ঊনিশে মে বাঙ্গালীর প্রকৃত ভাষা দিবস

0
1370

উত্তর পূর্ব ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলির প্রাপ্য অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ে  আসামের শিলচরে ১৯৬১ সালের উনিশে মেতে বাঙ্গালী হিন্দুর আত্মবলিদান সত্যি অনস্বীকার্য।  মাতৃভাষার অধিকার  রক্ষার লড়াইয়ে বাঙ্গালী হিন্দু বরাবর সোচ্চার, সেটা ব্রিটিশ ভারতের বিহারের মানভূমেই হোক বা আসামের বরাক উপত্যকা  কিংবা পশ্চিমবঙ্গের দাড়িভিট। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের বিদ্বজনেরা যাঁরা নিজেদের বাঙ্গালী আত্মাভিমানী মনে করেন তাঁরা কেন  শিলচলের ১৯ মের হুতাত্মাদের বা দাঁড়িভিটের রাজেশ, তাপসদের স্মরণ করতে ভুলে যান? যাঁরা কিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনটিকে বাংলা ভাষা আন্দোলন বলে প্রচার মিথ্যা করেন, কিন্তু খোদ ভারতের বুকে ঘটে যাওয়া একাধিক বাঙ্গলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে চেয়ে যান । এই প্রবণতা কি মুসলিম তোষণের ঘৃণ্য মানসিকতার প্রতিফলন?

আসলে মানভূম, শিলচর, দাড়িভিটের  হুতাত্মাদের নামের লম্বা একটি তালিকার মধ্যে একটিও আরবী নাম না থাকায় আজকের পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী বিদ্বজনরা তা উৎযাপনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।  বাঙ্গলা ভাষী মুসলিমরা ঐতিহাসিক ভাবে কোনো দিনই বাংলা কে নিজের ভাষা মনে করেন নি, পরিবর্তে আসামের বাঙ্গলা ভাষা আন্দোলনের সময় আসামে বসবাসকারী বাংলাদেশের অবৈধ মুসলিমরা উগ্র অসামীয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে বাঙ্গালী নিধনে নেমে ছিলো। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আজকের ভণ্ড ভাষাপ্রেমিকদের পক্ষপাত দৃষ্টিতে শিলচরে বা দাঁড়িভিটের হুতাত্মারা সত্যিই সাম্প্রদায়িক ছিলেন কারণ দাঁড়িভিটের রাজেশ আর তাপস মাতৃভাষার জন্য সরাসরি আরব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল আর শিলচরের কমলারা প্রাণ দিয়েছিলেন উগ্র অসমীয়া এবং না-অসমীয়া বাংলাদেশী মুসলিমদের বিরুদ্ধে।

শ্রীহট্টের বরাক উপত্যকা ১৯৪৭ এর ধর্মীর বিভাজনের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে আসামে যুক্ত হয়, বরাক উপত্যকার তিনটি জেলায় শতভাগ বাঙ্গলাভাষীদের বসবাস। বরাক ব্যতীত বাকি আসামেও দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী বাঙ্গালী। কিন্তু ১৯৬০ সালের এপ্রিলে আসামের প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র রাজ্যভাষা  হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যাঁর ফলে আসামের বরাক এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাঙ্গালীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে।

১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি কথা ঘোষণা করেন। বরাক উপত্যকার বাঙ্গালীদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বরকে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।  ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন ।  বরাকের জনগণের মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ  সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল যা ২ মে তে শেষ হয়। এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পরিষদের মুখ্য সদস্য রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন যে, যদি ১৩ এপ্রিল ১৯৬১ সালের মধ্যে বাঙ্গলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে বাঙালিরা ব্যাপক গণ আন্দোলন শুরু করবেন।

১২ মে তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করে। ১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে বাঙ্গালী বিদ্বেষী আসাম সরকার। ১৯ মে-এর ঘটনা নিরস্ত্র মাতৃভাষা প্রেমী বাঙ্গালী সত্যাগ্রহীদের উপর লাঠিচার্জ করে আসামের পুলিশ। বরাক বাংলাভাষা আন্দোলনে ১৯ মে তে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে ব্যাপক বনধ ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারী কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তারা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার বনধ শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয় নি। সকালে বনধ শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল প্রয়োগ করে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা শুরু হয়। বিদ্রোহ দমনের চরম পর্যায়ে প্যারা মিলিটারি ফোর্স আন্দোলনকারী নিরস্ত্র বাঙালিদের লক্ষ করে ১৭ রাউণ্ড গুলি ছুঁড়ে। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন। দু’জন পরে মারা যান। ২০ মে তে শিলচরের জনগণ হুতাত্মাদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ  করেছিলেন।

বাঙ্গালী বিদ্বেষী উগ্র অসমীয়া জনতা বাঙ্গালীদের আক্রমণ করে। পরবর্তী সময় যা সহিংসতা রূপ নেয়। প্রায় ৫০,০০০ বাঙ্গালী হিন্দু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। অন্যরা (প্রায় ৯০,০০০ মানুষ) বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। ব্রহ্মাপুত্র উপত্যকার কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের বাঙ্গালী পরিবারগুলোর ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়। এই জেলার বাঙালিরা আসামে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিলো । শতাধিক বাঙ্গালী আহত হয়।

এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাঙ্গলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এটা আসাম তথা সমগ্র ভারতের বাঙ্গালীদের নিকট স্বভূমে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একটি বড় জয় ছিলো। কিন্তু ভাষা আন্দোলনেকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তানে যে পৃথক বাঙালি মুসলিম জাতীয়তার সূত্রপাত ঘটেছিল যা মোটেই অসাম্প্রদায়িক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ছিল না বরং তা ছিলো পূর্ব বাংলা থেকে বাঙ্গালী হিন্দুকে স্বমূলে উৎপাঠনের পূর্ব পরিকল্পনা মাত্র। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই নব প্রতিষ্ঠিত মুজিবের বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি মুছে ফেলে পরিপূর্ণ  ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়। সেই হতে আজ অবধি শরিয়ত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য়ে  অবিচল ইসলামী বাংলাদেশ রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ঢাল হিসেবে  ব্যবহার করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও ভারতের একদল স্বার্থান্বেষী বাঙালি, বাঙালির যাবতীয়  ইতিহাস, দলিল এবং বাঙ্গলাভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিকৃত করে বাংলা ও বাঙ্গালীর যাবতীয় কৃতিত্বের অবদান নব গঠিত ইসলামী বাংলার হাতে তুলে দিতে সদা আগ্রহী ।

যে ভূমির অধিকাংশ আরব সংস্কৃতির অনুসারী তারা কখনই উপমহাদেশের সংস্কৃতির সমৃদ্ধ সংস্কৃতির কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারে না। বাংলাদেশের মৌলবাদী বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী এবং তাঁদের ভারতীয় দালাল গোষ্ঠী ভারতে একাধিক বার সংঘটিত বাঙ্গলা ভাষা আন্দলনের নিরপেক্ষ ইতিহাস সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাভাষী মুসলিম জাতীয়তা গঠনের  আন্দোলনকে বাঙ্গলা ভাষা আন্দোলন বলে জোর প্রচার চালাতে থাকে। ভারতের শেকড়বিহীন বর্তমান সেকুলার মনস্ক বাঙ্গালী সন্তানরা সেই প্ররোচনার গা ভাসিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকেই একমাত্র বাঙ্গলাভাষা আন্দোলন বলে প্রচার করতে থাকে। কার্যত চাপা পড়ে যায় ভারতের মানভূম,  আসামের বরাকভূমিতে সংঘঠিত বাঙ্গলা ভাষা আন্দোলনের হুতাত্মাদের আত্মবলিদানের পবিত্র ইতিহাস। যা প্রকৃত পক্ষেই ভারতের মধ্যে অবস্থিত বঙ্গভূমিতে বাঙ্গালীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিলো।