যুদ্ধক্ষেত্র বাংলা : কেন্দ্রীয় বাহিনীকে মমতার হুঁশিয়ারি, বাঙালীর লজ্জা

0
565

নির্বাচন কমিশনের পশ্চিমবঙ্গে ভোটের কাজে নিযুক্ত সিএপিএফ কর্মীদের আশ্বস্ত করা উচিত যে যে কোনো রকম মামলা থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হবে এবং বাংলার পুলিশ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

অন্যথায়, বাংলায় স্বাধীনভাবে ও নিরপেক্ষ ভোট করার জন্য সিএপিএফ কর্মী মোতায়েন করার উদ্দেশ্যটিই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

যখন থেকে বাংলায় ভোটের প্রচার শুরু হয়েছে, তৃণমূলের প্রধানা মমতা ব্যানার্জী অনবরত নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও রাজ্যে ভোটের দায়িত্বে কর্তব্যরত কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণ করে চলেছেন।

মমতা ব্যানার্জী অভিযোগ করছেন যে নির্বাচন কমিশন ও সিএপিএফ কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের অধীনে থেকে তাঁদের কথা মতো চলছেন এবং তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কাজ করছেন।

নির্বাচন কমিশন যখন তাঁর দলের নানা জায়গায় ভোট লুঠ করা রুখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, তখনই তৃণমূল প্রধানা ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

তিনি সিএপিএফের প্রতি ক্ষুব্ধ কারণ তাঁরা তৃণমূলের কার্যকলাপে বাধা দিয়েছেন এবং ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁরা ঠিক যেমন করেছিলেন, তেমনভাবে দেশের একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে হাসির খোরাকে পরিণত করার জন্য দলের ভাড়া করা গুণ্ডাদের প্রতিহত করেছিলেন।

মমতা ব্যানার্জী তাঁর সমর্থকদের অনুরোধ করেছেন যাতে তাঁরা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করেন এবং তাঁদের নিজস্ব কর্তব্য করতে বাধা দিতে বলেছেন।

এই উস্কানির জন্যই ১০ই এপ্রিল তারিখে শীতলকুচিতে সিআইএসএফ জওয়ানদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছিল। (এটা পড়ুন)

১০ই এপ্রিল তারিখে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার শীতলকুচিতে একটি দাঙ্গাকারী উন্মত্ত জনতাকে লক্ষ্য করে সিএপিএফ-দের গুলি ছোঁড়ার ঘটনায় মমতা ব্যানার্জী ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।

তিনি কেবলমাত্র সিআইএসএফ ঠাণ্ডা মাথায় মানুষকে গুলি করেছে, এই অভিযোগে তাঁদের অভিযুক্ত করেছেন তাই নয়, কোনো রকম উস্কানি ছাড়াই তিনি এই গুলি ছোঁড়ার ঘটনাটিকে গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন।

কিন্তু, বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে যে অমঙ্গলকর, ভয়াবহ ঘটনার বিপজ্জনক পরিণতি ঘটতে চলেছে, তা হল মমতা ব্যানার্জীর কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে এফআইআর করার হুমকি।

এটি এখনই শুরু হয়ে গেছে এবং শীতলকুচিতে যেখানে সিএপিএফ কর্মীর উপর আক্রমণ ঘটেছিল, সেখানে ১২৬ নং বুথে যে সিআইএসএফ কর্মী ভোটের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর নামে ইতিমধ্যে একটি এফআইআর দায়ের করা হয়ে গেছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাঁর দলের প্রার্থী পার্থ প্রতিম রায়ের সঙ্গে একটি অডিও ক্লিপ শুক্রবার (১৬ই এপ্রিল)সন্ধ্যেবেলায় বিজেপি দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল এবং এটি চারিদিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল। তৃণমূল প্রধানাকে বলতে শোনা গেছে যে, সিএপিএফ কর্মীর বিরুদ্ধে কড়া এফআইআর দায়ের করতে হবে এবং ও তাঁর উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের (এসপি ও আইজি) ফাঁসাতে হবে

সিএপিএফ আধিকারিকদের ফাঁসানোর কথাটি কেবলমাত্র একটি ন্যক্কারজনক মনোভাবের পরিচয় দেয়।

দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, দয়ানন্দ তিওয়ারী বলেছেন, উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের (কেন্দ্রীয় বাহিনীর) ফাঁসানোর দাবি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল তাঁর নিন্দনীয় সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন এবং নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসনের স্বল্পই মর্যাদা রক্ষা করেছেন। তিনি নিজেকে একজন ম্যাকিয়াভিলি হিসাবে প্রকাশ করেছেন, যিনি তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যে কোনো সীমা লঙ্ঘন করতে পারেন।

আরো খারাপ ব্যাপার হল মমতা ব্যানার্জীর উর্দিধারী কর্মী ও আধিকারিকদের ফাঁসানোর জন্য কোনো অনুশোচনা নেই।

যদিও তিনি এই প্রথমবারের মত তাঁদের আক্রমণ করছেন, এমনটা নয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি হাস্যকর নাটক করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে ট্রাফিক চলাচলের (যে নিয়মিত কাজটি সারা দেশ জুড়েই চলে) উপর একটি আদম শুমারির জন্য টোল প্লাজায় নিযুক্ত করা সেনাবাহিনী নাকি অভ্যুত্থানের জন্য তৈরি ছিল এবং তাঁরা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সেখানে এসেছিলেন। (এটি পড়ুন)

শনিবার, (১৭ই এপ্রিল) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও সিএপিএফ সেনাবাহিনী, যাঁরা তৃণমূলের পোষ্য গুণ্ডাদের ভোট লুঠ করার প্রচেষ্টাকে বানচাল করেছেন, তাঁদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন এবং হুমকি দিয়েছেন।

তিনি বলেছিলেন, আমি কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা যদি ঝামেলা করেন, তবে মানুষ কিন্তু আপনাদের বিরুদ্ধে আদালতে যাবেযদি মানুষ আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে, তবে কিন্তু আপনাদের এখানে বারবার আসতে হবে (প্রশ্ন করা হবে এবং আদালতে উপস্থিত হতে হবে)

রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, আদালতের নানা মামলায় সিএপিএফ কর্মী আধিকারিকদের জড়িয়ে ফেলার ঘটনা, যে মামলাগুলি অবশ্যই মিথ্যা, এগুলির মাধ্যমে মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রীয় বাহিনীকে আসলে বলতে চান যাতে তাঁরা তাঁর দলের কার্যাবলীতে বাধা দেওয়া বন্ধ করেন এবং যে গুণ্ডারা নানা অসৎ উপায়ে ভোট লুঠ করার চেষ্টা করছিল, তাদের কাজে যেন বাধা না দেন

বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেছেন, মমতা ব্যানার্জী চান যে কেন্দ্রীয় বাহিনী তাঁর ইচ্ছেমত কাজ করুক, ঠিক যেমন তৃণমূলের কর্মীরা যখন আইন ভাঙে ও ভোট লুঠ করে, তখন বাংলার পুলিশ যেমন অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক তেমন। তাই তিনি বলছেন যে কেন্দ্রীয় বাহিনী যদি তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কাজ না করে, তবে তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে (মিথ্যা) মামলা দায়ের করবেন

অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস আধিকারিক নিরঞ্জন পট্টনায়েক, যিনি সিআরপিএফ এবং বিএসএফ-এ কাজ করেছেন, তিনি কটক থেকে স্বরাজ্য-কে বলেছেন যে : সিএপিএফের কোনো কর্মীই বাংলার কোনো মামলায় জড়িয়ে পড়তে চান না। প্রথমত, সেই মামলাটি খুব সম্ভবত একটি মিথ্যা মামলা হবে এবং এটির নিষ্পত্তি ঘটতে অনেক বছর সময় লেগে যাবে। এটি একজন আধিকারিকের বা একজন জওয়ানের পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এবং তারপর বাংলার পুলিশের উপর এর তদন্তের ভার দেওয়া হবে। আর তারপর রাজ্য পুলিশের পক্ষপাতিত্বের কারণে গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এবং যাঁর বা যাঁদের বিরুদ্ধে এরকম মামলা দায়ের করা হবে, তাঁদের প্রায়ই আদালতে হাজিরা দিতে আসতে হবে, যার অর্থ যে তাঁকে/তাঁদের তাঁর/তাঁদের কর্মক্ষেত্র থেকে বারবার ছুটেছুটে আসতে হবে। এইজন্য যে যে হয়রানিটা হবে, সেটা একবার চিন্তা করে দেখুন

যখন মমতা ব্যানার্জী সিএপিএফ এর কর্মী ও আধিকারিকদের হুঁশিয়ারি দিচ্ছিলেন, তখন নিশ্চয় তাঁর মনে এসব কিছু ছিল। তাঁর হুমকিতে এই গুপ্ত বার্তাটি আছে : সিধে হয়ে যান এবং আমার ইচ্ছে মতো কাজ করুন, নতুবা হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান, অথবা আরো নিকৃষ্টতম কিছুর জন্য প্রস্তুত হন।

কেন্দ্রীয় বাহিনীর(ভারতীয় বাহিনীর জন্যও) জন্য তাঁর স্বল্প পুরষ্কার এবং তাঁর হুমকি যে তাঁর রাজ্য পুলিশেরা যেভাবে অধঃস্তন চাকরের মত কাজ করে, তাঁরাও যদি তেমন না করেন, তবে তাঁরা মমতা ব্যানার্জীর ক্ষোভের মুখে পড়বেন এবং এটি নির্বাচন কমিশনকেও সামলাতে হবে।

নির্বাচন কমিশনের বাংলায় কোনো সিএপিএফ কর্মীর উপর কোনো মামলা করা নিষেধ করা উচিত, শুধু তাই নয়, বরং বাংলার পুলিশকে একটি হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখা উচিত যে যদি তাঁরা আইন অমান্য করেন এবং মমতা ব্যানার্জীর হাতের পুতুল হয়ে কাজ করেন, তবে তাঁরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

নির্বাচন কমিশনের পশ্চিমবঙ্গে ভোটের কাজে নিযুক্ত সিএপিএফ কর্মীদের আশ্বস্ত করা উচিত যে যে কোনো রকম মামলা থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হবে এবং বাংলার পুলিশ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

অন্যথায়, বাংলায় স্বাধীনভাবে ও নিরপেক্ষ ভোট করার জন্য সিএপিএফ কর্মী মোতায়েন করার উদ্দেশ্যটিই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

সিএপিএফ-কে এই রাজ্যে নিযুক্ত করতে হয়েছে, তার কারণ হল এই রাজ্যের পুলিশ একটি পক্ষপাতদুষ্ট শক্তি, যাঁরা তৃণমূলের অধঃস্তন কর্মচারী হিসাবেই ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল। সিএপিএফ-কে কখনোই বাংলার পুলিশের একটি হুবহু প্রতিলিপি করে তোলা যাবে না।

সিএপিএফ আধিকারিকদের ফাঁসানো-র কথা বলার জন্য মমতা ব্যানার্জীর নিন্দা করা উচিত ও সমালোচনা করা উচিত। তাঁর এই আচরণের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে কারণ এর ফলে অনেক খামখেয়ালী মুখ্যমন্ত্রী এই একই রকম ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত হয়ে পড়তে পারেন।

নির্বাচন কমিশন, এমনকি বিচারব্যবস্থারও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এতে হস্তক্ষেপ করা উচিত এবং মমতা ব্যানার্জীকে একটি কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া উচিত এবং তাঁর ভবিষ্যতের আচরণের উপর খুঁটিয়ে নজর রাখা উচিত।

তৃণমূল প্রধান যদি নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন এবং আইনের শাসন ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করেন, তবে তাঁর কঠোর আইনী শাস্তি প্রদানের হুঁশিয়ারি পাওয়া উচিত।

 

মূল লেখাটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত, লিখেছেন জয়দীপ মজুমদার। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুষা।