সেকুলার রাজনীতির অবশ্যম্ভাবী ফল: ওয়াইসী হতে চলেছেন ভবিষ্যতের জিন্নাহ

0
2107

রাঘবন জগন্নাথন

 

মীম, কংগ্রেস ও ভারতের মুসলিম রাজনীতি

বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের আসাউদ্দীন ওয়াইসীর সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (AIMIM মীম) দ্বারা বিজয়ী পাঁচটি আসন ভারতের মুসলিম রাজনীতির দিক সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত করে। তবে ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে বোঝা যায় এর সূত্রপাত হয়েছিল ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পূর্বে। যেখানে মুহম্মদ আলি জিন্নাহ রাজনীতিতে দ্বৈত সত্তার ভূমিকা পালন করেছিল, কিন্তু ওপরে ওপরে সে সবসময় এমন ভাব দেখাত যেন তার রাজনৈতিক পন্থা সংবিধানে বিশ্বাস রাখে এবং সে আদ্যপান্ত সেকুলার এবং লিবেরাল কিন্তু অন্তর থেকে সে ইসলামপন্থী এবং অ-সংহতিবাদী এবং সর্বোপরি হিন্দুবিদ্বেষী।

ওয়াইসী এবং ভারতের অন্যান্য উঠতি মুসলিম নেতারা বিশেষ করে, আসামের বদরুদ্দিন আজমল(যার উপস্থিতিতে শিলচর বিমানবন্দরে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান উঠেছিল বলে কদিন আগে শোরগোল তৈরি হয়েছিল) থেকে শুরু করে পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া এবং কেরালার ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগের আরও কিছু মৌলবাদী নেতৃবৃন্দ কংগ্রেসের ধাঁচে ভারতীয় সংবিধানে উল্লেখিত সেকুলারিজমের পক্ষে ভেক করে নিজের আখের গোছানোর কাজ করবে।

কংগ্রেস এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন “সেকুলার” দলগুলি সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় মুসলিমদের সংহত হওয়ার পথ হিসাবে অতীত হিন্দুদের করা কিছু ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। তাদের বক্তব্য এই নীতি এখানে কাজ করবে না,কারণ এটি ইউরোপে কাজ করেনি এবং এক‌ইসঙ্গে এটি অন্য কোথাও কাজ করবে না, কারণ ইসলামের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং অনন্য ধারা রয়েছে যা সংহতকরণ ও সিনক্রিটিজমকে প্রতিহত করে।

এই চিন্তাধারা কেবল তখনই পরিবর্তিত হতে পারে যখন পর্যাপ্ত সংস্কারবাদী মুসলমানরা বুঝতে পারে যে তাদের ধর্মীয় নেতারা তাদের ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে এবং তারা ভারত সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই পশ্চাদগামী এবং স্থায়ী রাজনীতিতে কখনোই টিকতে পারবে না।

কংগ্রেসের সেকুলারিজমের তিনটি পদ্ধতি রয়েছে:

১। হিন্দু “সংখ্যাগরিষ্ঠ” লোকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের কাল্পনিক সুরক্ষা প্রদান করে। যদিও হিন্দুরা মুসলনামদের জন্য কোন সমস্যা নয়। হিন্দুরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে লড়াইতে ব্যস্ত।

২। প্রচুর ভোট পাবার আশায় মুসলিম সমাজের জন্য সবচেয়ে গোঁড়া ও ধর্মান্ধদের মনঃপূত কাজগুলো করা ;

এবং

৩। মুসলমানকে কেবল মুসলমান হিসাবে বিবেচনা করা এবং দেশের বাদবাকি সাধারণ নাগরিকদের থেকে তারা আলাদা তাদের ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত পরিচয়‌ও আলাদা।

এই সেকুলারিজম ভালো কিছু করতে পারছে না উল্টে কার্যকরভাবে সংখ্যালঘুবাদ এবং ধর্মীয় প্রতিরোধকে বিপথে চালিত করছে। কংগ্রেসের তথাকথিত সেকুলারিজম বিশেষত প্রয়াত হামিদ দলওয়াই বা আরিফ মোহাম্মদ খানের মতো সংস্কারবাদী মুসলমানের কাছে প্রত্যাখ্যানযোগ্য।

সেই স্বাধীনতার পূর্বে খিলাফত আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর সাথে কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল এবং তখন একবার ব্যর্থ হলে মুসলমানরা কংগ্রেসকে ত্যাগ করে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে আবার এর প্রভাব খেটেছিল, যখন কংগ্রেস কিছু “জাতীয়তাবাদী” দেওবন্দী আলেম সমন্বিত জাতীয়তাবাদ (মুত্তাহিদা কৌমিয়ত) প্রচার করার জন্য এবং পার্টিশন রোধ করার জন্য ব্যবহার করেছিল। তবে কংগ্রেসের এই চেষ্টাকে ন্যাসাৎ করে দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় মুসলিম লীগ ও দেশভাগের পক্ষে ভোট দেয়। ।

ইসলামপন্থী প্রকল্পটির ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন ব্যবহার করে মাঝে মধ্যে ভয় দেখানো ও সহিংসতামূলক কাজগুলি করার উপায়ও অবশ্য রয়েছে। ১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে কেরালার অসহায় হিন্দুদের উপর মোপলা আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল, যার জন্য গান্ধী কোনও সমালোচনা বা ধর্না বা অনশন করেননি। গ্রেট কলকাতা কিলিং এবং নোয়াখালি হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, কিন্তু সাম্প্রদায়িক শান্তি নিশ্চিত করতে নোয়াখালিতে (বর্তমান বাংলাদেশে) কয়েক সপ্তাহ কাটানো সত্ত্বেও, পুনরুদ্ধারকারী মুসলমানরা গান্ধীকে চাপ দিয়ে বাধ্য করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি এই অঞ্চলের হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন জন্য তাদের এই অঞ্চল ছেড়ে পালাতে হবে অন্যথা মরে যেতে হবে। (গান্ধীর এই বিবৃতি নিউইয়র্ক টাইমস রিপোর্ট করেছিল)।

দেশ স্বাধীন হ‌ওয়ার পরেও মুসলমানদের কোরাণ ও ইসলাম মোতাবেক তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত আইন চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে, এমনকি ওয়াইসীর মতো তথাকথিত সংবিধানবাদীও পৃথক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক আইনের ধারণার প্রবল সমর্থক। তার ধর্মনিরপেক্ষতা হ’ল সংবিধানপন্থীর আড়ালে ইসলামবাদ সমর্থন।

আজ, কংগ্রেস-ব্র্যান্ডের ধর্মনিরপেক্ষতায় মুসলমানরা যেমন মোহগ্রস্তে আছেন, ওয়াইসী ও তাঁর দলের লোকেরা একই বিচ্ছিন্নতাবাদী মানসিকতা পুনরুদ্ধারের কাজ করছে যা জিন্নাহ পরিচালিত করেছিল। জিন্নাহর পরবর্তীকালে দ্বিতীয় জিন্নাহ আর তৈরি হয়নি। তাদের দাবি, সাধারণ নাগরিক নয়, মুসলমানদেরকে সর্বদা ‘মুসলমান’ হিসাবেই বিবেচনা করতে হবে তবে তারতে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে ঘটবে।

কেরালায় ইতিমধ্যে অনেকাংশে এই কাজের প্রসার ঘটেছে, যেখানে মুসলিমদের দাবি দাওয়া সম্পূর্ণরূপে একটি মুসলিম দল তুলে ধরে বর্তমানে এই দলের মধ্যে আগ্রাসন অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং আসামের কিছু অংশে (ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অসমীয়া মুসলমানদের পাশাপাশি অবৈধ অভিবাসী এবং অবৈধ অভিবাসীদের ) একমাত্র ঠিকাদার দল হিসাবে মুসলিম স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। এবং হায়দরাবাদ ও অন্যান্য অঞ্চলে ওয়াইসীর মীম দ্বারা পরিচালিত হয়।

 

মীম আদপে মুসলিম লীগের আধুনিক সংস্করণ

১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ৩০ শে ডিসেম্বর যখন মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন কল্পনাতীত ছিল ভারত ভেঙে মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের আহ্বান দিতে পারে এই সংগঠন। কিন্তু বাস্তবে তারা সেই রাস্তাতেই হেঁটেছিল এবং সহস্র সহস্র হিন্দু প্রাণের বিনিময়ে তারা আলাদা রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। ঢাকায় জন্ম নেওয়া মুসলিম লীগ প্রথম থেকেই মুসলমানদের মধ্যে এই ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে তারা স্বতন্ত্র নাগরিক, তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজন।তারা মানুষকে বুঝিয়েছিল মুসলিমরা বঞ্চিত এবং হিন্দুদের হাতে অত্যাচারিত, নিপীড়িত। তাই তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রগঠন করাই শ্রেয়।এইভাবে তারা অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছিল হিন্দু ও মুসলিম কখনো পাশাপাশি সহাবস্থান করতে পারে না বরং মুসলিমরা রাষ্ট্রের দাবিদার। সেই সময় জাতীয় কংগ্রেস মুসলিম লীগের দাবিকে পাত্তা না দিলেও পরবর্তীকালে দেখা যায় এই জাতীয় কংগ্রেস‌ই আখের গোছাতে তোল্লাই দিয়েছিল মুসলিম লীগকে।

মুসলিম লীগ গঠনের ২১ বছর পর ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ১২ ই নভেম্বর ভারতের মাটিতে জন্ম নিয়েছিল আরেকটি দল যারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মুসলিম লীগের রীতি অনুসরণ করে, সেই দলটির নাম অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিন। তাদের বক্তব্য, মুসলমানদের জন্য আলাদা সংবিধান সমস্ত, আলাদা ভূমি, সবকিছু পৃথক ও স্বতন্ত্র করতে হবে। মুসলিমদের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতায়ন দিতে হবে। কিন্তু তখন মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তার ধারে কাছে‌ও আসতে পারেনি সেই দল। বর্তমানে তারাই ভারতের জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ ভাগ হয়ে মুসলিমদের জন্য পৃথক দেশ পাকিস্তানের সৃষ্টি হলেও মজলিস-ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের কর্মকর্তারা রয়ে গেলেন ভারতে বিষাক্ত ভাইরাস রূপে‌। সুদীর্ঘ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও মুসলমানদের জন্য পৃথকীকরণের চিন্তা ভাবনা, আলাদা রাষ্ট্রের দাবি মুছে যায়নি তাদের মস্তিষ্ক থেকে বরং তা‌ আরও জোরদার হয়েছে।

কিন্তু অতীতের মুসলিম লীগ ও বর্তমান মীমের মিল কোথায় সেটা অনেকেই বুঝলেও মানতে চান না কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে খুব সহজেই অনুমেয় মীম হল মুসলিম লীগের আধুনিক সংস্করণ। মীম এবং মুসলিম লীগ একই পন্থায় বিশ্বাসী এবং তারা একই ভাবে ভারতবর্ষের বুকে বসবাসকারী হিন্দুদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে চায়।

 

মীম ও মুসলিম লীগের মিলগুলো এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক

১) মুসলিম লীগের প্রথম এবং একমাত্র বক্তব্য ছিল ভারতের মাটিতে মুসলমানরা বঞ্চিত, নিপীড়িত। তাদের জন্য আলাদা সংবিধান চায়। একই ভাবে মীম‌ও প্রচার করে চলেছে স্বাধীন ভারতের মাটিতে মুসলিমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে দশ কদম পিছিয়ে আছে এবং তারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে বঞ্চিত। তাদের ন্যায্য দাবী থেকে, ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে‌। একমাত্র মুসলিমদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলে তবেই দেশের অগ্রগতি সম্ভব।

২) মুসলিম লীগ প্রচার করত মুসলিমরাই একমাত্র সমাজের উন্নতির রাস্তা দেখাতে পারে। মীম প্রচার করে আসছে ভারতবর্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে কোনো রাজনৈতিক দলই মুসলমানদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে না বরং নিজেদের আখের গোছাতে মুসলমানদের ব্যবহার করে। একমাত্র মীম‌ই মুসলমানদের দাবি-দাওয়া নিয়ে চিন্তিত। মুসলমানদের উন্নতিসাধন একমাত্র মীমের হাত ধরেই সম্ভব।

৩) মুসলিম লীগ অতীতে মুসলিমদের জন্য আলাদা নির্বাচনের দাবি তুলেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তা আদায় করে নিতে সমর্থ হয়েছিল। পাশাপাশি মুসলিমদের জন্য একটি বিশেষ অংশ সংরক্ষণের দাবির জন্য আওয়াজ তুলেছিল তারা। একই ভাবে মীম শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে মুসলিমদের সংরক্ষণ দেওয়ার জন্য তীব্র দাবি করে আসছে প্রথম থেকেই।

৪) মুসলিম লীগ তৎকালীন সময়ে নিজেদের সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছাতে না পেরে দলিতদের কোলে টেনেছিল। তারা দলিত-মুসলিম ভাই ভাই গল্প ফেঁদেছিল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। একইভাবে মীম মুসলিম ঐক্যের স্বপ্ন বিক্রি করতে শুরু করেছে। নিজেদের দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে বাবাসাহেব আম্বেদকরকে পর্যন্ত তারা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তাই তাদের স্লোগান ‘জয় ভীম, জয় মীম’।

৫) মুসলিম লীগ সূচনা লগ্ন থেকেই তীব্রভাবে হিন্দুবিদ্বেষী প্রচার করত। এক‌ইভাবে হিন্দু বিরোধী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে আসাউদ্দীন ওয়াইসী এবং তার ভাই মীম নেতা আকবরউদ্দীন ওয়াইসী। এই মীম নেতা তার বক্তৃতায় প্রকাশ্যে ভারতে বসবাসকারী হিন্দুদের সরাসরি হুমকি দিয়েছিল। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন,”ভারতের যদি মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য পুলিশ সরিয়ে নেওয়া হয় তবে ২৫ কোটি মুসলমান ১০০ কোটি হিন্দুকে বুঝিয়ে দিতে পারে মায়ের দুধের জোর কতটা।”

 

বিহারের পরবর্তীতে শকুনের নজর পশ্চিমবঙ্গ

বর্তমানে পূর্ব বিহারে মীমের আধিপত্য বিস্তার ঘটেছে এবং খুব সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ নেক্সট টার্গেট রয়েছে। যেখানে ইতিমধ্যে এক চতুর্থাংশেরও বেশি মুসলিম। কংগ্রেসের অনুকরণে সংখ্যালঘু তোষণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির আসন্ন মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে অবশেষে ওয়েসিসকে মুসলিম রাজনীতিতে সঠিক প্রবেশপথ তৈরি করে দিয়ে যাবে।

বিহার নির্বাচনের সূত্র ধরেই চলে আসছে সামনের বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের কথা। আর এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের মুসলিম ভোট ব্যাংকে ওয়াইসী মাঠে নামতে পারে। এমন দাবি যে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, তার কারণ ইতিমধ্যেই ওয়াইসী জানিয়ে দিয়েছেন বাংলার ভোটে তাঁর দল হাড্ডাহাড্ডি লড়বে। কলকাতা-সহ বাংলার একাধিক জায়গায় ইতিমধ্যেই মিছিল-মিটিং-সভা তো করছেই মীম, এমনকী তলেতলে সংগঠন গোছানোর কাজও করতে শুরু করেছে। বিশেষত মুর্শিদাবাদের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলা, উত্তরবঙ্গের একটা বড় অংশে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে মীম। জনসংযোগ বাড়ানো হচ্ছে ফুরফুরা শরীফের সঙ্গেও।

পরিস্থিতি বুঝে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উস্কানি দেওয়া নিয়ে এই সংখ্যালঘু নেতাকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে আসাউদ্দীনের থেকে দূরে থাকার বার্তা দিয়ে উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নাম না করে আসাদউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন মীমকে আক্রমণ করেছেন তিনি। বিজেপির কাছ থেকে টাকা নিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে এই দলটি উত্তেজনা তৈরি চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ মমতার।

অপরদিকে, মমতার সরকারের বিরুদ্ধে আসাদউদ্দীন বলেছেন, বাংলার মুসলিমদের হাল যে কোনও সংখ্যালঘু সমাজের তুলনায় মানব উন্নয়ন সূচকের মাপকাঠিতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট, এটা বলা মোটেই ধর্মীয় কট্টরপন্থা, অসহিষ্ণুতা নয়। দিদি আমাদের মতো হায়দ্রাবাদের কিছু লোককে নিয়ে এতই উদ্বিগ্ন হয়ে থাকলে তাঁর বলা উচিত, কী করে বিজেপি বাংলায় ৪২টার মধ্যে ১৮টা আসন জিতল! অর্থাৎ ছক স্পষ্ট। যে ছকে বিহারে পদ্মফুলের ভিত মজবুত করছে বিজেপি, এরপরে কি বাংলাতেও লাগু হবে এই একই ফরমুলা?

 

আসাউদ্দীন ওয়াইসী এবং মীমের ভবিষ্যত পরিকল্পনা

আক্ষরিকভাবে না হলেও তবে ওয়াইসীর চিন্তাভাবনা হ’ল স্পষ্টভাবে মানসিক বিচ্ছিন্নতাবাদ তৈরি করা। এটি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা-পূর্বের মুসলিম রাজনীতিতে বিভক্ত হওয়ার সুনির্দিষ্ট পরিণতি লাভ করবে।

গত ১০ নভেম্বর টিভি চ্যানেলগুলিতে বেশিরভাগ অ্যাঙ্কর ওয়েসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করাকালীন প্রশ্ন করেছিলেন যে, মুসলিম ভোটারদের দোহাই তোলা হলেও বিহারের সীমাঞ্চল ও কোসি অঞ্চলগুলিতে মহাজোটবন্ধন কীভাবে হারাতে বসেছে, যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

মীমের প্রবেশের ফলে বিহারের কিছু অংশে মুসলিম ভোটগুলি বিভক্ত হয়েছিল, এর ফলে এই অঞ্চলগুলিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটকে (এনডিএ) আরও বেশি উন্নতি করতে সক্ষম করা হয়েছিল বলে ধারণা। ভারতে মুসলিম রাজনীতি কীভাবে রুপ নিচ্ছে তা নিয়ে মিডিয়া স্পষ্টভাবেই সবকিছু সম্পর্কে অবগত, কিন্তু তারা মুখে জিপ এঁটে বসে আছে। মুসলমানরা যখন কংগ্রেসী ঘরানার ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উপর বিশ্বাস রাখে না, তখন কেন কোনও ওয়েসী তার নিজের রাজনৈতিক ভিত্তি প্রসারিত করার জন্য লড়াইয়ের আসরে নামবে না?

হায়দ্রাবাদে বসে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মহারাষ্ট্রের নান্দেদ এবং আওরঙ্গবাদে এবং তারপর এখন বিহারে। এক পর্যায়ে, যে কেউ অনায়াসে আশা করতে পারে যে তিনি পশ্চিম উত্তর প্রদেশে তাঁর প্রভাব বিস্তার করবেন, যেখানে আগামী দিনগুলিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

ওয়াইসী স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে জিন্নাহর যোগ্য উত্তরসূরি হ‌ওয়ার রাস্তা বেছে নিয়েছেন। তাঁর দল যেটা তার বাবা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল, তিনি আবার রাজাকারদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এটি প্রাপ্ত হয়েছিল যে রাজাকাররা নিজামের হায়দ্রাবাদে হিন্দু-বিরোধী জঘন্য প্রচার চালিয়েছিল। ওয়েসীর দল সংবিধানের কন্ঠ রোধ করে গোপনে জনগণতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ইসলামবাদের বৃদ্ধির উপায়কে মাথায় রেখে কথাবার্তা বলে এবং মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে সবসময় সোচ্চার।

হায়দরাবাদের নিজের বাড়িতে বসে মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসতি স্থাপনের ইস্যুতে তিনি চার কদম এগিয়ে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র একটা কারণে। যখন বিজেপি দাবি করেছিল, যে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাবে, ওয়াসী পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, “আমরা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, আপনি কোন আইন বলে তাদের ফেরত পাঠাবেন, ঠিক কোন আইনের আওতায়?”

এই জটিলতা দূর করার জন্য‌ই স্পষ্টত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ (সিএএ), যা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘুদের দ্রুত নাগরিকত্ব প্রত্যাশা করে। নতুন পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এ শর্ত দেওয়া হয়েছিল ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ বা তার আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে যে সমস্ত অমুসলিম শরণার্থীরা ভারতে এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অর্থাৎ, হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, পারসি বা জৈন ধর্মের যেই লোকেরা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে থেকে ভারতে বসবাস করেছেন, তারা ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। এরই বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন বিরোধীরা। তাদের দাবি মুসলিমদের এই আইন থেকে বাদ দেওয়ায় এটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আঘাত হেনেছে।

কিন্তু এই আইনের বিরোধিতা করে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে ওয়াইসী পথে নামে। একটি ব্যাপার কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, ওয়েসী যে আইন অনুসরণ করতে চান না তা নয়, তবে তিনি ভারতে যে কোনও পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে বাধা বা প্রতিকূলতার সৃষ্টি করতে পারে এরকম যে কোন আইনের বিরোধিতা করবেন।

 

রাজনৈতিক মহলের চাপানোত্তর

বিজেপির কট্টর সমালোচক হয়ে প্রকাশ্যে এলেও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ওয়াইসীকে গেরুয়া শিবিরের ‘সিক্রেট এজেন্ট’ হিসেবে কটাক্ষ করে । বিহার বিধানসভা নির্বাচনেও ওয়াইসীর মীম যেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, তাতে অনেকেই বলেছিলেন বিরোধীদের নিশ্চিত মুসলিম ভোট ব্যাংকেই থাবা বসাবেন ওয়াইসী। আবার নীতীশ কুমারের দিকেও যে মুসলিম ভোট রয়েছে, তাতেও ভাগ নেবেন আসাদউদ্দীন। বাস্তবে ঘটেছেও তাই।

বিহারের শেষ দফা ভোটের আগেই মীম প্রধান ওয়াইসি প্রচারে রীতিমতো ঝড় তুলেছিলেন। আড়ালে ওয়াইসিকে নিয়ে চিন্তা গোপন করেনি আরজেডি-কংগ্রেস শিবির। বিহারের তৃতীয় দফার ভোটের আসনগুলিতেই সবচেয়ে বেশি মুসলিম ও উর্দুভাষী মানুষ সবথেকে বেশি ছিলেন। কিষানগঞ্জ, পূর্ণিয়ার মতো বিহারের মুসলিম অধ্যুষিত সীমান্ত এলাকায় ওয়াইসি জোরদার প্রচারে নেমেছিলেন। আরজেডি, কংগ্রেস নেতারা বলছিলেন, তিনি আসলে বিজেপির হয়ে বিরোধীদের ভোট কাটতে নেমেছেন। এমনকী নিজের রাজ্যে তেলেঙ্গানার ভোটে ৯টি আসনে প্রার্থী দিলেও বিহারে ২৪টি আসনে ভোটে লড়ছেন ওয়েইসি। মঙ্গলবার ভোটের ফল প্রকাশ শুরু হতেই বোঝা যায়, বিরোধীদের অভিযোগ খুব একটা ভুল নয়। বেশ কিছু আসনেই মুসলিম ভোটের একটা বড় অংশ যাচ্ছে ওয়াইসির দলে। তাতে আসন জেতার সম্ভাবনা না থাকলেও বিরোধীদের ভোট ব্যাংক কাটা যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। এমনকী বেশ কয়েকটি জায়গায় নীতীশ কুমারের দলের মুসলিম ভোট ব্যাংকেও থাবা বসিয়েছে এমআইএম। ফলে এখনও পর্যন্ত জোটবদ্ধভাবে সরকার গড়ার জায়গায় থাকলেও ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে নীতীশ কুমারের শক্তি।

তবে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এসবকে কোনরকম পাত্তা দিতে নারাজ। তিনি তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় বুধবার জানিয়েছেন, ‘বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে ধোঁয়াশা রয়েছে। আর আসাউদ্দিন ওয়াইসির দল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (মিম) বিজেপির দালালি করেছে।”

 

আগামীকাল ভাবাচ্ছে

সব দিক পর্যালোচনা করে বলা যায় কংগ্রেসী ঘরানার ধর্মনিরপেক্ষতা একটি ব্যর্থতা, এবং এটি কেবলমাত্র ভারতের মুসলিম প্রভাবশালী অঞ্চলে ঘরে ঘরে একটি করে জিন্নাহ জন্ম দিতে পারে। ওয়েসী কংগ্রেসী ধর্মনিরপেক্ষতা চূড়ান্ত নেমেসিসের উদাহরণ। তবে এর জন্য দোষ অবশ্যই হিন্দুত্ব এবং বিজেপির উত্থানের জন্য অর্পিত হবে।

যথারীতি বাম-উদারপন্থী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী লোকজন হিন্দুত্বের বিরোধিতা করবে এবং ওয়েসীকে সাপোর্ট করবে। এর ফলে সাধারণ মানুষ মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের ফলভোগ করবে এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাই সময় থাকতে রাশ টানা অত্যন্ত দরকারী।

রাঘবন জগন্নাথন স্বরাজ্যের প্রধান সম্পাদক। স্বরাজ্য়ে প্রকাশিত মূল লেখাটি থেকে অনুবাদ করেছেন প্রজ্ঞা পারমিতা।