সুশাসনে অটলবিহারী

0
730

বল, বল, বল সবে, শত বীণা-বেণু-রবে,

 ভারত আবার জগত-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে |

ধর্মে মহান্ হবে, কর্মে মহান্ হবে,

নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতনে পুরাতন এ পুরবে।

“”রাজনীতি হল পচা নর্দমা””- কান পাতলেই বহু যুগ ধরে প্রচলিত এই কথাটি আজকাল হামেশাই শোনা যায়, সমালোচনার লোকেরও অভাব নেই । অভাব শুধু সেই লোকের যিনি/যাঁরা এই নোংরা নর্দমায় নেমে নিজের হাতে অস্বাস্থ্যকর নর্দমা রূপী রাজনীতি কে পরিস্কার করে সুস্থ সমাজের নির্মাণের চেষ্টা করেন। তখনই তৈরী হয় পরম বৈভবশালী রাষ্ট্র । এর জন্য লাগে দৃঢ সংকল্প, দূরদর্শিতার ও সুশাসন ।

“সুশাসন” শব্দটা খুব ছোট্ট হলেও এর ব্যাপ্তি বিরাট। দেশ পরিচালনা থেকে শুরু করে সমাজের সমস্ত “কু” জিনিস কে সরিয়ে দিয়ে ব্যক্তি তথা সমাজের চরিত্র নির্মাণের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলা ও সমাজের উন্নতি সাধনের প্রাথমিক শর্তই হল “সুশাসন “। আর যিনি নিজের সংকল্পে অবিচল, তিনিই তো “অটল”।

তখনও ‘ইন্ডিয়া’ তৈরি হয়নি, দেশমাতৃকা আবদ্ধ পরাধীনতার শৃঙ্খলে। বিদেশী বৃটিশদের স্বৈরাচারী শাসনের গ্লানি কুরে কুরে খাচ্ছে দেশের তরতাজা যুবকদের । বিভিন্ন রাজনৈতিক – অরাজনৈতিক ও বিপ্লবী সংগঠন যে যার মতো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে । লড়াইটা শুধুমাত্র স্বাধীনতার নয় , লড়াই আত্মসম্মানের , লড়াই দেশের ভবিষ্যত গঠনের,  লড়াই সুশাসনের। যুগের এই সন্ধিক্ষণে গোয়ালিয়ারের এক দরিদ্র স্কুল শিক্ষকের ঘরে ১৯২৪ সালের ২৫ সে ডিসেম্বর ঘর আলো করে এলেন তিনি , ৭২ বছর পর স্বাধীন ভারতবর্ষ যাকে জানলো দেশের দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ।

স্থানীয় ‘সরস্বতী শিশু মন্দির’ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ১৯৩৪ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য  উজ্জয়ীনির AVM স্কুলে ভর্তি হন মাত্র নয় বছরের ছোট্ট অটল। তখন তাঁর বাবা , শ্রী কৃষ্ণ বিহারী বাজপেয়ী সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক । মাত্র ১৫ বছর বয়সের তরুণ অটল ১৯৩৯ সালে যুক্ত হন আরেক প্রবাদ প্রতিম যুগপুরুষ, ডাক্তার কেশব বলিলাম হেড গেওয়ারের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরী সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন  “রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ” তে। পরের পাঁচ বছরে সংঘের শাখায় আসা অটলবিহারী  পড়াশোনার সাথে সাথে সেরে ফেলেন সংঘের OTC (অফিসার ট্রেনিং ক্যাম্প)। ১৯৪২ সালে “ভারত ছাড়ো আন্দোলন” শুরু হলে তাতে অংশগ্রহণ করেন ১৬ বছরের অটল। এই যুগ সন্ধিক্ষণেই তাঁর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে হাতেখড়ি, এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রী মাধব রাও সদাশিব রাও গোলওয়ালকর ( যার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কাটে এই বাংলায়, মুর্শিদাবাদের সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশনে – সেসব অবশ্য অন্য ইতিহাস ) -এর অনুপ্রেরণায় বাংলার বাঘ “স্যার আশুতোষ মুখার্জির” সুযোগ্য সন্তান , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ প্রাক্তন উপাচার্য ও পশ্চিমবঙ্গের জনক, ভারত কেশরী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ১৯৫১ সালের ২১ অক্টোবর  প্রতিষ্ঠা করলেন “ভারতীয় জনসঙ্ঘ”। তাঁর হাত ধরেই পরবর্তীকালে বাজপেয়ীজীর জনসঙ্ঘে প্রবেশ ঘটে । প্রথম লোকসভা নির্বাচনেরই পশ্চিমবঙ্গ তথা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ছাপ ফেলে দেয় সদ্য প্রতিষ্ঠিত এই দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটি। তিন শতাংশ ভোট পেয়ে দখল করে নেয় লোকসভার তিনটি আসন – রাজস্থানে জেতেন শ্রী উমাশঙ্কর ত্রিবেদী, ঝাড়গ্রামে শ্রী দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দক্ষিন কলকাতায় ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সারা ভারতবর্ষে মোট ৩৫টি বিধানসভা আসনে জেতে জনসঙ্ঘ যার মধ্যে সবথেকে বেশি হয় পশ্চিমবঙ্গে – ৯ টি ( রাজস্থানে জেতে ৮টি)। শ্যামাপ্রসাদের সান্নিধ্যে রাজনীতিতে ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠা অটলবিহারী ছিলেন তাঁর একান্তই প্রিয়। যখন শ্যামাপ্রসাদ ৩৭০ এর বিরোধিতা করে এক দেশ এক আইনের স্লোগান তুলে কাশ্মীরে প্রবেশ করেন , তিনি বাজপেয়ীজী কে বলেন – ফিরে গিয়ে দলকে জানাতে যে উনি কাশ্মীরে পৌঁছে গিয়েছেন এবং সাথে নির্দেশ দেন দলকে সঙ্গে নিয়ে এক দেশ এক আইনের সপক্ষে দেশ ব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে । যেদিন মধ্যরাতে শ্যামাপ্রসাদের মৃতদেহ কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছায়, বিমানবন্দর থেকে শ্মশান পর্যন্ত অশ্রুবিজরিত নেত্রে সেই উত্তাল কলকাতায় তাঁর শেষ যাত্রার সঙ্গী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। শোনা যায়, কেওড়া তলা মহাশ্মশানে  শ্যামাপ্রসাদের মৃতদেহের মাথার পাশে ঠাঁই বসে সেদিন এক নাগারে কেঁদে চলেছিলেন যুবক অটল।

১৯৫১ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘ যোগদান ও পরবর্তী ২৯ বছরের বিভিন্ন রাজনৈতিক উত্থান পতনের সাক্ষী ও অংশীদার বাজপেয়ীজী তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী শ্রী লাল কৃষ্ণ আদবানি ও অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে জনতা সরকার থেকে বেরিয়ে এসে তৈরী করলেন “ভারতীয় জনতা পার্টি” যা মাত্র দুটি লোকসভার সাংসদ নিয়ে পথচলা শুরু করে আজ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে প্রতিষ্ঠিত, ২০১৪ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা দখল করে দীর্ঘ তিন দশকের ” নন সিঙ্গেল মেজরিটি পাওয়া দলের পরিচালিত সরকার” এর তকমা ঘোচানো দল।

বাজপেয়ীজী তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মোট তিনবার ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন, প্রথমবার ১৩ দিন – দ্বিতীয়বার ১৩ মাস ও তৃতীয়বার পূর্ণাঙ্গ সময়। তাঁর এই ছয় বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে ভারত তথা সমগ্র বিশ্ব দেখেছে ভারত-পাকিস্থানের মৈত্রী স্থাপনে অটলজীর উদ্যোগে অমৃতসর-লাহোর বাসযাত্রা, দেখেছে পোখরান, আবার দেখেছে কার্গিলের পাকিস্তানে ছায়াযুদ্ধ- পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা ও তৎপরবর্তী ছায়াযুদ্ধে পাকিস্তানের  শোচনীয় পরাজয়।

যখন আমেরিকা সহ পশ্চিমা বিশ্বের তাবর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি  ভারতের ওপর কড়া নজরদারি চালাচ্ছিল যাতে ভারত প্রকৃত অর্থে “পরমাণু শক্তিধর দেশ” হয়ে উঠতে না পারে, যখন দেশের প্রথম সারির আমলাদের অনেকেই তাঁকে নিষেধ করেছিলেন “পরমাণু পরীক্ষা” করার জন্য , অবগত করেছিলেন পরীক্ষা চালালে কী কী আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে সেই নিয়ে  – তিনি তাঁর দৃঢ় সংকল্পে ছিলেন ‘অটল’। কারন তাঁর নিজস্ব দূরদর্শিতা তাঁকে উপলব্ধি করিয়েছিল সেই পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার । আবার ঠিক তেমনই, কার্গিলে যুদ্ধের সময় তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সংযমী আচরণ এবং লাহোর বাসযাত্রার মাধ্যমে প্রতিবেশীর প্রতি মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রতিষ্ঠা করেছিল তাঁর “বিশ্বনেতা” হয়ে ওঠার দক্ষতাকে। বিমান অপহরণ ও তৎপরবর্তী কান্দাহার কান্ড শান্ত অথচ দৃঢ় মস্তিষ্কে সামলে তিনি তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের পুনরায় প্রমাণ দিয়েছিলেন ।

শুধু পররাষ্ট্রনীতিতেই নয়, পরম বৈভবশালী রাষ্ট্র গঠনের পথে দেশের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি থেকে দ্বিতীয় টেলিকম বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে তাকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রেও অটলজীর ভূমিকা চিরস্মরণীয়। সোনালী চতুর্ভুজ ও প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম গুলোকেও তিনি সহজেই জুড়ে দিয়েছিলেন দেশের বড় বড় শহর ও মহানগর গুলোর সাথে।   এতে যেমন একদিকে রোজগার  বৃদ্ধি ঘটেছিল তেমনই পরিবহন খরচা ও সময়ের সাশ্রয় দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আনতে ইনফরমেশন টেকনোলজির ভূমিকা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি দেশে ঘটিয়েছিলেন আইটি বিপ্লব। সৃষ্টি হয়েছিল বিশাল কর্মসংস্থান ।

বহুদলীয় গনতন্ত্রের সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরী করেছিলেন সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়সংকল্পের মেল বন্ধনের , যার প্রমাণ পাওয়া যায় তার প্রধানমন্ত্রীত্বের দ্বিতীয় দফাতে ( যখন AIADMK সমর্থন তুলে নেওয়ার পর মাত্র এক ভোটে তাঁর সরকার পরে গিয়েছিল)। তিনি বলতেন – তিনি নেতৃত্বে  থাকুন বা না থাকুন, দল ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক,  দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়া চাই ; কারন তিনি বিশ্বাস করতেন – “ছোটে মন সে কোয়ি বড়ে নেহি হোতা, টুটে মন সে কোয়ি খাড়ে নেহি হোতা”।