মাকাল মহাকাল জেলে মহাদেব

চাষ করিতে যায় ভোলানাথ বল্লুকা কুলে গো।

কোথায় আছো গৌরী দেবী দাওনা শঙ্খের ধ্বনি গো।।

আগে চলে দেব ভোলানাথ শেষে নারদ গো।

বল্লুকা কুলে আসি তারা উপনীত হলো গো ।

হাল জোড়ে হাল জোড়ে দেব ভোলানাথ গো ।

সিংগা বাজায় দেব ভোলা বাঁশের উপর বসে গো।।

এক চাষ , দুই চাষ, তিন চাষ দিল গো।।।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লৌকিক দেবদেবী কেন্দ্রীক লোকায়ত পালা গান গুলির মধ্যে বিশিষ্ট পালা গান হল “চাষী মহাদেব”। এই দেবপালার অন্তর্গত। বাংলা তথা ভারতের লৌকিক সমাজে মহাদেব কৃষি সহায়ক দেবতা হিসেবে পরিচিত যুগ থেকে যুগান্তরে।

মহাদেব সমগ্র লৌকিক জীবন ও জীবিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বারব্রত প্রিয় মহিলাগণ থেকে শুরু করে ধনী দরিদ্র সব শ্রেনীর কৃষক, জেলে, কুমার , কামার অর্থাৎ সমাজের কর্মঠ ও শ্রমজীবী মানুষেরা জীবনের নানা সংস্কারের সাথে তাঁকে বরণ করে নিয়েছেন।

যেমন – রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মহাদেবের পূজা, কৃষি ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য মহাদেবের পূজা, শিশুর রক্ষাকর্তা হিসেবে মহাদেবের কাছে মানত, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য মহাদেবের পূজা। মহাদেবের মতো স্বামী পেতে যুগ থেকে যুগান্তরে মেয়েরা মহাদেবের বারব্রত  করেন।

কিছু উদাহরণের দিকে চোখ দেওয়া যাক। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জনসমাজে শিব মহাদেবের উপাসনা ব্যাপকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় । এক সময় এই অঞ্চলে শৈব সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। যার জন্যই বর্তমানে এসব স্থানে নাথ , যোগী সম্প্রদায় প্রত্যক্ষ করা যায় । এরা নিজেদের শিব গোত্র হিসেবে পরিচয় দেয়।

শিব কে নিয়ে লোক কথার অন্ত নেই। দেবতা মহাদেব লৌকিক হয়ে মানুষের নিকট আপন হয়েছেন। তাঁর নিকট উচ্চ নিচ নেই। তিনি সবার। তিনি আদি, অন্তত, স্বয়ম্ভু ।  মহাদেব কে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানান পৃথক গান।

লোক সংস্কৃতির বিজ্ঞানীগণ মনে করেন মহাদেব, শিব শম্ভু, আদি অন্ত দেবতা পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম পর্যায় থেকে মানুষ দ্বারা পূজিত হয়ে এসেছেন । অর্থাৎ যদি আমরা দেখি তাহলে  ইতিহাস সাক্ষী মহেঞ্জোদারো হরপ্পা যুগ থেকে মানুষের কাছে তিনি  পূজিত।  সিন্ধু সভ্যতার সীলমোহরে তাঁকে পশুপতি হিসাবে আমরা দেখতে পাই । দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লোক বিশ্বাসের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার উৎখনন প্রাপ্ত পশুপতির মূর্তির সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় ।

তাছাড়া মহাদেব শিবকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার আঞ্চলিক দেবতা নন। তিনি সারা পৃথিবীর প্যাগান ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের কাছে বহু রূপে দেবতা হিসেবে পূজিত হয়ে আসছেন। ভারতবর্ষের বহু মানুষের জীবন সম্পৃক্ত নানা আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে বহুকাল আগে তিনি ঠাঁই পেয়েছেন । মহাদেব কে নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা ব্রত কথা,  ধাধা, গান, কথকতা,  কত কথা, পালা ও গান।

বিশেষত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারায় ও শাক্ত পদাবলীর কবিগণ নানাভাবে শিবকে চিত্রিত করেছেন। বাংলা লোকায়ত পালাগানে শিব নিতান্ত বাঙ্গালী রূপে বর্ণিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে মাঝে মাঝে তাঁর দেবত্ব উকি দিলেও মানব ধর্মই বেশি প্রকাশ পেয়েছে।

দক্ষিণবঙ্গের নিম্ন গাঙ্গেয় ও জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলে কৃষক ও জেলে সম্প্রদায় মানুষরা মাকাল ঠাকুরের পুজো করে। মাকাল শব্দটির নামের সাথে মহাকাল শব্দটি সামঞ্জস্যপূর্ণ । মহাকাল শব্দটির  ধ্বনি লোপ হেতু মাকাল শব্দের উৎপত্তি । চব্বিশ পরগনা লোকসমাজে মহাদেবের সংস্কার গত বিভিন্ন পূজাচারের মধ্যে মাকাল ঠাকুরের পূজার মিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া এই অঞ্চলে প্রচলিত মহাদেবের চাষ পালার মধ্যে মাকাল দেবতার পূজার ইঙ্গিত আছে।

জেলে সম্প্রদায় মূর্তি বিহীন মাটির বেদীকে মাকাল ঠাকুরের থান হিসেবে কল্পনা করেন । কোন কোন ক্ষেত্রে মাঠের উপর কাদা মাটির একটি বা দুটি আবক্ষ মূর্তি তৈরি করা হয়। মূর্তি অতি সাধারণ,  নির্মাণ পদ্ধতি অতি সহজ । পুকুরের খোল থেকে আঠালো পাঁকমাটি অল্প নিয়ে দুই হাতের তালুতে রগড়ে চার ছয় ইঞ্চি লম্বা ও দু তিন ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত করা হয়। তারপর তর্জনী বুড়ো আঙ্গুলের চাপ দিয়ে নাক, চোখ, মুখ তৈরি করে পূজার বেদীতে বসানো হয়। এই মূর্তিকে শিব লিঙ্গের মত দেখতে হয়। এইরূপ মূর্তি তৈরি হতো কুষাণ যুগে। এটিই মাকাল ঠাকুর।

চব্বিশ পরগনায় মাকাল ঠাকুরের ভিন্ন মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। পুকুর বা  ভেড়ি ছাঁচার সময় বা ব্যাপকভাবে মাছ ধরার সময় জেলারা পুকুরের খোলে মাকাল ঠাকুরের মূর্তি গড়ে পূজা করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে পুকুরে সেচন শুরু  হলে পুকুরের খোলের কোন এক স্থানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে মাটির বেদীর উপর ভাঁড় উপুর করে দেয়া হয় । এটিই মাকাল ঠাকুরের মূর্তি বলে কথিত হয়। একেই পূজা করা হয় ।যতদিন না মাছ ধরার কাজ সম্পূর্ণ হয় ততদিন এর পূজা চলে ।

মাকাল ঠাকুরের স্থায়ী আবক্ষ মূর্তি বা কেবল মুন্ড পুজিত হতে দেখা যায়।  মাকাল ঠাকুরের মূর্তি কাঁধ পর্যন্ত চুল, বিশাল ঝুলন্ত বিস্ফারিত চোখ ,কান কুন্ডল ও গলায় গলাপটি। এরূপ মূর্তি উত্তর চব্বিশ পরগনার ভেরি অঞ্চলে দেখা যায় ।

পুকুরের খোলে মাকাল ঠাকুরের পূজা ও গ্রামাঞ্চলে শিবের লৌকিক পূজার মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।  মাকাল ঠাকুরের পূজার প্রধান উপকরণ হলো বাতাসা । বড় রেকাবিতে বাতাসা, ফুল, জল, বেলপাতা। তাতেই ঠাকুর খুশি।

ক্ষেত্রবিশেষে ফলমূল, চিনি সন্দেশ, কলাপাতায় বেদীর সামনে বসিয়ে দেয়া হয়। ধুপ, প্রদীপ জ্বেলে আরাধনা হয়। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা অবশ্যই দেবতার কাছে একটি বিচালী জ্বালা হয়। বাড়ির যে কেউ বা যারা মাছ ধরতে যায় তারা এই পুজো নিজেরাই করেন। শিবের পূজা তে অনুরূপ পূজা পদ্ধতি আছে। শিবের পূজায় বিশেষ করে গাজনের সময় বাতাসের ডালা দেওয়া হয়  ও খড়ের আগুন জ্বালানো হয়।

প্রচলিত পালাগানে শিবের চাষ পালায় মৎস্য শিকারী রূপে মহাদেব ও গৌরী দেবীকে দেখা যায়। তারা যেমন ধান ক্ষেত সেচন করে মাছ ধরছেন, তেমনি সেই মাছ মাথায় করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন। অনুমান করা যায় এই কারণে জেলে সম্প্রদায় হরগৌরী কে জেলে দেব দেবী রূপে কল্পনা করে পুজো দেয় এবং প্রচলিত লোকবিশ্বাসের পুকুরের মধ্যে মাকাল ঠাকুরের যে দুটি রূপ বর্ণনা করা হয় সেগুলো হলো মহাকাল শিব ও অপরটি স্ত্রী গৌরী।

সুতরাং গভীর গবেষণা ও লোকসংস্কৃতির বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় মাকাল ঠাকুরের পূজা ও লৌকিক হরগৌরীর পূজা এক এবং অভিন্ন ।সম্প্রদায় ভেদে শিব ঠাকুরের পূজার বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় । তার মধ্যে মাকাল ঠাকুরের পূজা একটি ।

মাকাল ঠাকুরের যুগ্ম মূর্তিটির বিভিন্ন তাৎপর্য আছে । মাকাল ঠাকুরের কাদার যুগ্ম কাল্পনিক মূর্তি দেবদেবী সম্পর্কিত নিরাকার অবশেষ রূপে ধরা হয়। যা খ্রিস্টপূর্ব যুগের বলে অনুমান করা যায়।

কাদার যুগ্ম মূর্তি নারী ও পুরুষ যেমন ভাবে ভাবা যায় তেমনি একটি অপরটির অনুচর রূপেও কল্পনা করা যায়। যেমন দক্ষিণ রায়ের অনুচর কালিকা রঞ্জন মহাদেবের অনুচর নন্দী ভৃঙ্গী ইত্যাদি। শিব , মাকাল, ভোলেবাবা দেব রূপের আদিম তম ধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি আদিম লৌকিক হয়ে অলৌকিক ভাবে মিশে থাকেন আমাদেরই মধ্যে।

তথ্যঃ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লৌকিক দেবদেবী