২০২১ পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন, মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যার ফুলঝুরি – ৪

0
873

(তৃতীয় পর্বের পর)

১৮। আম্ফান ঘূর্ণিঝড়কে নিয়ে রাজনীতি

২০২০ সালের মে মাসে যখন আম্ফান ঘূর্ণিঝড় পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়েছিল, মমতা ব্যানার্জী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্দশার প্রতি উদাসীন ছিলেন কিন্তু তিনি মোদি সরকারকে অন্ধকারের মধ্যে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

তিনি দাবি করেছিলেন যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ববর্গের কাছ থেকে বাংলা কোনো আর্থিক সাহায্য পায়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদি পরিষ্কারভাবে ও স্বচ্ছভাবে জানিয়েছিলেন যে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সে ধ্বংসলীলা চলেছে, তার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র ১০০০ কোটি টাকা অগ্রিম সাহায্য করেছে।  তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় কোনো স্বচ্ছতা নেই, দাবি করে ইচ্ছাকৃতভাবে এটিকে বিতর্কিত করতে চেয়েছিলেন।

আসলে ঘটনাটি হল পশ্চিমবঙ্গে আম্ফান ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের ফলে রাজ্যকে ১০০০ কোটির সাহায্য প্রদান করার পাশাপাশি মোদি সরকার জাতীয় দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া তহবিলের অধীনে আম্ফান থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের জন্য অতিরিক্ত ২৭০৭.৭৭ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা করেছিল।

১৯। মমতা ব্যানার্জী শ্রমিক রেলগাড়িকে নিয়ে মিথ্যা খবর রটিয়েছিলেন

মোদি সরকারের তীব্র সমালোচক তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধানা, সরকার অভিবাসীদের মিথ্যা কথা ও অনুমানের মাধ্যমে তাদের নিজ রাজ্যে পাঠানোর চেষ্টা করেছে, এই দাবি করে শ্রমিক রেলগাড়ির পরিষেবাকে অসম্মানিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁর রাজ্যে করোনা এক্সপ্রেস পাঠানোর জন্য রেলপথের তীব্র নিন্দা করেছিলেন। তিনি বলেন, আমরা ২৩৫টি রেলগাড়ির জন্য টাকা দিচ্ছি, তবে লোকদের কেন কেবল একটি সিটে বসতে বাধ্য করা হচ্ছে? রেল দপ্তর বিশেষ শ্রমিক রেলগাড়ির নামে করোনা এক্সপ্রেস চালাচ্ছে। মানুষ এই রেলগাড়িগুলিকে করোনা এক্সপ্রেস বলে ডাকছে

তবে সত্যটি হল, ভারতীয় রেল দপ্তর আতকে পড়া মানুষদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য বিশেষ শ্রমিক রেলগাড়ি চালানোর জন্য তার অঞ্চলগুলির জন্য একটি নির্দেশিকা জারি করে বলেছে যে এর ৯০% পূর্ণ থাকবে। এটি আরো স্পষ্ট করে বলে যে প্রতিটি শ্রমিক স্পেশাল গাড়ি সোজা একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে যাবে এবং মাঝে কোথাও থামবে না। আরো বলা হয়েছিল যে এই রেলগাড়িগুলিতে সামাজিক দূরত্বসহ পূর্ণ দৈর্ঘ্যের মিশ্রণ সহ (মাঝের বার্থগুলি ছাড়া) প্রায় ১২০০ জন যাত্রী যেতে পারবে।

২০। মমতা মিথ্যা কথা বলেন যে তিনি কখনই শ্রমিকরেলগাড়িকে করোনা এক্সপ্রেস বলেননি

গত বছর জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অভিযোগের ভিত্তিতেঅস্বীকার করেন যে তিনি শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন যা পরিযায়ী শ্রমিকদের লকডাউনের সময় ফিরিয়ে নিয়ে আসছিল, তাকে করোনা এক্সপ্রেস বলে অভিহিত করেছিলেন। এবং তিনি জোর দিয়ে বলতে থাকেন যে এই সব ট্রেনগুলির জায়গা নিয়ে বিদ্রুপ করতে মানুষই এর নাম দিয়েছে।

শাহের একদিন পরেই পশ্চিমবঙ্গের একটি ভার্চুয়াল সভায় এই মন্তব্য উঠে আসে এবং অভিযোগ করা হয় যে তিনি পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ রাজ্যে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনের মাধ্যমে ফেরাকে করোনা এক্সপ্রেস বলে অপমান করেছেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, প্রায় ১১ লাখের বেশি পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় ফিরেছে। আমি কখনো পরিযায়ী শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনকে করোনা এক্সপ্রেস বলিনি। সাধারণ মানুষই এই নাম দিয়েছে

২১। মমতার দুর্গা পুজোয় ৫০,০০০ টাকার বোনাস

মমতা ২০২০ সালে পুজোর আয়োজকদের ৫০,০০০ টাকা করে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন। শীঘ্রই উচ্চ আদালত দুর্গাপুজোর আয়োজকদের বোনাস দেওয়ার জন্য মমতার সরকারকে তলব করেছিলেন। উৎসবে বিনোদনমূলক কাজের জন্য মানুষের টাকা খরচ করার জন্য আদালত মমতা সরকারের তীব্র নিন্দা করে এবং জিজ্ঞাসা করে যে এই ধরণের খরচের জন্য তাঁরা কী প্রকারের নির্দেশিকা নির্ধারণ করেছেন?

রাজ্য প্রশাসন তখন আদালতকে বলেছিল যে এই আর্থিক অনুদান কোভিড-১৯ এর স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য এবং স্যানিটাইজার ও মাস্ক কেনার জন্য দেওয়া হয়েছিল।

২২। মমতা ব্যানার্জী দাবি করেছেন যে প্রধানমন্ত্রী মোদি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন

মমতা ব্যানার্জী এই মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন যে, টেক্সাসের হস্টনে বিরাট অনুষ্ঠান চলাকালীন নরেন্দ্র মোদি ২০২০ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন।

তৃণমূল প্রধানা যে দাবি করছেন যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের হয়ে প্রচার করেছেন, তার বিপরীতে বলা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী মোদি ২০২০ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রচার করার বা হস্তক্ষেপ করার কোনো চেষ্টাই করেননি।

আগের বছর সেপ্টেম্বর মাসে টেক্সাসের হস্টনে যে বিরাট হাউডি মোদিঅনুষ্ঠিত হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদি দর্শকদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে ২০১৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রচারে ভারতীয় প্রবাসীদের কাছে আবেদন করার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে বলেছিলেন যে আব কি বার ট্রাম্প সরকার

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় প্রবাশীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী মোদি ট্রাম্পের উপরিউক্ত স্লোগানটি স্মরণ করেছিলেন। তিনি ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর হয়ে প্রচার করছেন- এই দাবিটি সর্বৈব মিথ্যা।

২৩। পিএম কেয়ার তহবিল নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর রাজনীতি

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বহুবার কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সার্বভৌম কাঠামো ধ্বংস করার জন্য বুলডোজার চালাচ্ছে, এই অভিযোগ করেছেন এবং জানতে চেয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রীর নাগরিক সহায়তা ও জরুরি অবস্থায় ত্রাণ তহবিলের (পিএম কেয়ারস)অর্থকোথায়?

তবে আসল ব্যাপারটি হল প্রধানমন্ত্রী কেয়ারস তহবিল সমস্ত রাজ্য/ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলসমূহের সরকারি কোভিড হাসপাতালগুলিতে ৫০,০০০ মেড ইন ইন্ডিয়া ভেন্টিলেটর সরবরাহের জন্য ২০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। এছাড়াও পরিযায়ী শ্রমিকদের কল্যাণে ১০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। মজার বিষয় হল এই যে, এই ১০০০ কোটির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গকেও ৫৩ কোটি টাকার অনুদান বরাদ্দ করা হয়েছে।

২৪। মমতা ব্যানার্জী দাবি করেন যে রাজ্যে করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে কোনো সাহায্য পাননি

২০২০ সালের ২৮শে নভেম্বর তৃণমূল কংগ্রেস দাবি করেছিল যে মমতা ব্যানার্জীর সতকার এত অবধিশ্চিমবঙ্গে কোভিড-১৯ এর মোকাবিলা করার জন্য ৪০০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে এবং কেন্দ্রে বিজেপি দ্বারা নেতৃত্ব প্রদানকারী এনডিএ সরকারের কাছ থেকে অতিমারীর পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য কোনো সাহায্য পাননি।

আসলে সত্যটি তৃণমূল প্রধানার মিথ্যা দাবিগুলির থেকে অনেক আলাদা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে রাজ্য দুর্যোগ মোকাবিলা তহবিলে (এসডিআরএমএফ)৫০৫ কোটি টাকা পেয়েছিল মহামারির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকার পিএম কেয়ার এর আওতায় ১০০০টি ভেন্টিলেটর পেয়েছিল।

২৫। মমতা ব্যানার্জী দাবি করেন যে মোদি বিগত ছয় বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কিছুই করেননি

তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা ব্যানার্জী দাবি করেন যে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের ক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা করেছে এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে গত ছয় বছরে এই রাজ্যের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তবে সত্য হল যে মমতা কেন্দ্রের কল্যাণকর প্রকল্পগুলিকে বাঙালি নাম দিয়ে নিজে বাহবা নেওয়ার জন্য কূটনৈতিক চাল দিয়ে সেগুলিকে পুনর্বিন্যাস করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মমতার সরকার প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্প থেকে প্রধানমন্ত্রী– নামটি বাদ দিয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা বাংলার আবাস যোজনা নামে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এছাড়াও, তিনি স্বচ্ছ ভারত অভিযানের নাম নির্মল বাংলা, দীন দয়াল উপাধ্যায় গ্রাম জ্যোতি যোজনাকে সবার ঘরে আলো অর্থাৎ সকলের ঘরে আলো পৌঁছবে এই নামে অনুবাদ করে দিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনা প্রকল্পের কথা বলতে গিয়ে বলা যায় যে এখানে প্রতি একক সহায়তার ব্যয় ৬০:৪০ অনুপাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বন্টন করা হয়। তদুপরি, যদি আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্থানগুলি পরিদর্শন করেন, তবে দেখতে পাবেন যে বাংলার আবাস যোজনা ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনার সমস্ত বিশেষত্ব অভিন্ন।

পশ্চিমবঙ্গে মোট ১ কোটি বিপিএল গ্রাহকরা কেন্দ্রীয় সরকারের উজ্জ্বলা যোজনার আওতায় এলপিজি গ্যাস পেয়েছেন। তদুপরি, কেন্দ্রীয় সরকার স্বচ্ছ ভারত অভিযানে যে তহবিল বরাদ্দ করেছিলেন, তা মমতার সরকার তার মিশন নির্মল বাংলার জন্য ব্যবহার করে ফেলেছে।

এই রাস্তাটি গিয়ে শেষ হচ্ছে ২০২১ সালের ২রা মে তারিখে, যখন ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হবে এবং এই রাস্তাটি তৃণমূল প্রধানা মমতা ব্যানার্জীর মিথ্যা দ্বারা জঞ্জালে ভরে উঠেছে। এখন, এটি দেখবার পক্ষে খুব আগ্রহের বিষয় যে মমতা এই যে মিথ্যাগুলি রটিয়েছেন, সেগুলি আদৌ তাঁর স্বার্থ চরিতার্থ করতে সাহায্য করবে না বিজেপি তাঁর অপ্রতিরোধ্য শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইতিহাস রচনা করবে। কেবল সময় এর জবাব দিতে পারে।

মূল লেখাটি লিখেছেন ঝঙ্কার মোহতা, অপইন্ডিয়া পত্রিকায়। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।