শিবলিঙ্গের পূজা কেন

0
1568

শিবরাত্রি এল, চলেও গেল। আমাদের ঘরের মা কাকিমারা ভক্তিভরে দুধ আর জল দিয়ে পুজো সারলেন, আর লিবেড়ালরা যথারীতি রুদালী নামালেন। অবশ্য রুদালীটা গতবারের তুলনায় এবার অনেকটা কম। একটা কারণ জাতীয়তাবাদী জনগণ গরম হয়ে আছে, স্যাটাভাঙা ক্যাল পড়ার ভয়। আরেকটা ভয় নতুন করে জাকিয়ে বসেছে মাকুদের মধ্যে। সেটা হচ্ছে চিত্র হয়ে যাবার ভয়। আহা চাকরিই যদি না থাকে কোথা থেকে মদ আর নেটপ্যাকে বিপ্লবের খরচ আসবে

যাই হোক গতবারের তুলনায় কম হলেও দুধরনের নাটক নজরে পড়লো। একদল কান্নাকাটি করছেন ওরে দুধ রে ঢেলে দিল রে, গরীবকে দিলনা রে। তা এদের নতুন করে কিছু বলার নেই লোকে এখন এসব শুনলেই পাল্টা জিজ্ঞেস করছেন “অন্যদিন কজনকে দুধখাওয়াও বাওয়া?” কিম্বা , ” নিজের মদের পয়সাটা বাচিয়ে গরীবকে দুধ কিনে দিলে হয়না?,” একজন অতি খচ্ছর প্রতিক্রিয়াশীল আবার কন্ডোম কিনে পয়সা নষ্ট না করে ঐ পয়সায় পথশিশুদের বেলুন কিনে দেবার পরামর্শ ও দিয়েছেন দেখলাম। তা সে যাই হোক, দ্বিতীয় দল সংখ্যায় কম, এরা একটু আড়ালে আবডালে মাকু কিম্বা ছাগু খোয়াড়ে চুপিচুপি পোস্ট করছেন যে লিঙ্গের পুজো হবে কেন?

প্রথম কথা সরাসরি বলুন যে হিন্দু তার ধর্মে লিঙ্গের পুজো করবে না গরুর পুজো করবে সেটা মাকুদের ভাবতে হবেনা, যাও সিফিলিসে মরা লেনিনের পচা মমিটার পুজো করো. আর লিঙ্গের পুজো শুধুমাত্র হিন্দু করেনা, ভুটান বা জাপানে বৌদ্ধরাও করেন. ওদের উপাস্য লিঙ্গের আকার কিন্তু হুবহু পুরুষাঙ্গের মতো, সঙ্গে অন্ডকোষ ও যুক্ত থাকে। থিম্পু বা টোকিওর রাস্তায় দাড়িয়ে আগে ঐ নিয়ে বালবাজারি করে তারপর আস্ত শরীরে কলকাতায় ল্যান্ড করে দেখান হে সেকুকুলনন্দনতিলক, তারপর কাফে কফিতে বসে বাকি কথা হবে, মানে যদি বসার অবস্থা আপনার পশ্চাদ্দেশের আদৌ থাকে।

যাই হোক, সমস্যা অন্যত্র। লিবেড়ালদের যুক্তির থেকে দৌড়ের ওপর রাখা বেশী উপযোগী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একদল হিন্দু ও বছরের পর বছর এই বালবাজারি শুনতে শুনতে নিজের শিকড়ের প্রতি সংশয়ে ভুগছেন। তাই ব্যখ্যা দেব, শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র ই যারা নিজেকে হিন্দু হিসেবে স্বীকারকরে শুধুমাত্র কৌতূহল থেকেই প্রশ্ন তুলছেন তাদের জন্য।

দেখুন দুটো ব্যখ্যা হয়, লৌকিক আর দার্শনিক। প্রথমে লৌকিক ব্যখ্যাটাই করা যাক। শিবলিঙ্গে শুধুমাত্র লিঙ্গ নয়, যোনীপট্ট ও থাকে. ওটা সৃষ্টি চিহ্ন। উর্বরতার প্রতীক। কৃষিভিত্তিক সমাজে উর্বরতার প্রতীক উপাসনা আর আদিদেবের উপাসনা এখানে মিলে গেছে।

বহুদিনগত চৈতীগাজন, মাটিছোয়া মেঘে অম্বুবাচন,
থামাও তোমার পাগুলে নাচন,বেধে নাও জটাজুট।
হাতের ত্রিশূল হাটুতে ভাঙিয়া, প্রলয়শালায় পিটিয়া রাঙিয়া,
গড়ে নাও ফাল হয়েছে সকাল , ধরো লাঙলের মুঠ।

ধ্বংসের পরে আবার সৃষ্টি আসে। যোনীপট্টে লিঙ্গ উপাসনা সেই সৃষ্টির আবাহন। যারা বুঝবেন, প্রণাম করুন, যারা বুঝবেননা, সরে যান। সৃষ্টি চিহ্ন বিদ্রুপের জিনিস নয়।

দ্বিতীয় আরেকটি ব্যখ্যা আসে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এই মতে লিঙ্গ মানে আদৌ পুরুষাঙ্গ নয়. লিঙ্গ অর্থে চিহ্ন। পুরুষ অর্থে এখানে পেনিসধারী জীব নয়, পুরুষ অর্থ অনেক ব্যাপক। সাংখ্যমতে মূলে দুটি তত্ত্ব। একটি পুরুষ অর্থাৎ সাক্ষীচৈতন্য, আরেকটি অব্যক্ত অর্থাৎ মূলপ্রকৃতি. এই মূলপ্রকৃতিই পুরুষের নিমিত্তে সূক্ষ্ম ও স্থূল জগৎরূপে manifested হন। পুরুষ নিরাসক্ত থেকে শুধুমাত্র অনুভব করেন. সাংখ্যমতে প্রতিটি জীবেই একটি করে পুরুষের অধিষ্ঠান, একটি ঘরে জ্বলন্ত অনেক দীপের মতোই প্রতিটি পুরুষ mutually exclusive. এই পুরুষ নিত্য মুক্ত, শুদ্ধ হয়েও শরীর মনের সাথে নিজেকে অভিন্ন বোধে দুঃখ ভোগ করেন. শরীরমন থেকে ভিন্ন স্বতন্ত্র পুরুষের অনুভবেই স্থায়ী দুঃখনিবৃত্তি সম্ভব। ইহাই কৈবল্যপ্রাপ্তি।

বেদান্ত একধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন ব্যক্তিভেদে পুরুষ আলাদা নন, একটাই consciousness সর্বত্র ব্যপ্ত. সেই পরম চেতনা আলাদা আলাদা অস্মিতায় প্রতিফলিত হয়ে আলাদা আলাদা চিদাভাসরূপে প্রকাশিত হচ্ছেন। এই পরম চৈতন্যের সন্ধানই হচ্ছে ভারতীয় দর্শনের মূল উদ্দেশ্য।

এই তাত্ত্বিক আলোচনায় বেদান্ত দর্শন আমাদের অনেকগুলো স্তরে চিন্তা করেছেন. স্থূল শরীরের পেছনে সূক্ষ্ম শরীর,কারণ শরীর ইত্যাদি। স্থূল শরীর অর্থে স্বাভাবিক শরীর নিয়ে যে system। তার ওপরে থাকে সূক্ষ্ম শরীর, মন প্রাণ ইত্যাদি নিয়ে গঠিত। তার ওপরে কারণ শরীর, যা আমাদের auto mode এ চালায়, “search for happiness”. এর ওপরে আছে লিঙ্গশরীর, অর্থাৎ যেখানে জীব স্বরূপের সাথে যুক্ত, কিন্তু অনন্তে লীন হয়নি, অর্থাৎ আলাদা অস্তিত্ব চিহ্নমাত্ররূপে রয়ে যাচ্ছে। সাধকের উদ্দেশ্য এই লিঙ্গশরীরের ধারণা করা। যেহেতু infinity কে ধ্যান করা অসম্ভব, সেজন্য সাধক “অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষ” ধ্যানমূর্তিতে লিঙ্গশরীরের ধ্যান করেন। এটাই ভারতের প্রকৃত লিঙ্গ উপাসনা।