সিএবি-র বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, না সন্ত্রাসের রাজত্ব?

0
575

এতদিন দাদু-ঠাকুমাদের মুখে তাঁদের দেশ ছেড়ে পালাবার সময়কার আতঙ্কের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি, কাশ্মীরী হিন্দুদের প্রাণসংশয়ে উপত্যকা ছাড়বার কথা শুনেছি, একাত্তরে রাজাকারদের অত্যাচারে মা-বোনেদের সম্ভ্রম রক্ষা করবার তাগিদে সাতপুরুষের ভিটেমাটি ত্যাগ করবার কথা শুনেছি, এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বিভিন্ন বিবরণ পড়েওছি – কিন্তু যে ভয়ে ভীত হয়ে এঁরা সকলে এইভাবে সহায় সম্বল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই এককাট্টা হয়ে জিহাদি সন্ত্রাস চালানো কাকে বলে তা আজ স্বচক্ষে দেখতে পেলাম।

ঘটনাস্থল শিয়ালদহ-বজবজ লাইনে স্থিত আকড়া স্টেশন, সময় দুপুর পৌনে একটা, তারিখ ডিসেম্বরের ১৫, ২০১৯। আমার স্ত্রীকে সঙ্গে ক’রে দুপুর সাড়ে বারোটার আপ শিয়ালদহ-বজবজ লোকাল ধ’রে যাচ্ছিলাম টালিগঞ্জ, গন্তব্য ছিল শ্বশুরবাড়ি। গতকাল এই একই রুটে লোকাল ট্রেনে চেপে এক আত্মীয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে সপরিবারে গিয়েছি, রাতে আবার ট্রেন ধরেই বাড়ি ফিরেছি। কোথাও কোনো গোলমাল চোখে পড়েনি। কর্মসূত্রে রাজ্যের বাইরে বসবাস করতে শুরু করবার আগে দীর্ঘদিন শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার এই লাইনেই লোকাল ট্রেন মারফত স্কুল-কলেজ-আপিসে যাতায়াত করেছি। এই লাইনে বিশেষ কোনো আন্দোলন-অবরোধের জেরে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হবার কথা তেমন মনে পড়ে না। আজ তাই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় – এমনকী কলকাতার কিছু অংশেও – বিক্ষিপ্ত হিংসার খবর টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে পেয়ে থাকলেও নির্ভয়েই আপ শিয়ালদহ-বজবজ লোকালে চেপেছিলাম। গন্তব্য স্টেশনে নেমে বেরোতে সুবিধে হবে সেকথা মাথায় রেখেই স্ত্রী-সমেত উঠেছিলাম ট্রেনের একেবারে প্রথম কামরায়।

আকড়া স্টেশনে ট্রেন ঢোকবার ঠিক আগে ট্রেনের গতি কিছু শ্লথ হয়ে এলো, আর সেইসঙ্গে কানে এলো ঐ স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের একশো মিটারের মধ্যে অবস্থিত একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রার্থনাস্থল থেকে সজোরে মাইক বাজানোর আওয়াজ। কিছু একটা ঘোষণা করা হ’ল – এবং সেই মুহূর্তেই আচমকা ব্রেক ক’ষে ট্রেনটি দাঁড়িয়ে পড়লো। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম যে প্রার্থনাস্থলের দিক থেকে এবং রেললাইনের অপর পারে স্থিত বসতি অঞ্চলগুলো থেকে শয়ে শয়ে লোক ভীষণ গর্জন করতে করতে ট্রেন ও রেললাইনের দিকে ধেয়ে আসছে। এদের বেশিরভাগ দৌড়ল প্ল্যাটফর্মের দিকে, যেখানে টিকিট কাউন্টার ও স্টেশন সুপারিন্টেনডেন্টের অফিস রয়েছে। আমাদের কামরার লোকজন বেশ ভয় পেয়ে কামরার দরজা ও জানালার ঝাঁপি বন্ধ করবার চেষ্টা দেখতে লাগলেন। কিছু যাত্রী ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ ক’রে কামরা থেকে লাফিয়ে প’ড়ে লাইন ধ’রে ফিরতি পথে দৌড় লাগালেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ঠিক কী চলছে তা বোঝবার চেষ্টা করলাম। দেখি স্টেশন চত্বরে প্রচুর লোকের ভিড়, আর সেইদিক থেকেই মুহুর্মুহু প্রাণ কাঁপানো হুঙ্কার ভেসে আসছে। নিজের আসনে ফিরে এসে রেল পুলিশের সহায়তা লাইনে ফোন করবার চেষ্টা করতে লাগলাম। নম্বর লাগছিল না। বাড়িতে ফোন ক’রে সংক্ষেপে ঘটনাটা জানালাম, এবং তৎক্ষণাৎ পুলিশে যোগাযোগ করতে বললাম।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাড়ি থেকে ফোন এল, জানা গেল যে একটি নম্বর পাওয়া গেছে যেখানে জিআরপি-কে ফোনে ধরা যাচ্ছে। দ্রুত সেই নম্বরে ডায়াল ক’রে ঘটনাটা বললাম। যেকোনো মুহূর্তে প্রাণসংশয় দেখা দেবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবার আশঙ্কা রয়েছে সেকথাও জানালাম। উত্তর পেলাম : “আমরা খবর পেয়েছি, দেখছি।” ফোনের ওপারে থাকা আধিকারিক হয়তো পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন না এই ভেবে আরেকবার তাঁকে ব্যাপারটার গুরুত্ব, কামরায় যাত্রীদের সংখ্যা এবং তাঁদের অসহায় অবস্থার কথা বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করলাম। উত্তর সেই এক : দেখছি, দেখবো। যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য কোনো ফোর্স পাঠানো হয়েছে বা আদৌ হবে কিনা সেরকম কিছু জানালে যেটুকু আশ্বাস পাওয়া যেত, তা-ও মিলল না জিআরপি-র কাছ থেকে। খুব অসহায় লাগতে লাগল। ততক্ষনে কামরার গায়ে দুম্‌ দুম্‌ ক’রে আঘাত করবার আওয়াজ শুরু হয়েছে। আমরা বাকি যাত্রীরা নেমে যাব, নাকি কামরার ভেতরেই ব’সে থাকব ভেবে কূলকিনারা না পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম।

এমন সময় শুরু হ’ল পাথর বর্ষণ। রেললাইনের ধারে প’ড়ে থাকা নিরেট ব্যাসল্ট শিলার সবেগে ছোঁড়া একটি সামান্য টুকরোও যেকোনো সবল মানুষকে গুরুতর জখম করতে, এমনকী তাঁর প্রাণহানির ঘটাতেও যথেষ্ট। কল্পনা করুন ঐ পাথরের মুহুর্মুহু বর্ষণ, ট্রেনের একেবারে সামনের কামরায় – যেখানে চালককে লক্ষ্য ক’রে পাথর ছোঁড়া হচ্ছে, আর পাথরের অনেকগুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কামরার দরজা জানলায় এসে আঘাত করছে। যেকোনো সময় তা যাত্রীদের গায়ে এসে লাগতে পারে। কামরায় আমরা সকলেই মাথা নিচু ক’রে মেঝেতে বসে প’ড়ে নিজেদের বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করতে লাগলাম। কামরায় তরুণ ও মাঝবয়েসি পুরুষ-মহিলা যাত্রী ছাড়াও বেশ কিছু প্রবীণ পুরুষ ও মহিলা যাত্রী ছিলেন। সবমিলিয়ে জনা চল্লিশেক যাত্রী হবে। ঠিক কতক্ষণ এইরকম প্রস্তরবর্ষণ চলেছিল ঠাওর করতে পারিনি। মানুষ সন্ত্রস্ত হ’লে সময়ের হিসেব গুলিয়ে যায়। দু-তিন মিনিটও হ’তে পারে, তার বেশিও হ’তে পারে। কিন্তু মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল। ঐ সময় কয়েক মুহূর্তের জন্য একথাও মনে উদয় হয়েছিল যে আজ এই পরিস্থিতি থেকে বোধহয় আর বেঁচে ফেরা সম্ভব হবে না।

একসময় পাথরবৃষ্টির প্রাবল্য কিছুটা কমতেই কামরার দরজা খুলে বেশ কয়েকজন যুবক উঠে এলো। কামরায় উঠেই তারা আমাদের অর্থাৎ যাত্রীদের লক্ষ্য ক’রে কামরা থেকে নেমে যেতে বলল। আমরা ইতস্ততঃ করতে লাগলাম। এহেন অবস্থায় কাকেই বা বিশ্বাস করা যায়? ট্রেন থেকে নেমে গেলে লাইন ধ’রে পিছু হটা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সামনের দিকে, অর্থাৎ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দিকে এগোবার প্রশ্নই ওঠে না। কোনোরকমে দরজা দিয়ে বাইরের দিকে একবার মাথা গলিয়ে স্টেশনের দিকে চোখ রাখতেই দুই প্ল্যাটফর্মের মধ্যবর্তী জোড়া লাইনের উপর বিশাল সংখ্যক উন্মত্ত জনতার উচ্ছৃঙ্খল দাপাদাপি, পৈশাচিক হুঙ্কার আর আগুনের হল্কার উপরে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে থাকা কালো ধোঁয়া চোখে পড়ল। শোনা গেল যে রেললাইনে টায়ার জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে কামরায় উঠে আসা যুবকেরা ক্রমাগত ব’লে চলেছে ‘নেমে যান, নেমে যান!’ মনে সন্দেহ হচ্ছিল, এদের কোনো দুরভিসন্ধি নেই তো? আর তাছাড়া ট্রেনের কামরা থেকে নেমে যাবার পর উন্মত্ত জনতা যে আমাদের ক্ষতি করতে উদ্যত হবে না, নিরাপদে শান্তিপূর্ণভাবে যেতে পথ ছেড়ে দেবে তার গ্যারান্টি কোথায়? স্টেশন ঘিরে ধ’রে যারা তাণ্ডবে রত সেই রণোন্মত্ত, হুংকার ছাড়তে থাকা জনতাকে দেখে তো অন্ততঃ কোনোভাবেই সে আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে না। যাইহোক, যাত্রীদের নেমে যেতে বলা আর একইসঙ্গে মধ্যে মধ্যে পাথর ছোঁড়া চলতে থাকায় ধ’রে নিলাম যে যাত্রীদের নামিয়ে দেবার পর ঐ কামরাসহ গোটা ট্রেনটিতে ভাঙচুর চালাবার মতলব থেকে থাকতে পারে। তাই ইষ্টদেবতাকে স্মরণ ক’রে নেমে পড়বার সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলাম। নামবার আগে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা প্রবীণ নাগরিকদের দিকে দেখিয়ে ট্রেনে উঠে আসা যুবকদের বললাম : “দাদা, আমরা তো তাও কোনোমতে লাফিয়ে নামার চেষ্টা করতে পারি; কিন্তু এই বুড়ো মানুষজনের কী হবে? ওঁরা তো এভাবে নামতে পারবেন না।” যুবকগুলো ওকথা যেন শুনেও শুনল না। তাদের মুখে এক রা : “নেমে যান, নেমে যান”।

দেখলাম যে কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু যুবক একদিকে আমাদের অসহায় অবস্থা আর অন্যদিকে স্টেশন চত্বরে ঘটতে থাকা তাণ্ডবের দৃশ্য খিলখিল ক’রে হাসতে হাসতে মোবাইলের ভিডিও ক্যামেরায় রেকর্ড করছে। অগত্যা আমি নামার তোড়জোড় শুরু করলাম। ট্রেনের পাদানি থেকে শুরু ক’রে নীচে এবড়োখেবড়ো পাথর-বিস্তীর্ণ লাইনের মধ্যে প্রায় দেড়-মানুষ সমান উচ্চতার ব্যবধান। লাফিয়ে নামতে চেষ্টা করলে একজন সুস্থ সবল যুবকেরও পা হড়কে গুরুতর চোট পাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পাথর বর্ষণ আর হিংস্র জনতার গর্জন, আগুন আর কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী – সব মিলিয়ে তখন বুক দুরুদুরু করছে। উপায়ান্তর না দেখে ঐ অবস্থাতেই লাফিয়ে রেল ট্র্যাকে নামলাম। স্ত্রী সঙ্গে থাকায় ঐ পরিস্থিতিতে তাঁর সুরক্ষার কথা চিন্তা ক’রে ভয় দ্বিগুণ হয়েছিল।

স্ত্রীকে কামরা থেকে নামতে সাহায্য ক’রে রেললাইনের পাশের সমতল জমিতে পা রাখতে না রাখতেই আরেকপ্রস্থ ভয়ঙ্কর হুঙ্কার শুনতে পেলাম, আর সেইসঙ্গে দেখলাম শ’খানেক লোক স্টেশনের দিক থেকে ছুটে আমাদের দিকে আসছে। মুহূর্তের আশঙ্কা কাটল যখন দেখলাম আমাদের ছাড়িয়ে ঐ জনতা আরও দূরের পানে পলায়নপর। দেখে অবাক হলাম যে এদের বেশিরভাগই কিশোর ও যুবক, যাদের অনেকেরই বয়েস খুব সম্ভবতঃ চৌদ্দও পেরোয়নি। আমরাও এদের মধ্যে মিশে ছুটতে শুরু করলাম। কোথায় যাচ্ছি জানা নেই – ছুটতে ছুটতে এদেরই মধ্যে একটি ছেলেকে কী ঘটেছে জিজ্ঞাসা করায় সে বললে যে র‍্যাফ নেমেছে, তাই সকলে পালাচ্ছে। শুনে ঐ অবস্থাতেও মনে খানিক স্বস্তি পেলাম। পর মুহূর্তেই মনে হ’ল যে র‍্যাফের তাড়া খেয়ে পালাতে থাকা ক্ষিপ্ত জনতা আমাদের উপর চড়াও হ’তে পারে – এমনকী র‍্যাফ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়লে আমরাও আক্রান্ত হতে পারি। যাই হোক, উপায়ান্তর না দেখে আমরা বসতি অঞ্চলের দিকে লক্ষ্য ক’রে ছুটতে থাকি। একটি গলির মধ্যে এসে পড়বার পর বাড়িঘরের দরজা জানালা দিয়ে উঁকি মারতে থাকা কৌতূহলী মহিলাদের জিজ্ঞেস ক’রে জানতে পারি যে সেখান থেকে আরো মিনিট পনেরো হেঁটে গেলে ডাকঘর মোড়ে মূল রাস্তা অর্থাৎ বজবজ ট্রাঙ্ক রোডে গিয়ে পড়া যাবে।

নোংরা খোলা নর্দমা এবং কাদায় প্যাচপ্যাচে সরু গলিপথের উপর দিয়ে দৌড়নো দূর, হাঁটাই দায়। তবুও আমরা বিস্তর গলিঘুঁজি পেরিয়ে অবশেষে দুটি বাড়ির মধ্যে দিয়ে বড় রাস্তার কিছুটা অংশ দেখতে পেলাম। এ রাস্তাটি হ’ল আকড়া স্টেশন রোড, যেটি গিয়ে শেষ হয়েছে আমাদের গন্তব্য ডাকঘর মোড়ে। ঐ ব্যবধান দিয়েই লক্ষ্য করলাম বড় রাস্তা থেকে বাইক আরোহীর দল সরু গলির ভেতরে ঢুকে আসবার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। নিঃসন্দেহে র‍্যাফের ভয়ে। আমরা দুজন গলির মুখে দাঁড়িয়ে, সঙ্গে ছিলেন আরও দু-চারজন ট্রেনযাত্রী যাঁরা ঐ হিংস্র জনতার রোষ থেকে বাঁচতে পালিয়ে মতই ডাকঘর মোড়ে যাবার পথ খুঁজছিলেন। নিজেদের কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো মনে হ’তে লাগল। নিজেদের নিরুপায় অবস্থার কথা ভেবে দুষতে ইচ্ছে করল আমাদের, অর্থাৎ হিন্দু বাঙালিদের অপ্রস্তুত অবস্থাকে, সংগঠিত-সঙ্ঘবদ্ধ হবার চেষ্টার অভাবকে, আর সেইসঙ্গে আমাদের কুখ্যাত আত্মবিস্মরণ-জাত গা-ছাড়া মনোভাবকে। আজ যা কিছু ঘটছিল তার মূলে এই-ই রয়েছে। কাজেই অন্য সম্প্রদায়বিশেষের দোষ খুঁজে লাভ নেই। তারা নিজেদের আদর্শ ও স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করে চলেছে মাত্র। তাদের লক্ষ্য স্থির। আমাদের লক্ষ্য স্থির হওয়া তো দূর – লক্ষ্যটা যে ঠিক কী অধিকাংশ বাঙালি হিন্দুর তা-ই জানা নেই।

কয়েকটি রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত কাটল। দেখলাম বাইক আরোহীরা র‍্যাফের ভয়ে যে যার পথ দেখছে। আমাদের দিকে তাকাবার প্রয়োজন কারুর বোধ হচ্ছে না। সবার ভাবখানা হ’ল : আপনি বাঁচলে বাপের নাম। আমার স্ত্রীয়ের সঙ্গে কথা ব’লে ঠিক করলাম বড় রাস্তা দিয়ে ডাকঘর মোড়ে হেঁটে পৌঁছোবার ঝুঁকিটা নিতেই হবে। ঈশ্বরের নাম নিয়ে গলির মধ্যে দিয়ে বড় রাস্তার দিকে অগ্রসর হলাম। সঙ্গে বাকি যাত্রীরা। গলির শেষ বিন্দুতে পৌঁছে সন্তর্পণে গোলা বাড়িয়ে রাস্তার এদিক-ওদিক দেখলাম। আমার বাঁদিকে রাস্তার শেষ প্রান্তটি যেখানে স্টেশনে গিয়ে মিশেছে, সেখানে আগুন আর সেই আগুন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় চারিদিক আচ্ছন্ন, বাকি কোনোকিছুই ওদিকে চোখে পড়ল না। ডানদিকে তাকাতে দেখতে পেলাম রাস্তায় ইতস্ততঃ লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সবার চোখেমুখে দুটি ভাব – কৌতূহল আর আশঙ্কা। কয়েকজন অত্যুৎসাহী যুবককে দেখলাম, তারা একটি উঁচু অট্টালিকার ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় নীচের ধ্বংসলীলার ছবি অথবা ভিডিয়ো ধ’রে রাখতে ব্যস্ত। এদের চেহারায় কেবলই কৌতুক আর কৌতূহল, আশঙ্কার লেশমাত্র নেই। ভঙ্গিটা শীতের দুপুরে রোদ পোহাতে পোহাতে মজা লুটবার।

আমরা ক’জন ট্রেনের যাত্রী বড় রাস্তায় নামলাম। র‍্যাফ টহল দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর রাস্তা শুনশান। যে দু-চারজন স্থানীয় লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আবার জটলা পাকাবার চেষ্টা করছিল তাদের এড়িয়ে আমরা দ্রুত হাঁটা লাগালাম। মুখে গালি, হুঙ্কার আর শরীরে আগ্রাসী ভঙ্গি দেখালেও কেউ আমাদের দিকে এগোতে সাহস করল না। এদের বেশিরভাগই বোঝবার চেষ্টা করছিল র‍্যাফ ওদিকে টহল দেওয়া সেরে এদিকে আবার ফিরবে কিনা। মতলবটা  পরিষ্কার : তেমনটা না ঘটলে এদের মধ্যে যারা স্টেশনের দিক থেকে পালিয়ে এসেছে, তারা আবার স্টেশনের দিকেই ফিরে যাবে। একপ্রস্থ ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ দাঙ্গাবাজি ক’রে হয়তো পুরোপুরি তৃপ্তি হয়নি। পথে যেতে যেতে দেখতে পেলাম রাস্তায় আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বেসরকারি বাস। সেটি পেরিয়ে এগোতে গিয়ে চোখে পড়ল চালকের আসনের সামনের কাঁচে ঢিল ছোঁড়বার স্পষ্ট দাগ, আরেকটি জানলার কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে।

আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার দোলাচলের মধ্যে আমরা আকড়া স্টেশন রোড ধ’রে হাঁটতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটবার পর যে পাড়াটা এলো, সেখানে সংখ্যালঘুদের বসত প্রায় নেই বললেই চলে। অপেক্ষাকৃত শান্ত পরিবেশ, হিংসার চিহ্ন নেই। লোকজন উৎসুক হয়ে রাস্তার ধারের বাড়িঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে কী ঘটছে তা বুঝে নিতে চাইছে। এঁদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম ডাকঘর মোড় থেকে যাতায়াতের জন্য বাস বা অটো মিলবে কি না। আশাব্যঞ্জক উত্তর মিলল না। অগত্যা হাঁটতে থাকলাম। আরও পাঁচ-সাত মিনিট হাঁটবার পর অবশেষে ডাকঘর মোড়ে বজবজ ট্রাঙ্ক রোডে পৌঁছনো গেল। এই রাস্তাটি বজবজ ও তারাতলার মধ্যেকার একমাত্র সরাসরি সংযোগপথ। ন্যূনতম সময়ে বজবজ থেকে সড়কপথে কলকাতায় পৌঁছতে হ’লে এটিই একমাত্র সুগম রাস্তা। এই রাস্তায় পৌঁছে দেখলাম ডাকঘর মোড়ও ধোঁয়াচ্ছন্ন, রাস্তায় চারিদিকে টায়ার ও কাঠের গুঁড়ি পোড়াবার চিহ্ন। এখানেও যে পুরোমাত্রায় তাণ্ডব করা হয়ে গেছে তা স্পষ্ট। বাস, অটো, ট্যাক্সি – কিছুরই দেখা নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার পর একটি টোটোর (বিদ্যুৎচালিত রিকশা) দেখা মিলল। ওতে আমি, আমার স্ত্রী এবং আরও জনাতিনেক ট্রেনযাত্রী ঠাসাঠাসি ক’রে বজবজের দিকে রওনা দিলাম।

বাড়ি ফেরবার পর থেকে ঐ অভিজ্ঞতা আমাদের দুজনকেই দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া ক’রে বেড়াচ্ছে। আমাদের সামনে কী ঘটেছে, আর আমাদের সঙ্গে কী ঘটে যেতে পারত – সেই চিন্তা নানারকম অপ্রিয় ছবির জন্ম দিচ্ছে দুটো উর্বর মস্তিষ্কের ভিতর। বিশাল সংখ্যক উন্মত্ত হিংস্র জনতার রোষ থেকে প্রাণ হাতে ক’রে বেরিয়ে আসা যে সম্ভব হয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে পরম করুণাময় শ্রীভগবানের অশেষ কৃপা বলেই আমি ম’নে করি। কিন্তু ভারতে যাদের তথাকথিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ব’লে গণ্য করা হয়, সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি সসম্মানে প্রাণ ও সম্পত্তি রক্ষা করবার তাগিদে সংগঠিত হবার চূড়ান্ত অনীহা এবং তজ্জনিত অপ্রস্তুত অবস্থা আরো একবার এই ঘটনায় একেবারে প্রকাশ হয়ে পড়ল।