জাতির লজ্জা! নালন্দা যেতে গেলে এখনো নামতে হয় ‘বখতিয়ারপুর’ স্টেশনে

0
2079

শান্তনু কর্মকার

ধরে নেওয়া যাক, আপনার বাড়িটাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে একদল ডাকাত। হাতের সামনে যা পেয়েছে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, মুল্যবান আসবাবপত্র লুটপাট করেছে। সবশেষে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দলিল, বইপত্রে। এবার এই ঘটনার পর আপনি নিজের বাড়ির নামকরণ সেই ডাকাতদের সর্দারের নামে করবেন!

এমনটাই হয়ে এসেছে স্বাধীন ভারতবর্ষে। যে ইসলামিক শক্তিরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে আমাদের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যকে, আমরা তাদেরকে মনে রেখেছি নায়ক হিসেবে। তাদেরকে নিয়ে বলিউডে সিনেমা তৈরি হচ্ছে, মানবিক দিক দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে তাদের চরিত্র।

ভারতবর্ষের ওপর ইসলামিক আক্রমণে ধ্বংস হয়েছে শয়ে শয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই ইসলামিক শক্তিগুলির মধ্যে বিশেষত মুঘলদেরকে কিছু ঐতিহাসিক যতই ‘সুশাসক’ বলে বর্ণনা করুন না কেন, আদতে যে তারা শুধুমাত্র শোষণই করেছিলেন, তার প্রমাণ দেয় ভারতের কোনায় কোনায় থাকা, কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একাধিক স্থাপত্য। বিধর্মী তথা কাফেরদের শিক্ষা কোনও শিক্ষাই নয়, তাদের সংস্কৃতির কোনও মূল্য নেই, তাদের ভাবাবেগ, তাদের পূজনীয় দেবতার কোনও অস্তিত্বই নেই, এই যুক্তিতে ইসলামিক শাসকরা ভেঙেছে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মন্দির ইত্যাদি ইত্যাদি।

বাদ যায়নি বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দাও। ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বিশ্বের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল কুতুবউদ্দিন আইবকের সেনাপতি ইখতিয়ার আল-দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি। সাধারণ ভারতবাসী হয়ে নিশ্চই আজ বখতিয়ার খলজির জন্য আমাদের মনে দরদ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা থাকা উচিৎ নয়। বরং সেই পাষণ্ডের জন্য বরাদ্দ হওয়া উচিত একরাশ ঘৃণা।

কিন্তু আমাদের জাতির মেরুদন্ডের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন! যে বখতিয়ার খলজি এই বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিল, প্রায় ৯০ লক্ষ পাণ্ডুলিপি জ্বালিয়ে দিয়েছিল, সেই বখতিয়ার খলজির নামেই কি না রয়েছে রেলস্টেশন। নালন্দার পাশে সগৌরবে রয়েছে বখতিয়ারপুর। বর্তমানে যদি কেউ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চান তাহলে তাকে নামতে হবে বখতিয়ারপুর স্টেশনে।

দিনের পর দিন পর্যটকদের এই স্টেশন যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে যে আমরা ভারতীয়রা জাতিগতভাবে বড়ই দুর্বল। আমাদের মেরুদণ্ড নেই, যে আক্রমণকারী আমাদের ঐতিহ্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিল তার নামেই আমরা রেলস্টেশন তৈরি করেছি, তাকে মনে রাখছি নায়ক হিসেবে। নালন্দার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত আচার্য নাগার্জুনের নামেও রাখা যেত এই স্টেশনের নাম, কিংবা স্টেশনের নামকরণ করা যেত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের নামে। কিন্তু না, আমরা তা করিনি, নাম পাল্টে দেওয়ার ইচ্ছেও প্রকাশ করিনি।

এ আমাদের জাতির লজ্জা যে, বহু ভারতীয় ঐতিহাসিকই বখতিয়ার খলজির সম্পর্কে সত্যিটা চেপে গিয়ে নিজেদের বইতে লিখেছেন বখতিয়ার ভুল করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে ফেলেছিলেন। তিনি নালন্দাকে একটি সামরিক ঘাঁটি ভেবে ফেলেছিলেন। যদি এই কথা সত্যি হত, তবে বখতিয়ার বিক্রমশীলা ধ্বংস করলেন কেন? আর নালন্দা ধ্বংস করার সময় প্রায় ৯০ লক্ষ পাণ্ডুলিপি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন কেন? কোন সামরিক ঘাঁটিতে বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা পাণ্ডুলিপি আগলে রাখেন? এতকিছু দেখার পরেও তিনি বোঝেননি যে নালন্দা আদতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, কোনও সামরিক ঘাঁটি নয়?

তিনি বুঝেছিলেন সবই, তাও যেহেতু ওটা বিধর্মীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেয়াত করেননি আর। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেন দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে।

আমেরিকায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনের অংশটিকে ‘লাদেন স্কোয়্যার’ বলে ঘোষণা করা হয়নি। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, নেতাইতে বুদ্ধ-সরণী কিংবা জ্যোতিমার্গ নেই। দেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে যে অশুভ শক্তি, তার নামে রেলস্টেশন থাকা আর যাই হোক, জাতির গৌরব হতে পারে না।