৩৭০ ধারা বিলোপ : জাতীয়-সুরক্ষার ব্রত

আবীর রায়গাঙ্গুলী

“The definition of insanity is doing the same thing over and over again and expecting different results.” –Rita Mae Brown

লিফট-লিবারেল বা ইসলামিস্টদের অনেকেই দাবি করেছিলেন যে, সংবিধানের ৩৭০ ধারা ছিল কাশ্মীরের ভারতে সংযুক্তির প্রাকশর্ত, সেইমতো মেহেবুবা মুফতি দাবি করেছিলেন যে ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত করলে কাশ্মীরে তিরঙ্গাকে শ্মশানে যাওয়ার লোকও পাওয়া যাবে না। এই হুমকির সারবত্তা কি সেটা আমরা গত এক বছরেই দেখে নিয়েছি, কিন্তু প্রশ্ন হল এই যুক্তির সারবত্তা কি সেই নিয়ে। শুধু মেহেবুবা মুফতি নন, বহু বাম-অবাম রাজনৈতিক, সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ, স্বাস্থ্যবিদ, শিক্ষাবিদ এমনকি আইনবিদও এই যুক্তি দিয়েছেন4 বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু আমরা যদি সময়পঞ্জির দিকে তাকাই, তাহলে বুঝবো যে কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে, উত্তর পশ্চিম প্রান্ত থেকে পাকিস্তানি আক্রমণের প্রেক্ষাপটে। কাজেই এই প্রাকশর্তের তত্ত্ব ভিত্তিহীন। ১৯৪৯ সালে শেখ আব্দুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর কাছে ৩৭০ ধারার দাবি নিয়ে আসেন। ভারতের গণপরিষদের ড্রাফটিং কমিটির চেয়ারম্যান বি আর আম্বেদকর এই দাবি তৎক্ষণাৎ খারিজ করেন। নেহেরু তার বিশেষ ক্ষমতাবলে এই ধারাকে সংবিধানে সংযোজন করেন, তবে সর্দার প্যাটেলের হস্তক্ষেপে ‘temporary’ ও transient’ শব্দদ্বয় এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়।

খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, ৩৭০ ধারা ভারতীয় পার্লামেন্টের আইনকে কাশ্মীরে প্রযুক্ত হওয়া থেকে আটকাত। ৩৭০ ধারা থাকাকালীন কাশ্মীরে সুরক্ষা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক নীতি ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে ভারতের মন্ত্রিসভা এমনকি ভারতের রাষ্ট্রপতিও কেন্দ্রীয় কোন আইন বলবৎ করতে পারতেন না। সুপ্রিম কোর্ট, এমনকি একসময় পর্যন্ত ভারতীয় নির্বাচন কমিশনেরও আওতায় পড়ত না কাশ্মীর। আমার-আপনার করের যে টাকা কাশ্মীরের রাজ্য সরকারকে দেওয়া হতো তার কোন প্রকার হিসাব চাওয়ার অধিকার ছিল না কেন্দ্র সরকারের। ৩৭০ ধারার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হল এর দোসর ৩৫(এ) ধারা ও কাশ্মীরের ১৯৫৬ সালের সংবিধান যাতে অধিকার, সংখ্যালঘু বা ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার শব্দগুলো ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে জিহাদকে সফল করা।

কাশ্মীরের “আন্দোলন” একসময়, অন্তত প্রকাশ্যে, ছিল রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন বা “আজাদি”র লড়াই; আজ তা সম্পূর্ণভাবে জিহাদে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে জিহাদ বা দার-উল-ইসলামে পরিণত করার পদক্ষেপগুলি ধাপে ধাপে বোঝা দরকার। প্রথম হল “সংখ্যালঘু” মুসলমানদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধে আদায় করে নেওয়া। জনবিন্যাস ইসলামের পক্ষে আসার সাথে সাথেই জিহাদী কৌশলে পরিবর্তন আসে, পৃথিবীর সর্বত্র এটা হয়েছে। তখনই রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইসলামীকরণ হয় এবং সেই মতন অন্য ধর্মাবলম্বী বা “কাফের”দের থেকে সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নেওয়া হয়। জনবিন্যাস ইসলামের আরেকটু পক্ষে আসার পরে অর্থাৎ অর্ধেকের কাছাকাছি আসার পরেই কাফেরদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ শুরু হয়। একবার সত্তর শতাংশের কাছাকাছি চলে গেলেই ইসলামী রাষ্ট্রের আখ্যা দিয়ে জিহাদের নিশান উড়িয়ে দেওয়া হয়। পার্শিয়া থেকে ইজিপ্ট, আর্মেনিয়া থেকে তুরস্ক সর্বত্র তাই হয়েছে, কাশ্মীর তার ব্যতিক্রম নয়। যদিও কাশ্মীরের ওপর প্রথম আঘাত আসে ১৩২০ সালে যখন শাহ-মীর কাশ্মীরে আসে, কিন্তু সেই দীর্ঘ ইতিহাস আলোচনা থেকে বিরত থাকলাম কারণ এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির সার্থকতা আলোচনা। এই প্রসঙ্গে মূলত জিহাদ তথা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ৩৭০ ধারা বিলোপের প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করব।

কিন্তু জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের অংশ হওয়ার দরুন, এই অঞ্চল অবহেলিত এবং ইসলামীকরণের প্রকোপে পড়ে। লাদাখের জনবিন্যাস পরিবর্তন হতে শুরু হয়েছিল গত তিরিশ বছরে, তাছাড়াও জম্মু-কাশ্মীরের নিত্যনৈমিত্তিক জিহাদি অশান্তি লাদাখের পর্যটন শিল্পকেও ব্যাহত করছিল।

৩৫(এ) ধারা এবং ১৯৫৬ সালে গৃহীত হওয়া জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধানে, রাজ্য সরকারকে অধিকার দেওয়া হয় যে তারা জম্মু-কাশ্মীরের “পারমানেন্ট রেসিডেন্ট” কে এবং কে নয় তা নির্ধারণ করতে পারবেন এবং ‘পার্মানেন্ট-রেসিডেন্ট’রাই হবেন জম্মু-কাশ্মীরের সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে অন্য যে কোন প্রকার অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক অধিকারের অধিকারী। ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বহু মানুষ যারা জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা তাঁরাও রাজ্য সরকারের “সিদ্ধান্ত”; অনুযায়ী এই “পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি” পাননি কারণ তাঁরা মুসলমান নন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাঞ্জাবের দলিত সম্প্রদায় যারা চার পুরুষ কাশ্মীরের বাসিন্দা এবং ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও কাশ্মীরে রাজ্য বিধানসভার ভোটার নন। হাস্যকর হলেও সত্যি যে জম্মু-কাশ্মীরে সংখ্যালঘু বলতে ভারতের সাংবিধানিক সংখ্যালঘুদের বোঝাত, সুতরাং জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের আশি শতাংশের মুসলমান হলেন সংখ্যালঘু এবং কাশ্মীর উপত্যকায় পাঁচ শতাংশের কম কাশ্মীরি পণ্ডিতরা হলেন সংখ্যাগুরু। এমনকি কাশ্মীরি মহিলারা যদি অন্য রাজ্যের পুরুষকে বিয়ে করতেন,তবে “পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি” হারাতেন। অথচ, কাশ্মীরি পুরুষদের পাকিস্তানি স্ত্রীরাও “পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি” পেতেন। ভারতের অন্যপ্রান্তের মানুষরা জম্মু-কাশ্মীরে সম্পত্তি ক্রয় করতে না পারলেও পাকিস্তান থেকে সহজেই মুসলমানরা জম্মু-কাশ্মীরে এসে সম্পত্তি ক্রয়, স্থায়ী বসবাস করতে পারতেন। কাজেই ৩৭০ ধারা এবং একই সাথে ৩৫(এ) ধারার অবলুপ্তি করে, মোদি-শাহের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এক সাংবিধানিক সংকট থেকে ভারতবর্ষ তথা জম্মু-কাশ্মীর কে রক্ষা করেছেন। একই সাথে সাধারণ সংখ্যালঘু-হিন্দু,বৌদ্ধ, শিখের অধিকার স্বীকৃত করেছেন।

৩৭০ ধারা অবলুপ্তির পরে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরীর সিদ্ধান্ত লাদাখকে জম্মু-কাশ্মীরের থেকে আলাদা করে তাদের অস্তিত্ব অবলুপ্তির সংকট থেকে রক্ষা করেছে। ১৯৪৯ সালের মে মাসে লাদাখি বুদ্ধিস্ট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট থিভাঙ রিঘজিঙ প্রধানমন্ত্রী নেহরু কে চিঠি লিখে ভারতে সংযুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করেন। লাদাখ ধর্মীয় দিক থেকে তিব্বতের ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও, ভারত যেহেতু তার বৃহত্তর অস্তিত্বকে রিপ্রেজেন্ট করে তাই লাদাখি কাউন্সিল, তিব্বতের পরিবর্তে ভারতে সংযুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের অংশ হওয়ার দরুন, এই অঞ্চল অবহেলিত এবং ইসলামীকরণের প্রকোপে পড়ে। লাদাখের জনবিন্যাস পরিবর্তন হতে শুরু হয়েছিল গত তিরিশ বছরে, তাছাড়াও জম্মু-কাশ্মীরের নিত্যনৈমিত্তিক জিহাদি অশান্তি লাদাখের পর্যটন শিল্পকেও ব্যাহত করছিল।

সংবিধান রক্ষার পাশাপাশি ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির একটি অন্য দিক রয়েছে যার গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না যে “temporary” ও “transient” ধারা বহু আগে রদ করা উচিত ছিল।সুবর্ণ সুযোগ ছিল ইন্দিরা গান্ধীর হাতে, যিনি বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজিত পাকিস্তান-কে সিমলা-চুক্তির পুরস্কার দিয়েছিলেন। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর পরাক্রমকে তিনি কূটনৈতিক বিজয়ে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এরপরে ক্রমশঃ পাকিস্তান কাশ্মীরে তাদের রণনীতি বদলায়। রাডিকাল ইসলাম, জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদ একত্রে লালিত পালিত হতে থাকে ভারতেরই সংবিধানের দেওয়া রক্ষাকবচ ৩৭০ ধারা এবং ৩৫(এ) ধারার ছত্রছায়ায়। পঞ্চাশের দশকে যেখানে নিরীহ শান্তিপ্রিয় সাধারণ কাশ্মীরির কল্পনা করা যেত, আশির দশকের শেষের দিক থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নরসংহারে সেই সাধারণ শান্তিপ্রিয় নিরীহ কাশ্মীরি মুসলমান হয়ে দাঁড়িয়েছিল নরখাদক। টিকালাল টাপলু-র মতো অসংখ্য নিরীহ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পাকিস্তান থেকে আসা সন্ত্রাসবাদীরা হত্যা করেননি, হত্যা করেছিলেন তাদেরই প্রতিবেশী তথাকথিত নিরীহ শান্তিপ্রিয় কাশ্মীরিরা। বলতে দ্বিধা নেই, রাডিকাল ইসলাম বা ওয়াহাবি মতাদর্শের মতো জিহাদি মতাদর্শর যে উন্মত্ত রূপ কাশ্মীরি পণ্ডিতরা প্রত্যক্ষ করেছে, তা পরোক্ষভাবে মদত পেয়েছে ৩৭০ ধারা ও ৩৫ (এ) ধরার মাধ্যমে। স্বায়ত্তশাসন ও “ফ্লেক্সিবিলিটি”র যে তত্ত্ব দিয়ে ৩৭০ কে মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা হতো তার অন্তঃসারশূন্যতা বারবার প্রমাণ হয়েছে। এই কারণেই কাশ্মীরি শৈবপীঠ গুলি বারবার বর্বরতার শিকার হয়েছে। শ্রীনগর হয়ে গেছে শাহের-এ-খাস, অনন্তনাগ হয়েছে ইসলামাবাদ, শংকরাচার্য পর্বত হয়ে গেছে তাখত- এ-সুলেমান। একদা ভারতীয় শিক্ষা সংস্কৃতির মূলকেন্দ্র কাশ্মীর হয়ে গেছে সন্ত্রাসবাদের আখড়া। কাজেই, ৩৭০ ধারা জাতীয় সুরক্ষা ও অখণ্ডতা রক্ষার ক্ষেত্রে মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে ভারতবর্ষের সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। ২০১৬ সালে ব্রাসেলসের সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে সন্ত্রাসবাদ কোন আইন-শৃঙ্খলা জনিত সমস্যা নয়। এটা মূলগতভাবে যুদ্ধ, তবে এর প্রকাশ ধ্রুপদী যুদ্ধের ধারণা থেকে একটু আলাদা।

কাশ্মীর অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ভারতের সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চল পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্য-এশিয়া, চীন ও রাশিয়ার সাথে যুক্ত তথা বিচ্ছিন্ন করেছে ভারতকে। প্রাকৃতিক খনিজে ধনী মধ্য-এশিয়ার সাথে নিকট কাশ্মীর, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে বাধা হওয়ার কারণে ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে এই সমস্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক উত্থান-পতন অতীতেও ভারতের কাশ্মীর-নীতির মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধুনা আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের পুনর্বহাল, এই সমগ্র অঞ্চলের রাজনীতিকে জটিল থেকে জটিলতর করেছে। এমতাবস্থায় কাশ্মীর, লাদাখ, পাঞ্জাব; এই সমগ্র অঞ্চলে রাষ্ট্রবাদী, সুসংবদ্ধ এবং বলিষ্ঠ শাসনের প্রয়োজন। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতের বাহ্যিক সুরক্ষার সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ সুরক্ষার ভিতও নড়িয়ে দিয়েছিল। ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং পিডিপি-র মত রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাসবাদীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল। জম্মু-কাশ্মীরের রাজনৈতিক দলগুলি প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসবাদীদের ‘ফ্রন্ট অর্গানাইজেশন’ হিসেবে কাজ করছিল। এমতাবস্থায় জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ যা সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যথেষ্ট দক্ষ ও সফল একটি প্রতিষ্ঠান, তা ক্রমাগতই রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল, কাজেই সন্ত্রাসবাদ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং বুরহান ওয়ানির মত সন্ত্রাসবাদীরা স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছিল।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে ভারতবর্ষের সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। ২০১৬ সালে ব্রাসেলসের সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে সন্ত্রাসবাদ কোন আইন-শৃঙ্খলা জনিত সমস্যা নয়। এটা মূলগতভাবে যুদ্ধ, তবে এর প্রকাশ ধ্রুপদী যুদ্ধের ধারণা থেকে একটু আলাদা। সামরিক শাস্ত্রে যাকে বলা হয় ‘Hybrid War’ বা ‘Fourth-Generation Warfare’। মোটের ওপর পার্থক্য হল এই যে সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে দেশের ভেতরে এসে আক্রমণ করে নিরস্ত্র নিষ্পাপ মানুষদের। এই সন্ত্রাসবাদীরা, অন্তত কাশ্মীরে, গরীবীর কারণে বা চাকরি না পেয়ে এই পথ বেছে নেননি। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের এক এবং একমাত্র কারণ হল রাডিকাল ইসলামের মগজ-ধোলাই। জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই উদ্দেশ্য।

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় মোটের উপর দু’ধরনের রণনীতি ব্যবহার হয়। রক্ষণাত্মক নীতির লক্ষ্য হল, মূলত সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি জনগণের সহানুভূতি এবং সমর্থন কে, রাষ্ট্র নির্মাণের মাধ্যমে, বিচ্ছিন্ন করা। অপরপক্ষে আক্রমনাত্মক নীতি সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযানের কথা বলে। এই দুটি নীতি কে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে ভুল হবে। কোন একটি নীতি শুধুমাত্র অবলম্বন করলে, সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সেই কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক প্যাকেজ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্মার্ট-সিটি, “Deradicalisation”-এর মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদকে নিশানা করলেও, সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করা করার জন্য সামরিক অভিযানের পথ বেছে নিয়েছে। এই দুই নীতির মধ্যে সমন্বয় রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আইনগত গঠনতন্ত্রের। এই দুইয়েরই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ৩৭০ ধারা। ভারতের সামরিক বাহিনী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারছিল না কারণ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অধিকাংশ সময়ই তাদের জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের সাথে সমন্বয় সাধন করে কাজ করতে হত, যার চাবিকাঠি ছিল রাজ্য সরকারের হাতে। দ্বিতীয়তঃ, জম্মু-কাশ্মীরের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার একটা বড় অংশ, বিজেপির উত্থানের পরেও, রাজনৈতিকভাবে রাডিক্যাল-ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি সহানুভূতি ও ভারত-বিরোধিতার কাজ করে থাকে। এমতাবস্থায়, Deradicalisation-র মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না।

গৃহমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ ১০ই আগস্ট ২০১৯ তারিখে, চেন্নাইয়ে আশা প্রকাশ করেছিলেন যে ৩৭০ ধারা বিলোপ সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ফলদায়ী হবে। এরই ফলস্বরুপ, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসে ২২৩টি সন্ত্রাসবাদী নাশকতার জায়গায় ২০২০ সালের ওই একই সময়ে নাশকতার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮।

অভিনব পাণ্ডিয়া, তাঁর 2020 সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র ‘The threats of National Terrorist Groups in Kashmir’- এ দেখিয়েছেন কিভাবে রাজ্যসরকার পরিচালিত স্কুলগুলোতে মগজ ধোলাই এর কাজ হয়ে থাকে এবং শিশুদের কাছে বুরহান ওয়ানি-র মত সন্ত্রাসবাদীদের কাশ্মীরের ‘হিরো’ হিসেবে দেখানো হয়। রাডিক্যালাইজেশন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছিল যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে ‘হুরিয়াত’ কে কাশ্মীর সমস্যার ‘স্টেকহোল্ডার’ হিসেবে দাবি করেছিল। আমাদের ভুললে চলবে না এই হুরিয়াত-ই প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতার কথা বলে এবং কাশ্মীর থেকে পণ্ডিতদের বিতাড়নের মূল কান্ডারী। যারা অপরাধী তাদের সাথে সওয়াল-জবাব শুধু আদালতে হতে পারে, কোনরকম রাজনৈতিক নেগোসিয়েশন তাদের সাথে সম্ভব নয়। এছাড়াও আর্থিক উন্নয়নের জন্য যে প্যাকেজ কেন্দ্র সরকার সময় সময় ঘোষণা করেছে এবং বলবৎ করার চেষ্টা করেছে, তা সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি, কারণ জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যসরকার সহ কোন প্রতিষ্ঠানের কোন প্রকার ফিনান্সিয়াল-একাউন্টাবিলিটি ছিলনা, সেই সুযোগে কেন্দ্রের টাকা অর্থাৎ আমার-আপনার পরের টাকা চলে যেত সন্ত্রাসবাদীদের হাতে। এই সমস্ত কারণেই ৩৭০ এবং ৩৫(এ) ধারা বিলোপ করে কাশ্মীর অঞ্চলের শাসনভার কেন্দ্রীভূত করে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের উন্নতি পৃথকভাবে ত্বরান্বিত করাই এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য। একদিকে উন্নয়ন, অপরদিকে সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান এই দুইয়ের প্রাকশর্ত ছিল ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি।

গৃহমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ ১০ই আগস্ট ২০১৯ তারিখে, চেন্নাইয়ে আশা প্রকাশ করেছিলেন যে ৩৭০ ধারা বিলোপ সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ফলদায়ী হবে। এরই ফলস্বরুপ, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাসে ২২৩টি সন্ত্রাসবাদী নাশকতার জায়গায় ২০২০ সালের ওই একই সময়ে নাশকতার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮। আমাদের মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি প্রথম পদক্ষেপ। তবে এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। কাশ্মীরি পণ্ডিতরা যতদিন না শান্তি সুরক্ষা ও সম্মানের সাথে কাশ্মীরে জীবনযাপন করতে পারছেন, ততদিন এই কর্মযজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে না। এছাড়াও কাশ্মীর পরিস্থিতি আমাদের গোটা দেশ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যার প্রথমটি হল; জনবিন্যাসের পরিবর্তন জিহাদের প্রথম পদক্ষেপ– তা যেন আমরা পশ্চিমবঙ্গে হতে না দিই এবং দ্বিতীয়, সংখ্যালঘুর সংজ্ঞা নির্ধারণ অবশ্যই যেন সেই রাজ্যের জনসংখ্যার বিন্যাসের ভিত্তিতে হয়, অর্থাৎ যেখানে হিন্দুরা সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম, যেমন অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, কাশ্মীর সেখানে যেন হিন্দুরা অবশ্যই সংখ্যালঘু হিসেবে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পান, তা না হলে গোটা দেশটা কাশ্মীর হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

(প্রতিবেদনটিতে প্রকাশিত হওয়া মতামত সম্পূর্ণ লেখকের৷ এর দায়ভার বহন করে না বঙ্গদেশ নিউজ পোর্টাল৷)