ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুঃ ভূমিকা

0
469

প্রথম পর্বের পর থেকে, শ্রীপ্রফুল্লকুমার সরকারের রচিত গ্রন্থ থেকে।

“ডা. ভগবানদাস বলিয়াছেন, আমি বহু চিন্তার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, হিন্দুধৰ্ম্মের বিকৃতিই হিন্দুদের বর্তমান দুৰ্গতির মূল। এই বিকৃতির জন্যই হিন্দুসমাজ আজ আর একটি সঙ্ঘবদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় নহে,—বহু বিভিন্ন সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সমষ্টি মাত্র। গত আদমশুমারীর রিপোর্ট অনুসারে এই সংখ্যালঘিষ্ট সম্প্রদায়গুলির সংখ্যা দুই হাজার হইতে তিন হাজার পর্য্যন্ত হইবে। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই পরস্পরের “অস্পৃশ্য”, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিহীন, এমন কি অনেক স্থলে পরস্পরের পরিপন্থী। জাতি, উপজাতি, শাখাজাতি এইভাবে হিন্দু- সমাজ ক্রমাগত বিভক্ত, খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন হইয়াছে এবং এখনও হইতেছে। হিন্দুধৰ্ম্মের বিকৃতির ফলেই ৭/৮ কোটি লোক অস্পৃশ্য ও অন্ত্যজ বলিয়া গণ্য, তাহারা হিন্দুসমাজের মধ্যে নামে মাত্র আছে। আরও ৭/৮ কোটি লোক হিন্দুসমাজ হইতে বাহির হইয়া গিয়া মুসলমান হইয়াছে এবং কয়েক কোটি খ্রীস্টান হইয়াছে।

উপরে যাহা বলা হইল তাহার মধ্যে কিছুমাত্র কল্পনা নাই, সমস্তই নিষ্ঠুর সত্য। যাঁহারা হিন্দুসমাজের দুর্গতির কথা চিন্তা করিতেছেন, তজন্য উদ্বেগ বোধ করিতেছেন, তাহাদিগকে ডা. ভগবান দাস জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, কেন এমন হইল ? যদি ইহা হিন্দুধৰ্ম্মের বিকৃতির ফল না হয়, তবে উহার অন্য কি কারণ হইতে পারে ? কেহ কেহ হয়ত বলিবেন,—তৃতীয়পক্ষের প্ররোচনা ও প্রচারের ফলেই এরূপ ঘটিয়াছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের সমাজব্যবস্থার মধ্যেই যদি ক্রটি ও দুর্বলতা না থাকিবে, তবে তৃতীয়পক্ষ তাহাদের অভীষ্ট সিদ্ধ করিতে সমর্থ হইবে কেন ? সুতরাং তৃতীয় পক্ষের স্বন্ধে সমস্ত দোষ চাপাইয়া নিস্কৃতি লাভের উপায় নাই। নিজেদের সমাজদেহেই যে ব্যাধি প্রবেশ করিয়াছে, সৰ্ব্বাগ্রে তাহারই প্রতীকারের ব্যবস্থা করিতে হইবে,—অন্যথা আসন্ন ধ্বংস হইতে হিন্দুসমাজকে রক্ষা করিবার কোন উপায় নাই।

“ডা. ভগবানদাস লিথিয়াছেন,—“আমাকে যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে,— হিন্দুসমাজের এই অনৈক্য, বিশৃঙ্খলতা এবং সঙ্ঘশক্তিহীনতার কারণ কি, তাহা হইলে আমি দ্বিধাহীনচিত্তে উত্তর দিব—প্রাচীন বর্ণাশ্রম ধৰ্ম্মকে বিকৃত করিয়া জাতিভেদে পরিণত করাই ইহার কারণ” প্রাচীন বর্ণাশ্রম ধৰ্ম্ম স্বাভাবিক কৰ্ম্মবিভাগ বা জীবিকাবিভাগের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল; যে যে-কার্য্যের যোগ্য, তাহাকে সেই কার্যের অধিকার দেওয়া হইত। উহা সব সময়ে বংশানুক্রমিক হইত না, অন্ততপক্ষে সেরূপ কোন বাধাধরা নিয়ম ছিল না। কিন্তু উহাই কালক্রমে বিকৃত হইয়া ‘জাতিভেদে’ পরিণত হইল, কৰ্ম্ম বংশানুক্রমিক হইয়া দাঁড়াইল, স্বাভাবিক যোগ্যতা বা গুণের আর কোন মৰ্য্যাদা রহিল না। কোন ব্রাহ্মণ-বংশজাত যতই মূৰ্খ হউক না কেন, বেদাধ্যয়ন, যাগযজ্ঞ, পৌরহিত্যের অধিকার সে পাইবে-ই। ক্ষত্রিয়ের পুত্র কাপুরুষ ও দুর্বল হইলেও যুদ্ধই হইবে তাহার কৌলিক বৃত্তি, বাণিজ্য-বুদ্ধি না থাকিলেও বৈশ্যপুত্রকেই করিতে হইবে শিল্প-বাণিজ্যের দ্বারা জীবিকা- নিৰ্ব্বাহ। এইভাবে—(১) বিভিন্ন বৃত্তিকে অবলম্বন করিয়া বংশানুক্রমিক প্রথার মধ্য দিয়া বহু ‘স্বতন্ত্র জাতি’র সৃষ্টি হইল। বৰ্ত্তমানে হিন্দু- সমাজে এই সব স্বতন্ত্র জাতির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। (২) এই সব জাতি পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিহীন। (৩) প্রত্যেক জাতির মধ্যে স্বতন্ত্র স্বার্থবোধের সৃষ্টি হইল, আর তথাকথিত উচ্চ জাতিরা সেই সুযোগে যতদূর সম্ভব সুখ-সুবিধা, অধিকার নিজেরাই হস্তগত করিলেন এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ ত্যাগ করিলেন। (৪) ঐশ্বৰ্য্য, শাসনক্ষমতা ও কর্ত্তৃত্ব, এমন কি, বিদ্যা পর্য্যন্ত মুষ্টিমেয় কতকগুলি বংশের মধ্যে নিবদ্ধ হইল। (৫) এই সব সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে যোগ্য লোকের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস হইতে লাগিল এবং অযোগ্যের সংখ্যা বাড়িতে লাগিল, কেন না যোগ্যতালাভের জন্য তাহাঁদের কোন প্রয়োজন বা উৎসাহ ছিল না, অযোগ্যতার জন্য ও তাহাদিগকে কোন শাস্তিভোগ করিতে হইত না। (৬) ইহার ফলে সমাজে ক্রমেই অযোগ্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীনের সংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল এবং সমষ্টিগতভাবে সমাজজীবন অধিকতর বিশৃঙ্খল ও সঙ্ঘশক্তিহীন হইতে লাগিল। (৭) দম্ভ, অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য, লোভ, বিদ্বেষ, কাপুরুষতা প্রভৃতি পাপ বুদ্ধি পাইতে লাগিল। (৮) তথাকথিত উচ্চ জাতিরা তথাকথিত নিম্ন জাতিদিগকে সৰ্ব্বদা সন্ত্রস্ত, অবনত এবং বাধ্য রাখিবার জন্য তাহাদের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার সৃষ্টির সহায়তা করিতে লাগিল। (৯) সাধারণভাবে ভারতবাসী এবং বিশেষভাবে হিন্দুরা দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িল এবং বিদেশীরা আসিয়া ভেদনীতির সাহায্যে সহজেই তাহাদিগকে পদানত করিতে পারিল। (১০) বৰ্ত্তমানে হিন্দুসমাজ তথা সাধারণভাবে ভারতবাসীদের মধ্যে যে অসন্তোষ, অশান্তি, বিদ্রোহভাব, পরস্পরের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ এবং বিপর্য্যয়ের লক্ষণ দেখা যাইতেছে,—ইহা পূৰ্ব্বোক্ত ঘটনাসমূহেরই শেষ পরিণতি।

নিজেদের যাহারা হিন্দু বলিয়া পরিচয় দেয়, যতদিন তাহারা নিজেদের এই সব দোষ বা অপরাধ হৃদয়ঙ্গম করিতে না পরিবে এবং উহার প্রতিকারে সঙ্কল্পবদ্ধ না হইবে, ততদিন হিন্দুসমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হইয়াই থাকিবে।

১। ডা: ভগবানদাস—হিন্দুধৰ্ম্ম বলিতে এখানে হিন্দুর সমাজব্যবস্থা বা বর্ণাশ্ৰমধৰ্ম্ম বুঝাইয়াছেন।—লেখক