আজকে রাতের রাজা – ৬

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

ছক্কা

বাগুইহাটিতে প্রাসাদ বানিয়েছে শুনেছিলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে জানা গেল, মৃন্ময় দে-সরকার সল্টলেকে শিফট করে গেছে। খোঁজ করার জন্য আমি অবশ্য গাড়ি থেকে নামিনি, নেমেছিল আলবার্তো। যে গাড়িটা আমাদের ফলো করছে সেটার থেকে নেমে ইমরানও সঙ্গী হয়েছিল ওর। ওরা যে অত তাড়াতাড়ি ইনফরমেশন নিয়ে ফিরে এল, মনে-মনে তার একটা কারণ আবিষ্কার করলাম আমি। সেটা এই যে, পুলিশকে লোকে ইচ্ছে করে মিসলিড করে অনেক সময়, কিন্তু চোর- ডাকাতও মিলিটারিকে হেল্প করে একটু গৌরব অনুভব করতে চায়। আলবার্তোকে কথাটা বলতে ও’ও একমত হল আমার সঙ্গে। দিলখুশ হয়ে গেল আমার। সুপ্রিম কমান্ডার হওয়ার সঙ্গে- সঙ্গেই আমি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ব্যাপারগুলো কী সুন্দর বুঝতে পারছি!
কিন্তু মৃন্ময় যে ওরকম সাদামাটা একটা বাড়িতে থাকে, আমি আন্দাজ করতে পারিনি । রাজাপুরকে ‘নিউ সিটি’ বানাবার চক্করে লোকটা তো কোটি-কোটি টাকা কামিয়েছে। জলজ্যান্ত এই সত্যের কথা রাজাপুরের যে-কোনও বাসিন্দা হলফ করে বলতে পারবে কারণ পরেরদিকে ওর চামচাদের অনেকেই সামন্ত প্রভু হয়ে নিজের-নিজের মতো করে টাকা কামানো শুরু করলে, মৃন্ময় ক্ষেপে গিয়ে নিজের টাকা নিজেই বুঝে নিতে শুরু করে।এয়ারপোর্টের কাছ থেকে যখন নতুন মহল্লায় চলে এলাম তখন আবার রাজাপুরের সমস্ত কথা কানে আসতে লাগল। ওই আদতে ছোট বস্তিটা বড় হল তো রাজাপুর থেকে তাড়া খাওয়া মানুষকে ঠাঁই দিতে-দিতে। সেই তাড়া খাওয়া মানুষদের একজন আজ হিসেব বুঝে নিতে এসেছে। আর সে একা আসেনি, ভারতের আর্মিকে পিছনে নিয়ে এসেছে। এবার?
কলিংবেল দু’বার টেপার পর, যে লোকটা দরজা ফাঁক করে মুখটা বাড়াল শুধু, সে নির্ঘাত কেয়ারটেকার জাতীয় কেউ। ইউনিফর্ম পরা ইমরান আর আলবার্তোর হাতের ইনস্যাস রাইফেল দেখেই কোনও প্রশ্ন না করে মুহূর্তের মধ্যে চাবি এনে গ্রিলের দরজা খুলে দিল লোকটা।আমার ইশারায় লোকটাকে বাইরেই আটকে রাখল ইমরানরা আর,মৃন্ময় কোন ঘরে জিজ্ঞেস না করেই ভিতরে ঢুকে গেলাম আমি। আরশোলাকে খুঁজে বের করে মারব, তাতেই তো আনন্দ। আলবার্তো যখন ঠিকানার খোঁজে রাস্তায় তখন অমরদীপের থেকে একটা পিস্তল চেয়েছিলাম। অমরদীপ বিনা বাক্যব্যয়ে পিস্তল তুলে দিল আমার হাতে। আর আলবার্তো গাড়িতে ফিরে আসার পরও যখন ব্যাপারটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করল না , আমি শিওর হয়ে গেলাম যে এরা এখন নির্বিচারে আমার হুকুম তামিল করবে। ক্ষমতাই মানুষকে সাহস দেয় আর সেই সাহস থেকেই আমি দুজন কমান্ডোকে একতলায় দাঁড় করিয়ে রেখে একা উঠে গেলাম দোতলায়। প্রথম ঘরটায় ঢুকে দেখলাম, ফাঁকা। শুধু দেওয়ালে এক অতি সুন্দরী ভদ্রমহিলার ছবি। এটা কে? মৃন্ময়ের রক্ষিতা ? গোটা বাড়িটায় সাড়াশব্দ নেই কেন? মৃন্ময় শুয়ে আছে ওই মহিলার সঙ্গে?
মাথায় কথাটা আসতেই আমি ঘরটা থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাশের ঘরের ভেজানো দরজায় লাথি মারলাম। আর দরজাটা খুলে যেতেই ইজিচেয়ারে যে লোকটাকে আধশোয়া হয়ে থাকতে দেখলাম, তার চেহারাটা আগের তুলনায় খারাপ হয়ে গেলেও, আমার চিনতে অসুবিধে হল না।
— আমায় চিনতে পারছিস?
মৃন্ময় কোনও উত্তর না দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
— না চেনারই কথা যেহেতু অনেক দিন আগে তুই দেখেছিস আমায়। তখন বাচ্চা ছিলাম আমি। কিন্তু সেই বাচ্চাটা তোর আসল চেহারাটা চিনতে পেরেছিল।
মৃন্ময় ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে রইল তবু।
আমি এবার এগিয়ে গিয়ে ঠাটিয়ে একটা চড় মারলাম ওর গালে। আর বাঁহাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরে ডানহাতের পিস্তলটা ওর মুখে ভরে দিয়ে বললাম, এবার মনে পড়ছে? সেই উঁচু ঢিবি, সেই আমার কাকুর মুখে পিস্তল ভরে দেওয়া ?
মৃন্ময়ের চোখে-মুখে কোনও চেঞ্জ দেখলাম না। একটু অধৈর্য হয়ে পিস্তলটা ওর মুখ থেকে বের করে আনলাম আমি। থুতু- লালায় মাখামাখি হয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছে যন্ত্রটার। আচ্ছা, পিস্তল কি ধোয়া যায়? নাকি ধুলে পরে মিইয়ে যাবে বুলেটগুলো? একটু জেনে নিতে হবে, আগে এই রাক্ষসটাকে সালটে নিই। কিন্তু আশ্চর্য ট্রেনিং শালার। নইলে এই অবস্থায় একদম চুপ করে থাকার নার্ভ থাকে কারও? আমি ওর ইজিচেয়ারের পিছনের জানলার কাপড়ে পিস্তলটা আলগা করে মুছে নিয়ে বললাম, আমি চাই মরার আগে তুই স্বীকার করে যা যে তুই নিজের হাতে কিম্বা লোক লাগিয়ে কাকুকে খুন করেছিস। তবে তার জন্য খুব বেশি সময় দিতে পারব না।
মৃন্ময় স্ট্যাচুর মতো বসে রইল।
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল আমার। আমি আবার পিস্তলটা ওর মুখে ভরে দিয়ে আনাড়ি হাতে ট্রিগার টানতে যাব, পিছনে বাসন ভাঙার প্রবল শব্দ হল। চকিতে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম, চোখেমুখে ভূত-দেখার আতঙ্ক নিয়ে এক মাঝবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে।
—কী চাই? আমি পিস্তলটা মৃন্ময়ের মুখ থেকে বের করে নিলাম আবার।
—আমি, আমি…
— আপনি কাজ করেন এই বাড়িতে?
ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে, হ্যাঁ বললেন।
ঘরের মেঝেয় ঝোল গড়াচ্ছিল ওই ভেঙে যাওয়া চিনেমাটির বাসন থেকে। আর একপাশে ডাঁই হয়ে ছিল, মণ্ড হয়ে যাওয়া নুডলসের মতো কিছু। খুব হাসি পেল আমার। চিন ভারত আক্রমণ করেছে জেনেও আজ চাইনিজ খাচ্ছে মৃন্ময়? নাকি, দেশের এত বড় শত্রু যে সেলিব্রেট করছে চাইনিজ খেয়ে? হাসি চেপেই বললাম, মানুষের মাংস কি আর সহ্য হয় না তোর?
—উনি তো কথা বলতে পারেন না। ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলা বললেন।
—কেন? মৌনব্রত নিয়েছে?
—সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছিল, তারপর থেকে। প্যারালাইসিস হয়ে গেছে তো ওনার।
পিস্তলটা যেন আমার দিকে ঘুরিয়ে ট্রিগার টেনে দিল কেউ। একটু থম মেরে বললাম, কবে হল এইসব?
—ওই ছোট দাদাবাবু চলে গেল, তার কিছুদিন পরেই।
—ছোট দাদাবাবু?
—ওনার ছেলে। মদ খেয়ে খুব ইস্পিডে বাইক চালাচ্ছিল, বাইপাসে। হেলমেটও দেয়নি মাথায়। একটা লরির সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল। প্রথমে তো খোঁজই পাওয়া যায়নি। তারপর রাস্তার ধারের একটা ঝিলে লাশ ভেসে ওঠে।
আবার একটা বুলেট এসে লাগল আমার গায়ে। কিন্তু কেন? আমার তো খুশি হবার কথা। অথচ খুশি-খুশি লাগছে না তো! আমি মৃন্ময়ের সামনে থেকে একটু সরে এসে জানতে চাইলাম, ওই ভদ্রমহিলা কে? যার ছবি পাশের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো?
—বাগুইহাটির বাড়িটায় বউদি আর ছোট দাদাবাবু থাকত আর এই বাড়িটায় উনি থাকতেন ওই ডাইনিকে সঙ্গে নিয়ে। ভদ্রমহিলা মুখ খুললেন।
ওই সুন্দরী তাহলে মৃন্ময়ের রক্ষিতা! ঠিকই ধরেছি। কিন্তু এখন কোথায়? সেটা জিজ্ঞেস না করে বললাম, ডাইনি বলছেন কেন?
— বলব না? ওই আঠারো বছরের ছেলেটার মৃত্যুসংবাদ যেদিন এল, আর ছেলেটার মা শোক সহ্য করতে না পেরে তিরিশটা না চল্লিশটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে ভরতি হল, তার পরদিনই এই বাড়িতে মদের পার্টি বসিয়েছিল ওই ডাইনি। আমি বারণ করতে গিয়েছিলাম তো আমায় বলল, ‘কাজের লোক, কাজের লোকের মতো থাকবে। যার গেছে তার গেছে, তাতে আমার কী’? ভাবুন একবার, তোর পেটের না হোক, যার সঙ্গে তুই থাকিস, তার ছেলে তো? আসলে লোভ ছিল, ওই বাগুইহাটির বাড়িটার ওপর। বউদি মরতেই…
—ওই ঘুমের ওষুধ খেয়েই?
— না, সেবার হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছিল। তবে একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে একটা মরার নেশা পেয়ে বসেছিল বউদিকে। গলায় দড়ি দিল,দু’মাসের মধ্যে। আর তারপরই দাদাবাবু ওই বাড়ি ওর নামে লেখাপড়া করে দিলেন। সেখানেই থাকে এখন।নতুন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ।
—এই বাড়িতে আসে না?
— সেরিব্রাল হওয়ার পর হাসপাতালেই যায়নি দু’দিনের বেশি তিনদিন, আর এখন সেবা করতে আসবে? তবে উনি মরলে পরে দখল নিতে আসবে ঠিক। আচ্ছা, আপনাকে কি ওই মহিলাই পাঠিয়েছে, একে মেরে ফেলতে? কথাটা বলে ফেলেই মুখে-চোখে ভয় বাসা বাধল ভদ্রমহিলার।
— আজ্ঞে না। আমি একজন ডাক্তার। আমাকে সরকার থেকে পাঠিয়েছে, আপনার দাদাবাবুর চিকিৎসার জন্য। আমি ওই পিস্তল দিয়ে ওনার শক-থেরাপি করছিলাম। মানে, ভয় পেয়ে অনেক সময় মানুষের জ্ঞান ফিরে আসে তো, সেই চেষ্টা করছিলাম। প্রায় একনিশ্বাসে বললাম।
— তাহলে ওই যন্তরটা দিয়েই চেষ্টা করুন। আমি যাই, আবার বানিয়ে নিয়ে আসি। নুন নেই, চিনি নেই, পাঁক একেবারে। যে ডাক্তারবাবু সপ্তাহে একবার করে দেখে যান, তিনি এটাই দিতে বলেছেন। ভালোমন্দ দিয়ে কী লাভ ? গলা না হলে তো খেতেও পারে না ছাই! ভদ্রমহিলা আমার কথা বিশ্বাস করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
উনি বেরিয়ে যেতেই আমার কেমন ভয় করতে লাগল। মনে হতে থাকল, মৃন্ময় দে-সরকার আমায় বলছে, টাইট দিতে এসে, কেমন টাইট খেয়ে গেলি? আমি কাছে গিয়ে ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লাম। হাত রাখলাম, নাকের নিচে। এই তো নিশ্বাস পড়ছে। চোখেও তো একটা দুষ্টুমি দেখতে পাচ্ছি, সেই পুরোনো দিনের মতো। এখনই যদি একটা মাইক এনে ধরি মুখের সামনে তাহলে আবার গমগমে গলায়, ‘বন্ধুগণ, ভাইসব’ বলতে শুরু করবে না, কে বলতে পারে? একসময় বোন খুব বলত, ‘ শত্রু বেঁচে না থাকলে শত্রুতা করব কী করে?’ । ঠিকই বলত। মানুষ তো জীবনের কাছ থেকেই জীবনের প্রতিশোধ নিতে আসে; মৃত্যুর ওপর কি কোনও প্রতিশোধ নেওয়া যায়? আমি আরও একটু ঝুঁকলাম। তারপর নিজের অজান্তে বলে ফেললাম, আমাকে চিনতে পারছ না মৃন্ময়কাকু?
কথাটা বলে ফেলার পর আর ওই ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। একছুটে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে এলাম আর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কমান্ডো দু’জনকে ইশারা করলাম, আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে। গাড়িতে উঠতে গিয়ে খেয়াল হল, থুতু-লালা মাখা পিস্তলটা আমি ওই ঘরে ফেলে এসেছি। মৃন্ময় দে-সরকারের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ার আগে ওর বিছানায় রেখেছিলাম। বেরোবার সময় নিতে ভুলে গেছি। একবার ভাবলাম, আবার ওপরে উঠে নিয়ে আসি। তারপর মনে হল, ইজিচেয়ারে আধশোয়া লোকটা এখন হয়তো ওই পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে আছে আর তাকিয়ে থাকতে থাকতে পুরোনো স্মৃতি ঝলসে উঠছে ওর মাথায়। সেই স্মৃতি ওকে পুরোনো জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না আর কখনই কারণ ওর জীবনটাই যে আর নেই। বউ নেই, ছেলে নেই, ক্ষমতা নেই। তবু যতদিন ওর বুকের ধুকপুকুনি আছে ততদিন ওর মুখোমুখি ওই পিস্তলটা থাকুক। সেটাই ওর পুরস্কার, ওর শাস্তি।
—আমরা কি স্টার্ট নেব ? ইমরান জিজ্ঞেস করল।
এই হচ্ছে কমান্ডোদের গুণ। একটা বাড়তি কথা বলে না। আমি পালটা বললাম, আলবার্তো কোথায়?
—ডিউটি শিফট হয়েছে। এবার আমি বসব আপনার পাশে।
— আই সি। আচ্ছা ইমরান, আমার হয়তো আবার একটা পিস্তল লাগবে।
ইমরান বলল, ওকে। কখন দিতে হবে বলবেন। ওর চোখ দেখে বোঝা গেল না কী ভাবছে।
অমরদীপ জিজ্ঞেস করল, কোথায় যেতে হবে?
উত্তর দেবার আগের মুহূর্তে গাড়ির কাচের ভিতর দিয়ে অন্তরাকে দেখলাম। মুখে সামান্য বয়সের ছাপ পড়লেও ওটা অন্তরাই। এখানে কী করছে অন্তরা?

এখন বলতে লজ্জা করে কিন্তু সত্যি এটাই যে একটা বছর লেগে থাকতে পারলে আমার এমএসসিটা হয়ে যেত। রামখিলাওন ওরফে রঞ্জন বোসের মতো তেত্রিশ বছর ডিফেন্সে চাকরির মতো গৌরবময় হোক না হোক, ব্যাপারটা ফেলনা হত না একেবারে। হত না কিন্তু হয়েছে। আমার জীবনের প্রায় সবকিছুর মতো। আর এক্ষেত্রে অন্তরার দায় অনেকখানি। আশ্চর্য এই যে, ঘণ্টাখানেক আগে যখন, প্রতিশোধ নেবার কথা চলকে উঠল মাথায়, অন্তরার নামটাও মনে পড়েনি। আসলে ফার্নেসের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসা গলন্ত ইস্পাতের সঙ্গে যেমন খনি থেকে তুলে আনা লোহার মিল পাওয়া যায় না, আমার সঙ্গে আমার কোনও মিল খুঁজে পাই না আমি আর। তাই ঘুগনির ক্যানেস্তারা হাতে ছুটে যাওয়া লোকটার চোদ্দবার করে মনে পড়ে যে সাট্টার ঠেকে যেতে হবে কিন্তু লাইব্রেরির সেই ফেরত না দেওয়া বইটার কথা?
মা’র গঞ্জনা, বাবার উদাসীনতা, বোনের ক্ষোভ সবকিছু থেকে মুক্তির জন্য ওই বইটাকে অবলম্বন ঠাওরে ছিলাম আমি, দু’নম্বর গেটের সেই বাড়িতে। পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল এক-একটা জায়গা। যেমন ওই যেখানে বলা হচ্ছে… “ বিজ্ঞানের সমস্ত জ্ঞান যদি ধ্বংস হয়ে যায় কোনও সর্বগ্রাসী প্লাবনে আর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বেঁচে থাকে একটাই মাত্র বাক্য, তাহলে কী হবে সেই উক্তি যার ভিতরে ধরে রাখা যাবে সবচেয়ে বেশি তথ্য? আমি বিশ্বাস করি যে সেটা হল সেই পারমাণবিক ধারণা বা পারমাণবিক সত্য যে সবকিছুই পরমাণু দিয়ে তৈরি। নিরবচ্ছিন্ন গতিতে ঘুরে বেড়ানো সেইসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণারা পরস্পরকে আকর্ষণ করছে যখন অল্প-অল্প দূরে থাকছে আবার প্রতিহত করছে যখন তাদের চটকে-মটকে একটাই দলা পাকিয়ে ফেলা হচ্ছে।”
কী কাণ্ড! মহাবিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যান’এর ‘ফেইনম্যান লেকচারস অন ফিজিক্স’এর এই কথাগুলো, আজ এতবছর পরেও একদম আগের মতোই মনে আছে আমার।নীল আর সবুজ দু’রকম কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করেছিলাম জায়গাটা আর প্রফেসরদের কাছে ঘুরে ঘুরে এক্স্যাক্ট বাংলা মানে কী হবে, জানতে চাইতাম। তন্দ্রা ম্যাম হেল্প করছিলেন বুঝতে, আরডি বলে উঠলেন, ‘ইংরেজি বোঝো না, এমএসসি পড়তে আসো কেন?’
অনেকের মাঝখানে কথাটা বলেছিলেন বলে এমন খারাপ লাগল যে দুম করে বলে দিলাম, ক্লাস সিক্সে এবিসিডি শেখানো শুরু হলে ইংরেজি কীভাবে বুঝব স্যার? ওয়ান থেকে শেখানোর ব্যবস্থা করুন।
কথাটা বিঁধল আরডি মানে রমানাথ দত্ত’কে। বহুবছর ধরে দোর্দণ্ডপ্রতাপ আরডি, যার মুখের কথাই ডিপার্টমেন্টের শেষ কথা , সে যেই থাকুক হেড অফ দা ডিপার্টমেন্টের চেয়ারে, তাকে মুখে-মুখে জবাব দিচ্ছে একজন ফ্রেশার, কথাটা ছড়িয়ে গেল ইউনিভারসিটিতে। গোপনে দু-একজন স্যার-ম্যামও পিঠ চাপড়ে দিলেন কিন্তু আরডি’র বিষনজরে পড়লে ক্ষতিটা যে ঠিক কী হয়, তা যদি বুঝতাম সেদিন, তাহলে হয়তো…
— আরডি’র কাছে প্রাইভেটে না পড়লে ফার্স্টক্লাস পাওয়ার জন্য মেঘনাদ সাহা হতে হবে। ক্যান্টিনে হামেশাই শুনতাম কথাটা।
আমাদের সংসার তখন এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। মা হাতের সামনে যা পাচ্ছে ভাঙছে, বাবা অশান্তি এড়াতে দমদম সেভেন ট্যাঙ্কসের কাছে কার একটা বাড়ির একতলা জুড়ে ‘ স্মৃতি পাঠাগার’এ বিনিপয়সার লাইব্রেরিয়ান বনেছে, বোন সারাদিন কাজ করছে চুপচাপ আর গজর-গজর করছে শুধু আমাকে কাছে পেলে; সংসার চলছে কলসির জল কাত করে, ওই রাজাপুরের সর্বস্ব বেচে পাওয়া টাকা ভেঙে- ভেঙে। আমি টিউশানি তখন থেকেই করতাম কিন্তু ইংরেজিতে কাঁচা বলে ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট পেতাম না আর বাংলা মিডিয়ামে টিউশানির যা রেট তাতে ওই আগ্নেয়গিরিতে একবালতি জলও ঢালা যেত না।
এরকমই একটা সময়ে আমি অন্তরার অস্তিত্ব বিষয়ে সচেতন হই। সচেতন হওয়ার অনেক কারণ ছিল, অন্তরা ডাকসাইটে সুন্দরী, টানা-টানা চোখ, ধারালো নাক, পাকা গমের মতো গায়ের রং , একঢাল চুল, মানে একেবারে দশে দশ।কিন্তু অচেতন থাকারও অনেক কারণ ছিল আমার তরফ থেকে। জীবন যখন আখ-মাড়াই কলে কাউকে নিংড়োয় তখন সারা বিশ্বের গ্লাস রসে ভরে উঠলেও, তার নিজের ভিতরে তো মিষ্টতা বলতে কিছুই থাকে না। আমার ভিতরটাও তেতো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একশোর ওপর ছেলে যাকে প্রোপোজ করেছে,রিজেক্ট হবার ভয়ে মনের ইচ্ছে মনে চেপে রেখেছে আরও কত, সেই অন্তরা আমার ওই তিক্ততাকে ভুল বুঝল। ওর মনে হল, আমি উদ্ধত। সেই মনে হওয়া থেকে নানান সময়ে নানা কথা আমাকে শোনাত অন্তরা। যেমন একদিন গেট থেকে বেরোবার মুখে বলল, ‘তোর ভিতর না সাইন্টিস্ট হবার সমস্ত গুণ রয়েছে’।
—মানে? রীতিমতো চমকে গেলাম আমি।
—তুই ঠিক সাইন্টিস্টদের মতো করে পর্যবেক্ষণ করিস। ধর, অনেকগুলো রং ভিতরে নিয়ে একটা চমৎকার ফুল ফুটেছে। সেই ফুলটাকে যে দেখবে সেই মুগ্ধ হবে। কিন্তু তুই অ্যানালিসিস করতে বসবি ফুলটার দিকে কোন কোন পতঙ্গ এগিয়ে আসছে। তারপর কনক্লুশন টানবি যে এই পতঙ্গগুলো নীল রংটা চেনে বলে ফুলটার দিকে এগোচ্ছে, অন্য একটা গ্রুপ খয়েরি রং পছন্দ করে বলে… এইরকম আর কী। এরকম অ্যানালিটিকাল মাথা যার সে সাইন্টিস্ট হলে অনেক দূরতক যাবে।
—বলছিস? আমি পুরো ব্যাপারটাকে কমপ্লিমেন্ট মনে করে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালাম অন্তরার দিকে।
অন্তরা কোনও উত্তর না দিয়ে ওর বাড়ির গাড়িতে উঠে গেল।
—কমপ্লিমেন্ট? এটাকে তোর কমপ্লিমেন্ট মনে হল? পায়ের ধুলো দে বাপ। সিগারেটের কাউন্টারটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল চয়ন।
—কমপ্লিমেন্টই তো!
— তোর মুণ্ডু। পাশে ওর গার্লফ্রেন্ড বসেছিল বলে শরীরের অন্য একটা জিনিসের নাম করতে গিয়ে থেমে গেল চয়ন। আমি বুঝলাম।
—কিন্তু কেন নয় সেটা তো বলবি?
— আরে পাগল, অন্তরা হার্ট হয়েছে তোর ব্যবহারে। যে নিজে সবাইকে ডায়রি বার করে দেখায় কবে কে তাকে প্রোপোজ করেছিল আর তারপর ‘না’ শুনে ফিরে গেছে, যাকে ক্লাসে দেখতে না পেলে আরডি পর্যন্ত দু’বার কেশে, তিনবার হেঁচে , ‘ইয়ে,অন্তরাকে দেখছি না’ বলে পজ দেয়, ক্লাসেরই একটা ছেলে তাকে নিয়ে একদম বদারড নয়, এটা ও সহ্য করে কী করে?
— তার মানে তুই বলতে চাস, দমদম এয়ারপোর্টে নেমে মাধুরী দীক্ষিত খুব হার্ট হয় যখন দেখে যে এয়ারলাইন্সের কুলিরা ওকে খেয়াল না করে যে যার মতো মাল তুলছে প্লেনে?
— ভালো দিয়েছিস।কিন্তু বস, একটা কথা বলছি, তোকে দেখলে না ঠিক কুলি বলে মনে হয় না। তোর চেহারায় একটা অ্যারোগ্যান্স আছে। আর যারা ক্ষমতায় থাকে তারা এই ব্যাপারটা একদম নিতে পারে না।
—অন্তরা ক্ষমতায় আছে নাকি?
—বাজে তর্ক করিস না তো। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকাটাও ক্ষমতা। যে অন্তরাকে আরডি চোখে হারায়, তার খাতা যেভাবে দেখা হবে তোর-আমারটাও সেভাবে হবে? সে ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টে যত পাবে, তুই-আমিও তত ? ভালো চাস, তো মিটিয়ে নে। চয়ন ওর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে সিনেমা দেখতে চলে গেল।
আমি তালগোল পাকিয়ে গেলাম পুরো। অন্তরার দিকে ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকি না মানেই কি অন্তরার সঙ্গে ঝামেলা আছে আমার? এ আবার কীরকম কথা? দু’তিনদিন পরে একদিন অন্তরাকেই জিজ্ঞেস করলাম ঘুরিয়ে।
অন্তরা এত জোরে হেসে উঠল যেন এমন মজার কথা ও জীবনে শোনেনি। আর তারপর গলাটা পালটে বলে উঠল, তোর মনে হয় না যে তুই আরডিকে অপমান করেছিস?
—কীভাবে?
—নাহয় স্যার,একটু রেগেই গিয়েছিলেন তোর ওপর। তাই বলে, তুই স্যারকে এড়িয়ে চলবি? এতে তো তোরই একটা বদনাম হচ্ছে যে তুই উদ্ধত…
আবার সেই শব্দ, ‘উদ্ধত’। সেদিন রাতে মা’ও কি এই শব্দটা বলতে চেয়েছিল আমায়? মনে করতে না পেরে বলে উঠেছিল, ‘নর্দমার পোকা’? উদ্ধত বলেই কি আমার সঙ্গে যারাই ক্ষমতায় আছে তাদের লাগে? দোষ কি আমার না ক্ষমতার অপব্যবহারের?
—ক্ষমতার কোনও অপব্যবহার হয় না, শুধু ব্যবহার হয়। যে মেয়েটা সুন্দরী সে যদি দশজনের সঙ্গে প্রেম না করে তো কে করবে? একটু মিসইউজ করার অধিকারই যদি না রইল তাহলে সেটা কীসের ক্ষমতা? অন্তরাই আমাকে বলল পরে একদিন।
তার মধ্যে আমি নিজের ‘উদ্ধত’ ইমেজ পালটানোর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, আরডি’র সামনে গিয়ে গলা খাদে নামিয়ে বলেছি, স্যার দু-একটা ব্যাপার বুঝতে একটু সমস্যা হচ্ছিল…
আরডি হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে আমার পিঠ চাপড়ে বলেছেন, তোমার মতো ব্রিলিয়ান্টের সমস্যার সমাধান আমি করতে পারব না। তার জন্য তোমাকে ফেইনম্যানের কাছে যেতে হবে।
মাথা নিচু করে করে ফিরে আসার সময় টের পেয়েছি, চোখের কোণে একফোঁটা জল। ওটাও কি ঔদ্ধত্য? ভাবতে ভাবতে বেসিনের সামনে গিয়ে জলের ঝাপটা দিয়েছি মুখে। আর সেই গল্প অন্তরাকে বলতে গিয়ে শুনেছি যে, ক্ষমতার চার্ম চলে যায় একটু মিসইউজ না হলে।
কথাটা যে অন্তরা অন্তর দিয়েই বলেছিল তা বুঝতে পেরেছিলাম, রায়চকে গিয়ে। অন্তরা আর ওর খুব ক্লোজ পাঁচ-ছ’জনের একটা দল রায়চক যাচ্ছিল। সেই দলের মধ্যে আমার নামটা জোর করে ঢুকিয়েছিল অন্তরা। ব্যাপরটাকে পিকনিক বা এক্সকারশন বলা যাবে না, কারণ ওরকম একটা লাক্সারি রিসর্টে থাকার ক্ষমতা, শুধু আমি কেন, ওই দলের কারোরই ছিল না। অন্তরা ছাড়া। তাই ওটা ছিল অন্তরা স্পন্সরড ট্রিপ।
সেই স্পন্সরড ট্রিপে গিয়ে আমি যেন নতুন শিং গজানো গোরু হয়ে উঠলাম। ওই অত নদী, অত আকাশ আর অত বড় একটা চাঁদ আমি কি আগে কখনও দেখেছি? মনে করতে পারলাম না। সেই কোন ছোটবেলায় বার দু-তিনেক পুরী আর একবার নর্থ ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়েছিলাম। উত্তর ভারতের কোন-কোন জায়গায় গিয়েছিলাম তা অবধি মন থেকে মুছে গিয়েছিল। হতে পারে শিমলা-কুলু-মানালি। কিম্বা নইনিতাল- দেহরাদুন। তাদের সবার থেকে সৌন্দর্যে এই নদী, এই চাঁদ এগিয়ে। কারণ এটা বর্তমান।
অনেক মদ খেয়ে এই কথাটাই নাকি চিৎকার করে বলেছিলাম আমি। প্রায় ভোররাতে আমার ঘরে এসে অন্তরা বলল।
কুকুরের পেটে ঘি যেমন সহ্য হয় না একসঙ্গে অত মদ আর মাংস সহ্য হয়নি আমার। মাঝরাতে গা-গোলানি আর পেট ব্যথা নিয়ে জেগে উঠে বার দুই বাথরুমে গিয়ে সবটাই বেসিনে ঢেলে দিয়ে এসেছিলাম। তারপর শরীরটা এমন দুর্বল লাগতে লাগল যে ঘুমোবার শক্তিটুকুও হারিয়ে কাত হয়ে পড়ে ছিলাম। ধাক্কা শুনেই দরজা খুলেছিলাম কারণ ভেবেছিলাম ওপারে যেই থাক তার কাছে ডায়ভল বা র‍্যান্ট্যাক গোছের কিছু ওষুধ থাকবে, যা সঙ্গে আনার কথা মনে হয়নি আমার। কিন্তু ওই সেমি-ট্রান্সপারেন্ট স্লিভলেস নাইটি পরা অন্তরাকে দেখে আমি ওষুধের কথা ভুলে গেলাম। অসুখ যদি এত সুন্দর হয় ওষুধে কী দরকার?
ঘরে ঢুকে অন্তরা আমার বিছানায় বসল। তারপর শুয়ে পড়ল দুম করে। আমি বসেই ছিলাম, আমার হাতটা ধরে একটা টান দিল। কিন্তু তাতে যখন আমি হুমড়ি খেয়ে ওর ওপর পড়লাম না তখন উঠে বসল আবার। আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমায় কেমন লাগে?
–সুন্দর। আই মিন, অপূর্ব।
— প্রথমটা সত্যি। কিন্তু দ্বিতীয়টা নয়। কারণ আমার মুখের মধ্যে একটা খুঁত আছে।
আমি ভালো করে তাকালাম, অন্তরার দিকে। কোনও খুঁত নজরে এল না। উলটে জানলার ফাঁক গলে ভিতরে আসা জ্যোৎস্নায় আরও সুন্দরী লাগল ওকে। অনেকটা মাইকেল এঞ্জেলোর মূর্তিগুলোর মতো। সুন্দরী। সেক্সি নয়।
—তুই নেশা করে আছিস বলে ধরতে পারছিস না। কিন্তু সত্যি করে একটা খুঁত আছে। আমার ঠোঁট-দুটো পাতলা।
—সেটা কি খুঁত নাকি?
—অবশ্যই। মেয়েদের ঠোঁট হবে তালশাঁসের কোয়ার মতো। টইটম্বুর। নইলে অ্যাপিলিং লাগবে কেন?
— কিন্তু…
—কোনও কিন্তু নেই । এটাই ফ্যাক্ট। তবে এই ফ্যাক্টটা মেনে নিতে মন চায় না বলে আমি এই খুঁতটা সারিয়ে তোলার একটা ব্যবস্থা করেছি।
—কসমেটিক সার্জারি?
—না। ন্যাচারাল। আমাকে যখন কেউ খুব যত্ন করে চুমু খায় তখন আমার ঠোঁট-দুটো ভারী হয়ে আসে। আরও ডিসায়ারেবল লাগে আমাকে।
‘ডিসায়ারেবল’ শব্দটা আমার কানে লাগল, ওই অবস্থাতেও। যে বিউটিফুল তারও তবে মুক্তি নেই? হয়তো বমির সঙ্গে মাল-মশলা সব বেরিয়ে গেছে বলেই আমি একটু ফিলোসফিকাল টোনে জানতে চাইলাম, পুরুষের আকাঙ্খার বস্তু হতেই হবে অপ্সরাকে?
অন্তরা একটা পাখির ডানার মতো ওর হাসিটা ঠোঁটের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, অফ কোর্স। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী হিরেটাকেও তো কাচ দিয়ে কাটতে হয়, তাই না?
এবার আর কিছু বলতে পারলাম না। অন্তরা সে সুযোগও দিল না । দুটো মোমের মতো হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে নিজেই খুব যত্ন করে চুমু খেল আমায়। ওপরের ঠোঁট দিয়ে আমার নীচের ঠোঁট , তারপর নীচেরটা দিয়ে ওপরেরটা।
খুব শান্তি পেলাম আমি। কোথাও এতটুকু উত্তেজিত না হবার শান্তি। মনে হচ্ছিল একটা পরী যেন নেমে এসেছে আকাশ থেকে। আর সে আমার ভিতর থেকে আমার সমস্ত অ্যারোগ্যান্স, সব যন্ত্রনা, আজীবনের জ্বালা শুষে নিচ্ছে। আমি আবার একদম ভেজা ন্যাতা দিয়ে স্লেট মুছে নতুন করে শুরু করতে পারব। আমাকে ভয় দেখানোর, আমার বোনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কেউ থাকবে না।
ততদিনে আমার সঙ্গে শিপ্রার আলাপ-পরিচয় সবই হয়েছে। ফরম্যালি সম্পর্ক শুরু হয় নি কিন্তু কোথাও একটা আমি ফিল করছিলাম যে শিপ্রার মতো কাউকে পাশে পেলে বেঁচে থাকাটা একটু সহনীয় হয়। শিপ্রাও একটা কথা, একটু হাসি, একটা বাস মিস করে গিয়ে সিগনাল দিচ্ছিল আমায়। কোনও একটা মোড় থেকে আমরা একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করব আর সেটা বেশি দূরে নয়, এমন একটা সঙ্কেত দুজনেই পাচ্ছিলাম হয়তো। তবু ওই ভোররাতে, নদীর বাতাস আর চাঁদের আলো গায়ে মেখে অন্তরাকে আদর করতে একটুও পাপবোধ হচ্ছিল না আমার। কেমন যেন মনে হচ্ছিল,লাইফটাইম এ্যাওয়ার্ডের মতো এটাও একটা লাইফটাইম প্রাপ্তি। যা জীবন এমন বিনা-চাওয়ায় ক্বচিৎ- কখনও জীবনে মিশিয়ে দেয়।
—ভালো লাগল? অন্তরা জিজ্ঞেস করল।
আমি চুপ করে রইলাম।
—কতটা ভালো?
—মাপতে পারব না। সঙ্গে দাঁড়িপাল্লা আনিনি তো।
অন্তরা হেসে উঠল, আরডি’র সঙ্গে তোর সম্পর্ক আমি ঠিক করে দেব।
— চাইনি তো।
—তাহলে কী চাস?
কেমন একটা সামনে এগিয়ে চলা অন্ধ ইঞ্জিনের মতো আমি মুখটা বাড়িয়ে দিলাম অন্তরার মুখের দিকে।
—আবার?
—আর একবার।
অন্তরা নিজের মুখটাকে এগিয়ে আনল আমার দিকে। আমি দেখলাম, ফেইনম্যানের তত্ব উলটে দিয়ে একটা পরমাণু খেদিয়ে দিচ্ছে না আর একটা পরমাণুকে। শুধুই কাছে টানছে। শিপ্রার মুখটা একবার ভেসে উঠল মাথায়। আবার মিলিয়েও গেল। দোষ হয় না। পরীর চুমুতে কোনও দোষ হয় না। আমার মন বলল।
—তোর কাছে একটা ফেভার চাইব? অন্তরা বলল।

সেদিন সেই ফেভার অন্তরাকে করতে পারিনি। করা সম্ভব ছিল না। অন্তরা আমার প্রেমিকা না, কিন্তু তাই বলে সেই শেষরাতের রূপকথা একটা ভয়ংকর হরর সিনেমায় বদলে যাচ্ছে দেখে আমার কোনও প্রতিক্রিয়া হবে না?
—তুই বলেই চাইতে পারছি। কারণ তুই অন্যদের থেকে আলাদা। যখন দিস তখন সবটা দিস না আবার যখন নিস তখনও সবটা নিস না।
আমি ভাবছিলাম অন্তরাকে একদিন আমার বাড়ি নিয়ে যাব। আমার মাথা-খারাপ মা, সংসার-এড়ানো বাবা আর ওই কালকুঠুরিটা দেখলেই ও টের পাবে সবটা বলতে আমি ঠিক কতটা দিতে পারি। কিন্তু ওর কথার পরের অংশটা আমাকে অবাক করল। নিলাম তো, একটা স্বপ্নের থেকে যতখানি নেওয়া যায় ততটাই নিলাম। এর বেশি কী নেব? তাজমহল দেখতে এসে ছেনি- বাটালি দিয়ে গুঁতিয়ে ভেঙে একটা মার্বেলের টুকরো নিয়ে যাব?
—তোর ভিতরের এই রিস্ট্রেন ব্যাপারটা আমাকে টানে। খুব কম লোকের মধ্যে এটা থাকে। আমাদের বয়সীদের কথা বাদ দে, অনেক সিনিয়র লোকের মধ্যেই নেই। আরডি নিজেই একজন বড় এগজাম্পল।
অন্তরা আবার কেন আরডি’র কথা তুলছে বুঝতে পারলাম না। আমি তো বলেই দিয়েছি যে ওনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক জোড়া লাগাতে হবে না। যে সম্পর্ক তৈরিই হয়নি কখনও তার আবার জোড়া আর ভাঙা!
—কিছু বলছিস না যে?
—যা বলব, সেটাই হয়তো, স্যার আর তার প্রিয় ছাত্রীর, ঔদ্ধত্য বলে মনে হবে।
অন্তরা হেসে উঠল, ঔদ্ধত্য নয়, ওটা সাহস। আর তোর সাহসটা আমার দরকার। পারবি না আমার জন্য সেই হাতে তলোয়ার,মাথায় মুকুট পরা, ঘোড়ায় চড়া নাইট হতে? তারপর কোন আরডি তোর ফার্স্টক্লাস পাওয়া আটকায় আমি দেখে নেব। তোর চাকর হয়ে থাকবে আরডি, আমি কথা দিলাম।
—তোকে একটা রিকোয়েস্ট করব, এই মুহূর্তে ওই লোকটার কথা বারবার বলে আমাদের ভিতরের এই মোমেন্টটা নষ্ট করে দিস না।
অন্তরা আমার হাত-দুটো চেপে ধরে বলল, আই হ্যাভ টু। দ্যাট বাগার হ্যাজ মেড মি প্রেগন্যান্ট।
আমার মনে হল এবার আমার মুখেই কেউ পিস্তল ভরে দিয়েছে। কোনও কথা বলতে পারলাম না।
— তুই ভুল বুঝিস না আমাকে। তুই হয়তো জানিস না, আমার, সমবয়সীদের ঠিক ভালো লাগে না। মানে, ভালো লাগে বাট আই ডোন্ট গেট অ্যাট্রাকটেড। আমায় অ্যাট্রাক্ট করে একটু বয়স্ক লোকরা। তাই বলে যে-কোনও বুড়ো নয়, যাদের অনেক পয়সা তারাও নয়। আমি পাগল হয়ে যাই, সেইসব লোকের সংস্পর্শে যাদের প্রচুর জ্ঞান, অসম্ভব পাণ্ডিত্য। আর লোকটা যেরকমই হোক, আরডি’র ভিতরে যে এই দুটো জিনিস প্রবল পরিমাণে আছে, তোকে মানতেই হবে।
—কিন্তু, হি ইজ ম্যারিড।
— সো হোয়াট?
— ও তোর জন্য ডিভোর্স করবে নিজের বউকে?
— তুই কি পাগল? ওর ছেলে আমাদের বয়সী। মেয়ে আরও বড়। তার বিয়ে এই বছরের শেষে। এখন ও ডিভোর্স ফাইল করবে?
— কিন্তু না করলে পরে তোর…
— কী হবে আমার? আমি কি রাস্তায় পড়ে আছি? নাকি এটা গুপ্তযুগ? আই উইল ড্রপ দা বেবি।
চুপ করে গেলাম আবার। সমাজের অনেক উঁচু স্তর থেকে আসে অন্তরার মতো মেয়েরা। ওদের কাছে বিবাহিত লোকের সঙ্গে শুয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়াটা যেমন কঠিন নয়, অ্যাবরশন করানোটাও জল-ভাত। এটাই যদি আমার বোন বা শিপ্রা করে ফেলত, সুইসাইড করা ছাড়া পথ থাকত না কোনও। আবার বোনই বলছিল, আমাদের ঠিকে কাজের মেয়েটা যে টানা একসপ্তাহ কামাই করল তার আসল কারণ, ও বাচ্চা খালাস করাতে গিয়েছিল কোন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে। যার বাচ্চা পেটে ধরেছে সে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায়, খালাস। সোজা রাস্তা। সোসাইটির একদম ওপর আর একেবারে নীচের তলার লোকেরা স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারে। যত মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত গলি-ঘুঁজি খুঁজে মরছে।
— জানি তুই আমাকে খারাপ ভাবছিস। কিন্তু বিলিভ মি, আমি কোনও স্বার্থ থেকে লোকটার কাছে যাইনি। হ্যাঁ, এরপর আমি ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হলে তুই দুইয়ে দুইয়ে চার করবি। কিন্তু একটু ভেবে বল তো, ক্লাসে প্রথম দু-তিনজনের মধ্যে আমি কি এমনিও থাকব না? তাহলে? কীসের লোভে আমি ওর বেড-পার্টনার হলাম? শুধু, ওর নলেজটা যাতে আমার ভিতরে আসে, জাস্ট দ্যাট। হ্যাঁ, সেই সময়টা একটু প্রোটেকশন নেওয়া উচিত ছিল। তোর মতো কেউ হলে নিশ্চয়ই নিতাম। বুড়োর যে এত ক্ষমতা বুঝতে পারিনি, একদম। ভেবেছিলাম ছ্যাতলা পড়ে গেছে। কীসের কী? কেমন ফাঁসিয়ে দিল দ্যাখ।অন্তরা হেসে উঠল।
— আমাকে বলছিস কেন, এতসব? বিরক্ত লাগতে শুরু করল আমার।
— কারণ তোকেই তো নিয়ে যেতে হবে আমায় অ্যাবরশন করাতে।
— বাড়ির গাড়িতে যেতে পারবি না বলে ট্যাক্সি ধরে দিতে হবে?
— বাড়ির গাড়িতে গেলেও আমার ড্রাইভার তো ভিতরের ফর্মটায় সই করত না। ওই সইটা তোকে করতে হবে।
— মানে?
— পাঁঠার মতো প্রশ্ন করিস না তো। ইদানিং ওই কন্যাভ্রূণ হত্যা-টত্যা নিয়ে খুব কড়াকড়ি হচ্ছে তাই কোটি টাকা দিলেও কোনও ভালো নার্সিংহোম অ্যাবরশনের রিস্ক নেবে না যতক্ষণ না একটা ছেলে বন্ডে সাইন করছে। ওই সাইনটা করে তুই বেরিয়ে যাবি। ব্যস, ওটুকুই তোর দায়িত্ব।
— এই দায়িত্ব আমি নিতে যাব কেন? আরডি তোর পেট বাধিয়েছে, আরডি’কে বল বন্ডে সাইন করতে।
— আরডির পজিশনের একটা লোকের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। বাই-চান্স জানাজানি হয়ে গেলে আমাদের দুজনেরই সর্বনাশ হয়ে যাবে।
— আমি সই করছি, সেটাও তো জানাজানি হতে পারে।
— ডাজন্ট ম্যাটার। কেউ বিশ্বাস করবে না।
—কেন?
—কারণ তুই ফুটপাথের শার্ট গায়ে দিস, তোর কথাবার্তা চাষাদের মতো, তুই গ্রাম থেকে এসেছিস…
— আমি ভোররাতে একটা মেয়ে আমায় সিডিউস করতে ঘরে ঢুকলেও তাকে বিছানায় পেড়ে ফেলে ফাঁসিয়ে দিই না।
ভীষণ চটে গিয়েছিল অন্তরা কিন্তু আমার উত্তরটা শুনে পলকে ঠান্ডা হয়ে গিয়ে বলল, আমি তো একটা ফেভারই চাইছি তোর কাছে। আর এমনি চাইছি না।
— জানি ওই একটা সইয়ের বদলে অনেক পরিবর্তন ঘটে যাবে, আমার মার্কশিটে আর জীবনেও। কিন্তু আমি পারব না রে।
—কেন?
—গ্রাম থেকে আসা চাষা তো আমি। টিপছাপ দিয়ে কাজ চালাই। সই করতে জানি না।
— ঠিক আছে। করতে হবে না । কিন্তু সারাজীবন তোকে ওই টিপছাপের জোরেই চলতে হবে, এটাও বলে দিলাম। তুই এমএসসি ডিগ্রি পাবি না, তোকে আজ এই ঘরে দাঁড়িয়ে বলে গেলাম। পার্ট ওয়ান আসছে, ভালো করে পরীক্ষা দে। বাট আই অ্যাসিওর ইউ, তোর একটা পেপারেও পাসমার্কস থাকবে না।ঘর থেকে বেরোনোর সময় কথাগুলো বলে গেল অন্তরা।
কথাগুলোর চাইতেও বেশি করে ওর ওই জ্বলন্ত দৃষ্টিটা ভয় পাইয়ে দিল আমায়।

— তুই পরীক্ষাটা দিলি না কেন? আমি রাগের মাথায় কী একটা বলেছিলাম তার জন্য তুই পরীক্ষাই দিলি না? আমি সামনে গিয়ে ‘চিনতে পারছিস’ জিজ্ঞেস করার পর, দশ-সেকেন্ড চুপ করে থেকে, ঠিক এটাই বলল অন্তরা।
— দিতাম। মাথার মধ্যে থেকে তোর থ্রেট বের করে দিয়ে সাধ্যমতো প্রিপারেশনও নিয়েছিলাম। কিন্তু যেদিন অ্যাডমিট কার্ড আনতে গেলাম আর আমাকে শুনিয়ে তুই সবাইকে বলতে শুরু করলি, ‘ কে ফার্স্ট হবে বলতে পারব না কিন্তু কারা কারা ফেল করবে আমি লিখে দিতে পারি’, সেদিন নার্ভ ফেল করে গেল একদম। জ্বরে পড়ে গেলাম বাড়ি এসে। সবাই বলল, ড্রপ না করতে কিন্তু আমি তখন একটা ঘোরের মধ্যে একটাই কথা বলে যাচ্ছি, ‘আমি পাশ করতে পারব না’।
— আমি যে তোর কেরিয়ারটা শেষ করে দিলাম তার জন্য আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে না তোর?
একটু চমকে উঠলাম অন্তরার কথা শুনে। আমি তো আজ প্রতিশোধ নিতেই বেরিয়েছি। কিন্তু যে সর্বনাশই আমার করে থাক, একুশ-বাইশ বছরের সেই গ্রাম্য ছেলেটার জীবনে যে ‘চুম্বন’ শব্দটাকে অনুভবে বদলে দিয়েছিল তার ওপর কী প্রতিশোধ নেব?
— তোর জায়গায় আমি থাকলে, প্রতিশোধ নিতাম। অন্তরা বলল।
— কী করতি?
— জানি না। ওই ছেলেরা যেরকম মেয়েদের মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারে সেরকম কিছু করতাম হয়তো।
— শিউরে উঠে অন্তরার একটা হাত ধরলাম আমি।
— মারবি? অন্তরা জিজ্ঞেস করল।
— ঠাটিয়ে চড় মারতে ইচ্ছে করছে একটা। কিন্তু জীবনের প্রথম চুমু যে মেয়েটাকে খেয়েছি, তাকে যে চড়ও মারা যায় না।
অন্তরা কাঁদতে শুরু করল। আর এবার অস্বস্তিতে পড়লাম আমি। ওকে দেখে গাড়ি থেকে নামার সময় আমি ইমরানকে বলে দিয়েছিলাম যেন গাড়ি থেকে না নামে। আর পিছনের গাড়িতে যারা আছে তাদেরও বারণ করে দেয়। কিন্ত এই যে এখন অন্তরা কাঁদতে শুরু করেছে ওপেন রাস্তায়, গাড়ির ভিতর থেকে নজর রাখতে-রাখতে ওরা কী ভাবছে? সুপ্রিম কমান্ডার একটার বদলে দশটা রিভলভার চাইতে পারে কিন্তু সে একটা মেয়েকে কাঁদাচ্ছে, এটা ভালো দেখায় না।
— আমি কিচ্ছু মনে রাখিনি তুই বিশ্বাস কর।
—কিন্তু আমি যে ভুলতে পারি না ।
— দ্যাখ এরকম ঘটনা এক-আধটা ঘটেই। তার জন্য কী ইউনিভার্সিটিগুলো তুলে দিতে হবে নাকি তোর মতো লোক সেখানে পড়াবে না?
— আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়াই না।
— কলেজে আছিস এখনও? চিন্তা করিস না। ফার্স্টক্লাস ফার্স্টরা বেশিদিন কলেজে পড়ে থাকে না।
— আমি কলেজেও পড়াই না। অন্তরা ভেজা চোখে আমার দিকে তাকাল।
—তাহলে কি আইএএস হয়েছিস? কিন্তু আমি যে খবর পেয়েছিলাম তুই কোন একটা কলেজে পড়াচ্ছিস…
— নেট কোয়ালিফাই করেছিলাম, জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়েছিলাম, একটা কলেজে পড়াতেও ঢুকেছিলাম, ইন্টারভিউ দিয়ে। পাশাপাশি নতুন একটা ইউনিভার্সিটিতেও পড়াচ্ছিলাম গেস্ট লেকচারার হিসেবে। কিন্তু কোথাও টিকতে পারলাম না।
—কেন?
— আরডি সবার কাছে সব ফাঁস করে দিল। তুই না বলার পর আমি আরেকজনকে ধরে অ্যাবরশনটা করিয়েছিলাম। কিন্তু, কে জানে কেন, সেই রাতের পর থেকে আরডি’র সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারিনি আর। মন থেকে সায় পাইনি। আর সেটাই আরডি নিতে পারল না। ওর ইগোতে এমন লাগল যে লোক ডেকে আমার আর ওর রিলেশনের কথা বলতে লাগল।
— তাতে ওর প্রেস্টিজ কতটা বাঁচল?
—ওর প্রেস্টিজ আদৌ ছিল? সবাই তো জানত, লোকটা কতবড় মাগিবাজ, কী রেঞ্জের করাপ্ট। আর তাছাড়া ও ঘটনার অ্যাঙ্গেল পালটে দিয়েছিল। আরডি’র বক্তব্য ছিল যে আমি আরডিকে ব্যবহার করে প্রেগন্যান্ট হয়েছি আর তারপর ওকে ব্ল্যাকমেল করে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছি। আর সেই ব্ল্যাকমেলের কাছে নতিস্বীকার করে উনি আমাকে বেশি নম্বর পাইয়ে দিয়েছেন বলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, শিক্ষক সমাজের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
— এ তো নিজের নাক কেটে মাস্টারস্ট্রোক !
— ওর নাক-মুখ এমনিই কাটা হচ্ছিল,কারণ ওর জিভে ক্যানসার হয়েছিল। ও জানত যে ওর দিন ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু মরার আগে আমাকে মেরে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে ও মারতে পারেনি।
— আরডি মারা গেছে?
—হ্যাঁ। কিন্তু আমার অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি।পড়ানোর কথা ছেড়ে দে, আমি যদি কোনও কলেজের সেমিনারে একটা পেপার পড়তে যাই, লেকচারার-প্রফেসরদের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর প্রাইভেটে পড়াচ্ছিলাম কিছুদিন। একদিন নিজের স্টাডিতে ঢুকতে গিয়ে শুনলাম, একটা ছাত্র, একজন ছাত্রীকে বলছে, ‘ম্যাডামের কাছে পড়িস বলে ম্যাডামের মতো ফাঁসাস না’ আর ঘরে বসে থাকা বাকি পাঁচ-ছ’জন হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আমি দরজার সামনে থমকে গেলাম আর কানে এল সেই ছাত্রী উত্তর দিচ্ছে, ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মতো আমাদের অনার্সে একটা কোয়েশ্চেন আসতে পারে, প্রেগন্যান্সি আগে না ব্ল্যাকমেলিং?’
—ভিতরে ঢুকে চড় মারলি না সবকটাকে?
— না। ক্লাস নিলাম। আর তারপর বলে দিলাম, আর কোনওদিন যেন না আসে।
— ভালো করেছিস? পড়ানো ছাড়াও অনেক কাজ আছে পৃথিবীতে।
—কিন্তু আমি যে পড়াশোনা ছাড়া থাকতে পারি না রে। আমার সেক্স বল, ভালোবাসা বল, সবকিছুর কেন্দ্রে ওটা। আমার বরের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেল, তার কারণ শুধু আমার স্ক্যান্ডাল নয়। লোকটা একদম ইট-কাঠ-পাথরে ডুবে থাকা ইঞ্জিনিয়ার। আমি পারলাম না। আরডি আমার সঙ্গে সেক্স করার সময়, ‘ থার্টি ইয়ার্স দ্যাট শুক ফিজিক্স’ এর কথা বলত। নিলস বোর কীরকম রাত বারোটায় পাঁচিলের খাঁজে-খাঁজে পা রেখে একটা ব্যাঙ্কের দোতলা পর্যন্ত উঠে গিয়েছিলেন, সেই গল্প করত। আমি তাই… অন্তরা ডুকরে উঠল।
— এখানে কোথায় এসেছিলি? অন্য কথা খুঁজে পেলাম না আর।
— আমি এই উলটো ফুটের একটা ফ্ল্যাটেই থাকি। আর এখানে ওই যে হলুদ বাড়িটা দেখছিস, ওটার একতলায় পড়াতে আসি।
— আচ্ছা? ঢেঁকি তাহলে স্বর্গে গিয়েও ধান ভানছে।
—নরকে। অবশ্য না, এটা আমার স্বর্গই। এরা সব ডিফ অ্যান্ড ডাম্ব বাচ্চা জানিস? তাই আমি নিশ্চিন্তে ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক করি। জানি কেউ আওয়াজ দেবে না পিছন থেকে।
রাজার চোখে জল আসা উচিত নয় কিন্তু সেটা কতটা মনে রাখতে পারতাম জানি না, ওই ভদ্রমহিলার গলার আওয়াজ না পেলে।
—কী হল সবিতা? ওকে ছুটে আসতে দেখে অন্তরা এগিয়ে গেল দু’পা। আমিও।
—দিদি, তিয়াসা কীরকম ছটফট করছে। ওর টানটা ভীষণ বেড়ে গেছে। একবার আসবেন?
— ওর বাড়ির লোক নিতে আসেনি?
—না। আর মোবাইল চলছে না বলে ওর মা’কে জানাতেও পারছি না। ভয় করছে, ওর অবস্থা দেখে।
— চলো দেখছি। কথাটা বলেই অন্তরা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মেয়েটা খুব ইন্টেলিজেন্ট কিন্তু সিভিয়ার অ্যাজমা পেশেন্ট।
—কত বয়স?
—দশ-এগারো হবে। ইনহেলার ক্যারি করে, আজ কী হল বুঝতে পারছি না। তুই একবার, আসবি আমার সঙ্গে?
— তুই বললে যাব।
— প্লিজ আয়। আমি বলছি। ধরে নে একটা ফেভার চাইছি তোর কাছে। অন্তরা হাসল।