মরুভূমি বনাম নদী, বাইনারি বনাম বহুত্ববাদ – দ্বিতীয় পর্ব

0
902

(প্রথম পর্বের পর)

এবিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে যাবতীয় মনুষ্যসৃষ্ট মতবাদ, দর্শন, ধ্যান ধারণা, সংস্কৃতি এমনকি বিজ্ঞান চিন্তা এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও প্রকৃতির অবদান অবিসংবাদিত। আপেলটি কেন উর্ধ্বমুখী না হয়ে নিম্নমুখী হল এমন একটি প্রকৃতি সঞ্জাত ঘটনা থেকেই মাধ্যাকর্ষণের আবিস্কার — এই জাতীয় স্থূল প্রতীতিকে প্রশ্রয় না দিয়েও বলা যায় — Necessity is the mother of invention, অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী মানুষ প্রয়োজন অনুসারেই তাদের জীবন ধারণের উপযোগী সামগ্রী, ধ্যান ধারণা, সংস্কৃতি এবং মতবাদের আবিস্কার তথা জন্ম দিয়েছিল। এই কারণেই আদিমতম মানব সভ্যতাগুলির বৈশিষ্ট্য, ধরনধারণে বিস্তর প্রভেদ লক্ষ করা যায়। নদীমাতৃক সভ্যতাগুলি যেমন হরপ্পা/ সিন্ধু সভ্যতা, মেসোপোটেমিয়া কিম্বা মিশরীয় অথবা আরও পরে চীনা সভ্যতা — এই চারটি সভ্যতার মধ্যে যেমন সাদৃশ্য ছিল, বৈসাদৃশ্যও কম ছিলনা। আর মরু কেন্দ্রিক সভ্যতা, সংস্কৃতির সঙ্গে তুলনামূলক বৈসাদৃশ্য যে অনেক বেশি প্রকট হবে তা বলাই বাহুল্য। আবার নাতিশীতোষ্ণ পরিমণ্ডলে যে যাপন, দর্শন অথবা মতবাদের আবির্ভাব ঘটেছে, চরম জলবায়ুতে ( অর্থাৎ অতি উষ্ণ,অথবা অতি শীতল) ভিন্ন এমনকি বিপরীত ধর্মী হওয়ারই সম্ভাবনা। মোদ্দা কথা প্রকৃতি সঞ্জাত নয় এমন কোনো সংস্কৃতি, দর্শন, মতবাদ, ধর্ম, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব এমনকি কল্পনারও অস্তিত্বও নেই।

মনুষ্যসমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করার বাইনারিটিও কি তবে প্রকৃতি সঞ্জাত? আপাতদৃষ্টিতে তাই। প্রকৃতি স্বয়ং এক অনন্ত বাইনারির ভাঁড়ার। সমগ্র সৃষ্টিজগতই এই দ্বৈততার পূজারি। জল / স্থল, আলো/ অন্ধকার, নারী/ পুরুষ, জন্ম/ মৃত্যু, কঠিন/ তরল, জীব/ জড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক বাইনারি থেকেই মনুষ্যসৃষ্ট দ্বৈততার আত্মপ্রকাশ ধরে নিলে ভুল হবেনা৷ পাপ/ পূণ্য, ধর্ম/ অধর্ম, সৎ / অসৎ, সুখ / দুঃখ, ইত্যাদি বাইনারি প্রতীতিগুলিও নিঃসন্দেহে প্রকৃতি সঞ্জাত। কিন্তু এসব তো নিছক মূল্যবোধ, নৈতিকতার রূপরেখা, যা সভ্যতার জন্মলগ্নেই আত্মপ্রকাশ করে। ধর্ম বা মতবাদের উপর ভিত্তি করে মানব সমাজকে কঠোর এবং সুনির্দিষ্টভাবে বিভক্ত করার সূত্রপাত ঘটায় আব্রাহামিক ধর্ম। ইসলাম এটিকেই চরম তীব্রতায় পৌঁছে দেয়। পরবর্তীতে মার্ক্স, এঙ্গেলসও কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে ( বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে উৎখাত করে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো এই মহান পুস্তিকাটি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়) এই বাইনারিটিকেই অর্থনৈতিক ভিত্তি দেওয়া হয়। অর্থাৎ মুসলমান / কাফের নামক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইনারিটি আর্থসামাজিক রূপ গ্রহণ করে। বলাই বাহুল্য ধর্ম হিসেবে ইসলাম এবং মতবাদ হিসেবে মার্ক্সবাদ উভয়কেই বিজ্ঞানসম্মত এবং প্রকৃতি সঞ্জাত সত্য বলে দাবি করা হয়। ইসলাম অনুগামীরা কোরানকে সৃষ্টিকর্তার অভ্রান্ত বানী মনে করেন। অতএব এটি হল চিরন্তন শাশ্বত সত্য। মার্ক্সবাদ ডায়ালেক্টিক্স ( dialectical materialism) অর্থাৎ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিছক প্রকৃতি সঞ্জাত নয়, সমগ্র বিশ্ব ব্রম্মাণ্ডই এই dialectics অনুযায়ীই পরিচালিত হচ্ছে। অতএব এটি অভ্রান্ত, সমস্ত সন্দেহের উর্ধ্বে৷ এমন দাবিই করা হয়।

বলাই বাহুল্য আব্রাহামিক কিম্বা মার্ক্সীয় কোনো ক্ষেত্রেই এই ” প্রকৃতি সঞ্জাত” বাইনারি চিরস্থায়ী হয়নি। প্রথম দিকে একটি আপাত সুসংহত প্রভেদরেখা তৈরি করা সম্ভব হলেও কলেবর এবং ব্যাপ্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান / ইনফিডেল, মুসলমান/ কাফের, প্রলেতারিয়েত/ বুর্জোয়া — দ্বৈততা ছত্রখান হয়ে ভেঙে পড়েছে। খ্রিস্টানরা যেমন একত্রিত হয়ে বিশ্ব শাসন করতে পারেনি, মুসলমানরাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাফের বিশ্বকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে। মার্ক্সবাদীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তথাকথিত সর্বহারার সংখ্যা বুর্জোয়াদের তুলনায় শত সহস্র গুণ বেশি হওয়া সত্ত্বেও কম্যুনিজমের স্বপ্ন আজও অধরা। কেন এমন ঘটল? কারণ সহজবোধ্য। মানুষকে দ্বিধাবিভক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্ট এই দ্বৈততাগুলি সুকঠিন আইডেন্টিটি হিসেবে নির্মিত হলেও কালক্রমে তরল হয়ে পড়ল। সংজ্ঞা নিরূপণে প্রাথমিকভাবে যে উপাদানগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল যেমন খ্রিস্টান হয়ে ওঠার শর্তাবলি, মুসলমান বলতে কী কী বৈশিষ্ট্য বাধ্যতামূলক অথবা খাঁটি মার্ক্সবাদীর নির্ণায়ক কি, প্রলেতারিয়েতের মধ্যে কোন কোন আর্থ সামাজিক উপাদান থাকবে, সময় প্রবাহের ফলশ্রুতিতে এই শর্তাবলীতে বিবিধ জটিলতা এবং নতুন নতুন অনুসঙ্গ ঢুকে পড়ে। বাইনারি কেন্দ্রিক এই ধর্ম বা মতবাদগুলি সৃষ্টিলগ্নে কেবল দিশা, লক্ষ্য এবং পরিপূর্ণ আনুগত্যের উপরই মাত্রাতিরিক্ত জোর দিয়েছিল। শুধুই একটি প্রতীতির উপর গড়ে ওঠা আইডেন্টিটি যে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনা, চিরস্থায়ী তো দূরের কথা, প্রণেতারা ভেবে দেখেননি বা এগিয়ে ভাবার মত দূরদর্শিতা তাঁদের ছিলনা। প্রাথমিক অবস্থাতে সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যে ( যারা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের অধিবাসী ছিল, অভিন্ন শারীরিক, জাতিগত, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বহন করছিল) এই ধর্ম, মতবাদগুলি একটি monomorphic ( এক আকৃতির) জীবনাচরণ এবং সংস্কৃতি নির্মাণে সক্ষম হয়েছিল।

জেরুজালেম, বেথলেহেমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা খ্রিস্টান ধর্ম, মক্কা মদিনাকে তথা মধ্য প্রাচ্যকে কেন্দ্র করে নির্মিত ইসলাম, প্রাথমিক অবস্থায় যথেষ্ট ঐক্যবদ্ধতা দেখিয়েছিল। তার মূল কারণ অবশ্যই অপেক্ষাকৃত অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা, ধর্মের অভিনবত্ব, আপাত উতকৃষ্টতা ( যা একান্তই সমসাময়িক, কোনোমতেই চূড়ান্ত নয়) এবং সর্বোপরি বিজ্ঞান তথা সমাজ চেতনার অভাব। মার্ক্সবাদের প্রাথমিক সাফল্যের কারণও তাই। কালপ্রবাহের সঙ্গে যখন অনুসারীদের সংখ্যা হাজার থেকে লক্ষ, লক্ষ থেকে নিযুত, নিযুত থেকে কোটিতে পৌঁছে গেল, আপাত কঠিন আইডেন্টিটিগুলি তরল হতে শুরু করল। মনোমরফিক আবরণ ভেদ করে ভেতরের রক্ত মাংস, হাড় কংকাল বেরিয়ে পড়ল। এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন রেইস, ( race), ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির বিভিন্নতা ধর্মে, মতবাদে প্রভাব ফেলল। জেরুজালেমের খ্রিস্টান এবং রোমের খ্রিস্টানের অভিন্ন থাকলনা, নাইজেরিয়ার খ্রিস্ট উপাসকটি আরও ভিন্ন হয়ে পড়ল। দেশ কাল বর্ণ, সংস্কৃতি ভেদে খ্রিস্টানদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের একতা চূর্ণবিচূর্ণ হল। আবির্ভাব ঘটল রোম্যান ক্যাথলিক, প্রোটেস্টেন্ট, ক্যালভিন , লুথারপন্থী নামে অজস্র ভাগ উপভাগ৷ অসলোর মুসলমানটি যেমন মক্কা মদিনার সাহাবী হয়ে উঠতে পারলনা, শাহজাদা দারা শিকোও মহম্মদ বিন কাশেম হয়ে উঠতে পারলেননা, অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা বাংলাদেশি মুসলমানটিও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিজেকে অভিন্ন ভাবতে অসমর্থ হল। সিরিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তান থেকে ইউরোপে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীরা যেমন মূলস্রোতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, স্থানীয় মানুষের উষ্মার কারণ হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ ধর্মকে ছাপিয়ে সামাজিক প্রগতির সূচকটিই সামনে চলে আসছে। এই সূচকে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশি মুসলমান রোহিঙ্গাদের আর ধর্ম ভাই ভাবতে পারছেনা। আর একটি কারণ জাতীয়তাবোধ, যা ধর্মীয় উম্মতকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।
চট্টগ্রাম টেকনাফে আশ্রয় নেওয়া এগারো লক্ষাধিক রোহিঙ্গার কার্যকলাপ গভীর উদবেগের জন্ম দিয়েছে। অত্যধিক জন্মহার, মাত্রাতিরিক্ত অপরাধ প্রবণতা ( পারস্পরিক হিংসাতেই ৪২ জন নিহত, পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে আরও ৩২ জন), স্থানীয় অধিবাসীদের অকারণ আক্রমণ ও হত্যা, ধর্ষণ, ইয়াবা চোরাচালান ইত্যাদির ক্রমবর্ধমান হারে স্থানীয়দের নাভিঃশ্বাস উঠেছে। রোহিঙ্গা জন্মহার নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিদ্রুপ আর ট্রোল বেড়েই চলেছে। অথচ একটু ভাবলেই বোঝা যায় একসময় স্থানীয় বাংলাদেশিরাও রোহিঙ্গাদের স্তরেই ছিল। জন্মহার, অপরাধ প্রবণতা, হিংস্রতা। নির্যাতিত হিন্দু সংখ্যালঘুরা (যারা অবশ্যই মুসলমানদের তুলনায় অগ্রবর্তী) তা হাড়ে হাড়ে বোঝে। নোয়াখালির মত তীব্র না হলেও এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এখনও বন্ধ হয়নি। কিন্তু রোহিঙ্গা তাণ্ডবের সম্ভাব্য মাত্রার তুলনায় সেটি শিশু মাত্র। তাই স্থানীয় মুসলমানরাও রোহিঙ্গাদের ভয় পাচ্ছেন।

” ওরা ( পড়ুন রোহিঙ্গা) কয়েক ঘন্টার মধ্যে পাঁচ লক্ষ লোক জড়ো করে ফেলেছে, কোনো রাজনৈতিক দল, ইসলামি সংগঠন দু লাখ লোকের জমায়েত করতেই হিমসিম খায়। “

রোহিঙ্গাদের ডাকা একটি জমায়েত দেখার পরসিংহভাগ বাংলাদেশিই এমন একথা বলছেন। কিন্তু কেন? ওই যে অগ্রগতি! শিক্ষা, প্রগতির স্পর্শ মানেই ক্রমহাসমান গোষ্ঠীবদ্ধতা।মানুষ যতই আলোকপ্রাপ্ত হয়, সে ততই চিন্তাশীল এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হয়ে ওঠে। অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক এই উপাদানটিকেই edu-cultural phenomenon বলা যেতে পারে যা এই বাইনারি কেন্দ্রিক ধর্ম, মতবাদকে শতধা বিভক্ত করে ছেড়েছে।

ইসলামই হোক অথবা মার্ক্সবাদ, এই জাতীয় মতবাদের প্রবক্তারা সমকালের নিরিখে নিজ নিজ পরিমণ্ডলে অবশ্যই এগিয়ে ছিলেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রেই মৌলিক চিন্তনও করেছিলেন, কিন্তু শিক্ষা, বিজ্ঞান চেতনা এবং প্রযুক্তির বিস্তার যে সযত্নলালিত সমীকরণগুলিকে তছনছ করে দেবে, স্বপ্নেও ভাবেননি। শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়া বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি তথা মুক্তচিন্তার ফলে মার্ক্সবাদের মত রেজিমেন্টেড মতবাদটিও দেশ কাল ভেদে অজস্র রাজনৈতিক দল এবং স্থান কাল পাত্র ভেদে শতধাবিভক্ত হল। মার্ক্সবাদের প্রায়োগিক রূপ লেনিনবাদেও সে থেমে থাকলনা। মাওবাদের আবির্ভাব হল। আর সেই মাওবাদকে ভিত্তি করে দেশে দেশে জন্ম নিল উগ্র বামপন্থার রক্তপিপাসু মুখ, যা নকশালপন্থী নামে এদেশেও বিকশিত হল। এখানেই থামলনা। এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, চার থেকে আট — জন্ম দিল অসংখ্য দল, উপদল ইংরেজি পরিভাষায় ফ্যাকশন! শুরু হয়ে গেল infighting বা অন্তর্দ্বন্দ্ব। নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের পুলিশের হাতে যত সংখ্যক নকশাল মরেছে, ফ্যাকশন ফাইটে নিহত হয়েছে তার কয়েক গুণ।

ইসলামের অবস্থাও তাই। নবী তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে শিয়া, সুন্নি নামক দুটি চরম শত্রুভাবাপন্ন সেক্ট-এ ইসলাম দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল। ভাগ উপভাগ বেড়েই চলল। শিয়ারাও এখন তিনটি উপভাগে বিভক্ত — জাইদিয়াহ, ইসমাইলিয়াহ এবং জা’ফরিয়াহ! সুন্নিরা চারটি — হানাফি, হানবালি, সাফেয়ি, মালিকি। এছাড়াও আছে উগ্রতম ওয়াহাবি / সালাফি এবং উদারবাদী আহমেদিয়া, সুফি! ইসলাম বিশ্বের সিংহভাগ আহমেদিয়া, সুফিদের মুসলমানই মনে করেনা। এঁরা প্রতিনিয়ত আক্রমণের শিকার হন। আর বাংলাদেশ? সেখানে উম্মত ঐক্যের কী অবস্থা? ইসলামিক ব্রাদারহুড কতটা মজবুত? রোহিঙ্গা আগমন তো সাম্প্রতিক ঘটনা! নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামি একতার কী শোচনীয় অবস্থা দেখুন! হেফাজতে ইসলাম পাঁচ ভাগে বিভক্ত, ইসলামি ঐক্যজোট চার ভাগ, খেলাফত মজলিস তিন ভাগ, খেলাফত আন্দোলন দুই ভাগ, জামায়াতে ইসলামি দুই খণ্ড, তাবলীগ জামায়াত দুই ভাগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামে চার ভাগ! এত ভাগ উপভাগ হয়ে গেলে যে এক ডাকে পাঁচ লক্ষের জমায়েত সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য। রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশি মুসলমানের মত সুন্নি ইসলামের অনুসারী। কিন্তু শিক্ষা, বিজ্ঞান চেতনার অভাব, সুতীব্র স্বজাত্যবোধ (এরা নিজেদের স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করে) সব মিলিয়ে একটি উগ্র আইডেনটিটির জন্ম দিয়েছে যা নিছক ধর্মীয় পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। ইসলামি ভ্রাতৃত্বের সুমুধুর সংলাপ শুনিয়ে তাদের আস্থা অর্জন করা অসম্ভব। শিক্ষা, বিজ্ঞান চেতনায় অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা বাংলাদেশি মুসলমানরাও তাদের নিজের অংশ হিসেবে মানতে পারছেনা। তাদের আচরণে অপরিসীম ঔদ্ধত্য চোখে পড়ছে। ফলশ্রুতি হিসেবে রোহিঙ্গারা নিজস্ব ভূখণ্ডের দাবি তুলেছে। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে, যা আগামীতে যে বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশে তীব্র সংঘাত এবং জটিলতার জন্ম দেবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইসলামই হোক আর মার্ক্সবাদ, নরমপন্থী, মডারেটদের সঙ্গে চরমপন্থীদের সংঘাত অনিবার্য। এ সংঘাত নিছক মতাদর্শের কারণে নয় edu -cultural উপাদানটির ভূমিকাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি মুসলমানদের সৌদি আরব নিকৃষ্ট মনে করে৷ পরিচারক, পরিচারিকা হিসেবে ওদেশে কাজ করতে যাওয়া বাংলাদেশিরা তা হাড়ে হাড়ে বোঝে।

কিন্তু প্রাকৃতিক, বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবি করা এই বাইনারি কেন্দ্রিক ধর্ম বা মতবাদ ভারতবর্ষ নামক দর্শন এবং চিন্তনের সূতিকাগারটিতে প্রকাশ পেলনা কেন? এদেশে যে বিপুল দর্শন, বৈদিক, লোকায়ত, কাব্য, মহাকাব্যের আত্মপ্রকাশ এবং সৃজন ঘটেছিল, যুগপৎ আস্তিকতা নাস্তিকতা,অজ্ঞেয়বাদ, সন্দেহবাদ বেদান্ত উপনিষদের অসীম সম্ভার, এইসব বিপুল এবং বিচিত্র জ্ঞান ভাণ্ডারের স্রষ্টা মুনি, ঋষিরা কেউই এই প্রাকৃতিক দ্বৈততাটি দেখতে পেলেননা? যা আব্রাহামিক ধর্মগুলি এমনকি মার্ক্স, এঙ্গেলসও অবলীলায় বুঝে ফেললেন এবং মানবজাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেললেন!

আমার দৃঢ় বিশ্বাস এখানেও প্রকৃতি এবং জলবায়ুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এদেশের নাতিশীতোষ্ণ পরিমণ্ডল এবং ঋতু বৈচিত্র্যের মধ্যেই এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে যা চরম জলবায়ুর আরব মরুভূমিতে উৎপন্ন প্রতীতির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। নদীহীন, স্রোতহীন মরুদেশের দ্বিমাত্রিকতা ( দিনে তীব্র দাবদাহ, রাতে সুতীব্র শীতলতা) থেকে বহুদূরে এই বহুমাত্রিক ভারতবর্ষ। জল, মাটি,নদী, সমুদ্র, পাহাড় পর্বতে খেলে বেড়ানো রামধনুর মত ঋতুরঙ্গ প্রকৃতির বুকে বাইনারি বা দ্বৈততা নয়, বহু-র সন্ধান পেয়েছিল। প্রকৃতির উপাসনা দিয়ে যাত্রা শুরু করা এই প্রাচীনতম সংস্কৃতিই তার উত্তরাধিকারীকে দিয়ে বলিয়ে নিতে পারে – “বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি, কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”
স্থূল, কঠোর একেশ্বরবাদ নয়, বহু-র ভেতরে সেই একমেবাদ্বিতীয়ম শক্তির অনুসন্ধান। এখানে শংকরাচার্য আছেন, রামানুজমও আছেন, কপিল আছেন, চার্বাকও আছেন। উত্তর মীমাংসা দর্শন মতে ব্রহ্ম সত্যং, জগন্মিথ্যা; জীবঃ ব্রম্মৈব নাপরঃ – এর মত বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদ যেমন আছে, তেমনই আছে জীব সেবাই শিব সেবা-র মত সর্বেশ্বরবাদ বা pantheism কে এক নির্মল মানবিক উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া। “বহিরাগত ” তকমা লাগিয়ে দেওয়া আর্যরাই ( যারা আসলে একটি ভাষাগোষ্ঠীর প্রতিনিধি) সমগ্র বিশ্বে বহুত্ববাদ তথা সর্বেশ্বরবাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। মেসোপোটেমিয়া থেকে মিশর, ইরান থেকে গ্রীস, সিন্ধু থেকে আফগানিস্তান সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে আর্য সংস্কৃতির বিজয়রথ। প্রখ্যাত নৃতত্ববিদ, ভাষাবিদ এবং ঐতিহাসিক Asko parpola তাঁর The roots of Hinduism : The Early Aryans and the Indus Civilisation গ্রন্থটিতে দাবি করেছেন সিন্ধু, হরপ্পা সভ্যতাও আর্য সভ্যতা ছিল। নিছক দাবি নয়, যথোপযুক্ত এবং যথাযথ তথ্য এবং বিশ্লেষণ সহকারে সেটি প্রমাণও করেছেন। নিম্নলিখিত পর্যবেক্ষণটিই ( এই বই থেকেই) সেই উপলব্ধিকে নির্দেশ করে —

” Hinduism has two major roots. The more familiar is the religion brought to South Asia in the second millennium BCE by speakers of Aryan or Indo- Iranian languages, a branch of the Indo- European language family. Another more enigmatic root is the Indus civilisation of the third millennium BCE, which left behind exquisitely carved seals and thousands of short inscriptions in a long forgotten pictographic script.”

যাঁরা সিন্ধু সভ্যতাকে দ্রাবিড় সভ্যতা বলে দাবি করে থাকেন, তাঁদের প্রশ্ন করুন দক্ষিণ ভারতের সুবিস্তৃত দ্রাবিড় জনপদে সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক তো দূরের কথা, পরবর্তীতেও এ জাতীয় একটিও নমুনার দেখা মেলেনা কেন?

পৃথিবীর প্রাচীনতম চারটি মহাকাব্য ( রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি), দর্শন, জ্ঞান, বিজ্ঞানের অমিত ভাণ্ডার এবং তাঁদের প্রবক্তা, প্রণেতা যাজ্ঞবল্ক্য থেকে সক্রেটিস, কপিল থেকে প্লেটো, বিশ্বামিত্র থেকে জরাথুস্ট্র, এরিস্টটল থেকে ভাস্করাচার্য সবাই এই মহান আর্য সভ্যতারই প্রতিনিধি ছিলেন। আর্য polytheism ( বহু ঈশ্বরবাদ) এবং pantheism (সর্বেশ্বরবাদ) এর শেকড় থেকেই মানতাবাদী, উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আবির্ভাব যাকে আমরা গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসি নামে ডাকি। Democracy ( demos + cracy অর্থাৎ জনগণের শাসন) শব্দটির জন্ম গ্রীসে হলেও প্রাচীন আর্যদের গ্রাম ব্যবস্থার মধ্যেই এর বীজ নিহিত ছিল।
তবু প্রশ্ন জাগে এত বিচিত্র, বহুমুখী দর্শন, অধ্যাত্ম চিন্তায় ব্যাপৃত প্রজ্ঞাবান আর্যকুলের কেউই এই বাইনারিটির সন্ধান পেলেননা? প্রকৃতির কোল থেকে আহৃত এই “বিজ্ঞানসম্মত” প্রতীতি ব্যবহার করে মানব সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করার মতবাদ কারও মস্তিষ্কেই স্থান পেলনা? প্রশ্নটি যথেষ্ট ভাবায়৷ যদিও সামান্য অনুসন্ধানেই এর উত্তর মেলে৷ বেদ, উপনিষদের মুনি, ঋষিরাও প্রকৃতির কোলে বিরাজমান অথবা সংঘটিত দিন রাত্রি, আলো অন্ধকার, জীবন মৃত্যুর দ্বৈততাগুলি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু ভূপ্রকৃতি এবং জলবায়ুর কারণ, এবং যুগপৎ মেধা ও মননের সান্নিধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন আপাতভাবে বাইনারি মনে হলেও বাস্তবিকপক্ষে এই মহাবিশ্বে দ্বৈততার কোনো স্থান নেই। যা আছে সকলই বহু। দূরদৃষ্টির অভাবে বাইনারির ভ্রম হয় মাত্র। দিন রাত্রির মাঝে ভোর আছে, আছে গোধুলিও। নারী পুরুষের মাঝে কিন্নর ( হিজড়া) আছে, আলো অন্ধকারের মাঝে ছায়া, প্রচ্ছায়া। গ্রীষ্ম এবং শীতের মাঝখানে আরও চার চারটে ঋতু! শুধু তাই নয়, জন্ম মৃত্যুর মধ্যেও সমাধি নামক এক বাহ্যজ্ঞানহীন দশা অর্জন করা সম্ভব যার মাধ্যমে জীবাত্মা পরমাত্মায় বিলীন হতে পারে। অর্থাৎ আপাত দ্বৈততাকে অতিক্রম করে বহু-র সমাবেশকে প্রত্যক্ষ করার প্রজ্ঞা তাঁদের ছিল। শুধু তাই নয়, আবার এই বহু-ই যে সেই অনন্ত সচ্চিদানন্দ পরম ব্রম্মের রূপ আপাত খণ্ডিত প্রতিবিম্ব এই সত্যও তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন। সমগ্র বিশ্ব ব্রম্মাণ্ডকে একটি অবিভাজ্য সত্ত্বা ( indivisible entity) হিসেবে দেখাই সনাতন সংস্কৃতির মূল সুর যা ভারতবর্ষ তো বটেই সমগ্র আর্য সংস্কৃতিতেই উচ্চারিত হয়েছে। এই সুরটি মাঝেমধ্যে অন্তঃসলিলা হয়ে গেলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি। আব্রাহামিক মতবাদের ঘেরাটোপ অতিক্রম করে সাহিত্যে শিল্পে বার বার ফিরে এসেছে। খ্রিস্টান ধর্মের ধারক, বাহক হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেনে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ব্লেক-এর মত প্রজ্ঞাবান কবি দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতির পূজারী রোম্যান্টিক কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর The World Is Too Much with Us [১৮০২] শীর্ষক সনেটে লিখেছেন —

Great God! I’d rather be
A Pagan suckled in a creed outworn;
So might I, standing on this pleasant lea,
Have glimpses that would make me less forlorn;
Have sight of Proteus rising from the sea;
Or hear old Triton blow his wreathèd horn.

স্থূল ভোগবাদিতাকে প্রত্যাখ্যান করে কবি পেগান [ polytheist অর্থাৎ বহু ঈশ্বরবাদীদের pagan বলা হয়] সংস্কৃতিতে ফিরতে চাইছেন। প্রোটিয়াস [ Proteus], ট্রিটন [Triton] এই দুই গ্রীসিয় দেবতার উল্লেখ এবং পলিথিস্ট সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ খ্রিস্টান ধর্মের বিপরীতে হাঁটা। অর্থাৎ এই সনেটটিতে স্পষ্টতই আব্রাহামিক ধর্মের বিরোধিতা পরিলিক্ষিত হয়।

প্রাক রোম্যান্টিক [ precursors of Romanticism] কবি উইলিয়াম ব্লেকও অভিভাজ্য পরম ব্রহ্মের সত্যটি উপলব্ধি করেছিলেন। বাইবেল এবং যীশুর অনুষঙ্গ থাকলেও তাঁর Tyger [Tiger] এবং The Lamb [ Songs of Innocence and of Experience [ 1794] কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত] কবিতাদুটিতে সাধারণ দুটি বাইনারির মাধ্যমে ( মেষশাবক এবং ব্যাঘ্র) এই সত্যটিকেই তুলে ধরা হয়েছে। অহিংস, নিরীহ মেষশাবক এবং হিংস্র, মাংসাশী বাঘ উভয়েই এই indivisible entity এর অন্তর্গত। আপাতদৃষ্টিতে এদেরকে যতই বিপরীত এবং পরস্পরবিরোধী মনে হোক, উভয়েই অভিন্ন সৃষ্টিকর্তার নির্মাণ। প্রকৃতিতে উভয়েরই অবিসংবাদিত আবশ্যকতা আছে। মেষ শিশু এবং বাঘ contrasting বা confronting ( সংঘাত ধর্মী) binary নয়, বরং complimentary ( পরিপূরক) দ্বৈত।
আব্রাহামিক দৃষ্টিকোণ অথবা মার্ক্সবাদী চিন্তন এখানেই একটি বড় ভুল করে বসে৷ প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে স্থূল দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের ফলে আপাত বাইনারিগুলিকেও পরস্পরবিরোধী বা সংঘাত ধর্মী ধরে নেওয়া হল। বাস্তবে আলো- অন্ধকার, জন্ম- মৃত্যু, জল -স্থল ইত্যাদি একে অপরের পরিপূরক এবং অভিন্ন। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটির অস্তিত্ব অসম্ভব। কিন্তু ইহুদি- অইহুদি, খ্রিস্টান ইনফিডেল, মুমিন কাফের, প্রলেতারিয়েত বুর্জোয়া — এই দ্বৈতগুলিকে একে অপরের পরিপূরক (complimentary) না ভেবে, পরস্পরবিরোধী,সংঘাতময় ( confronting) বাইনারি হিসেবে উপস্থিত করা হল। শুধু তাই নয়, খ্রিস্টান, মুসলমান এবং মার্ক্সবাদীরা সোচ্চারে জানিয়ে দিল বিরুদ্ধ শ্রেণিটিকে যেন তেন প্রকারে নিশ্চিহ্ন, নির্মূল না করলে সুদিন আসবেনা। খ্রিশ্চিয়ানিটি ঘোষণা করল এটাই যীশুর ইচ্ছে, ইসলাম জানিয়ে দিল এটাই সৃষ্টিকর্তার আদেশ, মার্ক্সবাদ বলল এটাই সমাজ পরিবর্তনের অনিবার্য অভিমুখ। অতএব বিজ্ঞান। কিভাবে? হত্যা অথবা ধর্মান্তর। আব্রাহামিক ধর্মদ্বয় সেই কাজেই ব্রতী হল। শুরু হল রক্তক্ষয়ী এক অধ্যায়। যার পরিণতি খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ। মার্ক্সবাদে declassed অর্থাৎ বুর্জোয়া থেকে সর্বহারা হওয়ার অপশন দেওয়া হল। সেও এক জাতীয় ধর্মান্তর। যদিও অর্থনৈতিক ভিত্তিতে। রাশিয়াতে বলশেভিক বিপ্লবের তথাকথিত সাফল্যের পর শুরু হল আরেকটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায়, যা অতীতের যাবতীয় নরসংহারকে ছাপিয়ে গেল। কারণ খ্রিশ্চিয়ানিটি অথবা ইসলাম যে সুবিধা পায়নি, মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী মাওবাদীরা পেয়েছিল। নরসংহারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। তরবারি দিয়ে যত মানুষ মারা যায়, রাইফেল, মেসিন গান দিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি নরহত্যা করা যায়। নাজিরা অবশ্য গ্যাস ব্যবহার করেও মাও, স্তালিনের নরসংহারের ব্যাপকতাকে পরাস্ত করতে পারেনি।

অনেকেই বলতে পারেন সনাতন সংস্কৃতির উন্মেষ কালে তার কোনো প্রতিপক্ষ ছিলনা। আর্যদের বেদ, উপনিষদে তাই বিধর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার নেই। আর কোনো ধর্মই ছিলনা! কার বিরুদ্ধে বলবে? কিন্তু আব্রাহামিক ধর্মগুলির আবির্ভাব অনেক পরে। আর ইসলাম তো নবীনতম। অর্থাৎ অন্যান্য ধর্মগুলিকে স্টাডি করেই তার সূত্রপাত। বিধর্মীদের মুণ্ডুপাত না করলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। তাই মানব সমাজের এই বিদ্বেষমূলক বিভাজন। এই পর্যবেক্ষণেও ভ্রান্তি আছে। সনাতন ধর্ম বড় বেশি আচার, যাগযজ্ঞ কেন্দ্রিক হয়ে পড়ায়, জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব। “ব্রাম্মণ্যবাদ বিরোধী ” ধর্ম হিসেবে যাদের বার বার তুলে ধরা হয়েছে।প্রতিবাদী ধর্ম হিসেবে জন্ম হলেও এরা কেউই মারমুখী, হিংস্র হয়ে ওঠেনি। ব্রাহ্মণদের হত্যা অথবা ধর্মান্তরিত করে বৌদ্ধ বানানোর কথাও এরা একবারও উচ্চারণ করেনি। বরং অহিংসা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথই বেছে নিয়েছিল। পরবর্তীকালে আবির্ভূত শিখ এবং বৈষ্ণব ধর্মের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। এরা কেউই উগ্র বাইনারি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেনি। ভিন্ন আইডেন্টিটির জন্ম দিলেও পূর্বসূরিদের নির্মূল করে অমানবিক আধিপত্য স্থাপনের অভিলাষ ছিলনা। ধর্ম বা আইডেন্টিটির ভিত্তিতে মানুষের বৈষম্যমূলক বিভাজনে তাঁদের রুচি ছিলনা। সনাতন ধর্মে কর্মের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র — এই চতুর্বর্ণের সৃষ্টি করলেও তা নিছকই সামাজিক শৃঙখলার স্বার্থে। ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য একজোট হয়ে সমস্ত শুদ্রকে হত্যা করবে এমন কোনো অভিপ্রায়ই ছিলনা। কারণ এই বর্ণগুলি confronting বা contrasting ( সংঘাতমূলক) প্রতীতি হিসেবে নয়, complimentary ( পরিপূরক) শ্রেণিবিন্যাস হিসেবেই গড়ে উঠেছিল।

কর্ম ভিত্তিক বর্ণবিন্যাসটি পরবর্তীতে বিকৃত এবং কায়েমি হয়ে উঠলেও উচ্চবর্গীয়রা কখনও শুদ্র হত্যায় মেতে ওঠেনি, যদিও শাসন তথা রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতেই ছিল। কারণ শুদ্র ছাড়া সামাজিক কর্মকাণ্ডই বিপন্ন হয়ে পড়ত। অর্থাৎ তথাকথিত এই নিম্ন বর্ণটিকে সমাজের অঙ্গাঙ্গী অংশ হিসেবেই ভাবা হয়েছিল। সনাতন ধর্মই বলুন, অথবা তা থেকে উৎসারিত শত সহস্র আইডেন্টিটি — কেউই কাউকে নির্মূল করতে চায়নি। কারণ এই নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু তে, বহুমাত্রিকতার ভূপ্রকৃতিতে কেবল include ই করা যায়, exclude করা যায়না।

এই উগ্র বাইনারির পরিণতি কী? উত্তর ইতিমধ্যেই চোখের সামনে। প্রকৃতি যেহেতু বহুত্ববাদী, আব্রাহামিক এবং মার্ক্সবাদী উভয় বাইনারিগুলিই শতধা বিভক্ত হয়েছে। গোষ্ঠী, উপ দলে বিভক্ত হতে হতে অসংখ্য বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। তাই মুসলমান মানেই আর উম্মতের ভাই নয়। মার্ক্সবাদী মানেই অভিন্ন পথের পথিক নয়। পরিণতি একটিই। নিজেরদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। এই সংঘাতের ফলে মার্ক্সবাদ ধ্বংসের মুখে। খ্রিস্টান ধর্মই সবচেয়ে বেশি নাস্তিক উৎপাদন করে চলেছে। ইউরোপের পাট প্রায় চুকে গেছে। এখন অশিক্ষিত তৃতীয় বিশ্বেই ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান দেখা যায়। ইসলামের ভাঙনও ত্বরান্বিত হচ্ছে। এক্স মুসলিম পরিচয় দেওয়া মানুষের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি, খনিজ তেলের বিকল্প জোরদার হওয়ার আবহে সৌদি আরবও অবস্থান বদলাচ্ছে। আধুনিকীকরণের পথে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। সৌদি জিডিপির ৯০% খনিজ তেলের বিক্রি এবং ১০% হজ্জের উপার্জন। ইতিমধ্যেই বহিরাগত, বিদেশি নাগরিকদের বহিষ্কার করা হয়েছে। কর্মসংস্থানের ৩০% বিদেশিদের দখলে ছিল। বলাই বাহুল্য এদের সিংহভাগই ভিনদেশি মুসলমান। সেই পেশাগুলি এখন দেশীয়দের জন্যই বরাদ্দ করা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলামি উম্মতের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষকটি নিজেই ঘোর সংকটে। পায়ের তলা থেকে দ্রুত মাটি সরে যাচ্ছে।

এটিই প্রকৃতি নির্দেশিত, এটিই ভবিতব্য। নদী মাতৃক সনাতন সংস্কৃতির স্রোত কখনও থেমে থাকেনি। সময়ের দাবি মেনে সে নব নব খাত খুঁজে নিয়েছে। কখনও অন্তঃসলিলা ফল্গু, কখনও খরস্রোতা ব্রম্মপুত্র। হাজার বছরের আব্রাহামিক নিপীড়নও তাকে ধ্বংস করতে পারেনি। আগামীতেও পারবেনা। মরুভূমির উগ্রতায় জন্ম নেওয়া ইসলামে চরৈবেতির স্রোত নেই। যেভাবে খ্রিস্টান ধর্ম বিপন্ন হয়ে পড়েছে। যতটুকু অবশিষ্ট আছে, অর্থের, কর্তৃত্বের জোরে। স্বতঃস্ফূর্ততার লেশমাত্র নেই। সংস্কারের অভাবে অট্টালিকাও ধসে পড়ে, মরুভূমির জাতক ইসলামও সেই পথে চলেছে। কিন্তু মার্ক্সবাদ? সে তো মরুভূমির জাতক নয়। তবে তার মধ্যেও এত উগ্রতা কেন? আব্রাহামিক মতবাদের মত সেও কেন মানুষকে confronting binary তে বিভক্ত করল? তার জন্ম তো ইউরোপে। তাই কী? একটু ভাবলেই বুঝবেন মার্ক্সবাদের শেকড়ও আসলে মরুভূমিতেই। বিস্মিত হবেন না। কার্ল মার্ক্স নামক সর্বহারার দার্শনিকটির ধর্মীয় পরিচয় জানেন নিশ্চয়। তিনি ইহুদি ছিলেন। অর্থাৎ আব্রাহামিক ধর্মের বাতাবরণেই তাঁর বেড়ে ওঠা। যদিও তাঁর বাবা হাইনরিখ মার্ক্স নিজের ধর্মীয় পরিচয় লুকিয়ে রাখতেন। কার্ল মার্ক্স তাঁর তত্ত্বাবধানেই বার বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সেই সময় কি তিনি ইহুদি ধর্ম গ্রন্থ টোরা-র সংস্পর্শে আসেন নি? সেটাই স্বাভাবিক। আব্রাহামিকদের ধর্মশিক্ষা সাধারণত বাড়ি থেকেই শুরু হয়। অনুসন্ধানী পাঠক মাত্রেই জানেন, ইহুদি গ্রন্থ টোরা থেকেই ইসলামের উল্লেখযোগ্য অংশ, নীতি, পর্যবেক্ষণ গ্রহণ করা হয়েছে। ইসলামের সঙ্গে মার্ক্সবাদের এই বিপুল সাদৃশ্য কি এই কারণেই? একে কি নিছক কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়? মানব সমাজকে প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া এই দুটি confronting binary তে বিভক্ত করার সময় তাঁর মনে কি আব্রাহামিক মরু মতবাদ প্রকট বা প্রচ্ছন্ন প্রভাব ফেলেনি? নিঃসন্দেহে ভাবনার রসদ এবং গবেষণার দাবি রাখে

বহুত্ববাদের রঙ মেখেই সনাতন ধর্মের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সে-ই আধুনিক গণতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে। edu- cultural উপাদানটি যত ব্যাপ্ত এবং শক্তিশালী হবে, মানুষ ততই চিন্তাশীল এবং গণতান্ত্রিক হবে। কোনো একদেশদর্শী মতবাদই এর বাইরে নয়। শ্লথগতিতে হলেও ইসলামেও মুক্ত বায়ুর অনুপ্রবেশ ঘটছে। এর ফলেই হাজার হাজার মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করছেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যে। মৌলবাদীদের ভয়ে অনেকেই মত প্রকাশে ভয় পাচ্ছেন। বেশ কিছু মুক্ত চিন্তক, এক্স মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে। এঁরা ইসলামের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। তবে ভয়ের রক্তচক্ষু মহাকালের অভিমুখ বদলাতে পারবেনা । বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং আধুনিক মননের প্রবেশকে রুদ্ধ করার মৌলবাদী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবেই। ইসলাম ভেতর থেকেই ভেঙে পড়বে। সংস্কার না হওয়া গগনচুম্বী অট্টালিকাও যেভাবে ভেঙে পড়ে। সময়ের সঙ্গে বদলাতে না পারলে এই পরিণতিই অনিবার্য। নিজেকে বদলাতে পেরেছিল বলেই খ্রিস্ট ধর্ম যৎসামান্য হলেও এখনও টিকে আছে। আর মাত্র কয়েকটি দশক ইসলাম নামক আব্রাহামিক ঝড়টির মোকাবিলা করতে হবে। তবে আক্রমণাত্মক হয়ে নয়। নিজেদের ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংহত করলেই যথেষ্ট। আত্মরক্ষার ক্ষমতাটিকে শক্তিশালী করতে হবে। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এটিই যুক্তযুক্ত। সেগুন নয়, সজনে গাছেই ঘুণ ধরে। আত্মরক্ষাকে মজবুত করার উদ্দেশ্যেই আধুনিক বিশ্বে defence budget এ বরাদ্দ করা হয়। Offence bugdet বলে কোনো পরিভাষাই নেই। সেই সঙ্গে মতাদর্শগত সংগ্রাম। চিন্তনে আঘাত করতে পারলেই ইসলামি মৌলবাদের পতন ত্বরান্বিত হবে। আন্তর্জাল সহ বিবিধ আধুনিক প্রযুক্তির বিস্তারের ফলে সেই কাজ অনেকটা সহজ হয়েছে। সুফলও মিলছে।

আব্রাহামিক ধর্মই বলুন অথবা মার্ক্সবাদ উভয়েই অন্ধকারের অ্যান্টি থিসিস, যা discrimination এর উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে। আলোর বিপরীতে যেমন অন্ধকার থাকে, অগ্রগতির বিপরীতে পশ্চাৎপদতা। friction ছাড়া যেমন velocity অসম্ভব, দ্বন্দ্ব ছাড়া অগ্রগতিও অধরা। বহুত্ববাদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে এই মতবাদগুলি আসলে এই প্রাকৃতিক নিয়মকেই অনুসরণ করেছে। confronting binary-র জন্ম দিয়েও এরা নিজের অজান্তেই complimentary হয়ে উঠেছে। প্রকৃতিতে বাস করে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ অসম্ভব। থিসিস অথবা সিন্থেসিস হতে না পারলে অ্যান্টি থিসিস হওয়ার পথটিই খোলা থাকে। অন্ধকার ছাড়া আলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হয় এ যেমন সত্য, অন্ধকারকে পরাজিত করেই আলোর বিজয় সম্পন্ন হয়, এও তেমন সত্য। সময়ের অভিমুখ সেদিকেই । মোহম্মদ এবং মার্ক্স উভয়েই মহাকালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। বেঁচে থাকবে সনাতনী আলো। কিন্তু তারপর ? আবার হয়ত নতুন কোনো অন্ধকার আসবে। প্রকৃতিই তাকে জন্ম দেবে। অন্ধকার ছাড়া আলো বাঁচেনা ! বাঁচে কী?