মহালয়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণর কণ্ঠে চন্ডীপাঠ আজও বাঙালির দুর্গাপুজোর ইউএসপি

0
1546

সৌম্যজ্যোতি মন্ডল

রেডিও থেকে ভেসে আসছে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে, বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত, জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা৷’ যাঁর কণ্ঠ দিয়ে হয় শারদোৎসবের এই আগমন, তাঁর নাম বিরূপাক্ষ ওরফে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠের জনপ্রিয়তার কারণে বেতারের অনুষ্ঠানকেই ‘মহালয়া’ বলে ভুল করেন অনেকে। আসলে ‘মহালয়া’ একটি তিথি। অনুষ্ঠানটির নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে তাঁর গম্ভীর কণ্ঠে স্তোত্রপাঠ দিয়েই শুরু হয় আনন্দময়ী মহামায়ার আগমনী। আকাশবাণী কলকাতার প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ দিয়েই শুরু হয় মহালয়ার ভোর। বিরূপাক্ষর কণ্ঠ বেজে ওঠে ঘরে ঘরে।

১৯০৫ সালের ৪ অগস্ট উত্তর কলকাতায় মামারবাড়িতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম হয়। পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র ও মাতা ছিলেন সরলাবালা দেবী। কালীকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন বহুভাষাবিদ, তিনি ১৪টি ভাষা জানতেন। পরবর্তীকালে ঠাকুমা যোগমায়া দেবীর সঞ্চিত টাকায় ক্রয় করা ৭, রামধন মিত্র লেনে উঠে আসেন তাঁদের পরিবার। পাঞ্জাবের নাভা স্টেটের মহারানির প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তাঁর ঠাকুমা যোগমায়া দেবী। তিনি ছিলেন সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা উচ্চশিক্ষিতা মহিলা। ইংরেজি, সংস্কৃত জানতেন। ঠাকুমার কাছেই সংস্কৃতের প্রথম হাতখড়ি বীরেন্দ্রর।

কালীকৃষ্ণের দুই পুত্র ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ১৯২৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯২৮ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন।

১৯২৮ সালে বিএ পাশ করে বাবার বন্ধুর সুপারিশে যোগ দেন ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে। দুপুরে টিফিনের বিরতি বা বিকেলের অবসরে চলে আসতেন রেডিওর অনুষ্ঠানে। যেখানেই যেতেন, আসর জমিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর এই গুণেই মোহিত হয়ে নৃপেন মজুমদার তাঁকে আহ্বান জানালেন রেডিওতে। চাকরি ছেড়ে যোগ দিলেন রেডিওয়, ১৯২৮-এর শেষের দিকে। রেডিওর জগতেই কেটে গেল তাঁর জীবন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আলো-আঁধারিতে।

শুরুতে ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুরু করলেন ‘মহিলা মজলিশ’। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বীরেন্দ্রর কণ্ঠ জনপ্রিয় হয়ে উঠল মহিলা মহলে। ১৯৩০-এর দশকের এই সময় থেকেই দুর্গাপুজো উপলক্ষে দেবী দুর্গার পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে দু’ঘণ্টার সঙ্গীতালেখ্য মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এই অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা করেছিলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেন। প্রথমে লাইভ অনুষ্ঠান হত, তার পর থেকে রেকর্ড বাজানো হয়।

১৯৩২-এর ষষ্ঠীর ভোরে প্রথম বার প্রচারিত হয় বেতারের কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী। পরে এটি মহালয়া তিথিতে পরিবর্তিত করা হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর গম্ভীর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ আজও শুধু মহালয়া নয় সারা পুজোর ইউএসপি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চণ্ডীপাঠ শোনার সময়ে আমাদের সকলের উপলদ্ধি হয় একসময় তাঁর গলা ধরে আসে ক্রন্দনরত হয়ে পড়েন তিনি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বলতেন এর কারণ হল তিনি সামনে তখন মা দুর্গাকে দেখতে পান।

জীবনে শুধু একবার রেডিও অফিসে যাননি তিনি। সেটা ছিল ১৯৭৬ সাল। রেডিয়ো সে বার মহিষাসুরমর্দিনী প্রচারিত হয়নি। হয়েছিল, ‘দুর্গা দুর্গতিহারিণী’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে যা উত্তমকুমারের মহালয়া বলে প্রচলিত। সেই প্রথম, সেই শেষ। শোনা যায় আগের রাতে উত্তম কুমার নিজে এসেছিলেন ওঁর কাছে। হাত ধরে বলেছিলেন, তিনি ওই অনুষ্ঠানটি করতে চাননি। তখন নাকি তিনি উত্তমবাবুকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, ‘কেন করবেন না আপনি? অবশ্যই করুন। নতুন কিছু তো করা দরকার। আমি আপনার পাশে আছি।’ সেই মহালয়ার ভোরেও অনুষ্ঠান শুনেছিলেন তিনি। বলেওছিলেন ভালো হয়েছে অনুষ্ঠান৷ কিন্তু জনতা অবশ্য সেটা মেনে নিতে পারেনি। সে কী বিক্ষোভ! প্রবল চাপে ষষ্ঠীর সকালে আবার রেডিও বাজাতে বাধ্য হয়েছিল মহিষাসুরমর্দিনী। ’শেষ পর্যন্ত আবার বীরেন্দ্রবাবুর কন্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনানো শুরু হয়।

রবীন্দ্রনাথ, বিধানচন্দ্র রায় থেকে উত্তমকুমার, তিন কিংবদন্তির প্রয়াণ যাত্রার ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। যে রেডিওর জন্য এতকিছু, তারা অবশ্য শেষ বয়সে পেনশনও দেয়নি। কারণ, তিনি চুক্তিতে কাজ করতেন। তাই পেনশন পাননি। পরে তেমন কেউ খোঁজও নেয়নি। জীবনের শেষদিকে স্মৃতিভ্রংশ হয়ে গিয়েছিল ওঁর।

শুধুমাত্র রেডিও নয় চলচ্চিত্রের প্রতিও তাঁর ঝোঁক ছিল বেশ। একই সঙ্গে অভিনয়েও ছিলেন আগ্রহী। মেস নং ৪২ সহ একাধিক নাটক রচনা করেন তিনি নিজেই। বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সুবর্ণ গোলক নাটক তিনি মঞ্চস্থ করেন। একাধিক গুণের অধিকারী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র রেডিওর জন্য যা করেছেন যা দিয়েছেন তাঁর পরিবর্তে তিনি ও তাঁর পরিবার রেডিও থেকে সেরকম কিছু পাননি। পেয়েছেন আজীবন জনতার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। কিন্তু এই কিংবদন্তি বাঙালির আরও অনেক বেশি কিছু প্রাপ্য ছিল।

আজও মহালয়া বাঙালির সকাল শুরু হয়েছে চিরাচরিত্র কন্ঠ ধ্বনীতে। মহালয়া মানেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের বিকল্প কেউ হতে পারেনি এখনও। গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ভিড় জমেছে পিতৃ পুরুষের উদেশ্যে শ্রদ্ধা জানাতে শুরু হয়ে গিয়েছে তর্পণ। নিয়ম অনুযায়ী মহালয়ের দিন পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে দেবী পক্ষের সূচনা ঘটে, কিন্তু এবার ব্যাতিক্রম এবার ‘মা’র মর্তে আগমন ঘটবে এক মাস পর। একে করোনার কাঁটা তারপর দেরিতে আসছে মা তাই বাঙালির মনে মনে পুজো পুজো ভাবটা এখন তেমন ভাবে আসেনি।