পৃথক উত্তরবঙ্গ রাজ্যের দাবী পশ্চিমবঙ্গের ও বাংলাদেশের ইসলামী মৌলবাদীদের উৎসাহিত করবে

0
1009

মোহিত রায়

উত্তরবঙ্গের নেপালীভাষী অধ্যুষিত পাহাড় অঞ্চলে গোর্খাল্যাণ্ডের দাবী দীর্ঘদিনের। ভারতবর্ষকে শতধা বিভক্ত করার লক্ষ্যে অবিচল কম্যুনিস্টদেরও এই দাবী সেই স্বাধীনতার সময় থেকেই। মাঝে মাঝে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অংশ নিয়ে কামতাপুরী, কোচ রাজ্য ইত্যাদি দাবীও ভেসে ওঠে। এবার নবতম দাবীটি উঠে এসেছে পুরো উত্তরবঙ্গকেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক রাজ্য গঠনের। লক্ষ্যণীয় এই যে পূর্বের দাবীগুলি এসেছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কিছু প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে কিন্তু পুরো উত্তরবঙ্গকেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করার দাবী ও প্রচার করছে সর্ব ভারতীয় বৃহত্তম হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা কর্মী ও তার সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা কর্মীরা। ফলে আগের দাবীগুলির থেকে এই নবতম দাবীটির গুরুত্ব অনেক সুদূর প্রসারী, কেবল একটি নতুন রাজ্য গঠন নয়। আমরা প্রথমে নবতম দাবীটির এই বিষয়টি আলোচনা করব ও পরে এই দাবীটির গুণাগুণ বিশ্লেষণে যাব।

দেশের বৃহত্তম হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটির কাছে ভারত একটি একক রাষ্ট্র যাকে সুশাসনের প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রশাসনিক অংশে বিভক্ত করা সঙ্গত। এঁদের কাছে ভারতের সবাই ভারতীয়, সবার এক ডিএনএ এক, হিন্দু মুসলমান বাঙ্গালী পাঞ্জাবী – সবাই। সুতরাং এইসব প্রশাসনিক ভাগাভাগিতে এই একপ্রাণ মানুষদের কিছু যায় আসে না। এই সর্বগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী ধারণা ভুলে গেছে যে ভারত একটি সভ্যতা-ভিত্তিক রাষ্ট্র যা গত অন্তত পাঁচ হাজার বছরের বিভিন্ন সভ্যতার ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, উপাসনা পদ্ধতির সমন্বয় সংমিশ্রণে একটি সনাতনী ভাবনার ভিত্তিতে গঠিত। এই বৈচিত্র্যকে আত্মস্থ ও সম্মান করা না গেলে ভারতকে বোঝা সম্ভব নয়। সম্ভবত এই জন্যই হিন্দীভাষী অঞ্চলের বাইরে, গুজরাত ব্যতীত, এই সংগঠনের প্রভাব খুব কম।

এখন দেখা যাক পৃথক উত্তরবঙ্গের দাবীর অর্থ কি দাঁড়ায়। প্রথমেই যেটা বলা প্রয়োজন যে পশ্চিমবঙ্গ কোন অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক অঞ্চল নয় যে অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রয়োজনে তাকে সুবিধামতন ভাগ করা যেতে পারে। পাকিস্তানের দাবীর ভূখণ্ড থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিশেষভাবে গঠিত হয়েছিল হিন্দু বাঙ্গালীর নিরাপদ বাসভূমি বা হোমল্যান্ড হিসাবে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গ মানে শুধু যুক্ত বঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল ভূখণ্ড নয়, পশ্চিমবঙ্গ ইসলামী অত্যাচার থেকে হিন্দু বাঙ্গালীর ধর্ম, সংস্কৃতি, নারীর সম্মান ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার ভাবনা। পশ্চিমবঙ্গ গঠিত হতে পেরেছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাহসী নেতৃত্বে। সেই শ্যামাপ্রসাদ হিন্দুত্ববাদী ধারণার কাছে শুধুই কাশ্মীরের জন্য আত্মবলিদানের প্রতীক। ফলে তাঁরা শুধু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাশ্মীরের জন্য আত্মবলিদানের দিনটিকে পালন করেন, শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠার দিনকে কোন গুরুত্‌ব দেন না। আজকের পৃথক উত্তরবঙ্গের দাবী ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গের কথা স্মরণে আনছে। জাতীয়তাবাদী হিন্দু বাঙ্গালীকে কোণঠাসা করতে ব্রিটিশ শাসকেরা বাংলাকে ভাগ করে হিন্দু প্রধান অঞ্চলকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল বিহার উড়িষ্যার সঙ্গে আর মুসলমান প্রধান অঞ্চলকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল আসামের সঙ্গে। নতুন প্রদেশে বাঙ্গালী হিন্দু পরিণত হয়েছিল ভাষিক সংখ্যালঘু। আজকের পৃথক উত্তরবঙ্গের দাবী সেরকমই বাঙ্গালী হিন্দু হোমল্যাণ্ডের উপর আক্রমণ, শ্যামাপ্রসাদের ভাবনাকে অপমান এবং বাঙ্গালী হিন্দুর জাতিসত্ত্বাকে আহত করা। কেউ কেউ বলেছেন এসব বাঙালি জাতিটাতি কিছু ‘উচ্চবর্ণ’ ভদ্রলোক বাঙ্গালির কল্পনা মাত্র, খেটে খাওয়া, ‘দলিত’ বাঙালি হিন্দুর এসবে কিছু আসে যায় না। কিন্তু এই শ্যামাপ্রসাদের গঠিত পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রাণ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও নারীর সম্মান বাঁচাতে পেরেছেন লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী হিন্দু, যাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাকথিত ‘দলিত’। পশ্চিমবঙ্গ গঠন বাঙ্গালীর আত্মপরিচয়কে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করছে। বাংলাভাষী মানেই বাঙ্গালী নয়, যে বাংলাভাষী পাঁচ হাজার বছরের ভারতীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে স্বীকার করে সেই বাঙ্গালী।

পৃথক উত্তরবঙ্গের দাবী পশ্চিমবঙ্গকে দখল করার ইসলামী মৌলবাদী প্রচেষ্টাকে প্রভূত সাহায্য করবে। ১৭ কোটি বাংলাভাষী মুসলমানের দেশ এখন দাবী করে তারা, মুসলমান বাঙালিই আসল বাঙালি। হিন্দু বাঙ্গালীরা মুল বাঙালির একটি উপজাতি মাত্র। বাংলাদেশী বাংলাভাষীদের কাছে বাঙ্গালী জাতির বয়স হাজার বছরের, বাংলায় ইসলামের অনুপ্রবেশের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিরা এভাবে বাঙ্গালী জাতির নতুন ইতিহাস তৈরী করছেন, বাংলা ভাষার ইচ্ছেমতন বিকৃতকরণ ও আরবীকরণ করছেন, পাল্টাচ্ছেন বাংলা পঞ্জিকা, পালটে দিচ্ছেন হিন্দু নববর্ষের উৎসব। পশ্চিমবঙ্গ উত্তরবঙ্গ আর দক্ষিণবঙ্গে বিভক্ত হলে বাংলাদেশের ইসলামী শক্তি বৌদ্ধিক ভাবে আরো শক্তিশালী হবে, বলতে পারবে বাঙ্গালী হিন্দু বলে কিছু নেই। যারা আছে তারা বাংলাভাষী কিছু আঞ্চলিক উপজাতি, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে ব্যস্ত। গত প্রায় পঞ্চাশ বছরের বামপন্থী ও তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে পশ্চিমবঙ্গকে পশ্চিম বাংলাদেশ বানানোর কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ইসলামী মৌলবাদীরা খুশী হবে যে এখন এ কাজে হিন্দুত্ববাদীরাও হাত লাগিয়েছে, হিন্দুত্ববাদীরাও ভারত বিভাজনকারী ‘টুকরে টুকরে গ্যাং”-এর সঙ্গেই আছে।।

বলা হচ্ছে যে উত্তরবঙ্গ চীন ও বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা ফলে নিরাপত্তার জন্য একে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করা হোক। এরকম সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্য ভারতে অনেক – আসাম, মনিপুর, ত্রিপুরা, মেঘালয়, গুজরাত, রাজস্থান, পাঞ্জাব ইত্যাদি। সুতরাং এ দাবীর কোন সারবত্তা নেই।

কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো যে এখন হটাত এই দাবী তোলা হচ্ছে কেন? উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে সে কথা শাসক তৃণমূল দল বা পূর্বতন শাসক সিপি আই এম দলও অস্বীকার করে না। তারাও বলে উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। একইরকমের উন্নয়ন সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে দক্ষিণ বঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে বা পশ্চিমে জঙ্গলমহল অঞ্চলেও। তাহলে কি উন্নয়নের জন্য পশ্চিমবঙ্গকে টুকরো টুকরো করে দিতে হবে? যে কোন দেশে, রাজ্যে স্থানিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক কারণে আঞ্চলিক উন্নয়ন বৈষম্য থাকে, তাকে যতটা সম্ভব বাস্তবগত ভাবে সমাধান করাই সরকারের কর্তব্য। সেজন্য দেশকে টুকরো টুকরো করাটা কোন পথ হতে পারে না।

মনে হচ্ছে এই দাবী তোলার একটি বিশেষ কারণ থাকতে পারে । গত ২০২১এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জনসাধারণ ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতাদের রূপ সামনে দেখতে পেল। অনেকেই ভেবেছিলেন যে এবারে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ভোটে জিতে শাসন ক্ষমতায় আসবে। ফলে ক্ষমতার ভাগ পেতে রাজ্যের শাসক দলের বেশ কিছু নেতা এবং এমনকি টালিগঞ্জের ফিল্ম পাড়ার দ্বিতীয় তৃতীয় সারির অভিনেতা-নেত্রীরা বিজেপিতে যোগদান করলেন। রাজ্য নেতারাও তাদের অতি আগ্রহে গ্রহণ করলেন। বেশ কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রী হবার জন্য তৈরী হয়ে গিয়েছিলেন, মনে হচ্ছিল নতুন সরকারে হয়ত একাধিক মুখ্যমন্ত্রী রাখতে হবে। যাহোক সে স্বপ্ন নির্বাচনের পর ভাঙ্গলো, অনেকে নিজের নীড়ে ফিরলেন। এবার অন্য একটি স্বপ্ন দেখা শুরু হল। ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে ৯টি আসনের ৮টি পেয়েছিল বিজেপি, অর্থাৎ প্রায় ৯০ শতাংশ সাফল্য। ২০২১ এর নির্বাচনে বিজেপির অত্যন্ত হতাশাজনক ফলাফলের পরও উত্তরবঙ্গের ফলাফল তেমন খারাপ নয়। উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসনের ২২টিতে জিতে ৪০ শতাংশ সাফল্য খারাপ নয়। সুতরাং কিছু নেতা যদি আগামী দিনে উত্তরবঙ্গ রাজ্যের মন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখেন তাতে দোষের কিছু নয়। আর তার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সমর্থন থাকলে এই দাবী তোলাটাও গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে। অবশ্য বিজেপির জাতীয় শীর্ষ নেতৃত্ব এই দাবীকে সমর্থন করে নি। বাঙ্গালী হিন্দুকে আগামী অনেক অন্ধকার দিনের মুখোমুখি হবার সাহস সংগ্রহ করতে হবে।