি যুক্তি তর্ক করে বলেছেন যে, কুরআনের উসমানিক লিপিকে পবিত্র বলে জ্ঞান করাও অযৌক্তিক এবং হাশেমের উল্লিখিত উদাহরণের পাশাপাশি তিনি তার সাপেক্ষে  কুরআনের নানা ভুলত্রুটির উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তিনি আধুনিক বানান ব্যবহার করে কুরআনের সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশের প্রস্তাব দেন কারণ কুরআনের বর্তমান রূপ আধুনিক ইসলামী জাতি বিশেষত আরবি মুসলিম ব্যতীত মুসলিমদের জন্য উপযুক্ত নয়। এই সংশোধনের কাজের যাবতীয় দায়িত্ব নিতে হবে সৌদি আরবকে, বিশেষত সৌদি আরবের রাজা ও ক্রাউন প্রিন্সকে।

 

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ইলাফ ওয়েবসাইট থেকে গুলিজাদার প্রবন্ধ সরিয়ে ফেলা হয় কারণ সামাজিক মাধ্যমে সৌদি বিশেষত ইলাফের মুখ্য সম্পাদক উসমান আল উমিরের ঔদ্ধত্য কুরআনকে অপমানের জন্য মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কুয়েতি পণ্ডিত ড.আহমেদ আল দাহিদি ট্যুইট করে বলেন, ‘ সৌদি সাংবাদিক উসমান আল উমির পরিচালিত ইলাফ ওয়েবসাইটে উসমানি লিপির লক্ষ্যণীয় ভুলত্রুটি সংশোধন করে কুরআনকে নতুন করে লেখার কথা বলা হচ্ছে! আল্লার বইও তাদের এই অবমাননার হাত থেকে রক্ষা পেল না?’ ‘টুওয়ার্ডস ফ্রিডম’ নামক ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট যা সৌদি শাসনব্যবস্থার সমালোচক, মন্তব্য করে, ‘ইলাফ (অনলাইন) পত্রিকা যার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন, রাজা সলমনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বিন সলমনের (ক্রাউন প্রিন্স মহম্মদ) পরামর্শদাতা (উসমান আল উমির), তাতে কুরআনকে নতুন করে লেখার এবং ইসলামী শরিয়তের নীতিকে পুর্নবিবেচনা দাবি তোলা হয়েছে! শুধু মূর্তিগুলি কাবায় ফেরত পাঠানোই  অবশিষ্ট রয়েছে।’

 

আহমেদ হাশেম ও জারজিস গুলিজাদার প্রবন্ধদ্বয়ের অনুবাদ করা অংশ নিম্নরূপ:

 

সৌদি সাংবাদিক: কুরআনপাঠ্যে প্রায় ২৫০০টি বানান ও ব্যাকরণ ভুল বর্তমান

২০২০ সালের ১০ই জানুয়ারি ‘কুরআনের সংশোধন’ প্রবন্ধে আহমেদ হাশেম লেখেন, ‘কুরআন তৃতীয় খলিফা উসমান ইবন আফ্ফানের সময়কালে তাঁর নামাঙ্কিত উসমানি লিপিতে রচিত হয়। বেশিরভাগ মুসলিমই বিশ্বাস করেন যে, কুরআনের এই সংস্করণ হিজরার ৩৭ বছর পর লেখা হয়, কুরআনের সংকলন সম্পূর্ণ হওয়ার পর সেটি যেখানে আজ অবধি প্রজন্মের পর প্রজন্মে হস্তান্তর করা হয়, তাই তা পবিত্র ও তাকে কোনভাবেই সংশোধন করা চলে না।

 

যাইহোক, বর্তমানের কুরআনে অসংখ্য বানান, ব্যাকরণ ও বাক্যগঠনে অসংখ্য ভুল রয়েছে। এটি অনুমান করা হয়েছে যে এই ভুলের সংখ্যা প্রায় ২৫০০। কুরআন সংকলনের কাজে নিযুক্ত সমিতির দ্বারা কিছু ভুলত্রুটি হয়েছে। কিছু শব্দ সংযোজন বা বিয়োজন অথবা একটি শব্দের পরিবর্তে অন্য শব্দ ব্যবহার এই ভুলত্রুটির সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, ৬৮তম সুরাহের ষষ্ঠ শ্লোকে, بأيكم শব্দের পরিবর্তে بِأَيِّيكُمُ [“তোমাদের মধ্যে”] শব্দের ব্যবহার হয়েছে। অন্যভাবে, বলা চলে একটা অতিরিক্ত ي যোগ করা হয়। ২৫তম সুরাহের চতুর্থ শ্লোকে, جَاءُوا বা جاؤوا এর পরিবর্তে جَآءُو [“তারা সম্পন্ন করেছে”] শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়,

বহুবচন পুংলিঙ্গ প্রত্যয় وا এ আলিফ অনুপস্থিত। ২৮তম সুরাহের নবম শ্লোকে, امرأة শব্দের পরিবর্তে امرأت [“স্ত্রী”] শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ৫৪টি দৃষ্টান্তে দেখা যায়, إبراهيم [ইব্রাহিম] নামটি إبراهم হিসেবে লেখা হয়েছে যাতে ي অক্ষরটি বাদ পড়েছে। سماوات[ “আকাশ”] শব্দটি এইভাবে কেবল একবার লেখা হয়েছে, যেখানে ১৮৯টি  দৃষ্টান্তে শব্দটি ভুলবশত লেখা হয়েছে سموت, যেখানে ا…অক্ষরটি বাদ গেছে। قرآن [“কোরান”] শব্দটি ا…অক্ষর বাদ দিয়ে ৬৮ বার লেখা হয়েছে। سنة [“বছর”] শব্দটি আটবার শেষে ة অক্ষর  দিয়ে লেখা হয়েছে এবং পাঁচবার ت অক্ষর দিয়ে লেখা হয়েছে।

 

যে উসমানি লিপিতে কুরআন রচিত হয়েছে, সেই লিপি তৎকালীন খলিফার সহকারী ও সেই প্রজন্মের কিছু সদস্য মিলে তৈরি করেন। ঐ সময়ে নিজেদের সামর্থ্য মত প্রচেষ্টা করার জন্য তারা যথার্থ সম্মান পাওয়ার যোগ্য। যাইহোক, তারা যা কিছু আমাদের দিয়ে গেছে তার বিকাশ ঘটানো ও সংশোধন করা যেতে পারে, যদি আমাদের কাছে আরও ভালো ও সুবিধাজনক বিকল্প থাকে যেমন কুরআন রচনার পরে কোনো অক্ষরের ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনি নির্দেশক চিহ্ন ও নানা যতিচিহ্ন যোগ করা হয়। এখন সময় এসেছে যখন এই বানান ভুল বা অন্যান্য ভুলগুলো সংশোধন করা উচিত। আরবি ভাষা ও ব্যাকরণের রীতিনীতি মেনে কুরআনকে সংশোধন করলে আল্লার বই মুসলিমদের কাছে আরও বোধগম্য ও ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে আরও সঠিক হয়ে উঠবে।

 

কুর্দি-ইরাকি গবেষক: কুরআন সংশোধনের প্রয়োজন; ইসলামী পাঠ্যে পুর্নবিবেচনা কাম্য, আধুনিক যুগে অভিযোজনের প্রয়োজন

কুর্দি-ইরাকি বংশোদ্ভূত লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জারজিস গুলিজাদা ২০২০ সালের ২০শে জুলাই ‘কুরআন পুর্নলিখনের আবেদন’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘করোনাভাইরাস অতিমারী পর্বে ইসলামের ধর্মীয় ভাবনায় এক অন্যতম পরিবর্তন আনা হয়। ইসলামী শরিয়ত অনুসারে ঘেঁষাঘেঁষি করে প্রার্থনার প্রচলনের পরিবর্তে প্রার্থনার সময় মুসলিমদের পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখতে অনুমতি দেওয়া হয়। যদিও এটি ইসলামী পাঠ্যের নিয়মনীতি বিরুদ্ধ। উপরন্তু, জমায়েত হয়ে প্রার্থনা, মসজিদে শুক্রবার ও ছুটির দিনগুলিতে প্রার্থনা করাকে নিষিদ্ধ করা হয় উপাসকদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে, যাতে জমায়েতের সময় উপাসকদের মধ্যে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে। এটি ধর্মীয় রীতিনীতি বিরুদ্ধ হলেও গভীর পর্যালোচনার পর মানুষের জীবনের কথা ভেবে এগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

 

“গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, এই ধর্মে নমনীয়তার সুযোগ রয়েছে এবং তাই বর্তমানের ইসলামী সমাজে এক সহনশীল ধর্মীয় শাসন জারি ও কায়েম করা হয়। ধর্মনিষ্ঠ খলিফার (ধর্মপ্রবক্তার পরের চারজন খলিফা) শাসনকালের পর ইসলামী ইতিহাসে এই প্রথম প্রার্থনার নিয়মনীতি শিথিল করা হয় কেবল মানুষ প্রাণ রক্ষার্থে। কোরানের গোল্ডেন রুল – ‘আল্লাহ্ কোনো আত্মাকে তার সামর্থ্যের অধিক ভার অর্পণ করেন না'[কুরআন২:২৮৬] এর ওপর ভিত্তি করে এই শাসন জারি করা হয়। সমস্ত পরিবর্তনের যুক্তিসম্মত ও বিবেচনাপূর্ণ ভিত্তি গড়তে এটি সাহায্য করে। যদিও এই পরিবর্তনগুলি খুবই বিরল এবং এগুলি এখনই প্রবর্তিত হয়েছে, তবুও এগুলি ইসলামী পাঠ্যের ও রীতিনীতির ক্ষেত্রে পুনর্বিবেচনার যে সুযোগ রয়েছে তার দিকে ইঙ্গিত করে। এটি আধুনিক ধারণা ও উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হচ্ছে যাতে মুসলিম সম্প্রদায় তথা সমস্ত মনুষ্য সম্প্রদায় এবং সকল ধর্মের মূল লক্ষ্য মনুষ্যত্ব উপকৃত হয়।

 

এই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বিশ্বব্যাপী, আঞ্চলিক, স্থানীয় স্তরে ধর্ম ও বিশ্বাসের ক্ষেত্র এবং বিশেষত ইসলামী রীতিনীতিতে এইরূপ পরিবর্তন আনে। আমি এই নমনীয়তার সূত্র ধরে সমস্ত ইসলামীয় কর্তৃপক্ষকে ইসলামী আইনত মতবাদকে পুর্নবিবেচনা করার আবেদন জানাচ্ছি যা আধুনিক ধ্যান ধারণার ওপর ভিত্তি করে মুসলিম সম্প্রদায় তথা মনুষ্য সম্প্রদায়কে উপকৃত করবে।

 

আমি তাদের অনুরোধ করব সর্বপ্রথম কুরআনের উসমানি লিপিটি পুনর্বিবেচনা করার জন্য কারণ এই লিপি বর্তমান মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষত আরবিমুসলিম ব্যতীত বাকি মুসলিমদের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। ভুল বানানের শব্দগুলি উচ্চারণ করতে যথেষ্ট অসুবিধা দেখা দেয়। যদিও সুন্নিরা এই উসমানি লিপিকে পবিত্র বলে জ্ঞান করে, কিন্তু তার সাপক্ষে তাদের প্রমাণগুলি অযৌক্তিক। একটি মনুষ্যসৃষ্ট লিপিকে পবিত্র বলে মেনে নেওয়াতে কোনো যুক্তি নেই। উপরন্তু,  এই কুরআনের শ্লোক রচনা বা সংকলনের কাজ ধর্মপ্রবক্তার সময়কালে হয়নি, বরং তাঁর মৃত্যুর বহুবছর পরে প্রথম খলিফা আবু বকরের শাসনকালে [৬৩২-৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ] হয়। কুরআনের অনুশাসনগুলি রচিত হয় তৃতীয় খলিফা উসমান ইবন আফ্ফানের শাসনকালে [৬৪৪-৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ] এবং পরে তা নানা ইসলামীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। উসমানি লিপিতে শ্লোকের শব্দে নানা অসংগতি, ভুল উচ্চারণ ও ভুল বানান চোখে পড়ে, তবু আজ অবধি তার কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। সেই সময় থেকে ১৪০০ বছর ধরে আরবি ভাষায় লেখা, পড়া, উচ্চারণে নানান উন্নতি হলেও কুরআনের ভুলগুলি সংশোধন করা হয়নি।

 

আহমেদ হাশেমের প্রবন্ধ ‘কুরআনের সংশোধন’ এ উসমানি লিপির ভুলত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন যে, ধর্মপ্রবর্তকের অনুগামীরা কুরআনের শ্লোক লেখার সময় নানা ভুল করেছিলেন। পরের উদাহরণগুলি দেখলে বোঝা যাবে, উসমানি লিপি ও বর্তমানের সাধারণ লিপির মধ্যে ফারাক কতটা এবং কীভাবে উসমানি লিপিতে অক্ষরের বিয়োজন ঘটেছে। الكتاب… শব্দের পরিবর্তে الكتب [“বই”] ব্যবহারে ا অক্ষর বাদ পড়ে, ننجي… এর পরিবর্তে نجي [“আমরা রক্ষা করব”] এর ব্যবহারে ن, অক্ষর বাদ পড়ে। উসমানি লিপির সবচেয়ে বড় ভুল হল, ১৪৪১ বছর আগে ৩ নং সুরাহের ৮৬ তম শ্লোকে মক্কার পরিবর্তে বেক্কা লেখা। সেই শ্লোকে লেখা হয়, ‘ মানুষের জন্য প্রথম উপাসনালয় স্থাপন করা হয় বেক্কাতে যা মানুষকে ধন্য করবে ও পথ দেখাবে।’ ২২তম সুরাহের ৫৫তম শ্লোকে, عظيم يوم [“ভালো দিন”] এর পরিবর্তে  يوم عقيم [” নিরর্থক দিন”] শব্দটি ব্যবহার করা হয়। লিখিত ত্রুটির কারণে ق অক্ষরটির স্থানে ظ অক্ষরের প্রয়োগ দেখা যায়। ১৫০০ সাল ধরে কোনো কর্তৃপক্ষ মক্কার স্থানে বেক্কা শব্দটি [কুরআন৩:৮৬] যে ভুল করে লেখা হয়েছে সেটি নিয়ে কথা বলননি।

 

এই সমস্ত কারণে এবং এই লেখাকে ভুলত্রুটি শূণ্য করে সঠিক আকারে উপস্থাপন করার জন্য আমাদের বৈজ্ঞানিক, ভাষাতাত্ত্বিক ও যুক্তিসম্মতভাবে কোরানের উসমানি লিপিকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে এবং তাকে সঠিকভাবে লিখতে হবে যাতে ভাষাগত নানা ভ্রান্তি ও অন্যান্য ভুলগুলি শোধরানো যায়।

 

এই কাজটির দায়িত্ব অবশ্যই সৌদি আরবের রাজা ও ক্রাউন প্রিন্সের নেওয়া উচিত কারণ তাঁরা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধার্মিক, পর্যটন ইত্যাদি সমস্ত দিক থেকে নিজেদের দেশের আধুনিকীকরণের উদ্দেশ্যে  নানা প্রকল্প ও পরিকল্পনাকে উৎসাহ দিয়েছেন। তাই আমার মনে হয়, এটিই উপযুক্ত সময় ১৪০০ বছরের বানান ও ব্যাকরণের ভুলত্রুটি সংশোধন করে বর্তমান লিপিতে কুরআন পুনঃপ্রকাশিত করার।

 

এর সঙ্গে ইরাকি কুর্দিস্থান আরবি মুসলিম ব্যতীত মুসলিমদের জন্য কুরআনের এই বিশেষ সংকলনের প্রকাশনার কাজে উৎসাহ প্রদান করতে পারে, যাতে ভুল বানানের জন্য আরবি ভাষা না জানা মুসলিমদের উচ্চারণে অসুবিধা না হয়। ইসলামী দুনিয়ায় এই প্রকল্পের আধ্যাত্মিক, মতাদর্শগত এবং ধার্মিক গুরুত্বের জন্য, ইরাকি-কুর্দিস্থানের সভাপতি এই প্রকল্পে উৎসাহ প্রদান করবেন। এমনকি এমন একটি বই আপনাদের বিনীত সেবক ইতিমধ্যেই প্রস্তুত করে ফেলেছে এবং তা প্রকাশিত হওয়ার জন্য তৈরি রয়েছে। শুধু সভাপতির অনুমোদনের অপেক্ষা।

 

আমি এই বিষয়টি জোর দিয়ে বলতে চাই যে খ্রিস্টান, ইসলামী, ইহুদি লিপিগুলির দিকে যুক্তিসম্মতভাবে দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক। এই সময়ে মানুষের মস্তিষ্ককেই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, তাকে নানা অস্পষ্টতা ও অযৌক্তিকতা থেকে মুক্ত করতে হবে, এক বা দুই হাজার বছর আগে মনুষ্যসৃষ্ট ধর্মীয় পাঠ্যগুলিতে অনুন্নত লেখনী পদ্ধতির কারণে যে সব ভুলত্রুটি হয়েছিল, সেগুলি চিহ্নিত করে তাকে যথাসম্ভব সংশোধন করতে হবে।

 

এই করোনাভাইরাস অতিমারী বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনের নতুন পথ খুলে দিয়েছে বিশেষ করে ধর্ম ও আচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যা আগে প্রায় অসম্ভব ছিল। এই সময় ইসলামের আধুনিক দুনিয়ায় পদার্পণের জন্য উপযুক্ত সময়। যার প্রমাণ এই ধর্মেই রয়েছে। দ্বিতীয় সুরাহের ৪৪তম শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘যখন তুমি কুরআন পড়বে, তখন তা পড়ার কারণ খুঁজবে না?’

“আল্লাহ্ মানব মনের গোপন কথা জানেন।”

 

[১] কুরআনের পাঠ্য সংশোধনের আবেদন অভূতপূর্ব নয়। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে, জর্ডনের প্রাক্তন ধর্মীয় অনুদান মন্ত্রী ড. আব্দ আল আজিজ আল খয়াত দর আল ইফতা ওয়েবসাইটে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যা কুরআনের অসংখ্য ভুলত্রুটির কথা উল্লেখ করে এবং তা সংশোধনের আবেদন করে। আল ইফতা.জো এপ্রিল ২,২০১৫।

[২] Mubasher.aljazeera.net, July 22, 2020; bbc.com/arabic, July 25, 2020.

[৩] Twitter.com/DrAlthaidi, July 22, 2020.

[৪] Twitter.com/hureyaksa, July 21, 2020.

[৫] Saudiopinions.org, January 10, 2020.

[৬] Elaphmorocco.com, July 20, 2020.

মূল লেখাটি মেমরি পত্রিকায় প্রকাশিত, অনুবাদ করেছেন পিয়ালি।