শ্রীমুরারিমোহন বেদান্ততীর্থ শাস্ত্রী

[মহামহোপাধ্যায় শ্রীমুরারিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বেদান্ততীর্থ শাস্ত্রী, তান্ত্রিকাচার্য কে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করা হচ্ছে এক যুগের ও তার এক অবিস্মরণীয় ঐতিহ্যর যখন সসাগরা ভারতবর্ষে জ্ঞান চর্চার আলোকে বঙ্গভূমি দেদীপ্যমান ছিল. সংস্কৃত ও ন্যায় চর্চার ভূমি হিসেবে নবদ্বীপের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। মহামহোপাধ্যায় দুর্গাচরণ সাংখ্য -বেদান্ত-তীর্থ, শ্রী সত্যব্রত সামশ্রমী, শ্রী শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ, শ্রী গৌরী শাস্ত্রী সেই মহত্তম ধরার সাধক ছিলেন, শ্রীমুরারিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় তার সর্বশেষ প্রতিনিধি বলা চলে।] 

 

সনাতন ঐতিহ্যের প্রতিনিধি প্রয়াত

শুধু পুঁথির পাতায় নয়, “হিন্দুয়ানি’ জড়িয়ে ছিল তাঁর দৈনন্দিনে। সেই দিনযাপন থেমে গেল সোমবার গভীর রাতে। ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন পন্ডিত মুরারিমোহন বেদান্ততীর্থ শাস্ত্রী। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই একজন সদস্য কমল সেই লুপ্তপ্রায় বাঙ্গালী শ্রেণীর, বিশ্বাস ও জীবনাচরণে যার কোনও ফারাক ছিল না।

বারাণসী-সমতুল গঙ্গার পশ্চিমকূলে জন্ম তাঁর। পাঁচশো বছরেরও বেশি পুরোনো সেই হাওড়ার সংস্কৃত শিক্ষার ঐতিহ্য নিয়ে তাঁর গর্বের শেষ ছিল না। মজা করে বলতেন, “আমরা পশ্চিমী, তাই সূর্যমুখী। পশ্চিমে তীর বলে গঙ্গায় স্নান করতে গেলে আমরা পূর্বমুখী অর্থাৎ সূর্যমুখী হই, গঙ্গাস্নানের সেটাই রীতি। কলকাতার লোকেরা তা পারেন না, তাই পিছন ফিরে স্নান করতে হয়।”

জীবনের সর্বত্র হিন্দু ধর্মের আচার-বিচার, রীতিনিয়ম একনিষ্ঠ ভাবে মেনে চলতেন মুরারিমোহন।  সংস্কৃতের প্রথাগত শিক্ষাকে টিকিয়ে রাখতে আজীবন লড়াই করেছেন। আন্দুল, মাজু, উদয়নারায়ণপুর, আমতা ও শিবপুরে ন্যায়চর্চার যে ঐতিহ্যহ গড়ে উঠেছিল, মুরারিমোহন তার শেষ প্রতিনিধি। পাশাপাশি ছিল জ্যোতিষচর্চা। নিয়মিত বসতেন তার জ্যোতিষকেন্দ্রে। সময়ের নিয়মে হাওড়ায় টোলের সংখ্যা প্রায় ২৫০ থেকে নেমে এসেছে পাঁচ কি দশে, কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। সংস্কৃত শিক্ষায় সরকারকে উদ্যোগী হতে চাপ দিয়েছেন, সংস্কৃত ভাষার সজীব চর্চার জন্য “হাওড়া পন্ডিত সমাজ” – এর ব্যানারে সংস্কৃত নায়ক অভিনয়ে উৎসাহ দিতেন। ১৯১৫-য় তাঁর জন্মের বছর ছয় আগে এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর বাবা, পন্ডিত কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতিরত্ন। সেই সংস্থার সঙ্গে আজীবন জড়িয়ে ছিলেন তিনি।

নামের সঙ্গে উপাধি, নানা সংস্কৃতশিক্ষণ সংস্থার সাম্মানিক পদ, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার-সহ বিবিধ স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি বোধহয় ছিল মানুষের মনে তাঁর “সনাতন” আসনটি। সময়ের শত পরিবর্তনেও যা অপরিবর্তনীয়।

 

হিন্দু আচার রক্ষার সেই ট্রাফিক পুলিশ

শংকর

বারবার অসাবধান প্রয়োগে “যুগাবসান” শব্দটি তার গুরুত্ব হারিয়েছে, না হলে বলা যেত মুরারিমোহনের দেহাবসানে যুগাবসান হল। মুরারি পন্ডিত নিজেই বলতেন, সব ধর্মে এবং সব সমাজে নিয়ম-কানুনের ট্রাফিক পুলিশ থাকে ; একমাত্র আমাদের সনাতন ধর্ম ছাড়া। আচার-বিচার ও নিয়মের নৈরাজ্যের সুযোগ নিয়ে এক সময় কেউ কেউ আমাদের এই সমাজকে অকারণে নিপীড়িত করেছে হয়তো। কিন্তু, এখন তার উল্টো পরিস্থিতি। একমাত্র আমাদেরই নিজের আচরিত ধর্মের কিছু জানতে হয়না। ফল কিন্তু ভালো হয়না, ভ্রমাত্মক আচরণে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।

আমাদের সময়ে যে সামান্য কয়েকজন লোক বিপুল নিষ্ঠায় এবং তুলনাহীন ত্যাগ করে শাস্ত্রীয় ধারাগুলিকে প্রাণবন্ত রাখার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, মুরারিমোহন তাঁদের অন্যতম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অল্প কয়েক বছর আগে বাবার সঙ্গে যখন বনগ্রাম থেকে হাওড়ার খুরুট রোডের কাছে চলে এলাম তখন মুরারিদার পিতৃদেবের নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পন্ডিত বলে যথেষ্ট নামডাক। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের টোলটি ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছে। সেই বাড়ির এক বাসিন্দা দেবীচরণ খাঁ পরবর্তী সময়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল। মুরারিমোহন আমার থেকে বেশ কয়েক বছরে বড়। কিন্তু, বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে তাঁর ভাইরা পড়তেন। এবং সেই সূত্রে গোপাল ব্যানার্জি লেনে ওদের বাড়িতে একসময় আমার যাতায়াত ছিল।

মুরারিদা পড়তেন শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ে। ওঁদের পরিবারের সঙ্গে বিখ্যাত ইংরেজ প্রতিষ্ঠান বার্ড হাইলজার্সের বিশেষ সম্পর্ক ছিল. সেই ছোটবেলায় শুনতাম, বিখ্যাত বেনথল সাহেব এবং তাঁর ভাই এই পরিবারের পান্ডিত্যের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সেই সূত্রে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ওয়েনকেই বার্ড হাইলজার্সে কাজ করতেন।

মুরারিদা সম্বন্ধে অন্য কথা শুনতাম, সাহেব বাড়ির করণিক না হয়ে তিনি শাস্ত্রপাঠে ডুবে গেলেন ও বহু বছর সংখ্যাহীন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের গর্বের কারণ হয়ে উঠলেন। বড় বড় ডাইরেক্টরি পঞ্জিকার নতুন সংস্করণ এলেই প্রথমেই যেই নামটি খুঁজে পেয়ে বিস্মিত হতাম তা হল, মহামহোপাধ্যায় শ্রীমুরারিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বেদান্ততীর্থ শাস্ত্রী, তান্ত্রিকাচার্য।

তখন হাওড়া ছিল সংস্কৃতচর্চার বড় কেন্দ্র। আমাদের বাড়ির কয়েক পা দূরেই ছিল পন্ডিত রামগোপাল ন্যায়রত্নের টোল। তাঁর পুত্র নিত্যানন্দেরও ভারতজোড়া খ্যাতি। মুরারিমোহন যথাসময়ে তাঁর বংশের খ্যাতিকে বহুবিস্তৃত করেছিলেন। স্থানীয়েরা জানতো, বার্ড হাইলজার্সের কর্ণধারেরা এক সময় তাঁকে ‘রিলিজিয়াস এডভাইসর’ – এর দুর্লভ সম্মান দিয়েছিলেন। খুরুট রোডে মুরারিদার টোলের সামনেই ছিল আমাদের আড্ডা। এবং কলকাতার খ্যাতনামা ব্যক্তিদের তাঁর কাছে এসে বিধান নিতে দেখা যেত। বিশিষ্টদের এই তালিকায় উত্তমকুমার থেকে কে না থাকতেন! শোনা যায়, অংকে দিয়ে লক্ষীপুজো করানোর জন্য উত্তমকুমার ব্যাকুল হতেন। তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে এই অনিচ্ছুক পন্ডিতকে কয়েক বার বাড়ি নিয়ে যেতে সক্ষমও হন মহানায়ক। দূর থেকেও বহু কোষ্ঠীবিচারের অনুরোধ আসত, এই তালিকায় অমিতাভ বচ্চন ও তাঁর পরিবারের নামও শুনতে পাবেন আমাদের পুরনো পাড়ায়।

কিন্তু কোষ্ঠীবিচার ইত্যাদি ছিল মুরারিদার জীবনের ছোট্ট একটি অংশ। প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের পূজাপদ্ধতি, আচার-বিচার সম্বন্ধে ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। এই জ্ঞান যাতে সম্পূর্ণ লুপ্ত না হয় সে জন্য ছিল আজীবন প্রচেষ্টা। এ নিয়ে সারা জীবন অনেক প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন। একবার বলেছিলেন, ধর্মীয় আচারের গ্রামার না জানাটা কোনও গর্বের কথা নয়। স্বামী বিবেকানন্দের পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত ‘শিষ্টাচার পদ্ধতি’ নামে

একটি বই লিখেছিলেন, ক্যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা শুনে মুরারিদা বলেন, ‘বইটা পেলে আমাকে দেখিও।’ আমি বলেছিলাম, ‘আপনি বিলেতের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো হয়েছেন, আমাদের উচিত আপনাকে দিয়ে হিন্দুইজম -এর একটি হ্যান্ডবুক লিখিয়ে নেওয়া।’ তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যান্ডবুক নয়। ঠিকমতো সংকলন করলে এনসাইক্লোপিডিয়া হয়ে যাবে।’ একবার লেখার প্রয়োজনে টেলিফোনে মুরারিদাকে চান্দ্রায়ণ ব্রত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। এক মুহূর্ত না ভেবে উনি বললেন, ‘চার রকম চান্দ্রায়ণের মধ্যে কার কথা বলছ? তুমি প্রথমে পিপীলিকা-মধ্য চান্দ্রায়ণের লক্ষণগুলো লিখে নাও।’

বাংলা মতে মুরারিমোহন দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন, প্রাণান্তকর পরিশ্রম সত্বেও আট দশকেরও বেশি তিনি জ্ঞানচর্চা করেছেন।  তবু মনে হয়, জ্ঞানের জাহাজটি তাঁর অমূল্য সম্পদগুলি অনাগত কালের জন্য রক্ষা না করেই সমুদ্রগর্ভে বিলীন হলেন।  নববর্ষের প্রথম দিনে হাওড়া বাঁশতলা ঘাটে তাঁর শেষকৃত্য হল – সেখানেও কিন্তু নিষ্ঠাবান সাধকের সুচিন্তিত নির্দেশ ছিল। তাই বৈদ্যুতিক চুল্লির ব্যবহার না করে হাজার হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় কাঠের আগুনে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হল।

(সৌজন্যে – আনন্দবাজার পত্রিকা)