মরুভূমি বনাম নদী, বাইনারি বনাম বহুত্ববাদ – প্রথম পর্ব

0
464

এই উপমহাদেশের জটিলতম রাজনৈতিক তথা এথনো রিলিজিয়াস [ethno-religious] সমস্যাটি কী ? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই হয়ত কাশ্মীরের দিকেই আঙুল তুলবেন। যদিও কাশ্মীর সমস্যাটিকে আদৌ এথনো- রিলিজিয়াস বলা যায় নাকি সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। তাছাড়া ৩৭০ এবং ৩৫ এ বিলুপ্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জম্মু কাশ্মীরে নতুন এক সম্ভাবনার উদয় হয়েছে। তাই আমাকে এই প্রশ্নটি করা হলে উত্তরটি ভিন্নতর হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কেন্দ্র করে উদ্ভূত সমস্যাটিই এই উপমহাদেশের জটিলতম ethno-religious সমস্যা।

এই উত্তরে অনেকেই হয়ত বিস্মিত হবেন কারণ এখনও এটি স্বমহিমায় প্রতিভাত হয়নি। তবে বাংলাদেশের অনেকেই সেই অশনি সংকেত দেখতে পেয়েছেন এবং অকপটে তাঁদের আশংকা ব্যক্তও করছেন। ethno religious সমস্যা কী বস্তু, রোহিঙ্গা সমস্যাকে আদৌ এই বিশেষণে ভূষিত করা যুক্তিযুক্ত হবে কিনা, ethnic এবং racial এই দুটি শব্দের মধ্যে কী সাদৃশ্য অথবা বৈসাদৃশ্য ইত্যাদি এই আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। বহু জিজ্ঞাসিত একটি প্রশ্নকে সামনে রেখে এই আলোচনাটির অবতারণা। জিজ্ঞাসাটি নিছক পণ্ডিত অথবা বিশেষজ্ঞের নয়, সাধারণ মানুষেরও।

কী সেই জিজ্ঞাসা ? রোহিঙ্গারা মূলত ইসলাম ধর্মাবলম্বী।[মূলত শব্দটির প্রয়োগ এই কারণেই হিন্দু রোহিঙ্গা ক্রমহ্রাসমান প্রজাতি হলেও, একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। বিপন্ন সংখ্যালঘু হিসেবে তাঁরা কালাতিপাত করছেন। মুসলমান রোহিঙ্গাদের দ্বারা নির্যাতিত এমনই ১০৫ টি পরিবার, সাকুল্যে ৪০০ জন বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সংবাদে প্রকাশ [India Today, 10 jan, 2019] মায়ানমার সেনা নয়, মুসলমান রোহিঙ্গাদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েই এঁরা পালিয়ে এসেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ৯৯ জন হিন্দু রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। গণকবরও পাওয়া গেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশলাল এই তথ্যকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। লক্ষণীয় এই যে এঁদের সঙ্গে মায়ানমারের নাগরিক স্বীকৃতিপত্রও আছে, দেশে ফিরতেও ইচ্ছুক এবং সেদেশের সরকার এঁদের গ্রহণ করতেও আগ্রহী। মুসলমান রোহিঙ্গাদের কাছে এই জাতীয় কোনো পরিচয়পত্র নেই।] এই কারণেই তাঁদের বাংলাদেশে আশ্রয় পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে [যাকে মিথ্যা বলা যাবেনা। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি [ ARSA] সংগঠনটির অজস্র সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ প্রকাশ্যে এসেছে] বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সময় বাংলাদেশ সরকার তথা দেশবাসী মানবিকতার চাইতে উম্মতকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রকাশ্যে জানিয়েছেন নির্যাতিত মুসলিম ভাই বোনদের জন্য বাংলাদেশের দরজা উন্মুক্ত। অর্থাৎ বিধর্মী হলে এই উষ্ণ সমাদরের প্রশ্নই ছিলনা। ইসলামি ভ্রাতৃত্বের আহ্বানই কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু তারপর ? প্রারম্ভিক আবেগ এবং উষ্ণতা অন্তর্হিত হয়ে চরম এক বৈরিতার আত্মপ্রকাশ। টেকনাফ তথা চট্টগ্রাম এমনকি সমগ্র দেশের মানুষ এখন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। অনেকে তো মায়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতনকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে বসেছেন। ওদের উপর অত্যাচার করে মায়ানমার নাকি সঠিক কাজই করেছে। কেউ কেউ হিটলারি কায়দায় রোহিঙ্গা নিধন চাইছেন। যা প্রারম্ভিক অবস্থায় অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু কেন ? শরণার্থী রোহিঙ্গারাও তো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশির মত ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ধর্মের কারণেই তাঁদের আশ্রয় পাওয়া সহজ হয়েছে। তবে কেন এই বিদ্বেষ ? কেন এই শত্রুতা ? ইসলামি উম্মতের একতা যা একমাত্র সত্য ছিল, কী এমন ঘটল যাতে এই এগারো লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী [২০১৮-র ২৮ শে সেপ্টেমবরের হিসেব অনুযায়ী] বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শত্রুতে পরিণত হল ? কতিপয় বাংলাদেশি রোহিঙ্গাদের হাতে নিহত হয়েছে বলে ? সমস্যা অনেক গভীরে। অতি সম্প্রতি ছয় লক্ষ রোহিঙ্গার জমায়েত সেদিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। ইসলাম মানেই আর মুসলিম ঐক্য নয়। বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা ইতিমধ্যেই হুংকার ছাড়ছে। বাংলাদেশকে খণ্ডিত করে তারা যদি স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র নির্মাণের পথে এগোয়, বিন্দুমাত্র বিস্মিত হবনা। বাস্তবিকপক্ষে সেটিই ভবিতব্য। হ্যাঁ, রোহিঙ্গারাই আগামীতে বাংলাদেশি মুসলমানের ত্রাস হয়ে উঠবে। কিন্তু কেন ? সেই কারণ অনুসন্ধানই এই আলোচনার বিষয়। সনাতন ধর্মের বিজয় কেন নিশ্চিত সে বিষয়টিও ছুঁয়ে যাওয়ার প্রয়াস থাকবে। তবে তার আগে দুটি শব্দের উপর আলোকপাত অত্যন্ত জরুরি—Differ এবং Discriminate !

ইংরেজি শব্দভাণ্ডারের অন্তর্ভুক্ত differ এবং discriminate শব্দদুটির যথাযথ ব্যবহার নিয়ে বেশ বিভ্রান্তি আছে। আলোচ্য বিষয়ে প্রবেশ করার আগে এবিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত জরুরি, যেহেতু সভ্যতার সংঘাত, অগ্রগতি সর্ব ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় শব্দটির অবদান অনস্বীকার্য। দুই শব্দেরই অর্থেই কিন্তু পার্থক্য ফারাক, প্রভেদ ইত্যাদি অর্থগত সাদৃশ্য বিদ্যমান। কিন্তু differ শব্দটি যে প্রভেদ, পার্থক্যের কথা বলে তা প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক এবং যার অবর্তমানে সৃষ্টিই রসাতলে যাবে, মানব সভ্যতার অস্তিত্বও থাকবেনা। এই যেমন ধরুন 1) A man differs from a woman. 2) A tiger differs from a cow in many respects.
উপরিউক্ত বাক্যদুটিতে পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে ( অর্থাৎ নারীর সঙ্গে পুরুষের, গরুর সঙ্গে বাঘের) তা একান্তই প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক। এতটাই স্বাভাবিক যে এর অন্যথা ঘটলে সৃষ্টিই বিলুপ্ত হবে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যও বিপন্ন হবে। প্রজাতি উৎপাদনের জন্য নারী পুরুষের শারীরিক, ( অনেক ক্ষেত্রে মানসিকও) পার্থক্যটি অনস্বীকার্য। দ্বিতীয় বাক্যটি খাদ্য শৃঙ্খলের বাস্তবতাকে চিহ্নিত করছে, যা একান্তই প্রাকৃতিক।

তবে কী দাঁড়াল? differ শব্দটি প্রভেদ, পার্থক্যকে সূচিত করলেও, কখনই বিদ্বেষ কিম্বা ঘৃণার দ্যোতক নয়। দুটি বস্তু, প্রাণি, দেশ অথবা ব্যক্তির মধ্যে দৃশ্যমান, বিদ্যমান বৈসাদৃশ্যকে চিত্রিত করাই এই শব্দটির কাজ৷ একান্তই প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক এই প্রভেদ মাঝেমধ্যে conflict বা দ্বন্দ্বের জন্ম দিলেও তা কখনও প্রকৃতির বিরুদ্ধে যায়নি। প্রকৃতির উপর আধিপত্য করার প্রয়াসও করেনি। প্রকৃতিবিরুদ্ধ কৃত্রিম কোনো মূল্যবোধ, মতবাদের জন্মও দেয়নি। বাঘ এবং হরিণের মধ্যে যতটুকু confict তা complementary, কোনো ভাবেই contradictory নয়।

The word “discriminate” also started a more or less harmless sojourn as in the sentence like “A blind man is unable to discriminate between light and darkness.

অর্থাৎ discriminate শব্দটিও মোটামুটি নিরীহ ভাবেই পথচলা শুরু করেছিল এই যেমন ধরুন এই বাক্যটিতে — একজন অন্ধ মানুষ আলো অন্ধকারের প্রভেদ করতে পারেনা। একটু ভাবলেই বুঝবেন এটি নিতান্তই একটি fact যা statement এর আকারে পরিবেশিত হয়েছে। বিদ্বেষ বা ঘৃণার কোনো প্রশ্নই নেই। এখানে discriminate এর পরিবর্তে distinguish শব্দটিও স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ A blind man cannot distinguish between light and darkness.

এবার বুকে হাত দিয়ে বলুন তো discriminate শব্দটি শোনামাত্র ( যদি ইংরেজি ভাষায় আপনার ন্যুনতম দখলও থাকে) কোন আবহ বা অর্থটি প্রকট হয়ে ওঠে? আরও সহজ করে বললে আপনি এই শব্দটিকে কী এই অর্থে ব্যবহার করেন? সুদূর অতীতেও করেছেন? মনে হয়না। তবে কোন অর্থে করেন? কোন অর্থটি আপনার মনে বাসা বেঁধে ফেলেছে? আমিই বলে দিচ্ছি। এবার এই বাক্যটি পড়ুন — We should not discriminate against people on the basis of caste and creed. আর একটি — Discriminatory laws have no place in civilised society.

হলফ করে বলতে পারি discriminate এর এই অর্থটিই (প্রথম বাক্যে — জাত পাত ধর্ম বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মানুষে মানুষে বৈষম্য করা উচিত নয়, দ্বিতীয় বাক্যে — সভ্য সমাজে বৈষম্যমূলক আইনের কোনো স্থান নেই।) অর্থাৎ বৈষম্য, বিদ্বেষ জনিত ভেদাভেদ, আপনার কাছে প্রধান এবং পরিচিত। Discriminate এর নিরীহ অর্থটি আপনার জানাই নেই, থাকলেও অব্যবহারে বিস্মৃতপ্রায়। যেমন gay শব্দটির অর্থ যে পুলকিত বা আনন্দিত, আপনি মাথায় রাখেননি, বা জানেননা। Gay বলতেই আমরা এখন পুরুষ সমকামী বুঝি। তাই তো?

কী ভাবছেন? মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি? মোটেই না। বরং কিঞ্চিৎ গভীরে যাওয়ার প্রয়াস করছি।

এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন প্রকৃতি differ শব্দটিকে গুরুত্ব দিয়েছে, এবং সেই প্রতীতি নিয়েই নারী পুরুষ, পশু পাখি, গাছ পালা ইত্যাদির সৃজন করেছে। অর্থাৎ প্রকৃতি difference চেনে, discrimination এর বোধটি তার মধ্যে নেই। অর্থাৎ সে বৈসাদৃশ্যকে লালন করলেও, বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেয়নি। তবে কে বা কারা প্রথম discriminate বা বৈষম্য করণের বোধ এবং প্রক্রিয়ার জন্ম দিল? অবশ্যই মানুষ। হ্যাঁ মানুষ নামক সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণিটিই প্রথম প্রকৃতি সঞ্জাত difference বা বৈসাদৃশ্য কে মনুষ্যসৃষ্ট discrimination বা বৈষম্যের রূপ দেওয়া শুরু করল। এই যেমন শ্বেতকায় মানুষ নিজেদের উৎকৃষ্ট ভেবে নিয়ে কৃষ্ণকায়দের বারবারিয়ান ডার্টি নিগার বলে অভিহিত করল। এই ঘৃণা, বিদ্বেষ যে নিছক মনেই সীমাবদ্ধ থাকল এমন নয়, চরম বৈরিতার আকারে প্রকাশিত হল। অসংখ্য কৃষাঙ্গ মানুষকে হত্যা করা হল। দাস বানানো হল। বিদ্বেষমূলক আইন পর্যন্ত বানানো হল। apartheid শব্দটি নিশ্চয় শুনে থাকবেন। শাদা, কালো, পীত, বাদামি মানুষের সৃষ্টি নিছক difference হিসেবেই হয়েছিল, এদের সৃষ্টি করার সময় প্রকৃতি নিশ্চয় বৈষম্য, বিদ্বেষের রঙ তুলি নিয়ে বসেননি।

কেবল racial difference নয়, বৈষম্য করা হয়নি বা discrimination এর আওতায় নেই এমন কোনো বিষয় নেই বললেই চলে । প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বৈসাদৃশ্য গুলিকে সে যেমন অপব্যবহার করেছে, তেমনই মনন তথা ভাবনার জগতকে কাজে লাগিয়ে তার কয়েকগুণ বেশি বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে। একটির পর একটি মতবাদ, ধর্ম ইত্যাদির জন্ম দিয়ে নিজের গোষ্ঠী, দল, জাতিকে উৎকৃষ্ট এবং বাকিদের নিকৃষ্ট বলে ঘোষণা করা, কখনও মনে মনে কখনও প্রকাশ্যে বিদ্বেষ ছড়ানো, নিজেদের সঠিক প্রতিপন্ন করে অন্যদের উপর অত্যাচার করা — এই ওরা আমরার কৃত্রিম জগতটি বৈষম্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত। বর্ণ ভিত্তিক শ্বেতকায় / কৃষ্ণকায়, সম্পদ, উৎপাদন সম্পর্কের মালিকানা ভিত্তিক বুর্জোয়া/ প্রলেতারিয়েত, ধর্ম ভিত্তিক খ্রিস্টান / ইনফিডেল, মুসলমান/ কাফের ইত্যাদি ইত্যাদি! প্রাকৃতিক প্রভেদ [dissimilarity, difference] যেমন দীর্ঘকায় বনাম হ্রস্বকায়, গৌরবর্ণ বনাম কৃষ্ণবর্ণ, ভোঁতা নাক বনাম উন্নত নাসিকা, দৈহিক, মানসিক প্রতিবন্ধী বনাম সুস্থ স্বাভাবিক মনুষ্য ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে মতবাদ ভিত্তিক, আইনানুগ বৈষম্যের প্রতিষ্ঠা না হলেও [বিশুদ্ধ “নর্ডিক রক্তের” শ্লোগান তুলে নাজিবাদ ব্যর্থ হয়েছে] মানসিকভাবে অনেকেই এটিকে লালন করেন এবং ব্যক্তিজীবনে সেই অনুযায়ী পরিচালিত হন। অর্থাৎ প্রতিটি ব্যক্তি মানুষই এই discrimination এর সম্ভার দিয়ে নিজেদের মানস প্রতিমা নির্মাণ করে চলেছেন। প্রাকৃতিক বৈসাদৃশ্যের উপর গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ জনিত বৈষম্য এই আলোচনার বিষয় নয়। অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত প্রবাহিত এই মানসিকতা দেশীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনা। মতবাদ ভিত্তিক বৈষম্যই যা একান্তই মনুষ্য সৃষ্ট, সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরিয়েছে। যেমন মতবাদ, ধর্ম [religion] এবং ভাষা। অনুসন্ধিৎসু পাঠক মাত্রেই একমত হবেন এই তিনটি বিষয়ই মানব সভ্যতায় হানাহানির কারণ। এর মধ্যে আবার প্রথম দুটির অবদান সর্বাপেক্ষা অধিক। এই আলোচনায় এই দুটি বিষয়কেই কেন্দ্র করেই।

ধর্ম [religion] ভিত্তিক বৈষম্যের অবতারণা আব্রাহামিক ধর্মের হাত ধরে। নিজের গোষ্ঠীটিকে শ্রেষ্ঠ এবং উৎকৃষ্ট ভেবে নিয়ে নির্দিষ্ট একটি ধর্ম গড়ে নেওয়া। প্রথম আব্রাহামিক ধর্ম হিসবে জুদাইজমের [ইহুদিদের ধর্ম] আবির্ভাব হলেও এটি রেইস [race] ভিত্তিক। অর্থাৎ ইহুদি নামক একটি জাতিগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করেই এই ধর্মের জন্ম। জুদাইজমে ইহুদিদের ঈশ্বরের প্রিয় জাতি [chosen People] হিসেবে বর্ণনা করা হলেও অন্য বিধর্মীদের প্রতি হিংস্রতা অথবা বলপূর্বক ধর্মান্তরের কথা বলা হয়নি। কারণ জন্মসূত্র ব্যতীত কেউ ইহুদি হতে পারেনা। এই কারণেই জুদাইজমের বিস্তার ঘটেনি, যা খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে বিপুলভাবে ঘটেছে। তবে আগ্রাসী না হলেও জুদাইজমই সর্বপ্রথম একটি শক্তিশালী ধর্মীয় পরিচিতির [religious identity] জন্ম দেয় যা পারসিক বা আর্যদের দর্শন ভাবনা থেকে একেবারেই ভিন্ন । বহু ঈশ্বরবাদী, প্রাকৃত বা পলিথিস্ট [polytheist] [যাকে কথ্য ভাষায় পেগান [pagan] শব্দটি দিয়েও বোঝানো হয়] পূর্বসূরিদের পথ ত্যাগ করে এই আব্রাহামিক ধর্মটিই প্রথম মোনোথিস্ট বা একেশ্বরবাদী পথ বেছে নেয়। মজার কথা এই যে একেশ্বরবাদকে ভিত্তি করে পথ চলা শুরু করলেও আব্রাহামিক ধর্মগুলি কিন্তু মানবজাতিকে এক এবং অভিন্ন হিসেবে গণ্য করেনি। তাই বসুধৈব কুটুম্বকম জাতীয় কোনো উচ্চারণ এদের ধর্ম শাস্ত্রে স্থান পায়নি। জুদাইজম মানুষকে দুটি ভাগে ভাগ করে— ইহুদি এবং অইহুদি । প্রকৃত অর্থে আগ্রাসী হয়ে ওঠা পরবর্তী আব্রাহামিক ধর্মটি মানুষকে খ্রিস্টান এবং ইনফিডেল [ যীশুকে যারা মানেননা ] অর্থাৎ অবিশ্বাসী অখ্রিস্টান হিসেবে দ্বিধাবিভক্ত করল। Discrimination এর জয়যাত্রাটি এখানেই থেমে থাকলনা। এরপর উগ্রতম, হিংস্রতম, চরম আগ্রাসী আব্রাহামিক ধর্মটির আবির্ভাব ঘটল। ইসলাম। এটিই নবীনতম এবং সর্বশেষ আব্রাহামিক ধর্ম। কারণ পয়গম্বর মোহম্মদ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন এর পর আর কোনো নবী বা পয়গম্বরের আবির্ভাব ঘটবেনা। তিনিই সর্বশেষ নবী। অর্থাৎ সংস্কারের পথটিও রুদ্ধ হয়ে গেল।

সভ্যতার ইতিহাসে এই আব্রাহামিক ধর্মের কী কী অবদান, কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক সে বিষয়ে যাচ্ছিনা। কিন্তু এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই জুদাইজমে যে discrimination মূলত তাত্ত্বিক এবং মানসিক স্তরে ছিল, খ্রিস্টান ধর্মে তা ব্যবহারিক [practical] স্তরে উন্নীত হয়, এবং ইসলাম সেটিকে নৃশংসতম মাত্রায় পৌঁছে দেয়। কিভাবে ? খ্রিস্টানরাই প্রথম বিধর্মীদের উপর চরম অত্যাচার নামিয়ে আনে। পৈশাচিক, বর্বর এই নিপীড়নে শত সহস্র মানুষ নিহত হন। নতুন নতুন ভূখণ্ড জয় করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ছলে বলে কৌশলে ধর্মান্তরিত করা, বিধর্মীদের সামনে “হয় খ্রিস্টান হও, নয় মৃত্যুবরণ কর” এই নিদানের প্রচার করা— এক হাতে তরবারি, আরেক হাতে বাইবেল নিয়ে খ্রিষ্টানদের এই বর্বর দিগ্বিজয় ইতিহাসের পাতায় রক্তবন্যা বইয়েছে। এই বৈষম্যমূলক বিভাজনটিকেই ইসলাম আরও নৃশংসভাবে প্রয়োগ করল। নিজেদের মুমিন হিসেবে উৎকৃষ্ট ভেবে নিয়ে বিধর্মীদের রাতারাতি কাফের বানিয়ে দেওয়া হল। শুরু হল আরেক রক্তাক্ত অধ্যায়। এই হিংস্রতার স্বাদ কেমন তা মোহম্মদ বিন কাশেম এবং তার উত্তরসূরিরা এদেশের মানুষকে বুঝিয়েও দিয়েছেন। বিশ্বের প্রথম ধর্মযুদ্ধ [পড়ুন ক্রুসেড] এই দুটি ধর্মেরই অবদান। ১০৯৬ থেকে ১২৯১ পর্যন্ত খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে আটটি বড়সড় ক্রুসেড। প্রায় সতের লক্ষ মানুষের মৃত্যু। সভ্যতার ইতিহাস শ্রেণি সংগ্রাম দিয়ে নয়, এই আইডেন্টিটি প্রতিষ্ঠা/ রক্ষার লড়াই দিয়েই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সেটি ভিন্ন আলোচনার বিষয়।

শুধু ধর্ম [religion] নয়, Discrimination কে পাথেয় করে জন্ম নিল একটি পৈশাচিক মতবাদ [ doctrine] মার্ক্সবাদ ! কেউ কেউ এটিকে দর্শনের [philosophy] তকমা দিলেও এটি আদপে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার রূপরেখা ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সবাদ যদি ফিলসফি হয় তবে হজরত মোহম্মদের ইসলাম অথবা সান ঝু-র আর্ট অফ ওয়ার বইটিকেও দর্শনের শিরোপা দিতে হয়। নবী মোহম্মদ সৃষ্টিকর্তার আকার প্রকারের উপর একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ধর্মটিকে দাঁড় করিয়েছিলেন। স্বধর্মের লোকজনকে উৎকৃষ্ট এবং বিধর্মীদের নিকৃষ্ট ঘোষণা করে রীতিমত উদ্যোগ নিয়ে মূর্তি ভেঙেছিলেন এবং জিহাদের ঘোষণা করেছিলেন। লক্ষ্য একটাই এই মহান ধর্মের আওতায় সব মানুষকে নিয়ে আসা। রাজি না হলে হত্যা করা।

মার্ক্স সাহেবের “ঈশ্বর” হলেন অর্থনীতি ! আরও ভাল করে বললে উৎপাদন এবং উৎপাদন সম্পর্ক । এর উপর ভিত্তি করেই তিনি মানব জাতিকে দুটি ভাগে ভাগ করলেন—বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত। উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা যাঁদের হাতে আছে তাঁরা মালিক শ্রেণি অর্থাৎ বুর্জোয়া, আর যারা তাঁদের অধীনে শ্রম দান করছেন তাঁরা হল শ্রমিক শ্রেণি অর্থাৎ প্রলেতারিয়েত, যাঁদের কিছুই নাকি হারাবার নেই। বিষয়টি এখানেই থেমে থাকলে discrimination বা বৈষম্যের প্রশ্ন উঠতনা। থিউরি বা তত্ত্ব হয়েই রয়ে যেত। কিন্তু ওই যে discrimination এর চরিত্রই হল এক পক্ষকে সাধু এবং অপরপক্ষকে চোর বলে প্রতিপন্ন করা। মার্ক্স সাহেবের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটলনা। তিনি বুর্জোয়া শ্রেণিকে রক্তচোষা, স্বার্থপর, লোভী বলে চিহ্নিত করলেন এবং শ্রমিক শ্রেণিকে শোষিত, বঞ্চিত, অসহায়, গোবেচারা হিসেবে গণ্য করলেন। অতঃপর বললেন এই মালিক শ্রেণিকে হটিয়েই শ্রমিকদের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হবে। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হবে, Dictatorship of the proletariat, সাম্যবাদ । শান্তিপূর্ণ পন্থায় নয়। হিংসা, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো তাই বলছে—“forcible overthrow of all existing social conditions” অর্থাৎ পুরো সিস্টেমটাকেই গায়ের জোরে বদলে ফেলা। সেটা কিভাবে সম্ভব ? কেন ? শ্রমিক শ্রেণির মনে প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ ঢুকিয়ে দেওয়া। যাতে তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং “রক্তচোষা” বুর্জোয়াদের কচুকাঁটা করে ! মনুষ্যসৃষ্ট discrimination এর বিদ্বেষ এতটাই তীব্র যে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদীদের উদ্দেশ্যে ফ্রিডরিখ নিতজের মত দার্শনিকও অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখছেন–

Whom do I hate most heartily among the rabbles of today? The rabble of Socialists, the apostles to the Chandala, who undermine the workingman’s instincts, his pleasure, his feeling of contentment with his petty existence—who make him envious and teach him revenge . . . . Wrong never lies in unequal rights; it lies in the assertion of “equal” rights . . . . What is bad? But I have already answered: all that proceeds from weakness, from envy, from revenge. [section no. 57 of Friedrich Nietzsche’s The Anti-Christ. The translation is by H. L. Mencken.]

বাংলা তর্জমা—বর্তমানে যত ইতর মনুষ্য দেখি [তাদের মধ্যে সবচেয়ে] কাদের অন্তর দিয়ে ঘৃণা করি ? ঘৃণা করি সাম্যবাদীদের, ঘৃণা করি যারা চণ্ডালদের মাথায় তোলে—শ্রমজীবীদের সহজাত প্রবৃত্তিকে, তাদের পেশাগত আনন্দকে, নিজেদের ক্ষুদ্র অস্তিত্বের মধ্যে খুঁজে পাওয়া তৃপ্তিকে নস্যাৎ করে দেয়—যারা এদের ভুল বুঝিয়ে ঈর্ষাপ্রবণ করে তোলে, যারা এই চণ্ডালদের প্রতিশোধের পাঠ দেয়—- অসম অধিকারে কোনো অন্যায় নেই, “সাম্যের” শ্লোগান তোলাটাই অন্যায়। তবে মন্দ কাকে বলব ? ইতিমধ্যেই উত্তর দিয়েছি—যা দুর্বলতা থেকে, ঈর্ষা থেকে, প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে জাত।

অর্থনৈতিক অবস্থা তথা উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানাকে ভিত্তি করে সৃষ্টি করা এই discrimination এর বলি কতজন হলেন ? সর্বহারাদের মুক্তি দেওয়ার দাবি তুলে যে দেশে দেশে “শ্রেণি সংগ্রাম” এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সুবন্দোবস্ত হল তার ফলে কত সংখ্যক মানুষের ভবলীলা সাঙ্গ হল ? হিটলার তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে ইহুদি নিধন যজ্ঞ শুরু করেছিলেন। আনুমানিক ষাট লক্ষ ইহুদি তাঁর নৃশংসতার শিকার হন। কিন্তু সাম্য এবং মুক্তির ধ্বজাধারী সর্বহারার নেতারা শান্তিকালীন পরিমণ্ডলে যে নরসংহার করেছেন, তা যাবতীয় হিংস্রতা এবং বর্বরতাকে ছাপিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চিনের কম্যুনিস্ট চেয়ারম্যান মাও সেতুং সাড়ে চার কোটি মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য এঁরা কেউই “রক্তচোষা” বুর্জোয়া ছিলেননা। গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড নামক “সমাজবাদী’ পদক্ষেপের শিকার এই সব মানুষ খেটে খাওয়া কৃষক এবং সাধারণ মানুষ। আর জোসেফ স্তালিন ? তাঁর পাল্লা অবশ্য এতটা ভারি নয়। মাত্র কুড়ি মিলিয়ন মানুষ তাঁর মহান কর্মযজ্ঞের বলি হয়েছিলেন। খোদ রাশিয়ার মানুষ,সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এই পরিসংখ্যান মেনে নিয়েছেন। অনেকেই বলছেন সংখ্যাটি আরও বেশি। বস্তুত এই গণহত্যার পরিসংখ্যানগুলি বর্তমানে এতটাই পরিচিত যে তথ্যসূত্রের প্রয়োজন পড়েনা। কম্বোডিয়ার সর্বহারা নেতা পল পটের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। তিনি মাত্র দেড় থেকে দুই মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছিলেন। বেচারা ! ছোট্ট দেশ। ইচ্ছে থাকলেও মারার মত এত মানুষ পাবেন কোথায় যা তাঁর সহযোদ্ধা কমরেড মাও এবং স্তালিন পেয়েছিলেন !

Discrimination কে ভিত্তি করে গড়ে তোলা এই ধর্ম, মতবাদগুলি কতটা সাফল্য পেয়েছে ? তাদের বর্তমান অবস্থাই বা কি ? এত এত নরহত্যার বিনিময়ে তাদের প্রাপ্তির ঝুলি কতটা উপচে পড়ল ? মানবজাতিকে দ্বিধাভক্ত করে, মোটা দাগের খ্রিস্টান/ ইনফিডেল, মুমিন/ কাফের বৈষম্য বানিয়ে কোন মহান কার্যোদ্ধার হল ? মানুষকে এক রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাই বা কতটা সফল হল ? কিঞ্চিৎ ভাবলেই বুঝবেন এই তিনটি ধর্ম/ মতবাদের লক্ষ্য তথা উদ্দেশ্যের মধ্যে অদ্ভুত একটি সাদৃশ্য। এরা প্রত্যেকেই মানুষকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিল। নিজেদের গোষ্ঠী, সমর্থিত পথকে শ্রেষ্ঠ, উৎকৃষ্ট বলে প্রচার এবং বিধর্মী, ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষকে জানিয়ে দিয়েছিল যেহেতু তাদের পথটিই উৎকৃষ্ট, তাই সমগ্র মানবজাতিকেই তাদের মতকে গ্রহণ করতে হবে। নইলে মৃত্যু অনিবার্য। খ্রিশ্চিয়ানিটি বলল সব্বাইকে খ্রিস্টান হতে হবে, সমগ্র বিশ্বই এই মহান ধর্মের অধীনে আসবে, ইসলাম ঘোষণা করল সব্বাইকে মুসলমান হতে হবে, সমগ্র বিশ্ব দার-উল-ইসলামে পরিণত হবে, মার্ক্সবাদ জানাল সর্বহারারাই বিপ্লবের শক্তি, প্রগতির কাণ্ডারি। বুর্জোয়াদের declassed অর্থাৎ শ্রেণিচ্যুত হয়ে তাদের মিছিলে পা মেলাতে হবে। তবেই আসবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। সেখানে বুর্জোয়ার স্থান নেই। সবাই সর্বহারা, রাষ্ট্রের সেনানী। এভাবে সমগ্র বিশ্বেই একদিন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। বুর্জোয়াদের ধ্বংস করা হবে। সাদৃশ্যগুলি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। তিনটি মতবাদই ১] আন্তর্জাতিক আধিপত্যে বিশ্বাসী। ২] “ওরা আমরার” discrimination এর উপর প্রতিষ্ঠিত। ৩] বলপ্রয়োগ, সহিংসতার মাধ্যমে অভীষ্ট সাধন। আরও অনেক সাদৃশ্য আছে।

ফল কী দাঁড়াল? প্রথমদিকে বিপুল সাফল্য লাভ করলেও, স্বেচ্ছায় অথবা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে খ্রিস্টান বানানো গেলেও, রক্তক্ষয়ী ক্রুসেড সত্ত্বেও বিশ্বের সমস্ত মানুষকে খ্রিস্টান বানানো গেলনা। যারা খ্রিস্টান হয়েছিলেন বা হয়েছেন, তাঁরাও একযোগে ইনফিডেলদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেননা, যা প্রাথমিক অবস্থায় অনেক দেশে ঘটেছিল। মানবজাতিকে খ্রিস্টান বানানো সম্ভব তো হলই না, বরং লক্ষ লক্ষ খ্রিস্টান নাস্তিক হতে শুরু করল। কাগজে কলমে এখনও খ্রিষ্টানদের সংখ্যা সর্বাধিক [২২০ কোটি] হলেও এঁদের সিংহভাগই নাস্তিক অথবা নন রিলিজিয়াস। তাঁরা তেমনই দাবি করেন। খোদ ইউরোপেই [যেখানে এই ধর্মটির ব্যাপকতম বিস্তার ঘটেছিল, মূল অবদান অবশ্যই সেন্ট পল এবং সম্রাট কনস্টানস্টাইন যিনি ৩১৩ খ্রিস্টাব্দের মিলান এডিক্টের মাধ্যমে সমগ্র রোম্যান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্মকে মান্যতা দেন।] এখন খ্রিস্টানরা বিপন্ন প্রজাতি। জমায়েত, প্রার্থনার অভাবে একের পর এক গীর্জা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। লোক সমাগম নেই বলে ব্রিটেনের চার্চগুলিকে মসজিদে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব এসেছে। কাজও শুরু হয়ে গেছে। Gatestone Institute প্রকাশিত [2nd April, 2017] একটি সমীক্ষায় Guilio Meotti জানাচ্ছেন ব্রিটেনে ৫০০টি গীর্জা বন্ধ হয়ে গেছে। ৪২৩টি নতুন মসজিদ নির্মিত হয়েছে। স্বধর্মের প্রতি উদাসীনতা এবং মুসলিম শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান দাপট দুই মিলিয়ে খ্রিস্ট ধর্মের নাভিঃশ্বাস উঠেছে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এখন কেবল তৃতীয় বিশ্ব। আফ্রিকা, এশিয়ার দেশগুলিতেই এখন পোপ কার্ডিনালদের নজর। নানাবিধ কৌশলে সেখানে যিশু ভক্তের সংখ্যা বাড়ানোর কার্যক্রম চলছে। এদেশের উত্তর পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণের কিছু রাজ্যে এঁরা মহান “ভালবাসার” ধর্মটির চাষাবাদ করে চলেছেন। তাতেও লাভ নেই। কারণ এই ধর্মটির মৃত্যুঘন্টা জন্মের সময়ই ধ্বনিত হয়েছে।

আর মার্ক্সবাদ ? তার অবস্থা আরও করুণ। মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের ল্যাবরেটরি সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক সর্বহারা রাষ্ট্রটিই ভেঙে পড়েছে। ফিরে এসেছে ধনতন্ত্র , অর্থাৎ “রক্তচোষা” বুর্জোয়া ব্যবস্থা। স্তালিনের চাপিয়ে দেওয়া কম্যুনিজম গিলে পূর্ব ইউরোপের বদহজম এবং পুনরায় গণতন্ত্রে ফিরে আসা –এ কাহিনি এখন সুবিদিত। চিনও দীর্ঘদিন আগেই মার্ক্সীয় পথ এবং পন্থা বিসর্জন দিয়েছে। সে কারণেই এখনও টিকে আছে। নইলে শক্তিধর তো দূরের কথা, উত্তর কোরিয়ার মত ভিক্ষাপাত্র হাতে ঘুরতে হত। অর্থাৎ সর্বহারার এই মতবাদটিও বিপন্নতার পথে। ভেনেজুয়েলা পথে বসেছে। এদেশের কতিপয় রাজ্যে কিঞ্চিৎ অস্তিত্ব থাকলেও সাম্প্রতিক নির্বাচনে এটি শূন্যে পর্যবসিত হয়েছে। অবশিষ্ট যতটুকু জন সমর্থন আছে সেটিও অচিরে অস্তগামী হবে।

বাকি রইল ইসলাম। বিশ্বের কুড়ি শতাংশ ভূভাগ দখল করে প্রায় ১৮০ কোটি মুসলমান ! আপাতদৃষ্টিতে এই আব্রাহামিক ধর্মটিকে অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও এরও পতন শুরু হয়ে গেছে। আর এই পতনের অন্যতম একটি লক্ষণ বাংলাদেশি মুসলমান বনাম রোহিঙ্গাদের সংঘাত ! কিন্তু কেন ? এমন তো কথা ছিলনা। কী কথা ছিল ? ইসলামের জন্ম লগ্নে সাহাবিদের প্রতি মহান নবীর উপদেশ, তাঁদের কার্যকলাপ ইত্যাদি অনুসারে সমগ্র মুসলমান উম্মতের ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা। অর্থাৎ সমগ্র ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ কাফেরদের বিরুদ্ধে একযোগে রুখে দাঁড়াবে এবং জিহাদের মাধ্যমে দার উল ইসলাম কায়েম করবে। বাস্তবে তা কি ঘটছে ? এই মুহূর্তে বিশ্বে প্রায় পঞ্চাশটি ইসলামি দেশ। কিন্তু তাদের মধ্যে একতা ? শূন্য বললেও কম বলা হবে। একতা, ভ্রাতৃত্ব তো দূরের কথা, নিজেদের মধ্যে হানাহানিই এখন দৈনন্দিন ব্যাপার। যে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শরিয়া শাসনের পক্ষে, যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা মালাউন উপাধিতে ভূষিত এবং দৈননন্দিন অত্যাচারের শিকার, যার ফলে তাঁদের সংখ্যা কমতে কমতে ৮% এসে দাঁড়িয়েছে, সেই বাংলাদেশি মুসলমানদের চোখে রোহিঙ্গারা এমন শয়তান হয়ে উঠল কেন ? ইসলামি ভ্রাতৃত্ব কি তবে বুদবুদ হয়ে গেল ? ঠিক তাই। সেই কারণ অনুসন্ধান করাই এই আলোচনার উদ্দেশ্যে।

অভিন্ন ইসলামিক আইডেন্টিটি সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা কেন বাংলাদেশি মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণ করছে এবং মায়ানমারের ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবেনা বলে হুঙ্কার ছাড়ছে, সম্যক বুঝতে হলে আমাদের সেই বিশেষ বাইনারিটির [binary অর্থাৎ মুসলমান কাফের] সম্ভাব্য উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে হবে। যদিও বিষয়টি ডকুমেন্টেড নয়, হাইপোথেতিকাল। কারণ এই ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ একান্তভাবেই এই লেখকের। কেবল মুসলমান/ কাফের নয়, খ্রিস্টান/ ইনফিডেল, বুর্জোয়া/ প্রলেতারিয়েত ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই এই বাইনারির আধিপত্য। অনুসন্ধিৎসু পাঠক মাত্রেই জানেন বাইনারি হল—relating to, composed of or involving two things. অর্থাৎ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত দুটি বিষয় বা বস্তু। দুটি বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত কোনো প্রতীতিও হতে পারে। গণিত/কম্পিউটার শাস্ত্রে বাইনারি সিস্টেম একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। আব্রাহামিক ধর্মগুলি এবং পরবর্তীতে মার্ক্সবাদ কি এই বাইনারির দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিল? বিশেষত ইসলাম এবং মার্ক্সবাদ, যারা নিজেদের প্রাকৃতিক এবং বিজ্ঞানসম্মত সত্য বলে দাবি করে থাকে?