হিন্দুত্বর উৎপত্তি ফ্যাসিবাদে নহে, বঙ্গভূমিতে

0
1366

হিন্দুত্ব, ১৮৯৪ সাল (প্রথম প্রকাশিত ‘হিন্দু’ নামে)

শ্রী পঞ্চাননতর্ক রত্ন (ভট্টাচার্য) মহাশয়

দেবতনুর উবাচ:

এক দল নিকৃষ্ট হনুমান বিশ্বাস করেন হিন্দুত্ব নাকি ফ্যাসিবাদ হইতে অনুপ্রেরিত। অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক কুড়ি বছর আগেই বঙ্গের মাটিতে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দের ব্যবহার হয় এই নিম্ন প্রকাশিত রচনায়।

দুই দিক দিয়ে এটি উলেখযোগ্য;

এই  রচনাটি প্রকাশ পায় “জন্মভূমি” নামক পত্রিকায়। রাজনীতি ও দেশপ্রেম নিয়ে লেখালেখি থাকলেও তার মূল রচনাগুলো ব্যবসা সংক্রান্ত। ইংরেজ শোষণ ব্যবস্থায় তিতিবিরক্ত বৃহত্তর বাঙালি সমাজকে ব্যবসা করার নতুন কল মেশিন এবং নানা কলাকৌশল বিষয় নিয়ে ছিল বেশির ভাগ রচনা। বলা যেতেই পারে ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন এবং তৎসম স্বদেশী-বয়কট আন্দোলন এর প্রচ্ছন্ন ভূমিকা এইসব পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমেই তৈরী হচ্ছিলো।

আবার অন্যদিকে তর্করত্ন মহাশয়ের মতো বেশিরভাগ বাঙালি ছিলেন শক্তিবাদে বিশ্বাসী। স্বদেশী আন্দোলনের আংশিক জয়লাভের পরবর্তীকালে এইসব হিন্দু উগ্রপন্থীদের হাত ধরেই বঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির হালখাতা চালু হয়। তার এই লেখাতেও ফুটে ওঠে গ্রামের হিন্দু নিয়ম পালন করা মুসলমানদের বৃহত্তর হিন্দু সমাজে জায়গা করে দেয়ার একটা সুপ্ত বাসনা।

তর্করত্ন মহাশয় ন্যায়দর্শনের বিশিষ্ট পন্ডিত ছিলেন। এই রচনার আমসত্বর মতন শুকনো মস্করা ইংরেজদের বোধগম্য হয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে তিনি ১৯২৯এর সারদা act এ ক্ষুদ্ধ হয়ে ভারত সরকারের  “মহামহ-উপাধ্যায়” পদবি ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন।

 

হিন্দু

 

হিন্দু শব্দ সংস্কৃত নহে, জাবনিক। হিন্দু শব্দের প্রকৃত অর্থ কি, তাহা আমরা জানিনা। কেহ কেহ বলেন; হিন্দু শব্দে গোলাম – ভৃত্য বা ক্রীতদাস। জবনেরা আমাদের এই সনাতন-ধৰ্মাবলম্বী জাতিকে বিদ্বেষ বশে হিন্দু বলিত, এক্ষণে সে-ই হিন্দু নামই আমাদের প্রচলিত। কেহ কেহ বলেন ‘সিন্ধু ‘ শব্দ হইতে হিন্দু – শব্দের উৎপত্তি। যাহা ইন্ডিয়ার মূল, তাহাই হিন্দুর মুল। প্রতীচ্যগণের নিকট, বর্তমান ভারতবর্ষের সিন্ধুনদ সর্বাগ্রে পরিচিত। সেই নদের নাম হইতে হিন্দু শব্দের উৎপত্তি। ভারতবর্ষ এই নাম প্রতীচ্যাদিগের সম্পূর্ণ বিদিত থাকিলে, হিন্দু নামের পরিবর্তে ‘ভারত’-ঘটিত কোন নাম আমাদের হইত, এরূপ অনুমান করা নিতান্ত অসঙ্গত নহে। কেহ কেহব লেন, হিন্দু,-কুশ পর্বতের নিকট হইতে সমগত বলিয়া প্রকাশ থাকাতেই ‘হিন্দু’ আখ্যা হইয়াছে। মুসলমান রাজগণের প্রদত্ত হিন্দুনামএখনআমাদের অতি প্রচলিত। কি বিজাতীয় কি সজাতীয় — সকলের নিকটেই হিন্দু নাম পরিচিত। গৌরব ও ঘৃণা, সমাদর ওঅবহেলা, পুজা ও অবমাননা, অমরা হিন্দু নামের সঙ্গেই পাইতেছি। হিন্দু নাম এখন আমাদের প্রিয়, অতি প্রিয়, হিন্দু নামের সহিত এখনই আমাদের অভেদ্য অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। এই অসংস্কৃত জবনিকশব্দ, এত প্রচলিত হইবার কারণ—হিন্দু নামের অনুরূপ কোনপ্রকার সংস্কৃত নাম না থাকা। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, সংকরজাতি, অন্ত্যজজাতি, নীচতম জাতি সকলকে শোধ করে এম নশব্দ আর তো কিছু নাই।

পূর্বকালে, বৌদ্ধ, মুসলমান ও খ্রীষ্টান প্রভৃতি জাতি ছিল না, একারণ—কেবল মানব বা মানুষ্য ইত্যাদি শব্দ দ্বারাই উচ্চ হইতে নীচ জাতি পর্যন্ত পাওয়া যাইত। এখন নানা ধৰ্ম ও নানা জাতি ; এ সময়ে আমাদের জাতি সাধারণত বুঝাইতে হিন্দু শব্দই পৰ্যাপ্ত ।

যাউকও-কথা ।হিন্দু শব্দের মূল অর্থ যাহাই কেন হউক না, হিন্দু শব্দের ব্যবহার এক্ষণে, কি দৃশজন সাধারণের প্রতি হইতেছে (১), অপরের প্রতি হইতে পারে কিনা ? (২), ধর্মের নাম হিন্দু-ধৰ্ম্ম কেন হইল?

(৩) এবং শাস্ত্র ও লোকব্যবহার হিন্দু সম্বন্ধে এক রূপ কিনা ? (৪) এই চারিটী বিষয়ের আলোচনা এই প্রবন্ধে করিব।

হিন্দু জাতির লক্ষণ নির্দেশ না করিলে, এ সকল বিষয়ের আলোচনা করা অসম্ভব, সুতরাং প্রথমে তাহাই কৰ্ত্তব্য। কিন্তু এই লক্ষণ বড় জটিল। বাস্তবিকই ভাবিতে হয়, হিন্দু হওয়ার লক্ষণ কি ? আচ্ছা, কতিপয় লক্ষণ নির্দেশ করিতেছি, তন্মধ্যে যেটা বিচারে বিশুদ্ধ হইবে, তাহাই গ্রহণ করা যাইবে।

১! যে জাতি শাস্ত্রে বিশ্বাস যুক্ত, তাহারই হিন্দু জাতি।

২।যাহারা শিব দূর্গা রাম প্রভৃতি দেব-দেবীকে মানে, তাহারা হিন্দু।

৩।যে জাতি পুরুষানুক্রমে ভারতবর্ষেরঅধিবাসী ,সে-ই জাতিই হিন্দু।

৪।গোহত্যা –পরান্মূখ জাতিই হিন্দু।

৫।ভারতবর্ষের অধিবাসী হইয়া যাহারা দেব-দেবী পুজা করে, তাহারাই হিন্দু।

৬। বেদ, স্মৃতি, পুরাণ এবং তন্ত্র ;এই চতুর্ব্বিধ শাস্ত্রের মধ্যে কোন এক শাস্ত্রের মত যাহারা পুরুষানুক্রমে অবলম্বন করিয়া আছে, তাহারাই হিন্দু।

৭। যাহারা কোন পুরুষে উক্ত চতুর্ব্বিধ শাস্ত্রের অনুপদিষ্ট ধর্ম অবলম্বন করিয়াছে বলিয়া স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না, তাহারাই হিন্দু জাতি।

প্রথম হইতে ছয়টী পর্য্যন্ত লক্ষণ বিশুদ্ধ নহে, অতএব পরিত্যাগ করা গিয়াছে ;শেষ লক্ষণটী প্ৰচুলিত ব্যবহারের উপযোগী ।কেন ? তাহা দেখাইতেছি।

১। আপন আপন শাস্ত্রে সকলেই বিশ্বাস যুক্ত, অতএব সকল জাতিই হিন্দুপদবাচ্য হইতে পারে, অতএব প্রথম লক্ষণটী অতিব্যাপ্তি-দোষে দূষিত।

২। বিবি বেশান্ত প্রভৃতি অনেক বিভিন্ন জাতি শিব দুর্গা রাম প্রভৃতি মানিতেছেন, নবদ্বীপের নিকটবতী একঘর মুসলমান ও দুর্গাপুজা করাইতেন, দুর্গা মানিতেন, দেবদেবী মানিতেন ;তাই বলিয়া তাঁহাদিগকে কি হিন্দু বলিয়া ধরা যাইবে ? সুতরাং এ লক্ষণেরও মাত্রা অধিক, অর্থাৎ অতিব্যাপ্তি দোষ আছে।

৩। অনেক বন্য জাতি ভারতবর্ষে আছে, যাহারা পুরুষানুক্রমেভারতবর্ষের অধিবাসী, তাহাদিগকে কি কেহ হিন্দু বলিয়া থাকে? এইসব বন্য জাতিতে তৃতীয় লক্ষণের অতিব্যাপ্তি এবং সাহেবদের মতে অসম্ভব। অর্থাৎ: এ লক্ষণটী কোন হিন্দুতেও বৰ্ত্তে না। কেননা হিন্দুজাতি ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসী নহে। হিন্দুর পুরুষানুক্রমে বাস ভারতবর্ষে নহে। অনেক সাহেব এই কথা বলেন।

৪। অনেক বৌদ্ধ গোহত্যা কি কোন প্রাণীহত্যাই করেনা। কিন্তু তাহারা তো হিন্দুপদবাচ্য নহে। এই হইল অতিব্যাপ্তি। পক্ষান্তরে খুব নীচ জাতীয় হিন্দুরা অনেকে গোহত্যা করে; অতএব সে স্থলে হইলো অব্যাপ্তি।

৫। শুনিতে পাই, যবদ্বীপে হিন্দু আছে, কাবুলে হিন্দু আছে, বৰ্ম্মায় হিন্দু আছে। কিন্তু ঐ সকল স্থানকে সাহেবেরা ত ভারতবর্ষ বলেন না; তবে ভারতের অধিবাসী না হইলেও হিন্দু হওয়া যায়, ইহা বুঝা আছে। এখন হিন্দুজাতির পঞ্চমলক্ষণ মানিলে, অব্যাপ্তি হয়, এই সকল স্থানের হিন্দুকে হিন্দু বলা চলেনা। পক্ষান্তরে নবদ্বীপের নিকটস্থ সে-ই এক ঘর মুসলমান, যাহারা দেব-দেবীপূজক, তাহদিগকে এবং কোন ভারতীয় মুসলমান বা খৃষ্টান যদি দেব-দেবীপূজা করে ত তাহাকে হিন্দু বলিতে হয়।

৬। যষ্ঠ লক্ষন মানিলে, কলিকাতা অঞ্চলে হিন্দুজাতি দুর্লভ হইয়া উঠে। এক্ষণে দু এক পুরুষে সবশাস্ত্রের মতই পরিত্যক্ত হইয়াছে এবংঅনেকে বলেন, পুরাতন বৌদ্ধবংশও এখন হিন্দুর সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে, সুতরাং, অবধারণ করিয়া বলি কি রূপে যে, “যাহারা পুরুষানুক্রমে এসব শাস্ত্রের কোন-না-কোন মত অবলম্বন করিয়া আছে, তাহারাই হিন্দু।”

৭। এই জন্য সপ্তম লক্ষণের অবতারণা করিয়াছি। সপ্তম লক্ষণের ভাব—ব্ৰহ্মার প্রথম সৃষ্টি হইতে এইকাল পর্যন্ত যে বংশে, কোন পুরুষ ধর্মান্তর পরিগ্রহ করিয়া সন্তান উৎপাদন করিয়াছে বলিয়া স্পষ্ট প্রমাণ আছে, সে-ই সন্তান-ধারা —হিন্দু বলিয়া গণ্য হইবে না। যে সব বংশ এইরূপ বেদাদিশাস্ত্রোক্ত অনুপদিষ্ট-ধর্মাবলম্বীগণের শুক্র-শোনিত-সম্ভূত বলিয়া স্পষ্ট প্রমাণ নাই, তাহা হিন্দুজাতির বংশ বলিয়া অভিহিত। সে সব বংশে যাহাদিগের জন্ম, তাহারা ও ধর্মান্তর অবলম্বন না করিলে হিন্দু বলিয়া গণ্য হইবে। এইরূপ বংশ ও ব্যক্তি লইয়া হিন্দু জাতির নির্ধারণকরিতে -হইবে। ভারতবর্ষ ভিন্ন অপর দেশবাসী হিন্দু ও এইপ্রকার হিন্দু লক্ষণাক্রান্ত হইতে পারে। এখন যাহারা শাস্ত্রসম্মত আচার ব্যবহার পালন করেনা, কিন্তু মুসলমান বা খ্রীষ্টান প্রভূতির ধর্ম পরিগ্রহ করে নাই, তাহারা সপ্তম লক্ষণানুসাৱে লক্ষণাসুরে হিন্দুজাতির অন্তৰ্গত হইতে পারে।  কোন বৌদ্ধবংশ  এক্ষণে হিন্দু হইয়াছে, একথা অনেকে বলিলেও স্পষ্ট প্রমাণ নাই। অপ-ধৰ্ম্মবস্বী লোকে যে হিন্দু হইতে পারেনা, তাহার কারণ ও সপ্তম লক্ষণের অনুসারী, হিন্দুসমাজের অভিপ্রায়। কর্ত্তাভজা, বাউল প্রভৃতি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের শাখা প্রশাখাগণ হিন্দু হইয়াছে পুনরানুবর্তীতার জন্য। তাহাদের মত ভাল হউক, মন্দ হউক, সে বিচার এ প্রসঙ্গে করিতেছি না; তবে এই বলিতেছি,  তাহারা স্ব স্বমতকে শ্রীমদ্ভাগবত প্রভৃতি বৈষ্ণব পূরণের অনুবর্তী বলিয়া বিশ্বাস ও প্রকাশ করে ।ব্রাহ্মণ হইতে চণ্ডাল পর্যন্ত উচ্চ হইতে নীচতম জাতি –তে এই লক্ষণের লক্ষ্য হইতে পারে।

এই লক্ষণ দ্বারাই আমাদের আলোচ্য দুইটা বিষয়ের একরূপ মীমাংসা করা হইয়াছে।-অর্থাৎ কীদৃশ জনসাধারণ এক্ষণে হিন্দু নামে ব্যবহৃত, সপ্তম লক্ষণ দ্বারা তাহা বুঝান গিয়াছে। আর, অপর জাতীয় উক্তরূপ হিন্দু-লক্ষণাক্রান্ত হইতে পারেনা, অতএব হিন্দু নামেও ব্যবহৃত হইতে পারেনা,  ইহাও বলা হইল। লক্ষণটী মোটামুটি। ব্যবহারোপযোগী হইলেও আমার ইহাতে একটু কিন্তু আছে। ‘কিন্তু’ টুকু এই ; –

সাঁওতাল  প্রভৃতি বন্যজাতির মধ্যে অনেকেই ক্রমে ‘নীচজাতীয় হিন্দু’ বলিয়া পরিচিত হইয়াছে ও হইতেছে। ইহাৱা পুরুষানুক্রমে কোনো শাস্ত্রেরই ধার ধারেনা।   ইহারা অন্ত্যজ জাতি বা অন্ত্যাবসায়ী জাতির মধ্যে শাস্ত্রে পরিণিত হইয়াছে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি পূর্ব্বকালে ধর্মআর ছিলনা, বন্যদিগের সাধারণ ধর্ম ঋষ্যনুমোদিত। অসাধারন ধর্ম তখন ছিল কিনা বলা যায়না। থাকিলেও তাহা সম্প্রদায়-বিশেষগত কুলধর্মের মধ্যেই গণ্য ছিল।

 

সেই ধৰ্ম্মপালনের অপরাধে তাহাদিগকে চণ্ডাল হইতে নিম্নশ্রেণীতে অবনমিত করা হইত না! তাহাদিগেরও গুন্ * [*]তারতম্য বুঝিয়া জাতিভেদ করা ছিল। ভিলজাতি চণ্ডাল হইতে ভাল। অপর বন্যজাতি বা ম্লেচ্ছজাতি চণ্ডালের সমান, সুতরাং পূর্ব্বে চণ্ডাল পর্যন্ত জাতিকে এক শ্রেণীর অন্তর্গত করিয়া এক নামে অভিহিত করিয়া আর তদপেক্ষা উচ্চজাতিকে পৃথক শ্রেণীতে  উপবেশন করান ঋষিগণ উচিত মনে করিতেন না। সাধারণ শব্দ প্রয়োগ করিতে হইলে, মানব, বা মানুষ ইত্যাদি বলিতেন ।বিশেষস্থলে, বর্ণ, আর্য্য, দ্বিজ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, ইত্যাদি নাম ব্যবহার করিতেন। এখন জাতিভেদের মূল হারাইয়া গিয়াছে। যা হউক এখনকার আইনে, বন্যজাতি শাস্ত্রানুসারে কৈবর্ত্তের সমান হইলেও হিন্দু নহে, যেমনভিল[†]। তা যদি হইল, তবে অনেক হীন জাতিই হিন্দুত্ব হইতে বিচ্যুত হয়। ইষ্টাপত্তি অনেকেই করিবেন। কিন্তু যাহা সত্য সত্য হইয়াছে, সত্য সত্য হইতেছে এবং সত্য সত্য হইবে, তাহার অপলাপ করিব কি রূপে? যে জাতির এক শ্রেণীকে বন্য বলিযা মনে করিতেছ, সে-ই জাতিরই অপর শ্রেণী দুইতিনশত বৎসর পূর্ব হইতে হিন্দু সমাজে মিলিয়া হিন্দু নামে তোমারই নিকট কীর্ত্তিত হইতেছে। এই এক কথা। দ্বিতীয় কথা এই,-

শাস্ত্রোক্ত ধৰ্ম্ম লইয়া হইয়াছে, হিন্দু জাতির লক্ষণ। কিন্তু এই ধৰ্ম্ম কি রূপ ধরিতে হইবে ? সাধারণ ধৰ্ম্মত সকল জাতিরই সমান। সকল ধর্মাবলম্বীরাই তাই কোননা কোন রুপে পালন করেন। অতএব বিশেষ ধর্ম ধরিতে হইবে। মনে কর, বাপ্তাইজ হইতে হইলে জার্ডনের জল মাথায় দিতেহ য়, স্থূলকথায় এরকম কার্যকেই চতুর্ব্বিদ শাস্ত্রের অনুপদিষ্ট ধর্ম বলিয়া ধরিতে হইবে,  কিন্তু তাহা হইলেও বিষম বিপদ। মনে কর, একজন প্রকৃত হিন্দু, সক করিয়া বা মজা দেখিবার জন্য অথবা ভ্রমক্রমে জার্ডনের জল মাথায় দিল, কিন্তু অভক্ষ্য ভক্ষন, কি আমাদের শাস্ত্রে বিশ্বাস, অথবা পরকীয় ধৰ্ম্মে অনুরাগ কিছুই তাহার হয় নাই; সে ব্যক্তি এবং তৎসন্তান সন্ততি, সপ্তম লক্ষণের বলে হিন্দু-লক্ষণ-ভ্রষ্ট হইতে বাধ্য ।লক্ষণ মিলাইয়া দেখ, আমার কথা ঠিক কিনা। অথচ যে সব লক্ষণ করিতে যাইবে,  তাহাতে আচারে ভ্রষ্ট ধর্মভ্রষ্ট আধুনিক অনেক হিন্দুকে বাদ দিতে হইবে। কিন্তু তাহাত করা হয় না – হিন্দুজাতির মধ্যে তাহাদিগকে ত ধরা হইয়া থাকে। তাই বলিতেছিলাম, সপ্তম লক্ষণেও আমার ‘ কিন্তু’ আছে। অতএব  “খ্রীষ্টান মুসলমান প্রভৃতি সেই-সেই জাতি ভিন্ন যে জাতি; তাহাই হিন্দুজাতি—এইরূপ জটিল ও বহুজন মনোরঞ্জনের অক্ষম লক্ষণের আশ্রয় লইতে হয়। এই হইল, হিন্দুজাতির লক্ষণ। এইরূপ জাতির অন্তর্গত ব্যক্তি হইল হিন্দু। বর্ত্তমান সময়ের গরজে এইরুপ লক্ষণ অবলম্বন করিতে হইলো। একথা কিন্তু বারংবার বলিব।  পূর্ব্বেও বলিয়াছি, এখনও বলিতেছি, লক্ষণ অনুশীলনেই প্রথম দুই বিষয়ের আলোচনা হইয়া গিয়াছে। তা যাহা অবশিষ্ট থাকিল, তাহা পরে বলিতেছি।

এখন তৃতীয় বিষয়ের আলোচনা করা যাক।

হিন্দুজাতি মধ্যে প্রচলিত ধৰ্ম্ম বলিয়া আমাদের ধর্মের নাম হিন্দু ধর্ম হইয়াছে। খ্রীষ্টান মুসলমান  প্রভূতি জাতির নাম হইয়াছে ধর্মের নাম হইতে। আর হিন্দুধর্মের নাম হইয়াছে হিন্দু জাতির নাম হইতে। ঠিক বিপরীত।  এইজন্যই মুসলমান ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিলেই যে জাতির ছেলে হউক, মুসলমান হইবে। খৃষ্টানের পক্ষেও এই নিয়ম আছে।  কিন্তু হিন্দুধর্ম অবলম্বন করিলে অর্থাৎ শিবপূজা আরম্ভ করিলেও অ-হিন্দুজাতি, হিন্দু হইতে পারেনা। ফল কথা এই, মুসলমানেরা দেশ লইয়া জাতির নাম হিন্দু ও জাতি লইয়া ধর্মের নাম হিন্দুরাখিয়াছে। ধর্মের নাম হিন্দু হইয়াছে এই কারণে বটে, কিন্তু এক্ষণে হিন্দু-শব্দ জাতি ও ধৰ্ম্ম উভয় অর্থেই ব্যবহৃত। ভারতবর্ষে হিন্দুর সংখ্যা—এত। এস্থলে হিন্দু জাত্যর্থবোধক; “অমুক লোকটী বেশ হিন্দু” এই কথায় হিন্দু শব্দের অর্থ হইল ধর্মের পক্ষে। তা যা ইহউক, হিন্দুধৰ্ম্ম-শব্দ যে জাতিমুলক, ইহা বেশ বলা যায়।

এই গেল তৃতীয় বিষয়। এক্ষণে দেখা যাক শাস্ত্র ও লোকব্যবহার হিন্দু সম্বন্ধে কিরূপ?- শাস্ত্রজ্ঞ মাত্রই অবগত আছেন, হিন্দু শব্দ বা তদনুরূপ শব্দ কোন শাস্ত্রেই নাই। হিন্দু বলিয়া বিশেষরূপে নির্দ্দেশও শাস্ত্রে নাই। হিন্দুজাতি বলিয়া কোনরূপ নিগ্রহ বা অনুগ্রহ শাস্ত্রে দেখা যায়না। চণ্ডাল হিন্দু আর বন্যজাতি বা ম্লেচ্ছজাতি হিন্দু নহে, কিন্তু চণ্ডালের ধর্মে ও ম্লেচ্ছের ধর্মে বিশেষ কোন প্রভেদ শাস্ত্রে পাওয়া যায় না! ব্রাহ্মণ, চণ্ডালের সংসর্গে যে প্রকার পাপী হন, ম্লেচ্ছের সংসর্গেও সেই প্রকার পাপী হইয়া থাকেন। এইরূপ যেদিকেই দেখিবে, তাহাতেই বুঝিবে ;হিন্দুনাম কল্পিত, শাস্ত্রের সঙ্গে উহার কোন সম্বন্ধ নাই ।তবে এ সময়ে লোকব্যবহারে ‘হিন্দু’ স্বতন্ত্র হইয়াছে। ঋষিগণের বচন বিশ্বাসী বা নিরক্ষর ম্লেচ্ছ জাতি হইতে, ততসদৃশ চণ্ডালাদি জাতি হিন্দু বলিয়া আমাদের অধিক আত্মীয়, এইরুপ লোকব্যবহার হইয়াছে। লোকব্যবহার যাহা হইয়াছে, তাই চলে চলুক; কিন্ত জাতি সম্বন্ধে শাস্ত্রের মর্ম যথাসাধ্য এ স্থানে প্রকাশ করিতেছি।

শাস্ত্রে দ্বিবিধ ধর্মের উল্লেখ আছে, সামান্য ও বিশেষ ধৰ্ম্ম। বিশেষ ধৰ্ম্ম আবার, বর্ণ-আশ্ৰম ধৰ্ম্ম ইত্যাদি ভেদে নানা প্রকার। সামান্য ধৰ্ম্ম হইল, –

অহিংসা সত্যমস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ।

মনু১০মঅ: ৬৩।

অহিংসা, সত্য, চৌর্য না করা, শুচি থাকা এবং ইন্দ্রিয় নিগ্রহ ;এই কয়েকটি হইল সামান্য ধৰ্ম্ম; তবে যে সব জাতির হিংসাই হইল, শাস্ত্রনির্দিষ্ট জীবিকা, তাহাদিগের সেই হিংসা, হিংসাই নহে। তদতিরিক্ত হিংসা ত্যাগ হইলে অহিংসা।

এই সামান্য ধৰ্ম্মে সকলেরই অধিকার আছে।

বিশেষ ধৰ্ম্মে অধিকারি ভেদ আছে। ব্রাহ্মণের ধৰ্ম্মে ক্ষত্রিয়ের অধিকার নাই, ক্ষত্রিয়ের ধৰ্ম্মে বৈশ্যের অধিকার নাই, গৃহীর ধর্মে ব্রহ্মচারী অধিকারী নহে; ইত্যাদি। বিশেষ ধর্ম নানা; এ প্রসঙ্গে তাহা দেখাইবার প্রয়োজন নাই। তবে এই মাত্র বলা আবশ্যক যে, চতুর্বর্ণের  বিশেষ ধৰ্ম্মে হীনজাতির অধিকার নাই; চণ্ডালাদির যে বিশেষ ধৰ্ম্ম, তাহাতে ম্লেচ্ছ পর্য্যন্ত অধিকারী।

গঙ্গাস্নান, হরিনাম, শিবপূজা, শারদীয় দুর্গাপূজা এইসব ধৰ্ম্মকাৰ্যে, ম্লেচ্ছ পর্য্যন্ত অধিকারী। তবে শৌচহীন হইলে কোন কৰ্ম্মেই অধিকার নাই। দেবদ্বিজে ভক্তি, গো-সেবা সকলেরই ধৰ্ম্ম। স্ত্রীলোক রক্ষা, বালক রক্ষা এবং গোরক্ষার জন্য প্রাণত্যাগ করা চণ্ডাল ম্লে চ্ছপ্রভৃতি হীনজাতির স্বর্গ প্রাপ্তির হেতু।

অন্ধা: ক্লীবা জড়া ব্যঙ্গা:পতিতাযোগিনাহন্তজা:।

গঙ্গাবং সৎসেব্য পুরুষা দেবৈর্গচ্ছন্তি তুল্যতাম।

প্রায়শ্চিত্ততত্ত্বধৃত মহাভারত।

ভাগবত, নারদীয়পুরাণ ও হরিভক্তিবিলাসে হরিনাম মানবমাত্রেরই পাপনাশকও মঙ্গলপ্রদ ইহা বারবার উক্ত হইয়াছে।

যে কীর্ত্তয়ান্তি সততং দেব-দেবং মহেশ্বরম।

ন মোহমধিগচ্ছন্তি যেহপি স্যূ: পাপযোনয়: ।

                                                    শিবপুরাণ। 

সর্ব্বেষমধিকারোহস্থি শঙ্করস্য প্রপূজনে।

এবং নানা ম্লেচ্ছগণৈঃ পূজ্যতে সর্বদস্যুভিঃ।।

শরৎকালীনপূজামধিকৃত্য ভবিষ্যপুরানাম,—

ব্রাহ্মণার্থে গবার্থে চ দেহত্যাগোহনুপস্কৃত:।

স্ত্রীবালাভ্যুপপতৌ চ বাহ্যানাং সিদ্ধিকারণম।

                                                      মনু

আমাদের ধর্ম, মুষ্টিমেয় হিন্দুর জন্য নহে, সৰ্ব্ব জাতির জন্য। সকলেই আসিয়া এই ধৰ্ম্মতরূর ছায়ায় শীতল হইতে পারে। সকলের জন্যই এই ধৰ্ম্ম-মহানগরের মহাদ্বার সতত উন্মুক্ত। কেহ ভীত হইও না, কেহ পশ্চাৎপদ হইও না। অভিমান, অহঙ্কার পরিত্যাগ করিয়া, শাস্ত্রের আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া, অবনমস্তকে এই মহাধর্মের শরণাগত হও; হে বৌদ্ধ, মুসলমান, বন্য, খ্রীষ্টান ! সকলেই এ ধর্মের আশ্রয়ে আসিতে পারিবে। তবে অধিকারি ভেদ সকলকেই মানিতে হইবে, সামান্য ধর্ম ও অধিকারানুরূপ বিশেষধৰ্ম্ম – সকলকেই পালন করিতে হইবে। তুমি  লোকব্যবহারে হিন্দু হও, না হও, জাবনিক হিন্দু নামে তুমি সম্মানিত হও, না হও, শাস্ত্রোক্ত ধর্মের মধুর আস্বাদ লাভে কৃতার্থ হইবে।  পরম মঙ্গলময় মহাধর্মের মন্দিরে উপবিষ্ট হইয়া সকল যন্ত্রনা হইতে মুক্তি লাভ করিবে।

তোমরা লোকের মুখে হিন্দু না হও, বিধাতার কাছে হিন্দু হইবে। কিন্তু মনে রাখিবে, শাস্ত্র যাহার যে ধর্ম নির্দেশ করিয়াছেন, তাহাকে সেই ধৰ্ম্মই পালন করিতে হইবে।

[*](* সত্ত্ব, রজঃতমঃ)

[†]* রাজকশ্চর্মকারশ্চনটোবরুড়এষচ:।

কৈবর্ত্তমেদভিল্লাশ্চসপ্তইতেচান্তজা: স্মৃতা:।যম।

জলপাইগুড়ি অঞ্চলে একজন রাজবংশী (তিওর )জাতীয় জমিদার মৃত্যুকালে দত্তকের অনুমতি দিয়া যান। জমিদার –পত্নী দত্তক নিলেন। ভ্রাতুস্পুত্র দত্তক সম্বন্ধে কি কি আপত্তি করে। শেষে বিলাতে তাহার চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়, রাজবংশী জাতি হিন্দু নহে, বন্য। অতএব হিন্দুশাস্ত্র সম্মত দত্তকে রাজবংশীর অধিকার নাই। সাহেবরা এই পার্থক্য যে কেন করেন, তাহা বুদ্ধিমানের অবিদিত নাই।