২৭শে মার্চ, ২০১৯। ভারতের ইতিহাসের এক স্বর্ণময় দিন। ভারত কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র সাফল্যের সাথে পরীক্ষা করল। আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে আমেরিকা, রাশিয়া আর চীনের পরে ভারত চতুর্থ দেশ হিসাবে এই ক্ষেপণাস্ত্র সাফল্যের সাথে পরীক্ষা করল। তিন মিনিটের মধ্যে নিজের কোন মেয়াদ-উত্তীর্ণ উপগ্রহকে ধ্বংস করে। কোন না কোন ক্ষেপণাস্ত্র তো ভারত প্রায়ই সাফল্যের সাথে নিক্ষেপ করে থাকে। তাই কৃত্রিম উপগ্রহ বিধ্বংসী এই সাফল্যের বিশেষ কোন সমরনৈতিক মূল্য আছে কি? সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই প্রবন্ধের অবতারণা।
আজকের দুনিয়ায় তথ্যই হচ্ছে সর্বোত্তম মূল্যবান। কিছুদিন আগেও যা ছিল পেট্রোলিয়াম। মহাশক্তিধর দেশগুলির শক্তির এক চাবিকাঠি হচ্ছে তথ্যের ব্যাপারে অধিকতর অধিকার। মহাশক্তিধর দেশগুলির গোয়েন্দা বিভাগগুলির কথা আমরা কে-ই বা না শুনেছি? কিন্তু প্রথাগত পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের চেয়ে আজ কৃত্রিম উপগ্রহ মারফৎ বেশি শক্তিশালী। ভারত যখন পোখরান বিস্ফোরণ করেছিল ১৯৯৮ সালের ১১ই এবং ১৩ই মে, তখন আমেরিকার কৃত্রিম উপগ্রহের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। আজ যখন ভারত-পাকিস্তান বা ভারত-চীন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন আমাদের সমরনৈতিক দ্রষ্টাদের মস্তিষ্কে সর্বদাই অনুরণিত হয় মার্কিন, চীনা বা রাশিয়ার গোয়েন্দা উপগ্রহের শকুন-দৃষ্টির কথা। তাদের ফাঁকি দিয়ে কিছু করতে হবে অথবা সমরনৈতিক পরিকল্পনা ব্যর্থই রয়ে যাবে।
ক্ষেপণাস্ত্র কেন?
কৃত্রিম উপগ্রহ তো রকেটের মাধ্যমেও ধ্বংস করা যায়। তাহলে ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন হল কেন? কারণ আর কিছুই নয় যুদ্ধকালীন স্থিতিতে রকেট উৎক্ষেপণ সহজ নয়, ভীষণ কঠিন। কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্র খুব সাধারণ ভাবে নিক্ষেপিত হয়। রেলের ওয়াগন বা বড় ট্রাকের সাহায্যেও নিক্ষেপ করা সম্ভব। যদি কোন শত্রু দেশের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ হয় এবং তাদের সাহায্যকারী কোন গোয়েন্দা উপগ্রহকে ধ্বংস করার কথা ভাবা হয়, তবে সহজ উপায় হল ক্ষেপণাস্ত্র। সেই কারণেই ইসরো বা ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নয়, ডি আর ডি ও বা সমর বিষয়ক গবেষণা সংস্থাই এই কাজ করেছে।
ভারতের সঙ্গে ভবিষ্যতে কোন যুদ্ধ বাধলে চীন আমাদের উপর কোন তথ্যমূলক বিশেষ সুবিধা পাবে না। পাকিস্তানকে উপগ্রহ-প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে চাইলে চীন বা অন্য যে কোন দেশ দুইবার ভাববে। কারণ তাদের কাছে যে প্রযুক্তি আছে, ভারতের কাছেও কম কিছু নেই।
কূটনৈতিক মাহাত্ম্য কোথায়?
১৯৯৮ এর পোখরান পরীক্ষা ছিল ভারতরাষ্ট্রের দীর্ঘ কূটনৈতিক ব্যর্থতার পরিণতি। ভারতে পরমাণু শক্তি নিয়ে গবেষণার কথা বলে গিয়েছিলেন ডঃ মেঘনাদ সাহা। তৎকালীন ভারতরাষ্ট্র সম্যক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিশ্ববন্দিত পরমাণু গবেষক ডঃ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনার নেপথ্যের নায়করা এখনও উন্মোটিত হয় নি। যাই হোক, ভারত পরমাণু অস্ত্র বানাতে সক্ষম হলেও বরাবর সেই দাবী পেশ করে নি এবং পরমাণু বোমাও বানায় নি। কিন্তু এই পদক্ষেপ কূটনৈতিক ভাবে ভারতকে পিছিয়ে দিয়েছে। একদিকে পরমাণু অস্ত্রধর পাঁচ রাষ্ট্র (আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন) ভারতের পরমাণু অস্ত্র বানাবার অধিকারকে স্বীকার করে নি, অন্যদিকে ভারত সি টি বি টি এবং এন পি টি ইত্যাদি আন্তর্জাতিক চুক্তির অঙ্গ না হওয়ায় পরমাণু বিদ্যুৎ বানানোর জ্বালানিও পায় না। তাই কূটনৈতিক ভাবে ভারতের পরমাণু অস্ত্র না বানানো ছিল এক বিপুল বিপর্যয়।
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী এই ইতিহাস বদলে দিতে পোখরানে পরমাণু বিস্ফোরণ করেন। কিন্তু তাতে অধিকাংশ দেশ ভারতের উপর বিরূপ হয়। ভারতের মধ্যেও কমিউনিষ্ট পার্টি ভারতের পরমাণু নীতির বিরোধিতা করে। আজ কার্যক্ষেত্রে ভারত পরমাণু শক্তিধর দেশের মর্যাদা পেলেও এখনও চীন ভারতকে এই সব কারণেই এন এস জি থেকে পরমাণু জ্বালানি আনতে বাধা দিতে পারে। শ্রী অটল বিহারীর পরমাণু নীতি পূর্বসূরীদের ব্যর্থতাকে পুরোপুরি মুছে দিতে পারে নি।
কেন?
কারণ, প্রত্যেক কাজের একটি নির্ধারিত সময় আছে। বিলম্বে সংঘটিত হলে যথোচিত কাজও সঠিক ফল দেয় না।
জেনিভার পূর্বে
আজ সময় খুবই পরিণত। মহাশূন্যের অধিকার নিয়ে চুক্তি ইত্যাদি দানা বাঁধছে। বর্তমানে মহাশূন্যের নিয়ম নিয়ে তেমন বিস্তারিত নিয়ম নেই। জাতিসংঘের যে কমিটি আছে তার ক্ষমতা সীমিত। চেষ্টা চলছে এই চুক্তিকে আরও কার্যকরী করার। আর আমরা তো জানিই, আমাদের পরমাণু ক্লাবের অভিজ্ঞতা থেকে, দুনিয়া চলে জিসকি লাঠি উসকা ভঁহিষ নীতিতে। যদি ভারত আজ শক্তি প্রদর্শন না করে, তবে ভারতকে নিশ্চিত বাকী সাধারণ দেশের সাথে একাসনে রাখা হবে আর বহু প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হবে ভবিষ্যতে মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে। তাই এ এক সন্ধিক্ষণ ভারতের আপন অধিকার কায়েম করার। এই ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষার পর ভারত আজ মহাশক্তিধরদের সাথে একাসনে বসল এবং ভারতকে কোন রকম সুবিধা থেকে বাদ দেবার পথ বন্ধ হল।
পোখরানের চেয়ে এ এক অনেক বড় উত্তরণ।
রাজনৈতিক সক্ষমতা
এবার আসা যাক সারা দুনিয়ার প্রতিক্রিয়ার দিকে। ২০০৭ এ যখন চীন এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছিল, তখন নিখিল বিশ্ব তাদের নিন্দা করেছিল। কিন্তু ভারতের পরীক্ষার পরে কেউই কোন নিন্দামূলক প্রতিক্রিয়া দেয় নি। এর কারণ নিশ্চয়ই শ্রী নরেন্দ্র মোদী সরকারের কার্যকরী বিদেশ নীতি।
পূর্বতন ইউ পি এ সরকারের আমলে ডি আর ডি ও-র প্রধান ডঃ ভি কে সারস্বত জানিয়েছেন যে ইউ পি এ সরকার এই ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর প্রকল্পে সবুজ সংকেত দেয় নি যদিও ডি আর ডি ও ক্ষেপণাস্ত্র বানাতে চেয়েছিল। কাজেই প্রযুক্তিবিদ এবং বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বকে একটুকু ছোট না করেও বলতে হয় বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সক্ষমতার কথা।