চীন ও নেহেরুর শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা

0
2170
Picture taken from the 50s of Indian prime minister Pandit Jawaharlal Nehru, in official visit in China, talking with his chinese counterpart Zhou Enlai. Indian statesman and prime minister (1947-64). Nehru joined the Indian Congress Committee in 1918, he was influenced by Gandhi and was imprisonned several times by the British. In 1947 he became India's first prime minister and minister of external affairs. N/B B/W (Photo credit should read STAFF/AFP/Getty Images)

[গত ৬০ র দশকে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব, নেহেরুর বকচ্ছপ নীতিসমূহের সুবিশাল পতন এক যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তার করেছিল যা আজও ভারতবর্ষের রাজনৈতিক-সামাজিক সত্তা তথা কাঠামোয় যথেষ্ট ক্রিয়াশীল রয়েছে। যাঁরা ইতিহাসকে এক পুরানো, বাতিল ইতিবৃত্ত রূপে আখ্যায়িত করেন তাঁরা এক অতিশয় গন্ডমুর্খ – সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, থাকা উচিতও নয়। একটি ঘটনা সৃষ্টি করে আর একটি; সেটি আর একটি – এই ভাবেই ইতিহাস এগিয়ে চলে। – সম্পাদকীয়] 

 

একজন বাস্তব জ্ঞানহীন ব্যক্তিকে যদি রাষ্ট্রনায়ক করা হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রকে বছরের পর বছর ধরে সেই ভুলের মাসুল গুণতে হয়। যেমনটা ভারত করে চলেছে।  নেহেরুর ভুলের মাসুল আরো কত প্রজন্ম ধরে আমাদের দিতে হবে জানা নেই।

চীনের কুয়োমিনতাং আমলের শেষ রাষ্ট্রদূত ছিলেন পানিক্কর, এবং তিনিই কমিউনিস্ট চীনে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত। পানিক্করের কমিউনিস্ট প্রেম এবং কমিউনিস্ট চীনের প্রতি সমর্থন সুবিদিত ছিল, কমিউনিস্ট চীন সম্পর্কে নেহেরুর কাছে তাঁর পাঠানো রিপোর্ট বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ হতো না। কিন্তু বলা বাহুল্য নেহেরু এই অভিযোগকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না।

সর্দারের সাবধানবাণী

পানিক্করের প্রতি সর্দার প্যাটেল অবশ্য নেহেরুর মত অন্ধ ছিলেন না। মৃত্যুর পাঁচ সপ্তাহ আগে প্যাটেল নেহেরুকে চীনের তিব্বত নীতি নিয়ে একটি চিঠি লেখেন। পানিক্করের ভারতের হয়ে চীন সরকারের কাছে বিনা কারণে হাত কচলানো সর্দারকে যথেষ্ট বিরক্ত করেছিল। তিব্বতে ইঙ্গ-মার্কিন চক্রান্তে চীনের ক্ষতি হতে পারে, সেটা কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের বক্তব্য হতে পারে না। ভারত রাষ্ট্রসঙ্ঘে চীনের ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে প্রচেষ্টা করছে।  কিন্তু চীন তবুও ভারতকে সন্দেহ করছে এবং তিব্বতে চীনা বাহিনীর প্রবেশের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিবাদকে উড়িয়ে দিয়েছে – তা কোন বন্ধুর ভাষা নয়, তা শত্রুর।

ভবিষ্যৎদ্রষ্টা প্যাটেল আরো লেখেন, কমিউনিজম সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষেধক নয়, বরং সাম্যবাদের মোড়কে এক নব সাম্রাজ্যবাদ। উত্তর এবং উত্তরপূর্বে একটি  নতুন বিপদাশঙ্কা শুরু হয়েছে; চীন শুধু তিব্বত গ্রাস করেই থেমে থাকবে না, তার নজর সিকিম, দার্জিলিং এবং অসমের উপজাতি এলাকা (বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ)। এসব জায়গায় যোগাযোগ দুর্বল, অবিচ্ছিন্ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, পুলিশি ব্যবস্থা উপযুক্ত নয়, আর অনুপ্রবেশের অবাধ সুযোগ।

প্যাটেল আরও একটি আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলেন যে তিব্বত দখল করার ফলে চীনের সীমানা অনেক কাছে চলে এসেছে, যার ফলে সুবিধা হবে ভারতীয় কমিউনিস্টদের। তারা সহজেই চীনের কমিউনিস্টদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।  ভারতীয় কমিউনিস্টদের গোলাবারুদ, অস্ত্র সরবরাহ চীনের পক্ষে সুবিধাজনক হবে। তিনি চিঠির সঙ্গে তৎকালীন তাঁর অধীনস্থ স্টেটস মন্ত্রকের একটি সার্ভে রিপোর্ট পাঠান। সেখানে উল্লেখ ছিল  সোভিয়েত রাশিয়া মনে করছে  ভারতীয় কমিউনিস্টরা রাশিয়ার  থেকে চীনের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হতে পারে। মাও সে তুং স্ট্যালিনের থেকেও  বেশী প্রভাবশালী হয়ে উঠবেন। ইতিমধ্যে পিকিং এ একটি লিয়াজোঁ ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ভারতের বিষয়ে মাওকে নির্ধারকের ভূমিকা দেওয়া হয়েছে, ভারতীয় কমিউনিস্টদের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা দ্ব্যর্থহীন ভাবে চীনের পথ অনুসরণ করতে বলেছে। অবশ্যই এর ফল ভারতীয় সংহতির পক্ষে লাভজনক হবে না।

এই অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য পটেল একটি কর্মসূচির প্রস্তাব করেন। কর্মসূচির কতগুলো উল্লেখযোগ্য দিক হল,
১) এই সময় ভারতের চীনের রাষ্ট্রসঙ্ঘে অন্তর্ভুক্তির দাবি সমর্থন করাটা হয়তো ঠিক নাও হতে পারে।
২) উত্তর এবং উত্তর পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা চূড়ান্ত করার জন্য উপযুক্ত ও দ্রুত রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩)  নেপাল, ভূটান, সিকিম, দার্জিলিং এবং অসমের উপজাতি অঞ্চলকে এই ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৪) সীমান্ত অঞ্চলের দেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে হবে।
৫) সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্য, যেমন উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ আর অসমের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।
৬) তিব্বতের লাসাতে ভারতের  দূতাবাস, গিয়াংসে আর ইয়াতুঙ ভারতীয় অফিস এবং তিব্বতে কর্মরত ভারতীয় রক্ষীদের ভবিষ্যৎ স্থির করতে হবে।
৭)  ম্যাকমেহন লাইন সম্পর্কে নীতি স্থির করতে হবে।

প্যাটেলের চিঠির উত্তরে নেহেরু প্যাটেলকে একটি নোট পাঠান। নোটে উল্লেখ করেন তিব্বতকে বাঁচানো ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। ভারত হস্তক্ষেপ করলে তিব্বতের জটিলতা আরো বেড়ে যেতে পারে। তবে তিব্বতকে তার স্বশাসনের অধিকার রক্ষা করতে ভারত সাহায্য করতে পারে।

পন্ডিতের পান্ডিত্য

নেহেরু এটাও জানান, অদূর ভবিষ্যতে চীনের থেকে কোন সামরিক আক্রমণের সম্ভাবনা নেই, কেননা তা বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হতে পারে। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত পাকিস্তানের আক্রমণের কথা মনে রেখে স্থির করা হয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে সেইরকম ব্যবস্থা নিলে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে।

১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে প্যাটেলের মৃত্যু হয়। ফলে নেহেরুকে তাঁর চীন নীতি থেকে নিরস্ত করার কেউ রইল না।

১৯৫০ এর ডিসেম্বরে,লোকসভায় পন্ডিত নেহেরু তাঁর এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখেন।  বিরোধী নেতৃবৃন্দ, যেমন অধ্যাপক এন জি রাঙা, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রী এম  আর মাসানি নেহরুকে চীনের আগ্রাসনের ব্যাপারে সাবধান করে দেন।  এর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর ছিলেন মাসানি, তিনি মনে করিয়ে দেন “নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি”  বিবৃতি প্রকাশ করেছে “তিব্বত অধিকারের জন্য অ্যাংলো আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীরা আর তাদের এজেন্ট নেহরু লাসায় আঘাত হানছে। ” এবং ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্তে চীন গেরিলা বাহিনী পাঠিয়েছে। নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি সমানে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে পিপলস লিবারেশন আর্মি হিমালয়ের ওপর লাল পতাকা উত্তোলন করবে।

পন্ডিতজি অবশ্য তাঁর মতামত পরিবর্তন করেননি। একটি দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি জানান যে ভারতের মত দরিদ্র দেশের পক্ষে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো সম্ভব নয়। বিরোধী নেতৃবৃন্দকে তিনি বলেন “বাস্তববিরোধী”, এবং তাদের যুক্তিতর্ক  ” একেবারেই সময়োপযোগী নয়। ” অন্যদিকে, ১৯৫১ র মার্চ মাসে বন্যার মতো তিব্বতে চীনা সেনার অনুপ্রবেশ ঘটে। নেহরু চীনে চিঠির পর চিঠিতে “মৈত্রীপূর্ণ আর নিঃস্বার্থ উপদেশ” পাঠাতে থাকেন। ঐদিকে মাও সে তুংয়ের রণহুংকার  শোনা  যায় “পূর্ব দিকে তাকিয়ে তারস্বরে চিৎকার করে পশ্চিম দিকে আঘাত হানো।”

এইসময় একটি প্রেস কনফারেন্সে তিব্বতে চীনা সেনার উপস্থিতি ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে কি না জিজ্ঞাসা করলে পন্ডিতজি উত্তর দেন, “ঘটনাগুলি সেনাদলের  উপস্থিতির সাপেক্ষে যথেষ্টই অস্পষ্ট। কি মাত্রায় তারা বাধার সৃষ্টি করবে তা স্পষ্ট নয়। “

চীনু মেরি জান

তিব্বতে যখন চীনের সেনা অভিযান চলছে, সেই সময় পন্ডিতজি ব্যস্ত থাকেন চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির প্রয়াসে। মাঞ্চুরিয়ায় মার্কিন যুদ্ধবিমানের আনাগোনার  প্রসঙ্গ তুললেন দিল্লির মার্কিন রাষ্ট্রদূত এলিনর রুজভেল্টের কাছে। পানিক্করকে চৌ এন লাইএর কাছে তাঁর উদ্বিগ্নতা জানাতে বললেন।  চৌ এন লাই এই ব্যাপারে পানিক্করের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হলেও তিব্বত প্রসঙ্গে ভারতীয় স্বার্থের সাধারণ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার ব্যাপারে রইলেন আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব।

আসলে চীন সেই সময় তিব্বতে নিজেদের অবস্থান ক্রমশ আরো শক্তিশালী করে তুলছিল। পন্ডিতজী অবশ্য বিবৃতি দেন ” তিব্বতে চীনের সেনা সমাবেশ খুব অল্প সময়ের জন্য হয়েছিল। তাঁরা সমস্যার অনুপুঙ্খ আলোচনা করেন নি। চৌ এন লাইএর অভিযোগ চীন কে দোষী সাব্যস্ত করে না “।
১৯৫২ র ৫ই এপ্রিল চৌ এন লাইন  পানিক্কর কে তিব্বতে চীনা বাহিনীর জন্য ভারতকে ” নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ” পাঠাতে অনুরোধ করেন। মে মাসে নেহরু ৫০০ টন খাদ্যশস্য পাঠাতে রাজী হন। নেহেরুর বিবৃতি অনুসারে “স্থায়ী অথবা আংশিক স্থায়ী ব্যবস্থাদি চীনে আমাদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে আলোচিত হতে পারে।” 

অবশ্য ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে চীনে ভারতের নতুন  রাষ্ট্রদূত এন রাঘবন এক প্রতিবেদনে জানান ভারতীয় স্বার্থের ব্যাপারে চীনের মনোভাব “এখনও পর্যন্ত শীতল। ” আসলে চীন অপেক্ষা করছিল উপযুক্ত সময়ের জন্য যা তার পক্ষে একান্ত লাভজনক ছিল। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে, কোরিয়া সংকট নিরসনের পর চীন ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করতে রাজী হয়।  যার ফল হল পঞ্চশীল চুক্তি।

প্রেমিকার থেকে সামান্যতম ইঙ্গিত পেলে যেমন  প্রেমিকের প্রেমোচ্ছাস বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাসের আকার ধারণ করে, পরবর্তীতে নেহেরুর চীন প্রীতির ক্ষেত্রে ঠিক সেই উদাহরণ দেওয়া যায়। নেহেরু তিব্বতে চীনা সেনার উদ্দেশ্যে শুধু খাদ্যশস্য নয়,  পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদি সামগ্রী পাঠানোর অনুমতি দেন। এই প্রেমোচ্ছাসের ফল কি হয়েছিল আমরা দেখব, কিন্তু তার আগে পঞ্চশীল চুক্তি টি কি একবার দেখা যাক।

পঞ্চশীল চুক্তি

কোরিয়া সংকটের অবসানের মুখে চীন ভারতের সঙ্গে চুক্তি করতে রাজী হয়, যদিও তা এক দিনে হয়নি। আলোচনা শুরু হয় ১৯৫৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর এবং শেষ হয় ১৯৫৪ সালের ২৯শে এপ্রিল।

এই পঞ্চশীল চুক্তি অনুযায়ী – 
১)  ভারত ও চীন – দুই দেশ পরস্পরের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা স্বীকার করবে।
২)  একে অন্যের প্রতি কোন সামরিক অভিযান থেকে বিরত থাকবে।
৩)  একে অন্যের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না।
৪) একে অন্যের ক্ষতি করবে না।
৫)  দুই দেশ  শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে।

নেহেরু প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে চুক্তির মেয়াদ হোক পঁচিশ বছর, কিন্তু চীন পাঁচ বছরের বেশী মেয়াদ বাড়াতে রাজী ছিল না। অত্যন্ত পীড়াপীড়িতে চীন পাঁচ বছরের জায়গায় আট বছরে রাজী হয়। এই চুক্তিটি হওয়ার পর  ব্রিটেন ১৯০৪ সালে চীনের থেকে সীমা বহির্ভূত যেসব সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল তা ভারত ছেড়ে দেয়। তিব্বতে ভারত সরকার নিয়ন্ত্রিত যেসব ডাক ব্যবস্থা, তার ব্যবস্থা, টেলিফোন এবং গেস্ট হাউজের সুবিধা ছিল ভারত তা বিনামূল্যে দিয়ে দেয়, যদিও চীন তার ন্যায্য মূল্য দিতে রাজী ছিল। নেহেরুর বক্তব্য অনুযায়ী  এর ফলে ভারত ও চীনের মধ্যে যে সম্পর্কের ভিত তৈরি হবে, তার দাম অনেক বেশি।

কিন্তু চুক্তির একমাস যেতে না যেতেই  চীন বদ্রীনাথের উত্তর পূর্বে বারাহোতি নামে এক জায়গা নিজেদের অধিকৃত বলে দাবি করে বসল।

হিন্দী চীনি ভাই ভাই

চুক্তি সই করার দুই মাস পর নেহেরুর আমন্ত্রণে চৌ এন লাই তিন দিনের ভারত সফরে আসেন।  এই সময় চৌ এন লাইএর সঙ্গে নেহেরুর এক দীর্ঘ বৈঠক হয়। চৌ এন লাই  পশ্চিম এশীয় দেশগুলো, এমনকি শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য নেহেরুর সাহায্য প্রার্থনা করেন। এবং নেহেরুকে অক্টোবরে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে যান। নেহেরুর উদ্যোগে এশিয়া আর আফ্রিকার ২৯টি দেশের সম্মেলন ঠিক হয় ইন্দোনেশিয়ার জাভার বান্দুং শহরে। যদিও পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা চীনকে আমন্ত্রণের বিরোধী ছিল, কিন্তু এই বান্দুং সম্মেলনে প্রথম পাকিস্তান এবং চীন, একে অন্যের সন্নিকটে আসে এবং উভয়ের মধ্যে এক নতুন সম্পর্কের সূচনা হয়, যার দাম ভারতকে এখনও দিয়ে যেতে হচ্ছে।

পিকিং সফরে দশ লক্ষ মানুষ নেহেরুকে রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। মাও সে তুং  আর তাঁর সহযোগী, যেমন চু তে, লিউ শাও চি,  চৌ এন লাই,  সুং চিং লিং দের সঙ্গে দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, ভূমি সমস্যা, বন্যা নিবারণ, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে  আলোচনা হয়। কিন্তু চীনে প্রকাশিত  কিছু মানচিত্রে নেহেরু দেখেন নেপাল, ভূটান, অসমের বেশ কিছু অংশ ( অরুণাচল প্রদেশ) , লাদাখ এইগুলো চীনের অধিকারভুক্ত। নেহেরুকে এই বলে চুপ করানো হয় যে ম্যাপগুলো পুরোনো। চীন সরকার এখনো এইসব খুঁটিয়ে দেখার সময় পায়নি।

১৯৫৫ র গ্রীষ্মে চীন আবার বর্তমান উত্তরাখন্ডের উত্তরে বারাহোতি আর নীতি গিরিপথ আর হিমাচলের শিপকিলা গিরিপথে হানা দেয়। যদিও এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নেহেরুর বান্দুং সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং চু এন লাইএর সঙ্গে দাদাগিরি দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি।

আমার বধুঁয়া আনবাড়ি যায় আমারি উঠান দিয়া

বান্দুং সম্মেলনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমে পাকিস্তান এই সম্মেলনে কমিউনিস্ট চীনের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করে এবং মার্কিন উস্কানিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আর নিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে সম্মেলন ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করে। নেহেরু চীনকে বড়দাদার মত আগলে রাখতে চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয়,  চৌ এন লাইএর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বান্দুংএর রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, দুপাশে লোক জড় হয়ে হাততালি দিত। (যদিও নেহেরুর এই মাতব্বরিতে চৌ এন লাইএর বিরক্ত হয়েছিলেন।  ১৯৬৫ সালে চীনে সফররত শ্রীলঙ্কার এক প্রতিনিধি দলকে বলেছিলেন, নেহেরুর চেয়ে বেশি উদ্ধত ব্যক্তি তিনি দেখেননি)।

ওদিকে সকলের অগোচরে নেহেরুর ছোট ভাই চৌ এন লাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলির সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেন। এই আলোচনার কথা স্বয়ং চৌ এন লাই  এক রাজনৈতিক কমিটির বৈঠকে প্রকাশ করেন।  তিনি বলেন মহম্মদ আলি তাঁকে জানিয়েছেন পাকিস্তান চীনের বিরোধী নয়। পাকিস্তান চীনের থেকে আক্রমণ আশা করে না। পাকিস্তান ও চীনের আভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার মাধ্যমে যৌথ শান্তি প্রতিষ্ঠা আর সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়েছে।

যদি মারো কলসীর কানা

১৯৫৬র সেপ্টেম্বরে  মেজর জেনারেল জয়ন্ত চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন প্রতিনিধি চীনের আমন্ত্রণে চীন সফর করেন এবং তাদের রণকৌশল প্রত্যক্ষ করেন। ফিরে এসে  চীন দ্বারা আক্রমণের আশঙ্কা রক্ষামন্ত্রককে জানায়।  কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন তাঁদের কথায় গুরুত্ব দেননি।

১৯৫৬র ডিসেম্বরে চৌ এন লাই ভারত সফরে এসে বলেন চীন এবং মায়ানমারের মধ্যে সীমান্ত হিসেবে ম্যাকমাহন লাইনই বজায় আছে। চীন ও ভারতের মধ্যে ম্যাকমাহন লাইনের যে অংশ পড়ে, তার মীমাংসাও শান্তিপূর্ণ ভাবে করা হবে, অতি শীঘ্রই। অতি শীঘ্রই চীনা সৈন্যরা হানা দিলে তৎকালীন নেফার (অরুনাচল প্রদেশ)  ওয়ালংএ। 

১৯৫৭ সালে পিকিংএর ভারতীয় দূতাবাস থেকে নিউ দিল্লিতে চীনের পিপলস ডেইলির একটি সরকারি ঘোষণার ক্লিপিংস পাঠানো হয় যাতে বলা হয় চীনের সিং কিয়াং প্রদেশের ইয়ে চেং থেকে  তিব্বতের গারটক পর্যন্ত ৭৫০ মাইল লম্বা, ১২ ফুট চওড়া একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে এবং সেটি গিয়েছে লাদাখ অঞ্চলের আকসাই চীনের মধ্যে দিয়ে।  গ্রীষ্মকালে দুইটি টহলদারি পুলিশ পার্টি পাঠানো হয় যার মধ্যে একটি নিখোঁজ হয়ে যায়। দিল্লির চীনা রাষ্ট্রদূতকে তাদের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে চীন নিরুত্তর থাকে। 

দুই মাস পর চীনের তরফ থেকে জানানো হয় ভারতীয় জওয়ানরা চীনা এলাকায় অনধিকার প্রবেশ করলে তাদের বহিষ্কার করে কারাকোরাম গিরিবর্ত্মে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। সৌভাগ্যক্রমে একটি ভারতীয় অনুসন্ধান পার্টি  তাদের আবিষ্কার করে, যখন অনাহারে তারা প্রায় মৃত্যুর দরজায় উপস্থিত হয়েছে। ভারত সরকার অবশ্য  ঘটনাটি চেপে যাওয়া সাব্যস্ত করে।

১৯৫৮র জুলাইতে ‘চায়না পিক্টোরিয়াল’ নামক একটি পত্রিকায় প্রকাশিত মানচিত্রে নেফার পাঁচটি বিভাগের চারটি এবং আকসাই চীন সহ লাদাখের একটি বিস্তীর্ণ অংশ  চীনের অন্তর্ভুক্ত বলে দেখানো হয়। নেহেরু চৌ এন লাই কে একটি দীর্ঘ চিঠিতে ঐ ম্যাপের কথা উল্লেখ করে বলেন চীন যেন ম্যাকমাহন লাইনকে দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে মেনে নেয়। দেড় মাস পর চৌ এন লাই উত্তর আসে, যেখানে চীন ম্যাকমাহন লাইনকে দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে মানতে অস্বীকার করে। তবে তিনি জানান শীঘ্রই ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান’ সম্ভব হবে। আর পশ্চিম সীমান্ত তো ভারতীয় ম্যাপে ভুল দেখানো হয়েছে।

পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায় যখন ১৯৫৯ এর ৩০শে মার্চ দলাই লামা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। চীন খোলাখুলি ভারত বিরোধিতা শুরু করে। পালডেন গিয়াৎসো নামক  একজন তিব্বতী বৌদ্ধ ভিক্ষু বলেছেন ঐসময় চীনে নেহেরুকে “the running dog of imperialist”  বলে উল্লেখ করা হত। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য উল্লেখ করে তিব্বতের “প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি” বিদেশীদের সাহায্যে ষড়যন্ত্রে নেমেছে।

ক্লাইম্যাক্স

১৯৫৯এর আগস্টে চীনারা নেফার সুবনসিরি নদীর কাছে লংজু দখল করে। এক ভারতীয় পুলিশ নিহত এবং আর একজন আহত হয়।কয়েক সপ্তাহ পর, লাদাখের কংকাল পাসে, ভারতের সীমানার চল্লিশ মাইল ভিতরে ভারতীয় টহলদার বাহিনী চীনা বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। ১০-১২ জনের প্রাণ যায়।১৬জন বন্দী হয়,যাদের চার সপ্তাহ পর ফেরত দেওয়া হয়। ভারতকে তাদের অধিকৃত এলাকার ২০  কিলোমিটার পর্যন্ত জায়গা থেকে সেনা সরাতে বলা হয়, যা মানা ভারতের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

১৯৬০ সালের এপ্রিলে চৌ এন লাইন ভারতে আসেন। কিন্তু কোন সমাধান হয়নি।  কৃষ্ণ মেনন মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে চৌ এন লাইএর সঙ্গে দেখা করেন, যা সফরসূচির অন্তর্গত ছিল না। যদিও এই আলোচনার ফলাফল বিদেশ মন্ত্রকের কাছে অজানা থাকে।

১৯৬২ সালের মাঝামাঝি ভারতীয় সেনারা লাদাখে চীনা সেনাদের রসদ যাতায়াতের পথে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে শক্ত ঘাঁটি বানায়।

পূর্বে ৮ই সেপ্টেম্বর; ২০শে অক্টোবর পূর্ব এবং পশ্চিম, দুই দিক থেকেই প্রবল আক্রমণ শুরু হল। প্রতিটি ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে ছয় জন চীনা সৈন্য মোতায়েন হয়েছিল। চীনে প্রচার হতে লাগল আগ্রাসনকারী ভারত এবং তার নেতা সাম্রাজ্যবাদীদের পোষা কুকুর নেহেরু চীনা এলাকা দখল করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।

পন্ডিতজীকে স্বীকার করতে হল ভারত সরকার বাস্তব জগতে নয়, এক কল্পলোকে বাস করছিল। সৈন্য- সামন্ত, অস্ত্র, গোলাবারুদ, খাদ্য, রসদ, পরিকাঠামো, রণনীতি, রাস্তাঘাট প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই ভারতীয় সরকার অযোগ্য প্রমাণিত হল।

(পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট লৌহমানব আয়ুব খান ঐ সময় প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধানকে ডেকে পশ্চিম দিক থেকে ভারত আক্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে সেনাপ্রধানেরা রাজী হননি, কেননা তাতে মার্কিন মহাপ্রভু  চটে যেতে পারেন, মার্কিন সাহায্য বন্ধ হতে পারে।) 

২০ থেকে ২৪ অক্টোবর প্রবল যুদ্ধ হল। নেফায় লোহিত নদী ধরে ওয়ালং থেকে হায়ুলিয়ং পর্যন্ত আশি মাইল চীনেরা দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেল এবং অধিকৃত এলাকায় প্রয়োজনীয় রাস্তাও বানিয়ে ফেলল। এর পর হল পাঁচ দিনের যুদ্ধবিরতি। সেই পুরোনো প্রস্তাবের পুনরুক্তি, ভারতীয়দের অধিকৃত এলাকা থেকে কুড়ি কিলোমিটার পিছিয়ে যেতে হবে। ভারতের পক্ষে তা মানা ছিল অসম্ভব। ৩১শে অক্টোবর নেহরু বিরোধীদের চাপে কৃষ্ণ মেননকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন। যশবন্ত চৌহান হলেন নতুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।

১৪ই থেকে ১৯শে নভেম্বর নেফাতে আর ১৮ই থেকে ২১শে নভেম্বর লাদাখে বন্যার জলের মত চীনা সৈন্যদল ঢুকতে লাগল। চীনের ছয়টি ব্রিগেড পৌঁছে গেল তেজপুর শহরের কাছে।

ভারতের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ পরাজয়। ২১ তারিখে চীনের তরফ থেকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয় এবং চীন নেফা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। তার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়  রাশিয়া চীনকে তেল সরবরাহ বন্ধ করেছিল। তাছাড়া সমতলভূমিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লড়তে অসুবিধা হত না।

উপসংহার

সর্দার প্যাটেলের সাবধানবাণীকে গুরুত্ব না দিয়ে, চীন সফরকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিনিধির সতর্কীকরণকে পাত্তা না দিয়ে, চীনের একটার পর আগ্রাসন কে দেখেও না দেখার ভান করে, চৌ এন লাইয়ের প্রতি অতিরিক্ত দুর্বলতা আর চীনের প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়ে নেহেরু
যে ভুলটা করেছিলেন তার খেসারত দিয়েছিল হতভাগ্য ভারতীয় সেনারা, শত্রুর বুলেটে প্রাণ দিয়ে, শীতে জমে, অঙ্গহানি করে।

আকসাই চীন এখন পাকাপাকি ভাবে চীনের দখলে। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা আর আকসাই চীনের রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অত্যাধুনিক বলা যায়। এদিকে ভারত উত্তরপূর্ব সীমান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির জন্য জোর দিয়েছে এই সেদিন, ২০১৪র পর থেকে।   বান্দুং সম্মেলনে চীন আর পাকিস্তান প্রথম কাছাকাছি আসে, এখন তারা একে অন্যের বন্ধু। ভারতে পাকিস্তানের জঙ্গি কার্যকলাপে চীন উদাসীন। মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক আতঙ্কবাদী ঘোষণার পথে চীন একটি বড় বাধা।

প্রজাতন্ত্রের মোড়কে রাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার ভুলের মাসুল আমাদের দিয়ে যেতে হবে অনির্দিষ্ট কাল ধরে।

তথ্যসূত্র:

১.হস্তান্তর, পর্ব ২। শংকর ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স

২.চিন বন্ধু না শত্রু।  অরুণ শৌরি।  ভাষান্তর, তরুণ বন্দোপাধ্যায়।  পত্র ভারতী।

৩. এক বৈমানিকদের স্মৃতিকথা।  এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল।  অনুবাদ ইলা লাল। আই এম এইচ। New Delhi.

৪. Fire under the Snow. Testimony of a Tibetan Prisoner. Palden Gyatso. The Harvill Press. London.