পরিবর্তন

0
732

ভুণ্ডিল মুনি

ফেব্রুয়ারি, ২০০৫

আজ সরস্বতী পুজো। এখন সকাল নটা। বুবাইদের পাশের বাড়ির চ্যাটার্জিদের পুজো ইতিমধ্যেই সারা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে ওদের বাড়ি থেকে প্রসাদ দিয়ে গেল। পাড়ায় কারো বাড়িতে পুজো হলে পর বাড়ি বয়ে এসে প্রসাদ দিয়ে যাওয়াটাই দস্তুর। বুবাইদের বাড়ি থেকেও প্রসাদ যাবে পাশের বাড়ি, পেছনের বাড়ি, রাস্তার ওপারে সমুদের বাড়ি। জ্ঞান হওয়া ইস্তক বুবাই সেরকমটাই দেখে এসেছে। চার-পাঁচ বাড়ির প্রসাদ ঘরে আসবে, একেক বাড়ির প্রসাদের স্বাদ একেক রকম। উপকরণ, পদ সবই এক, তবুও স্বাদ আলাদা আলাদা। একবার চেখেই বুবাই ব’লে দিতে পারে কোন্‌টা কার বাড়ি থেকে এসেছে। এমনটা কী ক’রে হয়? বুবাই ভাবতে ভালোবাসে, যাদের পুজোয় নিষ্ঠা আর ভক্তি বেশি, তাদেরই প্রসাদের স্বাদগন্ধ বেশি ভালো।

সকাল সকাল প্রসাদ দিতে এসে ও-বাড়ির পিসিমা যে হাঁকডাক জুড়েছিল, বুবাইয়ের ঘুম তাতেই ভেঙেছে। খুব সকালে ওঠা বুবাইয়ের ধাতে নেই। ও নিশাচর। ওর মতে, রাতে ওর বুদ্ধিটা বেশি খোলতাই হয়, লেখাপড়ার কাজে মন বসে অনায়াসে। মা অবশ্য এ ব্যাপারে ওর সঙ্গে একেবারেই একমত নয়। সকালে উঠে পড়াশুনো, লেখালেখি, কিংবা রেয়াজ করলে মানুষের কতরকম উপকার হয়, তার ফিরিস্তি বুবাই অনেকবার শুনেছে। এতরকম উপকার আছে জেনেও বুবাইয়ের অভ্যেস বদলায়নি। বারোটা থেকে চারটে অব্দি নিজের মস্তিষ্কের অতিরিক্ত উর্বরতার ভরপুর সুযোগ ও নিয়মিত নিয়ে চলেছে। ওর ঘুমোতে যাবারও একটা নির্দিষ্ট মুহূর্ত রয়েছে। ব্রাহ্ম মুহূর্ত। ভোরে পাখির কিচিরমিচির শুরু হ’লেই বুবাই কাজ বন্ধ ক’রে শুয়ে পড়ে। আজ সাড়ে চারটে নাগাদ শুয়েছিল। ইচ্ছে ছিল আরও একঘণ্টা ঘুমোবার। কিন্তু তা আর হ’ল কই?

ঘুম চট্‌কে যাওয়াতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। আর দেরি করলে মা-র চেঁচামেচি শুনতে হ’ত। পুজোগণ্ডার দিন কাজ থাকে। অন্যান্য বছর এই দিনে বুবাই যেমনটা ক’রে থাকে, সেসব এবারেও চটপট সেরে নিতে হবে – মানে গায়ে-মুখে নিম-কাঁচাহলুদ বাটা ঘ’ষে চান সেরে নেওয়া, তারপর নিয়ম ক’রে গেটের বাইরে গিয়ে রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা এইসব আর কি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাটা পুরুত ধরবার প্রতীক্ষায়। কতক্ষণ থাকতে হবে তার কোনো ঠিক নেই। দু-দেড় ঘণ্টা হতে পারে। আবার দশ মিনিটও হতে পারে। এ জিনিস শুরু হয়েছে ‘সাদা’ দাদু গত হবার পর থেকে। এই নিয়ে বছর তিনেক হ’ল। ‘সাদা’ দাদু বুবাইয়ের দাদুও হন না, ঠাকুরদাও হন না। রক্তের সম্পর্ক নয়। তিনি আসলে ছিলেন বুবাইয়ের ঠাকুরদার সহকর্মী, বন্ধুস্থানীয় একজন। নিজের ঠাকুরদাকে বুবাই চোখে দেখেনি। ওর জন্মের বছর পাঁচেক আগেই তিনি গত হন। ‘সাদা’ দাদু একরকম বুবাইদের বাড়ির অভিভাবক ছিলেন বলা চলে। ছোটবেলা থেকে বুবাই দেখেছে যে বাড়িতে খুব গুরুতর কোনো সাংসারিক বিষয়ে আলোচনা চললে হয় তিনি উপস্থিত থাকতেন, আর নয়তো বাড়ির বড়রা তাঁর কাছে ছুটতেন পরামর্শের জন্য। তিনি ছিলেন খুব শান্ত প্রকৃতির লোক, কিন্তু গম্ভীর বলতে যা বোঝায় ঠিক তা-ও নয়। ধীরে ধীরে কথা বলতেন, কিন্তু মুখে একটা প্রশ্রয়ের হাসি লেগে থাকত। হালকা ঠাট্টাও করতে ভালোবাসতেন। চোদ্দ বছর বয়েস হওয়া অব্দি বুবাই দেখে এসেছে যে মাঘী শুক্লপঞ্চমীর দিন ধপধপে সাদা চুল আর তার চাইতে কিছু কম উজ্জ্বল সাদা ধুতি-চাদর প’রে বুবাইদের বাড়ির এই বাঁধা পুরুতমশাই দশটা-সাড়ে দশটা নাগাদ রিক্‌শ ক’রে চলে আসতেন। তাঁর মাথার ঐ ধপধপে সাদা ঢেউখেলানো চুল আর একজোড়া পুরু সাদা ভুরুর কারণে বুবাই প্রথম থেকেই তাঁকে ‘সাদা’ দাদু ব’লে ডেকে এসেছে। লক্ষ্মীপুজো, সত্যনারায়ণের পুজো, কিংবা বারের পুজো থাকলে তিনি আসতেন বিকেল ক’রে। পাঁজি দেখে ধার্য করা সময়েরও অন্ততঃ আধঘণ্টা আগে। প্রত্যেকবার। এর অন্যথা ঘটতে বুবাই দেখেনি কখনো। সেসময় কেউ যদি তাকে বলত যে আর ক’বছর বাদে পুজোর দিনগুলোতে পুরুত ধরবার জন্য রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, তাহলে সে ধরেই নিত যে নির্ঘাত মশকরা হচ্ছে। এখন আর ওকথা শুনলে কেউ মশকরা ঠাওরাবে না। পুরুত ধরা! বুবাই ভেবে দেখেছে, পুরুতমশাই সম্বোধনটা ‘সাদা’ দাদুর মতো মানুষকেই মানায়। বাকিরা – মানে যারা ‘সাদা’ দাদু গত হবার পর থেকে ওদের বাড়ির পুজোগুলোতে অ্যাড হক বেসিসে কাজ চালিয়ে দিয়েছে – তারা শুধু পুরুত। তারা আসে, ভুলভাল সংস্কৃত উচ্চারণে পাঁচমেশালি মন্ত্র আউড়ে ফুড়ুৎ ক’রে পুজো সেরে বেরিয়ে যায়। এদের দেখলে বুবাইয়ের প্রতিবারই কেন জানি মনে পড়ে প্রতিমাসে বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগের মিটার পড়তে আসা সিইএসসি-র কর্মীদের কথা। এরা হন্তদন্ত হয়ে আসে, ঠাকুরঘরটা (মিটারঘরটা) কোথায় জেনে নিয়ে কারো দিকে না তাকিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে সোজা কাজে লেগে যায়, কাঁধের ঝুলি থেকে সরঞ্জাম বের ক’রে মন্ত্রপাঠ (যন্ত্রপাঠ) শুরু করে, পুজো শেষ হ’লে কোনোদিকে না তাকিয়ে আবার হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। তা যাক, ক্ষতি নেই, অনেকের বাড়িতেই পুজো সারতে হবে তো। কিন্তু এদের এই যন্ত্রচালিতের মতো হাবভাব, আর কর্ণপীড়া উৎপাদক সংস্কৃত উচ্চারণের কারণেই বুবাইয়ের মনে যত অশান্তি। সংস্কৃত উচ্চারণে শুদ্ধতারক্ষার ব্যাপারে বুবাইয়ের বিশেষ খুঁতখুঁতানি আছে, কারণ সে স্কুলের পাঠক্রমে সাকুল্যে দু’বছরের জন্য বরাদ্দ সংস্কৃত পেপারে দু’বারই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। পুজো করবার সময় ‘সাদা’ দাদুও দেবভাষাকে বাংলার মতো ক’রে উচ্চারণ করতেন, কিন্তু তা খুব একটা গায়ে লাগত না। সে তো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রও রেডিওর মহালয়াতে বাংলার মতো উচ্চারণে চণ্ডীপাঠ ক’রে থাকেন। কিন্তু সে পাঠ নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা ও ভক্তিভাবে এমন টইটম্বুর হয়ে থাকে যে সেখানে উচ্চারণের খামতি কানে বড় একটা বাজে না। ভাবের অভাব ঘটলেই আর যা কিছু খামতি সেগুলো খুব বেশি বড় হয়ে দেখা দেয়।

খালিপেটে গেটের বাইরে রাস্তায় বুবাই দাঁড়িয়ে আছে প্রায় মিনিটকুড়ি হ’ল। একে তো রাতজাগা-ভোরভাঙা-অঞ্জলি-দেব-ব’লে-উপোষ-করে-থাকা খিদে, তার উপর পুজো সারা হ’লে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সৌরভ-তাতাইদের স্কুলের গেট থেকে স্কুটারে তুলে নিয়ে সন্ধে অব্দি টো-টো করবার মতলব ফাঁদা হয়ে আছে। এ-দুয়ের তাড়ায় বুবাইয়ের পেট-মন দুই-ই উশখুশ করছে। শিবতোষ স্যারের কোচিং ক্লাসের নীলাঞ্জনাদের ব্যাচটা যে প্যান্ডেলে আড্ডা দিতে বসে, এবছর সেখানেই সামান্য দূরে ওরাও আসর জমাবে ব’লে ঠিক করেছে। বেশি দূরে নয়, আবার খুব কাছেও নয় – যেখানটায় বসলে ইচ্ছে ক’রে জোরে জোরে বলা কথাবার্তা আর মুহুর্মুহু অট্টহাসি অভীষ্ট কানগুলোয় গিয়ে পড়তে পারে এমন জায়গা খুঁজে নিতে হবে। গলার আওয়াজ ঠিক ঠিক কানে পৌঁছে যাওয়া চাই। নেহাত সরস্বতী পুজো ব’লে কথা, নাহলে দুর্গাপুজোর দিনগুলোর মতো কাঁধে গিটারটা ঝুলিয়েই বেরোনো যেত। তাতে পনেরো থেকে পঁচিশদের চক্রে ওর মতো সদ্য কৈশোর-তথা-স্কুলোত্তীর্ণ, লিট্‌ল্‌ ম্যাগাজিন করা বাঙালি ছেলেদের মান বাড়ে। যাদের বয়েস পনেরোর কম কিংবা পঁচিশের বেশি, তাদের কাছে এসব চক্র আবার সাক্ষাৎ চক্রব্যূহ – সেখানে তাদের ঢোকবার রাস্তা বন্ধ। সরস্বতী পুজোয় বুবাইয়ের সব বাজনা ঠাকুরের আসনের পাশে দুদিন রাখা থাকে। তাই গিটারটা এখন তোলবার জো নেই। বইপত্র, পেন, বাজনা সব ঠাকুরের জিম্মায়। পড়াশুনোর তাড়া খাবার চিন্তাও তাই নেই, যেটা এই প্রথার একটা অন্যতম ভালো দিক।

বুবাইয়ের উশখুশানি বেড়ে চলেছে। ‘সাদা’ দাদু থাকলে এভাবে বেকার সময় নষ্ট হ’ত না। তাঁর মতো সময়নিষ্ঠ, নিয়মনিষ্ঠ, এবং আচারনিষ্ঠ ‘পুরুতমশাই’ গোত্রের পুরোহিত যে এ বাজারে দুর্লভ হবে, তা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু হঠাৎ পুরুতদেরও এমন আকাল পড়ল কেন?

একটু আগে বুবাই মা-কে বলতে শুনেছে যে এবারে চ্যাটার্জিদের বাড়ির পুজো নাকি ওদের গৃহকর্তাই সেরেছে। এমনিতে ওদের বাড়িতে একজন টিকিধারী পুরুত মশাই প্রত্যেক পুজোয় পৌরোহিত্য ক’রে থাকেন। এবারে তিনি কোনো একটা কারণে হাজির হননি। তাতে অবশ্য চ্যাটার্জিদের খুব একটা অসুবিধে হবার কথা নয়। ব্রাহ্মণ পরিবার – বাড়িতে একটি পৈতেধারী পুরুষও মজুত রয়েছে। সে-ই ও-বাড়ির একমাত্র পুরুষ সদস্য। লোকটা কলকাতার উত্তরে একটা নামজাদা টায়ার তৈরির কারখানায় মাঝারি মাপের ম্যানেজার। শৌখিন, মিশুকে লোক, ছোট পরিবার নিয়ে থাকে। পুজো সেরে, প্রসাদ দেওয়া-নেওয়া-খাওয়া সেরে এইমাত্র লোকটা বুবাইয়ের সামনে দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। ‘ভালো তো?’ ‘হ্যাঁ, এই তো…তোমরা?’ প্রত্যুত্তরে সাইকেলের হাতল থেকে একটা হাত তুলে নাড়া। বুবাই ভেবে দেখল, এই রিজার্ভেশনের যুগেও বামুন হবার অন্ততঃ একটা প্র্যাক্টিকাল সুবিধে আছে তাহলে। বুবাইরা বামুন নয়, তাই বাড়ির পুজোর জন্য পুরুতের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। মাঝেমাঝে মা-কে বুবাই জিজ্ঞেস করেছে, নিজেরা নিজেরাই পুজো সেরে নিলে হয় না কি? শুধু শুধু অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকে কী লাভ, বিশেষতঃ যখন ‘সাদা’ দাদুর মতো প্রকৃত অর্থে পুরুতমশাই পাওয়া আজকাল একরকম অসম্ভব? সরস্বতী কি আমাদের মতো পড়াশুনো-গানবাজনা নিয়ে থাকা একটা পরিবারের কোনো সদস্যের হাতে পুজো নেবেন না? এসব চোখা চোখা প্রশ্নের মুখে প’ড়ে মা বিশেষ কথা বাড়ায়নি বটে, কিন্তু বুবাইয়ের পারিবারিক ধর্মীয় বিপ্লব এখনো নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছয়নি – রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরুতের জন্য অপেক্ষারত বুবাই সেকথা আরও একবার উপলব্ধি করল।

ফেব্রুয়ারি ২০১৫

আজ সরস্বতী পুজো। সকাল সাড়ে ন’টা। মায়ের ঝাড় খেয়ে বুবাই অবশেষে বিছানা ছেড়েছে। এখন দাঁত মাজছে, এরপরই নিম-কাঁচাহলুদ বাটা মুখে-গায়ে ঘ’ষে চান করতে যাবে। তারপর পুরুত ধরা আছে। স্কুল-কলেজে থাকতে ছুটির দিনগুলোতে যে-রকমটা হ’ত, সেই ‘কতক্ষণে-বাড়ি-থেকে-বেরবো’ উচাটন ভাবটা আজকাল আর আসে না। নিত্য অফিসে যাওয়া-আসার মাঝে পুজো-টুজোর সুবাদে এক-আধটা ছুটির দিন পেলে বুবাইয়ের মনে হয় বাড়িতেই নিজের ঘরে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকি। আর বোনের সাথে গুলতানি করি। আজ পুজো সারা হ’লে পর খিচুড়ি তরকারি খেয়ে বিছানায় জমিয়ে বসে কী কী ফিল্ম দেখা যায় – মুখের ভেতরে ব্রাশ চালাতে চালাতে সেই ভাবনাতেই মেতে ছিল বুবাই। ট্যারান্টিনো? কিউব্রিক? নাকি কপোলা? ইতিমধ্যেই বারদুয়েক দেখা হয়ে গেছে এরকম দু-একটা ফিল্ম মনে মনে ঠিক ক’রে নিয়ে বুবাই স্থির করল, আজ দুপুরে ওগুলো বোনের সঙ্গে আবার দেখবে।

বলতে নেই, এবারে সাত-তাড়াতাড়ি পুরুত জুটে গিয়েছিল। দুপুর বারোটার মধ্যে পুজো সারা হয়েছে, একটার মধ্যে মিটে গেছে নিজেদের আর পাড়ার অন্যান্য বাড়িগুলো থেকে প্রসাদ দেয়ানেয়ার পালা। পুজোর প্রসাদ খেতে ব’সে বুবাইয়ের চোখে পড়ল, থালার সংখ্যা আগের চাইতে কিছু কম। চামচ দিয়ে একটা একটা ক’রে থালা থেকে কুলের টুকরো, বাতাবি লেবু, সাদা নাড়ু, লাল নাড়ু, পায়েস, সন্দেশ, রসগোল্লা, লাল-হলুদ রকমারি আকারের মঠ, খিচুড়ি-তরকারি ইত্যাদি হরেক রকম প্রসাদ নিজের প্লেটে উঠিয়ে নিয়ে বুবাই খাওয়া শুরু করল। পেছনের বাড়ির তরকারিটা প্রত্যেকবারের মতো এবারও বেশ করেছে, সমুদের খিচুড়ি আর পায়েস দুটোই দু’বার ক’রে নেওয়া গেল – অপূর্ব বললে কম বলা হবে – মা-র রান্না করা সুজি-লুচির ভোগ খাওয়া হল; আর কোথায়?

‘চ্যাটার্জিদের বাড়ি থেকে প্রসাদ এখনো দিয়ে যায়নি? ওদের এবার দেরিতে পুজো হচ্ছে নাকি?’ সোফায় পা তুলে একহাতে প্লেট ধ’রে খেতে খেতে বুবাই মা-র উদ্দেশ্যে কথাটা ছুঁড়ল। ও জানে যে পাশের বাড়ির সময়টা গত বেশ কয়েক মাস হ’ল ভালো যাচ্ছে না। টায়ার তৈরির কারখানা কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে বছরখানেক হ’ল। একেবারে উপরতলার মাথারা, আর একেবারে তলার না-থাকলেই-নয় এরকম শ’খানেক লোকজনকে বাদ দিলে মাঝের অনেকের চাকরি গিয়েছে। এই হতভাগ্য মাঝারি মাপের চাকুরেদের তালিকায় পাশের বাড়ির ভদ্রলোকটিও আছে। বুবাই মাঝখানে মা-র কাছে শুনেছিল, আজকাল লোকটা নাকি কীসব সেল্‌সের ব্যবসা-ট্যাবসা করছে। অফিস থেকে ফেরার পর বুবাই খেয়াল করেছে, কয়েক দিন অন্তর অন্তর সন্ধেবেলা প্রায়ই ডজনখানেক লোক জুটিয়ে ওদের বাড়িতে লম্বা-লম্বা মিটিং চলে। বাড়ির বাইরে মেলা জুতো আর চটি জমে থাকে। সেসব মিটিং সাধারণতঃ শেষ হয় রাত ক’রে, সমবেত গানের মাধ্যমে। গানের কথাগুলো বুবাই ঠাহর ক’রে উঠতে পারেনি, কিন্তু সুরটা কেঠো, অনেকটা রবীন্দ্রনাথের বিলিতি গানগুলোর ঢঙের। তা গানবাজনার মধ্যে দিয়ে কেউ যদি ভালো থাকার অতিরিক্ত রসদ খুঁজে নিতে পারে, তা তো ভালো লক্ষণ। বুবাই নিজেও মাঝেমধ্যে রাতের দিকে রেয়াজ করে, তাই এসব ওর গায়ে লাগেনি। শুধু ঐ সমবেত গানগুলোর সুর শুনে মাঝেমধ্যে মজা পেয়েছে।

বুবাইয়ের প্রশ্নের জবাবে প্রসাদ খাওয়ার মাঝে ওর দিকে না তাকিয়েই মা বলল, ‘গেছিলাম প্রসাদ নিয়ে,’ তারপর একটু থেমে একটা কুল মুখে পুরে বলল, ‘নিল না।’
‘নিল না?’ ভুরু কুঁচকে গেল বুবাইয়ের। প্রসাদ খাওয়া থামল। ‘নিল না কেন?’
‘ওরা পুজোও করেনি তো এবার, জানিস না?’
‘না! কেন?’
‘চ্যাটার্জি আমাকে বলল, বৌদি কিছু মনে কোরো না, আমাদের তো এইসব মূর্তি-টুর্তির পুজোয় আর বিশ্বাস নেই, তাই প্রসাদ নিতে পারবো না। তুমি তো আমার অবস্থাটা শুনেছ। খুব সমস্যায় পড়েছিলাম। ইএমআই কী ক’রে মেটাব সে চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে গেছিল। এতগুলো পাওনাদার! কিন্তু গড আর তাঁর শিশুপুত্রকে মানবার পর থেকেই আমার কপাল একটু ফিরেছে। পাদরি সাহেব আমার মাথায় গডের আশীর্বাদ তুলে দিয়েছেন। বলেছেন, প্রতি রোববার সকালে চার্চে আসবে, গডের অন্য ভক্তদের বাড়িতে ডেকে এনে একসঙ্গে গডকে ধন্যবাদ দেবে, এইভাবে আমরা সবাই একসঙ্গে ব’সে নিজেদের সমস্যা ভাগ করে নেব গডের সামনে। গড আমাদের প্রত্যেকের জন্য অপেক্ষা করে আছেন, তাঁর পুত্র নিজের ভক্তদের জন্য সত্যি সত্যি মিরাক্‌ল করেন। আমার জীবনেও গডের আশীর্বাদ আসার পর থেকে মিরাক্‌ল হয়েছে। ব্যবসাটা একটু একটু ক’রে জমছে। আর গডের কৃপা পেতে গেলে ভাবের ঘরে চুরি করা চলে না। গড আসলে একজনই, তাঁর কোনো রূপ নেই, আকার নেই। তাঁর নানান রকম মূর্তি গ’ড়ে পুজো করা, প্রসাদ বিতরণ এসব মোটে ভালো কথা নয়। এগুলো কুসংস্কার।’

প্রসাদের নাড়ু খেতে খেতেও বুবাইয়ের মুখের ভেতরটা কেমন জানি তেতো ঠেকল।