বিধাতার হাতে লেখা গান – ৩১

অভীক মুখোপাধ্যায়

(ত্রিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৩১

বিশ্বের অন্যতম সেরা উক্তির সারিতে জায়গা পেয়েছে প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেওয়ার পর জন এফ কেনেডির ভাষণ — ‘আস্ক নট, হোয়াট ইয়োর কান্ট্রি ক্যান ডু ফর ইউ — আস্ক হোয়াট ইউ ক্যান ডু ফর ইয়োর কান্ট্রি।’ জিজ্ঞেস কোরো না দেশ তোমার জন্য কী করতে পারে — বরং নিজেকে প্রশ্ন করো, তুমি দেশের জন্য কী করতে পারো?

ভারত বা ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী নিজের রাজনৈতিক দল থেকেই নিজের মন্ত্রীসভার সদস্যদের চয়ন করেন। আর আমেরিকায় তো প্রধানমন্ত্রী নামক পদটাই নেই। রাষ্ট্রপতি, উপ – রাষ্ট্রপতি এবং পনেরো জন মন্ত্রী (সেক্রেটারি) নিয়ে গঠিত হয় মার্কিন – মণ্ডলী। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি দুটি দল থেকে উপযুক্ত ব্যক্তিদের সেক্রেটারি হিসেবে বেছে নেন। জন এফ কেনেডি প্রতিরক্ষা এবং অর্থমন্ত্রকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ নিজের প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান পার্টির সদস্যদের দিয়েছিলেন। সেক্রেটারি পোস্টের জন্যে কিন্তু মার্কিন সংসদের বাইরে থেকেও কাউকে বেছে নেওয়া সম্ভব। যেমন কেনেডির মন্ত্রীমণ্ডলে থাকা প্রতিরক্ষা সচিব (মন্ত্রীই) কিন্তু সাংসদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন ফোর্ড মোটর কোম্পানির অধ্যক্ষ তথা বিপক্ষের রিপাবলিকান পার্টির সদস্য। তবে কেনেডি তাঁকেই বেছে নিয়েছিলেন। ভোটের আগে পক্ষ – প্রতিপক্ষের মধ্যে যত কাদা ছোঁড়াছুড়িই হোক না কেন, ভোট মিটে গেলে কিন্তু আমেরিকায় সকলে মিলে দেশ মেরামতির কাজে লেগে পড়ে।
মার্কিন মুলুকের আরেকটা নিয়ম হল রাষ্ট্রপতি কিন্তু সংসদের সদস্য নন। তিনি সংসদেও বসেন না। হ্যাঁ, কোনও নির্দিষ্ট আমন্ত্রণে অবশ্যই তিনি সংসদে আসতে পারেন, অন্যথা সদনে রাষ্ট্রপতির কোনও প্রকার মুরুব্বিপণা চলবে না। বিল পাস হয়ে অন্তিম সই হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে চলে যাবে। এসব ব্যাপারে ভারতের রাষ্ট্রপতির পদাধিকারের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাতে কার্যপালিকা শক্তি বা একজিকিউটিভ পাওয়ার অনেক বেশি। সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণে থাকে। ওঁর ক্যাবিনেট ওঁর সহযোগী। বিভিন্ন সংস্থার নিযুক্তিকরণ, আর্থিক বাজেট, বিদেশনীতি, দেশের আভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, এবং একতরফা সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকে। প্রেসিডেন্ট অব আমেরিকা হলেন আমেরিকার সি ই ও। বিশ্ববাসীর কাছে মার্কিন রাষ্ট্রপতিই আমেরিকার মুখ।

জন এফ কেনেডির ক্যাবিনেট নাহয় তৈরি হয়ে গেল, কিন্তু ভাই ববি কেনেডি? তিনি কী হলেন?

রাষ্ট্রপতি কেনেডি কিন্তু নিজের ভাই ববির ওপরে বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিলেন। ববির বয়েস তখন মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর। রাজনীতির ক্ষেত্রে এটাকে নিতান্ত কাঁচা বয়েস ছাড়া আর কী বলি বলুন তো? তবে এই বয়েসেই ববি একজন দক্ষ সঞ্চালক হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া পাপা জো চাইছিলেন — এত খরচ করেছি, ববিও প্রচুর খেটেছে, ও -ও কিছু একটা হোক। ববি নিজে অবশ্য মিডিয়ার সামনে অন্য কথাই বলছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, তিনি পরিবারতন্ত্রের বিরোধী। এসব ভাই – ভাইপোবাজি চলবে না। তিনি কোনও পদে থাকতে চাইছিলেন না। কিন্তু নিয়তি চাইলে পদ যে মিলবেই। জন এফ কেনেডি তখন অ্যাটর্নি জেনারেলের পদের জন্যে একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে খুঁজছিলেন। দুজনকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও তাঁরা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেন। অবশ্য নিন্দুকে বলে, এগুলো নাকি সবই নাটক ছিল। ববিকে অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই গৃহীত হয়েছিল বলে গুজব উঠল। আমেরিকার দুটি অন্যতম শক্তিশালী পদে দুই ভাই জমিয়ে বসলেন।

ববি ওকালতি পাস করেছিলেন, কিন্তু একটি দিনের জন্যেও কোর্টকাছারির দোরগোড়ায় যাননি। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁকে অ্যাটর্নি জেনারেল বানিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ভয়ানক বিরোধিতা করা হল। কেনেডি মজার সুরে মিডিয়ার সামনে বললেন — ‘কয়েক বছর অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে থাকলে আগামীদিনে ওকালতি করতে সুবিধে হবে।’

জন মজা করে যা-ই বলে থাকুন না কেন, ববি কেনেডি কিন্তু আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসে যোগ্যতম অ্যাটর্নি জেনারেল রূপে জায়গা করে নিয়েছেন। টাইম ম্যাগাজিন একটি তালিকা জারি করেছিল। সেখানে ববি এক নাম্বারে ছিলেন। ববি সম্পূর্ণ চালচিত্র বদলে দিয়েছিলেন। দিন-রাত কাজের মধ্যে থাকতেন। ওঁর বিভাগীয় কর্মীরা বলেছিলেন, এমন পরিশ্রমী এবং সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ তাঁরা তার আগে বা পরে কখনোই দেখেননি। যদি পরবর্তীকালে ভোটপ্রচারে বেরিয়ে ববি নিহত না হতেন, তাহলে হয়তো আমেরিকার রাষ্ট্রপতির আসনে উনিই বসতেন। যাই হোক, সেসব অবশ্য অনেক পরের কথা। আমরা আবার লাইনে ফিরি।

জ্যাক ভোটে জেতার পরেও রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ারের সঙ্গে স্কখাত করতে গেলেন। আইজেনহাওয়ার হোয়াইট হাউসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাথায় সেই ট্রেডমার্ক টুপি ছিল। কেনেডি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে শেকহ্যান্ড করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আর মিডিয়া সেটাকেই একটা দুর্দান্ত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়ে বলে দিল, আগামী আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ঠিক এতটাই এনার্জেটিক।

আইজেনহাওয়ার প্রথমদিন দেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বললেন। মিডিয়ার সামনে কথা হচ্ছিল। আইজেনহাওয়ার বলেছিলেন — ‘পরদিন তোমার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই, মিডিয়ার সামনে নয়।’

সময়ে – সময়ে যখন যিনিই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তখনই তাঁর কাছে এমন কিছু গুপ্ত সংবাদ বা তথ্য থেকেছে যা তিনি উপ – রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও শেয়ার করেননি। যেমন রুজভেল্ট নিজের উপ – রাষ্ট্রপতিকে এটম বোমা সংক্রান্ত তথ্য গোপন করেছিলেন। এটা একেবারে টপ সিক্রেট বিষয়, যা একজন রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র পরের রাষ্ট্রপতিকেই বলে যাবেন। আইজেনহাওয়ার একান্তে কেনেডিকে বলেছিলেন, ‘মিসাইল – রেসে আমেরিকা পিছিয়ে রয়েছে এই কথা বলে তুমি ভোটে জিতেছ। মিডিয়া, জনতা আর নিক্সন জানে যে আমরা সত্যিই পিছিয়ে আছি। শুধুমাত্র ভোটে জেতার জন্যে আমি তো আর এই রহস্যের কথাটা বাইরে বলে দিতে পারতাম না যে আমরা সত্যিই পেছিয়ে নেই। সোভিয়েতের সমস্ত গোপন ছবির ফাইল আমি তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি। ওদের কাছে সত্যিই কিছু উন্নতমানের মিসাইল আছে, তবে আমরাও বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র লুকিয়ে রেখেছি। গুণলে পরে দেখা যাবে ব্যাপারটা সমানে –সমানে চলছে।’

কেনেডি একথা শুনে খুশিই হলেন। প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু যদি আমাদের ওপরে পরমাণু – আক্রমণ করা হয়?’

‘তোমার হাতেও অসীম শক্তি আছে। যদি এখুনি আমাদের ওপরে আক্রমণ হয়, তবে কি হবে দেখতে চাও?’

কেনেডিকে কিছু বলার সুযোগ না-দিয়েই আইজেনহাওয়ার ফোন তুলে বললেন — ‘ওপল ড্রিল থ্রী!’

ফোন রাখতে –না – রাখতেই কেনেডি আর আইজেনহাওয়ারের সামনের লনে একটি সামরিক হেলিকপ্টার এসে পড়ল। অবাক কেনেডির চোখ তখন চকচক করছে।

কেনেডির কাঁধে হাত রেখে আইজেনহাওয়ার বলেছিলেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তুমি একজন সফল রাষ্ট্রপতি হবে।’

পরের মাসেই নিকিতা ক্রুশ্চেভ কেনেডিকে বার্তা পাঠালেন — ‘আমেরিকার নতুন রাষ্ট্রপতিকে শুভকামনা জানাই। শুনেছি, আপনি বেশ ভালো মানুষ। আপনাদের দুজন পাইলট গতবছর আমাদের দেশে গুপ্তচরবৃত্তি করতে এসেছিল, ধরা পড়ে যায়। উপহার হিসেবে আপনার কাছে ফেরত পাঠাচ্ছি। যদি নিক্সন রাষ্ট্রপতি হতেন, তাহলে কখনোই ওদের ফিরিয়ে দিতাম না।’

উপহার! মন খুশি করে দেওয়ার মতোই উপহার! আমেরিকা ভাবছিল, যাক শীতযুদ্ধ শেষ হতে চলেছে। কিন্তু কোথায় কী? পিক পয়েন্ট তো এবার আসার পালা ছিল। কিউবা হয়ে।

(ক্রমশঃ)