লুকিয়ে রাখা বিবেকানন্দ: রামকৃষ্ণ মিশনের বইতে স্বামীজীর যে “অসেকুলার” লেখাগুলি নেই

0
2918

রামকৃষ্ণ মিশনের প্রকাশিত স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনার সবকটি খণ্ডে বা ইংরেজী সংস্করণ Complete Works of Swami Vivekananda স্বামীজীর প্রণীত বেলুড় শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের নিয়মাবলীটি দেখতে পাবেন না। এই নিয়মাবলী প্ৰকাশক পি. কে , চট্টোপাধ্যায় শ্ৰীকৃষ্ণ প্রিন্টিং ওয়ার্কস, ২৭-বি, গ্রে স্ট্রীট কলিকাতা থেকে মুদ্রিত করেন বাংলা ১৪১১ সালে দোলপূর্ণিমায়। এই পুস্তিকার ভূমিকায় বিশিষ্ট লেখক রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায় লেখেন,

“স্বামী বিবেকানন্দের স্বল্পস্থায়ী জীবনের কীর্তি পর্বততুল্য স্বামীজীর ভাষণ, চিঠিপত্র ও বিভিন্ন রচনার পরিমাণ বিশাল, এই বিশাল সম্ভার থেকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে কিছু কিছু উৎকলিত করে যে কোনও নাস্তিক ও হিন্দু ধর্মের ঘোষিত শত্রুরাও হিন্দু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে কুকাজে ব্যবহার করতে পারে এবং তা করছেও। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে স্বামী বিবেকানন্দকে উপলব্ধি করার উপায় কী? স্বামীজীর কোন রচনা আমাদের কাছে বেদতুল্য হবে?

মানুষ যখন ভাষণ দেন তখন তাঁর চিন্তায় থাকে কোন কথা শ্রোতার মানসিকতার সঙ্গে সাযুজ্য রচনা করবে। কোনও পত্রিকায় লেখার জন্য চিন্তা করতে হয় সম্পাদক সেই লেখা পছন্দ করবেন কিনা। চিঠি লেখার সময় চিন্তা করতে হয় এই চিঠি প্রাপকের কাছে প্রীতিপ্ৰদ হবে কিনা। সেজন্য এই ধরনের রচনায় পরিপ্রেক্ষিত বিচার করা অবশ্যকর্তব্য।

কিন্তু সেই সত্য — যা মানুষ সততার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, পরিপ্রেক্ষিতের চাপে নয়। কোনও প্রতারক যখন একই জমি দুবার বিক্ৰী করে তখন দুটি দলিলে একই কথা লেখা থাকতে পারে। কিন্তু প্ৰথম দলিলটি সম্পাদনা করে সততার সঙ্গে, দ্বিতীয়টি অসততার সঙ্গে। সততার সঙ্গে উচ্চারণ করা কথাই মূল্যবান — সেটাই ঐতিহাসিক সত্য বলে গ্রাহ্য। মানুষ মনের কথা সততার সঙ্গে কার কাছে উচ্চারণ করে? স্ত্রী যদি বুদ্ধিমতী হন তবে তাঁর কাছে, অথবা অন্তরঙ্গ জনের কাছে। ব্ৰহ্মচারী সন্ন্যাসীরা তাঁদের মনের কথা অন্তরঙ্গ গুরুভ্রাতা বা শিষ্যদের কাছেই বলে যেতে পারেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে বিবেকানন্দের স্বহস্তলিখিত বেলুড় শ্ৰীরামকৃষ্ণ মঠের নিয়মাবলীতেই যথার্থ স্বামী বিবেকানন্দকে পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণকেও — স্বামীজীর চােখে দেখা যায় তাঁকে।

ইসলাম ও খ্রীস্টানীকে ‘বাহ্য ধর্ম’ বলেছেন স্বামীজী। তিনি মুসলমান ও খ্রীস্টানদের আর্যধর্মে ধর্মান্তরিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, “হিন্দু জাতি ও ধৰ্ম্মের রক্ষার জন্যই করুণাবতার ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব অবতীর্ণ হইয়াছেন।” আরও বলেছেন, “যে কেহ হিন্দু ধৰ্ম্ম হইতে বাহিরে যায়, আমরা যে কেবল তাহাকে হারাই তাহা নয়, একটী শক্ৰ অধিক হয়। ঐ প্রকার স্বগৃহ-উচ্ছেদকারী শক্রদ্বারায় মুসলমান অধিকার কালে যে মহা অকল্যাণ সাধিত হইয়াছে, ইহা ইতিহাস প্ৰসিদ্ধ।”

স্বামী বিবেকানন্দ শ্ৰীরামকৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ শিষ্যরূপে সর্বজনস্বীকৃত। যে বিবেকানন্দ ইসলাম ও খ্রীস্টানীকে ‘বাহ্যধর্ম’ বলছেন, সেই বিবেকানন্দের গুরু যে ঐ মতদ্বয়কে তাঁর যত মত তত পথের অন্তর্ভুক্ত করেননি, এ সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করাতে ইতঃস্তত করার কিছু নেই।”

বঙ্গদেশ পত্রিকা এই পুস্তিকাটি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে বাঙ্গালী সমাজকে উপহার দিচ্ছে। নীচে পুস্তিকাটি হুবহু মুদ্রিত হল।

 

বেলুড় শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের নিয়মাবলী

১৮৯৮

মঠ—(১)

১। শ্ৰীভগবান রামকৃষ্ণ-প্ৰদৰ্শিত প্ৰণালী অবলম্বন করিয়া নিজের মুক্তিসাধন করা ও জগতের সর্ব্বপ্রকার কল্যাণ সাধনে শিক্ষিত হওয়ার জন্য এই মঠ প্রতিষ্ঠিত হইল। স্ত্রীলোকদিগের জন্যও ঐ প্রকার আর একটি মঠ স্থাপিত হইবে।

২। যে ভাবে পুরুষদিগের মঠ পরিচালিত হইবে, স্ত্রীলোকদিগের মঠও ঠিক সেইভাবে পরিচালিত হইবে। বিশেষ এই স্ত্রীলোকদিগের মঠে পুরুষের কোন সংস্রব থাকিবে না এবং পুরুষদিগের মঠে স্ত্রীলোকের কোন প্রকার সংস্রব থাকিবে না।

৩। হিমাচলে কোন উপযুক্ত স্থানে ঐ প্রকার দুইটি মঠ স্থাপিত হইয়া ঐ প্রকার নিয়মে পরিচালিত হইবে।

৪ । স্ত্রীমঠ, যতদিন পৰ্য্যস্ত কাৰ্য্য সম্পাদনে সমর্থ স্ত্রী না পাওয়া যায়, ততদিন দূর হইতে পুরুষদের দ্বারা চালিত হইবে; তাহার পর উহারা আপনাদের সকল কাৰ্য্য আপনারাই করিয়া লইবে।

৫। বিদ্যার অভাবে ধর্ম-সম্প্রদায় নীচদশা প্রাপ্ত হয়। অতএব সৰ্ব্বদা বিদ্যার চর্চা থাকিবে।

৬ । ত্যাগ এবং তপস্যার অভাবে বিলাসিতা সম্প্রদায়কে গ্ৰাস করে ; অতএব ত্যাগ এবং তপস্যার ভাব সর্বদা উজ্জ্বল রাখিতে হইবে।

৭। প্রচারের দ্বারায় সম্প্রদায়ের জীবনীশক্তি বলবতী থাকে, অতএব প্রচারকাৰ্য্য হইতে কখনও বিরত থাকিবে না।

৮। এই প্রকার মঠ সমস্ত পৃথিবীতে স্থাপন করিতে হইবে। কোন দেশে আধ্যাত্মিক ভাব মাত্রেরই প্রয়োজন। কোন দেশে ইহজীবনের কিঞ্চিৎ সুখস্বচ্ছন্দতার অতীব প্রয়োজন। এই প্রকারে যে জাতিতে বা যে ব্যক্তিতে যে অভাব অত্যন্ত প্ৰবল তাহা পূরণ করিয়া সেই পথ দিয়া তাহাকে ধর্মরাজ্যে লইয়া যাইতে হইবে।

৯। ভারতবর্ষে প্রথম ও প্রধান কৰ্ত্তব্য — নীচ শ্রেণীর লোকদিগের মধ্যে বিদ্যা ও ধৰ্ম্মের বিতরণ। অন্নের ব্যবস্থা না করিতে পারিলে ক্ষুধাৰ্ত্ত ব্যক্তির ধৰ্ম্ম হওয়া অসম্ভব। অতএব তাহাদের নিমিত্ত অন্নাগমের নূতন উপায় প্রদর্শন করা সৰ্ব্বাপেক্ষা প্ৰধান ও প্ৰথম কৰ্ত্তব্য।

১০। সমাজসংস্কারের উপর মঠের অধিক দৃষ্টি থাকিবে না। কারণ, সামাজিক দোষ বা কুরীতি সমাজরূপ শরীরের ব্যাধিবিশেষ। ঐ শরীর বিদ্যা ও অন্নের দ্বারা পুষ্ট হইলে ঐ সকল কুরীতি আপনা আপনি চলিয়া যাইবে। অতএব সামাজিক কুরীতির উদ্ঘোষণে বৃথা শক্তি ক্ষয় না করিয়া সমাজশরীর পুষ্ট করাই এই মঠের উদ্দেশ্য।

১১। চরিত্রবল না হইলে মনুষ্য কোন কাৰ্য্যেই সক্ষম হয় না। এই চরিত্রবলবিহীনতাই আমাদের কাৰ্য্যপরিণত-বুদ্ধির অভাবের একমাত্র কারণ।

১২। আত্মনির্ভর ও আত্মপ্রত্যয় চরিত্রগঠনের একমাত্র উপায়। অতএব এই মঠের প্ৰত্যেক কার্য্যে ও প্রত্যেক শিক্ষায় ইহার উপর যেন লক্ষ্য থাকে।

১৩। শিষ্যের গুরুর উপর একান্ত বিশ্বাস থাকা উচিত। সেই প্রকার গুরুও শিষ্যের প্রতি একান্ত বিশ্বাসাবান না হইলে শিষ্যের উন্নতি হইতে পারে না। গুরু শিষ্যের উপর বিশ্বাস করিলে শিষ্যের শক্তি স্ফুরিত হয়। শিষ্যের বিশ্বাসে গুরুরও শক্তি বিপুলতা লাভ করে।

১৪। এই মঠের সমস্ত কাৰ্য্যই মঠস্থ সৰ্ব্বাঙ্গের সম্মতিক্রমে সম্পাদিত হইবে। সৰ্ব্বসম্মতির অভাবে অধিক সংখ্যকের সম্মতিতে হইবে।

১৫। যে কেহ কামকাঞ্চনত্যাগ করিয়া নিষ্কাম কৰ্ম্ম, ভক্তি, যোগ, জ্ঞান — ইহাদের এক, দুই বা সমস্ত অভ্যাস করিয়া জীবন অতিবাহিত করিতে চান, যিনি সচ্চরিত্র, ঈর্ষাশূন্য ও অধ্যক্ষের এবং গুরুর আদেশ পালনে প্রাণপণ তৎপর, তিনি এই মঠের অঙ্গ রূপে গৃহীত হইতে পারিবেন।

১৬। মঠের অঙ্গগণ দুই ভাগে বিভক্ত — নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসী। নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী শব্দে যাহারা আকুমার ব্রহ্মচারী ও যাহারা আজীবন ব্রহ্মচর্য্য পালন করিবে, তাহাদিগকে বুঝাইবে।

১৭। খণ্ডিত-ব্ৰহ্মচৰ্য্য যাহারা পুনৰ্ব্বার ব্ৰহ্মচৰ্য্য অবলম্বন করিয়া সন্ন্যাস লইবার জন্য প্ৰস্তুত হইতেছে, তাহারাও মঠের অঙ্গ হইতে পারিবে।

১৮। পিতামাতা বা অভিভাবকেরা যে সকল বালককে স্বেচ্ছায় শিক্ষার নিমিত্ত এই মঠে পাঠাইবেন, অথবা যে সকল বালক অনাথ, তাহারাও এই মঠে গৃহীত ও শিক্ষিত হইবে, কিন্তু মঠের অঙ্গ হইতে পারিবে না। শিক্ষা সমাপ্তির পর বিবাহ করা বা না করা তাহাদের ইচ্ছাধীন।

১৯। আপাততঃ কেবল সদ্বংশজাত হিন্দু-বালকই গৃহীত হইবে।

২০। ধৰ্ম্মের মধ্য দিয়া না হইলে ভারতবর্ষে কোন ভাব চলে না। এই জন্য অর্থ বিদ্যা, সমাজ-সংস্কার ইত্যাদি সমস্তই ধৰ্ম্মমধ্য দিয়া চালাইতে হইবে।

২১। এখন উদ্দেশ্য এই যে, এই মঠটিকে ধীরে ধীরে একটি সর্ব্বাঙ্গসুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করিতে হইবে। তাহার মধ্যে দার্শনিক চৰ্চ্চা ও ধৰ্ম্ম-চৰ্চার সঙ্গে সঙ্গে একটি পূর্ণ “টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট” করিতে হইবে। এইটী প্রথম কর্তব্য। পরে অন্যান্য অবয়ব ক্রমে ক্রমে সংযুক্ত হইবে।

২২। ভারতবর্ষের সমস্ত দুঃখের মূল — “নিম্নশ্রেণী ও উচ্চশ্রেণীর মধ্যে অত্যন্ত প্ৰভেদ হওয়া”। এই ভেদ নাশ না হইলে কোনও কল্যাণের আশা নাই। এই জন্য সকল স্থানে প্রচারক পাঠাইয়া ঐ সকল ব্যক্তিদিগকে বিদ্যা ও ধৰ্ম্ম শিক্ষা দিতে হইবে।

২৩। অতএব এই মঠে যাঁহারা এক্ষণে অধ্যক্ষ আছেন বা পরে অধ্যক্ষ হইবেন, তাহারা সৰ্ব্বদা যেন এইটী মনে রাখেন যে, এই মঠ কোনমতেই বাবাজীদিগের ঠাকুরবাটীতে পরিণত না হয়।

২৪। ঠাকুরবাটী দ্বারা দুই চারিজনের কিঞ্চিৎ উপকার হয়, দুই দশজনের কৌতুহল চরিতার্থ হয়, কিন্তু এই মঠের দ্বারা সমগ্ৰ পৃথিবীর কল্যাণ সাধিত হইবে।

মঠ — (২)

১। প্রীতি, অধ্যক্ষদিগের আজ্ঞাবহতা, সহিষ্ণুতা ও একান্ত পবিত্রতাই ভ্ৰাতৃবর্গের মধ্যে একতারক্ষার এক মাত্র কারণ।

২। সৰ্ব্বাপেক্ষা উদ্দেশ্যের একতা ঐক্যবন্ধনের প্রধান কারণ।

৩। আমাদের ঠাকুর মানের জন্য আসেন নাই, আমরা তাঁহার দাস, আমরাও মান ভোগের আকাঙ্ক্ষী নাহি। কেবল নিজে পবিত্ৰ থাকিয়া অন্যকে পবিত্রতা শিক্ষা দিয়া তাঁহার আজ্ঞা পালন করাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য।

৪। এই মঠের প্রত্যেক অঙ্গেরই ভাবা উচিৎ যে, তাঁহার প্রত্যেক কাৰ্য্যে তিনি যেন শ্ৰীভগবানের মহিমা প্ৰকাশ করেন। তিনি যেখানেই যান বা যে অবস্থাতেই থাকুন তিনি শ্ৰীরামকৃষ্ণের প্রতিনিধি, এবং লোকে তাঁহার মধ্য দিয়াই শ্ৰীভগবান্‌কে দর্শন করিবে।

৫। এই ভাবটী সদা মনে জাগরূক থাকিলে আর বেচালে পা পড়িবে না।

৬। আজ্ঞাবহতাই কাৰ্য্যকারিতার প্রধান সহায়। অতএব প্রাণভয় পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া আজ্ঞাপালন করিতে হইবে। সকল দুঃখের মূল ভয়। ভয়ই মহাপাপ, সেই ভয় একেবারেই ছাড়িতে হইবে।

৭। অপরের নামে গোপনে নিন্দা করা ভ্ৰাতৃভাব বিচ্ছেদের প্রধান কারণ। অতএব কেহই তাহা করিবে না। যদি কোন ভ্রাতার বিরুদ্ধে কিছু বলিবার থাকে ত একান্তে তাহাকেই বলা হইবে।

৮ । তাঁহার সেবক বা সেবকদের মধ্যে কেহই মন্দ নহে। মন্দ হইলে কেহ এখানে আসিত না। অতএব কাহাকেও মন্দ ভাবিবার অগ্ৰে “আমি মন্দ দেখি কেন?” প্ৰথম ভাবা উচিত।

৯। পুরুষানুক্রমে উদ্দেশ্যের একতানতাই (Continuance of Policy) মহৎকাৰ্য্য সাধনের ও উত্তরোত্তর শক্তিসঞ্চয়ের একমাত্র কারণ। অর্থাৎ আমাদের পূৰ্ব্বোক্ত উদ্দেশ্য সাধন করিবার জন্য একজন মঠাধ্যক্ষ যে কাৰ্য্যপ্ৰণালী পরিচালিত করিবেন, তাঁহার উত্তরাধিকারী তাহাই যেন অবলম্বন করিয়া অগ্রসর হয়েন।

১০। সংহতিই অত্যুত্থানের প্রধান উপায় ও শক্তিসংগ্রহের একমাত্র পন্থা। অতএব যে কেহ কায় মন ও বাক্যের দ্বারা এই সংহতির বিশ্লেষণ করিতে চেষ্টা করিবেন, তাহার মস্তকে সমস্ত সঙ্ঘের অভিশাপ নিপতিত হইবে এবং তিনি ইহপরলোক উভয় হইতে ভ্ৰষ্ট হইবেন।

১১। যদি কাহারও পদস্খলিত হয়, তাহা হইলে সমস্ত সঙ্ঘের নিকট আপন অপরাধ স্বীকার করিয়া সঙ্ঘ যাহা বিধান করেন, তাহাই অবনত মস্তকে পালন করিবে।

১২। যে কেহ অপরাধ করিয়া তাহা অস্বীকার পূর্বক সঙ্ঘের সহিত বিবাদ করিতে উদ্যত হন, তিনিও ইহলোক ও পরলোক হইতে ভ্ৰষ্ট হইবেন।

১৩। কারণ, এই সঙ্ঘই তাঁহার অঙ্গস্বরূপ এবং এই সঙ্ঘেই তিনি সদা বিরাজিত।

১৪। একীভূত সঙ্ঘ যে আদেশ করেন তাহাই প্রভুর আদেশ, সঙ্ঘকে যিনি পূজা করেন তিনি প্রভুকে পূজা করেন, এবং সঙ্ঘকে যিনি অমান্য করেন তিনি প্রভুকে অমান্য করেন।

মত

১। ঠাকুরের উক্তিসকল একত্র করিয়া তাহাকে একমাত্র শাস্ত্ৰ করিলে তাহার বিশাল ভাব ও আমাদের আজীবন পরিশ্রমের এই মাত্র ফল হইবে যে, আমরা একটি ক্ষুদ্র ও সঙ্কীর্ণ সম্প্রদায়ের স্রষ্টা হইব ও বহু বিবদমান ভাগে বিভক্ত এই সমাজকে আরও কোলাহলময় করিয়া তুলিব।

২। অতএব আমাদের সনাতন শাস্ত্ৰ বেদই একমাত্র শাস্ত্ররূপে পরিগৃহীত ও প্রচারিত হইবে, ও গীতা যে প্রকার পুরাকালে ছিল সেই প্রকার ঠাকুরের উক্তি আধুনিক সৰ্ব্বাঙ্গ সুন্দর বেদমতের ব্যাখ্যা।

৩। অর্থাৎ শঙ্করাচাৰ্য্য প্রভৃতি সমস্ত ভাষ্যকারেরাই এক এই বিষম ভ্ৰমে পতিত হইয়া ছিলেন যে, সমগ্ৰ বেদরাশিই এক কথা বলিতেছেন। সেইজন্য আপাতবিসম্বাদী উক্তিসকলের মধ্যে স্বীয় মতের বিরুদ্ধ উক্তিগুলিকে বলপূর্বক আপন মতানুযায়ী অর্থকরণ দোষে দূষিত হইয়াছেন।

৪। পুরাকালে যে প্রকার একমাত্র গীতা বক্তা ভগবান্‌ই এই সকল আপাতবিবদমান উক্তিসকলের মধ্যে কিঞ্চিৎ সামঞ্জস্য বিধান করিয়াছিলেন, কালে অতীব বিশালতাপ্ৰাপ্ত সেই বিবাদ নিঃশেষে ভঞ্জন করিবার জন্যই তিনিই শ্রীরামকৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হইয়াছেন।

৫। এইজন্য তাঁহার উক্তিসকলের মধ্য দিয়া না পড়িলে ও তাঁহার জীবনের মধ্য দিয়া না দেখিলে বেদ বেদান্ত বুঝিবার কাহারও শক্তি নাই। অর্থাৎ, এই যে সকল স্থূল দৃষ্টিতে বিসম্বাদী শাস্ত্ৰোক্তি অধিকারিবিশেষে উপদিষ্ট ও ক্রমবিকাশের প্রণালীতে নির্দিষ্ট, ইহা শ্ৰীভগবান্ই প্ৰথমে নিজের জীবনে প্রকাশ ও উপদেশ করেন এবং সমস্ত জগৎ বিবাদ বিসম্বাদ ভুলিয়া ধৰ্ম্ম ও অন্যান্য বিষয়ে যে ভ্রাতৃভাবে নিবন্ধ হইবে, তাহা এই কেন্দ্ৰ হইতেই ক্রমশঃ দূরবিসর্পী প্রভাব-চক্রবাল দ্বারা অনুমিত হইতেছে।

৬। অর্থাৎ বেদাদি শাস্ত্ৰ এতদিন অজ্ঞানান্ধকারে লুপ্ত ছিল, শ্ৰীরামকৃষ্ণরূপ প্ৰদীপ উহাকে পুনঃপ্রকাশিত করিল।

৭। অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, নূতন শাস্ত্ৰ অনাবশ্যক । প্রাচীন অনাদি শাস্ত্ৰ হইতে নতুন আলোক আসিতেছে; শ্ৰীরামকৃষ্ণরূপ অনুবীক্ষণের মধ্য দিয়া এই শাস্ত্রের মৰ্ম্ম সংগ্ৰহ করিতে হইবে।

৮। ঠাকুরের উক্তি সকল উত্তমরূপে সংগৃহীত ও যে সকল সেবক ঠাকুরের নিকট সৰ্ব্বদা থাকিতেন তাঁহাদের দ্বারা পরিগৃহীত হইলে বেদের টীকারূপে পূজিত হইবে।

৯। ঠাকুরের ভাবের অনুকূল বেদার্থ করিতে হইবে। সৰ্ব্বাপেক্ষা এই ভাব যেন সৰ্ব্বদা মনে থাকে যে , তাঁহার সমস্ত উপদেশই জগতের হিতের জন্য। যদি কেহ কখন কোন অহিতকর বাক্য শুনিয়া থাকেন তাহা হইলে বুঝা উচিত যে, সে বাক্য অধিকারিবিশেষে প্রযুক্ত এবং অন্য লোকে পালন করিলে অকল্যাণকর হইলেও সেই অধিকারীর জন্য মঙ্গলপ্ৰদ।

১০। ঐ প্রকার ঠাকুরের সমস্ত উক্তির মধ্যে ব্যক্তিবিশেষে উপদিষ্ট ও সাৰ্ব্বজনিক কল্যাণের জন্য উপদিষ্ট উক্তি বাছিয়া লইতে হইবে। তন্মধ্যে সাৰ্ব্বজনিক কল্যাণ প্রযুক্ত উপদেশ সমূহই পুস্তকাকারে সংগৃহীত হইবে ও জনসাধারণে প্রচারিত হইবে।

১১। অধিকারিবিশেষে উপদিষ্ট উপদেশ সকলও সংগৃহীত হইয়া গোপনভাবে মঠে পরিরক্ষিত হইবে। — যাহা দ্বারা মঠের প্রচারকগণ ব্যক্তিবিশেষে বিশেষ উপদেশ প্রদানে শিক্ষিত হইবেন।

১২। প্রভুর নিজের মুখের একটি উপদেশ এই যে, যাহারা বহুরূপী একবার দর্শন করিয়াছে তাহারা বহুরূপীর একটীমাত্র রঙই জানে; কিন্তু যাহারা বৃক্ষের তলায় বাস করিয়াছে তাহারা বহুরূপীর সকল বর্ণই জ্ঞাত থাকে। এইজন্য যাঁহারা প্রভুর নিকট সৰ্ব্বদা বাস করিতেন ও যাঁহাদিগকে তিনি স্বীয় কাৰ্য্যসাধনের জন্য পালন করিয়াছেন, তাঁহাদিগের সম্মতি ব্যতিরিক্ত কোন উক্তিই প্রমাণিক বলিয়া গৃহীত হইবে না।

১৩। জ্ঞান, যোগ, ভক্তি ও কৰ্ম্মের পরাকাষ্ঠা সমষ্টিস্বরূপ এরূপ অপূৰ্ব্ব পুরুষ আর মানবজাতির মধ্যে কখনই সমুদিত হন নাই। ঐ প্রকার সৰ্ব্বাঙ্গসুন্দর যাহার চরিত্র, তিনিই শ্ৰীরামকৃষ্ণদেবের যথার্থ শিষ্য ও অনুগামী।

১৪। ঐ প্রকার সৰ্ব্বাঙ্গসুন্দর চরিত্র গঠনই এই যুগের উদ্দেশ্য ও তাহার জন্যই সকলের প্রাণপণ চেষ্টা করাই কৰ্ত্তব্য।

সাধন প্ৰণালী

১। শ্ৰী ভগবান্ ব্যক্তিবিশেষে বিভিন্ন সাধন শিক্ষা দিতেন। এইজন্য সাধন প্ৰণালীর সাৰ্ব্বজনীন কোন নিয়ম হইতে পারে না।

২। তবে লোকসাধারণের জন্য কিঞ্চিৎ ভক্তি, ভজন ও কৰ্ম্মপরিণত জ্ঞান (Practical Advaitism – “অদ্বৈত জ্ঞান আঁচলে বেঁধে যা ইচ্ছা তাই কর”) শিক্ষা দিলেই যথেষ্ট হইবে।

৩। প্রভুর প্রদর্শিত সমুদয় সাধন প্রণালী পূর্বোক্ত প্রকারে সংগৃহীত হইয়া গোপনভাবে মঠে পরিরক্ষিত হইবে এবং শিক্ষকদিগের শিক্ষার জন্য থাকিবে, কারণ, ব্যক্তিবিশেষে উপদিষ্ট সাধন অপর ব্যক্তির অনিষ্টকারকও হইতে পারে।

৪। জ্ঞান, ভক্তি, যোগ ও কৰ্ম্মের সমবায়ে চরিত্র গঠিত করা এই মঠের উদ্দেশ্য এবং তন্নিমিত্ত যে সকল সাধন করা প্রয়োজন সেই সকল সাধনই এই মঠের সাধন বলিয়া পরিগৃহীত হইবে।

৫। অতএব সকলেরই মনে রাখা উচিত যে, এই সকল অঙ্গের যিনি একটাতেও ন্যূনতা প্রদর্শন করেন, তাঁহার চরিত্র রামকৃষ্ণরূপ মূষায় প্রকৃষ্টরূপে দ্রুত হয় নাই।

৬। আরও ইহা মনে রাখা উচিত যে, নিজের মুক্তি সাধনের জন্যমাত্র যিনি চেষ্টা করেন তদপেক্ষা যিনি অপরের কল্যাণের জন্য চেষ্টা করেন তিনি মহত্তর কার্য্য করেন।

৭। এই শিক্ষার জন্য প্রথমতঃ এই মঠ চতুর্বিভাগে বিভক্ত হইবে। যথা — জ্ঞান, ভক্তি, কৰ্ম্ম ও যোগ; এবং প্রত্যেক বিভাগেই ঐ বিভাগের শিক্ষিতব্য বিষয়ের উপদেশের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিগণ উপদেষ্টারূপে নিযুক্ত থাকিবেন।

৮। প্রত্যেক বিভাগেই ঐ বিভাগের শিক্ষিতব্য বিষয়ের উপযোগী পুস্তকাদি পাঠ হইবে ও অনুভূতির নিমিত্ত সাধন শিক্ষিত হইবে।

৯। কিন্তু সকল বিভাগেরই অঙ্গাদিকে কিছু না কিছু কৰ্ম্মবিভাগের কাৰ্য্য করিতে হইবে।

১০। “শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম্মসাধনম।” অতএব শরীররক্ষার প্রতি সর্ব্বদা দৃষ্টি রাখিতে হইবে। তবে কোন মহদুদ্দেশ্য সাধনে যদি শরীর পাত হয়, পরমকল্যাণ বুঝিতে হইবে।

১১। গীতাদি শাস্ত্র এবং শ্ৰীভগবান্ স্বয়ংও বৃথা কঠোর তপস্যার প্রতিপক্ষ ছিলেন। অতএব তাহা পরিত্যাগ করিতে হইবে। কিন্তু যে সকল তপস্যা শারীরিক কিঞ্চিৎ ক্লেশপ্ৰদ হইলেও বিশেষ কল্যাণকর, সকলেরই ঐ সকল তপস্যা অভ্যাস করা আবশ্যক; নতুবা বিলাসিতা প্ৰবেশ করিয়া সর্বনাশ করবে।

১২। আমাদের উদেশ্য বিলাসিতাও নহে, তপস্যাও নহে, অথবা যোগও নহে; উদ্দেশ্য— ভববন্ধন ছেদন, জ্ঞানলাভ বা ভক্তিলাভ।

১৩। অতএব যে কোন উপায় দ্বারা এই উদ্দেশ্য সাধিত হইবে, আমরা মহা সমাদরে তাহাই গ্রহণ করিব।

১৪। শ্ৰীভগবান এখনও রামকৃষ্ণশরীর ত্যাগ করেন নাই। কেহ কেহ তঁহাকে এখনও সেই শরীরে দেখিয়া থাকেন ও উপদেশ পাইয়া থাকেন এবং সকলেই ইচ্ছা করিলে দেখিতে পাইতে পারেন। যতদিন তিনি পুনৰ্ব্বার স্থূল শরীরে আগমন না করিতেছেন ততদিন তাহার এই শরীর থাকিবে। সকলের প্রত্যক্ষ না হইলেও তিনি যে এই সঙ্ঘের মধ্যে থাকিয়া এই সঙ্ঘকে পরিচালিত করিতেছেন ইহা সকলেরই প্রত্যক্ষ; তাহা না হইলে এই নগণ্য, অত্যল্পসংখ্যক, অসহায়, পরিতাড়িত বালকদিগের দ্বারা এতাদৃশ স্বল্পকালের মধ্যে সমগ্ৰ ভূমণ্ডলে এত আন্দোলন কখনই সংঘটিত হইত না।

১৫। অতএব এই সঙ্ঘের মধ্যে যদি কেহ শ্ৰীভগবানের উপদেশের অবিসম্বাদী কোন নূতন প্রণালী উদ্ভাবন করেন এবং তাহার সুফল যদি প্রত্যক্ষ হয়, তাহা হইলে উহাও শ্ৰীভগবানের আদেশরূপে গৃহীত, আদৃত ও পালিত হইবে।

১৬। শ্ৰীভগবান্ কামিনীকাঞ্চনের ন্যায় আর কোন ভাবকে যদি বারম্বার ত্যাগ করিতে আদেশ করিয়া থাকেন তাহা এই যে, ঈশ্বরের অনন্ত ভাবকে ইতি ইতি করিয়া সীমাবদ্ধ করা।

১৭। যে কেহ ঐ প্রকারে শ্ৰীভগবানের অনন্তভাবকে সীমাবদ্ধ করিতে চেষ্টা করিবে, সে নরাধম তাঁহার দ্বেষী।

১৮। সঙ্কীর্ণ সমাজে ধর্মের গভীরতা ও প্রবলতা থাকে, ক্ষীণবপু জলধারা সমধিক বেগ শালিনী উদার সমাজে ভাবের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে গভীরতা ও বেগের নাশ দেখিতে পাওয়া যায়।

১৯। কিন্তু আশ্চৰ্য্য এই যে, সমস্ত ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত উল্লঙ্ঘন করিয়া এই রামকৃষ্ণশরীরে সমুদ্র হইতেও গভীর ও আকাশ হইতেও বিস্তৃত ভাব রাশির একত্র সমাবেশ হইয়াছে।

২০। উহার দ্বারা প্রমাণ হইতেছে যে, অতি বিশালতা, অতি উদারতা ও মহা প্ৰবলতা একাধারে সন্নিবিষ্ট হইতে পারে এবং ঐ প্রকারে সমাজও গঠিত হইতে পারে। কারণ, ব্যষ্টির সমষ্টির নামই সমাজ।

ভক্তি

১। সেবা, জপ, ভজনাদি যে সকল ভক্তি সাধনের উপায় পুরাকালে বা আধুনিক কালে উপদিষ্ট হইয়াছে অথবা ভবিষ্যতে উপদিষ্ট হইবে সেই সমুদয়ই সমাদরে পরিগৃহীত হইবে। কিন্তু তন্মধ্যে সাবধানের বিষয় এই যে, অনেক সময় ভক্তিমাত্ৰেই চরিত্র গঠিত হয় না। আচার পূত (moral) না হইলে কাহারও ভক্তিতে অধিকার নাই, ইহা বিশেষ রূপে মনে রাখিতে হইবে।

২। সঙ্কীৰ্ত্তনের উৎসাহে লম্ফঝম্প করিয়া স্নায়ুমণ্ডলীকে পৰ্য্যস্ত করতঃ মূর্চ্ছাগ্রস্ত হওয়াই ভক্তি নহে, ইহাও যেন সকলের মনে থাকে।

৩। ভক্তির প্রবলতায় যোগের উচ্চ সীমায় উপস্থিত হওয়া যায়। কিন্তু লম্ফঝম্প করিলে, বা মূর্চ্ছাগ্রস্ত হইলে, অথবা উক্ত ভাবকালে অলৌকিক দর্শন হইলেই যে জীব সমাধি-অবস্থা প্ৰাপ্ত হইয়াছে, ইহা সিদ্ধান্ত নহে।

৪। ভক্তির প্রভাবে সমাধি উপস্থিত হইয়াছে, বা স্নায়ুর তাড়নায় স্বপ্নসন্দর্শন হইতেছে, ইহা স্থির করিতে হইবে।

৫। শ্ৰী ভগবান ভাবসমাধির পরে যে সকল ঘটনা দেখিতেন বা ভবিষ্যৎবাণী করিতেন, সে সমস্তই ক্রমশঃ পরিপূর্ণ হইতেছে। অপিচ সেই অবস্থাতে তাঁহার প্রত্যেক প্রত্যক্ষই জীবের কল্যাণের কারণ, স্বাৰ্থশূন্য ও সদাচারপূর্ণ।

৬। যদি কাহারও ঐ প্রকার ভাবসমাধি হয় তাহা হইলে তাহা ভক্তিসাধনের ফলস্বরাপ বুঝিতে হইবে। আর যদি উহা স্বাৰ্থপূর্ণ, সদাচারবিরোধী ও নিস্ফল হয়, তাহা হইলে সেই ব্যক্তিকে স্নায়ুরোগে আক্রান্ত বুঝিতে হইবে, এবং যাহাতে তাহার সেই রোগ উপশমিত হয় তাহার জন্য যত্ন করিতে হইবে।

৭। অধ্যক্ষদিগের ইহাও বিশেষ দৃষ্টি রাখা উচিত যে, ভক্ত্যাদি অঙ্গের একটি প্রবল হইয়া অপরগুলিকে নিরন্ত না করে।

৮। ভক্তিভাব বৃদ্ধির জন্য ভজন স্বরূপ ভগবানের গুণানুবাদ গীত হইবে। এবং উহাতে তাল মানাদির প্রতি দৃষ্টি রাখিতে হইবে।

ঠাকুরঘর

১। এই মঠের প্রত্যেক অঙ্গই ঠাকুরঘরে যাইয়া পূজা করিতে পারিবেন।

২। ঠাকুর স্থাপন, পূজা, ভোগরাগ ইত্যাদি সম্বন্ধে পরমহংসদেবের কোন উপদেশ নাই। ইহা তাঁহার সম্মানের জন্য আমরা কল্পনা করিয়াছি।

৩। যোগ, ধ্যান, ভজন, জপ ইত্যাদিই তাহার প্রধান শিক্ষা। মঠে বৰ্ত্তমান ব্যক্তিদিগের মধ্যে কেহই একথা স্বীকার করেন না যে, পরমহংসদেব কাহাকেও মূৰ্ত্তিস্থাপন, পূজা, ভোগরাগাদির উপদেশ করিয়াছেন। কেবল তাঁহার জীবনের শেষ অবস্থায় কোন কোন শিষ্যকে নিজমূৰ্ত্তি ধ্যান করিতে বলিতেন।

৪। প্রভুর উপদেশানুসারে কাৰ্য্য করাই তাঁহাকে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা।

৫। অতএব প্রভুর নিজ জীবনে প্ৰদৰ্শিত ও তাঁহার মুখে উপদিষ্ট ধ্যান, ভজন ইত্যাদি উচ্চ অঙ্গের ভক্তিমুক্তিপ্রদ সাধনের শিক্ষা ও সিদ্ধির নিমিত্ত, আম্লেচ্ছচণ্ডালাদি সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ঐ সকল ভাব প্রচার করিবার জন্য এই মঠ স্থাপিত হইয়াছে।

৬। যে কেহ পবিত্ৰহৃদয়ে যে কোন প্রকারে তাঁহার প্রদর্শিত পন্থা অবলম্বন করেন, তিনিই ত্যাগী হইলে এই মঠের অঙ্গস্বরূপে নিৰ্ব্বাচিত হইতে পারিবেন। প্রভুকে তিনি ঈশ্বর ভাবে, অবতার ভাবে বা সাধারণ গুরু ভাবে গ্রহণ করুন তাহাতে ইষ্টাপত্তি নাই।

৭। মূৰ্ত্তিপূজাদি অন্যান্য ভাবও যথাস্থানে পরিরক্ষিত হইবে। কিন্তু প্রভুর প্রদর্শিত শিক্ষাপ্রণালীই সৰ্ব্বোচ্চ স্থান প্রাপ্ত হইবে ও সৰ্ব্বাপেক্ষা সমধিক প্রযত্নের অধিকারী হইবে।

৮। অর্থাৎ প্রত্যেকেই এইটী বিশেষ মনে রাখিবেন যে, যিনি ধ্যান, ভজন ইত্যাদি প্ৰণালী ত্যাগ করিয়া কেবলমাত্র মূৰ্ত্তিপূজা, ভোগরাগ ইত্যাদিতে ব্যস্ত আছেন, তিনি প্রভুর প্ৰদৰ্শিত শিক্ষা প্ৰণালীকে অবজ্ঞা করিতেছেন। ধ্যান ভজন ইত্যাদি প্ৰধান কৰ্ত্তব্যের সঙ্গে মূৰ্ত্তিপূজা প্রভৃতি আর সমস্ত থাকুক হানি নাই।

ভারতবর্ষের কাৰ্য্যপ্ৰণালী

১। মুসলমানগণ যখন এইদেশে প্রথম প্রবেশ করেন, তখন তাঁহাদের ঐতিহাসিক মতে এই ভারতবর্ষে ৬০ কোটী হিন্দুর অধিবসতি ছিল। এই গণনায় অত্যুক্তিদোষ না থাকিয়া বরং অনুক্তি দোষ আছে, কারণ মুসলমানদিগের অত্যাচারেই অনেক প্রজা ক্ষয় হইয়া যায়। অতএব স্পষ্টই প্ৰতীত হইতেছে যে, হিন্দুর সংখ্যা ৬০ কোটীরও অধিক ছিল; কিছুতেই ন্যূন নয়। কিন্তু আজ সে হিন্দু ২০ কোটীতে পরিণত হইয়াছে। তাহার উপর খ্রীস্টানরাজ্যের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ২ কোটী লোক খ্রীস্টান হইয়া গিয়াছে এবং প্রতি বৎসর প্রায় লক্ষাধিক লোক খ্রীস্টান হইয়া যাইতেছে। এই হিন্দু জাতি ও ধর্মের রক্ষার জন্যই করুণাবতার ভগবান শ্ৰীরামকৃষ্ণদেব অবতীর্ণ হইয়াছেন।

২। জাতিবিভাগেই আমাদের সমাজ গঠিত। সকল সমাজই ঐ প্রকারে গঠিত। তবে আমাদের সমাজ ও অন্যান্য সমাজে কিছু প্ৰভেদ আছে।

৩। সমস্ত প্ৰকৃতির মধ্যে দুইটি মহাশক্তি নিরন্তর কাৰ্য্য করিতেছে। এই দুই মহাশক্তির সঙ্ঘর্ষেই জগতের বৈচিত্র্য ও লীলা সংঘটিত হইতেছে। মানবসমাজেও এই দুই শক্তি জাতি রােপ বৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত উৎপাদনা করিতেছে ও করিবে। এই বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর ছায়ার ন্যায় অধিকারতারতম্য মানবসমাজে উপস্থিত হইতেছে।

৪। ঐ দুইটি শক্তির মধ্যে একটি অধিকারতারতম্যের অনুকূল ও দ্বিতীয়টী তাহার প্রতিকূলে উপস্থিত হইয়া তাহাকে নষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছে।

৫। বৈচিত্র্য জগতের প্রাণ। এবং এই বৈচিত্র্যরূপ জাতি কখনও বিনষ্ট হইবার নহে। অর্থাৎ বুদ্ধি ও শক্তির তারতম্যে ব্যক্তিবিশেষে ক্রিয়ার বিশেষত্ব থাকিবেই। যথা, কেহ সমাজ শাসনে পারদর্শী কেহ বা পথের ধূলি পরিষ্করণে ক্ষমতাবান। এই বলিয়া সমাজ শাসনে পারদর্শী মানবেরই যে জগতের যাবতীয় সুখভোগে অধিকার থাকিবে এবং পথের ধূলি-পরিষ্কারক অনাহারে মরিবেন, ইহাই সামাজিক অকল্যাণের মূল কারণ। আমাদের দেশে সম্প্রতি যত জাতি আছে তদপেক্ষা যদি লক্ষাধিক জাতি হয়, তবে কল্যাণ বই অকল্যাণ নাই। কারণ যে দেশে জাতির সংখ্যা যত অধিক সে দেশে শিল্পাদি ব্যবসায়ের সংখ্যা ততই অধিক; কিন্তু মৃত্যুর ছায়া রূপ ভোগতারতম্যরূপ জাতির বিপক্ষেই সংগ্ৰাম চলিতেছে। যে জাতি এ সংগ্রামে যত পরাজিত তাহার দুর্দ্দশা ততই অধিক। এ সংগ্রামে যে জাতি যে পরিমাণে জয়লাভ করিতেছেন, সে জাতি সেই পরিমাণে উন্নতির সোপানে আরোহণ করিতেছেন।

৬। সমাজে যাহাকে সমাজনীতি বা politics বলে, তাহা কেবল এই ভোগ্যতারতম্য-সমুত্থিত অধিকার-প্রাপ্ত ও অধিকার-নিরাকৃত জাতিসমূহের সংগ্রামের নাম।

৭ । এই অধিকারতারতম্যের মহাসংগ্রামে পরাস্ত হইয়া ভারতবর্ষ গতিপ্ৰাণপ্ৰায় পতিত হইয়াছে।

৮। অতএব বাহ্যজাতির সহিত সাম্য স্থাপন অতি দূরের কথা, যতদিন এ ভারত নিজগৃহে সাম্য স্থাপন করিতে না পারিবে, ততদিন তাহার পুনৰ্জ্জীবনী শক্তি লাভের আশা নাই।

৯। অর্থাৎ সার কথা এই যে, ব্রাহ্মাণ ক্ষত্রিয়াদি জাতিবিভাগ কোন দোষের নহে; কিন্তু ভোগাধিকার তারতম্যই মহা অনর্থের কারণ হইয়া উঠিয়াছে।

১০ । অতএব আমাদের উদ্দেশ্য জাতিবিভাগ নষ্ট করা নয়; কিন্তু ভোগাধিকারের সাম্যসাধনই আমাদের উদ্দেশ্য। আচণ্ডালে যাহাতে ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের অধিকার সহায়তা হয়, তাহার সাধন করাই আমাদের জীবনের প্রধান ব্ৰত৷

১১। এই ভারত পুনৰ্ব্বার জাগ্রত হইবে। এবং যে মহাতরঙ্গ এই কেন্দ্ৰ হইতে সমুত্থিত হইয়াছে, মহাপ্লাবনের ন্যায় তাহা সমগ্ৰ মানবজাতিকে উচ্ছ্বসিত করিয়া মুক্তিমুখে লইয়া যাইবে। ইহা আমাদের বিশ্বাস এবং শিষ্যপরম্পরাক্রমে প্ৰাণপণে ইহারই সাধনে আমরা কটিবদ্ধ।

১২। যে কেহ ইহাতে বিশ্বাস করিবে, সেই প্রভুর কৃপায় মহাবীৰ্য্য ও ওজস্বিতা লাভ করিবে।

১৩। পাশ্চাত্য আলোকের প্রভায় এই ভারতভূমি অধুনা কিঞ্চিৎ প্রতিভাত হইতেছে। ধীরে ধীরে এই সুপ্ত জাতির মধ্যে পাশ্চাত্য মহাজাতি সমূহের অধিকার তারতম্য ভঞ্জনের বিরাট্ উদ্যম ও প্রাণপণ সংগ্রামের বার্তা অস্মদ্দেশীয় পরাহত প্ৰাণেও কিঞ্চিৎ আশার সঞ্চার করিতেছে। মানবসাধারণের অধিকার, আত্মার মহিমা নানা বিকৃত সুকৃত প্ৰণালীমধ্য দিয়া শনৈঃ শনৈঃ এ দেশের ধমনীতে প্রবেশ করিতেছে। নিরাকৃত জাতি সকল আপনাদের লুপ্ত অধিকার পুনৰ্ব্বার চাহিতেছে। এ সময়ে যদি বিদ্যা, ধৰ্ম্ম ইত্যাদি জাতিবিশেষে আবদ্ধ থাকে, তবে সে বিদ্যার ও সে ধৰ্ম্মের নাশ হইয়া যাইবে।

১৪। তিন বিপদ আমাদের সম্মুখে – (১) ব্রাহ্মণ-ব্যতিরিক্ত আর সমস্ত বর্ণ একত্রিত হইয়া পুরাকালে বৌদ্ধধৰ্ম্ম বিশেষের ন্যায় এক নূতন ধৰ্ম্ম সৃষ্টি করিবে ; (২) বাহ্যদেশীয় ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিবে; অথবা (৩) সমস্ত ধৰ্ম্মভাব ভারতবর্ষ হইতে একেবারে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে।

১৫। প্ৰথম পক্ষে এই অতি প্ৰাচীন সভ্যতা সমাধানে সমস্ত প্ৰযত্নই বিফল হইয়া যাইবে। এই ভারতবর্ষ পুনরায় বালকত্বপ্রাপ্ত হইয়া সমস্ত পূৰ্ব্বগৌরব বিস্মৃত হইয়া উন্নতির পথে বহুকালান্তরে কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইবে। দ্বিতীয় কল্পে ভারতীয় সভ্যতার ও আৰ্য্যজাতির বিনাশ অতি শীঘ্রই সাধিত হইবে। কারণ, ষে কেহ হিন্দু ধৰ্ম্ম হইতে বাহিরে যায়, আমরা যে কেবল তাহাকে হারাই তাহা নয়, একটী শক্ৰ অধিক হয়। ঐ প্রকার স্বগৃহ-উচ্ছেদকারী শক্রদ্বারায় মুসলমান অধিকার কালে যে মহা অকল্যাণ সাধিত হইয়াছে, ইহা ইতিহাস প্রসিদ্ধ। তৃতীয় কল্পে মহাভয়ের কারণ এই যে, যে ব্যক্তির বা জাতির যে বিষয়ে প্রাণের ভিত্তি পরিস্থাপিত, তাহা বিনষ্ট হইলে সে জাতিও নষ্ট হইয়া যায়। আর্য্যজাতির জীবন ধর্ম্মভিত্তিতে উপস্থাপিত। তাহা নষ্ট হইয়া গেলে আৰ্য্যজাতির পতন অবশ্যম্ভাবী।

১৬। নদীবেগ আপনা হইতেই বাধাহীন পথ নিৰ্ব্বাচিত করিয়া লয়। সমাজের কল্যাণ-স্রোতও সেই প্রকার বাধাহীন পথে আপনা হইতেই চলে। অতএব সমাজকে ঐ প্রকার পথে লইয়া যাইতে হইবে।

১৭। এই ভারতবর্ষ স্বগৃহজাত ও বাহ্যদেশসমাগত বহু জাতিতে পরিপূর্ণ। আৰ্য্যধৰ্ম্ম, আৰ্যভাব ইহাদের অধিকাংশের মধ্যে এখনও প্রবিষ্ট হয় নাই।

১৮। অতএব এই ভারতবর্ষকে প্রথমতঃ আৰ্য্যভাবাপন্ন করিলে, আৰ্য্যাধিকার দিলে, আৰ্য্যজাতির ধৰ্ম্মগ্রন্থে ও সাধনে সকলকে সমভাবে আহ্বান করিলে এই মহা বিপদ্ হইতে আমরা উত্তীর্ণ হইতে পারিব। এই জন্য প্রথমতঃ যে সকল জাতি সংস্কারবিহীন হইয়া আৰ্য্যধৰ্ম্ম হইতে কিঞ্চিৎ বিচ্যুত হইয়াছে, পুনঃসংস্কার দ্বারা আৰ্যজাতির ধৰ্ম্মে তাহাদিগকে সম্পূর্ণ অধিকার দিতে হইবে। মনুষ্যের যেখানে অধিকার, সেখানেই তাহার প্রেম। নতুবা ব্ৰাহ্মণ মাত্রেরই ধৰ্ম্ম বলিয়া অন্যান্য জাতি পরিত্যাগ করবে। ঐ প্রকার আচণ্ডাল সৰ্বজাতিকে ও ম্লেচ্ছাদি বাহ্যজাতিকেও সংস্কারাদি দ্বারা হিন্দুসমাজকে বিস্তৃত করিতে হইবে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই কাৰ্য্যে অগ্রসর হইতে হইবে। অধুনা শাস্ত্রোক্ত অধিকারী হইয়াও যাহারা নিজ অজ্ঞতায় সংস্কারবিহীন, তাহাদিগকে সংস্কৃত করা কৰ্ত্তব্য।

১৯। এই প্রকারে শাস্ত্রের ও ধৰ্ম্মের প্রচার ও প্রচারক বহুল হইবে।

২০। মুসলমান বা খ্রীস্টানদিগকেও হিন্দু ধৰ্ম্মে আনিবার বিশেষ উদ্যোগ করিতে হইবে। কিন্তু উপনয়নাদি সংস্কার কিছুদিনের জন্য তাহাদের মধ্যে হওয়ার আবশ্যক নাই।

২১। এই জগতের আবার সেই অবস্থা যখন “সৰ্ব্বং ব্ৰহ্মময়ং জগৎ” পুনরায় হইবে, যখন শূদ্ৰবল, বৈশ্যবল, ও ক্ষত্রিয়বলের আর আবশ্যকতা থাকিবে না, যখন মানবসন্তান যোগবিভূতিতে বিভূষিত হইয়াই জন্ম পরিগ্রহ করিবে, যখন চৈতন্যময়ী শক্তি জড় শক্তির উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য স্থাপন করিবে; তখন রোগশোক আর মনুষ্য শরীরকে আক্রমণ করিতে পারিবে না, ইন্দ্ৰিয় সকল আর মনের প্রতিকূলে ধাবমান হইতে পারিবে: না, পশুবলপ্রয়োগ পুরাকালের স্বপ্নের ন্যায় লোকস্মৃতি হইতে একেবারে বিলুপ্ত হইবে। যখন এই ভূমণ্ডলে প্রেমই একমাত্ৰ সৰ্ব্বকার্য্যের প্রেরয়িতা হইবে, — তখনই সমগ্ৰ মনুষ্য জাতি ব্ৰাহ্মণ্যবিশিষ্ট হইয়া ব্ৰাহ্মণ হইয়া যাইবে। তখনই জাতিভেদ লুপ্ত হইয়া প্রাচীন ঋষিদিগের দৃষ্ট সত্যযুগ সমুপস্থিত হইবে। সেই পথে যে জাতি বিভাগ ক্রমশঃ অগ্রসর করে, তাহাকেই অবলম্বন করিতে হইবে। যে জাতি বিভাগ জাতিভেদনাশের প্রকৃষ্ট উপায় তাহাই সুপরিগৃহীত হইবে।

২২। স্বগোত্রে বা যে সকল গোত্রের সহিত অতি নিকট রুধির সম্বন্ধ তাহাদের পরস্পরের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধবন্ধন হওয়াই জাতির শরীরকে দুর্ব্বল করিয়া ফেলিয়াছে। দুৰ্ব্বলশরীরধারী জাতি কখনও মহান হইতে পারে না, ইহাও ইতিহাস প্ৰসিদ্ধ। অতএব হিন্দুদিগের শরীর যাহাতে সমধিক বলবিশিষ্ট হয়, তাহার উপায় বিধান করা এক প্রধান কৰ্ত্তব্য।

২৩। জাতিভেদে বিবাহ স্থগিত করা, ও এক এক জাতির মধ্যে বহুশাখাভেদ হইয়া তাহদের মধ্যে আদান প্ৰদান বন্ধ হওয়া, ও তাহার উপর কৌলীন্য প্ৰথা দ্বারায় বিবাহের পরিধি আরও সঙ্কীর্ণ হওয়ায় রক্ত দূষিত হইয়া জীবনীশক্তি ও বলের অত্যন্ত ক্ষয় হইয়াছে।

২৪ । ইহার প্রতিবিধান করিতে গেলে প্ৰথমতঃ প্ৰত্যেক জাতির মধ্যে যে সকল অবান্তর বিভাগ আছে তাহদের মধ্যে যাহাতে আদান প্ৰদান হয় তাহার উদ্যোগ করা উচিত।

২৫। “তেজীয়সাং ন দোষায় বহ্নেঃ সৰ্ব্বভুজো যথা।” যে সম্প্রদায়ে শক্তিরাশি সমাহিত তাহারা সমাজকে যে দিকে চালাইবে সমাজ সেই দিকেই চলিবে। পবিত্রতা, নিঃস্বার্থতা ও বিদ্যাধারতাই এই শক্তিসঞ্চয়ের উপায়। যত অধিক পরিমাণে উহা আমাদের মধ্যে সঞ্চিত হইবে, তত অধিক পরিমাণে আমরা সমাজের উপর কার্য্য করিতে পারিব।

২৬। উহা সাধিত করিতে গেলে একটী মহাবলশালী সমাজের সষ্টি করিতে হয়, যাহার প্রাণশক্তি ভারতের অস্থিমজ্জায় ক্রমশঃ প্রবিষ্ট হইয়া মৃতপ্রায় ভারতকে পুনরুজ্জীবিত করিবে।

২৭। লোকভয়ে, অন্নাভাবের ভয়ে, মানহানির ভয়ে মনুষ্য সমাজের পক্ষে কল্যাণকর হইলেও নূতন উদ্যমে উদ্যুক্ত হয় না । তাহার উপর যে সমাজ যত অধিক দিন পথবিশেষকে অবলম্বন করিয়া আসিয়াছে, তাহার পক্ষে নূতন কোনও পথাবলম্বন করা ততই কঠিন হয়। অতএব এই মহাবলশালী সমাজভিত্তি সৃষ্টি করিতে হইলে নূতন উপনিবেশ সংস্থাপন করাই একমাত্র উপায়। যে স্থানে নরনারী প্রাক্তন সংস্কারাপেক্ষাও কঠিনতর বন্ধন সমাজ শাসন হইতে দূর থাকিয়া নূতন উৎসাহ, নূতন উদ্যম প্রয়োগ করিয়া নববলে বলীয়ান্ হইবে। ভারতবর্ষের বাহিরে উপনিবেশ স্থাপনের উপায় নাই।

২৮। মধ্যভারতে হাজারীবাগ প্রভৃতি জেলার নিকট ঊৰ্ব্বর, সজল, স্বাস্থ্যকর অনেক ভূমি এখনও অনায়াসে পাওয়া যাইতে পারে। ঐ প্রদেশে এক বৃহৎ ভূমিখণ্ড লইয়া তাহার উপরে একটি বৃহৎ শিল্প-বিদ্যালয় ও ধীরে ধীরে কারখানা ইত্যাদি খুলিতে হইবে। অন্নাগমের নূতন পথ যেমন আবিষ্কৃত হইতে থাকিবে, লোক তেমনই উক্ত উপনিবেশে আসিতে থাকিবে। তখন তাহাদিগকে যে প্রকারে গঠিত করিবে সে প্রকারেই গঠিত হইবে।

মঠের নিয়মাবলী1

১। এই মঠই প্রধানমঠরূপে নিৰ্দ্ধারিত হইল। ইহার অধীনস্থ সমুদয় মঠকেই ইহার নিয়মাবলী অনুসারে চলিতে হইবে।

২। এই মঠের সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারিগণ মাত্র এই মঠসংক্রান্ত বিষয়ে মতামত প্ৰকাশ করিতে পারিবেন। এস্থলে সন্ন্যাসী ও ব্ৰহ্মচারিগণ বলিলে শ্ৰী রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য ও প্ৰশিষ্যগণকে বুঝিতে হইবে।

৩। সমুদয় সন্ন্যাসী ও ব্রহ্মচারিগণ মিলিয়া একটী প্রধান অধ্যক্ষ নিৰ্দ্ধারিত করিবেন।

৪। উক্ত প্ৰধানাধ্যক্ষের সহিত, এক, দুই বা ততোধিক সহকারী নিৰ্দ্ধারিত হইবেন।

৫। কোন বিষয় নিৰ্দ্ধারিত করিতে হইলে সন্ন্যাসী ও ব্ৰহ্মচারিগণের ৩/৪ অংশের মত হইলেই চলিবে। আপাততঃ ৪ বৎসরের জন্য প্ৰধানাধ্যক্ষ ও তাহার সহকারীরা সন্ন্যাসী ও ব্ৰহ্মচারিগণের অমত সত্ত্বেও কাৰ্য্য করিতে পারিবেন।

৬। প্রত্যেক সন্ন্যাসী দুইটী ও প্রত্যেক ব্ৰহ্মচারী একটী ভোট দিতে পারিবেন।

৭। মঠে তামাক ব্যতীত অন্য কোন মাদক দ্রব্য সেবন নিষেধ। সকলেই পরস্পর সদ্ভাবে কথাবাৰ্ত্তা কহিবেন। যখন কাহারও কিছু আবশ্যক হইবে তিনি কৰ্ম্মাধ্যক্ষকে জানাইবেন।

৮। ব্ৰহ্মচারিগণ সন্ন্যাসিগণকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করিবেন।

৯। সকল ধৰ্ম্ম, ধৰ্ম্মপ্রচারক ও সকল ধৰ্ম্মের উপাস্য দেবতার প্রতিই যথাযোগ্য ভক্তিসম্মান রাখিতে হইবে।

১০। যথা সম্ভব সকলেই প্ৰত্যুষে শয্যাত্যাগ করবেন। গাত্ৰবস্ত্রাদি সমুদয় পরিষ্কার রাখিতে হইবে।

১১। কৰ্ম্মাধ্যক্ষ দেখিবেন যেন সকলে সমুদয় পরিষ্কার রাখেন ও যথাকালে উপযুক্ত আহার পান।

১২। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য সকলকে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ ব্যায়াম করিতে হইবে।

১৩। মঠাধ্যক্ষ ও তাহার সহকারী দেখিবেন যেন সকলে প্ৰাতঃকালে নিজ নিজ রুচির অনুযায়ী জপ, ধ্যান, পূজা পাঠাদি করেন।

১৪। যথাসম্ভব সকলে একত্ৰ আহার করিবেন। তৎপরে দুইঘণ্টা বিশ্রাম করিবেন।

১৫। তৎপরে প্রত্যেকে নিজ নিজ অভিপ্রায়ানুযায়ী পৃথক্ পৃথক্ বা দুই তিন জনে একত্র মিলিত হইয়া শাস্ত্ৰ পাঠ করবেন।

১৬। অপরাহ্নে পুনরায় পাঠ হইবে। তাহাতে একজন পাঠক থাকিবেন ও সকলেই শুনিবেন।

১৭। সন্ধ্যার পর পুনরায় জপ, ধ্যান ও স্তব পাঠাদি হইবে।

১৮। সমুদয় কাৰ্য্য ও কথাবাৰ্ত্তা শান্তভাবে করিতে হইবে।

১৯। যাঁহারা বাহিরে ধৰ্ম্ম প্রচার করিতে যাইবেন, তাঁহারা প্রধান মঠের অনুরূপ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে মঠ স্থাপনের চেষ্টা করিবেন। যাঁহারা প্রচার বা ভ্ৰমণ করিতে বাহিরে যাইবেন, তাঁহারা প্রতি সপ্তাহে তাঁহাদের প্রচার বা ভ্রমণবৃত্তান্ত সম্বলিত অন্যূন একখানি পত্র মঠে লিখিবেন। যাঁহারা চিঠি পত্ৰাদি রাখিবেন তাহারা ঐগুলি বিশেষরূপে রক্ষা করিবেন, ও মঠাধ্যক্ষের আদেশ ও উপদেশমত তাঁহাদিগকে পত্র লিখিবেন ও তাহার প্রতিলিপি রাখিবেন।

২০। আগন্তুকেরা বাহিরের ঘরে বসিয়া যাঁহার সহিত আবশ্যক কথাবাৰ্ত্তাদি কহিবেন।

 

পাদটীকা

[1] এই শেষোক্ত নিয়মগুলি আলমবাজার মঠে নবাগত ব্ৰহ্মচারিগণের জন্য প্রথম রচিত হয়। পূর্ব্বোক্ত সাধারণ নিয়মগুলি পরে রচিত হয়। মঠ তখন নীলাম্বর বাবুর বাগানে।