চীন সীমান্ত: ভারতের চিরন্তন অগ্নিপরীক্ষা

0
1455

ভারতের লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় গত ১৫-১৬ জুন ভারত-চীন সীমান্ত-সংঘর্ষ ও দু’পক্ষের একাধিক সেনার হতাহতের ঘটনা এক অভূতপূর্ব অবস্থার সৃষ্টি করেছে। আমাদের বিশজন সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, চীনের কমবেশি চল্লিশ জন সেনার মৃত্যু ঘটেছে। একবিংশ শতাব্দীতে কোভিড অতিমারীর প্রেক্ষাপটে এই ঘটনার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। কোনো কোনো পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম এই ঘটনাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হিসাবে দেখাতে চেষ্টা করছে।

দেশ ও রাষ্ট্র

হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে কামরূপ, সিন্ধু থেকে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা থেকে গোদাবরী বিধৌত যে ভূখণ্ডে হাজার হাজার বছর ধরে বহমান এক জীবনধারা, তা ভারতবর্ষ নামের এক দেশের ঐতিহ্য ও পরম্পরায় ঋদ্ধ। সেই দেশ এক চেতনা, এক সংস্কৃতি, এক ভাবনায় বয়ে চলেছে, যা এক দেশগত রাষ্ট্রীয় চেতনায় সিদ্ধ; যেখানে এই দেশ শুধুমাত্র এক ভূখণ্ড নয়, তা মাতৃভূমি।

আমরা জানি, আজকের বিশ্বে একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় থাকে চারটি প্রধান স্তম্ভের উপর: ভূমি, জনগণ, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। তার সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রীয় চেতনা ও আবেগ, যাকে জাতীয়তাবাদ বা রাষ্ট্রীয়তাবাদ নামে অভিহিত করা হয়। তবে ভারতের ক্ষেত্রে শুধু জাতীয়তাবাদ বা ন্যাশনালিজম নয়, তা ছাড়িয়েও এই ভূমিকে, এই দেশকে দেশমাতৃকা- ভারতমাতা হিসাবে আরাধনা করা হয়, যা ধার্মিক ভারতের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও পরম্পরা।

সরকারের প্রধান দায়িত্বই হলো ভূমি, জনগণ ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা। সরকারের রূপ, গঠন ও চরিত্র যাই হোক না কেন, এই দায়িত্ব পালনের অন্য কোনো বিকল্প নেই। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সীমান্তরক্ষার জন্য সরকারের হাতে থাকে একদিকে যেমন সামরিক বাহিনী (ডিফেন্স সার্ভিস), অন্যদিকে আভ্যন্তরীণ তথা সামগ্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য অসামরিক সেবা ব্যবস্থা (সিভিল সার্ভিস)। তবে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় (স্টেট সিস্টেম), বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়, সরকারের তিন প্রধান অঙ্গ, যথা আইনসভা (লেজিসলেচার), কার্যনির্বাহী শাসনব্যবস্থা (এক্সিকিউটিভ) ও বিচারব্যবস্থার (জুডিশিয়ারী) সঙ্গে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমও চতুর্থ অঙ্গ হিসাবে মান্যতা পেয়েছে।

ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে ওই চার অঙ্গের আলাদা অস্তিত্ব ও কার্যকরী স্বশাসন স্বীকৃত। অপরপক্ষে, চীন পৃথিবীর বৃহত্তম অগণতান্ত্রিক একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে ওই সব অঙ্গই সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত সরকারের অধীনে। এই প্রেক্ষাপটেই সীমান্ত সমস্যা নিয়ে এই আলোচনা।

আমরা আজকে আধুনিক বিশ্বে যে জাতিরাষ্ট্র বা নেশন-স্টেট ব্যবস্থা পেয়েছি তা ইউরোপীয় নেশন-কেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ফসল। ইউরোপে কয়েক দশকের ধর্মীয়-রাজনৈতিক রক্তক্ষয়ী বিবাদের পর ওয়েস্টফেলিয়া শান্তি চুক্তি, ১৬৪৮ সালে  স্বাক্ষরিত হয়, যার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল রাজ্যগুলোর পরস্পরের সীমানাকে মান্যতা দেওয়া। তারপর থেকে সারা পৃথিবীতে এই জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আর, আজকের আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় সীমানা-নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে প্রতিটি ইঞ্চি জমি বুঝে নেওয়া ও তাকে রক্ষা করা রাষ্ট্র-নেতাদের পরম দায়িত্ব।

যেসব ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক জাতি সেই সপ্তদশ শতাব্দীতে থেকে সারা পৃথিবীতে উপনিবেশিক শাসন কায়েম করেছিল, তার পরম্পরাতেই জাতিরাষ্ট্রের কাঠামাতে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশেও প্রতিবেশী দেশগুলি ও প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। আমরা জানি ইংরেজ উপনিবেশিক শাসকদের সময় বিভিন্ন চুক্তি/সমঝোতা/প্রস্তাব হয়েছিল যেগুলোর পরিণতি হিসাবে আমরা পেয়েছি আরডাগ-জনসন লাইন, ১৮৬৫/১৮৯৭, ম্যাকার্রটনি-ম্যাকডোনাল্ড লাইন, ১৮৯৯, ম্যাকমোহন লাইন, ১৯১৪। ভারত-চীন সীমান্তের সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে এইসব লাইনগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা বৃহত্তর অর্থে ‘গ্রেট গেমের’ অংশ।

 

ভারত রাষ্ট্র ও সীমান্ত

এখানেই উল্লেখ্য যে, ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ অনুযায়ী অখণ্ড ভারতবর্ষের দ্বিজাতি তত্ত্বের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে যে খণ্ডিত ভারত এক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো, সেই ভারত সীমান্ত-সমস্যা নিয়েই পথচলা শুরু করল। এ ভারতের আরেক ঔপনিবেশিক লিগাসী।

এবার যদি ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কথা ধরি, তাহলে দেখব, স্থল সীমানা ও জল সীমানায় যে রাষ্ট্রগুলো আছে তারা এরকম। স্থল সীমানায় যুক্ত রাষ্ট্রগুলি হল: আফগানিস্তান (বাল্টিস্থানের সেই ভূখণ্ড এখন পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের দখলদারীতে), পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার ও বাংলাদেশ। আর জল সীমানায় আমাদের ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো হলো: শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া। সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থল ও জল সীমান্ত নিয়ে যা কিছু বিবাদ-সমস্যা ছিল তা মিটে গেছে। মায়ানমার ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের সীমানা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। জল সীমান্ত নিয়েও ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ বা ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে কোনো বিবাদ নেই। শেষে রইল তিনটি রাষ্ট্র। নেপালের সঙ্গে এতদিন পর্যন্ত সে রকম কোনো সমস্যা ছিল না, কিন্তু সম্প্রতি সেই বিবাদ শুরু হলো। বাকি দুই রাষ্ট্র: পাকিস্তান ও চীন। এখানেই দুটি ব্যাপারে পরিস্কার হওয়া দরকার। একটি হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংক্রান্ত ‘নিয়ন্ত্রণ রেখা’ (এলওসি), আর চীনের সঙ্গে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা’ (এলএসি)।

গুজরাটের কচ্ছ এলাকায় ‘স্যার ক্রিক’ নামের ৯৬ কিমি একটা জল-বিবাদ ছাড়াও পাকিস্তানের সঙ্গে মূল বিবাদ হল পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ও গিলগিট-বাল্টিস্থান নিয়ে। সেই ১৯৪৭ সালের পরে কাশ্মীরের ভারত-ভুক্তি থেকেই এই সমস্যা। তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছে তথাকথিত চীন-পাকিস্তান সীমান্ত চুক্তি, ১৯৬৩ অনুযায়ী চীনকে কাশ্মীরের কিছু ভূখণ্ড পাকিস্তানের উপহার দেওয়া, যা পুরোপুরি আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী। এছাড়া সিয়াচেন হিমবাহ ও সালতোরো গিরিশৈল এখন ভারতের অধিকারে রয়েছে।

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৫০ সাল থেকেই ভারত ও চীন দুই ভিন্ন পথের পথিক: ভারতের পথ বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, আর চীনে একদলীয় কম্যুনিস্ট স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। ভারত-চীন সীমান্ত তিনটি ভাগে বিভক্ত: পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব, যার মোট দৈর্ঘ্য ৩৪৮৮ কিমি। গালওয়ান উপত্যকা পশ্চিম সেক্টরে লাদাখে অবস্থিত। মধ্য সেক্টরে বিশেষত প্যাংগং ৎসো হ্রদ বা লেক হয়ে পূর্ব সেক্টরে ভুটানের ডোকলাম থেকে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত এই ভারত-চীন সীমান্ত।

আর, নেপালের সঙ্গে ভারতের যে সীমান্ত সমস্যা তা মূলত কালাপানি অঞ্চলের, যা উত্তরাখণ্ডে ভারত, নেপাল ও চীনের সীমান্ত সংযোগস্থলে। বিতর্কের কেন্দ্র মহাকালী নদীর উৎসের চিহ্নিতকরণকে নিয়েই। যদিও ১৮১৬ সাল থেকেই ‘সুগাউলি চুক্তি’ অনুযায়ী মহাকালীর পশ্চিমপ্রান্ত ভারতের অধিকারেই আছে। কিন্তু, কমিউনিস্ট শাসকগোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত নেপাল সরকার এই এলাকাকে নিজেদের বলে দাবী করে সংবিধান সংশোধন করে নেপালের নতুন মানচিত্র বানিয়েছে। ফলে, ভারত-নেপাল সম্পর্ক এক গভীর প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টের অনেক সেনাই নেপালের।

 

চীন ও সালামি স্লাইসিং

সালামি স্লাইসিং কি? রাষ্ট্রীয় ধারণায় তা হলো, স্থিতাবস্থা ভেঙে একটি রাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রের ভূমিকে বা অচিহ্নিত ভূখণ্ডকে আস্তে আস্তে ছোট ছোট করে নিঃশব্দে দখলে নিয়ে আসা এবং তথাকথিত নতুন স্থিতাবস্থা তৈরি করা। পরে তা নিজ রাষ্ট্রভূমির অংশ করে নেওয়া।

চীনের ভূমি দখলের ইতিহাস আজকের নয়, যার শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ইনার মঙ্গোলিয়া দখলের মধ্যে দিয়ে। তারপর, একে একে ১৯৪৯ সালে উইঘুর মুসলিম-প্রধান জিনজিয়াং অঞ্চল, ১৯৫০-৫১ সালে তিব্বত দখল, ১৯৫৮ সালে আকসাই চীন দখল, ২০১২-২০১৬ সালে দক্ষিণ-চীন সাগরে পারাসেল দ্বীপপুঞ্জ দখল। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মাও জে দং কথিত যে নীতি, সেখানে তিব্বত হলো হাতের তালু, যা চীনের মুঠোয় চলে এসেছে। আর, বাকি পাঁচটি আঙ্গুল- লাদাখ, নেপাল, ভুটান, সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশ, যেগুলো দখল করা তাদের লক্ষ্য। ২০১৮ সালে দক্ষিণ চীন সাগরে ‘নাইন ড্যাশ লাইন’ বিবাদের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আদালত চীনের বিরুদ্ধে যখন রায় দিল, চীন তখন সেই রায় না মেনে আরো বেশি করে দখলদারী বাড়াতে শুরু করেছে।

প্রশ্ন হলো, এই যে দখলদারীর মানসিকতা তা কি চীনের নতুন নীতি, না কি তা তাদের জাতীয় মানসিকতা? কথায় আছে, নাম দিয়ে যায় চেনা! ইংরেজিতে চীন ‘পিপলস্ রিপাবলিক অফ চায়না’ নামে পরিচিত। কিন্তু, চীনারা তাদের দেশকে নিজেরা কি নামে রেখেছে? তা হল মান্দারিন ভাষায় Zhongguo যার অর্থ হলো ‘সেন্ট্রাল বা মিডল কিংডম’, যা Zhou Kingdom ঝাও রাজবংশ থেকে চলে আসছে। অর্থাৎ তারা মনে করে, সারা পৃথিবীর কেন্দ্রে আছে চীনা কিংডম বা সাম্রাজ্য। এই যে একটা মানসিকতা, যেখানে তারাই থাকবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিংডম বা রাষ্ট্র হিসেবে। এইটাই হচ্ছে তাদের সাপেক্ষে Sinocentrism বা চৈনকেন্দ্রীকতা, যেখানে চীন মনে করে তারা সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি ও রাষ্ট্র, আর বাকি পৃথিবী থাকবে তাদের অধীনে। এই আধিপত্যকামী ও বিস্তারকামী মানসিকতা আজকের চীনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় রূপ পেয়েছে একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনের মাধ্যমে, যেখানে কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদী কুওমিনটাং দলকে হটিয়ে সেই জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে আত্মসাৎ করে এককেন্দ্রিক কমিউনিস্ট শাসনের মধ্য দিয়ে শাসনব্যবস্থাকে জাতীয়তাবাদী রূপ দিয়ে চৈনিক সমাজে প্রতিষ্ঠা করে সারা বিশ্বে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ নেশন বা জাতিরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এর ভিত্তি হচ্ছে হান জাতীয়তাবাদ, যেখানে চিনের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯২% হচ্ছে হান চৈনিক জনগোষ্ঠী।

 

ভারত-চীন সম্পর্ক

ভারত-চীন সম্পর্ক তো আজকের নয়, হাজার হাজার বছরের। তবে, এই সম্পর্কের মধ্যে যে তিব্বত আছে, সেটাই আমরা ভুলে যাই। আসলে ভারত-চিন সম্পর্ক হিসেবে আজকের কিছু উদারবাদী তথা কম্যুনিস্ট নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা যা বলেন তা আসলে যতোটা না চীন সম্পর্কে খাটে, তার থেকে শতগুণে বেশি প্রযোজ্য ভারত-তিব্বত সম্পর্কের ক্ষেত্রে। দু’হাজার বছরের আগে থেকেই সনাতন হিন্দু ধর্মদর্শন ও বৌদ্ধধর্মের প্রসারের মাধ্যমে এবং প্রাচীন ‘সিল্ক রুট’ ধরে ও অন্যান্য পথে বাণিজ্যের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে তিব্বতের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল। তিব্বতের মধ্যে দিয়েই চীন বাকি বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগ রাখত। এমনকি আজকের যে গালওয়ান সমস্যা হচ্ছে, তার উত্তর-পশ্চিমে যে অংশ টারিম বেসিন তাকে ঋকবেদে এবং মহাভারতে বলা হয়েছে ‘উত্তর কুরু’, যা বোঝায় ওই অংশের সঙ্গে ভারতের হাজার হাজার বছরের পরম্পরাগত সম্পর্ক। তাই, আকসাই চীনের বদলে আমরা ওই ভূখণ্ডকে উত্তর কুরুও বলতে পারি।

আজকের সমস্যা রাষ্ট্রগত সমস্যা। এই সমস্যাকে হাজার হাজার বছরের মানবিক ও দেশগত সাংস্কৃতিক সম্পর্ক দিয়ে মেটানো যাবে বলে মনে করলে, তা অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে। একবার ভাবুন, কেন ভারত-চীনের মধ্যে এলএসি রয়েছে? কেন সীমানা নির্ধারিত হলো না? কারণ, চীন জনসন লাইন ও ম্যাকমোহন লাইন মানে না। তাই তার নিঃশব্দে সালামি স্লাইসিং চলছে।

আধুনিক ভারত-চীনের সম্পর্কের সমস্যা শুরু হয়েছিল আকসাই চীনকে নিয়ে, যা জনসন লাইন অনুযায়ী ভারতের। কিন্তু, চীন নিঃশব্দে তা দখল করে নিল। তার প্রেক্ষিতে নেহরু সরকার যা যা পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার পরিণতি হলো ভারতের ‘হিন্দি চীনি ভাই ভাই’ নীতিকে পেছন থেকে ছুড়ি মেরে ১৯৬২ সালের চীন আক্রমণ ও দিশাহীন নেতৃত্বের জন্য ভারতের লজ্জাজনক পরাজয়। তারপর, অবশ্য ১৯৬৭ সালে নাকুলা পাসে ভারত চীনকে শিক্ষা দিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে ভারত-চীনের সীমান্ত-সংঘর্ষ হয়েছিল। তারপর, আবার ২০১৭ সালে ভারত-ভুটান-চীন সীমান্তে ডোকলামে সংঘর্ষ হয়েছে। এরপর, আজকের এই গালওয়ান সংঘর্ষ। তার সঙ্গে প্যাংগং হ্রদে সীমানা নিয়েও সমস্যা। আর, অরুণাচল প্রদেশ তো আছেই।

 

কেন এই চীনা-আগ্রাসন

প্রশ্ন হলো, ঠিক এইসময় কেন এই চীনা-আগ্রাসন, যখন সারা বিশ্ব কোভিড অতিমারীতে পর্যুদস্ত? সীমান্ত-বিবাদের কারণ হিসেবে ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা চারটি ফ্যাক্টরের কথা বলেছেন: রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ-জনিত। আর, সীমান্ত-আগ্রাসনের ব্যাপারে পাঁচটি ফ্যাক্টরের কথা বলেছেন: প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব, ভৌগোলিক অবস্থান, আভ্যন্তরীণ রাজনীতি, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা। এবার কিছু ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করা যাক।

চীনের আধুনিক সিল্ক রুট ‘বেল্ট এ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ সিপেকে ভারতের অংশগ্রহণে চিনের আহ্বানকে মোদি সরকার শুধু অস্বীকার করে নি, তার বিরোধিতা করেছে। কারণ, তা ভারতের পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের গাওদর বন্দরে গিয়ে মিশছে এবং এই করিডর ভারতের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। চীন এটা ভালো ভাবে নেয় নি। আবার, গত কয়েকবছর ধরে পুরো এলএসি ধরে রাস্তাঘাট, বিমানপোত ইত্যাদি পরিকাঠামো গড়ে তোলার যে চেষ্টা ভারত সরকার করছে, তা চিনকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। এছাড়া, সামরিক ক্ষেত্রে ভারতের বিভিন্ন রিফর্ম, যেমন, মাউন্টটেন ট্রাইক কর্পস, কমবাইন্ড চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ পদে নিয়োগ, কমবাইন্ড থিয়েটার কমান্ড গঠনের পথে এগুনো ইত্যাদি।

যদিও চীন ‘নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপ’- এনএসজিতে ভারতের মেম্বারশিপ ঠেকাতে পারছে, কিন্তু ভারত ইতিমধ্যে অন্য একটি গ্রুপ- ‘অষ্ট্রেলিয়া গ্রুপের’ সদস্যপদ পেয়েছে। আর, জাতিসংঘ ইউএনও সিকিউরিটি কাউন্সিল দ্বারা আজহার মাসুদকে গ্লোবাল টেররিস্ট হিসাবে ভারতের প্রস্তাবকে চীনের ঠেকানো তো আজকের কথা নয়। কিন্তু, ৩৭০ ধারা বাতিল করে ভারত সরকার যখন লাদাখকে আলাদা করে কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল করে আকসাই চীনসহ গিলগিট-বাল্টিস্থানের উপর দাবী নতুন করে জানালো, তখনই চীনের প্রতিবাদ জোরালো হলো।

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি যদি দেখা যায়, তবে যা দেখব তা এরকম। জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে নিয়ে যে ‘চতুর্ভুজ’ (কোয়াড) সম্প্রতি নতুন রূপ পেয়েছে, তা চীনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার, জি-সেভেন G7 গ্রুপে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারতকে আহ্বান জানানো চীনের রাগের আরেকটা কারণ। এছাড়াও আরো অনেক কারণের মধ্যে কোভিডে ব্যস্ত ভারতকে অন্ধকারে রেখে চুপি চুপি সালামি স্লাইসিং করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়ে ভারতকে ‘শিক্ষা দিতে’ এই গালওয়ান আক্রমণ। আর, কোভিড-সংক্রমণের জন্য সারা বিশ্বে দায়ী হওয়া ও লকডাউনের জন্য ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রির অচলাবস্থা দেশের মধ্যে যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, তার থেকে দেশবাসীর তথা বিশ্ববাসীর দৃষ্টিকে ফেরাতে ভারতকে ‘সফট টার্গেট’ ভেবে চীনের এই আগ্রাসন। সারা বিশ্ব কোভিড নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- হু’র মাধ্যমে চিনের দায়বদ্ধতা নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছে, ভারতেরও সেই প্রশ্নে বাকি বিশ্বের সঙ্গে থাকাটা চিনের গাত্রদাহ বাড়িয়েছে।

সম্প্রতি ইউএস নিউজ থেকে বলা হয়েছে, এক চীনা জেনারেল গানওয়ান আক্রমণের জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংএর সম্মতি ছাড়া এটা কি সম্ভব? মনে রাখতে হবে, কিছুদিন আগেই এই সীমান্ত সংঘর্ষের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট জিনপিং বলেছেন তাদের পিপলস লিবারেশন আর্মিকে তৈরি থাকতে। এর অর্থ কি?

 

চীন কনটেইনমেন্ট পলিসি

তুষ্টিকরণ নীতি শেষ পর্যন্ত আত্মধ্বংসে পরিণত হয়, যা এই ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মধ্যে দিয়ে দেখেছে। কিন্তু, মনে হয় আমরা তার থেকে কোনো শিক্ষা নিইনি। তাই নেড়া বেলতলায় বার বারই যাচ্ছে।

গত শতকের স্বাধীনতার পর থেকেই সর্দার প্যাটেল থেকে আরম্ভ করে রামমোহন লোহিয়া, মোরারজি দেশাই হয়ে ভূতপূর্ব প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ পর্যন্ত চীনকে ভারতের পক্ষে এক ‘পোটেনসিয়াল থ্রেট’  হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সেই শুরুর নেহেরু সরকার থেকেই ভারত চীনের ব্যাপারে এক অদ্ভুত তুষ্টিকরণের মানসিকতা ও স্থবিরতায় ভুগছে। তার থেকে বেড়িয়ে আসার সময় হয়েছে। তার জন্য চীন যখন ভারতকে চারদিক থেকে কনটেইনমেন্ট করার জন্য এক দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে, ভারতকেও কিন্তু সেইভাবেই পাল্টা ‘চীন কনটেইনমেন্ট পলিসি’ নিতে হবে। তার এক প্রাথমিক রূপরেখা সংক্ষেপে এমন হতে পারে।

ভারতকে উপযুক্ত ভাবে সোয়াট (SWOT) – আমাদের শক্তি, দুর্বলতা, সুযোগ ও বিপদগুলো কি তার সম্বন্ধে বিশ্লেষণ করা দরকার। চাণক্য নীতি অনুযায়ী ‘সাম-দান-ভেদ-দণ্ড’ নীতি রাষ্ট্রনীতির আবশ্যকীয় অঙ্গ। বিশ্ব রাজনীতিতে বন্ধু বা শত্রু রাষ্ট্র বলে কেউ হয় না।

ভারতকে প্রধানত দুটো ফ্রন্টে অর্থাৎ পশ্চিমে পাকিস্তান ফ্রন্ট ও উত্তর-পূর্ব জুড়ে চীন ফ্রন্ট- এই দুটো ফ্রন্টেই সামরিক ভাবে তৈরি থাকতেই হবে। সামরিক শক্তিতে চিনের থেকে ভারত একটু পিছিয়ে আছে। কিন্তু তা একেবারেই যাকে বলে চিনের কাছে ‘পুশ ওভার’ তা নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, অনেক বড় বড় সৈন্যবাহিনী অনেক ছোট মোটিভেটেড সৈন্যবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছে। গত শতকে আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধ সে কথাই প্রমাণ করে।

আবার কূটনৈতিকভাবে ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বব্যাপী যে অক্ষ তৈরি হচ্ছে তাকে ব্যবহার করতে হবে। ভারত তা করতে চেষ্টাও করছে। আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে ভারত ভালো কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। তাইওয়ান ও হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভারতের নৈতিক সমর্থন জানানো দরকার। সম্প্রতি ভারতের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ পদ ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্যপদ পাওয়াকে কূটনৈতিক ভাবে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে হবে।

তবে, সবকিছু পদক্ষেপের ক্ষেত্রে আসল ভিত্তিভূমি হলো অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নামে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)-কে ঢাল করে চীন ভারতসহ সারা বিশ্বকে এক ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত করেছে। গত কয়েক বছর ধরে চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য-ভারসাম্যে ভারত কয়েকগুণ পেছিয়ে আছে। চিন নিজে ডব্লিউটিও-এর ন্যাশনাল সিকিউরিটি ধারাকে ব্যবহার করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য দেশ থেকে আমদানিকে যেমন নিয়ন্ত্রিত করে, ভারতকেও সেইভাবেই সেই পথেই এগিয়ে যেতে হবে। ভারতে যে কোভিড-জনিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার জন্য ইতিমধ্যেই চিনা-পুঁজির ‘অটোমেটিক এপ্রুভাল’ ভারত বন্ধ করে দিয়েছে।

গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষ প্রমাণ করে দিয়েছে যে, জাতীয় নিরাপত্তা ধারায় ভারত সঙ্গতভাবেই চীনা পণ্যের আমদানি ঠেকাতে পারবে পারে। এটা অবশ্যই লকডাইনের মতো দু’তিন মাসের ব্যাপার নয়; বরং কোভিড-যুদ্ধের মতো দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা।  ভারতকে তার ম্যানুফ্যাকচারিং বেসের পরিকাঠামোকে এমন ভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে শুধু চীনা পণ্য আমদানি ঠেকানো নয়; পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানিগুলোর ম্যানুফাকচারিং চেইনের কিছু অংশ যেন ভারতে আসে। ভারতীয় মানসিকতায় যে চীন বিরোধিতা গড়ে উঠেছে, তাকে অবশ্যই প্রকৃত অর্থে আত্মনির্ভরতার পথে নিয়ে যেতে হবে। একদিকে যেরকম নিজের পায়ে দাঁড়ানো, তেমনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করা- সেটাই আত্মনির্ভরতা। যতটা সম্ভব পণ্য-পরিষেবা উৎপাদন করে সেই পণ্য-পরিষেবা আবার বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করা, সেটাই আত্মনির্ভরতা।

 

সামনের পথ

গ্রোথ ইকনোমি ছাড়া কোন দেশ দারিদ্র্য় দূরীকরণ করে উন্নয়নের পথে যেতে পারবে না। সেই ইকোনমিক গ্রোথ হতে পারে যখন কৃষি, শিল্প ও পরিষেবার তিনটি ক্ষেত্রেই সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন হবে। ভারত সেই পথে এগুচ্ছে; কিছু রিফর্ম হচ্ছে, সামনে আরো রিফর্ম প্রয়োজন।

ভারতের সামনে যে অগ্নিপরীক্ষা- আত্মমর্যাদাসহ নিজভূমি রক্ষা করা, আবার সঙ্গে সঙ্গে আত্মনির্ভরশীল হওয়া, তা আমাদের নিজেদেরকে নতুনভাবে গড়ে তোলার এক আত্মপরীক্ষা। ভারত যে ‘এক দেশ, এক জাতি, এক প্রাণ’ তা আমাদের সেনাবাহিনী প্রমাণ করে দিয়েছে।

তিব্বতের নির্বাসিত-সরকারের প্রেসিডেন্ট যেমন বলেছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতকে ‘হয় সহযোগিতা, নয় প্রতিযোগিতা’ করতে হবে। চিনের সঙ্গে ‘সহযোগিতা করার’ অর্থ হলো তিব্বতের মতো আত্মসমর্পণ। ২০০৯ সালে বেজিং থিংকট্যাংকের এক কর্তা যেমন বলেছিলেন যে, ভারতকে খন্ডে খন্ডে ভেঙে দেওয়া দরকার। এই ‘বলকানাইজেশন নীতি’ শুধু চীনের লক্ষ্য নয়, তা অনেক বহিঃশত্রু ও তাদের অনুসারী ভারতের অনেক ভেতরের শত্রুরও। তাই চীনের ক্ষেত্রে ভারতের পথ প্রতিযোগিতা। 

ভারত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’- আধ্যাত্মিক বিশ্বমানবতার কথা বলে ও মেনে চলে। কিন্তু, এই নীতি ও আদর্শের মানে এই নয় যে, দেশ জাতি ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেওয়া। ভারতের রাষ্ট্রনীতির অন্যতম অঙ্গ হোক চাণক্যনীতি।  ‘ভারতের পথ’ ঠিক করবে ভারতীয়রাই- ‘আমাদের পথ আমাদেরই’। এ অগ্নিপরীক্ষা আমাদেরই!