রাতের নিঃশ্বাস

0
1905

শেষ পর্যন্ত ওরা একটা বাড়ি পেয়েই গেল । কলকাতার খুব কাছেই । স্টেশন থেকে নেমে তিরিশ মিনিট ।এইদিকে শহরের রঙ এখনো মাখেনি , তবে অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে । বৃষ্টি পড়লে জল জমে , কাদাতেও মাখামাখি হয় । এই জমা জলে মশাও জমে । কাদা শুকিয়ে গেলে খরখরে হয়ে ওঠে । তাইবলে আগের মতন জল অনেক দিন অপেক্ষা করে থাকেনা , নিকাশি ব্যবস্থা আগের থেকে ভালো হয়েছে । এই ভরসাটুকু নিয়েই জলের দরে এই বাড়িটা কিনে ছিল ।         

দেবব্রত  মেদিনীপুর  থেকে  কলকাতার  স্কুলে  পড়াতে  এসেছে  পাঁচ  বছর  হয়েছে । এই বছরটা  ছয় নম্বর  বছর ।   নতুন  বিয়ে  ।  সুমালাকে   যেইদিন  প্রথম  দেখে ছিল ,  দেবব্রত  প্রথম  দেখায়  পাঁচ  মিনিট  গল্প  করেছিল । খুব অল্প  কথা । আজও  মনে আছে  ,প্রথম যেইদিন দেখে ছিল  সারারাত   সে ঘুমাতে  পারেনি  । চোখ  বন্ধ  করলেই  মনে  হচ্ছিল , এমন  মেয়েকে  সারা জীবনের জন্য পাশে  পাবে  ! বিয়ের  রাতে  এই   স্নায়ুর  দুর্বলতা কাটেনি  তার । সাতদিন  কেমন   ইতস্তত  হয়ে  থাকত ।  মেয়েটাই  স্বাভাবিক  করল ।

ভীরুতা আর খুনসুটির  তীব্র চেষ্টা  নিয়েই , তাদের  দাম্পত্য  চলেছে ।  সোম থেকে  শনি  স্কুল  , তারপর  ফিরে  আসা । সুমালা একদিন  সরাসরি  বলল – আমাকে  নিয়ে  কলকাতায়  চলো ।

বাড়িতে  ছোট  ভাই , বোন  , বাবা  -মা  ।  অবশ্য যৌথ পরিবারে  থাকে দেবব্রত, তাই  হয়ত খুব  সহজেই  সুমালাকে  নিয়ে  কলকাতায়  চলে  এসেছে  ।

এখানে  এসে  একমাস  ভাড়াই  ছিল , এক দালাল  এই বাড়ির খোঁজ  দিয়েছিল । জলের  দরে  পেয়ে  গেল বাড়িটা ।

প্রথম  ছয়মাস স্বপ্নের  মতন কেটে ছিল ।  দেবব্রতর  চোখে  ভাসছে  , বাড়ির  প্রথম  রাত । আগের  থেকে  সুমালাকে নতুন করে  পেয়েছিল । লালারঙের  রাত পোশাক খুলে ফেলতেই  হাতকাটা  নাইটি , ভীষণ  স্বচ্ছ । এতটা যে  দেবব্রতর বুক  কাঁপছিল । একে  ফাঁকা  বাড়ি , অন্য  পরিবেশ  , সাথে  একা –একা   সদ্য বিবাহিত  দম্পতি । সুমালা ভীষণ  ফর্সা নয় । এই রাতে  খোলা  চুল ,  লম্বা মুখ আর  সেই  মুখের  উপর  নাইট ল্যাম্পের  আলো এসে  মেখেছে ! মেয়েরা  এই  সময়  এমন  ভয়ংকর  হয়ে ওঠে !  দেবব্রত টের পেল   ।সেই রাতে  সুমালা  , দেবব্রতর  নগ্ন বুকে  মাথা  পেতে শুয়ে  ছিল । দেবব্রত মাথায়   হাত  বুলিয়ে  ঘুম  পাড়িয়ে  দিয়েছিল ।  সেইরাতে  শুধু মাত্র  ঠোঁটে  চুমু  খেয়েছিল ।

-দেবব্রত  দা ?

স্তম্ভিত  ফিরতেই ,  পিছনে দাঁড়িয়ে  আছে  রোগা মতন কালিপদ । স্কুলের  জুনিয়ার     টিচার ।পাড়ার ছেলে । ইংরাজি  পড়ায় । দেবব্রতর নিজের বিষয়   অঙ্ক ।

বলল – অনেকক্ষণ ?

কালিপদ  হাসতে  -হাসতে বলল – এখন  কটা  বাজে  ?

-কেন  দুটো ?

-দাদা , পাঁচটা  বাজতে  চলল । আপনি চিন্তায়  মশগুল  হয়ে  ছিলেন  । লাস্ট  ক্লাস চারটে পনেরো পর্যন্ত । সাড়ে চারটে অব্দি  ছেলেগুলো অপেক্ষা  করল । আমি  ক্লাস  ভাঙতেই  দেখি  , ওরা  বেড়িয়ে  যাচ্ছে ।  বুঝলাম আপনি  আজও ক্লাস  করেননি ।

দেবব্রত  মাথায়  হাত  রেখে  বলল – মনে  হচ্ছে , আমি  পাগল হয়ে যাব ।

-দাদা  , আমি আপনাকে   একজনের  কথা  বলেছিলাম মনে  আছে  ?

-কে  বলতো ?

-বেদ ।  যাদবপুর থানার  ভিতরেই  ছেলেটার  বাড়ি  ।

–  এই  ছয় মাসে  কম কিছু  করলাম  না  । অনেকের  কাছেই  গেলাম । ফল কিছুই না !

-দেবব্রত  দা । ছেলেটার  কাছে  একবার  চলুন  । দেখুন  যদি কিছু  হয় । মানে  আমি  কথা বলে  নিয়েছি । বেশি  দূর  নয় । চলুন । ওদিকে  আবার ফিরতে  হবে ।

আমি একটা   লেখা  লিখছিলাম  । সম্পাদককে  দিতে  হবে  ।    কাঁধ  ধরে  ঝাঁকাতেই , হুঁশ  এলো ।  ঘাড়  ঘুরিয়ে  দেখলাম মা দাঁড়িয়ে  আছে  ।

-হ্যাঁ  কিছু  বলবে ।

-কখন থেকে  ডাকছি । কানে  যায় না  কথা  ?

-শুনছিলাম   , উত্তর  দিতে  পারিনি ।

-কেন  আমায় মানুষের পর্যায়ে  ফেলিস  না  ?

-বলছিনা  দুদিনের  মধ্যেই   সম্পাদককে  লেখাটা  দিতে  হবে  ।  তাই কাজ  করছি ল্যাপটপে । দেখতেই পাচ্ছ । এখন  ডিস্টার্ব  করবে  না ।

-আমার  কথাটা  শুনে উত্তর  দিতে  পারতিস ।  উত্তর না  দিলে  বুঝব  কেমন  করে  , তুই  শুনতে পেয়েছিস  নাকি ?

মায়ের  কথা  মাঝপথে  থেমে  গেল ,  বাইরে  শুনলাম  পরিচিত  গলা । আমার নাম ধরে  ডাকছে । পুরুষের  গলা ।

বেদ  —

মা  রান্না  ঘরে  চলে  গেল । আমি  পর্দা  টেনে ।  দরজা খুলতেই  সামনে  দেখলাম  -কালিপদকে  ।

-হ্যাঁ  আয়  ।

কালিপদর  সাথে  আমার তিন বছরের  আলাপ । যে পাড়ায় ওর  স্কুল , আমি সেখানে  খেলতে  যেতাম ।   দুপুরে  আমাকে  ফোন  করে  ছিল । কেস আছে  ।

আমি  দেখলাম   সাথে  বছর   পঁয়ত্রিশের  লোকটি     মনমরা  হয়ে  আছেন । আমাকে  দেখে  দুহাত  জড়ো  করে নমস্কার  দিলেন  । আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম

-আসুন  স্যার । আমি  কালিপদর  মুখে  আপনার  কথা  শুনেছি  ।  আমার কথাও  হয়ে  গিয়েছে ।

লোকটি  আচমকাই  গলার  স্বর  পাল্টে  বললেন  – কার  সাথে  ? কবে ? কি কথা?

এমন প্রশ্নে  কালিপদ  ঘাবড়ে  গিয়ে  বলল – বেদের  গুরু যিনি । তার  কথা  বলছে ।

লোকটি হাসলেন । – আমি এইসবে  একদম  বিশ্বাসী  নই ।

আমি  জানতাম  আমাদের  কাছে  ক্লাইন্ট  বাধ্য  হয়ে  আসে আর  অবিশ্বাস  নিয়েই  আসে ।এটা  আমাদের  প্রাপ্য ।  তাছাড়া আমরা  যে  বিদ্যা  চর্চা করছি , তা  সবাই  করেনা । তাদের  পক্ষে  চোখে  দেখা  যায় না  এমন কিছু  বিশ্বাস করানো  যায়না । তাছাড়া  এটা  ঠিক  এখানে  যারা  আসেন , সব  দিকে  হেঁটে  তারপর । একদিক  থেকে  সুবিধা  আছে  প্রত্যাশার  চাপ  থাকেনা  ।

আমি  বললাম – স্যার , ভিতরে আসুন ।

ওনারা ঘরের ভিতর এসে  চেয়ারে  বসলেন , সামনেই খোলা দরজা । আমি দাঁড়িয়ে আছি ।

আমি বললাম –  আগেই  বলে রাখছি  আপনার  বাড়ি  গিয়ে  ভিজিটিং করতে  হাজার  টাকা  নেব  । তারপর  কটা   সিটিং   দিতে  হবে  সেই ভাবে  টাকা  রফা  হবে  । অবশ্য কাজ না  হলে  শুধু মাত্র   পাঁচশ টাকা  কেটে  বাকী  সবটাই  ফিরত পাবেন । হ্যাঁ পারিশ্রমিকটা কিন্তু  ক্যাশেই  দেবেন  । চেক বা  ড্রাফট  বা  ধার  বাকি  একদম চলবে না ।

দেবব্রত  বাবু  আমার  হাত  ধরে  বললেন –  তোমার  বয়স  আমার  থেকে  কম । ভাই টাকা নিয়ে  ভেবো না  । শুধু আমায় বাঁচাও ।

-দেখুন  আমরা  চেষ্টা  করব ।তার আগে  লজ্জা  না  করে  সব  কিছু  খুলে  বলবেন । স্যারকে  ডিটেইলে  রিপোর্ট  মেইল  করতে  হবে  ।

দেবব্রত বাবু  আমার দিকে  তাকালেন । কাঁপা  গলায় বললেন – দরজাটা ?

আমি  বুঝলাম  ,  দরজা  খোলায় উনি  বিব্রত  বোধ করছেন ।   আমি  বন্ধ  করে খাটে  এসে  বসলাম । দু’পা  মুড়ে  আসন করে  বসলাম ।  বললাম

-আপনি শুরু  করুন  দেবব্রতদা   ।

লোকটার  গলার  স্বর খানিক  শক্ত  হয়ে গেল । খুব  স্নায়ু  ঘটিত  চাপে  রয়েছেন ।

-আমি যা বলছি , শেষ কয়েকমাস  তার  থেকেও  বেশী    কিছু  ঘটেছে । আমি সবটা  গুছিয়ে  বলতে পারব না । আমি একটা  ঘোরের  ভিতর  রয়েছি   ।  জানিনা  এই অবস্থায়  কতটা  আমি  বলতে পারব ।

কথা   গুলো ধীরে কানে  আসছিল  কিন্তু  স্পষ্ট  ভেসে আসছিল ।

-আমি মেদিনীপুরের  বাসিন্দা  । চাকরীর  সূত্রে কলকাতায়  বাড়ি  কিনেছি । সুভাষগ্রাম  স্টেশনে  নেমেই  প্রায়  চল্লিশ  মিনিট  গেলেই  গ্রাম্য  পরিবেশে  দ্বোতলা   বাড়ি । প্রায় আট   মাস   আছি ।  আমার  জীবনে   যেই  পর্বের জন্য  আপনার কাছে  ছুটে  আসা  , তা  শুরু  হয়েছে  সাত  নম্বর  মাস  পেড়িয়ে  যেতেই ।

আমি  লক্ষ্য করলাম  , মার্জিত  শিক্ষিত  মধ্যবিত্ত  বাঙ্গালি । কলকাতার  লোকেরা  বাংলা বলেন , তাই বলে কথা  বলবার  সময়  এমন ভাবে  বলতে  শুনিনি  ।  যদি বলত , আরও  ভালো লাগত  শুনতে ।

-দাদা  বলুন । ইতস্তত   করবেন  না  ।

দেবব্রতদা  বলতে  শুরু করলেন —

 

রাতে সবেমাত্র  শুয়েছি । সুমালা  আমার পাশেই আছে  । আমি  ওর   বুকের  উপর  থুতনি  রেখে  চোখের  দিকে  তাকিয়ে আছি । আসলে সত্যি  বলতে,  কলকাতায় এসে একা- একা  মেসে  থাকতাম  পড়াশুনো  নিয়েই । নতুন  বিয়ে  আর  গ্রাম্য  পরিবেশে  নিরিবিলি  অবসরে  ,সুমালার  প্রতি আমার  আকর্ষণ বেড়েই  চলেছিল । সে নিজের মতন সংসার করছে, গুছিয়ে  করছে । মেয়েরা  নিজের  মতন চলতে  পারলে  আর  কিছু   চায়না  । রাতে আমরা  অনেকক্ষণ  গল্প করতে –করতে ঘুমিয়ে  যেতাম । আমাদের  বাড়ির  সাথে  লাগোয়া  তিনটে  বাড়ি  রয়েছে । বাড়ির সামনে লম্বা  হেঁটে  গেলেই  যে ইটের  রাস্তা  , তার  মুখেই  লাইটপোস্ট   বসেছে । আলো  খুব  বেশী  না  হলেও যথেষ্ট । বাড়ির  ভিতরেও  আলোর  ব্যবস্থা  পর্যাপ্ত , তবে  পাওয়ার  কম । ভোল্টেজ  যায় আর আসে ।আমাদের  বেড রুমে এখন  হাল্কা  আলো জ্বলছে  । সুমালা  ঘর অন্ধকার  করলেই রেগে  যায় । মাথার আর পায়ের কাছের  জানলা দুটো  বন্ধই  রয়েছে । ঘড়িতে  বেজেছে , রাত  দেড়টা ।

দেবব্রত  বাবু  থেমে  গেলেন  । আমি  বললাম – তারপর ?

-সুমালা  ঘুমিয়ে  পড়ল  ।  আচমকাই  অনুভব করছি ,   আমার  কাঁধে  কোন   নারীর  নরম  আঙুলের  ছোঁয়া ! বিশ্বাস  করুন সেই  নারী  সুমালা  নয় ।  ও  ঘুমিয়ে  আছে  , চিত হয়ে ।  আমার পাশেই ।  দুটো হাত  বুকের  উপর  রেখেছে  ।

আমি সুমালার  বুকের  উপর  থুথনি   রেখেছি  আর আমার  কাঁধে সেই    নরম  আঙুলের  অনুভূতি !   প্রথম  – প্রথম  আমার  খুব  অস্বাভাবিক   হয়েছিল । তারপর মনে হলও , মনের  ভুল । আমি নিজে  চিত  হয়ে  শুলাম  ।  সেই রাতে  অজানা কারনে চোখে  ঘুম নামছিল না ।বারংবার  সেই  হাতের  কথা  মনে পড়ছিল ।  আমি ভালো করে  ভাবছিলাম আসলে কিছু ঘটেছিল না সবটাই মনের ভুল ।  কখন চোখ লেগে গিয়েছে জানিও না ।

-তারপর ?

-চোখ খুলতেই  সকাল । সকাল  আটটার  সময় , সুমালার ডাকেই  ঘুম  ভাঙল । তার চোখের  দিকে  তাকাতেই  কেমন  যেন লজ্জা বোধ  হচ্ছিল । মনে  হলও , আগের রাতে  অন্য  মেয়ের  যৌন  আনন্দের কথা  ভেবে  আমি  সুমালার বিশ্বাসকে অপমান করলাম । এটা ঠিক  হল না । নিজের চোখে  নিজেই  নেমে গিয়েছিলাম । আবার  মনে হলও , এইসব  আবোল –তাবোল  ভাববার  কোন  মানে  নেই  । কেননা  আগের রাতের  ওইটুকু  স্পর্শ  আমার  মনের  ভুলই  হবে  । সারা  দুপুর আমি  ভিতর থেকে  থম মেরে  রইলাম । কেন রইলাম ? এর  কোন উত্তর  আমি  খুঁজে  পাচ্ছি  না  । যতই  ভাবছি  মনে হচ্ছে  এমন ফালতু  বিষয় নিয়ে  ভাবছি  কেন  ? তাও ভেবেই চলেছি  ! এই ভাবনা  আমাকে  দেড় দিনের  মধ্যেই  ঘিরে  ফেলেছে  ।  অথর্ব করে  দিয়েছে  ।  আমি  নিজেকে  খুঁজছিলাম । সুমালার  প্রেমকে  আঁকড়ে  ধরতে ইচ্ছা  হচ্ছিল ।   কিছুই পারছিলাম না ।

দেবব্রত  বাবু  থেমে  গেলেন  ।  তাঁকে  দেখে  আমার  খুব খারাপ  লাগছিল ।  কেননা  এই  অবস্থার মধ্য  দিয়ে যারা   সময় কাটিয়েছেন , শুধুমাত্র  তারাই  বুঝতে  পারেন । আমি তাদের  দেখেছি । আমি  ছাড়া  আর  কেউ  বুঝতে  পারবে  না  , দেবব্রত  বাবুর  কষ্ট । আমি  বললাম –তারপর

 দেবব্রত  বাবু  বললেন – আসল  খেলা  শুরু  হলও  সেই  রাত  থেকেই  ।  রাত   একটা পর্যন্ত  ঘুম আসছিল  না । পরের দিন সোমবার । আমরা  তাড়াতাড়িই  খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সুমালা আমার পাশে  ঘুমোচ্ছে । সারাদিন  কোন  কাজ  নেই  ,  দুপুরে  গল্পের  বই । বিকেলে  সিরিয়াল । রাতে  ঘুম । আমি  ভেবেছিলাম  আজ  রবিবার  অন্য ভাবে   কাটাব । অন্তত  ভালো  বাজার  করব  ।  কিছুই  হল না । মানে  হতে  দিল না । এই  রাত আমার কাছে  এক সন্দেহজনক    মনে  হচ্ছে । এর  ভিতরে কেউ  লুকিয়ে  রয়েছে । কে ? হ্যাঁ , সে এসেছে । আমার  কপালে  অস্তিত্ব টের পাচ্ছি ! মনে  হচ্ছে সুমালার  হাতের  আঙুল থেকেও  ভারী  কোন  মহিলা  আমার  কপালের  মাঝখানে  আঙুলের  খেলা  খেলছে  ।  আঙুল  দিয়ে  বুলাচ্ছে ।  চোখ  দু টো  ভারী  হয়ে  আসছে । আমার  শরীরের নিয়ন্ত্রণ আমার উপর  নেই !  চোখ খুলতেও  ইচ্ছা হচ্ছে না । আবার  এই  চোখ  না  খুলবার  ইচ্ছাটাও  আমার  নিজের  নয় ।  তাহলে  আমি কে  ? আর  আমার ভিতরে অন্যকেউ   রয়েছে  ,  তার  ইচ্ছার  হাতেই  আমি   নিজেকে তুলে  দিয়েছি ।   কার কাছে  নিজেকে বিলিয়ে  দিচ্ছি ?  এটা মনের  ভুল  নয় । কেননা মন  সব  কিছুই  বুঝতে  পারছে  ।  আমি বেশ  অনুভব  করছিলাম , সেই  নারীর চাপ –চাপ  আঙুলের  ছোঁয়া । এটা  আমার  ভুল   নয় । কেননা  ভুল  কখনই এতটা  সত্যি  হতে পারেনা।   এই  ছোঁয়াটুকুই  প্রচণ্ড  ভাবে  বাস্তব , যার কাছে  সুমালার  স্পর্শ পর্যন্ত  মিথ্যা  মনে  হচ্ছে  !

-তারপর ?

-শেষ  একমাস  আমি  অদ্ভুত  সুখে  ভেসে  যাচ্ছিলাম ।  সুমালা আমার  পাশেই  শুয়ে আছে । আমি  যেনও অজানা  সেই  নারীর অপেক্ষায়  জেগে  থাকতাম । আর  সুমালা  সাড়ে  বারোটায়  ঘুমিয়ে  পড়লেই ,  রাত একটা  থেকে আমার  বুকের  ভিতরে চাপা টেনশন  শুরু  হতও ।  একদিন  সকালবেলা  চায়ের  টেবিলে  বসে আছি , দেখলাম  সুমালার  মুখটা  ভারি  হয়ে  আছে  । বুঝতে  পারছি না , এমন  ভাবে  বসে  থাকবার    কারণ । আমি জিজ্ঞেস  করতেই  সে  বলল , আগের  দিন  রাতে  আমি নাকি তাকে  ফিরিয়ে দিয়েছি । আর  আমি তাকে  বলেছি , এখন  আমার ভালো লাগছেনা  এইসব । কিছুক্ষন কিছুক্ষণ বাদেই  সুমালার  চোখ  দিয়ে  জল  গড়িয়ে পড়তে  শুরু  করেছে । আমি বুঝতে পারলাম না । এত কিছু  ঘটল  আর আমি কিছুই টের পেলাম  না !  কিছুক্ষণ  বাদেই  মনে হচ্ছে  আমার আর সেই  অদৃশ্য   নারীর মধ্যে   যে  যৌন অনুভূতির  খেলা  শুরু  হয়েছে , একমাসে  আমরা  পরস্পরের  কাছে  পরিচিত   হয়েছি । আমাদের  ভিতর কন কোন গোপন কিছু  নেই ।  কেউ আমরা  পরস্পরকে  দেখিনি ,  কথাও  বলিনি ।  কিন্তু  বুঝে  গিয়েছি । আমাদের  এই  অবৈধ  সম্পর্কের  মাঝে  সুমালা  বাধা  হয়ে  দাঁড়াবে  নাতো ?

-তারপর ?

-যত  দিন  এগিয়েছে  , ততই আমি সুমালাকে  শত্রু  ভাবতে  শুরু  করলাম  । কয়েকদিনের  মধ্যেই  ওর  একটু  জোরে  কথা  বলা  বা  ভালোবাসার আকুতি দেখলেই , মাথা  গরম  হয়ে  যেত ।   যতই  দিন  যাচ্ছিল , আমি  সুমালাকে  সহ্য  করতে  পাচ্ছিলাম না ।  মনে – মনে ওকে  সরিয়ে  ফেলতে  হবে  । সুমালাকে  খুন  করতে হবে  । এখন  আমার মাথায়  একটাই  ভাবনা  ওকে খুন  করবই , কেমন  ভাবে  ?  না  , এটা  আমার ভাবনা  নয় আমার  ভিতরে কোন  শয়তান নির্ঘাত  ভাবিয়েছে ।  আমি  মনোবিদের  কাছে    গিয়েছিলাম  ।  তিনি টেনশনের  কথা  বললেন । ওষুধ  দিয়েছিলেন ।  আমাকে  কিছুদিন  ছুটি  নিয়ে  ঘুরতে  যাওয়ার পরামর্শ  দিলেন ।   লাভ  হয়নি ।আমি  সেই  অনুভূতির  অমোঘ আকর্ষণ  থেকে  পালাতে পারলাম  না।   আমি  এখন প্রায়  সত্তর  ভাগ  উন্মাদ । সুমালাও  আমাকে  ঘেন্না  করতে  শুরু  করেছে । আমি  ওকে খুন  করতে পারব না। নিজেই  সুইসাইড করব …

দেবব্রত বাবু  কাঁদতে  শুরু  করলেন । আমি  বুঝতে  পারলাম , এটা  একশ  শতাংশ  প্রেত ঘটিত  কার্যকলাপ ।  বলা  যায় , ঋণাত্মক  বা  অপবিত্র শক্তির  জন্য  হচ্ছে । আমি  বললাম

-আমি কাল  যাবও । দেখুন  আমরা  আপনার  কেসটা  হাতে  নিলাম  । আমার স্যারের  সাথে  আজ রাতেই  কথা   হয়ে যাবে । আপনি একদম  ভাববেন  না  ।  আমি কাল সন্ধ্যায়  আপনার বাড়ি যাব । রাতে  থাকতে  হতে  পারে  ।  মানে  যে  ঘরটাতে আপনারা  ঘুমান  সেখানেই , কাল  রাতে  আমরা  দুজনে  থাকব । আমি আর  মুমিন । দেখুন  আশা  করছি  আপনাকে  সুরাহা  করে  দেব  ।  আগে  বুঝতে  হবে  এই  নেগেটিভ  এনার্জিটা  আসছে  কোথা  থেকে  ।

বাসে তুলে  দেওয়ার  জন্য  , দেবব্রতদার   সাথেই  রয়েছি । আমরা বাসস্টপে  দাঁড়িয়ে আছি ।  আমার দিকে  তাকিয়ে  উনি বললেন – আপনার কথা  কালিপদ  আমায়  বলেছে । আপনিই  শেষ  ভরসা । জানিনা এরপর আমার  জীবনটা কোন  দিকে  ঘুরবে । আমি বাঁচতে  চাই  বেদ ।  আপনি আমার  ছোট  ভাইয়ের  বয়সী । দাদাটাকে  বাচিয়ে বাঁচিয়ে নিন । আর  হ্যাঁ  , কাল  আপনাদের  কোন অসুবিধা  হবে  না  ।  আমি  অগ্রিমটাও …

আমি  বললাম – দাদা   বাস  এসে গিয়েছে । কাল  সন্ধ্যা  সাতটায় । যাদবপুর স্টেশনে অপেক্ষা  করব ।  চিন্তা  নেই  ।  আপনার  ফোন   নম্বর আছে  । রাতে  প্রয়োজন হলে  আমাকে  ফোন করবেন । আর  বৌদিকে  ব্যাপার  গুলো  জানিয়েছেন ?

-না  ভাই  ।  তাহলে পাগল ভাববে ।  আসলে  ভূতুরে  কাণ্ডকারখানা  , বিশ্বাস যোগ্য নয় ।

-দাদা  উল্টোটাও হতে পারে  । ভয়ে  বৌদির  মানসিক  সমস্যা  শুরু  হয়ে  গেল !  তাই  না বলাটাই  ভালো  ।

আমরা  স্টেশনে  নেমেই দেখলাম  , ঘড়িতে    রাত    আটটা ।কলকাতায় যারা থাকেন  তাদের  কাছে  আটটা  সন্ধ্যা ।এখানে  মানে   কলকাতা  লাগোয়া   মফস্বলে   এখন রাত  ।

আমি   দেখলাম  চারদিকে  লোক  আছে  , তবে  তা   অনেকটাই কম । আমি কালিপদকে  বললাম – এখান  থেকে  কতদূর ?

-এই  কিছুটা ।

-কিছুটা মানে  ভাই ?

-চল্লিশ মিনিট । আমরা  অটো  ধরব ।  মিনিট  তিরিশ  । তারপর   রিক্সা  ধরে  দশ মিনিট । আমি  এই নিয়ে  তিনবার  এসেছি  ।

-ভালো ।

স্টেশনে  দেবব্রত  বাবু  কিছু  ফল কিনে  নিলেন  । যা বুঝতে  পারলাম  সাড়ে নটা  বেজে  যাবে ।

 

দেবব্রত বাবু  আমার  দিকে  এগিয়ে  এসে  বললেন – ভাবছেন ,  কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম !

আমি  বললাম –  একদম  নয় । আমি  জানি আপনার  সমস্যা বেশ  সিরিয়াস । পাগল  কেন  হবেন ? পাগলরাও  মানুষ । এতটা  ছোট  ভাববেন  না । আমরা  কেউই  সখের  জন্য আসিনি । পেশাদার । আপনার  মধ্যে  এতটুকু দ্বিধা  রাখবেন  না। আর  তুমি  বলবেন । কালিপদ আমার  বন্ধু  । মুমিন  আমার  থেকে  একবছরের  ছোট ।

আমার দিকে  তাকিয়ে  দেবব্রতদা  বললেন – আচ্ছা  ঠিক আছে। চলো ।

আমরা  চারজনে   অটো  থেকে  যেখানে  নামলাম , বেশ গা  ছমছমে  পরিবেশ । মানে  কলকাতার  কাছে  সুভাষগ্রামের  এই  অঞ্চল  একেবারেই  গ্রাম।   চারিদিকে  হোগলা পাতার  জঙ্গল ।  গোঁড়ায়   জমা  জলে  ,  সাপের  ছটফটানির  শব্দ  কানে  এলো ।  এই সাপ  বিষধর  হতেও  পারে  ।  মুমিনের  পীঠে  ব্যাগ রয়েছে । আমি আর  দেবব্রতদা  আগে  , পিছনে  কালিপদ আর  মুমিন ।  আজ রাতে  সজাগ থাকতে  হবে  ।  আজ রাতে নার্ভের উপর  খুব  চাপ  যাবে ।  আমি কালিপদকে  বললাম – তুই  , দেবব্রত  দাকে  নিয়ে  এগিয়ে  যা । আমি আর  মামুন  একটু কথা  বলে  নিচ্ছি ।

আমরা  হাঁটতে  -হাঁটতে  দেখলাম  দুটো  রিক্সা  এদিকেই  আসছে । একটায়   ওরা উঠে বসল ।  পিছনেরটায়  আমি আর  মামুন বসলাম ।  মামুন আমাকে  বলল – বেদ , কটা  থেকে  অপারেশন  শুরু  হবে  ?

-হিসেব  মতন  এগারোটা । আমরা সাড়ে  বারোটার  মধ্যেই   প্রস্তুত  হয়ে  থাকব ।

– ই এম  এফ মিটার  সাথেই  আছে  ।  ঘরে গিয়েই  ফুল স্পেক্টাম  ক্যামেরাটা  চার্জ  দিতে  হবে  ।

–  দেখিস  যেনও  যান্ত্রিক  সমস্যা  দেখা  না  দেয় ।

 

রিক্সা  বাড়ির  সামনে  এসে  থামল । দেবব্রতদা   রিক্সা  থেকে  নেমে   বললেন – তোমরা  সাবধানে  নামবে  । এই  পথটা  খানিক  কাদা  রয়েছে । পাঁচ মিনিট  হাঁটতে  হবে  । টাকা নিয়ে   রিক্সা   বাঁদিকের  রাস্তা  ধরে  চলে গেল । ছোট্ট  বিন্দুর  মতন ক্রমশ  মিশে  যাচ্ছে ।

সুমালা  বৌদি  গেট  খুলে  অপেক্ষা  করছিলেন । আমাদের  দেখে  বললেন – এসো , দেবব্রত  তোমাদের কথা  আগেই  বলে  রেখেছে । তোমাদের নাকি  শো  আছে । কিছুই  বুঝতে  পারলাম না  ! কালিপদ  বলল , আমার দিকে  তাকিয়ে  –  হ্যাঁ , বেদ এর  একটা  দল আছে  ।  দলের  নেতা সে নিজেই  । গ্রুপ  থিয়েটারের  দল ।  তাইনা ? বুঝতে  পারলাম  , আসল ঘটনা চেপে  গিয়ে  আমাদের  পরিচয়  গোপন করা  হয়েছে ।  মন্দ নয় । আমি  বললাম –  বৌদি  কালই  আমাদের  চন্দননগর  ফিরতে  হবে  । আমরা  থাকি  মুর্শিদাবাদ । এখানে  বিজয়গড়ে  শো  ছিল ।

সুমালা  বৌদি  চুড়িদার  পড়ে  ছিলেন ।  ওড়নাটা  বুকের  কাছে  টেনে  বললেন – ইস , আগে  বললে  দেখতে  যেতাম । তোমার  দাদা  একমাস  ধরে  কেমন  যেন হয়ে  গিয়েছে । কথা গুলো  বলেই  চুপ  হয়ে  গেলেন  ।  নিজের  মুখে  অন্যের কাছে  , দাম্পত্য  সমস্যা জানাতে  চাইছেন  না । ভারতীয়  নারীর  সেই  পরিচিত  স্বভাব !

আমি  বললাম – বৌদি খুব  ক্ষিধে পেয়েছে ,  কিছু খেতে  দিন  ।

-রাতে  মুর্গির ঝোল  আর  ভাত  । এখন  চপ আর  মুড়ি  । চলবে ?

আমি  বলবার  আগেই  মুমিন  বলে উঠল – ছুটবে  ।

রাতে   খাওয়ার টেবিলে  গল্প   হলেও , আমি আমার কাজের  দিকেই  মন  দিয়েছিলাম । আজ  রাতেই  কাজটা মিটে  যাবে । এইসব  কাজে  শুরুতে  যা  থাকে  , চাপা  উত্তেজনা। আর কিছুটা  স্নায়ু  দুর্বলতা ।   টেবিলে  দুটো  রুটি  আর  সবজি  খেলাম।  আমি আর  মুমিন । দুজনেই     এইরমক   অপারেশনের  রাতে  স্নায়ু  উত্তেজনা  তৈরি  করে  এমন  কিছু  খাইনা । বেশ  কিছুটা  গরম  দুধ  খেয়ে  ওদের  শোওয়ার   ঘরে  চলে এলাম  । অতিথির জন্য  এই ঘরটা  ভালো , এমন কিছু  বুঝিয়েই  দেবব্রত  দা  আমাদের  তিনজনের জন্য  এই  ঘর  দিয়েছেন ।

রাতের  অন্ধকারে  যা  বুঝলাম , সম্পূর্ণ গ্রাম্য  পরিবেশে  দ্বোতলা   বাড়ি । ঘর  গুলো বেশ  পুরানো ।  চুন  খসে গিয়েছে । রং ফিকে  হয়ে  গিয়েছে  ।  অনেক  দিনের  পুরানো  আসবাব  কয়েকটি  দেখতে  পাচ্ছি । শুনলাম  এই  বাড়ির  সাথেই  কিনে নিয়েছেন ।

আমাদের  খাওয়া  হয়ে  গিয়েছিল , রাত  দশটার মধ্যেই ।  এগারোটার  সময়  ছাদে   গেলাম  । এখনো পর্যন্ত  অন্ধকার , ঝি  ঝি র  ডাক  বাদ  দিলে ,  অপশক্তির  কোন  ইঙ্গিত  পেলাম  না ।

রাত বারোটার  সময় ।  মুমিন , ফুল স্পেক্টাম   ক্যামেরা চালিয়ে  দিল । এই যন্ত্রটার  বিশেষত্ব  হচ্ছে ,  অতি সূক্ষ্ম  আলো , আলট্রা  ভায়োলেট  আলো   বা কম রশ্মিতেও রেকর্ড করতে পারে  । হাল্কা  লাল  রঙের  আলো  বা  যদি তেমন আলো  নাও থাকে  ক্যামেরা  নিজের  থেকে  রেকর্ড  করে  নেয়  । আলোহীন    স্থানে  ক্যামেরা  রেকর্ড  করতে  পারে  । আমরা  এর  পর  আমাদের  ল্যাবে  গিয়ে  দেখে  নিতে  পারি  ।  ঘরে যদি কোন তড়িৎচুম্বকীয়   ক্ষেত্রের  উপস্থিতি  থাকে  , বা  কোন  শক্তির  আকর্ষণ  ক্ষমতা থাকে  , খুব সহজেই  বুঝবার  জন্য  সাথেই —   এম এফ  মিটার  রেখেছি ।

দেহহীন  অতৃপ্ত আত্মা  এমন  শক্তি , যার  বিরুদ্ধে কোন  প্রস্তুতিই  নিরাপদ  নয় । আমরা  এখনো  সব ধরণের  আত্মার  গতিবিধি  আর  ক্ষমতার  পরিমাণ  বুঝে  উঠতে  পারিনি  । এটা অসম্পূর্ণ  এবং  চলমান  খোঁজ ।

দেবব্রত দা  রাতে  এলেন । আমাদের  দিকে  তাকিয়ে বললেন –  জানিনা  , তোমাদের প্রতি অন্যায়  করছি  নাকি  ।

আমি  হেসে  বললাম

-একদম  নয় । আমরা  এই  কাজ  সব  রকমের  সাবধানতা  নিয়েই  করি । আর  হ্যাঁ , এই স্বীকারোক্তিটা  নিন ।

দু’পাতার   কোর্ট পেপার   দেখে  দেবব্রতদা  থতমতও খেয়ে   গেলেন  !

আমি  বললাম – এখানে  লেখা  আছে  আমাদের  দু’জনের  যদি  কিছু  হয় , তার  দায়িত্ব  আমাদেরই ।  কালিপদকে  আপনি  অন্যত্র  রাখতে  পারেন  ।  মানে  এটা  সাধারণ  ব্যাপার  যেমন কোন অপারেশনের  আগে  ডাক্তারকে  সই  দিতে  হয় রুগীর পক্ষ  থেকে  ।  তেমনই আমাদেরকেও   কোন  অভিযান    চালানোর  আগে  চুক্তি করতে হয়  ক্লাইন্টের সাথে   । আপনি এটা  বুঝতেই  পেরেছেন  ১ শতাংশ  হলেও লাইফ  রিস্ক  থাকেই  ।

কালিপদকে আমাদের  সাথে  রাখলাম  না  । যদিও  বেচারার  খুব  ইচ্ছা  ছিল ।  দরজা বন্ধ  করে  দিলাম  । ক্যামেরা  আর  ই  এম এফ  মিটার   চালিয়ে  দিয়েছি  । নাইট ল্যাম্প  নিভিয়ে , সেই  অদৃশ্য শক্তির  জন্য  অপেক্ষা  করে   রয়েছি ।

 

আজ  রবিবার । সন্ধ্যার ট্রেন   ধরলাম  । বাড়ি  ফিরতে রাত হবে ।  আজ আমি আর  মুমিন   বাড়ি ফিরব না । অন্য  জায়গায়  যেতে  হবে  ।  আমাদের সাথে  কালিপদ ফিরেছে । আমি আমার আগের  রাতের  অভিজ্ঞতা   ক্যামেরায়  বন্দী  করে  নিয়ে  যাচ্ছি ।  বৌদি  দুপুরে  পেট পুড়ে  খাওয়ালেন ।

স্টেশনে  নেমে , কালিপদ  বলল –  ওখানে কিছু  বললি না  ভাই  এখানে  কিছুতো  বল । ভাই  রাতের  ঘটনা  না  শুনলে  আমি আজ আর  ঘুমোতে  পারব  না । কাল স্কুল  আছে  । ট্রেনে  দেখছিলাম  তোরা ঝিমুচ্ছিলিস  ।

আমি হাসলাম ।- তাহলে  প্রথম  থেকেই  শুরু করছি স্টেশনের অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে  বসতে  পারি  । সাথে  অবশ্যই  তিন  ভাড় চা  ।

আমরা  চা  নিয়ে  , স্টেশনের  একদম  শেষ প্রান্তে  ,  খালি  কাঠের  বেঞ্চের  উপর  বসলাম  ।  এখানে লোকের কোলাহল  কমই আছে । ঘড়িতে  রাত  নটা ।  যেখানে  বসেছি দিনের বেলা  পান বিড়ির  দোকান  বসে । সন্ধ্যা আটটায়  বন্ধ  হয়ে যায় । বেঞ্চটা  বাঁধাই  আছে । এখানেই  থাকে  ।

আমি  গল্প  শুরু  করলাম ।

আমরা কেউই  চোখের  পাতা  এক করিনি । অথচ  আমরা  পাশাপাশি  শুয়ে  ছিলাম  ।  আচমকাই  টের  পেলাম,  মুমিন  আমার কাঁধে ঈশারা  করছে !

সত্যি  বলতে  আমি  শুয়ে   ছিলাম  ,হাল্কা  চোখের  পাতা আধ –বোজা অবস্থাতে   দেখলাম , কিছু একটা  আমার মাথার দিকে    সরে  গেল  ! মানে  কালো  ন্যাকরা  যেনও কেউ সরিয়ে  দিল  । নিঃশ্বাস  থামিয়ে  রেখেছিলাম । বুঝতে পারছি  উপদ্রব  শুরু  হল   বলে ।আমাদের সাথে  ই  এম এফ  মিটার  রয়েছে , ক্রমশই  অনুভব  করছি একটা  চুম্বকীয় ক্ষেত্রে র । মিটারের কাটা বা  সূচক   ক্রমশ   লাল  দাগের  ঘরের  দিকে  যাচ্ছে ,   মানে   শক্তি  ক্রমশই  শক্তিশালী  হচ্ছে  ।

মনে  হচ্ছে  একটা  শক্তি  তীব্র  আকর্ষণ করছে । হ্যাঁ  এইরকম পরিস্থিতি  নতুন  নয় ।    ঘর  অন্ধকারে  ভরা  । আমাদের  দুজনের  মাঝখানে   মিটারের লাল আলো  জ্বলছে  , আবার  নিভছে । পুরো  ঘরে   ওইটুকুই  লালা  বিন্দু  ।  কিছুক্ষণ  বাদে  অনুভব করলাম  আমার ঘাড়ের  কাছে  হাল্কা  স্পর্শ ।  আমাদের  চোখের  অনুমান রাখতে  হয় ।  কিছুক্ষণ  আগে  অন্ধকার  ঘরেও   আরেকটু   চাপা   অন্ধকার, চলমান  মিশে  না- যাওয়া   অন্ধকারকে  আমাদের  মাথার  দিকে  চলে আসতে  দেখেছি  ।  আর   মিটারের   সূচক  লাল  ঘর  ছুঁতেই  জ্বলে উঠেছে  লালা  আলো ;  অর্থ হচ্ছে সেই  আত্মা মাথার  দিকেই  রয়েছে ।

ভয় । আমার  মধ্যে  ভয়  কাবু  করছে ।   ত্রিনয়নদার  সাথে  আগেও  অনেক  অশরীরীর সন্ধানে  অভিযান করেছি । এই সময়  তবুও  যেনও  মনে  হলও , বেশী কিছু  হয়ে যাবে নাতো ?

সত্যি এই  ছোঁয়াটা  যেন  আমার  ভিতর পর্যন্ত  চলে  যাচ্ছে । আমি  ভাসছি । কিছুক্ষন কিছুক্ষণ আগে  যে  ভয়  ছিল  , তা  রোমাঞ্চে  রূপান্তরিত  হয়ে  গেল !

আমার এখন  এক  অদ্ভুত  খেয়াল  মনে  এসেছে  ।   পাশে  যে ছেলেটা  শুয়ে  আছে  , মানে  যাকে  আমি  মুমিন  নামে  ডাকি  , তার সাথে  আমার  সম্পর্ক   কিসের  ? কেন  জানি  আমি সহ্য করতে পাচ্ছি না  । আবার  কিছুক্ষণ  বাদেই  নিজেই  নিজেকে ধিক্কার জানালাম । হ্যাঁ , আমি  অবাক  হয়ে  যাচ্ছি  সহজে অপবিত্র  শক্তিটা  আমায়  দখল  করে নিচ্ছে ! তারমানে  এই  আত্মাটার  এটাই  কাজ  , অন্যের  অনুভূতিকে  নিজের  মতন  নিয়ন্ত্রণ  করতে  থাকবে  ।

মামুন আমার দিকে  তাকিয়ে  গল্প  শুনতে –শুনতে  বলল – বেদ , তুই আমাকে   শত্রু ভাবছিলি !

আমি  বললাম – বস , আমি  নই । ওই   নেগেটিভ এনার্জি  আমার  সমস্ত  চিন্তাকে নষ্ট  করে  দিচ্ছিল । আমি  কিন্তু  নিজেকে  অন্যের হাতে  আত্মসমর্পণ করিনি । নিজেকে  বলতে  শুরু  করি –  এই পৃথিবীতে  ভালো  আর  মন্দের লড়াই  চিরটাকালের ।  শয়তান  আর  ভগবান  পরস্পরের  মুখোমুখি ।  খারাপ  ভালো  পাশাপাশি  আছে  ।  পবিত্র আর  অপবিত্রের  এই  লড়াইয়ে  আমি  অন্ধকারের  বিপক্ষে  আলোর  সাথী ।

শক্তিটা   আমাদের এক  অন্য যৌন অনুভূতির  অনুভব করায়  আর সাথে –  সাথে  ঈর্ষার  জন্ম  দেয় । এখান থেকেই  ধ্বংসের  চিন্তা শুরু  হয় ,আমি  কিছুতেই এই  অনুভূতি  উপভোগ করব না।  কেননা  উপভোগ করলেই  তা  ধীরে  ধীরে  প্রবেশ  করবে ।

-তারপর ।

-কালিপদ  খালি  ভাঁড়ে  ভূতের  গল্প জমবে  না । আরেক রাউন্ড চাই । সাথে  কেক ।

চায়ের  ভাঁড়ে  চুমুক দিয়ে  , কেকে  কামড়  বসাতেই মুমিন  বলল – বেদ , এই সব  কিছু  দাদাকে  বলবি । আশা করছি  ভিডিও হয়ে গিয়েছে ।  সেই সব কিছু দেখেই দাদা নিজেই কালকে  দেবব্রতদা  কে  জানিয়ে  দেবেন  হয়ত ।

আমি বললাম – তাই  কথা  হয়েছে । এই  শক্তি  তেমন ক্ষতিকারক নয় । হলে  এত  সময়  নিত  না ।

কালিপদ  বলল – বেদ  এটা ঠিক  অপশক্তি  আছে । কিন্তু এটা কেন  ওই ঘরটাতেই  ?

আমি বললাম । আসলে…

দেখলাম  আমাদের  কথার  মাঝেই ,   একটি  ট্রেন  শিয়ালদহ  থেকে  এসে  সোনারপুরের  দিকে  চলে  গেল । বেশ  শব্দ  নিয়েই  । আমরা  কিছুক্ষণের  জন্য  শুনতে  পারছিলাম  না।  ট্রেনটার  সাথে  এক  ঝাঁক  হাওয়া  জলের  ঝাঁপটার মতন  মুখে  এসে  পড়ল ।

ট্রেনটি  যেতেই   আমি  বললাম – সত্যি  বলতে ,  অল্প  সময়ের  জন্য  হলেও  আত্মা  আর আমার মাঝে  ডুয়েল  হয়ে  গেলও  ।  শেষ পর্যন্ত  মানে  প্রায় ভোর   তিনটে পঞ্চাশ   হবে  , আমি  বুঝলাম  আত্মাটি  ক্রমশই  নিস্তেজ  হয়ে যাচ্ছে ।  মিটার এর  সূচক  সবুজ  ঘরে  আসতেই ,সবুজ  আলো  জ্বলে উঠল ।  বুঝলাম  আমরা  নিরাপদ । পিছনে  জানালার ফাঁকে  হাল্কা  আলোর  রেখা  যেনও  আটকে  রয়েছে । শরীর ক্লান্ত ,চোখে  ঘুম  নামছে  । সারারাত  আমি স্নায়ু  যুদ্ধ  করলাম !

সারারাত  আমরা  দু’জনেই  ঘুমাইনি । এটাই অবশ্য  নিয়ম । তবুও ঘুম নেমে এসেছে । পাশে  দেখি  মুমিন   ঘুমিয়ে  আছে  । হাতের  ঘড়িতে  তখন   ভোর  চারটে  দশ । ভাবলাম  এখন  চারপাশে  সবকিছু বেশ  শান্ত , নিরাপদ  ।  চোখ বন্ধ  হয়ে  এল ।

খুব  ভোরে  উঠেই , সাড়ে’ ছটায়   না  খেয়ে  বেড়িয়ে  গেলাম । চারপাশ  ঘুরতে  । অনেকের সাথেই  কথা  বললাম ।  ওখানকার পুরানো  বাড়ি  বলতে  এটাই । আমি একজন  বয়স্ক  বছর  ষাটের  লোককে  দেখলাম ।পুকুর পাড়ে  মাছ  ধরছিলেন ।  আমি কলকাতা  থেকে এসেছি  শুনে  নিজেই এসে জানতে  চাইলেন ।  কথায় – কথায়  অনেক  কিছু  জানতে  পারলাম  ।

কালিপদ  বলল – লোকটি কি  বলেছেন ?

-আসলে  এই  নিয়ে  তিনজন বাড়ির  মালিক  পরিবর্তন  হয়েছে । এরা  কেউই   থাকতে  পারেননি । কোন  এক  অজানা  কারণে   বাড়ি বিক্রি  হয়ে  যায় ।  আসলে  ওই  ঘরে অনেক  বছর  আগে প্রায়  তিরিশ  বছর  হবে  , এক বিবাহিত  মহিলাকে খুন  করা হয়েছিল ।

-মানে ?

– না  , সরাসরি নয় ।  আসলে   গ্রামের  লোকেরা  দিনের  বেলায়   শুধুমাত্র  দেখল  বউটিকে  চাতালে  শুয়ে  রেখে   বাড়ির  সকলে  খুব  কাঁদছে । স্বামী , শ্বশুর , শ্বাশুড়ি   । বউটির   ঠোঁটের  কাছটায়  নীল হয়ে গিয়েছে । আসলে  স্বামীটি  এই  বিয়ে  ছিল  শুধুই  টাকার   জন্য ।  বাইরে  হয়ত অন্য  কেউ  ছিল । অসহায়  মেয়েটিকে প্রাণ  দিতে  হয় । আমার  মনে হচ্ছে , ওই ঘরে  আচমকাই  তাকে  বিষ খাইয়ে  রাত  একটার  পর  মেরে  ফেলা   হয়েছিল । এটাই কারণ  ওই  সময়  বউটি র ভিতরের  শক্তি  ঘরেই  রয়ে  গিয়েছে । ওই  সময়ে  সে  সক্রিয় হয়ে ওঠে । সেই  শক্তি   আরও    সক্রিয়  হয়ে  ওঠে   ,  সেখানে  থাকা  এমন জীবন্ত  দেহ  , যার   ভিতরে যৌনতার   অনুভূতি   রয়েছে ।  দুটো  অনুভূতি  একে  অন্যের  খোঁজ  পেলেই  মিশতে  থাকে ।   তখন   অপশক্তি  সেই  জীবন্ত  দেহের  শক্তির আমন্ত্রণের  সুযোগ  নিয়েই , জীবন্ত  দেহে  প্রবেশ  করতে  থাকে  আর  নিয়ন্ত্রণ করতে  শুরু  করে ।   আমাদের  দেহ  আসলে  যন্ত্র । আমরা  বিভিন্ন  অনুভূতিতে নিজের  মধ্যে  নিয়ে  , নিজেকে  চালনা করি  তেমন ভাবেই   ধীরে – ধীরে  অন্যের  কাছে  নিজেকে  আত্মসমর্পণ করে ফেলি । আসলে  ত্রিনয়ন  ঘটক   একটা  ভালো  কথা  বলেছে – আমাদের এই যে  রক্ত মাংসের  দেহ , তা   সবটাই  ‘ভাবে ’পরিপূর্ণ । এই  ভাবটাই  আত্মা । আর আমাদের  দেহের  ভিতরে  এই যে  ভাবশক্তি  বা  আত্মায়  থাকা আত্মশক্তি  তা  যদি নির্দিষ্ট  ভাবে  তার  পরের পর্বে প্রবেশ  করে ,  তবেই   তা  আবর্তিত হয়ে পুনরায়  ব্যবহৃত  হয় । যেই  শক্তি  প্রকৃতিতে   মিশতে পারেনা , ব্যবহার হয়না , তারাই   আশ্রয়হীন ভাবে    থেকে  যায় । ঘুরতে  থাকে  । আর  যদি  নিজের  জীবিত পর্যায়ের  আশা  পূরণ  না  হয় , তাহলে  দেহহীন ভাবেও   আগের  মতনই  আচরণ করে ।  আচমকা   যেই  জীবন্ত  দেহে থেকে     শক্তি   বেরিয়ে  যায়  , তা  অন্য  দেহে  প্রবেশের  সুযোগ পায়না এবং  এই  শক্তি  কোন  যন্ত্রণা  বা  মানসিক আঘাত থেকে  নির্গত  হয় বলেই   —– তা  মিশতে পারেনা  ,  অতৃপ্ত  থাকে  । এই  ধরণের  শক্তিই  আসলে  অন্যের    জীবন্ত দেহে  নিজের  খেলা  দেখাতে  শুরু  করে ।সুতরাং  মোটা  বাংলায়  অতৃপ্ত  আত্মাকে  ভূত  বলতে পারি ।  আসলে  ভূত খুব সরল আর আরোপিত  শব্দ  । সত্যি  বলতে  ভূত  বলে কিছুই  হয়না  ।আমরা যা  নিয়ে  কাজ করি  তা  হচ্ছে  আত্মা । গল্প  এখানেই  শেষ ।  আমি  সবকিছু ত্রিনয়নদাকে  জানিয়ে  দেবো । আশা  করছি  এই সমস্যার  সমাধান  হবে  ।

অনেক রাত  হয়ে  গিয়েছে  ।  কালিপদ  উঠে দাঁড়িয়েছে । বলল – আজ বাড়ি  ফেরা  যাক ।

ঘড়িতে  রাত দশটা । এক  ঘণ্টা  ধরে  গল্প  চলেছে !

আমি বললাম – শুভ রাত্রি  আজ আমরা  ত্রিনয়ন স্যারের  কাছে  যাব । চিন্তা  করিস না । দেবব্রতদাকে   আমি সব  কিছু  বলে  দিয়েছি । আর অন্য  ঘরে  আজ রাতে  ঘুমোতে  বলেছি ।  রাতে   যা  ঘটবে রিপোর্ট   দেবে । আমাদের  কাজ এখানেই  শেষ এই  দেখ দেবব্রত দা  টাকাও  দিয়ে দিয়েছেন ।  শুধু কাল সকালে  রিপোর্ট পেলে  আরও  ভালো  ভাবে  বলতে পারব ।

কালিপদ  আস্তে  -আস্তে  রেল লাইন  পেড়িয়ে  উল্টো  দিকে  চলে  যাচ্ছে । আমি আর  মুমিন  তাকিয়ে  আছি  ।

মুমিন   আমার  দিকে  তাকিয়ে  বলল – আচ্ছা , এই  এনার্জিটা  আমাদের  এত  দ্রুত  আক্রমণ করে  বসল । অথচ  তুই  আমায়  বলেছিলিস দেবব্রতদাকে  আক্রমণ করতে  প্রায়  মাস  ছয়েক সময়  নিয়েছিল ।  ঠিক বুঝলাম  না  ।

-এটা  অনুমানের  মাধ্যমে বলতে  হয় ।  কেননা অনুমান  বলছে , নিষ্ক্রিয়  হয়ে  দীর্ঘ দিন  থাকবার  ফলে  শক্তির ভিতরকার যে  অনু –পরমাণু গুলো  রয়েছে , সেগুলো ক্রমশই নিজেদের  অভ্যাস  পাল্টাতে  শুরু  করেছিল । তাই  প্রথমেই  আক্রমণ করেনি । এরপর যখন দেবব্রত আর  সুমালা  বৌদির  দাম্পত্য  যৌন জীবনের  অনুভূতির  আঁচ  পেয়েছে , ধীরে –ধীরে নিজেকে  পাল্টাতে  শুরু  করল । আমরা  যখন ছিলাম  আমাকে  আক্রমণ করে ছিল কারণ আমি  মনে –মনে  প্রচণ্ড  ভাবে  যৌন  চিন্তা  করছিলাম । ফলত  শক্তি আমাকে বাধ্য  হয়েই  আক্রমণ করেছে ।  বুঝলি …

সোমবার  । দেবব্রত মাইতি   রিক্সায়  উঠে  সুবলার  কামড়ের  দাগটায়  হাত বুলালো । মনে – মনে  বলল – আজ রাতে  গিয়ে  , সুমালাকেও  এমনই কিছু উপহার দেবো    । এই   রকম  গুপ্ত  প্রেম চিহ্ন  মেয়েরা  , তার  প্রেমিককে  দেয় । কালিপদ  বলেছিল ।  ওর বান্ধবি দিয়েছে । লভ বাইট । এই একমাসে , সুমালা আগের  থেকে অনেক  বেশী  পরিণত   হয়েছে । দেবব্রতর  উপর অধিকারটাও  আগের থেকে  অনেক বেশী  ।  কাল অনেক রাত  পর্যন্ত  তারা  বিছানায়  দেহের খেলায়  ভেসে ছিল । সে এক  অন্য রকম মুহূর্ত  । ভোরের  দিকে  চোখে  ঘুম  নেমে  এসেছিল ।  বেলায়  যখন  ঘুম ভাঙল , পাশে  সুবলা বাচ্চা মেয়ের মতন  ঘুমিয়ে আছে । দুজনেই নগ্ন । পাতলা চাদর আছে  । শেষ রাতে , দেবব্রতই  দিয়েছে । সুবলাকে খুব আদর করতে ইচ্ছা  করছে । মানুষের  জীবনে  ভালোবাসা খুব দরকার । শেষ  একমাস  সে যেন  ভালোবাসার কাছ থেকে  নির্বাসন  নিয়েছিল !

স্টেশনে  নেমেই তার মনে হচ্ছে , অনেক দিন বাদে  সে বেশ  চনমনে  বোধ করছে । দেহে  আর মনে  অদ্ভুত  তৃপ্তি ! এই তৃপ্তিটুকু  শরতের   ঝলমলে  আলোর  মতন । যেখানে মুক্তির  বার্তা   রয়েছে । বুকের ডানদিকে  কামড়ের  চিহ্ন , সুবলার উপহার । এই মেয়েটাকেই  সে  ভালোবাসে । সে  চায়  এই মেয়েটাকেই   জীবন  ধরে  ভালবাসতে । কিন্তু এই আনন্দ তার  ক্ষনিকের  ? সে  কি সেই অভিশপ্ত  রাতেরম্বর শ্বাস  সে রেহাই পাবে  ? কেউ কি দেবব্রতকে  বলে  দেবে  সেই পথ ?

স্মার্ট ফোনে  রিং  হতেই , একটা  অপরিচিত  নম্বর !

-হ্যাঁ  বলুন ।

উল্টো  দিক থেকে  ভারী  গলা  ভেসে  এলো – আপনি  দেবব্রত  মাইতি ?

-হ্যাঁ ।

-শেষ  শনিবার মুমিন  আর বেদ আপনার বাড়িতে  ছিল  ?

-হ্যা  স্যার ।

-আমি সেই  বিষয়টা  নিয়েই  কথা  বলতে চাই  ।

-হ্যাঁ  স্যার ।

-দেখুন , সত্যি  বলতে যে ঘরটায়  বেদ রা ছিল সেখানেই কোন  অপমৃত্যু  ঘটেছে । আমাদের যন্ত্র  সেই নেগেটিভ  এনার্জি  বা  অপশক্তিকে  চিহ্নিত  করেছে । আপনি দেখতেই পারেন ।

গলা কাঁপছিল  দেবব্রতর  বলল – স্যার  বাড়িটা  ছাড়তে  হবে ?

-দেখুন , সত্যি বলতে  আমরা  ওই  স্পিরিটটাকে ওখানেই থাকতে  দেখেছি । শক্তিটা ওই  ঘরের , এমনকি  বিছানার  চারদিকেই  রয়েছে । একটা অদৃশ্য  চৌম্বকীয় ক্ষেত্র  তৈরি  করেছে , যা  নির্দিষ্ট  সময়ে  সক্রিয় হয়ে  ওঠে ।

-ঠিক  বুঝলাম  না ।

-দেখুন  আমি, আপনি আমরা  সবাই  শক্তি স্তম্ভ । বলতে  পারেন  আমাদের  চলন্ত দেহটা  প্রমাণ করছে যে  আমরা  বেঁচে  আছি । আচ্ছা সিলিং পাখাটায়  বিদ্যুৎ চালনা  করবার  আগে সেটা  কখনো দেখেছেন ?

-মানে  স্থির পাখা । সিলিং ফ্যান ?

-হ্যাঁ ।

-দেখেছি ।

-বলুন , অনেকটা  শ্মশানের    মৃতদেহের মতন মনে হয় ?

-এই রে ! মানে  স্যার  অতটা …

-এমন ভাবে  আমরা কেউই  ভাবতে  অভ্যস্ত নই । এটাই  স্বাভাবিক । তাইতো  ভূত , প্রেতের মতন মনগড়া  চরিত্রে  আমাদের  বিশ্বাস থাকলেও , জীবন্ত  শক্তিকে  অস্বাভাবিক  বলে মনে  হয় । দেখুন  , শক্তির  শেষ  নেই  শুধু  রূপান্তর  রয়েছে । এমনই  এক  বিশেষ শক্তির  অবস্থাই  আত্মা । এই  আত্মা  কখনো পবিত্র  হয়  আবার  অপবিত্র । এটা  নির্ভর করে  সেই  আত্মা  যেই পরিস্থিতিতে  দেহ বা  জীবন্ত  আশ্রয়  ত্যাগ  করেছে তার উপর ।আমাদের কাছে     সেই আত্মার  অস্তিত্ব  খালি  চোখে   ধরা  দেয়  না । এর  পিছনে আবার  দীর্ঘ  কারণ রয়েছে । এতকিছু  ফোনে  বললে  মাথায়   নিতে  পারবেন   না । তাই কাজের  কথায় আসছি  । দেখুন আমি বলতে চাইছি , আমাদের মধ্যে অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে । ভুল না বলে সরল ধারণাও বলা যায় । তারা ভাবেন আত্মা এক দেহ থেকে আরেক দেহে প্রবেশ করে । এমনটা হয়না একটা আত্মা নিজের ইচ্ছা শক্তি দিয়ে অন্য আত্মাকে  নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । আপনাদের ওই রুমে এমনই এক অতৃপ্ত নারী আত্মার অবস্থান  আছে । নারীটির অপমৃত্যু হয়েছে ।  আপনাকে বেদ সব জানিয়ে দেবে ।

–  তাহলে আমি এখন করব কী ?

-দেখুন আপনার  কাছে  এখন  দুটো পথ । এক  , সম্পূর্ণ  বাড়িটা  বিক্রি  করে  দেওয়া ।দুই, ওই  ঘরটাকে বন্ধ করে  দেওয়া  ।  সহধর্মিণীকে  বুঝিয়ে  দেখুন  ।

-মানে  স্যার  , কোনদিন ওই  ঘর ব্যবহার করা  যাবেনা ?

-না । ঘরেই  আত্মা আছে , তাই ঘর ব্যবহার  করলে  একই  রকমের পরিস্থিতি হবে  । ওই  ঘরে  এক নারী  দেহের  অতৃপ্ত  আত্মা  রয়েছে । যে  প্রতি  রাতে  একই  সময়ে  সক্রিয়  থাকে  । আর  কোন  যৌন অনুভূতির  স্পর্শ পেলে , সেই  শক্তি  অনুঘটকের কাজ  করে । নারী  আত্মা  পুরুষ দেহী  আত্মাকে  ক্রমশ  বশ  করে  নেয় ।  তখন  আপনি  এক  অদ্ভুত  যৌন  চিন্তায়  ডুবে  থাকবেন  । আর  এই  চিন্তার  সাথে – সাথে  মনে  হিংস্র  ভাবের জন্ম  হবে  ।  যেমন  আপনার   হয়ে ছিল  । তখন  আপনি আর সেই  যৌন অনুভূতির  মাঝে  তৃতীয় কোন  ব্যক্তির  স্থান  নেই । সে  শত্রু । তাকে  সরিয়ে  দেওয়ার  ইচ্ছার জন্ম হবে  । আপনি সবই  বুঝতে  পারছেন  । চিন্তা  নেই  এই   অপবিত্র  আত্মা  শুধু মাত্র  ঘর আর  ওই  খাটের  চারপাশেই  সীমাবদ্ধ । তাই ঘরের  বাইরে  আসবার  প্রশ্নই  নেই ।

-আচ্ছা  যদি  সে  ঘরের  বাইরে  চলে  আসে ?

কিছুক্ষণ থেমে  ভারী পুরুষালি কণ্ঠস্বরে লোকটি  দেবব্রতকে  বলল –আরে , না  । একদম নয় । কখনই কোন  আত্মা নিজে  থেকে  এক স্থান থেকে  আরেক স্থানে  হেঁটে  যেতে  পারেনা । তা  তখনই  আর  ততদূরই  যেতে  পারে  , তাকে  জীবিত অবস্থায়  যতটা নিয়ে  যাওয়া  হয়েছে ।  মানে  আত্মা  নিজের  পরিচিত  স্থানেই  ঘোরাফেরা  করে ।  আপনারা  অনেক সময় বেশ  কিছু    হরর মুভিতে  যা দেখেন  , বা   অধিকাংশ গল্প উপন্যাসে যা  পড়েন তা  বাস্তবের  থেকে  অনেক দূরে । আমরা  এগুলো  দেখে   খুব  বিরক্ত  হই । একেতো ভূত , প্রেত  নিয়ে  বাজারে  আলাদা  লোক  ঠকানো  বাজার আছে  । তারউপর   ভূতের  এমন  বিবরণ  শুনে অর্ধেকের বেশী  ভাবেন  ভূত  আসলে  মানুষের  মতনই ।  দেখুন আমি যেটা বোঝাতে  চাইছি , ভূত  বলে কিছু  হয়না । যেমন  বিদ্যুৎ  ছাড়া বাল্ব  জ্বলে না  , আত্মা  তেমন নিজের  পরিবেশের  বাইরে  নিষ্ক্রিয় । তাই  চিন্তার  কারণ  নেই  । তবে  বাড়িটাতে   থাকবেন  কিনা তা  সম্পূর্ণ  আপনার  উপর ।

দেবব্রত কিছুক্ষণ  চুপ  থেকে  বলল

-আপাতত  থাকব , তবে ভাবছি একমাসের মধ্যে  বিক্রি করে  দেব  ।

-আপনার  ব্যাপার  । আমি আপনাকে  জানাবার জন্যই  ফোন করেছি  যদি  প্রশ্ন  থাকে  করতে  পারেন  ।

-দাদা  , খুব  ভয়  লাগছে  । মানে  আত্মাকে ঠিক  বিশ্বাস করতে  পারছিনা ।আমি বুঝতে  পাচ্ছি আমার  কথা  আপনাকে  বিরক্ত  করছে । তাও   বলতে  পারবেন  আত্মা  কতটা  বিশ্বাসযোগ্য ?

-দেখুন  , মানুষকে  বিশ্বাস করেছেন । ভগবানকেও । না  হয়  একমাস  আত্মাকেও বিশ্বাস করুন । দেখবেন  , আপনার  আত্মবিশ্বাস  বাড়বে । আত্মাকে  ভালবাসতে শিখুন ।বিশ্বাস  আর ভালোবাসা  খুব  কাছাকাছি থাকে  । আপনি  যদি আত্মাকে  গিয়ে  চার্জ  না  করেন , তাহলে  সে  আগের  মতন  সক্রিয় হবে  না  ।  এটাই  স্বাভাবিক ।  তাই বলছি  মানুষকে  ভাড়া  না  দিয়ে  ভূতকে  থাকতে দিন  । ভূতেরা  মানুষের  ক্ষতি করেনা ।

-কি যে  বলছেন !

-আপনি  শীর্ষেন্দু  মুখোপাধ্যায়ের  ভূতের গল্প  পড়েছেন ?

-কেন  বলুন তো ?

-পড়ে দেখুন  ।  ভূত যে  উপকারী  , সে  ব্যাপারে  সন্দেহ থাকবেনা।

বলেই  লোকটি হাসতে  শুরু  করল ।

দেবব্রত  কিছু  বুঝতে  না  পেরেই  বলল – মজা করছেন ?

-বলতে  পারেন । আমাকে  বিশ্বাস  করতে পারেন । তাও  যদি কোন  অসুবিধা হয়  চলে  আসবেন  ৬৮ বি  যোধপুরপার্ক । আছি আমরা ।

-স্যার  কিছু  মনে  না  করেন , আপনার  পরিচয়  জানতে  পারি ?

-অবশ্যই । আমার  প্রথমেই  বলা  উচিত  ছিল । আমার নাম  ত্রিনয়ন  ঘটক । বেদ  আর  মুমিন  আমার  সহযোগী ……

-দেখা  হবে  স্যার ?

-অবশ্যই । ঠিকানায়  চলে  আসতে পারেন । তবে  এক সপ্তাহ  আগে  থেকে  ফোন করে  জানিয়ে  আসবেন    ।বুঝতেই  পারছেন নানা কাজে  ব্যস্ত থাকি ।

-আপনি ভূত  সন্ধান  করে  বেড়ান ?

-না ।আমি  আগেও বলেছি  আমরা  ভূত  বলে কোন কিছুতে  বিশ্বাস করিনা ।  তবে  আত্মায়  বিশ্বাস  করি । আর  ক্ষতিকারক আত্মাই  প্রেতাত্মা  হয় ।  আমরা  আত্মা সন্ধানী ।

-মানে  আপনার অপবিত্র  আত্মাদের  বিরুদ্ধে  লড়াই করে  চলেছেন  ! আপনাদের  কাছে  আমি  কৃতজ্ঞ ।

-লজ্জা  দেবেন না । এটাই  আমাদের  কাজ  , আপনি  এই  কাজের  পারিশ্রমিক  দিয়েছেন । যেমন বিদ্যালয়ে  ছাত্রদের  অঙ্ক  শেখানো  আপনার  পেশার  অংশ । তেমনই   অপবিত্র আত্মাদের  সন্ধান পেলে , তার  বিরুদ্ধে  অভিযান  চালানো আমাদের  পেশার  অঙ্গ ।

-আপনি  আমাকে  দুশ্চিন্তা থেকে  মুক্তি  দিলেন ত্রিনয়ন  বাবু ।

– দেবব্রত  বাবু, শুভ   শক্তির  উপর  ভরসা  হারাবেন না  । ঈশ্বর  অনেক শক্তিশালী  আর  চরম  সত্য  শক্তি । আমরা সকলেই  সেই  শক্তির  অংশ ।  আমি  বা   আমরা   সেই  শক্তির  সাধক মাত্র । খুব নগণ্য । সামান্য ।