হিন্দুদের জন্য চাই সমানাধিকার

0
618

হিন্দুদের জন্য সমানাধিকার দাবি করা বাঙালির রক্তে আছে। নেতাজী সুভাষ বসু বৃটিশ শাসনযন্ত্রকে বোকা বানিয়ে তাঁর অন্তর্ধানের আগে ১৯৪০সালের সেপ্টেম্বরে বন্দী ছিলেন আলিপুর জেলে। তখন জেলে মুসলমান এবং খ্রীষ্টান বন্দীরা সরকারি সাহায্যে তাঁদের উৎসব পালন করতেন, হিন্দুরা আপন উৎসব পালন করতে পারতেন না। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন নেতাজী। জেল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হলেন হিন্দু বন্দীদের দুর্গাপূজা করতে দিতে।

বৃটিশ জমানা আজ ইতিহাস। বিগত সাত দশকে কত সরকার দিল্লিতে এল আর গেল। হিন্দুদের উপর আইনী বৈষম্য সমানভাবেই চলছে। আজও হিন্দুরা ভারতে ইস্কুল চালাতে পারে না, মন্দির চালাতে পারে না। যদিও সেই বৃটিশ জমানার মত মুসলমান প্রভৃতি তথাকথিত সংখ্যালঘুরা পারেন আপন মাদ্রাসা মসজিদ চালাতে। এর সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলি। তারকেশ্বরে হিন্দু মন্দিরের সর্বেসর্বা আজ এক অহিন্দু। যে স্বামীজী বলেছিলেন, গর্বের সাথে বল আমি হিন্দু, সেই স্বামীজীর প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন বাধ্য হয়েছিল নিজেকে অহিন্দু বলতে।

এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে শতাধিক বিশিষ্ট হিন্দু দলমতভাষা নির্বিশেষে সারা ভারতের সমস্ত প্রান্ত থেকে এসেছিলেন দিল্লীতে। তাঁদের তরফে আজ পাঁচজন দিল্লীর প্রেস ক্লাবে হিন্দুদের সমানাধিকারের দাবি পেশ করেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমি, আসামের অধ্যাপক ডঃ ঈশাঙ্কুর শইকীয়া, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অধ্যাপক ডঃ ভরত গুপ্ত, অন্ধ্রপ্রদেশের লেখিকা শ্রীমতী হরিতা  এবং তামিলনাড়ুর প্রযুক্তিবিদ্ শ্রীসুরেন্দ্রনাথ।
আমরা বললাম সেখানে, ভারত এবং ভারতের সংস্কৃতি বললে যে চিত্র আমাদের মানসে ফুটে ওঠে তা হল নিরবিচ্ছিন্নভাবে বহমান এক প্রাচীন সংস্কৃতির চারণভূমি, যা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত এবং আহত হলেও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি অজস্র আক্রমণের পরেও। বর্তমান যুগের জাতিরাষ্ট্রের সংজ্ঞাতেও ভারত একটি রাষ্ট্র, যা স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়েছে ১৯৪৭ সালে। ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়েছে সেও ৬৮ বছর হয়ে গেল। কিন্তু ভারতের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি সমস্ত শৃঙ্খলবন্ধন থেকে। আইনি দিক থেকে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ভারতের সংবিধান এখনো এই জনগোষ্ঠীকে কিছু অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে, যা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে সাংবিধানিকভাবে প্রাপ্তিসাধ্য। এই অবস্থান সাম্যের ঐতিহ্যের বিপরীত, এবং ভারতরাষ্ট্রের তরফ থেকে এই সাংবিধানিক বৈষম্য মোচনের লক্ষ্যে লোকসভার সদস্য ডঃ সত্যপাল সিং তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছেন ভারতের আইনসভায়। ভারতীয় সংবিধানের ২৬ থেকে ৩০ নম্বর ধারায় পরিবর্তন এনে সংসদের আগামী অধিবেশনেই হিন্দুদের অন্যান্য ধর্মের মতই কিছু অধিকার সুরক্ষিত করার লক্ষ্য এই প্রস্তাব তিনি পেশ করেন ২০১৬ সালে (ক্রমাঙ্ক ২২৬)। এই অধিকারগুলির মধ্যে অন্যতমগুলি হলঃ
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানোর অধিকার, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে
  • মন্দির এবং উপাসনাস্থলে সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ করে তা হিন্দু প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যস্ত করা
  • হিন্দু ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি উদযাপন, আর তা সংরক্ষণের যথোচিত প্রচেষ্টা

এই সময়ে উল্লেখ করতেই হয় যে প্রয়াত সাংসদ সৈয়দ সাহাবুদ্দিন সাহেব একদা এই বিষয়গুলি অনুধাবন করে একটি ব্যক্তিগত খসড়া প্রস্তাব এনেছিলেন আইনসভায় (১৯৯৬ সাল, ক্রমাঙ্ক ৩৬), যাতে সংবিধানের ৩০ নম্বর ধারাকে পরিমার্জিত করে ‘সংখ্যালঘু’র বদলে ‘সমস্ত নাগরিক’কে তার আওতায় আনা যায়।

আগেই বলেছি, এই বিষয়, এবং আরও অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রায় আলোচনা করতে হিন্দু সমাজের শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি মিলিত হয়েছিলেন রাজধানী নয়াদিল্লীতে, ২২ সেপ্টেম্বর। বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসে যে ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষায় ভারত সরকারের দায়িত্ব অপরিসীম। সেই সাথে ভারত সরকারের কাছে কিছু ন্যূনতম দাবী প্রস্তাব করার সিধান্ত নেওয়া হয়, যার মধ্যে পূর্বোল্লিখিত দাবীটি একটি অন্যতম প্রধান দাবী।

এছাড়া কথা হয় আরও কিছু বিষয় নিয়ে, যেমন হল বিদেশ থেকে আগত প্রভূত অর্থের সমাহার, যা আমাদের দেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বিনষ্ট করতে সর্বদাই বদ্ধপরিকর। ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করা এবং ভারতকে বিচ্ছিন্ন করাই মূল লক্ষ্য এরকম বিদেশী শক্তির, যার সাথে ভারত বিরোধী বিভিন্ন দেশের যোগ আছে। এমন কি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও এরা ভারতকে সাহায্যের নাম করে তাদের হীন চক্রান্ত রচনায় সদা তৎপর থাকে। তাই ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিদেশী নাগরিকদের থেকে ব্যক্তিগত দান ছাড়া আর কোন বিদেশী অনুদান গ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করাও আরেকটি দাবী।

ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল এবং জম্মু-কাশ্মীরকে তিন ভাগে ভাগ করাও অন্যতম দাবী। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের গণহত্যা থেকে শিক্ষা নিয়ে এর পুনরাবৃত্তি রোধ করতে জম্মু, কাশ্মীর এবং লদাখ -এই তিন রাজ্য গঠন করার দাবী উঠেছে বর্তমান জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙ্গে।

বর্তমানে ভারত পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ গোমাংস রফতানিকারী দেশ, যা ভারতের সংবিধানের ৪৮ ধারার পরিপন্থী। পরিবেশ দূষণ রোধে গোমাংস রফতানির উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করাও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী।

হৈন্দব সংস্কৃতি জীর্ণোদ্ধারণ নিগম নামক একটি সংস্থা স্থাপনের মাধ্যমে এবং বার্ষিক ন্যূনতম ১০০০০ কোটি টাকা সেই সংস্থাকে অর্পণের মাধ্যমে ভারতের জীর্ণ মন্দির, বৈদিক পাঠশালা, প্রাচীন ধ্রুপদী কলা, নৃত্য, সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করার দাবী উঠেছে জোরালো ভাবে। ভারত হিন্দুদের চিরাচরিত বাসভূমি, এবং শেষ আশ্রয় এ সত্য চিরন্তন। সেই সত্যকে আইনি রূপরেখা দিতে যথাযত আইনি ধারা প্রণয়নের দাবীও জানানো হয়েছে।

সাথে সাথে ভারতের প্রত্যেক ভাষাকে সমমর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দ্বারা আরোপিত বৈষম্যমোচন আরেকটি অত্যন্ত অপরিহার্য দাবী। এই দাবীগুলি ভারতের অগ্রগতি এবং উন্নতির জন্য অত্যাবশ্যকীয়, এবং এই দাবী সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের জন্য হিন্দু সমাজ সর্বদা সরকারের সাথে সহযোগিতা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।