২০২১ সালে ভারতের অবশ্যকরণীয় ৮টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি

–  সোমদীপ ভট্টাচার্য

 

২০২০ সালে কোভিড -১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পরেও, পিপলস লিবারেশন আর্মি বহুল সংখ্যায় সৈন্য সমাবেশ করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ (এলএসি) রেখা বরাবর। এই উস্কানিমূলক কৌশলগুলি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত এবং চীনের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষের কারণ হয়েছিল।

এরপরে হ’ল একটি চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া – চৈনিক আগ্রাসনের মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অস্ত্র ব্যবস্থার জরুরি সংগ্রহ। এটি কোনো নতুন বিষয় ছিল না – ভারত সাম্প্রতিক অতীতে প্রায় প্রতিটি সামরিক সঙ্কটেই অনুরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তবে গুণগতভাবে নতুন এক চৈনিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে লাদাখের বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কেবল আলোচনাই সমাধানের একমাত্র উপায় হতে পারেনা। অন্যদিকে ডোকলামেও একইভাবে চীন আগ্রাসন চালায় যার ফলে ভারত বাধ্য হয় ভুটানের পাশে দাঁড়াতে।

চীন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে নিত্য নতুন ফ্রন্ট খুলছে। আবার অন্যদিকে পাকিস্তান চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছে চীনের হাতে। এই ভয়াবহ সামরিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য ২০২১ সালে এই আটটি প্রতিরক্ষা চুক্তি ভারতের সম্পূর্ণ করা উচিত।

 

লাইট কম্ব্যাট হেলিকপ্টার

হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড (এইচএল) দ্বারা নির্মিত, লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার (এলসিএইচ) হ’ল ভারতের প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত এট্যাক হেলিকপ্টার।

হেলিকপ্টারটিতে একটি সংকীর্ণ ফিউজলেজ কনফিগারেশন রয়েছে এবং এটি “লুকিয়ে থাকার (স্টেলথ) বৈশিষ্ট্য, বর্ম জাতীয় (আরমার্ড) সুরক্ষা, রাতে আক্রমণের সক্ষমতা এবং আরও ভালোভাবে সারভাইভ করার জন্য ক্র্যাশ প্রতিরোধী ল্যান্ডিং গিয়ার” দিয়ে সজ্জিতও করা হয়েছে।

চীনের সাথে উত্তেজনা বাড়ার কারণে এ বছর দুটি এলসিএইচকে লাদাখে মোতায়েন করা হয়েছিল এবং তারা সশস্ত্র অবস্থায় নিয়মিত টহল চালাচ্ছিল।

২০১৬ সালের নভেম্বরে, নরেন্দ্র মোদী সরকার এইরকম ১৫ টি হেলো কেনার ব্যাপার ভাবনা শুরু করে, তবে এখনও কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। এর নির্মাতা হ্যাল (HAL) আগের বছর ২০২০ তেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার প্রত্যাশা করেছিল। চূড়ান্ত চুক্তি হওয়ার পর, নির্ধারিত সময়ের আগেই এটি সরবরাহ করার পরিকল্পনা নিয়ে, পাঁচটি নতুন এয়ারফ্রেমের উৎপাদনও তারা শুরু করে দেয়। প্রাথমিক ছাড়পত্র ১৫ টি হেলোসের জন্য হলেও হ্যাল এগুলির মোট সংখ্যা ১৬৫ অবধি যাওয়ার কথা প্রত্যাশা করছে।

 

এডভান্সড টোওড আর্টিলারি কামান

প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা ডিআরডিও দ্বারা নির্মিত এবং দুটি বেসরকারি সংস্থা ভারত ফোর্জ ও টাটা অ্যাডভান্সড সিস্টেমসের দ্বারা যৌথ উদ্যোগে উৎপাদিত হয়েছে অ্যাডভান্সড টোওড আর্টিলারি গান সিস্টেম (এটিএসএস)। এই কামানগুলি ট্রায়াল চলাকালীন সিকিম ও পোখরানের মতো চ্যালেঞ্জিং জায়গায় ২ হাজার রাউন্ডেরও বেশি গোলা চালিয়েছে।

হাওইটজার তার শ্রেণিতে বিশ্বের দীর্ঘতম রেঞ্জের কামান হিসেবে পরিচিত যা সর্বাধিক ৪৮ কিলোমিটার দুরত্বের পরিসীমা অতিক্রমণ করতে পারে। প্রায় ১৮ টন ওজনের হাওইটজারকে তিন মিনিটেরও কম সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করা যেতে পারে।

একটি সর্ব-বৈদ্যুতিক ড্রাইভ বিশিষ্ট এবং একটি স্বয়ংক্রিয় কমান্ড। নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছাড়াও এই কামানটিতে স্ট্যান্ডার্ড তিন রাউন্ড ম্যাগাজিনের পরিবর্তে একটি ছয় রাউন্ড ম্যাগাজিন রয়েছে।

২০১৮ সালের আগস্ট মাসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর নেতৃত্বে Defence Acquisition Council, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য ১৫০ টি ATAGS ক্রয়ের কথা জানিয়েছে।

স্বরাজ্যসহ একাধিক প্রতিবেদনগুলি থেকে জানা গেছে যে সেনাবাহিনী তার আর্টিলারি আধুনিকীকরণ কর্মসূচির অংশ হিসাবে এই ক্লাসে ১,৫৮০ টি কামান প্রয়োজন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষা চলাকালীন ব্যারেল ফেটে দুর্ঘটনার কারণে এখনও কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। বন্দুকের ব্যবহারকারীরা এর ট্রায়াল শীঘ্রই আবার শুরু করবেন এবং ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তা শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

এলসিএ তেজস মার্ক ১ এ

এলসিএর মার্ক ১ এ গুলি, মূল মার্ক ১ ভেরিয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম হবে। এটিতে প্রথম সংস্করণের তুলনায় প্রায় ৪০ টি এডভান্সড ফিচার থাকবে যা ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে, এতে একটি সক্রিয় বৈদ্যুতিন স্ক্যান করা অ্যারে রাডারও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এলএসি-র মার্ক ১ এ সংস্করণে প্রতিটি বিমানের একেকটা ‘সর্টি’র পরে দ্রুত টার্নআরাউন্ড ক্ষমতাও থাকবে।

মার্চ মাসে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এমকে ১ এ কনফিগারেশনের ৮৩ টি হালকা কমব্যাট বিমান (এলসিএ) তেজসের অর্ডার করে। এই বছরের শুরুর দিকে হ্যালের চেয়ারম্যান আর মাধবান বলেছিলেন, এই চুক্তিটি ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

স্বল্পতম সময়ে আইএএফের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য হ্যাল তার আধুনিক সুবিধাযুক্ত যোদ্ধা বিমানের উৎপাদন হারকে উন্নত করছে। হ্যালের দ্বারা এই এসেম্বলি হার বৃদ্ধি করার জন্য একটি দ্বিতীয় ম্যানুফাকচারিং লাইনও স্থাপন করা হয়েছে।

“আমাদের টার্গেট রেট প্রতি বছর ১৬ টি এলসিএ যোদ্ধাবিমান তৈরি করা, যার জন্য ইতিমধ্যেই একটি দ্বিতীয় এসেম্বলি লাইনও স্থাপন করা হয়েছে।” জুনে এক সাক্ষাৎকারে মাধবন বলেছিলেন, “আমরা যখন ৮৩ টি এলসিএ অর্ডার পাই তখন আমরা প্রতি বছর সহজেই ১৬-২০ টি পর্যন্ত উৎপাদন করতে পারি”, স্বরাজ্য তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

 

প্রজেক্ট ৭৫ আই সাবমেরিন

ভারতীয় নৌবাহিনী বর্তমানে কেবল ১৫ টি প্রচলিত ব্যবস্থার সাবমেরিন পরিচালনা করে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও চারটি ‘স্করপিয়ান’ শ্রেণীর সাবমেরিন পরিষেবাতে প্রবেশ করবে। মোট সংখ্যা এর পরে ১৯ এ গিয়ে দাঁড়াবে। এই সাবমেরিনগুলির কোনওটিই বায়ু-স্বাধীন প্রপালশন (air-independent propulsion – এআইপি) দিয়ে সজ্জিত নয়।

ভারত মহাসাগরে চীনের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে সংখ্যার হিসেবে ২৪ টি প্রচলিত পদ্ধতির ডুবোজাহাজ প্রয়োজন নৌবাহিনীর। এই মূল্যায়ন অনুযায়ী প্রয়োজনীয়তার চেয়ে বর্তমান সংখ্যা পর্যাপ্ত বা যথাযথ নয়। তবে অভাব সত্ত্বেও এই প্রকল্পে ৭৫ আই সাবমেরিনের ক্ষেত্রে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে, যার অধীনে ভারত আরও ছয়টি ডিজেল-বৈদ্যুতিন সাবমেরিন অর্জনের পরিকল্পনা করছে।

পি ৭৫ – আই সাবমেরিনগুলি বর্ধিত সহনশীলতা এবং লম্বা লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য air-independent propulsion দিয়ে সজ্জিত করা হবে। এগুলি ব্রহ্মোস ক্রুজ মিসাইল উৎক্ষেপণ করতেও সক্ষম হবে।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এই প্রকল্পের জন্য দুটি ভারতীয় শিপইয়ার্ড এবং পাঁচটি বিদেশী সাবমেরিন প্রস্তুতকারক সংস্থাকে তালিকাভুক্ত করেছিল।

 

ভারতীয় নেভির ফাইটার জেট

মিগ – ৯৯ কে-এর পারফরম্যান্সে ভারতীয় নৌবাহিনী বহুদিন ধরেই অসন্তুষ্ট ছিল । তাই তারা ২০১৭ সাল থেকেই তাদের বিমানবাহক পোত (এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার) গুলির জন্য উপযুক্ত ৫৭ টি ফাইটার জেট জোগাড়ে একটি কর্মসূচি চালু করেছিল।

তবে বাজেটের সীমাবদ্ধতা এবং অন্যান্য কারণে, সেই সংখ্যাটি কমিয়ে এখন প্রায় ৩৬ এ নামিয়ে আনা হয়েছে। নৌবাহিনীর নিজস্ব বিমান সংগ্রহের এই ডিলটি এয়ার ফোর্সের ১১০টি মাল্টি রোল যুদ্ধ বিমান সংগ্রহের ডিলের সাথেও জড়িয়ে রয়েছে।

আইএনএস বিক্রান্ত যেটি কিনা ভারতের প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি বিমানবাহক ক্যারিয়ার সেটি ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে কোনও এক সময় ভারতীয় নৌবাহিনীর সার্ভিসে প্রবেশ করার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

ভারতীয় বিমান বাহিনীর জন্যে ১১০ টি যুদ্ধ বিমান

ভারতীয় নৌবাহিনী ২০১০ সালে ১১০ মাল্টি-রোল যোদ্ধাদের ক্রয়ের জন্য তথ্য বা আরএফআইয়ের (Request for Information or RFI) একটি বিজ্ঞাপন জারি করেছিল। ছয়টি সংস্থা আরএফআইয়ের উত্তরে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। যাইহোক নো কেন, অনেক অসুবিধার পরেও আইএএফ -এর এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে সরকারের তরফে খুব একটা মাথা ঘামানো হয়নি।

তবে আরএফআই-এ, আইএএফ বলেছিল যে তারা চুক্তি সই হওয়ার ৩ মাস পরেই ফ্লাইট অ্যাওয়ে অবস্থায় (মূল্যের ১৫ শতাংশ) মূল সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক (Original Equipment Manufacture ওএম) এর কাছ থেকে সরাসরি যোদ্ধা বিমানের ডেলিভারি নিতে চায়।

আইএএফ আরও জানিয়েছিল, ওইমের ভারতীয় অংশীদার দ্বারা প্রস্তুত করা বাকি বিমানগুলির ডেলিভারি চুক্তি সই হওয়ার পাঁচ বছর পরে শুরু হতে পারে।

অর্থাৎ যদি কোনও চুক্তি ২০২১ সালে স্বাক্ষরিত হয়, তবে সরবরাহ ২০২৪ সালে শুরু হতে পারে।

 

একে ২০৩ রাইফেল

ভারত ও রাশিয়া ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে একে -২০৩ রাইফেল তৈরির জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এই রাইফেলগুলির প্রথম ব্যাচটি প্রোডাকশন লাইন থেকে ২০১৯ সালে ‘রোল আউট’ করার কথা ছিল।

তবে স্বরাজ্যর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাইফেলের দাম ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে মূল বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের জুনে যৌথ উদ্যোগে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক একটি ব্যয় নির্ধারণ কমিটি নিয়োগ করে, তবে “অযৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য নয়” এমন একটি মূল্য উদ্ধৃত করার পরে এই ম্যানুফাকচারিংটি আটকে যায়।

ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রায় সাত লক্ষ একে – ২০৩ রাইফেল কেনার পরিকল্পনা করেছিল।

যদিও একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তবুও গত কয়েকমাসে আমেঠির কোরওয়াতে উৎপাদন শুরু করার ক্ষেত্রে কোনও অগ্রগতিই হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মার্চ মাস, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন। সেনার স্বার্থে অতি দ্রুত এখান থেকে উৎপাদন চালু করা প্রয়োজন।

 

ড্রোন

এ বছর নভেম্বরে ভারত, ভারতীর মহাসাগর অঞ্চলে সামুদ্রিক নজরদারি করার জন্য আমেরিকা থেকে দুটি এমকিউ – ৯ বি সিগার্ডিয়ান ড্রোন ইজারা দিয়েছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০ টি বিমান বাহিনীর জন্যে এবং নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর জন্য ১০ টি করে সশস্ত্র ড্রোন সংগ্রহের বিষয়ে আলোচনা চালিয়েছিল।

ভারত মহাসাগর এবং লাইন অফ একচ্যুয়াল কন্ট্রোল উভয় ক্ষেত্রেই চীনের উপস্থিতি অতি দ্রুত বাড়ছেম এই ড্রোনগুলি ক্রয় করার ফলে ভারত তাদের ক্রিয়াকলাপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করাতে পারবে।

আগামীতে দেশের সমর শক্তির বিকাশের জন্য এই চুক্তিগুলি যত দ্রুত সম্ভব ভারত সরকারের সম্পন্ন করা উচিত।

মতামত ব্যক্তিগত।