স্বামী প্রণবানন্দ…… হিন্দুর এক বিস্মৃত ত্রাতা

0
4830

১৬ই অগাষ্ট, ১৯৩২। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‌্যামসে ম্যাকডোনাল্ড ঘোষণা করলেন সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা।ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা।এর বৈশিষ্ট্য হল মুসলমানদের প্রাপ্য আসনের থেকে বেশি আসন ও হিন্দুদের কম আসনের ব্যবস্থা নিয়ে।পৃথক নির্বাচন নিয়ে কংগ্রেস না-গ্রহন না-বর্জন এক নপুংসক অবস্থান গ্রহন করল।তবে কংগ্রেসের মুল শক্তি ছিল হিন্দুসমাজ।হিন্দুর প্রাণের বিনিময়েই কংগ্রেসের যাবতীয় আন্দোলন।সেই হিন্দুদের একাংশ পৃথক নির্বাচনের ফলে কংগ্রেসের হাত ছাড়া হয়ে যাবে একথা বুঝে গান্ধীজী পুনেতে অনশন শুরু করলেন।তাঁর প্রাণ বাঁচাতে তফশিলী নেতা বি আর আম্বেদকর এক চুক্তি সাক্ষর করলেন।এর ফলে বর্ণ হিন্দুদের আরও আসন তফশিলীদের ছেড়ে দিয়ে যুক্ত নির্বাচনের ব্যবস্থা হল।তার ফলে,বিশেষতঃ বাংলার রাজনীতিতে হিন্দুদের প্রতিরোধের শক্তি চিরকালের মত বিনষ্ট হল।বৃহত্তর ক্ষতি হিসেবে, সরকারী নথিপত্র থেকে হিন্দু নামটি চিরতরে হারিয়ে গেল।মুসলমান, ইংরেজ, পার্শী, শিখ সবাই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের নামে সরকারী স্বীকৃতি পেল।কিন্তু হিন্দু নামটি চিরতরে মুছে গেল।

কংগ্রেসের নীতি ও স্বামী প্রণবানন্দের জাতিগঠনের পার্থক্য

ভারতে তখন আপামর হিন্দুর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হল কংগ্রেস।কিন্তু তারা হিন্দুত্ব/হিন্দু স্বার্থবাহী বিষয় সংক্রান্ত নিয়ে কোন আন্দোলনে গড়ে তুলতে অনিচ্ছুক পাছে কেউ তাদের সাম্প্রদায়িক বলে।হিন্দু-মুসলিম একতা নামক অলীক আত্মঘাতী প্রচারে সদা ব্যস্ত হিন্দুর অর্থে-শ্রমে-আত্মত্যাগে পুষ্ট এই রাজনৈতিক সংগঠন।

জাতিভেদ প্রথাকে হাতিয়ার করে হিন্দুসমাজকে যে টুকরো করে ফেলা হল তার মুলে কুঠারাঘাত করতে এগিয়ে এলেন কোন রাজনৈতিক নেতা নয়, বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় নয়, প্রতিপত্তিশালী মঠের সাধু সন্তরাও নয়।তিনি হলেন – একমাত্র ব্যতিক্রম, ভারতসেবাশ্রম সংঘ ও তার প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দ-যিনি হিন্দুসমাজের পরগাছা স্বরূপ ভোগানন্দ সন্ন্যাসী ছিলেননা।দীর্ঘকাল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ভারতবাসীর সেবা করতে করতে তাঁর উপলব্ধি …..মুসলমান সংঘবদ্ধ ও সুগঠিত, খৃষ্ঠানগণও সংঘবদ্ধ ও সুরক্ষিত-তাদের সম্মিলিত ও সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য কাউকে রণাঙ্গণে পদার্পণ করতে হবেনা।কিন্তু জাতির তিন চতুর্থাংশ যে হিন্দুজনগন তারাই ছিন্নভিন্ন, বিচ্ছিন্ন, বিবদমান, দুর্বল অরক্ষিত। এই বিরাট ভারতীয় হিন্দু-জনমন্ডলীকে সম্মিলিত ও সঙ্ঘবদ্ধ করতে না পারলে জাতীয় জীবন সম্ভব কি? যার কিছুমাত্র মগজ আছে সে বুঝবে ভারতে জাতি গঠনের পথে যথার্থ সমস্যা হিন্দুজাতিগঠন-হিন্দুমুসলিম মিলন নয়।…..

ধর্মনিরপেক্ষতার অসাড়তা ও হিন্দু ঐক্য

হিন্দুসমাজের ক্ষতি করেছে রাজনৈতিক দলগুলি, হিন্দুসমাজের দানদক্ষিণায় পরিচালিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি-যারা ডালের আগায় বসে গোড়া কাটায় ওস্তাদ – তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের জন্য স্বামী প্রণবানন্দ নির্ভীক কন্ঠে বলেছেন-

“যে যা তাকে তাই বলে ডাক দিলে সে সাড়া দেয়।মুসলমানকে মুসলমান বলে ডাক দেওয়া হচ্ছে, তাই সে সাড়া দিচ্ছে ,খৃষ্ঠানকে খৃষ্ঠান বলে ডাক দেবার লোক আছে, তাই সে ডাকে সাড়া দিচ্ছে, নিজেদের অস্তিত্বও সেভাবে অনুভব করছে।কিন্তু হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দেবার লোক নেই।গত একশ বছর ধরে কেউ ডাক দিয়েছে-ব্রাহ্ম বলে, কেউ ডেকেছে আর্য্য বলে, কেউ ডেকেছে ভারতীয় জাতি বলে, কোন পক্ষ তাকে আখ্যা দিয়ে রেখেছে অমুসলমান।বিরাট ভারতীয় জাতটা অসাড়, অবশ হয়ে আত্মভোলা হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে।আজ সময় এসেছে হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দেবার।”

১৯৩৭ র প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচনের পর কংগ্রেসের অবিমৃশ্যকারিতায় বাংলায় শুরু হয় মুসলীম লীগের দানবীয় শাসন।প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে হিন্দুরা বঞ্চিত, লাঞ্ছিত হতে থাকে।গ্রামবাংলায় নেমে আসে নারকীয় অত্যাচার।হিন্দুর জমি বাড়ি দখল, ক্ষেতের ফসল লুঠ, মন্দির ধ্বংস, পূজাপার্বনে আক্রমণ হতে থাকে।সব থেকে করুণ অবস্থা হয় হিন্দুনারীদের।কিশোরী, যুবতী, প্রৌঢ়া কেউই মুসলমানদের হাত থেকে রেহাই পেলনা।শত শত হিন্দুনারী অপহৃত হতে থাকল।স্বামী প্রণবানন্দ জেলা জেলায় সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে তৈরী করলেন বিস্তারিত রিপোর্ট।তবু হিন্দুসমাজের হতাকর্তা বিধাতা কংগ্রেসের মধ্যে এতটুকু হেলদোল দেখা গেলনা।

স্বামী প্রণবানন্দের ধর্মযুদ্ধ

বাঙ্গালী হিন্দুদের এই ভয়ঙ্কর বিপদের ক্ষণে স্বামী প্রণবানন্দ নিজেই এক ত্রিমুখী প্রচেষ্টা শুরু করলেন।

প্রথম, হিন্দু মিলন মন্দির।গ্রামে গ্রামান্তরে হিন্দুদের সামাজিক মিলন ক্ষেত্র।এর তাৎপর্য্য ব্যাখ্যা করে স্বামী প্রণবানন্দ বললেন – “আমার মন্দির কোন ইঁট পাথরের মন্দির নয়।ইঁট পাথর গেঁথে গেঁথে লোকে মন্দির করে,আমি হিন্দুসমাজের খন্ডবিখন্ড অঙ্গ গুলো ছিন্নবিছিন্ন অংশগুলিকে গেঁথে বিরাট হিন্দুমিলন মন্দির তৈরী করব।আমার মিলন মন্দির হচ্ছে-হিন্দুর সার্বজনীন মিলনক্ষেত্র…..”

দ্বিতীয়, হিন্দুরক্ষী দল।১৯৪০ সালের ৭ই মার্চ, শ্রী মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক সভায় গঠন করা হয়…. হিন্দু প্রতিরোধ বাহিনী।

স্বামী প্রণবানন্দ বললেন – “বাঙ্গালী হিন্দুর সামনে আজ একমাত্র পন্থা-বীরবিক্রমে যাবতীয় অন্যায় অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিবিধান এবং আত্মরক্ষার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হওয়া।”

তৃতীয়,  হিন্দুমহাসভা! হিন্দুদের কোন নিজস্ব রাজনৈতিক দল ছিলনা।শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর যেমন বলেছেন – যার দল নাই তার বল নাই।দীর্ঘদিন হিন্দুমহাসভা সামাজিক আন্দোলন করেছে।কংগ্রেসের আন্দোলনেই হিন্দুমহাসভা রাজনৈতিক ভাবে যোগ দিত।কিন্তু কংগ্রেসের হিন্দুঅত্যাচারে নীরবতা হিন্দুমহাসভাকে পৃথক পথে যেতে বাধ্য করে।শ্রী সুভাষচন্দ্র বসু হিন্দুমহাসভার সদস্যদের কংগ্রেসে যোগদান নিষিদ্ধ করেন।কিন্তু তৎকালীন সমাজে বিদ্বজ্জনদের মধ্যে হিন্দুর পৃথক রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব অনুভুত হয়।এই চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীর্ঘকাল হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন, হিন্দুমহাসভায় যোগদান করেন।১৯৩৯ সালে বীর সাভারকর বাংলায় আসেন এবং হিন্দুমহাসভার নীতি-আদর্শ প্রচার করেন।ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলায় হিন্দুমহাসভাকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।শ্যামাপ্রসাদ স্বামী প্রণবানন্দের অকুন্ঠ সমর্থন লাভ করেন।স্বামী প্রণবানন্দ ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘ ও হিন্দুমহাসভাকে একে অপরের পরিপুরক করে তুলতে চেয়েছিলেন।হিন্দুদের আসন্ন বিপর্যয় স্বামী প্রণবানন্দকে এতই উদ্বিগ্ন করে তোলে যে হিন্দুমহাসভার জনভিত্তির প্রসারে তিনি স্বয়ং প্রচেষ্ট হন।প্রায়ই তিনি ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রী এন সি চ্যাটার্জী, শ্রী মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ হিন্দুমহাসভার বরিষ্ঠ নেতাদের সাথে মতবিনিময় করতেন।

স্বামী প্রণবানন্দ তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটা বছর হিন্দুদের সংগঠিত করতে নিজেকে সঁপে দেন।বাংলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত তিনি অবিরাম প্রচার করেছেন।বাংলার নদী নালা পেরিয়ে হিন্দুজাগরনের বার্তা দিয়েছেন।গ্রামে গ্রামে গভীর রাতেও শত শত মানুষকে নিয়ে সভা করেছেন।প্রবল জ্বরও তাঁকে থামাতে পারেনি।তাঁর শরীর বোধ লুপ্ত হয়েছিল।নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দেশবাসীর জন্য বিলিয়ে দিয়ে স্বামীজীর অনুভব হয় তাঁর সমাপনের দিন আসন্ন। তাই, আগামী রণের জন্য, নেতৃত্বহীন বাঙ্গালী হিন্দুর প্রকৃত নেতা হিসাবে তিনি অভিষিক্ত করেন শ্যামাপ্রসাদকে।শেষ শিবরাত্রির এক বিরাটসভায় নিজের গলার মালাখানি শ্যামাপ্রসাদের গলায় পরিয়ে তাঁর উচ্চারণ – বিশ্বে হিন্দুর সামনে দাঁড়াতে পারে সেই নেতা ঠিক করে দিয়ে গেলাম।…..

বাঙ্গালী হিন্দুর দৃষ্টিতে স্বামী প্রণবানন্দ

দীর্ঘ দুইদশক একের পর এক হিন্দুবিরোধী দাঙ্গায় ত্রাণ কার্য করে ,মুসলিম লিগ রাজত্বে বাংলার হিন্দুদের উপর প্রবল অত্যাচারের রিপোর্ট প্রকাশ করে,তারপর কোনদিকে সাড়া না পেয়ে নিজেই হিন্দুসংগঠন ও হিন্দুপ্রতিরোধে প্রয়াসী হন স্বামী প্রণবানন্দ।বিনিময়ে অতিবুদ্ধি বাঙ্গালী হিন্দুপরিচালিত সংবাদপত্রগুলি তার সমালোচনা করে।হিন্দুদের সংগঠিত করে স্বামী প্রণবানন্দ সাম্প্রদায়িকতার অপরাধে দোষী।পরবর্তীকালে ডঃ জয়া চট্টোপাধ্যায়ের, “হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা ও দেশবিভাগ” গ্রন্থে স্বামী প্রণবানন্দকে দেশবিভাগের জন্য দায়ী করা হয়েছে।বাংলার সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির জগতে স্বামী প্রণবানন্দ এক উপেক্ষিত চরিত্র।মোটামুটি এটুকুই স্বামী প্রণবানন্দের হিন্দু আন্দোলনের মূল্যায়ন।

আসন্ন দেশবিভাগের ভয়াবহতা অনুমান করে স্বামী  প্রণবানন্দ বলেছিলেন…. বাঙ্গালী হিন্দুকে পিঁপড়ে মত টিপে মারা হবে হিন্দু প্রাণে বাঁচার জন্য এদিক ওদিক ছুটে বেড়াবে তবু তার এতটুকু ঠাঁই হবেনা! কতখানি অভ্রান্ত ছিলেন তিনি ইতিহাসই তা প্রমান করছে।

স্বামী প্রণবানন্দ বাকসর্বস্ব গুরু ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে এক বাস্তববাদী কর্মযোদ্ধা। দীর্ঘ তমসার শেষে আজ বাঙ্গালীসমাজে পুনরায় হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে স্বামী প্রণবানন্দের বাণী, কর্মধারা নবভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী তাত্বিক ও ব্যবহারিক অনুশীলনের বিষয় হয়ে উঠুক।