১
শেষ পর্যন্ত ওরা একটা বাড়ি পেয়েই গেল । কলকাতার খুব কাছেই । স্টেশন থেকে নেমে তিরিশ মিনিট ।এইদিকে শহরের রঙ এখনো মাখেনি , তবে অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে । বৃষ্টি পড়লে জল জমে , কাদাতেও মাখামাখি হয় । এই জমা জলে মশাও জমে । কাদা শুকিয়ে গেলে খরখরে হয়ে ওঠে । তাইবলে আগের মতন জল অনেক দিন অপেক্ষা করে থাকেনা , নিকাশি ব্যবস্থা আগের থেকে ভালো হয়েছে । এই ভরসাটুকু নিয়েই জলের দরে এই বাড়িটা কিনে ছিল ।
দেবব্রত মেদিনীপুর থেকে কলকাতার স্কুলে পড়াতে এসেছে পাঁচ বছর হয়েছে । এই বছরটা ছয় নম্বর বছর । নতুন বিয়ে । সুমালাকে যেইদিন প্রথম দেখে ছিল , দেবব্রত প্রথম দেখায় পাঁচ মিনিট গল্প করেছিল । খুব অল্প কথা । আজও মনে আছে ,প্রথম যেইদিন দেখে ছিল সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি । চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিল , এমন মেয়েকে সারা জীবনের জন্য পাশে পাবে ! বিয়ের রাতে এই স্নায়ুর দুর্বলতা কাটেনি তার । সাতদিন কেমন ইতস্তত হয়ে থাকত । মেয়েটাই স্বাভাবিক করল ।
ভীরুতা আর খুনসুটির তীব্র চেষ্টা নিয়েই , তাদের দাম্পত্য চলেছে । সোম থেকে শনি স্কুল , তারপর ফিরে আসা । সুমালা একদিন সরাসরি বলল – আমাকে নিয়ে কলকাতায় চলো ।
বাড়িতে ছোট ভাই , বোন , বাবা -মা । অবশ্য যৌথ পরিবারে থাকে দেবব্রত, তাই হয়ত খুব সহজেই সুমালাকে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছে ।
এখানে এসে একমাস ভাড়াই ছিল , এক দালাল এই বাড়ির খোঁজ দিয়েছিল । জলের দরে পেয়ে গেল বাড়িটা ।
প্রথম ছয়মাস স্বপ্নের মতন কেটে ছিল । দেবব্রতর চোখে ভাসছে , বাড়ির প্রথম রাত । আগের থেকে সুমালাকে নতুন করে পেয়েছিল । লালারঙের রাত পোশাক খুলে ফেলতেই হাতকাটা নাইটি , ভীষণ স্বচ্ছ । এতটা যে দেবব্রতর বুক কাঁপছিল । একে ফাঁকা বাড়ি , অন্য পরিবেশ , সাথে একা –একা সদ্য বিবাহিত দম্পতি । সুমালা ভীষণ ফর্সা নয় । এই রাতে খোলা চুল , লম্বা মুখ আর সেই মুখের উপর নাইট ল্যাম্পের আলো এসে মেখেছে ! মেয়েরা এই সময় এমন ভয়ংকর হয়ে ওঠে ! দেবব্রত টের পেল ।সেই রাতে সুমালা , দেবব্রতর নগ্ন বুকে মাথা পেতে শুয়ে ছিল । দেবব্রত মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল । সেইরাতে শুধু মাত্র ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল ।
-দেবব্রত দা ?
স্তম্ভিত ফিরতেই , পিছনে দাঁড়িয়ে আছে রোগা মতন কালিপদ । স্কুলের জুনিয়ার টিচার ।পাড়ার ছেলে । ইংরাজি পড়ায় । দেবব্রতর নিজের বিষয় অঙ্ক ।
বলল – অনেকক্ষণ ?
কালিপদ হাসতে -হাসতে বলল – এখন কটা বাজে ?
-কেন দুটো ?
-দাদা , পাঁচটা বাজতে চলল । আপনি চিন্তায় মশগুল হয়ে ছিলেন । লাস্ট ক্লাস চারটে পনেরো পর্যন্ত । সাড়ে চারটে অব্দি ছেলেগুলো অপেক্ষা করল । আমি ক্লাস ভাঙতেই দেখি , ওরা বেড়িয়ে যাচ্ছে । বুঝলাম আপনি আজও ক্লাস করেননি ।
দেবব্রত মাথায় হাত রেখে বলল – মনে হচ্ছে , আমি পাগল হয়ে যাব ।
-দাদা , আমি আপনাকে একজনের কথা বলেছিলাম মনে আছে ?
-কে বলতো ?
-বেদ । যাদবপুর থানার ভিতরেই ছেলেটার বাড়ি ।
– এই ছয় মাসে কম কিছু করলাম না । অনেকের কাছেই গেলাম । ফল কিছুই না !
-দেবব্রত দা । ছেলেটার কাছে একবার চলুন । দেখুন যদি কিছু হয় । মানে আমি কথা বলে নিয়েছি । বেশি দূর নয় । চলুন । ওদিকে আবার ফিরতে হবে ।
২
আমি একটা লেখা লিখছিলাম । সম্পাদককে দিতে হবে । কাঁধ ধরে ঝাঁকাতেই , হুঁশ এলো । ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম মা দাঁড়িয়ে আছে ।
-হ্যাঁ কিছু বলবে ।
-কখন থেকে ডাকছি । কানে যায় না কথা ?
-শুনছিলাম , উত্তর দিতে পারিনি ।
-কেন আমায় মানুষের পর্যায়ে ফেলিস না ?
-বলছিনা দুদিনের মধ্যেই সম্পাদককে লেখাটা দিতে হবে । তাই কাজ করছি ল্যাপটপে । দেখতেই পাচ্ছ । এখন ডিস্টার্ব করবে না ।
-আমার কথাটা শুনে উত্তর দিতে পারতিস । উত্তর না দিলে বুঝব কেমন করে , তুই শুনতে পেয়েছিস নাকি ?
মায়ের কথা মাঝপথে থেমে গেল , বাইরে শুনলাম পরিচিত গলা । আমার নাম ধরে ডাকছে । পুরুষের গলা ।
বেদ —
মা রান্না ঘরে চলে গেল । আমি পর্দা টেনে । দরজা খুলতেই সামনে দেখলাম -কালিপদকে ।
-হ্যাঁ আয় ।
কালিপদর সাথে আমার তিন বছরের আলাপ । যে পাড়ায় ওর স্কুল , আমি সেখানে খেলতে যেতাম । দুপুরে আমাকে ফোন করে ছিল । কেস আছে ।
আমি দেখলাম সাথে বছর পঁয়ত্রিশের লোকটি মনমরা হয়ে আছেন । আমাকে দেখে দুহাত জড়ো করে নমস্কার দিলেন । আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম
-আসুন স্যার । আমি কালিপদর মুখে আপনার কথা শুনেছি । আমার কথাও হয়ে গিয়েছে ।
লোকটি আচমকাই গলার স্বর পাল্টে বললেন – কার সাথে ? কবে ? কি কথা?
এমন প্রশ্নে কালিপদ ঘাবড়ে গিয়ে বলল – বেদের গুরু যিনি । তার কথা বলছে ।
লোকটি হাসলেন । – আমি এইসবে একদম বিশ্বাসী নই ।
আমি জানতাম আমাদের কাছে ক্লাইন্ট বাধ্য হয়ে আসে আর অবিশ্বাস নিয়েই আসে ।এটা আমাদের প্রাপ্য । তাছাড়া আমরা যে বিদ্যা চর্চা করছি , তা সবাই করেনা । তাদের পক্ষে চোখে দেখা যায় না এমন কিছু বিশ্বাস করানো যায়না । তাছাড়া এটা ঠিক এখানে যারা আসেন , সব দিকে হেঁটে তারপর । একদিক থেকে সুবিধা আছে প্রত্যাশার চাপ থাকেনা ।
আমি বললাম – স্যার , ভিতরে আসুন ।
ওনারা ঘরের ভিতর এসে চেয়ারে বসলেন , সামনেই খোলা দরজা । আমি দাঁড়িয়ে আছি ।
আমি বললাম – আগেই বলে রাখছি আপনার বাড়ি গিয়ে ভিজিটিং করতে হাজার টাকা নেব । তারপর কটা সিটিং দিতে হবে সেই ভাবে টাকা রফা হবে । অবশ্য কাজ না হলে শুধু মাত্র পাঁচশ টাকা কেটে বাকী সবটাই ফিরত পাবেন । হ্যাঁ পারিশ্রমিকটা কিন্তু ক্যাশেই দেবেন । চেক বা ড্রাফট বা ধার বাকি একদম চলবে না ।
দেবব্রত বাবু আমার হাত ধরে বললেন – তোমার বয়স আমার থেকে কম । ভাই টাকা নিয়ে ভেবো না । শুধু আমায় বাঁচাও ।
-দেখুন আমরা চেষ্টা করব ।তার আগে লজ্জা না করে সব কিছু খুলে বলবেন । স্যারকে ডিটেইলে রিপোর্ট মেইল করতে হবে ।
দেবব্রত বাবু আমার দিকে তাকালেন । কাঁপা গলায় বললেন – দরজাটা ?
আমি বুঝলাম , দরজা খোলায় উনি বিব্রত বোধ করছেন । আমি বন্ধ করে খাটে এসে বসলাম । দু’পা মুড়ে আসন করে বসলাম । বললাম
-আপনি শুরু করুন দেবব্রতদা ।
লোকটার গলার স্বর খানিক শক্ত হয়ে গেল । খুব স্নায়ু ঘটিত চাপে রয়েছেন ।
-আমি যা বলছি , শেষ কয়েকমাস তার থেকেও বেশী কিছু ঘটেছে । আমি সবটা গুছিয়ে বলতে পারব না । আমি একটা ঘোরের ভিতর রয়েছি । জানিনা এই অবস্থায় কতটা আমি বলতে পারব ।
কথা গুলো ধীরে কানে আসছিল কিন্তু স্পষ্ট ভেসে আসছিল ।
-আমি মেদিনীপুরের বাসিন্দা । চাকরীর সূত্রে কলকাতায় বাড়ি কিনেছি । সুভাষগ্রাম স্টেশনে নেমেই প্রায় চল্লিশ মিনিট গেলেই গ্রাম্য পরিবেশে দ্বোতলা বাড়ি । প্রায় আট মাস আছি । আমার জীবনে যেই পর্বের জন্য আপনার কাছে ছুটে আসা , তা শুরু হয়েছে সাত নম্বর মাস পেড়িয়ে যেতেই ।
আমি লক্ষ্য করলাম , মার্জিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙ্গালি । কলকাতার লোকেরা বাংলা বলেন , তাই বলে কথা বলবার সময় এমন ভাবে বলতে শুনিনি । যদি বলত , আরও ভালো লাগত শুনতে ।
-দাদা বলুন । ইতস্তত করবেন না ।
দেবব্রতদা বলতে শুরু করলেন —
রাতে সবেমাত্র শুয়েছি । সুমালা আমার পাশেই আছে । আমি ওর বুকের উপর থুতনি রেখে চোখের দিকে তাকিয়ে আছি । আসলে সত্যি বলতে, কলকাতায় এসে একা- একা মেসে থাকতাম পড়াশুনো নিয়েই । নতুন বিয়ে আর গ্রাম্য পরিবেশে নিরিবিলি অবসরে ,সুমালার প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়েই চলেছিল । সে নিজের মতন সংসার করছে, গুছিয়ে করছে । মেয়েরা নিজের মতন চলতে পারলে আর কিছু চায়না । রাতে আমরা অনেকক্ষণ গল্প করতে –করতে ঘুমিয়ে যেতাম । আমাদের বাড়ির সাথে লাগোয়া তিনটে বাড়ি রয়েছে । বাড়ির সামনে লম্বা হেঁটে গেলেই যে ইটের রাস্তা , তার মুখেই লাইটপোস্ট বসেছে । আলো খুব বেশী না হলেও যথেষ্ট । বাড়ির ভিতরেও আলোর ব্যবস্থা পর্যাপ্ত , তবে পাওয়ার কম । ভোল্টেজ যায় আর আসে ।আমাদের বেড রুমে এখন হাল্কা আলো জ্বলছে । সুমালা ঘর অন্ধকার করলেই রেগে যায় । মাথার আর পায়ের কাছের জানলা দুটো বন্ধই রয়েছে । ঘড়িতে বেজেছে , রাত দেড়টা ।
দেবব্রত বাবু থেমে গেলেন । আমি বললাম – তারপর ?
-সুমালা ঘুমিয়ে পড়ল । আচমকাই অনুভব করছি , আমার কাঁধে কোন নারীর নরম আঙুলের ছোঁয়া ! বিশ্বাস করুন সেই নারী সুমালা নয় । ও ঘুমিয়ে আছে , চিত হয়ে । আমার পাশেই । দুটো হাত বুকের উপর রেখেছে ।
-তারপর ?
-চোখ খুলতেই সকাল । সকাল আটটার সময় , সুমালার ডাকেই ঘুম ভাঙল । তার চোখের দিকে তাকাতেই কেমন যেন লজ্জা বোধ হচ্ছিল । মনে হলও , আগের রাতে অন্য মেয়ের যৌন আনন্দের কথা ভেবে আমি সুমালার বিশ্বাসকে অপমান করলাম । এটা ঠিক হল না । নিজের চোখে নিজেই নেমে গিয়েছিলাম । আবার মনে হলও , এইসব আবোল –তাবোল ভাববার কোন মানে নেই । কেননা আগের রাতের ওইটুকু স্পর্শ আমার মনের ভুলই হবে । সারা দুপুর আমি ভিতর থেকে থম মেরে রইলাম । কেন রইলাম ? এর কোন উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না । যতই ভাবছি মনে হচ্ছে এমন ফালতু বিষয় নিয়ে ভাবছি কেন ? তাও ভেবেই চলেছি ! এই ভাবনা আমাকে দেড় দিনের মধ্যেই ঘিরে ফেলেছে । অথর্ব করে দিয়েছে । আমি নিজেকে খুঁজছিলাম । সুমালার প্রেমকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা হচ্ছিল । কিছুই পারছিলাম না ।
দেবব্রত বাবু থেমে গেলেন । তাঁকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিল । কেননা এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যারা সময় কাটিয়েছেন , শুধুমাত্র তারাই বুঝতে পারেন । আমি তাদের দেখেছি । আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না , দেবব্রত বাবুর কষ্ট । আমি বললাম –তারপর
দেবব্রত বাবু বললেন – আসল খেলা শুরু হলও সেই রাত থেকেই । রাত একটা পর্যন্ত ঘুম আসছিল না । পরের দিন সোমবার । আমরা তাড়াতাড়িই খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সুমালা আমার পাশে ঘুমোচ্ছে । সারাদিন কোন কাজ নেই , দুপুরে গল্পের বই । বিকেলে সিরিয়াল । রাতে ঘুম । আমি ভেবেছিলাম আজ রবিবার অন্য ভাবে কাটাব । অন্তত ভালো বাজার করব । কিছুই হল না । মানে হতে দিল না । এই রাত আমার কাছে এক সন্দেহজনক মনে হচ্ছে । এর ভিতরে কেউ লুকিয়ে রয়েছে । কে ? হ্যাঁ , সে এসেছে । আমার কপালে অস্তিত্ব টের পাচ্ছি ! মনে হচ্ছে সুমালার হাতের আঙুল থেকেও ভারী কোন মহিলা আমার কপালের মাঝখানে আঙুলের খেলা খেলছে । আঙুল দিয়ে বুলাচ্ছে । চোখ দু টো ভারী হয়ে আসছে । আমার শরীরের নিয়ন্ত্রণ আমার উপর নেই ! চোখ খুলতেও ইচ্ছা হচ্ছে না । আবার এই চোখ না খুলবার ইচ্ছাটাও আমার নিজের নয় । তাহলে আমি কে ? আর আমার ভিতরে অন্যকেউ রয়েছে , তার ইচ্ছার হাতেই আমি নিজেকে তুলে দিয়েছি । কার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছি ? এটা মনের ভুল নয় । কেননা মন সব কিছুই বুঝতে পারছে । আমি বেশ অনুভব করছিলাম , সেই নারীর চাপ –চাপ আঙুলের ছোঁয়া । এটা আমার ভুল নয় । কেননা ভুল কখনই এতটা সত্যি হতে পারেনা। এই ছোঁয়াটুকুই প্রচণ্ড ভাবে বাস্তব , যার কাছে সুমালার স্পর্শ পর্যন্ত মিথ্যা মনে হচ্ছে !
-তারপর ?
-শেষ একমাস আমি অদ্ভুত সুখে ভেসে যাচ্ছিলাম । সুমালা আমার পাশেই শুয়ে আছে । আমি যেনও অজানা সেই নারীর অপেক্ষায় জেগে থাকতাম । আর সুমালা সাড়ে বারোটায় ঘুমিয়ে পড়লেই , রাত একটা থেকে আমার বুকের ভিতরে চাপা টেনশন শুরু হতও । একদিন সকালবেলা চায়ের টেবিলে বসে আছি , দেখলাম সুমালার মুখটা ভারি হয়ে আছে । বুঝতে পারছি না , এমন ভাবে বসে থাকবার কারণ । আমি জিজ্ঞেস করতেই সে বলল , আগের দিন রাতে আমি নাকি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি । আর আমি তাকে বলেছি , এখন আমার ভালো লাগছেনা এইসব । কিছুক্ষন কিছুক্ষণ বাদেই সুমালার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে । আমি বুঝতে পারলাম না । এত কিছু ঘটল আর আমি কিছুই টের পেলাম না ! কিছুক্ষণ বাদেই মনে হচ্ছে আমার আর সেই অদৃশ্য নারীর মধ্যে যে যৌন অনুভূতির খেলা শুরু হয়েছে , একমাসে আমরা পরস্পরের কাছে পরিচিত হয়েছি । আমাদের ভিতর কন কোন গোপন কিছু নেই । কেউ আমরা পরস্পরকে দেখিনি , কথাও বলিনি । কিন্তু বুঝে গিয়েছি । আমাদের এই অবৈধ সম্পর্কের মাঝে সুমালা বাধা হয়ে দাঁড়াবে নাতো ?
-তারপর ?
-যত দিন এগিয়েছে , ততই আমি সুমালাকে শত্রু ভাবতে শুরু করলাম । কয়েকদিনের মধ্যেই ওর একটু জোরে কথা বলা বা ভালোবাসার আকুতি দেখলেই , মাথা গরম হয়ে যেত । যতই দিন যাচ্ছিল , আমি সুমালাকে সহ্য করতে পাচ্ছিলাম না । মনে – মনে ওকে সরিয়ে ফেলতে হবে । সুমালাকে খুন করতে হবে । এখন আমার মাথায় একটাই ভাবনা ওকে খুন করবই , কেমন ভাবে ? না , এটা আমার ভাবনা নয় আমার ভিতরে কোন শয়তান নির্ঘাত ভাবিয়েছে । আমি মনোবিদের কাছে গিয়েছিলাম । তিনি টেনশনের কথা বললেন । ওষুধ দিয়েছিলেন । আমাকে কিছুদিন ছুটি নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন । লাভ হয়নি ।আমি সেই অনুভূতির অমোঘ আকর্ষণ থেকে পালাতে পারলাম না। আমি এখন প্রায় সত্তর ভাগ উন্মাদ । সুমালাও আমাকে ঘেন্না করতে শুরু করেছে । আমি ওকে খুন করতে পারব না। নিজেই সুইসাইড করব …
দেবব্রত বাবু কাঁদতে শুরু করলেন । আমি বুঝতে পারলাম , এটা একশ শতাংশ প্রেত ঘটিত কার্যকলাপ । বলা যায় , ঋণাত্মক বা অপবিত্র শক্তির জন্য হচ্ছে । আমি বললাম
-আমি কাল যাবও । দেখুন আমরা আপনার কেসটা হাতে নিলাম । আমার স্যারের সাথে আজ রাতেই কথা হয়ে যাবে । আপনি একদম ভাববেন না । আমি কাল সন্ধ্যায় আপনার বাড়ি যাব । রাতে থাকতে হতে পারে । মানে যে ঘরটাতে আপনারা ঘুমান সেখানেই , কাল রাতে আমরা দুজনে থাকব । আমি আর মুমিন । দেখুন আশা করছি আপনাকে সুরাহা করে দেব । আগে বুঝতে হবে এই নেগেটিভ এনার্জিটা আসছে কোথা থেকে ।
বাসে তুলে দেওয়ার জন্য , দেবব্রতদার সাথেই রয়েছি । আমরা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি । আমার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন – আপনার কথা কালিপদ আমায় বলেছে । আপনিই শেষ ভরসা । জানিনা এরপর আমার জীবনটা কোন দিকে ঘুরবে । আমি বাঁচতে চাই বেদ । আপনি আমার ছোট ভাইয়ের বয়সী । দাদাটাকে বাচিয়ে বাঁচিয়ে নিন । আর হ্যাঁ , কাল আপনাদের কোন অসুবিধা হবে না । আমি অগ্রিমটাও …
আমি বললাম – দাদা বাস এসে গিয়েছে । কাল সন্ধ্যা সাতটায় । যাদবপুর স্টেশনে অপেক্ষা করব । চিন্তা নেই । আপনার ফোন নম্বর আছে । রাতে প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করবেন । আর বৌদিকে ব্যাপার গুলো জানিয়েছেন ?
-না ভাই । তাহলে পাগল ভাববে । আসলে ভূতুরে কাণ্ডকারখানা , বিশ্বাস যোগ্য নয় ।
-দাদা উল্টোটাও হতে পারে । ভয়ে বৌদির মানসিক সমস্যা শুরু হয়ে গেল ! তাই না বলাটাই ভালো ।
৩
আমরা স্টেশনে নেমেই দেখলাম , ঘড়িতে রাত আটটা ।কলকাতায় যারা থাকেন তাদের কাছে আটটা সন্ধ্যা ।এখানে মানে কলকাতা লাগোয়া মফস্বলে এখন রাত ।
আমি দেখলাম চারদিকে লোক আছে , তবে তা অনেকটাই কম । আমি কালিপদকে বললাম – এখান থেকে কতদূর ?
-এই কিছুটা ।
-কিছুটা মানে ভাই ?
-চল্লিশ মিনিট । আমরা অটো ধরব । মিনিট তিরিশ । তারপর রিক্সা ধরে দশ মিনিট । আমি এই নিয়ে তিনবার এসেছি ।
-ভালো ।
স্টেশনে দেবব্রত বাবু কিছু ফল কিনে নিলেন । যা বুঝতে পারলাম সাড়ে নটা বেজে যাবে ।
দেবব্রত বাবু আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন – ভাবছেন , কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম !
আমি বললাম – একদম নয় । আমি জানি আপনার সমস্যা বেশ সিরিয়াস । পাগল কেন হবেন ? পাগলরাও মানুষ । এতটা ছোট ভাববেন না । আমরা কেউই সখের জন্য আসিনি । পেশাদার । আপনার মধ্যে এতটুকু দ্বিধা রাখবেন না। আর তুমি বলবেন । কালিপদ আমার বন্ধু । মুমিন আমার থেকে একবছরের ছোট ।
আমার দিকে তাকিয়ে দেবব্রতদা বললেন – আচ্ছা ঠিক আছে। চলো ।
আমরা চারজনে অটো থেকে যেখানে নামলাম , বেশ গা ছমছমে পরিবেশ । মানে কলকাতার কাছে সুভাষগ্রামের এই অঞ্চল একেবারেই গ্রাম। চারিদিকে হোগলা পাতার জঙ্গল । গোঁড়ায় জমা জলে , সাপের ছটফটানির শব্দ কানে এলো । এই সাপ বিষধর হতেও পারে । মুমিনের পীঠে ব্যাগ রয়েছে । আমি আর দেবব্রতদা আগে , পিছনে কালিপদ আর মুমিন । আজ রাতে সজাগ থাকতে হবে । আজ রাতে নার্ভের উপর খুব চাপ যাবে । আমি কালিপদকে বললাম – তুই , দেবব্রত দাকে নিয়ে এগিয়ে যা । আমি আর মামুন একটু কথা বলে নিচ্ছি ।
আমরা হাঁটতে -হাঁটতে দেখলাম দুটো রিক্সা এদিকেই আসছে । একটায় ওরা উঠে বসল । পিছনেরটায় আমি আর মামুন বসলাম । মামুন আমাকে বলল – বেদ , কটা থেকে অপারেশন শুরু হবে ?
-হিসেব মতন এগারোটা । আমরা সাড়ে বারোটার মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে থাকব ।
– ই এম এফ মিটার সাথেই আছে । ঘরে গিয়েই ফুল স্পেক্টাম ক্যামেরাটা চার্জ দিতে হবে ।
– দেখিস যেনও যান্ত্রিক সমস্যা দেখা না দেয় ।
রিক্সা বাড়ির সামনে এসে থামল । দেবব্রতদা রিক্সা থেকে নেমে বললেন – তোমরা সাবধানে নামবে । এই পথটা খানিক কাদা রয়েছে । পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে । টাকা নিয়ে রিক্সা বাঁদিকের রাস্তা ধরে চলে গেল । ছোট্ট বিন্দুর মতন ক্রমশ মিশে যাচ্ছে ।
সুমালা বৌদি গেট খুলে অপেক্ষা করছিলেন । আমাদের দেখে বললেন – এসো , দেবব্রত তোমাদের কথা আগেই বলে রেখেছে । তোমাদের নাকি শো আছে । কিছুই বুঝতে পারলাম না ! কালিপদ বলল , আমার দিকে তাকিয়ে – হ্যাঁ , বেদ এর একটা দল আছে । দলের নেতা সে নিজেই । গ্রুপ থিয়েটারের দল । তাইনা ? বুঝতে পারলাম , আসল ঘটনা চেপে গিয়ে আমাদের পরিচয় গোপন করা হয়েছে । মন্দ নয় । আমি বললাম – বৌদি কালই আমাদের চন্দননগর ফিরতে হবে । আমরা থাকি মুর্শিদাবাদ । এখানে বিজয়গড়ে শো ছিল ।
সুমালা বৌদি চুড়িদার পড়ে ছিলেন । ওড়নাটা বুকের কাছে টেনে বললেন – ইস , আগে বললে দেখতে যেতাম । তোমার দাদা একমাস ধরে কেমন যেন হয়ে গিয়েছে । কথা গুলো বলেই চুপ হয়ে গেলেন । নিজের মুখে অন্যের কাছে , দাম্পত্য সমস্যা জানাতে চাইছেন না । ভারতীয় নারীর সেই পরিচিত স্বভাব !
আমি বললাম – বৌদি খুব ক্ষিধে পেয়েছে , কিছু খেতে দিন ।
-রাতে মুর্গির ঝোল আর ভাত । এখন চপ আর মুড়ি । চলবে ?
আমি বলবার আগেই মুমিন বলে উঠল – ছুটবে ।
রাতে খাওয়ার টেবিলে গল্প হলেও , আমি আমার কাজের দিকেই মন দিয়েছিলাম । আজ রাতেই কাজটা মিটে যাবে । এইসব কাজে শুরুতে যা থাকে , চাপা উত্তেজনা। আর কিছুটা স্নায়ু দুর্বলতা । টেবিলে দুটো রুটি আর সবজি খেলাম। আমি আর মুমিন । দুজনেই এইরমক অপারেশনের রাতে স্নায়ু উত্তেজনা তৈরি করে এমন কিছু খাইনা । বেশ কিছুটা গরম দুধ খেয়ে ওদের শোওয়ার ঘরে চলে এলাম । অতিথির জন্য এই ঘরটা ভালো , এমন কিছু বুঝিয়েই দেবব্রত দা আমাদের তিনজনের জন্য এই ঘর দিয়েছেন ।
রাতের অন্ধকারে যা বুঝলাম , সম্পূর্ণ গ্রাম্য পরিবেশে দ্বোতলা বাড়ি । ঘর গুলো বেশ পুরানো । চুন খসে গিয়েছে । রং ফিকে হয়ে গিয়েছে । অনেক দিনের পুরানো আসবাব কয়েকটি দেখতে পাচ্ছি । শুনলাম এই বাড়ির সাথেই কিনে নিয়েছেন ।
আমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল , রাত দশটার মধ্যেই । এগারোটার সময় ছাদে গেলাম । এখনো পর্যন্ত অন্ধকার , ঝি ঝি র ডাক বাদ দিলে , অপশক্তির কোন ইঙ্গিত পেলাম না ।
রাত বারোটার সময় । মুমিন , ফুল স্পেক্টাম ক্যামেরা চালিয়ে দিল । এই যন্ত্রটার বিশেষত্ব হচ্ছে , অতি সূক্ষ্ম আলো , আলট্রা ভায়োলেট আলো বা কম রশ্মিতেও রেকর্ড করতে পারে । হাল্কা লাল রঙের আলো বা যদি তেমন আলো নাও থাকে ক্যামেরা নিজের থেকে রেকর্ড করে নেয় । আলোহীন স্থানে ক্যামেরা রেকর্ড করতে পারে । আমরা এর পর আমাদের ল্যাবে গিয়ে দেখে নিতে পারি । ঘরে যদি কোন তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের উপস্থিতি থাকে , বা কোন শক্তির আকর্ষণ ক্ষমতা থাকে , খুব সহজেই বুঝবার জন্য সাথেই — এম এফ মিটার রেখেছি ।
দেহহীন অতৃপ্ত আত্মা এমন শক্তি , যার বিরুদ্ধে কোন প্রস্তুতিই নিরাপদ নয় । আমরা এখনো সব ধরণের আত্মার গতিবিধি আর ক্ষমতার পরিমাণ বুঝে উঠতে পারিনি । এটা অসম্পূর্ণ এবং চলমান খোঁজ ।
দেবব্রত দা রাতে এলেন । আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন – জানিনা , তোমাদের প্রতি অন্যায় করছি নাকি ।
আমি হেসে বললাম
-একদম নয় । আমরা এই কাজ সব রকমের সাবধানতা নিয়েই করি । আর হ্যাঁ , এই স্বীকারোক্তিটা নিন ।
দু’পাতার কোর্ট পেপার দেখে দেবব্রতদা থতমতও খেয়ে গেলেন !
আমি বললাম – এখানে লেখা আছে আমাদের দু’জনের যদি কিছু হয় , তার দায়িত্ব আমাদেরই । কালিপদকে আপনি অন্যত্র রাখতে পারেন । মানে এটা সাধারণ ব্যাপার যেমন কোন অপারেশনের আগে ডাক্তারকে সই দিতে হয় রুগীর পক্ষ থেকে । তেমনই আমাদেরকেও কোন অভিযান চালানোর আগে চুক্তি করতে হয় ক্লাইন্টের সাথে । আপনি এটা বুঝতেই পেরেছেন ১ শতাংশ হলেও লাইফ রিস্ক থাকেই ।
কালিপদকে আমাদের সাথে রাখলাম না । যদিও বেচারার খুব ইচ্ছা ছিল । দরজা বন্ধ করে দিলাম । ক্যামেরা আর ই এম এফ মিটার চালিয়ে দিয়েছি । নাইট ল্যাম্প নিভিয়ে , সেই অদৃশ্য শক্তির জন্য অপেক্ষা করে রয়েছি ।
৪
আজ রবিবার । সন্ধ্যার ট্রেন ধরলাম । বাড়ি ফিরতে রাত হবে । আজ আমি আর মুমিন বাড়ি ফিরব না । অন্য জায়গায় যেতে হবে । আমাদের সাথে কালিপদ ফিরেছে । আমি আমার আগের রাতের অভিজ্ঞতা ক্যামেরায় বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছি । বৌদি দুপুরে পেট পুড়ে খাওয়ালেন ।
স্টেশনে নেমে , কালিপদ বলল – ওখানে কিছু বললি না ভাই এখানে কিছুতো বল । ভাই রাতের ঘটনা না শুনলে আমি আজ আর ঘুমোতে পারব না । কাল স্কুল আছে । ট্রেনে দেখছিলাম তোরা ঝিমুচ্ছিলিস ।
আমি হাসলাম ।- তাহলে প্রথম থেকেই শুরু করছি স্টেশনের অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসতে পারি । সাথে অবশ্যই তিন ভাড় চা ।
আমরা চা নিয়ে , স্টেশনের একদম শেষ প্রান্তে , খালি কাঠের বেঞ্চের উপর বসলাম । এখানে লোকের কোলাহল কমই আছে । ঘড়িতে রাত নটা । যেখানে বসেছি দিনের বেলা পান বিড়ির দোকান বসে । সন্ধ্যা আটটায় বন্ধ হয়ে যায় । বেঞ্চটা বাঁধাই আছে । এখানেই থাকে ।
আমি গল্প শুরু করলাম ।
আমরা কেউই চোখের পাতা এক করিনি । অথচ আমরা পাশাপাশি শুয়ে ছিলাম । আচমকাই টের পেলাম, মুমিন আমার কাঁধে ঈশারা করছে !
সত্যি বলতে আমি শুয়ে ছিলাম ,হাল্কা চোখের পাতা আধ –বোজা অবস্থাতে দেখলাম , কিছু একটা আমার মাথার দিকে সরে গেল ! মানে কালো ন্যাকরা যেনও কেউ সরিয়ে দিল । নিঃশ্বাস থামিয়ে রেখেছিলাম । বুঝতে পারছি উপদ্রব শুরু হল বলে ।আমাদের সাথে ই এম এফ মিটার রয়েছে , ক্রমশই অনুভব করছি একটা চুম্বকীয় ক্ষেত্রে র । মিটারের কাটা বা সূচক ক্রমশ লাল দাগের ঘরের দিকে যাচ্ছে , মানে শক্তি ক্রমশই শক্তিশালী হচ্ছে ।
মনে হচ্ছে একটা শক্তি তীব্র আকর্ষণ করছে । হ্যাঁ এইরকম পরিস্থিতি নতুন নয় । ঘর অন্ধকারে ভরা । আমাদের দুজনের মাঝখানে মিটারের লাল আলো জ্বলছে , আবার নিভছে । পুরো ঘরে ওইটুকুই লালা বিন্দু । কিছুক্ষণ বাদে অনুভব করলাম আমার ঘাড়ের কাছে হাল্কা স্পর্শ । আমাদের চোখের অনুমান রাখতে হয় । কিছুক্ষণ আগে অন্ধকার ঘরেও আরেকটু চাপা অন্ধকার, চলমান মিশে না- যাওয়া অন্ধকারকে আমাদের মাথার দিকে চলে আসতে দেখেছি । আর মিটারের সূচক লাল ঘর ছুঁতেই জ্বলে উঠেছে লালা আলো ; অর্থ হচ্ছে সেই আত্মা মাথার দিকেই রয়েছে ।
ভয় । আমার মধ্যে ভয় কাবু করছে । ত্রিনয়নদার সাথে আগেও অনেক অশরীরীর সন্ধানে অভিযান করেছি । এই সময় তবুও যেনও মনে হলও , বেশী কিছু হয়ে যাবে নাতো ?
সত্যি এই ছোঁয়াটা যেন আমার ভিতর পর্যন্ত চলে যাচ্ছে । আমি ভাসছি । কিছুক্ষন কিছুক্ষণ আগে যে ভয় ছিল , তা রোমাঞ্চে রূপান্তরিত হয়ে গেল !
আমার এখন এক অদ্ভুত খেয়াল মনে এসেছে । পাশে যে ছেলেটা শুয়ে আছে , মানে যাকে আমি মুমিন নামে ডাকি , তার সাথে আমার সম্পর্ক কিসের ? কেন জানি আমি সহ্য করতে পাচ্ছি না । আবার কিছুক্ষণ বাদেই নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানালাম । হ্যাঁ , আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি সহজে অপবিত্র শক্তিটা আমায় দখল করে নিচ্ছে ! তারমানে এই আত্মাটার এটাই কাজ , অন্যের অনুভূতিকে নিজের মতন নিয়ন্ত্রণ করতে থাকবে ।
মামুন আমার দিকে তাকিয়ে গল্প শুনতে –শুনতে বলল – বেদ , তুই আমাকে শত্রু ভাবছিলি !
আমি বললাম – বস , আমি নই । ওই নেগেটিভ এনার্জি আমার সমস্ত চিন্তাকে নষ্ট করে দিচ্ছিল । আমি কিন্তু নিজেকে অন্যের হাতে আত্মসমর্পণ করিনি । নিজেকে বলতে শুরু করি – এই পৃথিবীতে ভালো আর মন্দের লড়াই চিরটাকালের । শয়তান আর ভগবান পরস্পরের মুখোমুখি । খারাপ ভালো পাশাপাশি আছে । পবিত্র আর অপবিত্রের এই লড়াইয়ে আমি অন্ধকারের বিপক্ষে আলোর সাথী ।
শক্তিটা আমাদের এক অন্য যৌন অনুভূতির অনুভব করায় আর সাথে – সাথে ঈর্ষার জন্ম দেয় । এখান থেকেই ধ্বংসের চিন্তা শুরু হয় ,আমি কিছুতেই এই অনুভূতি উপভোগ করব না। কেননা উপভোগ করলেই তা ধীরে ধীরে প্রবেশ করবে ।
-তারপর ।
-কালিপদ খালি ভাঁড়ে ভূতের গল্প জমবে না । আরেক রাউন্ড চাই । সাথে কেক ।
চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে , কেকে কামড় বসাতেই মুমিন বলল – বেদ , এই সব কিছু দাদাকে বলবি । আশা করছি ভিডিও হয়ে গিয়েছে । সেই সব কিছু দেখেই দাদা নিজেই কালকে দেবব্রতদা কে জানিয়ে দেবেন হয়ত ।
আমি বললাম – তাই কথা হয়েছে । এই শক্তি তেমন ক্ষতিকারক নয় । হলে এত সময় নিত না ।
কালিপদ বলল – বেদ এটা ঠিক অপশক্তি আছে । কিন্তু এটা কেন ওই ঘরটাতেই ?
আমি বললাম । আসলে…
দেখলাম আমাদের কথার মাঝেই , একটি ট্রেন শিয়ালদহ থেকে এসে সোনারপুরের দিকে চলে গেল । বেশ শব্দ নিয়েই । আমরা কিছুক্ষণের জন্য শুনতে পারছিলাম না। ট্রেনটার সাথে এক ঝাঁক হাওয়া জলের ঝাঁপটার মতন মুখে এসে পড়ল ।
ট্রেনটি যেতেই আমি বললাম – সত্যি বলতে , অল্প সময়ের জন্য হলেও আত্মা আর আমার মাঝে ডুয়েল হয়ে গেলও । শেষ পর্যন্ত মানে প্রায় ভোর তিনটে পঞ্চাশ হবে , আমি বুঝলাম আত্মাটি ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে । মিটার এর সূচক সবুজ ঘরে আসতেই ,সবুজ আলো জ্বলে উঠল । বুঝলাম আমরা নিরাপদ । পিছনে জানালার ফাঁকে হাল্কা আলোর রেখা যেনও আটকে রয়েছে । শরীর ক্লান্ত ,চোখে ঘুম নামছে । সারারাত আমি স্নায়ু যুদ্ধ করলাম !
সারারাত আমরা দু’জনেই ঘুমাইনি । এটাই অবশ্য নিয়ম । তবুও ঘুম নেমে এসেছে । পাশে দেখি মুমিন ঘুমিয়ে আছে । হাতের ঘড়িতে তখন ভোর চারটে দশ । ভাবলাম এখন চারপাশে সবকিছু বেশ শান্ত , নিরাপদ । চোখ বন্ধ হয়ে এল ।
খুব ভোরে উঠেই , সাড়ে’ ছটায় না খেয়ে বেড়িয়ে গেলাম । চারপাশ ঘুরতে । অনেকের সাথেই কথা বললাম । ওখানকার পুরানো বাড়ি বলতে এটাই । আমি একজন বয়স্ক বছর ষাটের লোককে দেখলাম ।পুকুর পাড়ে মাছ ধরছিলেন । আমি কলকাতা থেকে এসেছি শুনে নিজেই এসে জানতে চাইলেন । কথায় – কথায় অনেক কিছু জানতে পারলাম ।
কালিপদ বলল – লোকটি কি বলেছেন ?
-আসলে এই নিয়ে তিনজন বাড়ির মালিক পরিবর্তন হয়েছে । এরা কেউই থাকতে পারেননি । কোন এক অজানা কারণে বাড়ি বিক্রি হয়ে যায় । আসলে ওই ঘরে অনেক বছর আগে প্রায় তিরিশ বছর হবে , এক বিবাহিত মহিলাকে খুন করা হয়েছিল ।
-মানে ?
– না , সরাসরি নয় । আসলে গ্রামের লোকেরা দিনের বেলায় শুধুমাত্র দেখল বউটিকে চাতালে শুয়ে রেখে বাড়ির সকলে খুব কাঁদছে । স্বামী , শ্বশুর , শ্বাশুড়ি । বউটির ঠোঁটের কাছটায় নীল হয়ে গিয়েছে । আসলে স্বামীটি এই বিয়ে ছিল শুধুই টাকার জন্য । বাইরে হয়ত অন্য কেউ ছিল । অসহায় মেয়েটিকে প্রাণ দিতে হয় । আমার মনে হচ্ছে , ওই ঘরে আচমকাই তাকে বিষ খাইয়ে রাত একটার পর মেরে ফেলা হয়েছিল । এটাই কারণ ওই সময় বউটি র ভিতরের শক্তি ঘরেই রয়ে গিয়েছে । ওই সময়ে সে সক্রিয় হয়ে ওঠে । সেই শক্তি আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে , সেখানে থাকা এমন জীবন্ত দেহ , যার ভিতরে যৌনতার অনুভূতি রয়েছে । দুটো অনুভূতি একে অন্যের খোঁজ পেলেই মিশতে থাকে । তখন অপশক্তি সেই জীবন্ত দেহের শক্তির আমন্ত্রণের সুযোগ নিয়েই , জীবন্ত দেহে প্রবেশ করতে থাকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে । আমাদের দেহ আসলে যন্ত্র । আমরা বিভিন্ন অনুভূতিতে নিজের মধ্যে নিয়ে , নিজেকে চালনা করি তেমন ভাবেই ধীরে – ধীরে অন্যের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে ফেলি । আসলে ত্রিনয়ন ঘটক একটা ভালো কথা বলেছে – আমাদের এই যে রক্ত মাংসের দেহ , তা সবটাই ‘ভাবে ’পরিপূর্ণ । এই ভাবটাই আত্মা । আর আমাদের দেহের ভিতরে এই যে ভাবশক্তি বা আত্মায় থাকা আত্মশক্তি তা যদি নির্দিষ্ট ভাবে তার পরের পর্বে প্রবেশ করে , তবেই তা আবর্তিত হয়ে পুনরায় ব্যবহৃত হয় । যেই শক্তি প্রকৃতিতে মিশতে পারেনা , ব্যবহার হয়না , তারাই আশ্রয়হীন ভাবে থেকে যায় । ঘুরতে থাকে । আর যদি নিজের জীবিত পর্যায়ের আশা পূরণ না হয় , তাহলে দেহহীন ভাবেও আগের মতনই আচরণ করে । আচমকা যেই জীবন্ত দেহে থেকে শক্তি বেরিয়ে যায় , তা অন্য দেহে প্রবেশের সুযোগ পায়না এবং এই শক্তি কোন যন্ত্রণা বা মানসিক আঘাত থেকে নির্গত হয় বলেই —– তা মিশতে পারেনা , অতৃপ্ত থাকে । এই ধরণের শক্তিই আসলে অন্যের জীবন্ত দেহে নিজের খেলা দেখাতে শুরু করে ।সুতরাং মোটা বাংলায় অতৃপ্ত আত্মাকে ভূত বলতে পারি । আসলে ভূত খুব সরল আর আরোপিত শব্দ । সত্যি বলতে ভূত বলে কিছুই হয়না ।আমরা যা নিয়ে কাজ করি তা হচ্ছে আত্মা । গল্প এখানেই শেষ । আমি সবকিছু ত্রিনয়নদাকে জানিয়ে দেবো । আশা করছি এই সমস্যার সমাধান হবে ।
অনেক রাত হয়ে গিয়েছে । কালিপদ উঠে দাঁড়িয়েছে । বলল – আজ বাড়ি ফেরা যাক ।
ঘড়িতে রাত দশটা । এক ঘণ্টা ধরে গল্প চলেছে !
আমি বললাম – শুভ রাত্রি আজ আমরা ত্রিনয়ন স্যারের কাছে যাব । চিন্তা করিস না । দেবব্রতদাকে আমি সব কিছু বলে দিয়েছি । আর অন্য ঘরে আজ রাতে ঘুমোতে বলেছি । রাতে যা ঘটবে রিপোর্ট দেবে । আমাদের কাজ এখানেই শেষ এই দেখ দেবব্রত দা টাকাও দিয়ে দিয়েছেন । শুধু কাল সকালে রিপোর্ট পেলে আরও ভালো ভাবে বলতে পারব ।
কালিপদ আস্তে -আস্তে রেল লাইন পেড়িয়ে উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে । আমি আর মুমিন তাকিয়ে আছি ।
মুমিন আমার দিকে তাকিয়ে বলল – আচ্ছা , এই এনার্জিটা আমাদের এত দ্রুত আক্রমণ করে বসল । অথচ তুই আমায় বলেছিলিস দেবব্রতদাকে আক্রমণ করতে প্রায় মাস ছয়েক সময় নিয়েছিল । ঠিক বুঝলাম না ।
-এটা অনুমানের মাধ্যমে বলতে হয় । কেননা অনুমান বলছে , নিষ্ক্রিয় হয়ে দীর্ঘ দিন থাকবার ফলে শক্তির ভিতরকার যে অনু –পরমাণু গুলো রয়েছে , সেগুলো ক্রমশই নিজেদের অভ্যাস পাল্টাতে শুরু করেছিল । তাই প্রথমেই আক্রমণ করেনি । এরপর যখন দেবব্রত আর সুমালা বৌদির দাম্পত্য যৌন জীবনের অনুভূতির আঁচ পেয়েছে , ধীরে –ধীরে নিজেকে পাল্টাতে শুরু করল । আমরা যখন ছিলাম আমাকে আক্রমণ করে ছিল কারণ আমি মনে –মনে প্রচণ্ড ভাবে যৌন চিন্তা করছিলাম । ফলত শক্তি আমাকে বাধ্য হয়েই আক্রমণ করেছে । বুঝলি …
৫
সোমবার । দেবব্রত মাইতি রিক্সায় উঠে সুবলার কামড়ের দাগটায় হাত বুলালো । মনে – মনে বলল – আজ রাতে গিয়ে , সুমালাকেও এমনই কিছু উপহার দেবো । এই রকম গুপ্ত প্রেম চিহ্ন মেয়েরা , তার প্রেমিককে দেয় । কালিপদ বলেছিল । ওর বান্ধবি দিয়েছে । লভ বাইট । এই একমাসে , সুমালা আগের থেকে অনেক বেশী পরিণত হয়েছে । দেবব্রতর উপর অধিকারটাও আগের থেকে অনেক বেশী । কাল অনেক রাত পর্যন্ত তারা বিছানায় দেহের খেলায় ভেসে ছিল । সে এক অন্য রকম মুহূর্ত । ভোরের দিকে চোখে ঘুম নেমে এসেছিল । বেলায় যখন ঘুম ভাঙল , পাশে সুবলা বাচ্চা মেয়ের মতন ঘুমিয়ে আছে । দুজনেই নগ্ন । পাতলা চাদর আছে । শেষ রাতে , দেবব্রতই দিয়েছে । সুবলাকে খুব আদর করতে ইচ্ছা করছে । মানুষের জীবনে ভালোবাসা খুব দরকার । শেষ একমাস সে যেন ভালোবাসার কাছ থেকে নির্বাসন নিয়েছিল !
স্টেশনে নেমেই তার মনে হচ্ছে , অনেক দিন বাদে সে বেশ চনমনে বোধ করছে । দেহে আর মনে অদ্ভুত তৃপ্তি ! এই তৃপ্তিটুকু শরতের ঝলমলে আলোর মতন । যেখানে মুক্তির বার্তা রয়েছে । বুকের ডানদিকে কামড়ের চিহ্ন , সুবলার উপহার । এই মেয়েটাকেই সে ভালোবাসে । সে চায় এই মেয়েটাকেই জীবন ধরে ভালবাসতে । কিন্তু এই আনন্দ তার ক্ষনিকের ? সে কি সেই অভিশপ্ত রাতেরম্বর শ্বাস সে রেহাই পাবে ? কেউ কি দেবব্রতকে বলে দেবে সেই পথ ?
স্মার্ট ফোনে রিং হতেই , একটা অপরিচিত নম্বর !
-হ্যাঁ বলুন ।
উল্টো দিক থেকে ভারী গলা ভেসে এলো – আপনি দেবব্রত মাইতি ?
-হ্যাঁ ।
-শেষ শনিবার মুমিন আর বেদ আপনার বাড়িতে ছিল ?
-হ্যা স্যার ।
-আমি সেই বিষয়টা নিয়েই কথা বলতে চাই ।
-হ্যাঁ স্যার ।
-দেখুন , সত্যি বলতে যে ঘরটায় বেদ রা ছিল সেখানেই কোন অপমৃত্যু ঘটেছে । আমাদের যন্ত্র সেই নেগেটিভ এনার্জি বা অপশক্তিকে চিহ্নিত করেছে । আপনি দেখতেই পারেন ।
গলা কাঁপছিল দেবব্রতর বলল – স্যার বাড়িটা ছাড়তে হবে ?
-দেখুন , সত্যি বলতে আমরা ওই স্পিরিটটাকে ওখানেই থাকতে দেখেছি । শক্তিটা ওই ঘরের , এমনকি বিছানার চারদিকেই রয়েছে । একটা অদৃশ্য চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করেছে , যা নির্দিষ্ট সময়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে ।
-ঠিক বুঝলাম না ।
-দেখুন আমি, আপনি আমরা সবাই শক্তি স্তম্ভ । বলতে পারেন আমাদের চলন্ত দেহটা প্রমাণ করছে যে আমরা বেঁচে আছি । আচ্ছা সিলিং পাখাটায় বিদ্যুৎ চালনা করবার আগে সেটা কখনো দেখেছেন ?
-মানে স্থির পাখা । সিলিং ফ্যান ?
-হ্যাঁ ।
-দেখেছি ।
-বলুন , অনেকটা শ্মশানের মৃতদেহের মতন মনে হয় ?
-এই রে ! মানে স্যার অতটা …
-এমন ভাবে আমরা কেউই ভাবতে অভ্যস্ত নই । এটাই স্বাভাবিক । তাইতো ভূত , প্রেতের মতন মনগড়া চরিত্রে আমাদের বিশ্বাস থাকলেও , জীবন্ত শক্তিকে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় । দেখুন , শক্তির শেষ নেই শুধু রূপান্তর রয়েছে । এমনই এক বিশেষ শক্তির অবস্থাই আত্মা । এই আত্মা কখনো পবিত্র হয় আবার অপবিত্র । এটা নির্ভর করে সেই আত্মা যেই পরিস্থিতিতে দেহ বা জীবন্ত আশ্রয় ত্যাগ করেছে তার উপর ।আমাদের কাছে সেই আত্মার অস্তিত্ব খালি চোখে ধরা দেয় না । এর পিছনে আবার দীর্ঘ কারণ রয়েছে । এতকিছু ফোনে বললে মাথায় নিতে পারবেন না । তাই কাজের কথায় আসছি । দেখুন আমি বলতে চাইছি , আমাদের মধ্যে অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে । ভুল না বলে সরল ধারণাও বলা যায় । তারা ভাবেন আত্মা এক দেহ থেকে আরেক দেহে প্রবেশ করে । এমনটা হয়না একটা আত্মা নিজের ইচ্ছা শক্তি দিয়ে অন্য আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । আপনাদের ওই রুমে এমনই এক অতৃপ্ত নারী আত্মার অবস্থান আছে । নারীটির অপমৃত্যু হয়েছে । আপনাকে বেদ সব জানিয়ে দেবে ।
– তাহলে আমি এখন করব কী ?
-দেখুন আপনার কাছে এখন দুটো পথ । এক , সম্পূর্ণ বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া ।দুই, ওই ঘরটাকে বন্ধ করে দেওয়া । সহধর্মিণীকে বুঝিয়ে দেখুন ।
-মানে স্যার , কোনদিন ওই ঘর ব্যবহার করা যাবেনা ?
-না । ঘরেই আত্মা আছে , তাই ঘর ব্যবহার করলে একই রকমের পরিস্থিতি হবে । ওই ঘরে এক নারী দেহের অতৃপ্ত আত্মা রয়েছে । যে প্রতি রাতে একই সময়ে সক্রিয় থাকে । আর কোন যৌন অনুভূতির স্পর্শ পেলে , সেই শক্তি অনুঘটকের কাজ করে । নারী আত্মা পুরুষ দেহী আত্মাকে ক্রমশ বশ করে নেয় । তখন আপনি এক অদ্ভুত যৌন চিন্তায় ডুবে থাকবেন । আর এই চিন্তার সাথে – সাথে মনে হিংস্র ভাবের জন্ম হবে । যেমন আপনার হয়ে ছিল । তখন আপনি আর সেই যৌন অনুভূতির মাঝে তৃতীয় কোন ব্যক্তির স্থান নেই । সে শত্রু । তাকে সরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছার জন্ম হবে । আপনি সবই বুঝতে পারছেন । চিন্তা নেই এই অপবিত্র আত্মা শুধু মাত্র ঘর আর ওই খাটের চারপাশেই সীমাবদ্ধ । তাই ঘরের বাইরে আসবার প্রশ্নই নেই ।
-আচ্ছা যদি সে ঘরের বাইরে চলে আসে ?
কিছুক্ষণ থেমে ভারী পুরুষালি কণ্ঠস্বরে লোকটি দেবব্রতকে বলল –আরে , না । একদম নয় । কখনই কোন আত্মা নিজে থেকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে হেঁটে যেতে পারেনা । তা তখনই আর ততদূরই যেতে পারে , তাকে জীবিত অবস্থায় যতটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে । মানে আত্মা নিজের পরিচিত স্থানেই ঘোরাফেরা করে । আপনারা অনেক সময় বেশ কিছু হরর মুভিতে যা দেখেন , বা অধিকাংশ গল্প উপন্যাসে যা পড়েন তা বাস্তবের থেকে অনেক দূরে । আমরা এগুলো দেখে খুব বিরক্ত হই । একেতো ভূত , প্রেত নিয়ে বাজারে আলাদা লোক ঠকানো বাজার আছে । তারউপর ভূতের এমন বিবরণ শুনে অর্ধেকের বেশী ভাবেন ভূত আসলে মানুষের মতনই ।
দেবব্রত কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
-আপাতত থাকব , তবে ভাবছি একমাসের মধ্যে বিক্রি করে দেব ।
-আপনার ব্যাপার । আমি আপনাকে জানাবার জন্যই ফোন করেছি যদি প্রশ্ন থাকে করতে পারেন ।
-দাদা , খুব ভয় লাগছে । মানে আত্মাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিনা ।আমি বুঝতে পাচ্ছি আমার কথা আপনাকে বিরক্ত করছে । তাও বলতে পারবেন আত্মা কতটা বিশ্বাসযোগ্য ?
-দেখুন , মানুষকে বিশ্বাস করেছেন । ভগবানকেও । না হয় একমাস আত্মাকেও বিশ্বাস করুন । দেখবেন , আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে । আত্মাকে ভালবাসতে শিখুন ।বিশ্বাস আর ভালোবাসা খুব কাছাকাছি থাকে । আপনি যদি আত্মাকে গিয়ে চার্জ না করেন , তাহলে সে আগের মতন সক্রিয় হবে না । এটাই স্বাভাবিক । তাই বলছি মানুষকে ভাড়া না দিয়ে ভূতকে থাকতে দিন । ভূতেরা মানুষের ক্ষতি করেনা ।
-কি যে বলছেন !
-আপনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প পড়েছেন ?
-কেন বলুন তো ?
-পড়ে দেখুন । ভূত যে উপকারী , সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকবেনা।
বলেই লোকটি হাসতে শুরু করল ।
দেবব্রত কিছু বুঝতে না পেরেই বলল – মজা করছেন ?
-বলতে পারেন । আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন । তাও যদি কোন অসুবিধা হয় চলে আসবেন ৬৮ বি যোধপুরপার্ক । আছি আমরা ।
-স্যার কিছু মনে না করেন , আপনার পরিচয় জানতে পারি ?
-অবশ্যই । আমার প্রথমেই বলা উচিত ছিল । আমার নাম ত্রিনয়ন ঘটক । বেদ আর মুমিন আমার সহযোগী ……
-দেখা হবে স্যার ?
-অবশ্যই । ঠিকানায় চলে আসতে পারেন । তবে এক সপ্তাহ আগে থেকে ফোন করে জানিয়ে আসবেন ।বুঝতেই পারছেন নানা কাজে ব্যস্ত থাকি ।
-আপনি ভূত সন্ধান করে বেড়ান ?
-না ।আমি আগেও বলেছি আমরা ভূত বলে কোন কিছুতে বিশ্বাস করিনা । তবে আত্মায় বিশ্বাস করি । আর ক্ষতিকারক আত্মাই প্রেতাত্মা হয় । আমরা আত্মা সন্ধানী ।
-মানে আপনার অপবিত্র আত্মাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন ! আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ ।
-লজ্জা দেবেন না । এটাই আমাদের কাজ , আপনি এই কাজের পারিশ্রমিক দিয়েছেন । যেমন বিদ্যালয়ে ছাত্রদের অঙ্ক শেখানো আপনার পেশার অংশ । তেমনই অপবিত্র আত্মাদের সন্ধান পেলে , তার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো আমাদের পেশার অঙ্গ ।
-আপনি আমাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলেন ত্রিনয়ন বাবু ।
– দেবব্রত বাবু, শুভ শক্তির উপর ভরসা হারাবেন না । ঈশ্বর অনেক শক্তিশালী আর চরম সত্য শক্তি । আমরা সকলেই সেই শক্তির অংশ । আমি বা আমরা সেই শক্তির সাধক মাত্র । খুব নগণ্য । সামান্য ।