‘বসুধৈব কুটুম্বকম’: ছলনার আরেক নাম -২ : পঞ্চতন্ত্র ও কৌটিল্য

0
4753
সর্বেশ কে তিওয়ারী বসুধৈব কুটুম্বকম্ ভারতীয় সংস্কৃতিতে কি অর্থে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার উপর সুন্দর তিন পর্বে লিখেছেন।  প্রথম পর্বের পর আজ দ্বিতীয় পর্ব। অনুবাদ করেছেন সুজিৎ রায়।

প্রথম পর্বে, হিতোপদেশের দুটি ব্যাঙ্গাত্মক গল্পকথার মধ্যে দিয়ে আমরা প্রাচীন রাজনীতিজ্ঞ আচার্যের কথিত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটির প্রেক্ষিত ও নিহিতার্থ বুঝতে চেষ্টা করেছি। এক নীতিআদর্শ বা সুপারিশ হিসেবে নয়, বরঞ্চ এই শ্লোকটিকে এক ধরনের ধূর্ত সাবভারসনিষ্টরা যেভাবে ব্যবহার করে, তার মর্মার্থ বুঝে মেকি ভ্রাতৃত্ব-প্রচারকদের বিশ্বাস করা থেকে দূরে থাকা, এবং ভ্রাতৃত্ববোধের আবেগে ভন্ডদের বিশ্বাস করে বন্ধুত্ব করা ও আশ্রয় দিয়ে নিজের চরম সর্বনাশ করা থেকে বিরত থাকাই এই শ্লোকের নিহিতার্থ।
এই পর্বে আমরা সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যান্য উৎসগুলো, বিশেষত পঞ্চতন্ত্র এবং চাণক্য়ের সংগ্রহগ্রন্থে এই শ্লোকের ব্যবহার ও নিহিতার্থ বোঝার চেষ্টা করব।

পঞ্চতন্ত্রে বসুধৈব কুটুম্বকম

হিতোপদেশ সংকলনগ্রন্থ হিসাবে গড়ে তোলার সময় নারায়ণ পন্ডিত অন্যান্য উৎসের সঙ্গে বিশ্বের সবথেকে বড় গল্পকথার সংকলন পঞ্চতন্ত্রকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। হিতোপদেশের মুখবন্ধে নারায়ণ পন্ডিত স্বীকার করে নিয়েছেন যে, পঞ্চতন্ত্র ও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে তিনি বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করেছেন:

“পঞ্চতন্ত্রাত্তথান্যস্মাত গ্রন্থাদ্কৃষ্য লিখ্যতে” (হিতোপদেশ ১.৯)

পণ্ডিতেরা নিশ্চিতভাবেই দেখিয়েছেন যে, হিতোপদেশ হচ্ছে পূর্বেকার দক্ষিণ-ভারতীয় পঞ্চতন্ত্রেরই পূর্ব-ভারতীয় প্রেক্ষিতে নবায়িত সংস্করণ। তাই, আচার্য বিষ্ণুশর্মার  এই অভূতপূর্ব প্রাচীন আখ্যানকথা ‘পঞ্চতন্ত্র’ সম্ভবত সবথেকে বেশি অনূদিত ও প্রচারিত সাহিত্যকর্ম, যা সাধারণ পূর্বাব্দ তৃতীয় শতকে মৌর্য যুগের শেষের দিকে লিখিত হয়েছিল। যদিও কোন স্থানে এটা লিখিত হয়েছিল সে ব্যাপারে বহুমত আছে। কারো মতে কাশ্মীর বা নেপাল, কারো মতে তা দক্ষিণ ভারত। কিন্তু, এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই যে, এই পঞ্চতন্ত্রটি লিখিত হওয়ার পর তা প্রায় সমসাময়িক প্রধান সব সভ্যতাতেই প্রচারিত হয়েছিল। ফলস্বরূপ, পঞ্চতন্ত্রের পরিবর্তিত রূপ আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ভাষাতে – পহ্লবী, পারসিক, সিরিও, তুর্কি, গ্রিক ও ল্যাটিন, হিব্রু, আরবীয়, তিব্বতী ও চৈনিক ভাষায়। ইউরোপের বিভিন্ন গল্পকথা, যেমন, ফিলপে, ঈশপ, গ্রিমের গল্পকথা এবং পারসিক-আরবীয় সাহিত্যের গল্পকথাগুলির উৎস সেই পঞ্চতন্ত্র।

পঞ্চতন্ত্রের যে স্তরায়িত গল্প-আখ্যানের কাঠামো, হিতোপদেশ শুধু তাই অনুসরণ করেনি; এমনকি, সরাসরি বিভিন্ন শ্লোকের ব্যবহারও করেছে। সেই রকম একটি শ্লোকই হলো এই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি।

পঞ্চতন্ত্রের পঞ্চম তন্ত্র ‘অপরিলক্ষিতকারকমে’ বিষ্ণুশর্মা এই শ্লোকটিকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘সীমাকারক মূর্খ ব্রাহ্মণ কথা’ আখ্যানে এবং এক বোকা লোকের মুখে এই শ্লোকটিকে বসিয়েছিলেন। তাই, এই শ্লোকের প্রেক্ষিত বোঝাতে সংক্ষিপ্তাকারে সেই আখ্যানটিকে নিচে দেওয়া হল:

“কোন এক কালে এক অখ্যাত গ্রামে চার তরুণ ব্রাহ্মণ বন্ধু বাস করত। এই চারজনের মধ্যে তিনজন ছিল একেবারেই বোকা, যদিও তারা শাস্ত্রজ্ঞ ছিল। অন্যপক্ষে, চতুর্থজন, যদিও শাস্ত্রজ্ঞ ছিল না, কিন্তু বুদ্ধিমান ও বাস্তব জ্ঞানের অধিকারী ছিল।

একদিন প্রথম তিনজন শাস্ত্রজ্ঞ বন্ধু ঠিক করল, তারা নগরে গিয়ে তাদের বিদ্যাবুদ্ধিকে ব্যবহার করবে। আদতে, খ্যাতি-অর্থ অর্জন করা যদি না যায়, তবে এই শাস্ত্রজ্ঞানের কি মূল্য? দলের সবাই এই ভাবনাকে স্বীকার করে দূরে এক বড় নগরের দিকে রওনা দিল।

নগরের পথে যেতে যেতে চার বন্ধুর মধ্যে সবথেকে বড় শাস্ত্রজ্ঞ বন্ধু বলে ফেলল, আমাদের এই যাত্রায় শাস্ত্রজ্ঞানহীন মূর্খ বন্ধুর থাকা তো অপ্রয়োজনীয়। সে বলল, ওই বন্ধুর বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে যেহেতু সেই বন্ধুর কোন প্রথাগত শিক্ষার নেই, তাই এই যাত্রায় ঐ বন্ধুর থাকার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় শাস্ত্রজ্ঞ বন্ধুও সেই প্রস্তাবে সহমত পোষণ করল এবং পরামর্শ দিল যে, মূর্খ বন্ধুর গ্রামে ফিরে যাওয়াই ভালো।

অবশ্য, তৃতীয় শাস্ত্রজ্ঞ বন্ধু সহৃদয় ছিল। সে সবাইকে মনে করালো যে, চতুর্থ বন্ধু তাদের বাল্যবন্ধু। তাই তাদের এই অভিযানে তারও অংশীদারিত্ব আছে। ঠিক এই সময়ে ঐ তৃতীয় বন্ধুর মুখে শোনা গেল সেই বিখ্যাত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি এবং প্রথম দুই বন্ধুকে রাজি করালো চতুর্থ বন্ধুকে তাদের দলে রাখতে। এরপর তারা নগরের দিকে এগিয়ে চলল।

কিছুদুর এগিয়ে চলার পর চার বন্ধু দেখল একটি মৃত প্রাণীর ছড়ানো-ছিটানো কঙ্কাল। সেই কঙ্কাল দেখেই প্রথম তিন বিদ্বান বন্ধু ঠিক করল, তারা ঐ কঙ্কালের উপর তাদের বিদ্যার পরীক্ষা করবে।

প্রথম বোকা বিদ্বান তার অধীত অস্থিবিদ্যার দ্বারা সব হাড়গোড়গুলোকে যথাযথভাবে পুনঃস্থাপিত করল। দ্বিতীয় জন তার বিদ্যা দ্বারা সেই পূর্ণ-কঙ্কালের উপর অস্থি-মজ্জা-মাংস-চামড়া পুনঃস্থাপিত করল। আর ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বাণীদাতা তৃতীয় বোকা-বিদ্বান তার অধীত বিদ্যার দ্বারা এবার সেই মৃত প্রাণীটিকে পুনরায় প্রাণ-দানের পরীক্ষা শুরু করল।

ঠিক এই সময়ে, চতুর্থ বন্ধু, যে যদিও অশিক্ষিত কিন্তু বুদ্ধিমান ও কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন ছিল, সবাইকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। সে বলে উঠল, ‘বন্ধুরা, একটু দাঁড়াও। শোনো, এই মৃত প্রাণীটিকে সিংহ বলে মনে হচ্ছে এবং তোমরা এই মৃত সিংহকে বাঁচাতে চেষ্টা করছ। এমন করলে, বিদ্বান বন্ধুরা, আমাদের সকলেরই প্রাণসংশয় হবে। তাই তোমাদেরকে সনির্বন্ধ অনুরোধ, মৃত প্রাণীটিকে যেমন আছে তেমনি থাকতে দাও। আর, চলো আমরা নিজেদের গন্তব্যে এগিয়ে চলি।‘

কিন্তু, ‘বসুধৈব’ বাণীদাতা সেই বোকা-বিদ্বান তৃতীয় বন্ধুটি সাধারণ কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন সেই সতর্কবাণী উপেক্ষা করল।

শেষে, বিদ্বান বন্ধুদের এই আত্মঘাতী বোকামির কাজ করতে দেখে সেই কান্ডজ্ঞানী চতুর্থ বন্ধুটি কাছের একটা উঁচু গাছে উঠে পড়ল। তারপরে যা হবার তাই হল। বাণীদাতা তৃতীয় বন্ধুটি মৃত সিংহকে প্রাণ করতে পারল এবং তখনই সিংহটি বেঁচে উঠে তিন বোকা-বিদ্বান ব্রাহ্মণকে হত্যা করল। শুধুমাত্র বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন বন্ধুটি, যে গাছের উপর উঠে পড়েছিল সে শুধু বাঁচতে পারল, তিন বন্ধুর মর্মান্তিক পরিণতি এড়াতে পারল।

গ্রামে ফিরে সে তিন বন্ধুর বোকামি, বিশেষতঃ ঐ ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বাণীদাতা বন্ধুর চরম বোকামির জন্য শোক করতে লাগল।“

পঞ্চতন্ত্রে এই সেই গল্পকথা যেখানে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি স্থান পেয়েছে।

যদিও নিশ্চিতভাবেই হিতোপদেশে নারায়ণ পন্ডিত ওই শ্লোকটিকে  ব্যঙ্গাত্মকভাবে ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু বিষ্ণুশর্মা এই শ্লোকটিকে খুব বেশি গুরুত্ব দেন নি। বিষ্ণুশর্মা সরাসরি তৃতীয় বিদ্বানটিকে মূর্খ বলে ঘোষণা করেছিলেন ও পরে তার মুখ দিয়েই বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটিকে উচ্চারিত করিয়েছিলেন। চতুর্থ বন্ধুকে দলে রাখার জন্য বোকা ব্রাহ্মণ যুবকটি ঐ শ্লোকটিকে ব্যবহার করেছিল একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও অবান্তর ভাবেই। তাই, এটা ভাবা খুবই সঙ্গত যে, বিষ্ণুশর্মা এই শ্লোকটিকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবেই এক বোকা-বিদ্বান চরিত্রের মুখে বসিয়েছিলেন, যাতে এই শিক্ষা দেয়া যায় যে, অশিক্ষিত কান্ডজ্ঞান তথাকথিত শাস্ত্রজ্ঞানের থেকে বেশি মূল্যবান।

তাছাড়াও, মহান বিষ্ণুশর্মা ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকের প্রতি তার মনোভাব কখনোই গোপন করেননি, যখন তিনি এই শ্লোকের বাণীদাতাকে ‘বোকা’ বলে ঘোষণা করেছেন, যে নিজেই নিজের মুর্খামিতে নিহত হয়েছে। হিতোপদেশেও ঐ শ্লোক-দাতা শেয়ালকেও প্রকৃত নায়ক সুবুদ্ধি কাক হত্যা করেছিল।

তাই, এখন আমরা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের অবকাশ পেরিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, নীতিশিক্ষার ক্ষেত্রে – পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ – দুটি গ্রন্থই জাগতিক ব্যাপারে বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকের নিঃশর্ত ব্যবহারের ব্যাপারে খুবই ক্রিটিক্যাল ছিল। ঐ শ্লোকের ব্যাপারে দুটি গ্রন্থই খুব পরিষ্কার ও দ্বর্থহীন মত দিয়েছে: প্রথমত, ভ্রাতৃত্ববোধক বসুধৈব কুটুম্বকম শ্লোকটি হচ্ছে সাবভারসনের এক লোকপ্রিয় পদ্ধতি; দ্বিতীয়ত, অতিসরলরা খুবই বোকার মতো  এর দ্বারা প্রভাবিত হয়; এবং তৃতীয়ত, দু’পক্ষই শেষে ধ্বংস হয়।

বসুধৈব কুটুম্বকম এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র

পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ – নীতি শিক্ষার দুটি গ্রন্থেই ইতিহাস-পুরাণ ও আরো প্রাচীন নীতি শিক্ষার বিভিন্ন শ্লোকের ব্যবহার দেখা যায়। এই দুটি গ্রন্থেই একজন প্রধান লেখকের নাম পাওয়া যায়। তিনি হলেন বিষ্ণুগুপ্ত ওরফে চাণক্য বা কৌটিল্য। বস্তুতপক্ষে, পঞ্চতন্ত্রের মুখবন্ধে প্রথম দুটি লাইনেই বিষ্ণুশর্মা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে কৌটিল্যকে একজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান হিসেবে স্মরণ করেছেন এবং স্বীকার করেছেন যে, তিনি পঞ্চতন্ত্র সংকলিত করার আগেই চাণক্যের অর্থশাস্ত্র যথাবিহিত ভাবে অধ্যায়ন করেছেন:

“মনবে বাচস্পতয়ে শুক্রায় পরাশরায় সসুতায়
চাণক্যায় চ বিদুষে নমোস্তু ন্যায়শাস্ত্র-কর্তুভ্যঃ।।
সকলার্থ শাস্ত্রসারং জগতি সমালোক্য বিষ্ণুশর্মেদম
তন্ত্রৈঃ পঞ্চভির এতচ্চকার সুমনোহরং শাস্ত্রং।।“ (পঞ্চতন্ত্র ১.২)

মৌর্য সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণ এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই সাম্রাজ্যকে সুসংহত করে কৌটিল্য অবসর নিয়ে দক্ষিণ ভারতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব-তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কৌটিল্য তার নিজস্ব ভাবনা দিয়ে রচনা করেছিলেন ‘অর্থশাস্ত্র’। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন বিদ্যা একটি সাধারণ শাস্ত্রের মধ্যেই সংকলিত হতে থাকে। তবে, পরে এইভাবে এইসব শাস্ত্রজ্ঞান এক জায়গায় সংগ্রহ করে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পরে দেখা যায়, হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞরা সেই সাধারণ শাস্ত্রজ্ঞানকে জীবন-জগতের বিভিন্ন বিষয় অনুযায়ী বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত করেছেন- ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, কামশাস্ত্র ইত্যাদি। এমন কি, পরে আরো সূক্ষ্ম বিষয়ের উপর শাস্ত্র গড়ে তুলেছেন। যেমন, নাটকের জন্য নাট্যশাস্ত্র, রন্ধনের জন্য  রন্ধনশাস্ত্র/পাকশাস্ত্র ইত্যাদি।

তাই, কৌটিল্যের বিভিন্ন কাজকে দেখতে হবে একটি মাধ্যম হিসেবে যার দ্বারা আমরা প্রাচীন হিন্দুদের রাজনৈতিক দর্শনকে বুঝতে পারব, যা শুধু কৌটিল্যের সমসাময়িক নয়, তারও আগের থেকেই ধারাবাহিকভাবে গড়ে উঠেছিল।

প্রকৃতপক্ষে, অর্থশাস্ত্র রচনা করতে গিয়ে কৌটিল্য কমপক্ষে পাঁচটি রাজনৈতিক দর্শনের উল্লেখ করেছেন – মানব, বাহর্স্পত্য, ঔশোনাস, পরাশর ও অমব্যাল্য, এবং কমপক্ষে তেরো জন পণ্ডিতের নাম উল্লেখ করেছেন – ভরদ্বাজ, বিশালাক্ষ, পরাশর, পূষণ, কৌনপদন্ত, ভাতব্যয়াদি, বহুদন্তি-পুত্র, কাত্যায়ণ, কনিকা-ভরদ্বাজ, দীর্ঘ-বরায়ণ, ঘটক-মুখ, কিঞ্জল এবং পূষণ-পুত্র। এখানে এটা বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, কৌটিল্য তার পূর্বেকার পণ্ডিতদের সঙ্গে যেখানে মতের মিল হয়েছে, তা যেমন বলেছেন; তেমনি যেখানে তিনি সহমত হননি, সেগুলোও উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি প্রথমে তাদের মতামত উল্লেখ করেছেন, পরে ব্যাখ্যাসহ নিজের মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন।

উপরের অংশগুলোকে আমাদের মূল বিষয়ের সাপেক্ষে প্রক্ষিপ্ত মনে হতে পারে। কিন্তু সেগুলি জরুরি। কারণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের প্রেক্ষাপট বিচার করলে আমরা অনুধাবন করতে পারব যে, নীতি শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাচীন আচার্য্যদের বক্তব্য, যদিও তা এখন আমাদের কাছে লভ্য নয়, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মাধ্যমে আমাদের কাছে পরিস্ফুট হয়েছে। কাজেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি যে অর্থশাস্ত্রে নেই, তার কারণ ওই শ্লোকের মূলভাব প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রভাবনার পরিপন্থী ছিল।

যদি রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ঐ শ্লোকটিকে নিঃশর্ত ভাবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা  ভীরুতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতা হিসেবেই বিবেচিত হবে, অর্থহীন বোকাবোকা ভাই-ভাই স্লোগানের মত মনে হবে। এই ধরনের ব্যবহার রাষ্ট্রকে এক ‘নরম রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরবে, যা রাষ্ট্রকে শাসনহীন নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেবে। আর, কৌটিল্য অবশ্যই এই ধরনের রাষ্ট্রকে নিন্দা করেছেন।

এই ধরনের রোমান্টিক-নৈরাজ্যবাদী ভাবনার বিপরীতে কৌটিল্য ছিলেন একজন বাস্তববাদী, এবং মানুষ ও মনুষ্য-সমাজ সম্পর্কে তার বিশ্ববীক্ষার ভিত্তিভূমি ছিল কঠোর বাস্তবতা। রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘ভ্রাতৃত্বনীতিকে’ তিনি মূল ভিত্তি হিসেবে ধরেননি, বরং ‘দুর্জনকে শাস্তি দানের ক্ষমতাকেই’ তিনি রাষ্ট্রনীতির অন্যতম ভিত্তি বলে গণ্য করেছিলেন। অর্থশাস্ত্রের প্রথম বইতে কৌটিল্য বলেছেন,

‘অপ্রণীতো হি মাৎস্যন্যায়ম উদ্ভাবয়ন্তি বলীয়ান, অবলম হি গ্রসতে দন্ডধর অভাবে’

‘পরিবার হিসেবে নয়, মনুষ্য-সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জলে থাকা মাছেদের মাছ মতো যেখানে শক্তিশালী মাছগুলো দুর্বল মাছেদের আক্রমণ করে, যদি না তাদেরকে এই আক্রমণ করা থেকে বিরত করার জন্য প্রতিহত করা হয়।‘ সেই জন্য দণ্ডনীতি, যা রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, তা রাষ্ট্রনীতির মূল হিসেবে ধরতে হবে। সমাজের চালিকাশক্তিই হল অর্থ, যা ধর্মনীতির মাধ্যমে অর্জন করতে হবে এবং শুধুমাত্র দন্ডনীতিই তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

এই বিশ্ববীক্ষার ক্ষেত্রে কৌটিল্য পেয়েছেন ভীষ্মকে (যাকে তিনি কৌনপদন্ত বলেছেন), যিনি মহাভারতের সাতষট্টিতম অধ্যায় শান্তিপর্বে একই নীতির কথা বলেছিলেন। ঋষি মনুও একই ধরনের মত দিয়েছেন:

“যদি ন প্রণয়েত রাজা দন্ডম দন্ডস্বতন্দ্রিতঃ জলে মৎস্যানিবাহিংস্যান দুর্বলান বলবত্তরাঃ” (মনুস্মৃতি ৭.২০)

“যদি রাষ্ট্র, যাদের উপর যথাযথভাবে দন্ডনীতি প্রয়োগ করা দরকার, তা না করে; তাহলে দুষ্টু লোক শক্তিশালী মাছের মত সৎ ও দুর্বল লোকের উপর আক্রমণ করবে।“

তাই, এইসব আচার্য-পন্ডিতেরা খুবই পরিষ্কার ছিলেন যে, যদি রাষ্ট্রশাসকরা তাদের প্রাথমিক কর্তব্য না করে, বসুদেব কুটুম্বকম শ্লোকের দোহাই দিয়ে দণ্ডনীতি না ব্যবহার করে; তবে কোনোই কুটুম্বিতা/আত্মীয়তা থাকবে না, সমাজে চালু হবে মাৎস্যন্যায়।

তাই, ‘সারা পৃথিবী এক পরিবার’ মডেলের পরিবর্তে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এটাই বলতে চেয়েছে, শঠতা ও শত্রুতা রাষ্ট্রীয় তথা সমাজজীবনে আছেই এবং রাষ্ট্র-পরিচালনার ক্ষেত্রে এক কঠোর মনোভাব দরকার, সেইসব অন্যায় থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য। দেশের শত্রুদের চিহ্নিত করে তাদেরকে কঠোরভাবে দমন করা রাষ্ট্রনায়কদের অবশ্যকর্তব্য, যাতে সমাজ জীবনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। তাই, কৌটিল্যের কয়েকটি বিখ্যাত উক্তি দেখা যাক: ‘বনে যেমন সব গাছ চন্দনগাছ নয়, যেমন সব হাতি মানিক্যযুক্ত নয়, তেমনি মনে রাখা দরকার যে, সবাই ভদ্রজন নয়’; ‘প্রত্যেকেই যেভাবেই হোক নিজের লোকেদের রক্ষা করা উচিত এবং শত্রুদেরকে আক্রমণ করা দরকার’, ‘হে প্রভু, আমাদের শত্রুদের, যদিও তারা এক বড় চক্র, তাদেরকে ধরাশায়ী করুন; সর্বশক্তি দিয়ে তাদেরকে দমন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না।‘

তাই, আমার বিশ্বাস, আমরা বলতেই পারি যে, কৌটিল্যের মতানুযায়ী ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ নীতির রোমান্টিক নৈরাজ্য নয়, বরং দেশশাসকরা বাস্তবজ্ঞানে শত্রু-মিত্র-ভেদ করে শাসননীতি প্রয়োগ করবেন এবং সমাজের শান্তির জন্য নির্দ্বিধায় নৈরাজ্যবাদীদের দমন করবেন।

কৌটিল্যের অন্যান্য রচনায় বসুধৈব কুটুম্বকম

অর্থশাস্ত্র ছাড়াও আরো কয়েকটি সংগ্রহগ্রন্থে চাণক্যের নাম পাওয়া গেছে এবং সেইগুলিতে চাণক্যের নামে কয়েকশো নীতিবচনের  উল্লেখ পাওয়া গেছে। কিছু জনপ্রিয় সংক্ষিপ্তসারে, যেখানে চাণক্যের উল্লেখ আছে, সেগুলি হলো: লঘু-চাণক্য, বৃদ্ধ-চাণক্য, চাণক্য-নীতি-দর্পণম্, চাণক্য-নীতিশাস্ত্র, চাণক্যনীতি-শতক, চাণক্য-রাজনীতি-শাস্ত্র, চাণক্যম, চাণক্য-শতকম, চানক্যনীতি-ব্যবহার-সারসমগ্র, চাণক্য-সূত্রনী,এবং রাজনীতি। উপরের উল্লেখিত সংগ্রহের অল্প কিছুই প্রকাশিত হয়েছে, বেশিরভাগই পান্ডুলিপি আকারেই পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রন্থাকারে রক্ষিত আছে।

উপরের তালিকার মধ্যে প্রথম চারটি, যথা, লঘু-চাণক্য, বৃদ্ধ-চাণক্য, চাণক্য-নীতি-দর্পণম্ ও চাণক্য-নীতিশাস্ত্র গ্রন্থ গুলি বহুচর্চিত গ্রন্থ এবং সেগুলির পান্ডুলিপি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেই পাওয়া গেছে। কাজেই প্রথম চারটি সংগ্রহ অবশ্যই প্রাচীন, যা চাণক্যের নিজের লেখার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, সংগ্রহকর্তারা চাণক্যের নাম ব্যবহার করেছেন সেগুলির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে।

‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একমাত্র ‘বৃদ্ধ-চাণক্য’ গ্রন্থেই ঐ শ্লোক পাওয়া যাচ্ছে, যা হচ্ছে তাঞ্জোর সংশোধিত সংস্করণ। আর চাণক্য-নীতি-শাস্ত্রের এক সংস্করণেও আছে। চাণক্যের নীতিবচনের  অন্যান্য সকল সংগ্রহগ্রন্থেই এই শ্লোকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই, অনুমান করা যায়, এই শ্লোকের উপস্থিতি কিছু পন্ডিত অন্যান্য গ্রন্থ থেকে চাণক্যের নামে উল্লেখ করেছেন।

লুডউইগ স্ট্যার্নবাক বিভিন্ন সংগ্রহগ্রন্থ থেকে চাণক্যের বিভিন্ন উক্তি বিচার-বিশ্লেষণ করে একটি অনন্য গ্রন্থ লিখেছেন। উনি পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করে তার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ শ্লোকটি চাণক্যবিযুক্ত বিভিন্ন উৎস গ্রন্থ থেকে পরবর্তী সময়ে চাণক্য নামযুক্ত বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।

স্ট্যার্নবাক আরো দেখিয়েছেন যে, চাণক্যের নামে বিভিন্ন উক্তি আসলে আরো পূর্বের মহাভারত থেকে সংগৃহীত হয়েছে।
সর্বোপরি, অর্থশাস্ত্রে চাণক্যের মূল ভাবনা-চিন্তাকে যদি পর্যালোচনা করা যায়, তবে এটা ভাবা অসম্ভব যে, রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে চাণক্য  ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’কে এক নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

আসলে এই শ্লোকের ব্যবহারনীতি আধুনিক ভারতের  দেশশাসকদের এক অভাবনীয় উদ্ভাবন!

(ক্রমশঃ)