বিধাতার হাতে লেখা গান – ৫

অভীক মুখোপাধ্যায়

(চতুর্থ পর্বের পর)

পর্ব – ৫

আমেরিকাতে একটা প্রবাদ চলে:

মদ বানায় কারা?

আইরিশ আর জার্মানরা।

খায় কারা?

অফকোর্স আমেরিকানরা!

প্রতি একশোজনের মধ্যে কুড়িজন মার্কিন নাগরিকের হাতে বাডওয়াইজার বিয়ারের ছোট-ছোট ক্যান দেখতে পাবেন, বন্ধুরা। কলেজের স্টুডেন্ট বিয়ার খেয়ে ক্লাস করতে ঢুকছে। এটা কোনো অবমাননা নয়, কোনো অপরাধ নয় ওদেশে। অপরাধ হওয়ার কথাও নয়। কারণ সংস্কৃতি। তা ভালো কী মন্দ এর বিচার করার আমরা কেউ নই, কিন্তু বাঁশ কেমন তা বোঝার জন্য ঝাড়টা যে চিনতেই হবে। আমরা টুক করে ফিরে যাব আমেরিকার ইতিহাসে। পাতাটা উলটে দেখে নেব যে, সেখানে কারা গিয়ে বসতি গড়ে তুলেছিল? তারা কি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের লোক ছিল? না। ডিউক অব এডিনবরার মতো কেউ বা কারা ছিলেন কি? না, তা-ও নয়। তাহলে কারা ছিল? তারা ছিল মাঠেঘাটে কাজ করা এবং করানো জমিদার, সামন্তপ্রভুর গোছের মানুষ। আর তাদের সংস্কৃতিতে দিনরাত মদের ফোয়ারা চলত।

‘মে-ফ্লাওয়ার’ জাহাজের কথা আগেই বলেছি তো, মনে আছে? সেই জাহাজ যখন এসেছিল, তার পেটের ভিতরে আনা হয়েছিল বিয়ার ভর্তি ইয়া বড়-বড় ব্যারেল। তারমানে শুধু মদ নয়, মদের নেশাটাকেও সঙ্গে করে এনেছিল তারা।

করোনা-পিরিয়ডে আমাদের দেশে রেশনিং সিস্টেমের ওপরে প্রবল চাপ। মানুষ কোথাও চাল, কোথাও গম, কোথাও চিনি তুলছেন। এমন ব্যবস্থায় কি মদ পাওয়া সম্ভব? মোটেই নয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে এই ছাড়পত্র রয়েছে। সব দেশের ক্ষেত্রেই এটা প্রায় সমানভাবে প্রযোজ্য। আমেরিকার ক্ষেত্রেও সত্য। জর্জ ওয়াশিংটন যখন স্বাধীনতার যুদ্ধ ল্রছিলেন, তখন তিনি সেনাদের রেশনে প্রতিদিনের হিসেবে আধ গ্লাস করে রাম/ হুইস্কি বরাদ্দ করেছিলেন। আব্রাহম লিঙ্কন তো আবার নিজেই মদ বিক্কিরি করতেন। এবং যদি খুব ভুল না-করি তবে উনিই আমেরিকার এমন একমাত্র প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যার হাতে মদ বিক্রি করার লাইসেন্স ছিল। আর কেনেডি পরিবারের গল্প তো বলেই চলেছি। আমেরিকায় অবস্থাটা এমন ছিল যে ডাক্তারেরা প্রেসক্রিপশনে অবধি মদের ডোজ লিখতেন। এটা নাকি ব্যথা-বেদনা কমার নিদান, ঘুম আসার বিধান। আমেরিকা আর মদ শুনলেই হয়তো আমাদের মনে দামী কাচের বোতলের ছবি ভেসে উঠবে, কিন্তু পুরো চিত্রটা মোটেই তেমন ছিল না। মদ মানে শুধু ইম্পোর্টেড পানীয় নয়, মার্কিনরা নিজেদের বাড়ির বাইরে কাঠের বড় বড় পিপে বসিয়ে রাখত, খেত থেকে খেটেখুটে ফিরে এসে মাগ আর প্রাণ ভরে পান করত সীডার অথবা বিয়ার। জেলেরা নিজেদের জুতোর মধ্যেই মদ লুকিয়ে চুরিয়ে নিয়ে গিয়ে বেচত। আর এই থেকেই জন্ম নিল একটা অদ্ভুত শব্দ, যা আজকের আবগারি বিভাগের ডিকশনারিতে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। কোন শব্দখানা? ‘বুটলেগিং’, যার মানে অবৈধ ভাবে মদ বিক্রি করা।

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু দাসত্বের বর্বর প্রথাকে শেষ করার পরে এবার আমেরিকার সামনে ছিল নতুন চ্যালেঞ্জ—মদের সংস্কৃতিকে আঘাত করা। একটা ঢেউ উঠল। বাজারে কথা ভাসল—এই সংস্কৃতি আমাদের মানে আমেরিকানদের নয়, এটা বাইরে থেকে আমদানি করা হয়েছে।

এর সূত্রপাত হল ঊনবিংশ শতকে। ওয়াশিংটোনিয়ান নামে একটি গ্রুপই শুরুটা করল। তারা একটা পথনাটিকার মাধ্যমে প্রচার চালাতে লাগল। সেটার নাম ছিল ‘টেন নাইটস্ ইন আ বার-রুম’। গল্পটা ছোট্ট করে বলে দিই, নেশায় চুর হয়ে থাকা এক পিতাকে ঘরে ফেরানোর জন্য একটি বাচ্চা মেয়ে বার-এ আসে এবং মদের নেশায় বুঁদ হয়ে সে নিজেও মাটিতে পড়ে যায়। পরে এটাই সিনেমা আকারে এসেছে। সেখানে গল্পে রদবদল হয়েছে। সোমরসের প্রভাব তাড়াতে করুণরস বেড়েছে অনেকটা। এভাবে একটা গণসচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছিল। মানুষজন নিজেদের আড্ডায় বসে মদ্যপানের কুফল নিয়ে আলোচনা করছিল। পরে এই একই কনসেপ্টে কাজ করেছে ‘অ্যালকোহলিক অ্যানোনিমাস’ নামক সংগঠন। স্কুলের বাচ্চাদের মধ্যেও মদ্যপানের কুপ্রভাব নিয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গঠিত হল একটা নতুন গ্রুপ—কোল্ড ওয়াটার আর্মি। কী সুন্দর সব গান বাঁধা হতো সেখানে—

The drink, that’s in the drunkard’s bowl

Is not the drink for me,

It kills his body and his soul,

How sad a sight is he!

But there’s a drink that God has given,

Distilling in the showers of heaven,

In measures large and free,

Oh, that’s the drink for me.

(এইচ রীড)

তবে এই সবকিছুর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রমিলাবাহিনীর ভূমিকা। এর আগে অবধি আমেরিকান রমণীরা শুধুমাত্র ঘর-সংসারের দেখাশোনাই করতেন। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ দেখাই যায়নি। এক একজনকে সাত –আটটা বাচ্চা সামলাতে হতো। কম কথা নয়। স্বামী মদের নেশায় চুর হয়ে পড়ে আছে ভাঁটিখানায়, আর বউ বাচ্চা সামলাচ্ছে। প্যাথেটিক সিচুয়েশন ছিল!

মদ-বিরোধী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠছিলেন এলিজা জন থমসন এবং সেন্ট ফ্রান্স বিলার্ড-এর মতো নারীরা। এঁরা মদের দোকানের সামনে বসে যিশুকে স্মরণ করে প্রার্থনা করতেন। আর আন্দোলনটা ছিল আমাদের সত্যাগ্রহের মতোই। অহিংস। তবে এসবই কিন্তু গান্ধীজির জন্মেরও আগের কথা। তাই সত্যি বলতে কী, যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন নিয়ে আমরা পেটেন্ট দাবী করার মতো লাফালাফি করে থাকি, তার সূত্রপাত কিন্তু আমেরিকাতেই হয়েছিল, সেখানকার নারীশক্তির হাতে, মদের দোকানের সামনে।

তা এই প্রমিলাবাহিনীর নাম কী ছিল?

  • উইমেন ক্রিশ্চিয়ান টেম্পারেট ইউনিয়ন।

এঁরা স্কুলের পাঠ্যবইতে মদের কুপ্রভাবের কথা ছাপালেন। বাচ্চারা পড়তে থাকল, সচিত্র থাকায় দেখতেও লাগল যে মদ খেতে-খেতে একটা সময়ে মদই মানুষকে গিলে খেতে আরম্ভ করে। শরীর নষ্ট হয়ে যায়। আবার এঁদের বিরুদ্ধেও প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। হয়তো কোথাও একটা শান্তিপূর্ণ ডেমনস্ট্রেশন চলছে, এমন সময়ে একদল লোক এসে সেই ভদ্রমহিলার মাথায় এক বালতি মদ ঢেলে দিয়ে চলে গেল।

একদিকে যেমন আন্দোলন চলছিল, অন্যদিকে দিনের-পর-দিন বেড়েই চলেছিল শুঁড়িখানার সংখ্যা। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার হিসেবটা দেখে নেওয়া যাক—তিন লাখ বৈধ এবং লক্ষাধিক অবৈধ মধুশালা ছিল আমেরিকায়। বারগুলোই তখন মিটিং পয়েন্ট। সেখানে পত্রপত্রিকা রাখা থাকত, বই রাখা থাকত। লোকে পান করতে-করতে পড়ত কিনা তা এখন বলা মুশকিল, বললেও কেউ বিশ্বাস করবেন কিনা তাও জানি না। এখানে বসেই চাকরি অফার করা হতো, লোকে চাকরি পেয়ে তা করতেও যেত, এবং মাইনে পাওয়ার পর আবার মদ খেতে আসত। বিনামূল্যে খাবার খাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। এখানে একটা বিজনেস পলিসি কাজ করত। খাবারে বেশি করে নুন দেওয়া হতো। নুনে মুখ খারাপ হলেই লোকে বিয়ার পান করত। বার-মালিকের তো ব্যবসার পোয়া বারো।

যাই হোক, প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ ভাবে বোলে তো মুন্নাভাই এম বি বি এস ওয়ালা জাদু কি ঝপ্পি মার্কা আন্দোলন আরম্ভ হলেও পরে তা হিংসার আশ্রয় নিতে থাকে। কেরি নেশন নামে এক মধ্যবয়স্ক মহিলা অদ্ভুত ভাবে হাতে কুড়ুল নিয়ে বেরোতে লাগলেন। সামনে মদের বোতল দেখলেই কুড়ুলের ঘা মেরে তা ভেঙে দিতেন। আসলে মদের মাত্রাতিরিক্ত নেশার কবলে পড়ে ওঁর পরিবার একেবারে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। তাই একটা ভয়ানক প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করত। পাগলের মতো উনি বারগুলোতে আক্রমণ চালাতেন। কেরি নেশন একাধিকবার এসব কারণে গ্রেফতার হয়েছেন। আবার ছাড়া পেতেই কুড়ুল নিয়ে বেরিয়েছেন। এবং ওঁকে দেখাদেখি অন্যান্য মহিলারাও কুড়ুল নিয়ে শুঁড়িখানাগুলোতে আক্রমণ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন।

যা আজকের দিনেও হচ্ছে, তা তখনও চলত—সরকার মদের দাম থেকে মোটা টাকা ট্যাক্স পেত। আমেরিকার প্রথম পাঁচটি সবথেকে বড় ব্যবসার মধ্যে মদের ব্যবসাটাও গণ্য হতো। অ্যাডলফ বুশের মতো মদ্য-ব্যবসায়ীর পকেটে তখন বেশ কয়েকজন সেনেটর। ক্ষমতার ব্যাপারটা আশা করি বোঝাতে পারলাম। কিন্তু এসবের ওপরে উঠতেই হবে। আমেরিকার প্রশাসন ভাবছিল যদি আয়কর বাড়িয়ে দিয়ে মদের ব্যবসাটাই বন্ধ করে দেওয়া যায়, তাহলে করের ঘাটতির বোঝা কমানো সম্ভব হবে। এই একই রকমের কথা পরে গান্ধীজি বলেছেন। ভারতে যখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, তখন তিনি প্রস্তাব দেন যে, মদের কেনাবেচা বন্ধ করে করের ঘাটতি আয়কর বাড়িয়ে দিয়ে পূরণ করা হোক। হেনরি ফোর্ড, কার্নেগীর মতো পুঁজিবাদীরা আবার মদ বন্ধ করে দেওয়াটাকে সমর্থন করলেন। স্বাভাবিক কারণ—মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকলে তাঁদের কারখানাগুলোতে প্রোডাকশনে প্রভাব পড়ত।

নানা কথা চলছিল। আন্দোলন হচ্ছিল। কিন্তু কাজ এগোচ্ছিল না। এইসব কিছুর ওপরে শেষ পেরেক বসাল জার্মানির আক্রমণ। যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি আমেরিকার সঙ্গে সরাসরি ভিড়ে বসল, তখন সারা মার্কিন মুলুক বলল—‘জার্মান-সংস্কৃতির বিরোধ চাই।’ আমেরিকার মুকে জার্মানদের বোই জ্বালানো হল। তাদের হত্যা করা হল, তাদের মদের দোকান ভেঙে জ্বালিয়ে দেওয়া হল।

আর তখনই সুযোগ বুঝে এক প্রচণ্ড রাষ্ট্রবাদী জিগির তুলে ধরা হল—‘বলো, তোমরা জার্মান মদ পছন্দ করো নাকি আমেরিকার মাটি?’

হাজার –হাজার মহিলা মদ্যপানের বিরোধ করে ওয়াশিংটনের বুকে মিছিলে হাঁটলেন। আমাদের গুজরাত বা বিহার রাজ্যের শরাব-বন্দির বহু-বহু বছর আগে আমেরিকা তার সংবিধানে সংশোধন করে মদ বন্ধ করে দিল।

আইনের বইতে অনেক কিছুই লেখা হয়, সব মানা হয় কি? এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। শিকাগোতে গুলি চলল। লুকিয়ে মদ বিক্রি করার দলগুলো সক্রিয় হয়ে উঠল। নিউইয়র্ক শহরের একটি বেশ্যালয়ের বাউন্সার, ইতালিয়ান অরিজিনের আল কাপোন শিকাগর মদ-মাফিয়া জন টোরিয়োর বডিগার্ড হয়ে গেল। এবং এই আল কাপোন পরে নিজের সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে শেষ করতে-করতে একটা সময়ে মদ-মাফিয়াদের গডফাদার হয়ে যায়। ক্ষমতার কাছে থাকা লোকেরা তার বন্ধুত্ব গ্রহণ করল। শিকাগোর মেয়র থেকে শুরু করে ‘পাপা জো’ কেনেডি (রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির পিতা) সবাই তার বন্ধু হলেন। মাফিয়ার শক্তি বাড়ছিল। এবং এতটাই বৃদ্ধি পাচ্ছিল যে, কয়েক দশক পরে মাফিয়াই ঠিক করতে চলেছিল যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হবে—কৌন বনেগা রাষ্ট্রপতি!

আর এই মহাপর্বের পরে এল বিশ্বের সবথেকে বড় অর্থনৈতিক মন্দা—দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন!

(ক্রমশঃ)