ইসলামীয় শাসনে স্বাধীন বঙ্গদেশঃ আতঙ্কের অতীত গাথা

0
1834

১৯৪৭ এ যখন দেশভাগ হয় হয়, সোহ্‌রাওয়ার্দী সাহেব মিষ্টি করে বলেছিলেন, বাংলার উচিত না ভারত, না পাকিস্তান এর সাথে যাওয়া, নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। যুক্তিটা কি? কলকাতার পাট, তাঁত, রেশমের অর্থনীতি পূর্ববঙ্গের সাথে ওতপ্রোতঃভাবে জড়িত, একসাথে থাকলে পূর্ব-পশ্চিম দুই কুলের-ই সুবিধা। বাংলার ঐতিহাসিক হিন্দু মুসলিম ভ্রাতৃত্ব এবং গতানুগতিক সুন্দরশ্রাব্য (অধিকাংশেই অন্তঃসারশূন্য) কথা যেগুলো রেডিও টিভিতে শোনা যায় সেগুলিও সেই প্রস্তাবের অঙ্গ ছিল বৈকি। শরৎ বোসের মত বেশ কয়েকজন কংগ্রেস নেতারও এতে সায় ছিল। রুখে দাঁড়িয়েছিল একমাত্র ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভা। ১৯৪৬এ তারকেশ্বর অধিবেশনে হিন্দু মহাসভা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল; বাংলা যদি ভারত ও পাকিস্তানে ভাগ না হয়, তাহলেও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বকে বিভক্ত করা উচিত। সাধারণ বাঙালিরা এই মতের পক্ষেই ছিলেন।

ইতিহাসের পাতা ঘটলে বেশি দূর যেতে হবে না, মুঘল সাম্রাজ্যের গুটিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে বাংলার বুকে যে নবাবকুলের উৎপত্তি হয়েছিল সেটাই যথেষ্ট| রায়বাহাদুর শ্রেণীর ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু ইতিহাসবিদরা এটুকুই শুধু বলে থাকেন যে মুর্শিদকুলি খানের জন্ম এক ব্রাহ্মণ ঘরে| তারপরে মহাভারতের মত “ইতি গজ”টুকু আর বলা হয়ে ওঠে না| মুর্শিদকুলি খানের জন্ম বাংলায় হয়ে নি, হয়েছিল দক্ষিণ ভারতে, ছোট অবস্থায় ক্রীতদাস হয়ে হাজি শাফি ইসফাহানির সম্পত্তি হয়েছিলেন। যথারীতি ইসলাম কবুল করার পর উনার নাম হয়ে যায় মুর্শিদকুলি খান। শাফি সাহেব ছিলেন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র। দাক্ষিণাত্যে মেয়াদ ফুরিয়ে আসার পর নিযুক্ত হন দিল্লিতে এবং তারপর বাংলায়। তিনি ছিলেন ফার্সি, টাকা পয়সা কামিয়ে ইংল্যান্ডের সাহেবদের মতো তিনি ফেরত গেছিলেন ইরানে। তাঁর মৃত্যুর পর অর্থকষ্টের বশেই মুর্শিদকুলি খানকে ফিরতে হয় ঔরঙ্গজেবের দরবারে। প্রথমে ১৭০০ সালে বাংলার দেওয়ান হয়ে তাঁর হাতেখড়ি। গরীব হিন্দুদের গরীব রেখে তাদের উপার্জনের সিংহভাগই কর হিসেবে তাদের ওপরঅত্যাচার করে আদায় করায় তাঁর পটুতার কোনো জবাব ছিল না। ফলস্বরূপ ১৭১৭ সালের মধ্যেই তিনি হয় ওঠেন ভারতের সব থেকে ধনী প্রদেশের নাজিম।

১৭২২ সালে তিনি যে রাজস্ব মূল্যায়ন করেন, তাতে রাজকোষের আয় এক ধাক্কায় বেড়ে যে সাড়ে ২২ শতাংশ, ১১৭ লক্ষ থেকে ১৪১ লক্ষ। Wheeler সাহেবের লেখায় জানা যায় যে বীরভূমের জমিদার আসাদুল্লাহ আর কৃষ্ণনগরের জমিদারি নতুন মূল্যায়নের আওতায় আসে নি। আফগান আসাদুল্লাহ রাজমহল পর্বতমালার ওপর থেকে জাহরচাঁদ এর আক্রমণ আটকাতে সামর্থ হন। অন্যদিকে কৃষ্ণনগরের বেশির ভাগ অঞ্চলে ছিল শুধু বন ও জঙ্গল, যেটা অধুনা সুন্দরবনের অধিকাংশ। তাই পুরো ফসলের পরিমাণ, দাম ইত্যাদি ঠিক রেখে রাজস্ব মূল্যায়ন করে ওঠা হয়ে পড়েছিল কঠিন।

প্রত্যেক মাসের শেষে দেওয়ানখানায় মুৎসুদ্দি,আমিন, জমিদার, কানুনগোদের বন্দি করে রাখা হতো যতক্ষণ না তারা নিজের রাজস্বের হিসেব দিতে পারছে| খাওয়া-দাওয়া তো দূরের কথা, তেষ্টা মেটানোর জলও পাওয়া যেত না। প্রকৃতির ডাককে অগ্রাহ্য করে তাদের সকলকে ভেতরে থাকতে হতো যতক্ষণ না হিসেব মিলছে। পাছে নবাব এর নিজের লোকেরাই দু চারটে বকশিশের বিনিময়ে জালিয়াতি করে ফেলে, আমাদের নবাব বাহাদুর তাই গুপ্তচরবৃত্তির আশ্রয় নেন। শেষ পর্যন্ত হিসেব না মিললে আর ঠাঁই নেই, উল্টো করে বেঁধে পায়ের তালুতে চাবুকের মার, তাদের পুরো পরিবারকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হত। তৎকালীন ইতিহাসবিদ, নবাবেরই চাকুরে গোলাম হোসেন সেলিম এই অত্যাচারের পরিণাম স্বরূপ কোনো বাড়তি রাজস্ব আদায় হতে দেখতে পান নি। হিন্দু তো আর শুধু হিন্দু নয়, মানুষ আর পশু-পাখির মধ্যবর্তী স্থানে আটকে থাকা প্রাণী বিশেষ। তাদের ওপর জোর-জুলুম করাটাও তাই শখ আর দরকার এর মধ্যবর্তী পর্যায়েই পরে।

নবাবের নাতজামাই সায়েদ রাজি খান হয় ওঠেন নতুন দেওয়ান, তাঁর প্রথম কাজ হয় ওঠে একটি বৃহৎ চৌবাচ্চা খুঁড়িয়ে তার নাম রাখা “বৈকুন্ঠ”। ক্ষীরসাগরের বদলে সেই চৌবাচ্চায় বিষ্ঠা দিয়ে ভরাট করে তার মধ্যে ক্লেশগ্রস্ত, হিসেব মেটাতে না পারা জমিদারদের গলাধাক্কা দেওয়া হত। সেলিমের লেখা থেকেই জানা যায় সুসঙ্গের জমিদার রাম সিংহকে পরিবার সমেত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। তাঁর বৃহস্পতি তুঙ্গে ছিল। ভূষণার জমিদার সীতারামের সেই ভাগ্য হয়নি, তাঁর মুখ গোবরে লেপে সারা মুর্শিদাবাদ ঘুরিয়ে গর্দান নেওয়া হয়। তাঁর পরিবারের সদস্যদের পাকাপাকি ঠাঁই হয় নবাবের কারাগারে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে হিন্দুরা যদি এতটাই খারাপ, তাহলে তাদের জমিদারি কেড়ে নবাবী পরিবারের কাউকে বসালেই তো হয়। বাংলার ইসলামী যুগ তো বেশ কয়েক শতক পুরোনো, সাধারণ ছেড়ে বনেদি মুসলমান পাওয়া কি খুব কঠিন কাজ? কোম্পানির চাকুরে এক স্টুয়ার্ট সাহেবের উপলব্ধি। নবাব বাহাদুরের আসলে অন্য চিন্তা, মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করলে তাদের লতায়-পাতায় জড়ানো যত আত্মীয় বাকি মুঘল সাম্রাজ্যের চার ধরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তারা যদি ষড়যন্ত্র করে তাহলে তো রাজপাটের ওপর এসে পড়বে সংকট। তার থেকে ভালো নিরীহ হিন্দুদের ওপর অত্যাচার ফলানো অনেক সহজ, বাকি মুসলমান রাজ্যগুলির কাছে জবাবদিহি করতে হবে না|

মুর্শিদকুলি খানের পর  দুই হাত ঘুরে নবাবের আসনে বসেন আলীবর্দী খান। তিনি ছিলেন বিহারের উপ-নবাব, মুর্শিদখানের জামাই সরফরাজ খানকে হত্যা করে নিজের আসনের ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর জমানায় রাজস্বর ওপর বাড়তি কর চাপিয়ে ১৭২২ সালের জমার চেয়ে আয় আরও বাড়ে, রাজকোষের ৩০ শতাংশ আয়বৃদ্ধি হয়। মজার ব্যাপার হলো খাজনার বোঝা চাপিয়ে দিয়েও নবাব বাহাদুর সেচ, রাস্তাঘাট ও বন্যা-নিয়ন্ত্রণ এর জন্য অর্থ জোগাড় করতে পারলেন না।

তবুও তাঁর সময়ে সিরাজ-উদ-দৌল্লার উৎপাতে মুর্শিদাবাদ অতিষ্ঠ হয় নি। এক বছরের মধ্যেই নতুন নবাব বাহাদুর হয় ওঠেন চরম নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি। হিল সাহেবের লেখা থেকে জানা যায় নবাব নিজের গুপ্তচরদের কাজে লাগাতেন সুন্দরী মেয়েদের খোঁজ নিতে। তারা যখন গঙ্গায় স্নান করতে ব্যস্ত, সাঙ্গপাঙ্গদের ছোট ডিঙিতে করে পাঠাতেন তাদের তুলে এনে নিজের কুৎসিত মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য। আর নদীর ভরা মরশুমে গঙ্গার বুকে নৌকা ডুবিয়ে শখানেক লোক কে নিজের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে হাবুডুবু খেতে দেখে তাঁর পৈশাচিক আনন্দলাভের কথা তো সুবিদিত।

১৭৫৭ এর চক্রান্তের মুখ ছিল মীরজাফর কিন্তু তাঁর পেছনে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। হিন্দুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শুধু কাশ্মীরী হিন্দু মহারাজ মোহনলাল ও বিহারের উপ-নবাব সাসারামের রামনারায়ণ সিরাজ-উদ-দৌল্লার সমর্থনে এসেছিলেন। নয় তো, জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ, নবাবের আরেক সেনাপতি দুর্লভ রাম, দেওয়ান রাজবল্লভ এবং নদীয়া ও বর্ধমান রাজবাড়ীর সমর্থন ছিল ইংরেজদের দিকেই।

বাংলার নবাব কতটা বাঙালি ছিলেন? শুধুমাত্র বাছাই করা শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেদেরই চাকরি দেওয়া হত। সুন্নি মুসলিমদের ওপর ভরসা করতেন না, তাই দূর ইরান থেকে আত্মীয় স্বজনদের ডেকে পদ বিলি করা হত। বেশির ভাগ কাজ তাই হিন্দুদের মাধ্যমে করা হলেও সবার ঘাড়ে একজন করে শিয়া মুসলমান চাপিয়ে দেওয়া হত। অতএব তাদের সুবিধার্থে ফার্সি ব্যবহার করাটাই ছিল রীতি। পাছে ফার্সি আত্মীয়দের ঠিক পেছনেই কেউ বাংলায় ষড়যন্ত্র করে, তাই দরবারে বাংলা ব্যবহার হয় ওঠে নিন্দাজনক ব্যাপার। বাংলা ভাষায় আবেদন করা ছিল নিষিদ্ধ। একমাত্র সেইসব হিন্দুদের চাকরিতে উন্নতি হত, যারা চোস্ত ফার্সি বলতে পারতেন। ম্যাকলে সাহেব আর ইংরেজি শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্য আমরাই হয়তো দেখতে পাই, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ বর্তমান রায়বাহাদুর শ্রেণী পায় না। ইসলামী ধর্ম ও আরবি ভাষা প্রসারের জন্য দুইটি মাদ্রাসা খোলা হয়। হুগলীতে প্রচুর সংখ্যক ফার্সি থাকত| তাই সেখানে, রাজধানী মুর্শিদাবাদে এবং ঢাকায় মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার ছিল চমকপ্রদ| এই সময়কালেই পাটনার আজিমাবাদ হয় ওঠে উর্দুশিক্ষার এক প্রাণকেন্দ্র|

উল্টো দিকে হিন্দু জমিদার কুলের হাত ধরেই বাংলার স্বর্ণযুগ শুরু হয়| মন্দির নির্মাণ করে পন্ডিত লোকেদের সভা ডাকা, টোল-পাঠশালা র জন্য জমিদান এবং জনসাধারণের ভাষায় ধর্মের বাণী পৌঁছে দিতে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে উৎসাহ দেন এই জমিদার-শ্রেণীর লোকেরাই| বর্ধমান এর রাজারা, রাজশাহীর রানী ভবানী আর বিষ্ণুপুরের রাজাদের টাকাতে গড়ে ওঠে একাধিক মন্দির-পরিসর| নদীয়ার জমিদারেরা চৈতন্য মহাপ্রভুর আদর্শে নদীয়ার বুক জুড়ে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের ব্রত নেন| ১৮২৯ সালেও প্রায় ২৫টা টোল বিদ্যালয়ে ন্যায়-দর্শন, বেদাঙ্গ ও ব্যাকরণ পড়ানো হত| প্রত্যেক টোলে গড়ে প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থীর ব্যবস্থা ছিল| মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভার কবি ভারতচন্দ্র রায় লিখে ফেলেন তাঁর সৃষ্টি অন্নদামঙ্গল কাব্য; সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং রাজার পূর্বসূরী ভবানন্দ মজুমদারের কথোপকথন। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের পার্থক্য সত্ত্বেও ধৰ্মসম্বন্ধীয় বিষয়ে অন্যের উপর মত না চাপিয়ে দেওয়া ছিল এই অধ্যায়ের মূল বিষয়। পরবর্তী কালে মঙ্গল কাব্যের বদলে ছোট কাব্যতেই বাঙালি ব্যবসায়ী শ্রেণী উৎসাহ দেন। ব্রিটিশ শাসনের সময় যে বাংলা প্রমিত হয়ে আসে, তাতে এই সব সাহিত্যের অবদান অনস্বীকার্য।

এই যদি ইসলামী শাসনে স্বাধীন বাংলার ইতিহাস হয়, তাহলে তার ভবিষ্যৎ কি? এখনো অনেক বাঙালি আছে যাদের জন্য দুই বঙ্গের এক হওয়া নস্টালজিয়া আর রোমান্টিসিজমে ঠাসা একটা চমৎকার স্বপ্ন। নবাবী ইতিহাস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই স্বপ্নের কতটা বাস্তব, আর কতটাই বা দিবাস্বপ্ন।

তথ্যসূত্র: ইতিহাস ঘটনার পর্যায়ক্ৰম এবং সেলিম, Wheeler ও টুয়ার্ট সাহেবের মন্তব্য-বিশেষ ডঃ মীনাক্ষী জৈনের লেখা Political Culture in Mughal Successor and Muslim Conquest States : Bengal, Parallel Pathways : Essays on Hindu-Muslim Relations (1707 -1857 ), Konark Pubishers Pvt. Ltd. পৃষ্ঠা ৫২-৬৩ থেকে নেওয়া।

 

ফীচার: Wikipedia  থোকে সংগৃহীত,  প্রতীকী চিত্র