যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পলায়ন ও পদত্যাগের ৭০ বছর পেরিয়ে এলাম

করোনার আবহে আমরা কি এই স্মৃতি ভুলতে বসেছি?

0
5256

২০২০ সাল বিশ্বের সব দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিকে ওলটপালট করে দিচ্ছে। এর মূল কারণ করোনা মহামারীর আক্রমণ। গত তিন মাসে ভারতে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণে সামাজিক যোগাযোগ, যাতায়াত, স্কুলকলেজের ক্লাস সবকিছুই বন্ধ রয়েছে। ২৫শে বৈশাখ পালন, সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষ উদ্‌যাপন, পুরীর রথযাত্রাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবও জনসমাগম এড়িয়ে অনলাইনে সারতে হল। বাংলাদেশে শেখ মুজিবরের জন্ম শতবর্ষ পালনের উদ্যোগও তথৈবচ। তবে মানুষের মননে তো উৎসবগুলি সতেজ। এদিকে ২০২০ সালে তো পাকিস্তান থেকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পালিয়ে আসা এবং পাকিস্তানের আইনমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার সত্তর বছর পূর্তি। বিষয়টি বাঙালির জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ চারিদিকে করোনা নিয়ে আলোচনার আবহে আজ যেন আমরা ভুলতে বসেছি যোগেন্দ্রনাথের জীবনের সেই নির্মম ইতিহাস।

কী সেই ইতিহাস?

দেশভাগের প্রাক্কালে অবিভক্ত বাংলার দলিত নমঃশূদ্র নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রথমে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বঙ্গকে নিয়ে অখণ্ড বাংলার দাবির সমর্থক ছিলেন। অখণ্ড বাংলার দাবি মানে দেশভাগ হলে ভারতকে তিনটি খণ্ডে ভাগ করতে হবে— ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অখণ্ড বাংলা যে অদূর ভবিষ্যতেই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবে তা বিভিন্ন হিন্দু বাঙালি নেতার বুঝতে দেরি হয়নি। তাই বহু নেতা অখণ্ড বাংলার দাবি সমর্থন করেননি। এদিকে হিন্দু মহাসভার নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দাবি তুলেছেন যে, দেশভাগ হলে মুসলিম লীগ যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য সমগ্র বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায় তা হতে দেওয়া যাবে না। কেননা, অখণ্ড বাংলায় তখনও ২৮ শতাংশ হিন্দু ছিল যাদের জীবন ও ধর্ম প্রস্তাবিত পাকিস্তানে বিপন্ন হবে। শ্যামাপ্রসাদ দাবি তোলেন যে, বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে বাংলার পশ্চিমাংশের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলিকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তখনকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং মেঘনাদ সাহা, রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন বিশিষ্ট জন শ্যামাপ্রসাদের দাবিকে সমর্থন জানালে বাংলাভাগ করে পশ্চিম বাংলাকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে পূর্ববঙ্গের দলিত নমঃশূদ্র নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল এক অদ্ভুত পদক্ষেপ নিলেন, যার ভয়াবহ ফল ভবিষ্যতে তিনি নিজে এবং তাঁর অনুগামী লক্ষ লক্ষ দলিত উদ্বাস্তু ভোগ করেছেন।

দেশভাগের প্রাক্কালে যোগেন্দ্রনাথ প্রথমে অখণ্ড বাংলার দাবির পক্ষে থাকলেও শীঘ্রই তিনি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে মহম্মদ আলি জিন্না ও মুসলিম লীগের হাত শক্ত করেন। গণভোটের মাধ্যমে হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীহট্ট জেলার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তিতেও তাঁর যথেষ্ট উদ্যোগ ছিল। যাই হোক, লীগের হাত শক্ত করার পুরস্কারস্বরূপ দেশভাগের পর যোগেনবাবু পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার উচ্চবর্ণের হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসতে শুরু করেন। কিন্তু যোগেনবাবু তাঁর অনুগামী পূর্ববঙ্গের দলিত নমঃশূদ্রদের বোঝান যে, উচ্চবর্ণ নয়, অনগ্রসর মুসলিমরাই অনগ্রসর দলিত হিন্দু নমঃশূদ্রদের ভাই। তাই দলিতদের দেশ ছাড়তে হবে না। তিনি আশ্বাস দেন যে, পূর্ববঙ্গে মুসলিম ভাইদের সঙ্গে সহাবস্থানেই দলিতরা সুখে থাকবেন। আর যদি দলিত হিন্দুদের কখনও ভারতে চলে যেতেই হয়, তবে সবাইকে নিরাপদে ভারতে পাঠিয়ে তিনি যাবেন শেষ ট্রেনে।

কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। দেশভাগের পরপরই সংখ্যাগুরু মুসলিমরা পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্যাতন চালায়। ফলে যোগেনবাবুর নেতৃত্বের প্রতি একদা আস্থাশীল দলিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশ ছেড়ে নিঃস্বরিক্ত উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। পূর্ববঙ্গের যে মাটিতে তাদের জন্ম, সেই মাটি তাদের আশ্রয় দেয়নি, বিতাড়িত করেছে। সামাজিক অবহেলার চরম শিকার এই দলিত নমঃশূদ্র বাস্তুহারার দল মাতৃভূমি ছেড়ে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছেন এপার বাংলার শিয়ালদহসহ বিভিন্ন রেলস্টেশনে, রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প, ধুবুলিয়া ক্যাম্পসহ অন্যান্য উদ্বাস্তু শিবিরে, আর খোলা আকাশের নীচে নানা স্থানে। তাদের জীবনে দুর্দশার সীমা নেই।

এদেশে ব্রিটিশ শাসনকালে পূর্ববঙ্গের নমশূদ্ররা ছিল সেখানকার হিন্দু জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় অংশ। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় তাদের আধিক্য ছিল। অশিক্ষা, অচিকিৎসা, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতার অভাব ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। পূর্ববঙ্গের হিন্দু কৃষকদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এই সম্প্রদায়কে ছারখার করে দেয়। দেশভাগের লগ্নে নমঃশূদ্রদের গুরুত্বপূর্ণ দু’জন নেতা ছিলেন—একজন ছিলেন মতুয়া সম্প্রদায়ের গুরু প্রমথরঞ্জন ঠাকুর এবং অন্যজন ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। দেশভাগের পর প্রমথরঞ্জনের পরিবার এপার বাংলায় চলে এলে তাঁর অনুগামী নমঃশূদ্রদের একাংশ এপারে চলে আসেন। অন্যদিকে, যোগেন্দ্রনাথ তাঁর অনুগামী নমঃশূদ্রদের আশ্বস্ত করেন যে, ভারতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, পূর্ববঙ্গে মুসলিমদের সঙ্গেই তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন। এভাবে দেশভাগ ঐক্যবদ্ধ নমঃশূদ্র সম্প্রদায়কে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়।

যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের আশ্বাসে যারা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে গেলেন, সাম্প্রদায়িক কারণে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে সংখ্যাগুরুর আক্রমণে প্রচুর হিন্দু খুন হতে থাকে। এই সাম্প্রদায়িক গণহত্যা নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে পাক সরকার তা বেমালুম অস্বীকার করে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্ত করার ভার দেয় যোগেন্দ্রনাথের হাতেই। সেদিন যোগেন্দ্রনাথ তদন্তের রিপোর্ট দেন যে, যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণহত্যার কথা বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ রূপ নেয় যে, আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলেরই প্রাণসংশয় হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর অনুগামী বিশাল সম্প্রদায়কে না জানিয়েই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ১৯৫০ সালে কলকাতায় আশ্রয় নেন এবং এখান থেকে ৮ই অক্টোবর ১৯৫০ তাঁর পদত্যাগ পত্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পাঠিয়ে দেন। প্রায় আট হাজার শব্দে লেখা পৃথিবীর দীর্ঘতম এই পদত্যাগপত্রের ছত্রে ছত্রে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানের হিন্দুদের উপর মুসলিম দাঙ্গা ও নির্যাতনের বিবরণ ফুটে উঠেছে। এখানে তিনি স্বীকার করেন যে, তদন্তের রিপোর্টে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু গণহত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেন। এই পত্রে তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, মুসলিম লীগের পক্ষ নিয়ে কাজ করা তাঁর জীবনের কত বড়ো ভুল ছিল।

যোগেনবাবু তাঁর পদত্যাগ পত্রে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আগেই সন্দেহ করেছিলেন যে, পাকিস্তানকে শরিয়তের ভিত্তিতে একটি একশো শতাংশ ‘ইসলামী’ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তা সত্ত্বেও তিনি ১৯৪৬ সালে সুরাবর্দীর নেতৃত্বে লীগ মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। এরপর ১৯৪৬এ লীগের উদ্যোগে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’এর নামে ১৬ আগস্ট কলকাতায় হিন্দু নিধন চলে। ফলে হিন্দুরা লীগের মন্ত্রীসভা থেকে তাঁর পদত্যাগ দাবি করে। কিন্তু তিনি তাঁর পথে অবিচল থেকে মন্ত্রীসভায় থেকে যান। এরপর অক্টোবরে নোয়াখালি দাঙ্গায় শ’য়ে শ’য়ে হিন্দু হত্যা, জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করা, হিন্দু মহিলাদের অপহরণ প্রভৃতি চলে। এরপরও তিনি লীগের সঙ্গে সহযোগিতা চালিয়ে যান। কলকাতায় ভয়াবহ গণহত্যার পর সুরাবর্দী মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে আইনসভায় ভোটাভুটি হয়। তাতে শুধু যোগেনবাবুর চেষ্টায় কংগ্রেসের চারজন ইঙ্গভারতীয় সদস্য ও চারজন অস্পৃশ্য সদস্যের সমর্থন যোগার করে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’এর নায়ক সুরাবর্দীর মন্ত্রীসভাকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। বছরের একেবারে শেষদিকে গোপালগঞ্জের মতো বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদের দ্বারা দাঙ্গার শিকার হওয়ার পর নমঃশূদ্ররা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখন যোগেনবাবু মারখাওয়া নমঃশূদ্রদের নিরস্ত করেন। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের উপর সংখ্যাগুরু মুসলিমরা কীরূপ ভয়াবহ দাঙ্গা ও হত্যালীলা চালিয়েছে তাও এই পদত্যাগ পত্রের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। তা আলোচনার অন্য একটি পর্ব হতে পারে।

পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিন্দু নিধনের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান থেকে যোগেনবাবুর পালিয়ে আসা এবং পাক মন্ত্রীসভা থেকে তাঁর পদত্যাগ করা এক উল্লেখযোগ্য বিষয়। পাকিস্তানে এক হিন্দু ক্যাবিনেট মন্ত্রীর যদি এই অবস্থার শিকার হতে হয়, তবে দেশভাগের সময়কার পূর্ববঙ্গের ২৮ শতাংশ হিন্দুর কীরূপ দুর্দশা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। এই ঘটনার সঙ্গে বাঙালি হিন্দুর ভবিতব্য জড়িত। ইসলামী আক্রমণে বাঙালি হিন্দুর জীবন ও ধর্ম বিপন্ন হতে চলেছে, যোগেনবাবুর এই ইতিহাস তার একটি বড়ো দৃষ্টান্ত। আজ ২০২০ সাল, পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে যোগেনবাবুর পালিয়ে আসার ৭০ বছর পূরণ হল। এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে আজ বাঙালি জাতিকে খুব একটা স্মরণ করতে দেখা যাচ্ছে না। তবে কি বর্তমান করোনার আবহে আমরা তা স্মরণ করতেই ভুলে গেছি? নাকি বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি বলে তারা এই ইতিহাস ভুলে থাকতে চাইছে?