আজকে রাতের রাজা – ৩

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস

আর ওই সময়টুকুর মধ্যে ট্রেনে উঠে পড়তে হবে বলে হনহন করে পা চালাতে চালাতে দেখলাম, শিয়ালদা স্টেশনে প্যাসেঞ্জার নেই। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ আর যেদিকে তাকাচ্ছি ইউনিফর্ম পরা সৈন্য। সন্ধে ছ’টা বাজতে যায়। এইসময় যার জনসমুদ্র হয়ে থাকার কথা সেই শিয়ালদা স্টেশনে মানুষ নেই শুধু অজস্র সৈনিক, হলটা কী?

গত রবিবারের পরের অংশ…

দুগগি

হাতের ক্যানেস্তারা নিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে প্ল্যাটফর্ম যাচ্ছিলাম, কল্যাণী সীমান্ত’র খোঁজে। বেশ কিছুদিন হল, আমিও আমার ব্যবসা বাড়িয়েছি। হরিদা, এই লাইনেই, মেয়েদের কপালের টিপ, আলতা, সিঁদুর,চিরুনি-ফিরুনি বেচে। ওর ফেভারিট ডায়ালগ হল, ‘ শুধু টাটা-বিড়লা-আম্বানিরাই ব্যবসা বাড়াবে, আমরা বাড়াব না?’। হরিদার কথা শুনে সবাই হাসি কিন্তু মনে মনে জানি, ওই হাসিই সার। ব্যবসা কি ফুটবল খেলার পাস যে বাড়িয়ে দিলাম, আর কেউ এসে গোল করে গেল? অত সহজ নয়; পুঁজি লাগে, বিজ্ঞাপন লাগে, গুডুউইল লাগে। আমরা পাব কোথায়? আমাদের পুঁজি বলতে এই শরীরের উদয়াস্ত ছোটার ক্ষমতাটুকু, বিজ্ঞাপন বলতে নিজের গলা চিরে চিৎকার আর গুডুউইল বলতে, ব্যবহার করে সুফল পেয়েছে এমন কয়েকজন কাস্টমার। এই নিয়ে শিয়ালদা থেকে নৈহাটি হয়ে কল্যাণী সীমান্ত পর্যন্ত এগোনো যায়,ম্যাক্সিমাম। তার বেশি ট্রাই নিলে মুখে রক্ত তুলে রাস্তায় পড়ে থাকতে হবে।

কিন্তু আজ তো এক-পা কোথাও এগোতে পারছি না। একটা অ্যানাউন্সমেন্ট নেই মাইকে, ইতিউতি যে ট্রেনগুলো দাঁড়িয়ে আছে তাদের কারও নড়বার নাম-গন্ধ নেই। কোনও আপ আসছে না, কোনও ডাউন যাচ্ছে না। আরে বাবা কী হয়েছে, কেউ সেটা তো একবার বলবে?
—ঘুরঘুর করিস না, বিপদে পড়ে যাবি। পিছনে রামখিলাওনের গলার আওয়াজ শুনলাম।
চেনা কন্ঠস্বরে, ধড়ে যেন প্রাণ এল। একগাল হেসে বললাম, বাঁচালে।
—আমি ভিক্ষে করে খাই, আমাকে কে বাঁচায় তার নেই ঠিক, আমি তোকে বাঁচাতে যাব কোন দুঃখে?
—আমি তোমার বন্ধু, তাই।আমি ক্যানেস্তারা মাটিতে নামিয়ে রাখলাম।
— বন্ধু? হকার কোনওদিন ভিখিরির বন্ধু হয়? তোরা লোকের মাথায় টুপি পড়াস আর আমরা টুপি খুলে লোকের দেওয়া দান, গ্রহণ করি। আমাদের জাত আলাদা। যা যা কেটে পড়।

রামখিলাওন একদম পাতি বাঙালি। ওর চার পুরুষে কেউ কোনওদিন আসানসোল পেরিয়েছে কি না সন্দেহ। কিন্তু ওর নাম আজ বহুদিন ধরেই রামখিলাওন। কেন, সে বিষয়ে অনেক গল্প থাকলেও আসল কারণটা রামখিলাওন আমাকে বলেছে। ঘটনাটা এই যে একবার এক অতি বৃদ্ধা কোনও এক ‘রামখিলাওন’ নামের ভিখিরিকে একটা নতুন কম্বল উপহার দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অবশ্য একটা শর্ত ছিল। বৃদ্ধার কোনও বিশেষ মনোবাঞ্ছা যাতে পূর্ণ হয় তার জন্য রামখিলাওন প্রতিদিন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবে। এবং তার বিনিময়ে, মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলেই, রামখিলাওনের কপালে জুটবে একটি ব্র্যান্ড নিউ কম্বল। এত অবধি গল্প ঠিকই এগোচ্ছিল কিন্তু বাধ সাধল শীত। সে বছর এমনই জাঁকিয়ে শীত পড়ল যে শিয়ালদা স্টেশনের অনেক বুড়ো ভিখিরিই পরপারের টিকিট কাটল। রামখিলাওন তাদেরই একজন। এবার এইসব ভিখিরিকে নিয়ে যম এক্সপ্রেস গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, শীতও যাই-যাই করছে, বাতাসে বসন্তের হিল্লোল, এমন সময় সেই বৃদ্ধার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল। মনোবাঞ্ছা যে ঠিক কী ছিল তা বৃদ্ধা ছাড়া কেউই জানত না কিন্তু এই কম্বল-প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা রামখিলাওন দু-একজনকে বলেছিল। তার মধ্যে একজন আমাদের এই বর্তমান রামখিলাওন। সে ব্যাপারটা মাথায় রেখেছিল তাই যে মুহূর্তে তার কানে যায় যে কোনও এক থুত্থুড়ে বুড়ি ‘ রামখিলাওন কাঁহা গইল বা’ বলে স্টেশনের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যাচ্ছে সে বুড়ির সামনে হাজির হয়ে নিজেকে কম্বলের হকদার হিসেবে দাবি করে।

—বুড়ি চিনতে পারল না? সে তো আসল রামখিলাওনকে বহুবার দেখেছে, কথা বলেছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
—মোটামুটিভাবে নব্বই ক্রস করা লোকেদের ক্ষেত্রে এই রিস্কটা তুই নিতেই পারিস। এদের কাছে প্রত্যেকটা লোকই যেমন চেনা লোক, উলটোদিকে প্রত্যেকটা আলাপই নতুন আলাপ।আর আমাকে কম্বল যে দিয়েছিল তার বয়স,একশোর ওপরে ছিল, খুব সম্ভব।
—তা তুমি কম্বল নিয়ে নিলে?
—নিলাম কিন্তু ব্যাপারটা চুপচাপ ঘটল না। কম্বল বুড়ির হাত থেকে আমার হাতে চালান হবার আগেই আরও দু-তিনজন দাবিদার জুটে গিয়ে স্টেশনের একধারে বিশ্রী ঝামেলা পাকিয়ে তুলল। তুই ভাব, তিন-চারজন ভিখিরি নিজেদের ‘রামখিলাওন’ বলে ক্লেম করছে। হতছেদ্দার একশেষ, একদম। আমি তো কম্বল না নিয়েই কেটে পড়ব ভেবেছিলাম কিন্তু এক টিকিট-চেকার বাবু আমাকেই ‘রামখিলাওন’ বলে শনাক্ত করে দিয়ে যান ওই হট্টগোলের ভিতর ঢুকে। তার একটা অন্য কারণ ছিল অবশ্য। উনি একবার এক ভুয়ো টিকিটের যাত্রীকে একদম গেট পেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে ধরেছিলেন। হারামজাদা শুধু যে দিল্লি থেকে বিনা টিকিটে আসছিল তাই নয়, ধরা পড়ার পর অনেক হম্বিতম্বি করে যাও বা একটা পাঁচশো টাকার নোট বের করল, সেটা জাল। আমি ওই গেটের সামনেই ভিক্ষে করছিলাম তখন। চেকার-বাবু সরল বিশ্বাসে ঘুষের টাকাটা পকেটে ভরে নিচ্ছিলেন, আমি গিয়ে পর্দা ফাঁস করায় ব্যাটার কলার চেপে ধরলেন। সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই হয়তো…
—বাপরে বাপ! তা তুমি বুঝলে কী করে নোটটা জাল?
—ভিখিরির চেয়ে ভালো করে কেউ টাকা চেনে? কেউ না। তাই তো বলি, প্রত্যেকটা ব্যাঙ্কে একটা করে ভিখিরিকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া উচিত। হ্যাঁ, তার মিনিমাম পনেরো বছর কোনও বড় জায়গায় ভিক্ষে করার এক্সপিরিয়েন্স থাকতে হবে। তাহলেই দেখবি… ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ারের খাটনি কমে গেছে, ম্যানেজারের মুখে হাসি ফুটেছে আর দেশ জুড়ে জাল টাকার রমরমা বন্ধ হয়ে গেছে।
—যাই বলো, একটা কম্বলের জন্য সারাজীবন অন্য একটা নাম বয়ে নিয়ে চলা হেভি ঝক্কির ব্যাপার।
—কিচ্ছু ঝক্কি নেই। নিজেকে নিজে ওই নামটায় তিনবার ডেকে নিতে হয়। ভোরে ঘুম ভাঙার সঙ্গে-সঙ্গে।
— তুমি ডাকো?
—না। আমি বহুদিন ধরেই একটা অবাঙালি নাম চাইছিলাম, কারণ আর ইন্টারন্যাশনাল হয়ে বাঁচতে ভালো লাগছিল না।
—মানে?
—খুব সহজ এবং সরল। এই ভারতে সবাই যে যার পরিচয়ে বেঁচে আছে। যে তামিল সে বুক ফুলিয়ে তামিল, যে পাঞ্জাবি সে পাগড়ি বেঁধে পাঞ্জাবি, যে জাঠ সে কুস্তির আখড়ার মাটি-মাখা জাঠ, যে বিহারি সে ছাতুর গর্বে গর্বিত বিহারি। শুধু এরাই নয়। মারাঠি, গুজরাতি, উড়িয়া, অসমিয়া প্রত্যেকের একটা নিজস্ব আইডেন্টিটি আছে। কিন্তু বাঙালির নেই।
—কী বলছ, রবীন্দ্রনাথ?
—রবীন্দ্রনাথ জাতির সম্পদ হতে পারেন,কিন্তু জাতির পরিচয় তার মেরুদণ্ড। বাঙালি জাতির সেই মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
—এটা তোমার ধারণা।
—হতে পারে। কিন্তু ধারণাটা যে কত সত্যি কোনওদিন কোনও টুরিস্ট স্পটে গিয়ে চারপাশটা খেয়াল করলেই বুঝবি। দেখবি, পাঞ্জাবি টুরিস্ট, তড়কা-রুটির খোঁজে ধাবায় ঢুকেছে, তামিলরা ইডলি-দোসার খোঁজে সাউথ-ইন্ডিয়ান হোটেলে। ওদিকে গুজরাতি ধোকলা খাবে বলে দেশোয়ালি ভাইয়ার রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করে বসে পড়েছে, শুধু বাঙালি হোটেল-মালিক হাত দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে কারণ ভুলেও একটা বাঙালি টুরিস্ট মাছ-ভাত খেতে ঢোকেনি।
—মাছ-ভাত না খেলেই কি বাঙালিয়ানা জলাঞ্জলি যায়?
— না, তা হয়তো যায় না। তবু এই ঘটনা থেকে এটা প্রমাণ হয় যে ভারতের আর সব প্রদেশের মানুষ নিজের পরিচয় ঝেড়ে ফেলতে চায় না বাইরে গেলেই। যে মালয়ালি,সে কলকাতাতেও মালয়ালি কিন্তু বাঙালিই পৃথিবীর একমাত্র জাত যে নিজের পাড়ায় দাঁড়িয়েও ট্যাক্সি-ড্রাইভার থেকে ফুচকাওলার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলে।
— কিন্তু এর তো একটা ভালো দিকও আছে। সেই যে কী একটা কবিতা ছিল না, দূরকে নিকট বন্ধু ,পরকে আপন ভাই করার কথা বলা হয়েছে যেখানে। তোমার মনে আছে, লাইনগুলো?
—থাকলেও বলব না। আরে, দূরকে নিকট , পরকে আপন করতে হিম্মত লাগে। যারা নিজের ভাইয়ের সঙ্গে হাঁড়ি আলাদা না করতে পারলে শান্তিতে ঘুমোতে পারে না, তারা যাবে অন্যকে ভাই বলে জড়িয়ে ধরতে। যে নিজের মা’কে খেতে দেয় না সে মাদার টেরেসাকে মা বলে ডেকে গগন ফাটিয়ে দিলেও কেউ বিশ্বাস করবে? এসব হচ্ছে ছল। ওই তোর ইউরোপিয়ান শাসক আর ইউরোপিয়ান ইডিওলজি এই দুইয়ে মিলে বাঙালিকে শুধু ছল করতে শিখিয়েছে। এটা শেখায়নি যে কথাটা, ‘ছলে-বলে’। ব্রিটিশ কিম্বা জার্মানদের শক্তি ছিল। তাই তাদের প্যাঁচ-পয়জার কাজে লেগেছে। যে ডিসপেপসিয়া আর আমাশায় ভুগছে বছরে আট-মাস, যার বল বলে কিছু নেই সে ছল করেই বা করবে কী?
— এত যে লেকচার ঝাড়ছ, ছাতু হজম হচ্ছে তো?
— জরুর হচ্ছে। মাথা থেকে ইডিওলজির ভূত নেমে গেছে আর নামতেই দেখছি পায়ের শিকলও খুলে গেছে। এখন হাঁটছি, ছুটছি; ভুট্টা থেকে ছোলা হজম করে দিচ্ছি সব।
তো এহেন রামখিলাওন আজ কেন আমাকে কেটে পড়তে বলছে, আমার ক্লিয়ার হল না। ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝার জন্য আমি ওর পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম আর রামখিলাওন আরও জোরে হেঁটে আমার থেকে দূরত্ব বাড়াতে লাগল।
—বলি, ছাতু খেয়ে শরীরে খুব জোর হয়েছে সে তো বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার থেকে পালাচ্ছ কেন? আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।
—তুই কি পুলিশ যে তোর থেকে পালাব? রামখিলাওন বাঁক ঘোরার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল, আমার চিৎকার শুনে।
—পুলিশ হলেই বা কী বাজেয়াপ্ত করতাম তোমার থেকে? থাকার মধ্যে আছে তো একটা কম্বল। এই গরমে সেটাও কাজে লাগবে না। হো হো করে হেসে উঠলাম আমি।
সেই হাসির আওয়াজে দু-তিনটে উর্দি পরা মিলিটারি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আর রামখিলাওন পিছিয়ে এসে বলল, চিৎকার করিস না,হতভাগা। হাসিস না অত জোরে। বেঘোরে মরবি।
—কিন্তু মরব কেন, সেটা তো বলবে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
—তুই টিভি দেখিসনি বেরোবার আগে?
— সে তো গত ছ’মাস দেখিনি। আমার ঘরে টিভি নেই তো। মানে, থাকলেও, সারাদিনে তিনরকম কাজ করে কখন আর দেখতাম, তাই রাখিইনি ওই আপদ।
—তাহলে তুই জানিসই না,গত তিনঘণ্টায় কী হয়ে গেছে?
—কী আবার হবে? মোক্ষদা মাসি বৃষ্টি-ভেজা উঠোন পেরিয়ে কলঘরে যেতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে এমন চোট পেয়েছে মাজায় যে আগামী একসপ্তাহ আর সিধে হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তার ওপর যে মেয়েটা আগু-পিছু করে দেয় সেই বিন্তির ধূম জ্বর কাল থেকে। আজ টিউশানি পড়ানো শেষ করে আমি নিজেই ঘুগনি তৈরির কাজে লেগে পড়েছিলাম। সে কি কম ঝামেলার ব্যাপার? এইসব হুজ্জুতিতে আজ সাট্টার ওখানে যেতেই পারলাম না। কড়কড়ে কতগুলো টাকা হাতছাড়া হয়ে গেল, ভাবো তো। আর এখন তুমি বলছ, ঘুরঘুর না করতে। ঘুরে ঘুরে সেল না করলে এই ঘুগনি কি আমি নিজের মাথায় ঢালব?
—ঢেলে লাভ হবে না কিছু। যুদ্ধের বাজারে, পাগলদের এক্সট্রা কোনও সুবিধে দেওয়া হয় বলে শুনিনি।
— কী যা তা বকছ? কে পাগল, কীসের সুবিধা ?
রামখিলাওন হটাৎ একদম অন্যরকম একটা গলায় বলল, তুই সত্যি জানিস না ? ইউ রিয়ালি ডোন্ট নো?

রামখিলাওন আর পাঁচটা ভিখিরির মতো নয়। ভদ্র, সভ্য, পেটে কিছু বিদ্যে আছে, এ আমি অনেকদিন ধরেই জানি। কিন্তু তাই বলে ওর গলায় এরকম সাহেবি উচ্চারণে ইংরেজি শুনব, তা ভাবিনি কখনও। ঘাবড়ানো গলায় বললাম, কী হয়েছে বলো-না গুরু? দুপুর থেকে লোডশেডিং, তারপর দেখলাম মোবাইলেও নো নেটওয়ার্ক; সাইকেল চালাতে চালাতে একবার যেন রাজাপুর জায়গাটা একটু বেশি নির্জন মনে হল আর যেখানে সাইকেল জমা রাখি সেখানেও কেউই ছিল না। তখন পাঁচটা-পঞ্চান্ন মিস হয়ে যাবে সেই দুর্ভাবনায় খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কেন ওরকম শুনশান ছিল, ওই জায়গাটা তো লোকজনের চিৎকারে গমগম করে প্রতিদিন। সরি, একটা লোক ছিল। কিন্তু সে তো ওই বুড়ো রিকশাওলা। সাইকেলগুলো নজরে রাখবে বলে ওকে কে যেন বহাল করেছে। অথচ বুড়ো মদ খেয়ে উলটে থাকে দিন-রাত আর বেসুরে রফি-কিশোরের গান গায়। আজ দেখলাম লুঙ্গিটাকে কষে গিঁট দিতে দিতে, কী একটা অচেনা গান গাইছে আর দু’লাইন গেয়েই গান থামিয়ে, ‘যুদ্ধ, যুদ্ধ’ বলে চেঁচাচ্ছে। শালা, দিব্যি দু’বেলা খাবার পাচ্ছে, তারওপর মদও যোগাড় হয়ে যাচ্ছে ফোকটে, ওর কীসের যুদ্ধ? যুদ্ধ তো আমার মতো লোকদের যারা দম ফেলার ফুরসত পায় না।

রামখিলাওন আমার হাতটা ধরল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, ডেলিবারেটলি লোডশেডিং করে রাখা হয়েছে দেশের বড় শহরগুলোয়। আর জ্যামিং করে দেওয়া হয়েছে যাতে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া না যায়। সব সিগনাল ব্লক করে দেওয়া হয়েছে বলে, টিভিতেও কোনও ছবি আসছে না, শুধু জরুরি সূচনাগুলো দেওয়ার জন্য দরকার মতো রেডিও স্টেশনকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমি জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম, তুমি আসলে কে? এতসব জানো কী করে? জিজ্ঞেস করে বসলাম, কেন?

রামখিলাওন আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ওই মাতাল রিকশাওলা ঠিকই বলেছে। চায়না হ্যাজ ডিক্লেয়ারড ওয়ার অন ইন্ডিয়া। চিন, ভারত আক্রমণ করেছে।

ক্রমশ…

(প্রতিটি পর্বের জন্য চোখ রাখুন, রবিবার বঙ্গদেশ নিউজ পোর্টালের ফেসবুক পেজে।)