বিধাতার হাতে লেখা গান – ৩৯

 অভীক মুখোপাধ্যায়

(অষ্টত্রিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৩৯

ওই তেরো দিন ছিল ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম তেরোটি দিন। বিশ্বযুদ্ধ আর শীতযুদ্ধের পার্থক্য একটাই — বিশ্বযুদ্ধে জানা ছিল যে এই যে হামলাটা হল এটা হল অ্যাকশন বা ক্রিয়া, এবার আসবে এর প্রতিক্রিয়া বা রিয়েকশন, আর শীতযুদ্ধে মানুষ চব্বিশ ঘণ্টা এই ভয়ে কাটাত যে এই বোধহয় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল। অবশ্য এই ভয়টা অমূলক ছিলও না।

আমেরিকা ইতালি আর তুরস্কতে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র সেট করে ফেলেছিল। সেখান থেকে নিশান দাগা যাবে সোভিয়েতের বুকে। সোভিয়েতের কাছেও বোমা ছিল, আমেরিকার থেকে বেশি শক্তিশালী মিসাইল ছিল। আসলে খেলাটা ছিল টেক্সাসের কাউবয় মুভির মতো, বন্দুক তো দুপক্ষের কোমরেই ঝুলছে — যে যত আগে বের করতে পারবে জয় তারই হবে।

সোভিয়েতের কাছে বেশ ভালো পাল্লার দূরত্ব অতিক্রমকারী মিসাইলই ছিল, যা এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে গিয়ে আঘাত হানতে পারে, কিন্তু তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিল হাওয়াই কিংবা আলাস্কা অবধি পৌছতে পারা। আমেরিকার নাভিস্থলে আঘাত করার মতো ব্যবস্থা কিছুতেই করা যাচ্ছিল না। তখন পরিস্থিতি ঠিক কী দাঁড়িয়েছিল বলুন তো, আমেরিকা চাইলেই এক চাপে ক্রেমলিন গুঁড়িয়ে দিতে পারত, কিন্তু সোভিয়েত বসে – বসে হোয়াইট হাউজে আঘাত হানতে পারত না। প্লেনে বোমা তোলো রে, প্লেন ওড়াও রে, সেই বোমা নিয়ে আমেরিকার মাথার ওপর থেকে ফেলো রে…অনেক জ্বালা রে, ভাই।

এইসব ডামাডোল যখন চলছে, তখন ফিদেল কাস্ত্রো ঘুরতে গেলেন সোভিয়েত রাশিয়াতে। কাস্ত্রোকে আমেরিকা সবসময় মারার চেষ্টা করত। এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট চাইলে যে কোনও সময়ে কিউবাকে পৃথিবীর বুক থেকেই মুছে দিতে পারতেন। কিন্তু এসব ঘটেনি। না – ঘটার অন্যতম কারণ হল কিউবা তথা কাস্ত্রোর প্রতি সোভিয়েত সদা সর্বদা বরাভয় মুদ্রা নিয়ে বসে থাকত। এখানে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, যে সোভিয়েত হোয়াইট হাউজে বোমা দাগতে পারবে না, সে আমেরিকার কী ক্ষতি করবে? আরে মশাই করতেই পারে, হোয়াইট হাউজ না – পারুক তারা জার্মানির বার্লিনকে তো উড়িয়ে দিতেই পারে। বার্লিনের মতো অজস্র শহর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন অর্থে ফুলেফেঁপে উঠছিল। ওই শহরগুলোই ছিল মার্কিন পুঁজিবাদের অন্যতম কেন্দ্র। উন্নতির উৎস। কাকের বাসায় যেমন কোকিলের বাচ্চা বড় হয়, সেভাবেই ইউরোপের কোলে বড় হচ্ছিল আমেরিকার অর্থনীতি।

তো যেটা বলছিলাম, কাস্ত্রো গিয়ে বললেন, সোভিয়েত চাইলে কিউবাকে নিজেদের নিউক্লিয়ার বেস বানাতে পারে। তাহলে এক ঢিলে দুটো পাখি মরবে — এক, কিউবা সুরক্ষিত হয়ে উঠবে। এবং দুই, সোভিয়েতের নাগালে চলে আসবে আমেরিকা। কিউবা থেকে মিসাইল অ্যাটাক করে আমেরিকার যে কোনও শহরের যে কোনও ইমারতকে বিধ্বস্ত করা সম্ভব। আর যদি সেই আক্রমণকে পারমাণবিক আক্রমণে পরিণত করা যায় তবে তো কোনও কথাই নেই। প্রস্তাব শুনে ক্রুশ্চেভের সে কী আনন্দ! এ তো সোনায় সোহাগা! এ যে মেঘ না – চাইতেই জল! কিন্তু মিসাইল তো আর এমন কোনও জিনিস নয় যে খামে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। সোভিয়েত থেকে বিশাল জাহাজে টন – টন ওজনের মিসাইল তুলে কিউবার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়াটা সহজ কাজ ছিল না।

সোভিয়েত একটু অন্যরকম চাল চালল। ১৯৬২ সালে আগস্ট – সেপ্টেম্বর মাসে সোভিয়েত থেকে কিছু কৃষি বিশেষজ্ঞ কিউবা গেলেন। তাঁরা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি। কৃষি নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছিলেন। এই কৃষি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কিন্তু সোভিয়েত আরও একটি দলকে পাঠিয়েছিল। তাদের পোশাক ছিল এস্কিমোদের মতো। আপাদমস্তক মোড়া। সাদা। দেখলে মনে হবে কিউবাতে নয় দক্ষিণ মেরু অভিযানে যাচ্ছে। দুমাস ধরে এভাবে ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রায় ৪৫০০০ সোভিয়েত সৈন্য কিউবাতে গিয়ে নামল। তাদের সঙ্গে গিয়ে পৌঁছল মিগ প্লেন, স্পাই এয়ারক্র্যাফট, বোমারু বিমান। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ কিউবাতে আর – টুয়েল্ভ মিসাইল পৌঁছে গেল। এই মিসাইলের সাহায্যেই পারমাণবিক আক্রমণ করা সম্ভব ছিল।

আমেরিকা তখন একটা ইলেকশন নিয়ে বেশ ব্যস্ত। ব্যস্ত হোক কিংবা না – হোক ব্যস্ততা দেখিয়ে সোভিয়েতের দিকে আর গুরুত্ব দিচ্ছিল না। তবে গুপ্তচরেরা কিন্তু নিজেদের কাজ সমানে করে চলেছিল। আমেরিকার গুপ্তচর বিমান থেকে কিউবার কিছু ছবি তুলে পেন্টাগনে পাঠানো হল। পেন্টাগনের কর্তারা সেইসব ছবি দেখে চমকে উঠলেন। ছবিগুলো কেনেডিকেও দেখানো হল। মিসাইল লাগানোর কাজটা সেরে ফেলেছিল কিউবা আর সোভিয়েত। তারমানে যে কোনও দিন, যে কোনও মুহূর্তে আমেরিকাকে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল।

ইউনাইটেড নেশনস-এ মার্কিন রাজদূত স্টিভেনসন সোভিয়েত প্রতিনিধিকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন — ‘আপনাদের মিসাইল কি কিউবাতে রয়েছে? হ্যাঁ কিংবা না-তে সরাসরি উত্তর দিন। এখুনি বলুন।’

‘শুনুন মশাই, এটা আপনার আমেরিকান কোর্ট নয় যে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা অপরাধীর মতো জবাবদিহি করব। আপনার প্রশ্নের উত্তর যথাসময়ে পেয়ে যাবেন।’

‘হ্যাঁ নাকি না? সারা বিশ্ব দেখছে। এসব বাজে কথা বলে পাড় পাবেন না।’

‘না। আমি যদ্দূর জানি ওগুলো সব ডিফেন্সিভ মিসাইল। আমেরিকা যদি কিউবাকে অ্যাটাক করে, তখন কিউবার সুরক্ষার কাজে লাগবে। আক্রমণ করার জন্যে নয়।’

‘তাহলে কিউবাতে কোনও পরমাণু বোমা নেই?’

‘না, নেই।’

সোভিয়েত রাজদূত কিন্তু সেদিন মিথ্যে বলেনওনি। কারণ তখনও পর্যন্ত কিউবাতে কোনও পরমাণু বোমা গিয়ে পৌঁছয়নি। এবং যদি সোভিয়েত রাজদূতের অগোচরে নিয়ে যাওয়া হয়েও থাকে, তিনি তা জানতেন না। সোভিয়েত এসব কথা যতই চাপুক, কিউবা চেপে রাখতে পারছিল না। জা হয় — নির্ধনের ধন হলে দিনে দেখে তারা। কিউবা লম্বাচওড়া কথা বলতে শুরু করে দিয়েছিল।

অক্টোবর মাসে কিউবার রাষ্ট্রপতি বলে বসলেন, ‘আমাদের কাছে এমন ক্ষমতা আছে যে আমরা এবার আমেরিকাকে ধ্বংস করে দিতে পারি।’ রাষ্ট্রপতি মানে কিন্তু কাস্ত্রো নন। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতির নাম ছিল ওসবালদো।

কেনেডি এবার ক্রুশ্চেভকে ধরলেন। ক্রুশ্চেভ বললেন যে, খবর মিথ্যে নয়। সোভিয়েতের পরমাণু বোমা কিউবাতে পৌঁছে গেছে নাকি পৌঁছবে সেটা বলব না। কিন্তু এটুকু বলছি যে সোভিয়েত আমেরিকা আক্রমণ করবে না, আপনারাও কিউবাকে অ্যাটাক করতে যাবেন না।

কেনেডির হাতে তখন অল্প অপশন।

এক, কিউবাকে আক্রমণ করা যেতে পারে, তাহলে সোভিয়েতের কাছ থেকে বদলা নেওয়াই হয়।

দুই, আন্তর্জাতিক রাজনীতির আঙিনায় চাপ সৃষ্টি করে ক্রুশ্চেভকে কিউবা থেকে অস্ত্র সরাতে বাধ্য করা।

আরও একটি বিকল্প অবশ্য ছিল। কোয়ারান্টাইন কিউবা — তৃতীয় বিকল্প।

কেনেডি তৃতীয় বিকল্পটিকে বেছে নিলেন। কিউবার সমুদ্রপথকে ঘিরে ফেললেন। তাঁর নির্দেশ ছিল, যে জাহাজ কিউবাতে যাবে, তাকে থামিয়ে পরীক্ষা করে তবেই ঢুকতে দেওয়া হবে। পারমাণবিক অস্ত্রে সুসজ্জিত রণতরীরা কিউবার পরিধি বরাবর চক্রব্যূহ বানিয়ে ফেলেছিল। সেই ব্যূহের কেন্দ্রে বসে কাস্ত্রো এমারজেন্সি ঘোষণা করলেন।

ওদিকে সোভিয়েতের মাটি থেকে পারমাণবিক অস্ত্রে ভর্তি একটি জাহাজ রওনা দিল কিউবার দিকে। অথোরিটির নির্দেশ ছিল, যে –ই কেউ জাহাজকে আটকানোর চেষ্টা করবে, তক্ষুনি পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ করে দেবে। ক্যারিবিয়ান মহাসাগরের বুকে বিশ্বের দুই মহাশক্তি মুখোমুখি সংঘর্ষের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পৃথিবী দেখতে চলেছিল এক সম্ভাব্য নিউক্লিয়ার হলোকাস্ট। তৃতীয় তথা ভয়ঙ্করতম বিশ্বযুদ্ধের রণদামাম বাজছিল।

এটা চলছিল একধারে। অন্য ধারে এশিয়ার দুই বড় শক্তির মধ্যে ঝঞ্ঝা ঘনাচ্ছিল ক্রমশ। বিশ্বের একপ্রান্তে মুখোমুখি হতে চলেছিল আমেরিকা আর সোভিয়েত, অন্য প্রান্তে ভারত আর চিন।

মানব সভ্যতার কপালে তখন শঙ্কার ছাপ।

(ক্রমশ)