নাগরিক সংশোধনী বিল — এক ঐতিহাসিক আইন, যা বাঙালি হিন্দুদের অধিকার

0
4456

শাশ্বতী সরকার, ষণ্মুখ ও দিকগজ

আমরা কয়েক মাস পূর্বেই নাগরিক সংশোধনী বিল এর পক্ষে সাংস্কৃতিক, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক এবং নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। নাগরিক সংশোধনী বিল এর বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সোচ্চার হয়েছিল কংগ্রেস, সিপিএম ও টিএমসির মত ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু বিরোধী দল। বিজেপির কৌশল আরও পরিশীলিত ছিল। প্রথমে এই বিল লোকসভায় যায়, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় অত্যন্ত সহজেই বিজেপি নাগরিক সংশোধনী বিল পাশ করাতে সক্ষম হয়। এরপর সেটা রাজ্যসভায় পাঠাবার কথা ছিল পাশ করাবার জন্য। কিন্তু ২014 এর ম্যানিফেস্টোতে বিজেপি দ্বারা স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, আসাম ও বাংলায় তৎকালীন বিভিন্ন গণসমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা পূর্ণ প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিজেপি রাজ্যসভায় বিলটি পেশ করেনি। রাজ্যসভায় বিল না পাঠানোয়, খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে বিল ল্যাপস হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সব দল একযোগেই রাজনৈতিক ছলনার মাধ্যমে বিলটির বিরোধিতা করছে। এরপর 2019 নির্বাচনী প্রচারের সময় নির্বাচনে সুবিধার আশায় বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বারম্বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, বিজেপি আবার ক্ষমতায় এলে এই বিল নতুন করে আনবেন এবং পাশও করাবেন [37]। আমরা বিলের পক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছি, কারণ এই নাগরিক সংশোধনী বিলের সাথে ভারতের ইতিহাস ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।

আগে আমাদের বুঝে নিতে হবে যে, একটি জাতি বলতে ঠিক কি বোঝায়? এক্ষেত্রে আভাস চট্টোপাধ্যায় সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে — “একটি জাতি শুধুমাত্র ভূখণ্ডের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয় না, তার মধ্যে মানুষ থাকে, সম্প্রদায় থাকে, ভাষা থাকে, প্রত্যেকটা সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভূখণ্ড, ভাষা, সংস্কৃতি থাকে, সব একসাথে নিয়েই একটি জাতি গঠিত হয়। একটি দেশের মধ্যে মাত্র একটি ভাষা, সংস্কৃতি বা জাতি থাকা সম্ভব নয়, তার মধ্যে বৈচিত্র্য থাকবেই। সবাইকে নিয়ে চলার নামই হল জাতি। একটি দেশের মধ্যে বসবাসরত প্রত্যেক জাতির মধ্যে সামান্য পার্থক্য থাকতে পারে, ভাষাগত, সংস্কৃতিগত বা জাতিগত; কিন্তু তাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে একটি দেশের জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রেই জাতিকে রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হয়, এবং তাতে সবসময়ে ভুল হবে তাও নয়। কিন্তু তাই বলে অন্য জাতিকে দমন করে অন্য জাতির পক্ষে বেশিদূর এগোনো সম্ভব নয়। এর উদাহরণ অতীতেও লক্ষ্য করা গেছে, এখনও যাচ্ছে ভবিষ্যতেও হয়ত যাবে। সবাইকে বুঝতে হবে যে, প্রত্যেক জাতিকে তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে দিলেই তবে দেশটা বাঁচবে। সর্বশেষে বলা দরকার — প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ইতিহাস থাকে, তাদের নিজস্ব নায়ক থাকে, নিজস্ব খলনায়ক থাকে, তাদের নিজস্ব জয় থাকে পরাজয় থাকে, নিজস্ব সাফল্য থাকে, ব্যর্থতা থাকে; যেগুলো অন্য জাতির কাছে ঠিক উল্টোটা বলে মনে হতে পারে।” পৃষ্ঠা 3 [38]। বিএন মুখার্জি লিখেছেন — “এই ‘জাতি’ শব্দটার আপাত অর্থ হচ্ছে একটি গোষ্ঠী, যা ভাষা, ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে তৈরি হয়, সব মিলিয়ে একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি গঠিত হলে সেটা জাতিতে পরিণত হয়। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভাবে একটি গোষ্ঠীও জাতির জন্ম দিতে পারে, যদি তারা দেশের একটি বড় অংশের সমর্থন পায়। সব মিলিয়ে বলা যায় যে, একটি মানুষ বা গোষ্ঠী, যা নির্দিষ্ট কয়েকটি নৃতাত্ত্বিক উপাদানের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে, তারা একক বা সম্মিলিত ভাবে একটি জাতির জন্ম দিতে পারে, এক্ষেত্রে একই কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজনৈতিক সংহতি যে থাকতেই হবে তার কোনও মানে নেই”। পৃষ্ঠা 1 [52]।

এই যুক্তিতে, সুদূর প্রাচীনকাল থেকে একটি জাতি, যারা তখন থেকে এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন ভাবে ঐতিহাসিক অবদান রেখে আসছে, তারা এখন অন্তত অন্যদের তুলনায় সমান সাংবিধানিক অধিকারের ন্যায্য দাবিদার । এখানে মনে রাখা দরকার যে, যে কোনও জাতির লোকের পক্ষে যে দেশে বা রাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যে দেশসেবা করতে হবে; তার কোনও মানে নেই। উদাহরণ হিসাবে আবিদ হাসান সাফরানির কথা বলা যায়, যিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের সহযোগী হিসাবে অত্যন্ত সুপরিচিত; তিনি নেতাজির সাথে সাবমেরিনে করে তিন মাসের দুঃসাহসী অভিযানের মাধ্যমে জার্মানি থেকে জাপানে রওয়ানা দিয়েছিলেন এবং শেষে আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। তিনি স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন বহু তামিল মানুষ, যারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাগরিক ছিলেন, তাদের অনেকেই ভারতকে সারাজীবনেও দেখার সুযোগ পান নি। — “আমি মনে করতে পারছি, যখন আমি রেঙ্গুন থেকে একটি ছোট শহরে প্রাতঃভ্রমণে হাঁটছিলাম, আমার সাথে ছিল ঝাঁসির রাণী রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জানকী থেভারও। আমরা একটি টিলার ওপর বসেছিলাম যেখান থেকে প্রায় পুরো শহর দেখা যাচ্ছিল। “এই পুরো জায়গাটা দেখে কি তোমার তামিলনাড়ুর গ্রামাঞ্চলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে না?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম “দেখে মনে হচ্ছে যেন ভারতেই আছি!” “আমি জানি না” জানকী সরাসরি উত্তর দিল, “আমি কোনওদিনও ভারতে আসিনি।” আমি এই উত্তরের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবছিলাম একজন বিশ বছরের তরুণী, যিনি প্রায় পুরো জীবন মালয়েশিয়ায় কাটিয়েছেন, সেখানেই পড়াশোনা করেছে; অথচ সেই পরিবারকে ত্যাগ করে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে একটি ছোট জায়গায় এসেছে কেবল ভারতকে ব্রিটিশদের অধীনতা থেকে মুক্ত করতে। জানকীই কেবল একা ছিল না। সেখানে কয়েকশ এমন মেয়ে ছিল, যারা পরিবার ছেড়ে ঝাঁসির রাণী ব্রিগেডে যোগ দিয়েছে; যারা জীবনে ভারতবর্ষ কেমন জায়গা অভিজ্ঞতা লাভ করেনি। শুধু ভারতকে ভালবেসে এরা অনেক অপমান সহ্য করে প্রচুর যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা অর্জন করে স্বাধীনতার লড়াই লড়তে এসেছে। কোনও সন্দেহ নেই, একজন সাধারণ ভারতের নাগরিকের তুলনায় এদের কাছে আমাদের ঋণী থাকা উচিৎ এভাবে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছে বলে।” পৃষ্ঠা 12-13 [45]।

এইবার নাগরিক সংশোধনী বিল প্রসঙ্গে আসা যাক, কেন আমরা এই বিলকে সমর্থন করছি, সে প্রসঙ্গে আসা যাক। বলা হচ্ছে এই বিলের মাধ্যমে উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাবে। বিশেষ করে বাঙালি, সিন্ধ্রি, পাকিস্তানী ও আফগান হিন্দু ও শিখরা — যারা পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মীয় হিংসার শিকার হয়েছে। আমাদের মতে, তামিল হিন্দুদেরও এই বিলের অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ, যারা শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ায় ধর্মীয় হিংসার শিকার হয়েছে। যদি ভারতের সংস্কৃতি ও মুক্তি সংগ্রামের প্রতি অবদান রেখেছেন এরকম জাতিগত তালিকা বানানোর ব্যাপার থাকলে দেখা যাবে এই তালিকায় বাঙালিদের অবদান সবচেয়ে বেশি। সেই জন্য তাদের যেমন নাগরিকত্ব দান করা উচিৎ, সেরকমই পাঞ্জাবী ও তামিলদেরও তালিকাভুক্ত করা উচিৎ। কেননা এদের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ।

বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে বুদ্ধিগত অবদানের কথা মারা সকলেই জানি। উদাহরণ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেনের কথা বলা যায়, যারা নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন সাহিত্য ও ইকোনমিক্স বিভাগে। ঠিক তেমনই অনেক এমন বাঙালি বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা যথেষ্ট যোগ্যতা দেখিয়েও নোবেল প্রাইজ পান নি — জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা মেঘনাদ সাহার কথা বলা যেতে পারে, যারা বিজ্ঞানে যথেষ্ট অবদান রেখেও নোবেল পান নি অজানা কারণে। আরেকজন জগদ্বিখ্যাত বাঙালি হিন্দুর (ব্রাহ্ম) নাম করা যায়, যিনি একমাত্র ভারতীয় হিসাবে চলচ্চিত্র জগতের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার ‘অস্কার’ পেয়েছিলেন।

তুলনামূলক ভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দেশকে স্বাধীন করার ব্যাপারে বাঙালি হিন্দুদের অবদান অনেক কম আলোচিত হয়। আমরা এই প্রবন্ধে এই নিয়ে আলোচনা করব। সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাষায় — “কলকাতা হচ্ছে বাংলার মস্তিস্ক ও হৃদয়, শুধু তাই নয়; বহু বছর ধরে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শক্ত ঘাঁটি।” পৃষ্ঠা 98-99 [14]।

তারপর বলেছেন, “যখন এই শতকে স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্রতা যত বেশী বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাঙালি হিন্দুরা ততই বেশি করে ব্রিটিশদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছে। কেননা এরাই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সুত্রধার ছিল।” পৃষ্ঠা 13 [14]। এরপর সুভাষ চন্দ্র বসু বাঙালিদের অবদান সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন — “নিঃসন্দেহে বাঙালিরা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মেরুদণ্ড স্বরূপ” পৃষ্ঠা 90 [1]। সুভাষ চন্দ্র বসু এরপর আরও তীক্ষ্ম ভাবে বলেছেন — “কেউই এই কথা অস্বীকার করতে পারবে না যে, ব্রিটিশ শাসনে প্রথম জাতীয়তাবাদের সূচনা বাংলাই করেছিল। বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু কয়েক দশক ধরে এই জাতীয়তাবাদের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে।” পৃষ্ঠা 169 [1]।

আমরা দেখছি যে, বিংশ শতকের শুরুতে, কি চিন্তাধারা প্রচারে কি ‘অ্যাকশনে’ স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে বাঙালিরা সবচেয়ে অগ্রসর ছিল। উনবিংশ শতকের শেষ দশক থেকে শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ শাসন সম্বন্ধে মোহভঙ্গ হচ্ছিল, বিশেষ করে ব্রিটিশদের কাছে থেকে বর্ণবৈষম্যমূলক ব্যবহার পেতে থাকায় তাদের ক্ষোভে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে বিপিন চন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্বে ব্রিটিশ অধীনতা থেকে মুক্তি সংগ্রাম শুরু করে বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। 1905 সালে অবিভক্ত বাংলার লর্ড কার্জন বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপ রুখতে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মোহভঙ্গ সম্পূর্ণ হয়। ব্রিটিশ সরকার এই সময় থেকে বিপ্লবী ভাবধারা রুখতে সামরিক বলপ্রয়োগের পাশাপাশি বাংলার সংখ্যাগুরু মুসলিমদের মধ্যে জিহাদীদের তোষণ করা শুরু করে। বাঙালিরা উনবিংশ শতকের শেষ থেকে বন্দেমাতরম ডাক দেওয়ার পাশাপাশি স্বদেশী আন্দোলন শুরু করে ব্রিটিশ পণ্যের বয়কট ঘোষণা করে। এতে বাংলা, বিহার ও ওড়িশা অঞ্চলে ব্রিটিশদের ব্যবসার প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছিল। মোটামুটি একই সময়ে স্বরাজ আন্দোলনের সূচনা হয়, যার মূল কথা ছিল ব্রিটিশ অধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়া। এর নেতৃত্বে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। পরের দিকে স্বরাজ আন্দোলন হাইজ্যাক হয়ে যায় কংগ্রেসের দ্বারা, এবং গান্ধী স্বরাজ আন্দোলনই শুরু করেন কিঞ্চিৎ অন্য ভাবে। গান্ধী অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে। কিন্তু বাঙালি হিন্দুরা কোনওদিনই সেরকম ভাবে গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে সাড়া দেয় নি, তারা পূর্ববৎ বিপ্লবী পথকেই সঠিক পথ ভাবত। তারা বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপ শুধু অবিভক্ত বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, পুরো ভারত জুড়েই চালিয়ে গিয়েছিল। আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে যখন বিভিন্ন প্রদেশ মিলিয়ে বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত ব্যক্তির তালিকা জোগাড় করছি, তখন লক্ষ্য করেছি যে, সব প্রদেশের বাসিন্দাদের মধ্যে বাঙালীর অংশগ্রহণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শুধু দুই বাংলাই নয়, প্রবাসী বাঙালিদের সংখ্যাও কম ছিল না। সরকারী পরিসংখ্যান থেকে এটুকু স্পষ্ট হয় যে, মোট বিপ্লবীদের মধ্যে বাঙালি হিন্দুদের সংখ্যার অনুপাত প্রায় 40 শতাংশ। তবে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের মধ্যে পূর্ববঙ্গের ভাগ যত বেশি, পশ্চিমবঙ্গের ভাগ তত বেশি নয় — মেদিনীপুর ছাড়া। এছাড়া প্রবাসী বাঙালিদের ভাগও নেহাত কম নয়।

ঠিক এই কারণেই বাঙালি হিন্দুরা, বিশেষ করে যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছে; তারা স্বাভাবিক ও ন্যায্য কারণেই ভারতে আশ্রয় পাবার উপযুক্ত। আগেই বলেছি যে, ভারতের বুকে বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থল ছিল পূর্ববঙ্গ, কিন্তু বাকি বাংলাও কম ছিল না। ভারতের বিপ্লবী কার্যকলাপের নেতৃত্বে বাঙালি হিন্দুরাই ছিল। সারা ভারত জুড়ে সব ভাষাভাষীর বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা, আদর্শ, বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা বা ভাষণ — সবই ছিল বাঙালি হিন্দুরা। স্মরণীয় জাতীয়তাবাদী বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ, রাসবিহারী বসু সুভাষ চন্দ্র বসুর মত বহু মানুষ সারা জীবন জুড়ে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রসার করতে ব্যস্ত ছিলেন। এদের জন্যই কলকাতা তথা অবিভক্ত বাংলা ‘জাতীয়তাবাদের মস্তিস্ক ও হৃদয়’ হিসাবে গণ্য হত ব্রিটিশ ভারতে। এদের সবাই কলকাতা ও তার আশপাশে বিপ্লবী চিন্তাধারা প্রচার ও ‘অ্যাকশনে’ ব্যস্ত ছিলেন, কেবল রাসবিহারী ব্যতিক্রম। তবে শুধু কলকাতা বা বাংলা নয়, বাঙালি হিন্দুরা যেখানেই সংখ্যাগুরু ছিল, সেখানেই তারা বিপ্লবী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে — যেমন উত্তর প্রদেশ ও মাদ্রাজ প্রদেশ। এই প্রবন্ধে আমরা ১৯৩২ সাল পর্যন্ত বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের অবদান বিবৃত করবো।

এই পর্যায়ে বাঙালি হিন্দুরা ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য করে, এছাড়া এদের জন্যই ব্রিটিশ সরকার অনেক জনস্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপ কমাতে বা রদ করতে বাধ্য হয়। বাঙালি হিন্দুরা কংগ্রেসে ঢুকে পড়ে এবং 1929 সালের লাহৌর অধিবেশনে কংগ্রেসের নেতৃত্বকে স্বাধীনতা চাই ঘোষণা করতে বাধ্য করে। এর কয়েক বছর বাদে 1938 সালে সুভাষ চন্দ্র বসু কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন গান্ধীকে চাপ দেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু করতে। যদিও বাস্তবে গান্ধী সুভাষ চন্দ্র বসু ভারত ছাড়ার দেড় বছর পরে ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করেন 1942 সালে, সুভাষ চন্দ্র বসুর চাপে। এরপর 1945-46 সালে বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের মরণপণ সংগ্রামের বিবরণ ভারতে যখন পৌঁছলো, তখন ভারতের সর্বত্র এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়; ফলে ব্রিটিশরা ভীত হয়ে পড়ে। তারা ভারত ছাড়ার কথা ভাবতে থাকে। তার ওপর 1946 সালে বন্দী আজাদ হিন্দ ফৌজ সৈনিকের বিচার শুরু হওয়ায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সদস্যরা বিদ্রোহ শুরু করে, নৌবাহিনী, স্থলবাহিনী, বায়ুসেনা, সবাই যোগ দেয়। তখন ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এইভাবে অরবিন্দ ঘোষ যে বিপ্লব শুরু করেন, সুভাষ চন্দ্র বসু তা শেষ করেন। আমরা বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এই প্রবন্ধ শুরু করছি।

শুরুর আগে অবশ্য বলা দরকার যে, ভারতের ইতিহাসে বহুবার বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন ধর্মের অনুপ্রবেশকারীরা ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে, সাম্রাজ্যবাদ স্থাপন করেছে। এবং হিন্দুরাও নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষার জন্য এদের বিরুদ্ধে অস্র ধরেছে। আফগান শাহী রাজবংশ ভারতের ইতিহাসের প্রথম হিন্দু রাজবংশ যারা সাহসের সাথে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের সাথে লড়েছে এবং কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ঠেকিয়ে রেখেছে। তারপর উত্তর ভারতের রাজপুতরা প্রায় 600 বছর ধরে মুসলিম শাসন ঠেকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করলেও তা সফল হয় নি। দক্ষিণে বিজয়নগর ও গজপতির হিন্দু রাজারাও চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত অনুরূপ ভাবে দাক্ষিণাত্যে ইসলামিক অনুপ্রবেশ রুখতে সব রকম ভাবে চেষ্টা করে গেছে। ষোড়শ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত মারাঠা, অহম, জাঠ, শিখ ও কোচরা ইসলামিক শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য সংগ্রাম করে গেছে। ইসলামিক শাসকের অবসানের পর খ্রিষ্টান (ব্রিটিশ) শাসকের অবসান চেয়ে সেনাবাহিনীর অনেক হিন্দু সদস্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং বহু জায়গায় যুদ্ধ করে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিন্তু এরা কেউই সম্পূর্ণ সাফল্য পায় নি। শেষে বাঙালি হিন্দু ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে মুখ্য ভূমিকা নেয়।

পরিচ্ছেদ 1 : ব্রিটিশদের সাথে লড়াই

বৌদ্ধিক ও দৈহিক বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা শুরু হয়েছিল সেই 1880-90 দশক থেকে, বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা ব্রিটিশদের ভারত শোষণকে অন্যায্য মনে করতেন — পৃষ্ঠা 10-14 [16]। বিপ্লববাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদ মুখ্যত একজন হিন্দু সাহিত্যিকের কলমের ওপর গঠিত হয়েছিল। তিনি হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তিনিই 1880 দশকে বন্দে মাতরম নামে একটি অসাধারণ জাতীয়তাবাদী সংগীত রচনা করেন যা বিংশ শতকের শুরুতে প্রায় ‘জাতীয় সঙ্গীতে’ রূপান্তরিত হয়। এছাড়া স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদী দর্শনও বাঙালি হিন্দুদের মনকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এইভাবে দুজনে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম দিয়েছিল, সেটা বাকি দেশের সামন্ততান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা ছিল — পৃষ্ঠা 10-13 [16]।

বিপ্লববাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদ, আগেই বলেছি মুখ্যত ব্রিটিশদের বর্ণবিদ্বেষের কারণে উদ্ভুত হয়েছিল। এখানে একজন ব্রিটিশ সরকারী অফিসার এফ. সি. ডেলী (F. C. Daly) এর লেখা একটি গুপ্ত নোটকে রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। পেশায় ভদ্রলোক ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চ এর বিশেষ শাখার ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল ছিলেন। তিনি পরবর্তীকালে বাংলা পুলিসের ইনস্পেক্টর জেনারেলের পদে উন্নীত হয়েছিলেন — পৃষ্ঠা 448 [15]। তিনি গুপ্ত নোটে মন্তব্য করেছিলেন — “আজকাল বাঙালি যুবকদের মধ্যে আগ্রাসক ও মোটামুটি হিংস্র মনোভাব দেখানো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, যা তারা প্রকাশ্য স্থানে ইউরোপীয়দের দেখলেই দেখিয়ে ফেলে। আমি এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বুঝেছি যে, এই যুবকগুলি সাধারণ ভদ্রলোক বাড়ির ছেলে নয়, প্রত্যেকেই কোনও না কোনও গুপ্ত সমিতির সদস্য। এরা প্রত্যেকেই আকারে বেশ শক্তপোক্ত, যে কোনও ইউরোপীয়কে একাকী মহড়া নিতে পার। এরা ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে এমন হাবভাব নিয়ে ঘোরে, যে মনে হয় যে কোনও সময়ে বড় ঝামেলা লেগে যাবে। এরা রাস্তায় চলতে চলতে ইউরোপীয়দের দেখলেই এমন দৃষ্টিকটু ভাবে গলা খাঁকড়াবে বা সিটি মারবে যা স্বাভাবিক ভাবেই বর্ণবিদ্বেষী ইউরোপীয়রা সহজ ভাবে নিতে পারবে না। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি লাগবেই। কখনও কখনও বাঙালি হিন্দু যুবকদের এই ট্যাক্টিক্স কাজে লাগলেও অধিকাংশ সময়েই লাগে নি। ইউরোপীয়রা বুঝে গিয়েছিল কেন তারা এরকম করছে।” পৃষ্ঠা 454 পৃষ্ঠা [15]।

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁর রচনায় ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে ব্রিটিশদের বর্ণবিদ্বেষ বাঙালি হিন্দু যুবকদের প্রভাবিত করতে সাহায্য করেছে। তিনি কলকাতায় একটি দিনের বর্ণনা প্রায় এক যুগ বাদে দিয়েছেন এইভাবে — “আমি যখন প্রতিদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরতাম, তখন একটা জায়গা দিয়ে পার হতাম; যেখানে মুখ্যত ব্রিটিশরা থাকতো। মাঝে মাঝেই বেশ কিছু ঘটনা ঘটতো। ব্রিটিশরা এই ট্রাম-কারে রকে ভারতীয়দের হেয় ও অপমান করার জন্য ইচ্ছা করে দুর্ব্যবহার করত। তারা ইচ্ছা করে পাজোড়া গাড়ির দরজার ওপর এমনভাবে রাখত, যাতে পথচারী ভারতীয়দের গায়ে লাগে। অধিকাংশ সময়েই তাদের উদ্দেশ্য সফল হত। পথচারীরা সাধারণত হত কেরানি বা নিম্নপদস্থ ভারতীয় সরকারী কর্মচারী। তাদের এই ব্যাপারটা হজম করতেই হত। কিন্তু সবার পক্ষে এই অপমানজনক ব্যাপারটা হজম করা সহজ ছিল না। দুই পক্ষের মধ্যে ঝামেলা প্রায়শই লাগত, আমিও অনেকবার তাদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হত। রাস্তায় যখন ব্রিটিশরা চলাচল করত, তখনও পরিস্থিতি এর চেয়ে আলাদা কিছু হত না। ব্রিটিশরা আশা করত যে, ভারতীয়রা তাদের দেখেই রাস্তা ছেড়ে দেবে। যখন সে আশা পূর্ণ হত না, তখন তারা প্রথমে গালিগালাজ এবং দরকারে হাতাহাতি করত। ভারতীয়দের চোয়ালে ঘুষি মারার মত অসভ্যতাও তারা করত। ব্রিটিশ টমিদের আচরণ সাধারণ ব্রিটিশের চেয়েও খারাপ ছিল। এর মধ্যে গর্ডন হাইল্যান্ডারদের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ছিল সবচেয়ে খারাপ। রেলওয়ে ট্রামে আত্মসম্মান বজায় রেখে যাতায়াত করা ছিল সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রেই মারামারি করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হত। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বা রেলওয়ে পুলিস — কেউই ভারতীয়দের সুরক্ষা দিতে পারত না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ হয় ব্রিটিশ নয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হত; ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তারা জাতভাইদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করত। এই কারণে নিগৃহীত হলে ভারতীয়রা সুবিচার পেত না। আমি কটকের একটি ঘটনার কথা মনে করতে পারি, যে সময়ে আমি একটি শিশু ছিলাম। আমার এক কাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে টিকিট থাকা সত্ত্বেও আবার বাড়িতে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন, কেননা জনৈক ব্রিটিশ তার আসন দখল করেছিলেন এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও সন্তোষজনক সমাধান করতে পারে নি। আমি বড় হয়ে অনেক এরকম সঙ্ঘাতের গল্প শুনেছি, যেখানে ভারতীয়রা অনেক উচ্চ পদে চাকরি করলেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেন নি — এই তালিকায় বিচারপতি, পুলিস অফিসার রয়েছেন। এই ধরণের ঘটনা ভারতে অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল এবং ভারতীয়রা কোনও সময়েই ন্যায় বিচার পেত না। এর ফলে ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে, ফলে তারা বিপদ আছে জেনেও আইন নিজের হাতে তুলে নিতে শুরু করে। তারা পালটা মার দিতে থাকে। এউ উন্মাদনা ধীরে ধীরে সর্বত্র ছড়াতে শুরু করে। আমি একজন কটক নিবাসী বাঙালিকে চিনতাম, যে ভাল বক্সার ছিল। তার সাথে দু একবার কলকাতার ব্রিটিশ সংরক্ষিত এলাকায় মারামারি হয়েছিল এবং প্রতিবার প্রবল মার খেয়ে ব্রিটিশরা পিছু হঠেছিল। এর ফলে ব্রিটিশরা বুঝতে পারে ভারতীয়দের পেছনে লেগে লাভ নেই, তাতে ইজ্জত হারাবে। এইভাবেই বাঙালি যুবকদের মধ্যে বিপ্লববাদ বাড়তে থাকে, যা পরে বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে রূপান্তরিত হয়।” পৃষ্ঠা 73-74 [16]।

পরিচ্ছেদ 2 : মুক্তি সংগ্রামের সূচনা

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন 1905 — উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা, জ্বালাময়ী-বার্তা 8 জুলাই 1905 সালে ভারত সরকার স্বরাষ্ট্র সচিবের মাধ্যমে জানিয়ে দিল তারা অবিভক্ত বাংলাকে তিন ভাগে ভাগ করে দিচ্ছে — পৃষ্ঠা 450-51 [15] । এই বঙ্গভঙ্গের ঘটনায় ক্রুদ্ধ বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় রাজ্য জুড়ে বিরাট আন্দোলন শুরু করে। শুধু বাংলা নয়, বাংলার বাইরেও বিরাট আন্দোলন শুরু হয়। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার এই আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন এই আন্দোলন থেকেই আদতে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। এবং এর ব্যাপ্তি 1857 এর মহাবিদ্রোহের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ 1857 এর অনেকটাই স্বাধীনতা সংগ্রাম এর বদলে ইসলামিক যুদ্ধ, অর্থাৎ জিহাদ, হয়ে গেছিল।

একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম তখনই সফল হয়, যখন উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা চলে আসে এবং দুঃসাহসী ‘অ্যাকশন’ কার্যকর হয়। বাঙালি হিন্দুরা দুই দিক থেকেই প্রচণ্ড সফল ছিল; এমনকি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের আগে থেকেই।

সারা ভারতেই বাঙালি হিন্দুরা বিপ্লবী চিন্তাধারায় উনবিংশ শতকের সময় থেকেই প্রভাবিত ছিল। তাদের একটা বড় সুবিধা ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষাতেই অমর ‘আনন্দমঠ’ রচনা করেছিলেন, যাকে ভারতের প্রথম হিন্দু জাতীয়তাবাদী সাহিত্য বলা হয় — এই আনন্দমঠ উপন্যাসেরই একটা অংশ ‘বন্দে মাতরম’ বাঙালি হিন্দু ও অন্যান্য ভারতীয় হিন্দুদের প্রচণ্ড ভাবে প্রভাবিত করেছিল। এমিলি ব্রাউন লিখেছেন কিভাবে বন্দে মাতরম বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে প্রভাব ফেলেছিল — “একজন মারাঠী হয়েও সাভারকার বন্দে মাতরমকে ‘জাতীয় মন্ত্র’ বলতে দুবার ভাবেন নি। এই গানটি প্রায়শই ইন্ডিয়া হাউসের হাউসগুলি ঘরে ঘরে শোনা যেত এবং সর্বোপরি প্রতিটি মিটিং বা সম্মেলনের উদ্বোধনে গাওয়া হতো।

এইভাবে বন্দে মাতরম এক সময়ে নাজিরা যেভাবে পরস্পর পরস্পরকে হেইল হিটলার বলে সম্ভাষণ করত ঠিক সেইভাবে ভারতীয় বিপ্লবীরা একের অপরকে সম্ভাষণ করার মন্ত্র হিসাবে বেছে নেয়।” পৃষ্ঠা 62 [26]। এইভাবে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমেই বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনের শুরু হয়।

বাঙালি হিন্দুরা হিন্দু সভ্যতাতে বহু প্রচলিত বেশ কিছু মৌলিক চিন্তাভাবনার সমন্বয় ঘটিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনের শক্তিশালী রণনীতির উদ্ভাবন করে। ঐতিহাসিক ভাবে ‘স্বরাজ’ শব্দটা ‘’স্বায়ত্ত্বশাসন’ অর্থে প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছিল মারাঠা বীর শিবাজির দ্বারা প্রণীত কয়েকটা চিঠিতে। শিবাজির দূত পীতাম্বর শেনভি দক্ষিণ কোঙ্কণ রাজ্যের কুদাল রাজ্যের খেম সাওন্তের সঙ্গে যে চুক্তি করেন, তাতে লেখা ছিল — শিবাজি তুর্কিদের সঙ্গে যা ব্যবস্থা করবেন তার মাধ্যমে মারাঠাদের ‘স্বরাজ’ রক্ষা করা হবে।— পৃষ্ঠা 1 [47]। বলাই বাহুল্য এই স্বরাজ শব্দটি বিংশ শতকের শুরুতে বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছিল আরেকজন মারাঠি ব্রাহ্মণের কলমের মাধ্যমে — সখারাম দেউস্কার। তিনি কর্মসূত্রে বহু বছর বাংলায় ছিলেন এবং বাংলায় লিখতে-পড়তে জানতেন। অরবিন্দ ঘোষের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় শিবাজি ও পেশোয়া বাজিরাওয়ের ওপর আত্মজীবনীমূলিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। শিবাজি গ্রন্থে প্রথমবার স্বরাজ শব্দটা ব্যবহার করেন, বাংলা ভাষায় এই শব্দের ব্যবহার আগে ছিল না। অরবিন্দ ঘোষ স্বরাজের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসাবে ‘Independence’ ব্যবহার করেন। একটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক সন্ধ্যা’র মাধ্যমে স্বরাজ শব্দটা প্রচারিত হয় এবং প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পায়। সন্ধ্যার সম্পাদক ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (1906) সভাপতি দাদাভাই নৌরজি স্বরাজ শব্দটা ‘’স্বায়ত্ত্বশাসন’ অর্থে ব্যবহার করেছিলেন।

ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে বাঙালিরা নীল বিদ্রোহের (1859) সময়ে প্রথমবার অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন — পৃষ্ঠা 50 [14]। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নীল বিদ্রোহের ওপর লিখতে গিয়ে লিখেছেন — “বৈজ্ঞানিক ভাবে কৃত্রিম নীল আবিস্কারের পূর্বে বাংলায় ছিল নীল উৎপাদনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। নীল চাষ মুখ্যত ব্রিটিশদের পয়সায় হত, তারা শত শত বিঘা জমিতে নীল চাষ করাত ভারতীয়দের দিয়ে। এই নীল চাষ করতে গিয়ে ব্রিটিশ নীল মালিকরা ভারতীয় চাষীদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার করত, কেননা ভারতীয় কৃষকরা বাংলার অর্থনীতির পক্ষে আপাত ক্ষতিকারক নীল চাষ করতে চাইত না। যখন ব্রিটিশ নীল মালিকদের অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল তখন নীলচাষীরা বিদ্রোহ শুরু করল। প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয় যশোহর ও নদীয়া জেলায়, পরে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। নীলচাষীরা নিজের হাতে আইন তুলতে বাধ্য হয়। তারা নীল চাষ করতে অস্বীকার করে, চাষাবাদ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় এবং এমন সব পদক্ষেপ নেয়, যার ফলে নীল মালিকদের পক্ষে বাংলায় থাকাই অসম্ভব হয়ে যায়। তাদের ওপর পালটা সন্ত্রাস চালিয়ে আতঙ্কিত করে। দীনবন্ধু মিত্রের বিখ্যাত উপন্যাস নীল-দর্পণে নীল বিদ্রোহের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে। এইভাবে নীলচাষীরা নিজের হাতে আইন তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল, কেননা তারা লক্ষ্য করেছিল ব্রিটিশ আইনব্যবস্থা ঐ অসভ্য বর্বর ইউরোপিয়ান নীল মালিকদের পক্ষেই রয়েছে।” পৃষ্ঠা 50 [14]।

1870 সালে পাঞ্জাবি কুকারা রাম সিংহের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় পণ্য, সরকারী স্কুল, সরকারী পরিষেবা, ডাক পরিষেবা ইত্যাদি বয়কট করতে শুরু করে। তারা পুরোপুরি স্বদেশী পণ্য ব্যবহার করতে থাকে [28]। দুই আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এটা যে, তারা নিজেরাই লড়ে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, একই ধরণের জিনিসপত্র ও অস্ত্র ব্যবহার করত, আর সবচেয়ে বড় মিল হল — বয়কট করার নীতি হিন্দু সভ্যতায় কোনও নতুন জিনিস নয় — সামাজিক বয়কট করার নীতি সেই মৌর্য যুগ থেকেই চলে আসছে। অরবিন্দ ঘোষ এই দুই বিদ্রোহের ইতিহাস জানতেন এবং এর প্রধান বৈশিষ্ট্য — সামাজিক বয়কট নীতি গ্রহণ করতে দুবার ভাবেন নি। কারণ তিনি জানতেন ভারতীয়রা এই কাজটা ভাল পারে। আমরা বিংশ শতকের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে আবার এফ. সি. ডেলীর তরফে 17 জুলাই 1905 সালে লেখা নোটে আসি। সেখানে তিনি লিখেছেন — অমৃত বাজার পত্রিকা প্রথমবার খোলাখুলিই ব্রিটিশ পণ্যের বয়কটের জন্য আবেদন জানিয়েছিল। জনৈক ‘G’ বয়কটের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ইহা লাল মোহন ঘোষের দ্বারা লিখিত হয়েছে, কিন্তু পরে আন্দাজ করেছিলেন এই ‘G’ আসলে হয় অরবিন্দ ঘোষ নয় তারই ভাই বারীন্দ্র ঘোষ হবে।

7 আগস্ট 1905 সালে কলকাতার একটি বৈঠকে এই বিদেশী পণ্য বয়কটের সিদ্ধান্ত সার্বিক ভাবে গৃহীত হয়েছিল, সাধারণভাবে ঐ দিনটাকেই ইতিহাস স্মরণে রেখে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল বলে। আর একই দিনেই স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল বললেও চলে। অমৃত বাজার পত্রিকার একজন প্রতিনিধি স্বদেশী আন্দোলনের ওপর লিখতে গিয়ে 1726 সালের একটি ঘটনার কথা তুলে ধরেছেন, যেখানে জনৈক ধর্মগুরু গুরুপদ স্বামী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করার সময়ে বিদেশী পণ্য বয়কট করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের মুখ্য লক্ষ্য ছিল দুটি বিদেশী পণ্য — বিদেশী লবণ ও ম্যানচেস্টার মিলে তৈরি কাপড় — পৃষ্ঠা 452 [15]। বাংলায় যেসব পাঞ্জাব থেকে আসা শিখ ও হিন্দুরা থাকতেন, তারা স্বদেশী আন্দোলনকে পাঞ্জাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ডেলী তার নোটে লিখেছিলেন — “1905 সালেই জনৈক পাঞ্জাবী তরুণ, টহল রাম গঙ্গা রাম এই স্বদেশী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে দুই বার কলেজ স্কোয়ারে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্ররোচক মন্তব্য করে গ্রেফতার হয়েছিলেন।” পৃষ্ঠা p. 452 [15]। ডেলীর ধারণা হয়েছিল টহল রাম সম্ভবত কুলা বিদ্রোহ থেকে প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা তারই রাজ্যে হয়েছিল। ডেলির নোট থেকে স্পষ্ট কিভাবে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার রীতিনীতি ভারতীয় বিপ্লবকে প্রভাবিত করেছিল। কুকা বিদ্রোহ বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। শান্তিপূর্ণ একটি বিদ্রোহ ব্রিটিশদের দমনপীড়ন নীতির কারণে শীঘ্রই অশান্ত হয়ে ওঠে। ক্ষুব্ধ কুকা আন্দোলনকারীরা ব্রিটিশদের দুর্গ মালের কোটলায় আক্রমণ করে, এর ফলে ব্রিটিশদের সুবিধা হয়ে যায়, কুকা আন্দোলনকারীদের নির্মম ভাবে দমন করা হয়। কিন্তু কুকারা যে সামাজিক বয়কটের নীতি নিয়েছিল, সেটা নতুন প্রজন্মের পাঞ্জাবিদের হাত ধরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমে।

গান্ধী নিজেও স্বরাজ শব্দটাকে ব্যবহার করতেন বটে, কিন্তু অতিরিক্ত ও বিকৃত ব্যবহারের কারণে শব্দতার তাৎপর্য অনেকটাই হারিয়েছিল। 1909 সালে তার ‘স্বরাজ’ গ্রন্থে স্বদেশী আন্দোলনকে নতুন করে চালু করার কথা লিখেছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন তাকে প্রভাবিত করেছিল। 1920 দশকে তিনি এই দুই নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এক্ষেত্রে লিখেছিলেন — “গান্ধী খুব ভেবেচিন্তেই অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি এমন ভাবে একটি পুরানো রণনীতিকে ব্যবহার করেছিলেন, যা দেশ আগে দেখে নি। 1905 সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর বাঙালিরা যে অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা-ই নতুন করে গান্ধীর হাত ধরে আবার শুরু হয়েছিল। 1905 সালে স্বদেশী আন্দোলনকারীরা স্বদেশী পণ্যের প্রস্তুতের ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। তারা নতুন জাতীয়তাবাদী মিশনে নেমেছিলেন — স্বদেশী পণ্য প্রস্তুতকারক কারখানা, স্কুল, কলেজ তৈরি করেছিল। স্বদেশী স্কুল ও কলেজে পড়তে বেতন লাগত না। বিখ্যাত আইনজীবী বিপিন চন্দ্র পাল ব্রিটিশ আদালতকে বয়কট করার জন্য আহ্বান করেছিলেন, তার মতে, ব্রিটিশদের কোনও অধিকার নেই আমাদের বিচার করার। অরবিন্দ ঘোষ স্বদেশী আন্দোলনকে আইরিশ ‘সিন ফিন’ আন্দোলনের সাথে তুলনা টেনেছিলেন; যার মূল নীতি একই ছিল। সিন ফিন আন্দোলনের কিছু বৈশিষ্ট্য গান্ধীর অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে ছিল। যারা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তারা ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় পণ্য, সরকারী স্কুল, সরকারী পরিষেবা, ডাক পরিষেবা ইত্যাদি বয়কট করতে শুরু করে। এইভাবে ব্রিটিশদের শোষণ নীতি থেকে তারা মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে।” পৃষ্ঠা 50 [14]। এখানে বলে রাখা দরকার 1920-21 সালের পুনর্জাগরিত স্বদেশী আন্দোলনে বাংলার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশী। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু লিখেছিলেন — “এই স্বদেশী আন্দোলনে যেভাবে বাঙালিরা অংশ নিয়েছিল, তা কল্পনাতীত বললেও কম বলা হবে। বাঙালি ছাত্ররা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বদেশী আন্দোলনের স্বার্থে আইন ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার মত বিরাট আত্মত্যাগে প্রভাবিত হয়েছিল। ছাত্র ও শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কংগ্রেস চাঁদা সংগ্রহ, সদস্য সংগ্রহ, দেশজুড়ে বৈঠক করতে, বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে, স্বদেশী পণ্য প্রস্তুত করতে আহ্বান জানিয়েছিল। এক্ষেত্রে চরকা ছিল বড় হাতিয়ার, যার মধ্যমে কাপড় বোনা যেত। গান্ধী সবাইকে চরকার মাধ্যমে সুতো কাটা ও কাপড় বোনার মত বিদ্যা রপ্ত করতে। স্বদেশী আন্দোলন শুরু না করলে ভারত জুড়ে গান্ধীজির প্রভাব এত বেশি হত কিনা সন্দেহ আছে।” পৃষ্ঠা 56 [14]। এইভাবে অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের মাধ্যমেই গান্ধীজি ভারতে নিজের প্রভাব বাড়াতে শুরু করেন।

পরিচ্ছেদ 3 : কিভাবে বাঙালি হিন্দু সারা ভারতে স্বাধীনতার সংগ্রামকে ছড়াতে ও সংগঠিত করতে সাহায্য করেছিল?

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকেই বাঙালি হিন্দু যুবকরা ভারতকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত করার জন্য সারা ভারত জুড়ে অ্যাকশনে নেমেছিল। সুভাষ চন্দ্রের ভাষায় — “বাংলা বরাবরই বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপের শক্ত ঘাঁটি ছিল।” পৃষ্ঠা 334 [14]। বাঙালি হিন্দুরা যেখানেই থাকুক না কেন, বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপে অংশ নিতে দেরি করে নি। ভারতের প্রায় প্রত্যেক প্রদেশেই প্রবাসী বাঙালিরা গুপ্ত সমিতি গঠন করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিল। আমরা এবার দেখব তারা কিভাবে সারা ভারত ও বহির্বিশ্বে বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপের বিস্তার ঘটিয়েছিল এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল।

পরিচ্ছেদ 3.1 :

বিংশ শতকের প্রথম দশক আমরা প্রথমে বিংশ শতকের প্রথম দশকে কিভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হল, কিভাবে তা ধীরে ধীরে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হল, তার ব্যাখ্যায় আসি। বাংলায় প্রথম বিপ্লবাত্মক ক্রিয়াকলাপ শুরু করেন অরবিন্দ ঘোষ, বলতে গেলে তিনিই বাংলায় সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেসয়া শুরু করেন। এফ. সি. ডেলির গুপ্ত নোট থেকে বোঝা যায় — ব্রিটিশরা আশঙ্কা করেছিল বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হতে পারে — “অরবিন্দ ঘোষ আবির্ভূত হলেন ভারত এক জাতি এই বাণী নিয়ে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সহিংস আন্দোলনের সাফল্যের জন্য ভারত জুড়ে অসন্তোষের মতবাদ ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন । , এবং বিদেশী শাসকদের প্রতি শত্রুতার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রদেশের মানুষকেএকত্রিত করা সম্ভব।। তিনি আরও দৃঢ়ভাবে দেখতে পেয়েছিলেন যে, এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিশ্চিত এবং নিরাপদ স্থলটি ধর্ম হবে। ধর্মপ্রচারকদের সন্ন্যাসীর পোশাকে ভারতের চতুর্দিকে প্রেরণের পন্থা উদ্ভাবন করেছিলেন। তারা নতুন এক ধর্মের প্রচার করবে, সে ধৰ্ম হবে দেশমাতৃকার পূজা। তার দূরদর্শিতা ছিল ঈর্ষণীয়। অরবিন্দ ঘোষ অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে শ্রীমদ্ভাগবৎ গীতাকে নতুন ভাবে ভাষ্য দিয়ে বাঙালি হিন্দু যুবকদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, অন্যায়ের দমন করতে হলে অস্ত্রের সাহায্য নেওয়া অন্যায় নয়, অন্যায়কে সহ্য করাই অন্যায়। তিনি গীতার ভাষ্যের মাধ্যমে বুঝিয়েছিলেন যে, আত্মার মৃত্যু নেই এবং প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভগবান থাকে, তাকে খুঁজে বের করা কর্তব্য।” পৃষ্ঠা 453-454 [15]।

ডেলী বিংশ শতকের শুরুতে কিভাবে বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা অংশ নিয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা করেছেন — “আমরা লক্ষ্য করেছিলাম যে, যেসব গুপ্ত সমিতি রয়েছে, প্রত্যেকটাই এক একজন ধূর্ত ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে; যার নির্দেশে পুরো আন্দোলন চলছে। এইসব ‘পরিচালকরা’ গোপনে তো বটেই প্রকাশ্য জনসভায় অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে প্রচ্ছন্ন ভাবে বিপ্লবকে সমর্থন করতে বলতেন। এবং জনসভা থেকে এমন ভাষণ দিতেন যে, মানুষের মধ্যে সরকার ও পুলিসের ওপর ঘৃণা ও ক্রোধ আরও বৃদ্ধি পেত; এই কর্তৃপক্ষ তাই বিপ্লবীদের নেতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টায় থাকত; যাতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে না চলে যায়। ছেলেমেয়েদের এমন ভাবে হত্যা করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত, যাতে ধরা পড়লেও সাধারণ মানুষ তাদের ‘দেশের শত্রু’ ভাবতে দ্বিধান্বিত হত। এদের বিরুদ্ধে প্রমাণ আনা প্রায় অসম্ভব ছিল, এতই সুকৌশলে হত্যাকাণ্ডগুলি ঘটাত। মানিকতলা বাগানে অনেক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোট ছোট ট্রাঙ্কে করে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তারা পুরো ব্যাপারটা এমনভাবে সাজিয়েছিল যেন সেখানে ধর্মীয় কার্যকলাপের বাইরে কিছুই হয় না। সেখানে গেলে দেখা যেত যুবকরা মাথা দুলে দুলে গীতা পাঠ করছে। সত্যি করে বলতে কি, অরবিন্দ ঘোষের অসাধারণ ব্যবস্থাপনার দরুন এই যুবকরা এক একজন কত বড় ভয়ঙ্কর ‘খুনি’ সেটা বোঝার উপায়ই থাকত না। তাদের হাবভাব ও কথাবার্তা শুনলে একজন ‘বিপ্লবীর’ চেয়ে ধর্মপ্রচারক বেশি মনে হত। আসলে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের প্রথম যুগের অপরাধীরা গভীর ধৰ্ম বিশ্বাস এর দ্বারা চালিত হতো। এই ধৰ্ম বিশ্বাস এর ভিত্তি অরবিন্দ ঘোষ আর অন্য কিছু মেধাবী ব্যক্তি গঠন করে।” পৃষ্ঠা 456-57 [15]।

এই সময়ে বহু বিখ্যাত বাঙালি জন্মেছিলেন, যারা বিপ্লবাত্মক ক্রিয়াকলাপের কারণে হয় ব্রিটিশ আদালতের রায়ে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন (ক্ষুদিরাম বসু, কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু ), সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন কারাবাস করতে (বারীন্দ্র ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত ও ইন্দুভূষণ রায়) বাধ্য হয়েছিলেন। ব্রিটিশদের গুলিতে নিহত বিপ্লবীদের মধ্যে ক্ষুদিরাম বসুর সহযোগী প্রফুল্ল চাকী উল্লেখযোগ্য নাম। শুধু দেশে নয়, বাঙালি হিন্দু যুবকরা গ্রেট ব্রিটেন থেকেও বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। মারাঠি বিপ্লবী বিনায়ক সাভারকার লন্ডনে বসে ইন্ডিয়া হাউস নামে একটি গুপ্ত সমিতি খুলেছিলেন, যেখানে সব বিপ্লবীরা একত্রিত হত। ইন্ডিয়া হাউসের ফাণ্ডিং করতেন বিখ্যাত গুজরাতি ব্যবসায়ী শ্যামজী কৃষ্ণ বর্মা। ইন্ডিয়া হাউসে সাভারকারের সাথে যারা যোগদান করেছিল, তাদের মধ্যে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় অন্যতম, যিনি সম্পর্কে সরোজিনী নাইডুর ভ্রাতা ছিলেন। এই বীরেন্দ্রনাথ মনে করতেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশদের অধীনতা থেকে ভারতকে মুক্ত করতে হবে — পৃষ্ঠা 18 [34]। পরের দিকে যুগান্তর নামক আরেক বাঙালি বিপ্লবী সংগঠনের নেতা হেমচন্দ্র দাস প্যারিসে আসেন অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে, তিনিও ইন্ডিয়া হাউসের সদস্য ছিলেন — পৃষ্ঠা 18 [34]। ইন্ডিয়া হাউস থেকে নন্দকুমার সেন নামে আরেক বাঙ্গালিও প্যারিসে গিয়েছিলেন অস্ত্র বানানো ও চালানো শিখতে। তার সাথে ছিলেন নীতিসেন দ্বারকাদাস — পৃষ্ঠা 19 [34]। ব্রিটেনে বসেই যারা প্রথম ব্রিটিশ সরকারী কর্মচারীর ওপর ‘সন্ত্রাসবাদী হামলা’ চালিয়েছিলেন, তারা আরেক বাঙালি কুঞ্জলাল ও বাসুদেব। এরা ইন্ডিয়া অফিসে ঢুকে পড়ে লী ওয়ার্নার নামে নামে একজনকে হত্যা করে — পৃষ্ঠা 19 [34]। এই সময়ে বীর সাভারকারের দুই বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও ভিভিএস আইয়ার — পৃষ্ঠা 27 [34]।

এবার আমরা ব্যাখ্যা করব কিভাবে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাঙালি হিন্দু যুবকরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে বিপ্লবী কার্যকলাপে নেতৃত্ব দিয়েছিল, সংগঠিত করেছিল এবং অবদান রেখেছিল। এছাড়া তামিল নাড়ু, পাঞ্জাব, সংযুক্ত প্রদেশ (আজকের উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাঞ্চল ও ছত্তিশগড়ের কিছু অংশ নিয়ে তৈরি হয়েছিল) এবং মহারাষ্ট্রেও এই সময়ে বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপ জোরদার হচ্ছিল।

পরিচ্ছেদ 3.2.1 : পাঞ্জাব ও সংযুক্ত প্রদেশ

বাঙালি হিন্দু বিপ্লবী রাসবিহারী বসু দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। 1912 সালে তার নেতৃত্বে ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। সে সময়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লিতে একটি প্যারেডে হাজির ছিলেন। প্যারেডে একজন বাঙ্গালি বিপ্লবী বসন্ত কুমার বিশ্বাস হার্ডিঞ্জকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়লে সাঙ্ঘাতিক ভাবে আহত হন হার্ডিঞ্জ। বসন্ত কুমার এই কাজে সাথী হিসাবে নিয়েছিলেন বালমুকুন্দ, আমিরচাঁদ ও দীননাথ নামে তিন পাঞ্জাবীকে; যারা দিল্লির প্রত্যেক অলিগলি চিনত। দিল্লী বিস্ফোরণে বাঙালি হিন্দুরা কিভাবে জড়িত ছিল সেটা দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলার বিচারক লর্ড রাওলাট লিখেছিলেন — “লাহোর থেকে ফিরে এসে দীননাথ বীরেন্দ্রনাথের সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছিলেন, তারপরেই তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান আইন নিয়ে পড়বেন বলে। বীরেন্দ্র তাকে কুখ্যাত বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। রাসবিহারী সে সময়ে দেরাদুনের ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটে সর্বোচ্চ কেরানীর পদে নিযুক্ত ছিলেন। এই রাসবিহারীই দীননাথকে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। শুধু দীননাথ নয়, তার সাথে আরও দুজন হিন্দু যুবকও ছিলেন — অবোধ বিহারী ও বালমুকুন্দ। এদের প্ররোচক বই পড়ানোর পাশাপাশি রাসবিহারী শিখিয়েছিলেন কি করে বোমা বানাতে হয়, বোমা ছুঁড়তে হয়। এই কাজে সাহায্য করেছিলেন তারই পরিচারক বসন্ত কুমার বিশ্বাস। অবোধ বিহারী লাহোর সেন্ট্রাল ট্রেইনিং কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেখানে সেভাবে যেতেন না, অধিকাংশ সময়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমিরচাঁদের সাথে দিল্লিতেই থাকতেন। আমিরচাঁদ নিজেও দিল্লী চক্রান্তে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি দিল্লির একজন সেশন জাজকে ‘দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক’ তকমা দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। এখানে সব চক্রান্তকারীর সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে। শুধু এটুকু বলা যেতে পারে, এরা হার্ডিঞ্জকে খতম করার ‘মিশনে’ নেমেছিল। তারা এই কাজে দিল্লী ও লাহোরের অনেক ছাত্রকে সহযোগী হিসাবে নিয়েছিল। তাঁরা ছাত্রদের এটাই বুঝিয়েছিলেন যে, ‘গীতা, বেদ ও কোরান আমাদের শিখিয়েছে যে, প্রয়োজনে দেশমাতৃকার শত্রুকে হত্যা করায় কোনও অন্যায় নেই। সে শত্রু অন্য জাতের হতে পারে, অন্য ধর্মের হতে পারে বা অন্য গাত্রবর্ণের হতে পারে; শত্রু শত্রুই।’

সব ছোটবড় জিনিসের খুঁটিনাটি লেখা বাদ দিয়ে শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, দিল্লির ওপর একটি ঐশ্বরিক শক্তি আছে, যে ডিসেম্বর মাসে ভারতকে মহাবিপর্যয় থেকে মুক্ত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে গিয়ে দেখছি যে, তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দিল্লির সাধারণ মানুষকে ক্রুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা কলকাতার রাজাবাজারে একটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্ররোচক ভাষণ সংবলিত ইস্তেহার তৈরি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব তৈরি করতে চেষ্টা করেছে এবং আংশিক সাফল্যও পেয়েছে। মামলায় প্রাপ্ত বিভিন্ন নথিপত্র থেকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, বসন্ত কুমার বিশ্বাসই সেদিন 17 মে 1913 সালে লাহৌরের লরেন্স গার্ডেনে বোমা রেখেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সেখানে জমায়েত হওয়া কয়েকশ ইউরোপীয়দের হত্যা করে জনমানসে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। দুর্ভাগ্যবশত কোনও ইউরোপীয়ের মৃত্যু হয় নি, কেবল একজন দুর্ভাগা বৃদ্ধ ভারতীয়কে মেরে দেয়। দীননাথ রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়, এর ফলে বসন্ত কুমার বিশ্বাস, অবোধ বিহারী, আমিরচাঁদ ও বালমুকুন্দ দোষী সাব্যস্ত হয় এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ পায়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা এই মামলার প্রধান চক্রান্তকারী রাসবিহারী বসুকে ধরতে পারি নি। ধুরন্ধর রাসবিহারী পালিয়ে যায়। এরফলে আমাদের মনে আশঙ্কা থেকে যায় যে, সে আমাদের বিরুদ্ধে আবার খুনে কার্যকলাপ চালাতে পারে। পুরো মামলা পর্যালোচনা করে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই কাজে তারা বেশী লোকের সমর্থন পায় নি এবং পুরো ঘটনায় জনগণ তাদের প্রতি নয় — আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।” পৃষ্ঠা 144-145 [30]। এখানে বলে রাখা দরকার বালমুকুন্দের ভাই পরমানন্দ দাদার ফাঁসির প্রতিশোধ নিতে বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে যুক্ত হয়; সে পাঞ্জাবের ঝিলাম জেলার বাসিন্দা ছিল, যা আজ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত।

আমরা ব্যাখ্যা করলাম কিভাবে রাসবিহারী শিক্ষিত ভারতীয়দের বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত হতে প্রভাবিত করেছিলেন। 21 ডিসেম্বর 1912 সালে লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর গুপ্তহত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি দেরাদুনে পালিয়ে যান। “সেখানে ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের কর্মীদের দিয়ে একটি সরকারী বিবৃতি দিয়ে এই বিস্ফোরণের নিন্দা করেন। এরপর একটি বড়মাপের জনসভা আয়োজন করে এক ‘কাপুরুষোচিত আক্রমণের’ সমালোচনা করে ব্রিটিশ অফিসারদের খুশি করার চেষ্টা করেন। তিনি এভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বোকা বানিয়ে নিজের বিপ্লবী চেহারা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন এবং দারুণ সফল হন” — পৃষ্ঠা 109-110 [40]। ভাইসরয় হার্ডিঞ্জ গুপ্তহত্যার ব্যর্থ প্রচেষ্টা সম্বন্ধে বিবরণ দিয়েছেন — “যখন আমি স্টেশন থেকে গাড়িতে করে আমার বাংলোয় ফিরছিলাম, তখন আমি একজন ভারতীয়কে দেখলাম যে আরো কয়েকজনের সঙ্গে নিজের বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা আমাকে দেখে ঘটা করে সেলাম ঠুকছিল একজন ভারতীয়র পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম, ভারতীয়টা তার বাড়ি থেকে বাইরে বেরুচ্ছিল। তার পাশাপাশি যেসব ভারতীয়রা রাস্তায় হাঁটছিল, তারা আমাকে দেখে সেলাম ঠুকছিল। যখন আমি খোঁজ নিলাম এরা কারা, তখন আমাকে বলা হলো যে প্রধান ভারতীয়টি দু দিন আগে দেরাদুনে এক মিটিং এ সভাপতিত্ব করে, আর আমার ওপর আস্থা প্রস্তাব পেশ করে, আমার জীবনহানির চেষ্টার । পরে প্রমাণিত হয়েছিল যে এই একই ভারতীয় ছিল যে আমাকে লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়েছিল!” পৃষ্ঠা 83 [41]। উমা মুখার্জি লিখেছেন — “রাসবিহারী সর্বত্র সরকারের পক্ষে ভাষণ দেবার ফলে উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের পুলিস অফিসারদের নেকনজরে ছিলেন। এদের মধ্যে সুশীল চন্দ্র ঘোষ রাসবিহারীর ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন; সম্ভবত তার কাছে থেকে রাসবিহারীর আত্মীয় পুলিসের সন্দেহভাজন চন্দননগরের বিপ্লবী শ্রীশ চন্দ্র ঘোষের খবর নেওয়ার চেষ্টা করছিল। রাসবিহারী এই পুলিসের সূত্রটিকে নিজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা শুরু করলেন। রাসবিহারী শুধু ব্রিটিশ নয় এমনকি বাঙালি পুলিস অফিসারদেরও ধোঁকা দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে গোপনে বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন — জনৈক বাঙালি পুলিস অফিসার ইন্টেলিজেন্স ব্র্যাঞ্চের একটি সাপ্তাহিক রিপোর্টে রাসবিহারীর সম্বন্ধে লেখেন — ‘দেরাদুনের বাঙালিরা মনে করেন রাসবিহারী একজন পুলিসের গুপ্তচর এবং বিপ্লবীদের খবর সিআইডিকে পাচার করেন। (29 জুলাই 1914)’। বুদ্ধির লড়াইতে রাসবিহারী নিজেকে চ্যাম্পিয়ন প্রমাণ করেছিলেন। দিল্লি-লাহোর বিস্ফোরণ মামলার যিনি বিচারক ছিলেন, তার পর্যবেক্ষণ ছিল — ‘রাসবিহারীকে দেখে আপাত দৃষ্টিতে যত বুদ্ধিমান মনে হয়, বাস্তবে তিনি অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তিনি পুলিসের কাছে যোগাযোগ রেখে নিজের ষড়যন্ত্র এগিয়ে নিয়ে যান।’ তাঁর ভাষণের জন্য ব্রিটিশ পুলিস তাঁকে এতটাই বিশ্বাস করত যে, তাঁকে দেরাদুনের সার্কিট হাউসে যেতে দেওয়া হয়েছিল যখন আহত লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লির বোমা নিক্ষেপ ঘটনার পর দেরাদুনে এসেছিলেন। ” পৃষ্ঠা 110-111 [40]।

রাসবিহারী নিজে আত্মজীবনীতে লিখেছেন তিনি কিভাবে ব্রিটিশ পুলিস ও ইন্টেলিজেন্সকে বোকা বানিয়েছিলেন — “যখন লাহোর জুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হল, আমি বুঝলাম, এখানে থাকাটা আদৌ নিরাপদ না। আমি স্থির করলাম বেনারস অথবা বাংলায় ফিরব। আমার এক পুরোনো বন্ধু বললেন যে, পুলিস নাকি প্রত্যেক ট্রেনে নজর রাখছে, তোমাকে আমরা বিপদের মুখে যেতে দেবনা। আমি বললাম ঐ জন্যই তো আমার পক্ষে লাহৌর ছেড়ে অন্যত্র পালানো সহজ কাজ। আগের মতই ব্রিটিশ পুলিস বাহিনী দিল্লী ও পার্শ্ববর্তী শহরের রেলওয়ে স্টেশনের ওপর নজর রাখছিল। এই কারণে আমি খুব সহজেই তাদের নজর এড়িয়ে দিল্লিতে চলে এলাম। তারা আমার মত দেখতে লোকজনকে বড্ড বেশি করে দেখছিল ও তল্লাশি করছিল; ফলে আমার পক্ষে খুব সহজে পালানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু কেউ যদি অভিজাত ভদ্রলোক সেজে, ঘোড়ার গাড়িতে চেপে আসে, গাড়ির চালককে এক আনার জায়গায় চার আনার বখশিস দেয়, যদি বুকিং অফিসে সোজা গিয়ে নিজের আসন সংরক্ষিত করে, তারপর বেঞ্চিতে বসে ইংরেজি দৈনিক পড়তে থাকে, যতক্ষণ না ট্রেন আসে; সেক্ষেত্রে পুলিসের বাবার পক্ষেও সন্দেহ করা সম্ভব নয়। পুলিস ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের ওপর যতটা নজর রাখছিল, যাত্রীদের ট্রেনে ওঠার সময়ে তত নজর রাখতে পারে নি। আমি বুঝেছিলাম যে, এর চেয়ে ভাল সুযোগ হয় না। আমি বন্ধু ও সাথী একজন মারাঠি যুবক বিনায়ক রাওকে বোঝালাম যে সন্ধ্যাবেলায় আমি লাহোর স্টেশনে পৌঁছেছি। আমি আগে থেকেই শিখদের মত পোশাক পড়ে রেখেছিলাম, সাথে করে গুলিভর্তি মাউজার পিস্তলও ছিল। দুই মিনিটের মধ্যে দিল্লী যাবার ট্রেন এসে গেল। আমি বিনায়ককে বললাম ঘুমাবার ভান করতে, আমি নিজেও তাই করলাম। নিরাপদেই সারারাত ভ্রমণের শেষে আমরা দিল্লী স্টেশনে পৌঁছলাম। আমি বিনায়ককে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে দেখেছিলাম। তার মুখ দেখে বুঝেছিলাম যে, আমি নিরাপদে দিল্লিতে পৌঁছেছি বলে সে খুবই খুশি হয়েছে।” পৃষ্ঠা 1-2 [39] ।

মাইকেল ও’ডায়ার, যিনি 1912 থেকে 1919 পর্যন্ত পাঞ্জাবের রাজ্যপাল ছিলেন, তিনিও দিল্লী চক্রান্ত সম্বন্ধে লিখেছিলেন — “হর দয়াল নামক জনৈক কুখ্যাত পাঞ্জাবী বিপ্লবী, যিনি এর পরে আমেরিকাতে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালনা করেন, তার মতই আরেক বিপজ্জনক ছিলেন একজন বাঙালি — রাসবিহারী বসু। দেরাদুনের সরকারী কর্মচারী প্রধান কেরানি এই বাঙালি ভদ্রলোক বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান চেয়ে চক্রান্ত করছিলেন। তার সাথে যারা ছিলেন, তারা অধিকাংশ কলেজ ছাত্র হলেও কিন্তু বেশ কিছু গন্যমান্য ও পরিণত বয়স্ক লোকেরা তাদের মধ্যে ছিলেন ।” পৃষ্ঠা 169 [29]। লালা হর দয়াল দিল্লিতে জন্মানো শিখ বংশোদ্ভূত বিপ্লবী ছিলেন, তিনিই গদর নামক দলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

রাসবিহারীর ব্যর্থ অভিযানের পর দুটো বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটে, দুটোই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভীত কাঁপিয়ে দেয়। প্রথমটা হল গদর বিপ্লব ও অপরটা হল ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্র (1915)। দুটো ঘটনা এত কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ঘটেছিল যে, দুটো ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র সহজেই পাওয়া যায়। বস্তুত বলতে গেলে বলতে হয় যে — দুটোই আসলে একটাই ঘটনা, শুধু দেশ আর কারণ আলাদা। এই দুই ঘটনাতেই রাসবিহারী বসু নেতৃত্ব দিয়েছিল, তার সাথী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল — শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, গিরিজা বাবু (বাঙালি হিন্দু), বিষ্ণু গণেশ পিংলে (মারাঠি) ও কর্তার সিংহ সরাভা (শিখ)।

লর্ড রাওলাট তার বইতে ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার সম্বন্ধে লিখেছেন — “পাঞ্জাবীদের বিশেষ করে শিখ বিপ্লবীদের প্রতি পিংলে অনুরোধ করেছিল যে, সে একজন বাঙালি হিন্দুকে আনবে; যে দারুণ ভালো বোমা বানাতে পারে। সে এও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, অনেক জায়গা থেকে বোমা বানানোর কাঁচামাল নয়ে আনবে। বেশ কিছু লুধিয়ানা কলেজের ছাত্রদের সহযোগিতায় কাঁচামাল জোগাড়ের কাজ সম্পূর্ণ হলে দিল্লী ষড়যন্ত্রের ‘খলনায়ক’ রাসবিহারী বসুর কাছে চলে এলেন। ঐ সময়ে রাসবিহারী বসু সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বেনারসে বসবাস করছিলেন। তিনি অমৃতসর থাকাকালীন এই বাড়িটা বেনামে কিনেছিলেন, ফেব্রুয়ারি 1915 পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। তিনি শিখ বিপ্লবীদের সাথে কাজ করেছিলেন। লাহোরে বসে একটি গুপ্ত বৈঠকে 21 ফেব্রুয়ারিকে ভারতকে স্বাধীন করার দিন হিসাবে ঘোষণা করেন। অতঃপর রাসবিহারী বসু লাহোর থেকে ভারতের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে যান এবং গোপনে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে ভারতীয় সৈনিকদের কাছ থেকে। তিনি পাঞ্জাবের গ্রামগুলিতে ঘুরে ঘুরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য প্ররোচনা দেওয়া শুরু করেন। অনেক জায়গায় ডাকাতির মাধ্যমে টাকাপয়সা জোগাড়ের ব্যবস্থাও করেন রাসবিহারী বাবু। গোপনে গোপনে বোমা তৈরি হতে থাকে, চোরাপথে বন্দুক ও অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র জোগাড় হতে থাকে, ভারতের পতাকা পর্যন্ত তৈরি হতে থাকে। রাসবিহারী বসু মনে মনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ ঘোষণা করার জন্য প্রস্তুত হন। তিনি বিপ্লবীদের রেলওয়ে লাইন ও টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন তার কেটে দিতে বলেন। তার নির্দেশে পাঞ্জাবী বিপ্লবীরা পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকাতি করতে থাকেন। রাসবিহারী বসু গুপ্তচর মারফত ব্রিটিশদের গতিবিধি সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করতে থাকেন। 19 ফেব্রুয়ারি রাসবিহারীর সদর দপ্তরে পুলিস হানা দেয়। সেখানে থাকা সাত জন অনাবাসী ভারতীয় গ্রেফতার হন, যাদের কাছে পিস্তল, বোমা ও বোমা তৈরির কাঁচামাল পাওয়া যায়। পরের দিন দুজন চক্রান্তকারী ধরা পড়েন। লাহোরের সদর দপ্তর থেকে সব মিলিয়ে মোট 13 জন চক্রান্তকারীকে গ্রেফতার করা হয়। একইসাথে চারটে গোপন ডেরায় তল্লাশি চালানো হয়। চারটে ডেরা থেকে সব মিলিয়ে 12 তাজা বোমা উদ্ধার হয়, যার নির্মাণকৌশলের সাথে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের হাতে বানানো বোমার সাথে অদ্ভুত সাদৃশ্য ছিল। রাসায়নিক পরীক্ষকের রিপোর্ট অনুসারে 10 বোমা কয়েক মাস আগে বানানো হলেও দুটো বোমা সাম্প্রতিক বানানো হয়েছে। বোমার জন্য যেসব কাঁচামাল পাওয়া গিয়েছিল তার সাথেও অতীতে বাঙালি বিপ্লবী সংগঠনের কার্যালয়ে হানা দিয়ে পাওয়া বোমা বানানোর কাচামালের সাদৃশ্য লক্ষণীয় ছিল। সেখানে জাতীয় পতাকাও মিলেছিল। সেখানে প্রাপ্ত নথিপত্র থেকে স্পষ্ট হয়েছিল যে, চক্রান্তকারীরা লাহৌর, ফিরোজপুর ও রাওয়ালপিণ্ডি ইত্যাদি জায়গায় হামলা চালাবার পরিকল্পনা ছিল; সফল হলে তারা পুরো ভারত জুড়ে একই কাণ্ড করত। আমরা লক্ষ্য করেছিলাম যে, বেনারস, জবলপুর থেকে প্রাপ্ত প্রমাণের ভিত্তিতে বলতে পারি, ঢাকা ও কলকাতাতেও একই ধরণের বিদ্রোহ হত; যদি শিখ বিদ্রোহ সফল হত।” পৃষ্ঠা 152-53 [30]।

এবার গদর বিপ্লবের কথায় আসা যাক। গদর বিপ্লবের হোতারা প্রত্যেকেই ছিলেন শিখ এবং তারা আমেরিকা ও কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। তারা গদর নামে একটি গুপ্ত সমিতি গড়েন, যার লক্ষ্য ছিল ভারতকে ব্রিটিশ অধীনতা থেকে মুক্ত করা। গদর বিপ্লবীরা আমেরিকা ও কানাডায় থাকা বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আমেরিকায় থাকা বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের মধ্যে তারকনাথ দাস, খগেন্দ্র চন্দ্র দাস এবং অন্যান্যরা উল্লেখযোগ্য ছিলেন, যারা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ নামে একটি গুপ্ত সমিতি গড়েছিলেন। এই সমিতি শুরুতে দরিদ্র বাঙালি ও শিখদের সব রকম আর্থিক ও সামাজিক সাহায্য করার জন্য তৈরি হলেও শীঘ্রই তা বিপ্লবাত্মক মোড় নেয়। 1907 সালে তারকনাথ দাস আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের সান ফ্রান্সিস্কো শহরে এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকেই গদর বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। এরপর তারকনাথ কানাডায় চলে আসেন এবং সেখানে জাপান থেকে সদ্য আসা সুরেন্দ্রমোহন বসুর সাথে পরিচিত হন। বিপ্লবী সুরেন্দ্রমোহন কানাডায় প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে বিপ্লবী সাহিত্য প্রচারণা শুরু করেন। সেখানে প্রথমে ইন্ডিয়ান আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সমিতি খোলেন, যার উদ্দেশ্য ইন্দিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের ন্যায় ছিল। এরপর আমেরিকা ও কানাডার ভারতীয়দের মধ্যে মিলন ঘটাবার উদ্দেশ্যে তারকনাথ দাস নিউ ইয়র্কে 1909 সালে একটি পাবলিকেশন হাউস গড়ে তোলেন — ফ্রি হিন্দুস্তান।” পৃষ্ঠা 48-53 [34]।

“আমেরিকার ভারমন্ট ও তামালপাইস শহরে পাণ্ডুরং খাঙ্খোজে, তারকনাথ দাস, অধর চন্দ্র লস্কর ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় — এই চারজন মিলে একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও খুলেছিলেন, যেখানে গোপনে বন্দুক চালানো শেখানো হত।” পৃষ্ঠা 55 [34]।

গদর বিপ্লবীরা তাদের উদ্দেশ্য ভারতীয়দের মধ্যে প্রসারিত করার জন্য একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও বের করেছিল যার শিরোনামা ছিল আংরেজি রাজ কা দুশমন। এই দৈনিকের প্রথম সংখ্যায় তারা একটি বিচিত্র বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সবার কাছে পরিষ্কার করেছিল [31]।

“লক্ষ্য : একদল সাহসী সৈনিক, যারা ভারতে বিদ্রোহ করবে।”

“বেতন : মৃত্যু।”

“মূল্য : বীরগতি।” “পেনশন : স্বাধীনতা।”

“যুদ্ধক্ষেত্র : ভারতবর্ষ।”

গদর বিদ্রোহের ‘মুখ’ হিসাবে যাকে ভাবা হয় সেই কর্তার সিংহ সরাভা, যিনি শচীন্দ্রনাথ সান্যাল ও রাসবিহারী বসুর সহযোগী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কর্তার সিংহ সরাভা পাঞ্জাবের লুধিয়ানার কাছে সরাভা গ্রামে জন্মেছিলেন। তিনি বাল্যকাল উড়িষ্যায় কাতিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করে আমেরিকায় চলেন যান। সেখানে ক্যালিফোর্নিয়ার কাছে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। বার্কলেতেই তিনি লালা হরদয়ালের দ্বারা প্রভাবিত হন ও বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েন। ডিসেম্বর 1912 সালে তিনি গদর সমিতিতে যুক্ত হন। তিনি একটি লিথো প্রেস তৈরি করে গদর নামে একটি দৈনিক বের করেন — পৃষ্ঠা 55-56 [5]। গদর বিদ্রোহীদের সাহস ও আত্মনিয়োজনের প্রশংসা করে একজন বিচারপতি লিখেছেন — “উক্ত 61 অভিযুক্তের মধ্যে সবচাইতে পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন এই কর্তার সিংহ সরাভা। তিনি হয়ত আমেরিকায় বসে কিংবা ভারতগামী জাহাজে বসে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করে থাকতে পারেন, কিন্তু এমন কোনও জায়গা নেই; যেখানে তার সাংগঠনিক দক্ষতা দেখান নি।” পৃষ্ঠা 64 [5]। অন্যান্য গদর বিপ্লবীদের মধ্যে নিম্নোক্ত নামগুলি স্মরণীয়, যারা দেশের জন্য লড়াই করেছিলেন — নিধন সিংহ, বিষেণ সিংহ, জগত সিংহ, সুরন সিংহ ও হরনাম সিংহ।

1915 সালে শেষ পর্যন্ত উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলার হলদিঘাটি অঞ্চলে যতীন্দ্রনাথ মুখার্জি, যিনি সবার কাছে বাঘা যতীন নামেই পরিচিত; তিনি যুগান্তর দলের একাধিক সদস্য নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সেখানে প্রাণপণ যুদ্ধ করেও বাঘা যতীন সফল হন নি এবং মৃত্যুবরণ করেন। তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন চার্লস টেগার্ট। হলদিঘাটির স্মরণীয় যুদ্ধে বাঘা যতীনের সহযোগী ছিলেন চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী, জ্যোতিষ, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ইত্যাদি। গুলিবিদ্ধ বাঘা যতীন ও চিত্তপ্রিয় হাসপাতালে ভর্তি হন এবং পরের দিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মারাত্মক আহত মনোরঞ্জন ও নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ফুরিয়ে যাওয়ায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। জ্যোতিষ মারাত্মক ভাবে আহত হন। নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, জ্যোতিষ ও মনোরঞ্জনকে বিচারের নামে প্রহসন করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। চার্লস টেগার্ট 1901 সালে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে ইন্ডিয়ান পুলিস সার্ভিসে জয়েন করেন। তিনি প্রায় 30 বছর ধরে পুলিসে কর্মরত ছিলেন। ডিসেম্বর 1931 সালে টেগার্ট পুলিসের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে সেক্রেটারি অফ স্টেট কাউন্সিলে যোগদান করেন। 1923 থেকে 1931 সাল পর্যন্ত টেগার্ট অবিভক্ত বাংলার পুলিস কমিশনার ছিলেন।

এবার একটু দক্ষিণ ভারতের দিকে নজর দেওয়া যাক। যে সময়ে রাসবিহারী বসু ও তার সহযোগীরা লর্ড হার্ডিঞ্জকে গুপ্তহত্যার ছক কষছিলেন, সে সময়ে দক্ষিণ ভারতে একটি নতুন সমিতি গঠিত হয়েছিল — ভারত মাতা। ‘ভারত মাতার’ কোষাধ্যক্ষ বাঞ্চিনাথন ও আরও 3000 ভারত মাতার সদস্য একসাথে শপথ নিয়েছিলেন যে, তারা পঞ্চম জর্জকে মাদ্রাজে পা রাখা মাত্রই হত্যা করবেন — পৃষ্ঠা 205 [13]। এই দলের দুই সদস্য ভি. ও. চিদাম্বরম পিল্লৈ ও সুব্রহ্মণ্যম শিবের নেতৃত্বে ব্রিটিশদের মালিকানাধীন প্রবাল কারখানাতে ধর্মঘট ডাকে। এতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ক্ষুব্ধ হয় ও দুজনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করে কারারুদ্ধ করে। এতে থুক্ককোড়ী ও থিরুনেলভেলি জেলায় দাঙ্গা হয়। এই দাঙ্গাকে দমন করতে ব্রিটিশরা নৃশংস পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। যার নেতৃত্বে এই দমনপীড়নের কাজ চলছিল সেই জেলাশাসক অ্যাশেকে শাস্তি দিয়ে প্রতিশোধ নেন বাঞ্চিনাথন স্বয়ং।

অন্যান্য তামিল বিপ্লবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভিভিএস আইয়ার, যিনি সাভারকারের সহযোগী ছিলেন। 1908 সালে ইন্ডিয়া হাউসে বসে অভিনব ভারত নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। আইয়ারের সাথে আরও দুজন লন্ডনে গিয়ে সাভারকারের সাথে যোগ দেন — টিএস রাজ্যম ও তিরুমল আচারিয়া। আইয়ার পশ্চিম ভারতের বৃহত্তম বিপ্লবী সংগঠন অভিনব ভারতের উপসভাপতির পদে আসীন হয়েছিলেন, ইনি আবার বাঞ্চিনাথনের গুরুও ছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর ভিভিএস আইয়ারের রহস্যময় মৃত্যু ছিল সাভারকারের কাছে বিরাট বড় ধাক্কা — পৃষ্ঠা 63 [33]। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নামক গ্রন্থে সাভারকার তার সংগঠনের পরিচয় সম্বন্ধে কিছুই লেখেন নি বটে, কিন্তু আইয়ারের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্বন্ধে লিখেছিলেন — “আইয়ারের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু একজন হিন্দু ভদ্রলোক হিসাবে, একজন পণ্ডিত হিসাবে, একজন বন্ধু হিসাবে আইয়ারের মৃত্যু আমাদের কাছে বড় ধাক্কা। কুড়ালের লেখক আইয়ারের মৃত্যু আসলে দেশের জন্য জীবন দান স্বরূপ। দুঃখের বিষয় তার মৃত্যু সম্বন্ধে জনতা সম্যক থাকলেও ব্রিটিশদের ভয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন নি। এইভাবে আমাদের একটি অসাধারণ প্রজন্মের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ঝরে গেল!” পৃষ্ঠা 63 [33]।

এটা জানলে অবাক লাগবে, মাদ্রাজ প্রদেশের বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের প্রভাব ছিল খুবই বেশি [35]। “মাদ্রাজ প্রদেশে জাতীয়তাবাদী প্রভাব ছিল বেশ ভালই। বিপিন চন্দ্র পাল মার্চ 1907 সালে মাদ্রাজ প্রদেশে গিয়ে জাতীয়তাবাদী লেকচার দিতে গিয়েছিলেন। মাদ্রাজ শহরে পালের লেকচারের আয়োজন করেছিলেন সুব্রহ্মণ্যম ভারতী। মাদ্রাজের একটি বিপ্লবী সংগঠন বাল ভারত সঙ্গম ভারতীকেই বেছে নিয়েছিল বিপিন চন্দ্র পালের সঙ্গে দেখা করে দুটি লেকচার আয়োজন করার জন্য। কথা ছিল বিপিন চন্দ্র পাল রাজামুন্দ্রি ও মাদ্রাজে ভাষণ দেবেন। সেইমত সুব্রহ্মণ্যম ভারতী বিপিন চন্দ্র পালকে মাদ্রাজের থিলাগার কাত্তাম সমুদ্রসৈকতে একটি জনসভায় ভাষণ দিতে অনুরোধ জানান। কথা ছিল উক্ত জনসভা পাঁচদিন ধরে চলবে এবং শেষ দুদিন পাল ভাষণ দেবেন। ভাষণের বিসয়বস্তু ছিল মুখ্যত দুটি — অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলন।” 1 মে 1907 সালে বিপিন চন্দ্র পাল মাদ্রাজে এসে প্রায় 30,000 লোকের সামনে ভাষণ দেন। বিপিন চন্দ্র পাল ভাষণ শেষে প্রচুর হাততালি পেয়েছিলেন। যারা পালের ভাষণ শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন, তাদের বেশিরভাগ ছিল তামিলভাষী, সামান্য কিছু বাঙালি ও অন্যান্য দক্ষিণ ভারতীয় জনজাতি। এরা প্রত্যেকেই ছিল মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। বিপিন চন্দ্র পালের উত্তেজক ভাষণ শুনে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীগণ এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে, তারা গ্রাজুয়েট হবার পর যে কালো টুপি পড়তে হয়, তা মাটিতে ফেলে পুড়িয়ে ফেলে ফেলে! — পৃষ্ঠা 215-16 [35]। বাল ভারত সঙ্গম বিপিন চন্দ্রের ভাষণকে রেকর্ড করে রেখেছিল এবং আরও বিপ্লবী নিযুক্ত করতে এই রেকর্ড ব্যবহার করত — “বিপিন চন্দ্র পালের আবেগপূর্ণ ভাষণ নীলকান্ত ব্রহ্মচারীর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল।” পৃষ্ঠা 217 [35]। নীলকান্ত ব্রহ্মচারী অতঃপর দক্ষিণ ভারতে বিপ্লবী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। “বিপিন চন্দ্র পাল তার সেক্রেটারি কুঞ্জ ব্যানার্জিকে নির্দেশ দেন — ‘নীলকান্তকে বলো, সে যেন যত বেশি সম্ভব দক্ষিণ ভারত জুড়ে বিপ্লবীদের নিযুক্তি শুরু করে। এটাই ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য আদর্শ সময়।’ কুঞ্জ সেইমত নীলকান্তের সাথে দেখা করেন। নীলকান্ত তাকে জানান যে, তিনি এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানতে তৈরি আছেন। কুঞ্জ তার আগ্রহ দেখে গোপনে বিপিন চন্দ্র পালের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।” পৃষ্ঠা 218 [35]।

যখন দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ বিপ্লবী ভি.ও. চিদাম্বরম পিল্লৈ নীলকান্ত ব্রহ্মচারীর সাথে দেখা করেন, তখন নীলকান্ত ব্রহ্মচারী চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তীকে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের সাথে মাদ্রাজি বিপ্লবীদের সাথে সংযোগ রক্ষার কাজ করত এবং এই কাজে তার প্রসিদ্ধি ছিল — পৃষ্ঠা 218 [35]। চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তীর ঐকান্তিক প্রচেস্তায় দক্ষিণ ভারতে একের পর এক বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এখানে চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তীর তরফে নীলকান্ত ব্রহ্মচারীকে দেওয়া একটি উপদেশের কথা বলা যেতে পারে — “আমি তোমাকে বিপ্লবী সংগঠনের জন্য একটি সাধারণ নিয়মের কথা বলছি, মেনে চলবে। সেটা হল — সংগঠনের প্রধান অবশ্যই নিয়মিত দেশ জুড়ে ঘুরবে এবং জনসভার আয়োজন করবে। যেখানে বৈঠক বসবে, সেখানে শুধুমাত্র সমসাময়িক রাজনীতির প্রসঙ্গ আসবে, যেমনটা কংগ্রেস নেতারা করে থাকে। সমিতির নেতারা যেন বৈঠক আয়োজন করার সময়ে অত্যন্ত সাবধান থাকেন, এবং শুধুমাত্র সাহসী যুবকযুবতীদের নির্বাচিত করবে বৈঠক চালাবার জন্য। আর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছাড়া আর কাউকেই যেন সমিতির গোপন তথ্য জানানো না হয়। সমিতির ইনার সার্কেলের সদস্যরা যেন দলের নেতা ছাড়া বাকি ইনার সদস্যদের কাউকে না চেনে তার ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। গোপনীয়তাই বিপ্লবের সাফল্যের মূলমন্ত্র। দলের যাবতীয় তথ্য ও অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থা যেন স্বচ্ছ ও অবিতর্কিত থাকে এবং নেতা ছাড়া দুই চারজনের বেশি না জানে তার ব্যবস্থা আবশ্যক। বিপ্লবী সংগঠনের গোপনীয়তা বজায় রাখতে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা মা কালীর মূর্তির সামনে শপথ নেবে এবং শপথ গ্রহণের পর নিজের বুড়ো আঙ্গুল কেটে রক্ত দিয়ে স্বাক্ষর করবে। দলের সদস্যদের অবশ্যই শপথ নিতে হবে যে, দেশের জন্য দরকারে প্রাণ দিতে পারেন। দল যাকে যে কাজ করতে বলবে, তা বিনা দ্বিধায় করতেই হবে দেশের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিতে। দরকারে অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে হবে, কিন্তু তথ্য ফাঁস করা চলবে না। সম্ভব হলে একমাত্র দলের নেতা ছাড়া যাতে এক সদস্য অন্য সদস্যকে চেনে না, নাম জানে না; তার ব্যবস্থা করতে হবে। দলের সদস্যরা যখন চিঠি লিখবে, যতটা সম্ভব সাঙ্কেতিক বাক্যে লিখবে, যাতে চিঠি ফাঁস হলেও গোয়েন্দারা ধরতে না পারে, আসল কথাটা হচ্ছে — সবকিছুই গুপ্ত রাখতে হবে, সদস্যদের আসল নামেও ডাকা চলবে না। এবং সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কলকাতার বিপ্লবীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।” পৃষ্ঠা 220 [35]।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মা শ্মশানকালীর সামনে শপথ নেওয়ার ব্যাপারটা বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীরা চালু করেছিল। মুখ্যত শাক্ত পরিবারের সন্তানরা বিপ্লবী হত বলে স্বাভাবিক ভাবেই তারা মা কালীর উপাসনা করত এবং তার কাছে শপথ নিত। 1 নভেম্বর 1932 সালে কলকাতা পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট তার বিদায়ী ভাষণে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন — “অরবিন্দের ভাই বারীন্দ্র ঘোষ কিছু টাকা সংগ্রহ করা পর 1905 সালে ভবানী মন্দিরের কাছেই একটি প্রেসে একটি ইস্তেহার ছাপিয়েছিল, যার শিরোনামা ছিল ‘ভবানী মন্দির’। ভবানী হচ্ছে মা কালীর একটি অবতারের নাম। হিন্দু পুরাণ অনুসারে ভবানী হচ্ছে ধ্বংসের প্রতীক। হিন্দু পুরাণে বলা হয়েছে যে; দেবতাদের দ্বারা ভবানীর সৃষ্টি হয়েছিল, যে পুরুষের দ্বারা অবধ্য দৈত্যের ধ্বংস করতে পারবে। বারীন্দ্র ভবানীকে বেছে নিয়েছিল এই জন্য যে, ভবানী রূপেই কালী সবচেয়ে বীভৎস ছিল; দুই হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ত। বারীন্দ্র সবাইকে শিখিয়েছিল যে, ভবানীর মত নিষ্ঠুর নির্মম হতে হবে। বারীন্দ্রের কাছে এখানে দৈত্যের জায়গায় ফিরিঙ্গী (শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়) ছিল প্রধান প্রতিপক্ষ।” পৃষ্ঠা 8 [2] । টেগার্ট এই লেকচার দিয়েছিলেন প্রাক্তন বাংলার রাজ্যপাল স্ট্যানলি জ্যাকসনের উপস্থিতিতে [46]। একই লেকচারে টেগার্ট অনুশীলন সমিতির বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন — “অনুশীলন সমিতিতে যারা ভর্তি হতেন, তাদের মা কালীর কাছে চারটে বিষয় শপথ নিতে হত। প্রথমত : দেশের জন্য প্রাণ দিতে পিছিয়ে এলে হবে না। দ্বিতীয় : পরিবারের সাথে সব রকম সম্পর্ক কাটাতে হবে, মাতাও ত্যাগ করতে হবে। তৃতীয়ত : নেতৃত্বের তরফে আসা প্রত্যেক আদেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মানতে হবে। চতুর্থত : ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ে গেলে হাজার যন্ত্রণা সত্ত্বেও দলের গোপন তথ্য ফাঁস করা যাবে না, যে ভয়ে বা অর্থলোভে তথ্য ফাঁস করবে, তাকে হত্যা করতে হবে যেনতেন প্রকারেণ।” পৃষ্ঠা 9 [2]।

ডেলি তার নোটে ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে রূপান্তরিত হচ্ছিল — “একজন বাঙালি অফিসারের মুখে শুনেছিলাম 28 সেপ্টেম্বর 1905 সালে মহালয়া উপলক্ষ্যে প্রায় 50000 বাঙালি হিন্দু যুবক কালীঘাট মন্দিরে মা কালীর কাছে শপথ নিচ্ছিল যে, তারা আর কোনওদিনও বিদেশী জিনিস কিনবে না, বিদেশী মালিকানাধীন অফিসে চাকরি করবে না, ভারত বিরোধী স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়বে, ইত্যাদি। ” পৃষ্ঠা 458-59 [15]। ইতিহাসবিদ আভাস চট্টোপাধ্যায় মোটামুটি একই কথা বলেছেন — “যখন বাংলা 1905 সেপ্টেম্বরে দ্বিধাবিভক্ত হল, তার কয়েকদিন বাদে মহালয়া উপলক্ষ্যে প্রায় 50000 মানুষ কালীঘাট মন্দিরে এসে গঙ্গায় স্নান করে কপালে তিলক কেটে বাঁহাতে ভাগবৎগীতা নিয়ে শপথ নেন তারা কোনওদিনও বিদেশী জিনিস কিনবে না, বিদেশী মালিকানাধীন অফিসে চাকরি করবে না।” পৃষ্ঠা 9-10 [38]।

নীলকান্ত ব্রহ্মচারী ছাড়াও শ্রীরামালু রাজু নামে একজন তেলুগুভাষী বিপ্লবী দক্ষিণ ভারতে পরিচিত ছিলেন; যিনি বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। অনন্ত সিংহ তার সম্বন্ধে লিখেছেন — “শ্রীরামালু রাজু 1920 সালে নেপালে গিয়ে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের সাথে দেখা করেন এবং সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের জন্য শেরপা জোগাড়ের কাজ করতেন এবং সেই ফাঁকে শেরপাদের প্ররোচিত করে শুধুমাত্র ব্রিটিশদের বয়কট করতে। তিনি ব্রিটিশ পর্বতারোহীদের কাছ থেকে বন্দুক ছিনতাই করে জঙ্গলে গা ঢাকা দেন। কয়েক মাস পর ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তেলেঙ্গানায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। প্রায় তিন বছর বাদে 1924 সালে বিশাখাপত্তনমের পার্বত্য অঞ্চলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইতে মারা যান।” পৃষ্ঠা 234 [51]।

তৃতীয় ও চতুর্থ দশক জুড়ে বাংলা সহ পুরো ভারত জুড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চলেছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সশস্ত্র সংগ্রাম চলেছিল বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের দ্বারা। কিভাবে ব্রিটিশরা বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের ধরে ফেলেছিল, তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল কিংবা সেলুলার জেলে পাঠাত; তার তালিকা পরবর্তী পরিচ্ছেদে দেওয়া হবে। আপাতত এই পরিচ্ছেদে কিভাবে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীরা দেশ জুড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল সেটা ব্যাখা করা হবে।

এরকমই একজন বাঙালি হিন্দু বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ স্যানাল, যিনি বেনারসের বাসিন্দা ছিলেন; তিনিই হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারী আর্মি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি হিন্দুস্তান রিভোলিউশনারী আর্মির ইস্তেহারের লেখক ছিলেন। 31 ডিসেম্বর 1924 সালে ইস্তেহারটা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নানান কারণে উত্তর ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু হয় এই হিন্দুস্তান রিভোলিউশনারী আর্মি ও অনুশীলন সমিতির হাত ধরে, যার নেতা ছিলেন যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী। অনুশীলন সমিতির প্রধান যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী এ সম্বন্ধে লিখেছেন — “বাংলায় বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপ নতুন কিছু নয়; বিপ্লবী সংগঠনের ইতিহাসও বেশ পুরানো। এবং বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের বিপ্লবী কার্যকলাপের পরিধি শুধু বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না — প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিল শচীন্দ্রনাথ সান্যাল।” পৃষ্ঠা 533-34 [11]। বাংলায় বিপ্লবী সংগঠন এত শক্তিশালী ছিল যে, চট্টগ্রামের অমর বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের পক্ষে সফল ভাবে গেরিলা যুদ্ধ 3 বছর চালানো কিছু কঠিন হয় নি। ইংরেজরা সেজন্য তার মাথার ওপর 10,000 টাকা দাম রেখেছিল। আজকের দিনের তার দাম প্রায় এক কোটির কাছাকাছি হবে। সূর্য সেনের উত্তরসূরি বিনোদ বিহারী দত্ত সাফল্যের সাথে 11 বছর লুকিয়ে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিনোদ বিহারী দত্ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জালালাবাদ অঞ্চলে ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছিলেন। যখন সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদার জেলে ছিলেন, তিনি চট্টগ্রামেই অবস্থিত একটি ক্রিকেট ক্লাবে আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজন ইউরোপীয়কে খতম করতে সক্ষম হয়েছিলেন — পৃষ্ঠা 387, 415 [15]। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স অফিসার জন হান্ট, যিনি বিনোদ বিহারী দত্তকে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন; তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন — “একজন সন্ত্রাসবাদী নেতা বিনোদ বিহারী দত্ত, আমরা তাকে ধরতে যতই ব্যর্থ হচ্ছিলাম; তিনি ধীরে ধীরে একজন কিংবদন্তী নেতায় রূপান্তরিত হচ্ছিলেন তাঁর সমর্থকদের কাছে…

তাঁর সম্বন্ধে প্রায় কিছু জানা না থাকায় আমাদের পক্ষে তার হালহদিশ জানা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। এর ফলে তাঁর সম্বন্ধে নানা রকমের গুজব তৈরি হচ্ছিল ভারতীয়দের মধ্যে; যার সত্যমিথ্যা নিরূপণ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। আমি মনে করতে পারি তাঁকে ধরতে গিয়ে যেসব অভিযান চালিয়েছিলাম সে কাহিনীগুলির কথা। একটি ভোররাতে একদল গোর্খা সৈনিক একটি গ্রামের দিকে নিঃশব্দে অগ্রসর হচ্ছিল। আমরা চারদিক দিয়ে গ্রামটা ঘিরে ফেলেছিলাম। আমরা যখন চারদিক থেকে মোটামুটি ঘিরে ফেলেছি — একটাও মাছি গলবার জায়গা নেই, তখন আলো ফুটতে শুরু করেছে। এমন সময়ে অনেক গুলো কুকুর চিৎকার করতে শুরু করেছে; গ্রামবাসীরা আমাদের দিকে তেড়ে আসছে। আমরা আগেই জেনেছিলাম ঐ গ্রামেই আমাদের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান’ বিনোদ বিহারী দত্ত লুকিয়ে আছেন। কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল ছিল, আমরা যখন গুলি চালাতে শুরু করলাম, তখন কুকুরের চিৎকার আরও বেড়ে গেল। সাথে মেয়েদের কান্নাকাটি। যখন আমরা ‘লক্ষ্যে’ পৌঁছলাম, তখন দেখি পাখি উড়ে গেছে। বুঝলাম গ্রামবাসীরা বিপ্লবীদের সমর্থন করে।” পৃষ্ঠা 21-22 [43]।

1 নভেম্বর 1932 সালের ভাষণে চার্লস টেগার্ট বাখ্যা করেন কিভাবে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীরা উত্তর প্রদেশে বিপ্লবী সংগঠন স্থাপন করেছে এবং সংগঠন ছড়িয়েছে। হিন্দুস্তান রিভোলিউশনারী আর্মির সম্বন্ধে তিনি বলেছেন — “আমার কার্যকালে বাংলায় বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপ অনেকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমি এখানে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি কিভাবে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীরা ভারতের সর্বত্র তাদের কার্যকলাপ ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছিল। 1912 সালে পাঞ্জাবের রাজ্যপাল হার্ডিঞ্জের ওপর আক্রমণ ও দিল্লির আইনসভায় বিস্ফোরণকাণ্ড দেখে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা চক্রান্তের জাল কোথায় বোনা হচ্ছে সেটা খুঁজতে গিয়ে বুঝেছিলাম যে, তাতে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের হাত আছে। দিল্লিতে জানুয়ারি 1912 সালে একটি গুপ্ত কার্যালয় খোলা
হয়, যেখানে হার্ডিঞ্জের ওপর হামলার চক্রান্ত রচিত হয়েছিল। এই আক্রমণে হার্ডিঞ্জ গুরুতর জখম হলেও তার ব্যক্তিগত সহকারী নিহত হন। আমরা হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও 1914 সালের আগে কারা এই ঘটনায় জড়িত ছিল তা জানতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। বাংলার পুলিস অবশেষে 1914 সালের মাঝামাঝি সময়ে জানিয়ে দেয় এই গুপ্তহত্যার পেছনে তাঁর মাথা কাজ করছে। বেনারসে হিন্দুস্তান রিভোলিউশনারী আর্মির সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত ছিল। এই দলের অধিকাংশ সদস্য ছিল বাঙালি হিন্দু এবং তারা বাংলার বদলে উত্তর প্রদেশে সন্ত্রাস ছড়াবার কাজে ব্যস্ত হয়েছিল। উত্তর ভারতে যেহেতু অতীতে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলা হয় নি, তাই সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অসম্ভব ঢিলেঢালা ছিল। তবে বাংলায় বিপ্লবীরা যতখানি জনসমর্থন ও চেনাপরিবেশের সুবিধা পেয়ে মারাত্মক হয়ে উঠেছিল; উত্তর ভারতে ততখানি বিপজ্জনক হবার সুযোগ পায় নি। পরের দিকে উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবে বাঙালি বিপ্লবীরা অনেকগুলো সহকর্মী পাওয়ায় তারা বাংলায় যেমন ভয়াবহ ছিল, এখানেও তেমনই ভয়াবহ হয়ে ওঠে। 1915 সালের মধ্যে উত্তর ভারতে সব মিলিয়ে 21টি গুপ্ত ডেরা গজিয়ে ওঠে, যেখানে হাতেকলমে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য জিনিস শেখানো হত। স্থানীয় বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যদের বলা হয়েছিল কংগ্রেসে যোগ দিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে বিপ্লবাত্মক চিন্তাধারা অনুপ্রবেশ করাতে। কিন্তু এই পরিকল্পনা তেমন সাফল্য পায় নি। উদাহরণ স্বরূপ এলাহাবাদে (প্রয়াগরাজ) দু সপ্তাহ আগে একটি না ফাটা বোমা পাওয়া গিয়েছিল। সেটা দিয়েই পুলিস থানায় বিস্ফোরণ করার চক্রান্ত করেছিল আর এই সপ্তাহে আজমগড় ও লখনৌতে দুটি থানায় বিস্ফোরণ ঘটালে সব মিলিয়ে দশ পুলিস অফিসার এবং 7 জন সাধারণ মানুষ নিহত হন।” পৃষ্ঠা 19 [2]।

এখানে লক্ষ্য করুন — বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীরা বাংলায় ঠিক যে লক্ষ্যে কাজ করত, উত্তর ভারতেও ঠিক একই লক্ষ্যে কাজ করত। তারা বাংলায় একইভাবে কংগ্রেসে বিপ্লবাত্মক চিন্তাধারা অনুপ্রবেশ করাবার জন্য সদস্যদের কাছে অনুরোধ রেখেছিল, যেমনটা উত্তর ভারতে করেছিল। তারা বাংলা কংগ্রেসে ঢুকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব ঢোকাতে, বিপ্লবীদের প্রতি মানুষের সহানুভুতি অনুপ্রবেশ করাতে সচেষ্ট হয়েছিল। তারা এই কাজে এতটাই সফল হয়েছিল যে, বাংলা কংগ্রেস একজন বিপ্লবী — গোপীনাথ সাহার মৃত্যুদণ্ডাদেশের সমালোচনা করেছিল, যিনি 1924 সালে একজন ব্রিটিশ পুলিশকে গুলি মেরে হত্যা করেছিলেন। 1930 সালে যখন ভারত জুড়ে তৃতীয়বার সন্ত্রাসবাদী হামলার জোয়ার শুরু হয়, তখন বাংলায় এমন কোনও জেলা ছিল না, যেখানে গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সদস্যরা কংগ্রেসের নিচুস্তরের নেতার পদ পান নি। জনৈক বিপ্লবীর একটা খসড়া চিঠি আমরা পেয়েছি, যাতে দাবি করা হয়েছে বাংলা কংগ্রেসের 90% সদস্যই নাকি কোনও না কোনও বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত আছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কলকাতা কর্পোরেশন যেদিন থেকে অশ্বেতাঙ্গদের দখলে চলে গেল, সেদিন থেকে কাকতালীয় ভাবে বাংলায় ‘সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মও’ চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। — পৃষ্ঠা 16 [2]।

সেই জন্যই এই ঘটনা মোটেই কাকতালীয় নয় যে, পাঞ্জাবের কাকোরি ট্রেন ডাকাতির মামলার অভিযুক্তরা অনেকেই ছিল বাঙালি হিন্দু। 1) যে চারজনের ফাঁসি হয় তাদের মধ্যে একজন বাঙালি হিন্দু (রাজেন্দ্র নাথ লাহিড়ী), 2) যে দুজনকে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়,তাদের মধ্যে দুজনই বাঙালি হিন্দু 3) শুধু একজনকে 14 বছর কারাবাসের রায় দেওয়া হয়েছিল, তিনি বাঙালি হিন্দু 4) যে পাঁচজনকে 10 বছর কারাবাসের রায় দেওয়া হয়েছিল,তাদের মধ্যে দুজন বাঙালি হিন্দু 5) যে দুজনকে 7 বছর কারাবাসের রায় দেওয়া হয়েছিল,তাদের মধ্যে একজন বাঙালি হিন্দু 6) যে দুজনকে 5 বছর কারাবাসের রায় দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন বাঙালি হিন্দু 7) শুধু একজনকে 4 বছর কারাবাসের রায় দেওয়া হয়েছিল, তিনি বাঙালি হিন্দু ।

উপরোক্ত বিপ্লবীদের মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় নাম নিঃসন্দেহে শহীদ ভগত সিংহ। কাকোরি ট্রেন ডাকাতির মামলার অভিযুক্তদের আত্মসম্মান ও সাহসের নমুনা দেখে যুগপৎ ভারতীয় ও ইউরোপীয় বিচারক ও পুলিস তাদের প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ ডিসেম্বর 1928 সালে লালা লাজপত রাইয়ের হত্যাকাণ্ডের মূল খলনায়ক সন্ডার্সের হত্যাকারী ভগত সিংহের তারিফ করে জহরলাল নেহেরু লেখেন — “ভগত সিংহ তার সন্ত্রাসবাদের জন্য মোটেই জনপ্রিয় হন নি, তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন এই জন্য যে লালা লাজপত রাইয়ের সন্মান রক্ষা করেছিলেন, আর তাঁর মাধ্যমে ভারতের । ভগত সিংহ এভাবেই একটি প্রতীক হয়ে উঠেছেন, তার সন্ত্রাসবাদী কাজটা ভুলে তার বীরত্বটাই সবার চোখে পড়েছে। তার নামটা এই মুহূর্তে পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে বীরত্বের প্রতীক হিসাবে। তার নামে সর্বত্র জয়গান গাওয়া হচ্ছে এবং তার জনপ্রিয়তা দিনকেদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে অবিশ্বাস্য হারে!” পৃষ্ঠা 24 [32]।

8 এপ্রিল 1929 সালে ভগত সিংহ যখন দিল্লির আইনসভায় বোমা ছুঁড়তে গিয়ে গ্রেফতার হন, তার সাথে বটুকেশ্বর দত্তও গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছিলেন। বটুকেশ্বর ছিলেন বাঙালি, বাংলার বর্ধমান জেলায় জন্মেছিলেন। দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় যে 15 জন অভিযুক্ত ছিল, তার মধ্যে 3 জন ছিল বাঙালি হিন্দু — পৃষ্ঠা 182-185 [49]। লাহোর জেলে বিচারাধীন বন্দীদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের অমানবিক ব্যবহারের প্রতিবাদ জানিয়ে একজন বাঙালি হিন্দু বিপ্লবী যতীন দাস ভগত সিংহ ও বটুকেশ্বর দত্তের সাথে যৌথভাবে আমরণ অনশন শুরু করেন। 63 দিন অনশনে থাকার পর 13 সেপ্টেম্বর 1929 সালে যতীন দাস মারা যান। ভগত সিংহ যে বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য ছিলেন সেই হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম বাঙালি সদস্য অজয় ঘোষ জানিয়েছিলেন, — “যতীন দাসকে কলকাতা থেকে এখানে আনা হয়েছিল কারণ যতীন দাসের মত ভালো বোমা বানাতে ভারতে কেউ পারত না।” পৃষ্ঠা 209 [3]।

দ্বিতীয় লাহোর মামলা চলার সময়ে অনেক বিপ্লবী লাহোর জেল থেকে যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ভাগিয়ে আনার চক্রান্তে অভিযুক্ত হয়েছিলেন — পৃষ্ঠা 131 [49]। এ থেকে বোঝা যায় হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন গঠনের পেছনে যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ছিল। আশা করি মনে আছে যে, আমি আগেই জানিয়েছিলাম সান্যাল ও চট্টোপাধ্যায় উত্তর ভারতে একাধিক বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে। এটা সত্যিই বিস্ময়কর যে, 1930 দশকে কেরালায় একাধিক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পেছনে বাঙালি হিন্দুর হাত ছিল। 1930 সালে ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ, যিনি ঐ সময়ে কমিউনিস্ট ছিলেন না; তিনি ছিলেন কিরণ চন্দ্র দাসের শিষ্য। কিরণ চন্দ্র রায় সম্পর্কে ছিলেন যতীন দাসের ছোট ভাই। এবং তিনিও দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত। এছাড়া আচার্য সেনগুপ্ত নামে আরেক বাঙালি হিন্দু বিপ্লবী নাম্বুদিরিপাদকে প্রভাবিত করেছিলেন — পৃষ্ঠা 68-69 [48]।

এখানে বলে রাখা দরকার ভারত জুড়ে যে কৃষক ও আদিবাসী বিদ্রোহ হচ্ছিল, তাতে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের কোনও ভূমিকাই ছিল না। যেমন কুকা বিদ্রোহ (পাঞ্জাব), আল্লুরি সীতারাম রাজুর নেতৃত্বাধীন তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ ও বাবা রাম চন্দ্রের নেতৃত্বাধীন অযোধ্যা কৃষক বিদ্রোহ। উপরোক্ত তিন বিদ্রোহের প্রভাব ছোট জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সমর্থন তেমন ছিল না। কিন্তু বাংলায় যখন নীল বিদ্রোহ (1859-61) হয়েছিল, তখন সেটা বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দারুণ সমর্থন পেয়েছিল এবং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ছড়িয়ে পড়েছিল। দীনবন্ধু মিত্র নীল-দর্পণ নাটক লিখে মানুষের মনে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। এই নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসুদন দত্ত এবং রেভারেন্ড জেমস লং তা প্রকাশন করেছিলেন। জেমস লঙকে এই জন্য 1000 টাকা জরিমানা শাস্তি হয়েছিল। সে সময়ে বিখ্যাত সাহিত্যিক ও জমিদার কালীপ্রসন্ন সিংহ 1000 টাকা জমা দিয়ে লংকে ছাড়িয়ে আনেন। কলকাতায় নীল-দর্পণ নাটক ন্যাশনাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়। হরিশ্চন্দ্র মুখার্জি তার সংবাদপত্র হিন্দু প্যাট্রিয়টে নীল কৃষকদের যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করেছিলেন।

পরিচ্ছেদ 4 : মুক্তি সংগ্রামের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি

এবার আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া বাঙালি হিন্দুদের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য পেশ করব। শ্রীকৃষ্ণন সরল নামে একজন গবেষক পাঁচ খণ্ডে বিপ্লবীদের ওপর একটি বই লিখেছেন [48-52]। উক্ত বইয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে 1757 থেকে 1910 সালের মধ্যে বীরগতিপ্রাপ্ত হওয়া 132 জনের মধ্যে 23 জনই বাঙালি হিন্দু [4]। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকা ও কানাডায় গদর ও অন্যান্য বিপ্লবী দলের মোট 183 সদস্যদের মধ্যে 44 জনই ছিল বাঙালি হিন্দু [5]। 1920 থেকে 1930 সালের মধ্যে ধৃত 85 বিপ্লবীদের মধ্যে 5 ছিল বাঙালি হিন্দু [6]। কাকোরি, চট্টগ্রাম ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেওয়া 496 জনের মধ্যে 236 জনই ছিল বাঙালি হিন্দু [7]। যে 287 জন স্বাধীনতা সংগ্রামী, আজাদ হিন্দ ফৌজে, আর গোয়া ও হায়দ্রাবাদে মুক্তি সংগ্রাম করেছিল, তার মধ্যে 13 জনই ছিল বাঙালি হিন্দু [8]। সব মিলিয়ে আমরা যে 1185 বিপ্লবীদের নাম পেলাম, তার মধ্যে 321 জনই ছিল বাঙালি হিন্দু। অর্থাৎ মোট বিপ্লবীদের প্রায় 27.1% ছিল বাঙালি হিন্দু। অথচ সে সময়ের অবিভক্ত ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র 7% ছিল বাঙালি হিন্দু। অবশ্য এই মাথাপিছু পরিসংখ্যান দিয়ে দেশজুড়ে বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের প্রভাব কেমন ছিল সেটা সম্পূর্ণ ভাবে অনুমান করা সম্ভব নয়। কেননা তারা দেশজুড়ে অসংখ্য বিপ্লবী সংগঠন তৈরি করেছিল। উদাহরণ দিয়ে সুভাষ চন্দ্র বোসের নামই ধরা যাক। যে 287 জন স্বাধীনতা সংগ্রামী, আজাদ হিন্দ ফৌজে, আর গোয়া ও হায়দ্রাবাদে মুক্তি সংগ্রাম, তার মধ্যে একমাত্র উল্লেখযোগ্য বাঙালি ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসুই। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? মনে রাখতে হবে, তিনিই ত আজাদ হিন্দ ফৌজের চালিকাশক্তি ছিলেন।

এবার হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির কথাতে আসা যাক। তারা একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল 121 ভারতীয়র, যারা 1883 থেকে 1943 সালের মধ্যে হয় ব্রিটিশদের গুলিতে নিহত হয়েছেন, ফাঁসিতে ঝুলেছেন অথবা আমরণ অনশন করে মারা গিয়েছেন। এর মধ্যে 35 জন্য বাঙালি, 34 জন বাঙালি হিন্দু, মাত্র 1 জন বাঙালি বৌদ্ধ। সব মিলিয়ে প্রায় 28.1% বাঙালি তালিকায় রয়েছে। আর যদি আমরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে মারা গেছে এরকম বীরগতিপ্রাপ্তের তালিকা বানাই, সেক্ষেত্রে সংখ্যা আরও 27 বাড়বে। উদাহরণ হিসাবে চট্টগ্রাম বিপ্লব, রাইটার্স বিল্ডিং যুদ্ধের কথা বলা যায়। উক্ত 27 জনের মধ্যে একমাত্র চন্দ্রশেখর আজাদ বাঙালি নন। এর অর্থ দাঁড়ালো প্রত্যক্ষ লড়াই করা বিপ্লবীর তালিকায় প্রায় 40.54% বাঙালি হিন্দু রয়েছে। এবার সেলুলার জেলে বন্দী তালিকার দিকে তাকানো যাক। আমরা তালিকা তৈরি করেছি মুখ্যত হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিপ্লবীদের ওপর। এ বিষয়ে আমরা ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভরসা করেছি [9]।

1857 মহাবিদ্রোহের পর সেলুলার জেলে যে 310 জনকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে মারাঠিরা সংখ্যাগুরু। 156 ছিল মারাঠি, হিন্দি বলয় থেকে আসা বন্দীর সংখ্যা ছিল 38, কর্ণাটক থেকে আসা বন্দীর সংখ্যা ছিল 26। এটা বললেই যথেষ্ট হবে — 1857 মহাবিদ্রোহের সময়ে যতগুলো বন্দী সেলুলার জেলে নির্বাসিত হয়েছিল, তাদের বড় অংশই ছিল মারাঠি। তারপর হিন্দি বলয় ও কর্ণাটক এর মানুষের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। এখানে আমরা অনেক মুসলিম নামও দেখতে পাই, যারা মহাবিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন। যদিও আমরা উপরোক্ত গ্রাফে মুসলিমদের নাম দিইনি, কেননা অধিকাংশ মুসলিম মুখ্যত জিহাদের দ্বারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন; তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট — ব্রিটিশদের বিতাড়ন পর্ব সম্পূর্ণ হলে পূর্বের মত ভারতকে ইসলামিক রাষ্ট্র করবে।

1909 থেকে 1921 সালের মধ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মুখ্যত পাঞ্জাবী ও বাঙালিদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছিল। পাঞ্জাবিদের বিদ্রোহে গদর সমিতি মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। তদ্রূপ বাঙালিরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে শেষে বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। এই সময়ে আন্দামানে নির্বাসিত মোট বন্দির সংখ্যা ছিল 149 জন, যার মধ্যে 86 পাঞ্জাবী, 46 জন বাঙালি হিন্দু (24 জন আজকের বাংলাদেশ থেকে) ছিলেন। মজার কথা 1857 থেকে 1883 সালের মধ্যে যেখানে আন্দামানে নির্বাসিত বন্দীর মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল 53, তা 1909 থেকে 1921 সালের মধ্যে কমতে কমতে মাত্র 10 এ থামে। তাও এরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য নয় — হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদী কার্যকলাপ চালাবার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল।

1932 থেকে 1938 সালের মধ্যে সেলুলার বন্দীদের মধ্যে বাঙালি হিন্দুদের সংখ্যা অবিশ্বাস্য হারে বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ হিসাবে বলা চলে এই সময়ের মধ্যে যে নতুন 376 বন্দী ‘ভর্তি’ হয়েছিল, তার মধ্যে 346 জনই ছিল বাঙালি হিন্দু; অর্থাৎ প্রায় 90% ছিল বাঙালি। এথেকে বোঝা যায় ঐ সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইতে বাঙালি হিন্দুদের দাপট কতখানি ছিল।

এখানে একটা বিষয়ের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। 1857 থেকে 1909 সালের মধ্যে ভারতের মূল ভূখণ্ডে থেকে সেলুলার জেল পাঠানো হয়েছিল, এমন বন্দীর সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের কম। সেলুলার জেলে প্রাপ্ত নথি থেকে জানা যাচ্ছে যে, 5 জন মণিপুরী (এরা 1891 সালের অ্যাংলো-মণিপুরী যুদ্ধবন্দী ছিল), এবং একজন উড়িষ্যার ভূমিপুত্র ছিল। প্রায় 10-12 মুসলমানকেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যারা 1857 থেকে 1909 সালের মধ্যে দেশজুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী জিহাদ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। 1922 থেকে 1931 সালের মধ্যে 7 জন অন্ধ্র থেকে এবং 2 জন হিন্দি বলয়ের লোককে ভারতে প্রত্যাবর্তন করানো হয়েছিল।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নিয়ে সেলুলার জেলে গিয়েছিল, এমন বন্দীর পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যাক।

সেলুলার জেলে সব মিলিয়ে যে 787 বন্দী ছিল 1857 থেকে 1943 সালের মধ্যে, তার মধ্যে প্রায় 50% বন্দীই ছিল বাঙালি। এখানে মনে রাখতে হবে যে, রমেশচন্দ্র মজুমদার কিন্তু 1857 মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতার লড়াই হিসাবে মানতে রাজি ছিলেন না।

এমনকি 1945 সালেও ব্রিটিশরা সেলুলার জেলে যে 65 জন রাজনৈতিক বন্দী ছিল, তাদের রেহাই দিতে অস্বীকার করেছিল। 65 জনই ছিল জাতির দিক থেকে বাঙালি হিন্দু কুলোদ্ভব — পৃষ্ঠা 326-354 [10]।

বিপ্লবীরা বেশিরভাগ ছিলেন হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষ। তার কারণ বিপ্লবী সংগ্রাম মুখ্যতা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অবদান, আর ওই সময় শিক্ষিতের সংখ্যা হিন্দু উচ্চবর্ণে সব চেয়ে বেশি ছিল। বিপ্লববাদে কিন্তু উচ্চ বর্ণের সব শ্রেণীর অবদান পাওয়া যাবে – উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, অত্যন্ত গরীব। উদাহরণ হিসাবে রায় বাহাদুর উপাধিপ্রাপ্ত জিগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দার্জিলিং এর লেবঙ্গে বাংলার রাজ্যপাল স্যার জন অ্যান্ডারসনকে হত্যা করার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে কয়েক বছরের জন্য আন্দামানে নির্বাসিত হন — পৃষ্ঠা 125 [9]। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ঘটনার সাথে জড়িত থাকা কল্পনা দত্তও একজন রায় বাহাদুর উপাধিপ্রাপ্ত জমিদারবাড়ির মেয়ে ছিল। সুভাষ চন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ ও বারীন্দ্র ঘোষ — তিনজনেই ধনী, অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। মদনলাল ধিংড়া ছিলেন অমৃতসরের চিফ মেডিক্যাল অফিসার গীতামলের সন্তান, যদিও গীতামল তাকে কার্জণ উইলিকে হত্যা করার পর ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন [50]। এই সব পরিবার অভিজাত হয়েছিল ব্রিটিশদের সাহায্য করার জন্যেই। অথচ তাদের বংশধররা ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল, এটা থেকে বোঝা যাই সেই সময় কিছু প্রদেশ এর সমাজে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব কি পরিমাণ সুদূরপ্রসারী ছিল। আবার অতি দরিদ্র হিন্দু বাঙালি পরিবারের লোকও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে এই রকমও দেখা গেছে। উদাহরণ স্বরূপ বীরেন দে’র কথাই ধরা যাক। তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া থানার অন্তর্গত সুচিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তার পিতা চন্দ্রনাথ চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গীবাজারের ঘরামীর কাজ করতেন। বীরেন দে বর্মা গ্রামে একটি বিপ্লবী সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি জালালাবাদে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। 4 জুন 1931 সালে সুচিয়া গ্রামেই একটি অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ দেবার সময়ে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে নিজের হাঁটুতেই গুলি মেরে বসেন। এর ফলে গুরুতর আহত হন বীরেন দে, তাকে গোপনে চক্রশালা গ্রামের একটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা শুরু হলেও এত দ্রুত গ্যাংগ্রিন শুরু হয় যে; তিনি পরের দিনেই মারা যান। তাকে গোপনে শ্রীমতী নদীর তীরে পাহাড়ের পাদদেশে কবরস্থ করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল মাত্র 16 — পৃষ্ঠা 376, 395 [15]। বীরেন দের মৃত্যু থেকেই বোঝা যায়, উচ্চবর্ণের মানুষ কতটা ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিল। 1925 সালের পর থেকে উচ্চবর্ণের পাশাপাশি নিম্নবর্ণের বাঙালি হিন্দুরাও সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিতে শুরু করে। উদাহরণ হিসাবে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার দরিদ্র খেতমজুরের ছেলে মোহন কিশোরের কথা বলা যায়, যিনি জাতে নমঃশূদ্র ছিলেন। তিনি 1930 সালে অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন। 1932 সালে নেত্রকোণায় সোয়ারিকান্দা গ্রামে তিনি ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার হন। তাকে অমানবিক অত্যাচারের শেষে সেলুলার জেলে 7 বছরের জন্য কারাবাসে পাঠানো হয়। 1933 সালে সেলুলার জেলেই মোহন কিশোর আমরণ অনশনে বসেন। তাকে জোর করে কারারক্ষীরা অনৈতিক পন্থায় তাঁর গলা দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে; যার ফলে মোহন কিশোরের ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হয় এবং তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। 17 থেকে 26 মে পর্যন্ত মৃত্যুর সাথে লড়ে যান মোহন কিশোর। অবশেষে 26 মে 1933 সালে মারা যান। মৃত্যুকালেও তিনি এক ফোটা খাদ্য কিংবা জল গ্রহণ করেন নি পৃষ্ঠা 162 [42]। এথেকে বোঝা যায় — ধীরে ধীরে উচ্চবর্ণের পাশাপাশি নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে শুরু করেছিল।

আমাদের সংখ্যাতত্ত্ব দেখাচ্ছে যে মুসলমানরা বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ যোগদান করেনি। অথচ ওয়াহাবি আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, মোপালা বিদ্রোহের মত পুরোপুরি জিহাদি কার্যকলাপে তারা বিপুল সংখ্যায় যোগ দিয়েছিল। তাই বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের নিরুৎসাহের কারণ আর যাই হোক,শিক্ষা বা বিত্তের অভাব নয়। হিন্দুরা কিন্তু মুসলমানদের বাদ দিতে বদ্ধপরিকর ছিলনা, আশফাকউল্লাহ খান কাকোরিতে অংশ নিয়েছিলেন। মুসলিম রা চাইলেই যোগ দিতে পারতো। চট্টগ্রামের নায়ক সূর্য সেন অনুশীলন সমিতিতে মুসলিমদের নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন,কিছুটা সফল হয়েছিলেন, কিন্তু মুসলিমদের মধ্যে থেকে প্রথম সারির কোনো বিপ্লবীকে পাননি। অদ্ভুত বিষয় এই যে, বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পূর্ববঙ্গের লোক, যা ঐতিহাসিক ভাবেই মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ ছিল। সূর্য সেন যে চট্টগ্রামের বাসিন্দা ছিলেন, সেই চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার প্রায় 74% ছিল মুসলিম। অধ্যাপক শামসুল আলম সৈয়দ লিখেছেন,ব্রিটিশ দের প্ররোচনায় আর শিক্ষার অভাবে মুসলিম সমাজে বিপ্লবী কর্মকান্ডকে সুনজরে দেখা হতো না, তাই কোনো মুসলিম যোগ দিলেও তার পরিবারের লোকেরা তার কার্যকলাপ গোপন রাখত পৃষ্ঠা 242 [15]। শামসুল তার বইতে কয়েকজন মুসলিম যুবকের নাম করেছেন, যারা চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন পৃষ্ঠা 242-45 [15]।

বিংশ শতকে যে কজন মহিলা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বাঙালি হিন্দু। চার্লস টেগার্টের বয়ানে— “সম্প্রতি নারী সন্ত্রাসবাদীদের আত্মপ্রকাশ আরও একটি অশুভজনক ব্যাপার। আইন অমান্য আন্দোলনে নারীরা কলকারখানা ঘিরে রেখে সক্রিয়ভাবে কাজে যোগদানে বাধা সৃষ্টি করত এবং অহিংসা আন্দোলন থেকে হিংসার পথে আসা খুব ছোট একটি পদক্ষেপ। আপনারা স্মরণ করুন সেই ঘটনার যখন দুজন নারী (শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী) সাম্প্রতিক কালে কুমিল্লার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার স্টিফেন্সকে হত্যা করে।

আর একজন নারী স্নাতক (বীনা দাস) স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসনকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। এরপর একজন নারী ডাকাতিতে অংশ গ্রহণ করেন এবং আরও সাম্প্রতিক কালে গত সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম রেলওয়ে ইন্সটিটিউটের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। যখন তাস খেলা চলছিল, তখন সন্ত্রাসবাদীরা বোমা, রিভলভার ও বন্দুক নিয়ে তিন দিক দিয়ে ঐ প্রাঙ্গণ আক্রমণ করে। একজন ইংরেজ রমণী নহত হন এবং চারজন নারীসহ এগারজন অতিথি আহত হন। পরে ঐ নারী সন্ত্রাসবাদীকে মৃত অবস্থায় বাড়ীটির বাইরে পাওয়া যায় — সে বিষপান করে।” পৃষ্ঠা 18-19 [2]। টেগার্টের লেখা থেকে বোঝা যায় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কতখানি সাহসী ছিলেন এবং কি সাহসের সাথেই না চট্টগ্রামের পুলিস কর্ডন পেরিয়ে একেবারে পুলিসকেই আক্রমণ করে বসেছিলেন।

আগেই বলেছি যে, বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের অধিকাংশ পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিলেন। টেগার্ট এ বিষয়ে লিখেছেন, পশ্চিম বাংলা থেকে বিপ্লব শুরু হয়েছিল যুগান্তর গোষ্ঠীর হাত ধরে — “কিন্তু পূর্ববঙ্গ খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। প্রায় একই সময়ে অনুশীলন সমতি নামক একটা গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন নির্মিত হয় — এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পুলিন বিহারী দাস। প্রথমে ধর্মীয় ও সামাজিক উদ্দেশ্যে সমিতি গঠিত হলেও পরের দিকে নিছক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই পূর্ববঙ্গে 500 শাখা খোলা হয়েছিল।” পৃষ্ঠা 9 [2]। এফ. সি. ডেলী তার গুপ্ত নোটে লিখেছেন — “অনুশীলন সমিতি পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সবচেয়ে নিষ্ঠুর বিপ্লবী সংগঠন হিসাবে পরিচিত ছিল। অনুশীলন সমিতির ঢাকা শাখাটা প্রাক্তন সেলুলার জেল ফেরত আসামী পুলিন বিহারী দাসের নেতৃত্বে খোলা হয়েছিল এবং এই কাজে দাস মহাশয় প. মিত্র ও বিপিন চন্দ্র পালের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ঢাকা শাখা দুই-তিন বছরের মধ্যে কলকাতার সদর দপ্তরের চেয়ে বেশি কুখ্যাত হয়ে ওঠে, তাদের বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপের দ্বারা। তাছাড়া ঢাকা শাখা কলকাতার শাখার চেয়ে বেশি শৃঙ্খলাপরায়ণও ছিল।” পৃষ্ঠা 456 [15]।

এবার আমরা পূর্ববঙ্গের বিপ্লবীদের সম্বন্ধে একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করি।

আমরা আগের যে রেখাচিত্র (বার গ্রাফ) দেখিয়েছি, তা থেকে স্পষ্ট যে, 1883 থেকে 1943 সালের মধ্যে সেলুলার জেলের বন্দীদের মধ্যে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল বিস্ময়কর। মোট 787 বন্দির মধ্যে 262 জন পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল — সংখ্যাটা নেহাত কম নয়; প্রায় এক তৃতীয়াংশ হবে। 1901 থেকে 1941 সালের মধ্যে হওয়া জনগণনা অনুসারে ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র 3% হওয়া সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের এই অবদান ভুলে যাবার মত বিষয় নয়।

আগেই বলেছি যে, 1945 সালে ব্রিটিশ সরকার যে 42 জন বন্দীকে ছাড়তে রাজি হয় নি, তার মধ্যে 23 জনই ছিল পূর্ববঙ্গ অথবা ত্রিপুরার লোক। এরা সম্মিলিত ভাবে 600 বছর কারাবাসের সাজা ভোগ করছিল — পৃষ্ঠা 326-354 [10]। 1883 থেকে 1943 সালের মধ্যে যে 35 জন হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয় ফাঁসিকাঠে ঝুলেছেন বা আমরণ অনশনে মৃত্যুবরণ করেছেন, তার মধ্যে 21 জনই ছিলেন বাঙালি হিন্দু, অর্থাৎ প্রায় 60 শতাংশ [12]। এই সময়ে ব্রিটিশদের সাথে যে 26 জন বাঙালি হিন্দু বিপ্লবী প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে নিহত হয়েছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। 1883 থেকে 1943 সালের মধ্যে মোট ফাঁসিকাঠে ঝোলা বা ব্রিটিশদের সাথে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে নিহত হওয়া ভারতীয় বিপ্লবীদের মোট তালিকা তৈরি হলে তাতে দেখা যায় 61 জন অর্থাৎ 77.05%শতাংশই হচ্ছে বাঙালি হিন্দু।

আবার যদি মহিলা বিপ্লবীদের (সন্ত্রাসবাদী) নাম খুঁজতে চাই, তবে দেখা যাবে প্রত্যেকেই জাতির দিক থেকে পূর্ববঙ্গবাসী বাঙালি হিন্দু ছিলেন। আবার যে বিপিন চন্দ্র পাল, যিনি কংগ্রেসের চরমপন্থী অংশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাল গঙ্গাধর তিলক ও লালা লাজপত রাইয়ের সাথে; তিনিও আদতে পূর্ববঙ্গের লোক ছিলেন; তার জন্মস্থান ছিল সিলেট, যা অবিভক্ত ভারতে আসামের অংশ ছিল।

এখানে মনে রাখতে হবে যে, ভারতের প্রধান আধ্যাত্মিক, আদর্শগত, দূরদর্শী নেতা ও বিপ্লবীদের প্রত্যেকেই ছিলেন অবিভক্ত বাংলার, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। উদাহরণ হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ, রাসবিহারী ঘোষ, সুভাষ চন্দ্র বসুর নামোল্লেখ করা যায়। এর মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ও রাসবিহারী ছাড়া বাকিরা সবাই কলকাতা থেকেই তাদের বিপ্লবী চিন্তাধারা ও কাজকর্ম চালিয়ে গেছেন। আগেই বলেছি যে, কলকাতাকে বাংলার মস্তিস্ক বলা হত। বঙ্কিমচন্দ্র কলকাতাতেই পড়াশোনা করেছিলেন। বিপিন চন্দ্র পালও অধিকাংশ সময়ে কলকাতায় বসেই কাজ করে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু হলেও বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে পূর্ববঙ্গ ভারতের বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। পূর্ববঙ্গের বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পুলিন বিহারী দাস ও মাস্টারদা সূর্য সেন। শুধু পূর্ববঙ্গ বা পশ্চিমবঙ্গেই ভারতের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী জন্মেছিলেন বললে ভুল বলা হবে। প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যেও অনেক স্বনামখ্যাত বিপ্লবী ছিলেন। এই তালিকায় শচীন্দ্রনাথ সান্যালের নাম করা চলে, যিনি আদতে বেনারসের মানুষ ছিলে। এইভাবে বাংলার ভেতরে ও বাইরে থেকে বাঙালি হিন্দুরা ব্রিটিশদের ওপর মারণ আঘাত হান্তে কোনও প্রয়াস বাদ দেয় নি।

এখানে একটা কথা স্বীকার করে নেওয়া দরকার, এমন অনেক সম্প্রদায় আছে, যারা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন নি বা অর্থসাহায্য করেন নি। উদাহরণ হিসাবে মাড়োয়ারি, সিন্ধ্রি বা গুজরাতিদের কথা বলা চলে। এই তিন হিন্দু জাতির একজনও সেলুলার জেলে কারাবাস ভোগ করেন নি বা ফাঁসিতে ঝোলেন নি। এখানে বলে রাখা দরকার যে, বিশেষ করে কলকাতায় মাড়োয়ারিরা বেশ ভালই সংখ্যায় রয়েছে প্রায় চারশো বছর ধরে। কিন্তু তারা বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে অংশ নেন নি। বাংলার বিখ্যাত বিপ্লবী অনন্ত সিংহ রাজপুত কুলোদ্ভব ছিলেন, যদিও তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন বাংলায় বসবাস সূত্রে বাঙ্গালী হয়ে গেছিলেন। তাঁর দিদি ইন্দুমতী সিংহও বিপ্লবী ছিলেন। দুই সিংহ চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনায় জড়িত ছিলেন। গুজরাতে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল বটে, কিন্তু তার প্রভাব জনসাধারণের মধ্যে সেভাবে পড়েনি। যে কয়েকজন গুজরাতি বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশ নিয়েছিলেন তার মধ্যে শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মা ইন্ডিয়া হাউসের ফান্ডিং করতেন। আরেক গুজরাতি হিন্দু স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী আর্য সমাজ আন্দোলন শুরু করেন। বহু বিপ্লবী ছিলেন আর্য সমাজের সদস্য, যারা পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশের মানুষ ছিলেন। আসাম ও উড়িষ্যায় কয়েকজন বিপ্লবীর নাম করা যায় যারা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। উত্তরপূর্ব ভারত থেকে একটাও উল্লেখযোগ্য বিপ্লবী জন্ম নেন নি। তাই বলা যায় ভারতের সশস্ত্র সংগ্রাম মুখ্যত তিন চার জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল — বাঙালি, পাঞ্জাবী (শিখ ও হিন্দু) মারাঠি ও তামিল। এরা ছাড়া বাকি রাজ্য থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন এমন ‘বিপ্লবীর’ সংখ্যা হাতে গুনেই বলা যাবে। মাড়োয়ারি, আসাম, ওড়িয়া ও সিন্ধ্রি জাতির মধ্যে প্রচুর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থাকলেও তারা বিস্ময়কর ভাবে বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশ নেন নি। এখানে বলে রাখা দরকার — আসাম ও উত্তরপূর্বের লোকেরা সেই 1947 সাল থেকেই তাদের রাজ্যে বাঙালি উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে ‘অশোভন’ ভাবে বিরোধিতা করে গেছে। এদের চোখে বাঙালিরা স্রেফ অনুপ্রবেশকারী ছাড়া আর কিছুই না। অথচ তারা বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুদের ওপর কিরকম অত্যাচার চলছে; সে সম্বন্ধে বিস্তর ওয়াকিবহাল। তারপরেও স্রেফ জাতিগত কারণে ও ঈর্ষার বশে তাদের রাজ্যে যাতে বাঙালি হিন্দুরা আশ্রয় না পেতে পারে; তার জন্য সব রকম রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

এটা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, ব্রিটিশরা মুখ্যত বিপ্লবীদের জন্যই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত রদ করতে বাধ্য হয়েছিল। এবং একইসাথে কলকাতায় নিরাপত্তা নেই বুঝে 1911 সালে রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। লর্ড হার্ডিঞ্জ এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন — “দুই বাংলা থেকে বিগত মাসে দিল্লিতে চলে এসেছি। আমরা অনুভব করেছি যে, বাংলা আমাদের জন্য আর নিরাপদ নয়। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বাঙালি হিন্দুদের খুবই ক্রুদ্ধ করেছে এবং তারা সরাসরি সংঘাতের পথ ধরেছে। কলকাতায় আইনসভার সদস্যদের মধ্যেও বাঙালি হিন্দু বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদের প্রভাব মারাত্মক ভাবেই পড়েছে। যেসব বাঙালি হিন্দু সদস্য ছিলেন তারাও বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের ঘোরতর সমালোচনা করে প্রচ্ছন্ন ভাবে বিপ্লবী কার্যকলাপের সমর্থন করেছেন। তাদের মতে, অনৈতিক ভাবে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে আদতে বাঙালি হিন্দু স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ব্রিটিশ সরকার। একমাত্র বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত রদ করলেই তবে রাজ্যজুড়ে অশান্তি ও নৈরাজ্য খতম হবে। আমিও বুঝেছিলাম এছাড়া সত্যিই কোনও উপায় নেই। আমার মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রসচিব স্যার জন উইল্কিন্স 17 জুন 1911 সালে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলেন, তাতে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বলার পাশাপাশি কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। তার সুপারিশের সাথে আমার মন্ত্রীসভার অনেক সদস্যই একমত হয়েছিল। তাদের মতে, এর ফলে ভারতের রাজনীতিতে নতুন যুগ আসবে। আমরা দিল্লিতে রাজদরবারে একই অনুরোধ করেছিলাম।” পৃষ্ঠা 161-62 [13]। এইভাবে আমলাতান্ত্রিক ভাষা ব্যবহার করে লর্ড হার্ডিঞ্জ বুঝিয়েছিলেন যে, বাংলায় বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে অরাজক অবস্থা চলছে এবং বিপ্লবী কাজকর্মের জেরে ইউরোপীয়দের ধনপ্রাণ সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ছে; তা থেকে মুক্তি পেতে তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করাতে চাইছেন।

কিংবদন্তী বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ স্যানাল দাবি করেছিলেন যে, বিপ্লবীদের সৌজন্যেই বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্ত রদ হয়েছে। 12 ফেব্রুয়ারি 1925 সালে গান্ধীকে একটি চিঠিতে সান্যাল বিপ্লবী কার্যকলাপকে আড়াল করেছিলেন — “আমি এই চিঠিতে আপনার তরফে 39তম কংগ্রেস অধিবেশনে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যে ভ্রান্ত ধারণা করেছেন, সে সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাইছি। আপনি বলেছেন যে, বিপ্লবীদের জন্যই নাকি ভারতের প্রগতি রুদ্ধ হচ্ছে। আমি জানি না আপনি ‘প্রগতি’ বলতে ঠিক কি বলতে চাইছেন? যদি আপনি ‘রাজনৈতিক প্রগতির’ কথা বলতে চান, তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে; ভারতের বুকে অদ্যাবধি যেটুকু প্রগতি হয়েছে; তা বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের জন্যই হয়েছে। আমি জানি আপনি এই কথা অস্বীকার করতে পারবেন না। আপনি কি অস্বীকার করতে পারবেন যে, বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত কেবল মাত্র বিপ্লবীদের জন্য রদ করা হয়েছে? আপনি কি অস্বীকার করতে পারবেন যে, মর্লে মিন্টো সংস্কার কেবলমাত্র বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের জন্যই সম্ভব হয়েছে? আপনি কি অস্বীকার করতে পারবেন যে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় যে মন্টেফোর্ড সংস্কার এসেছে; তা বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের জন্যই সম্ভব হয়েছে?” পৃষ্ঠা 244-45 [44]।

আমরা জানি না বিপ্লবীরা ভারতের রাজনীতিতে ঠিক কতখানি প্রভাব ফেলতে পেরেছিল। কিন্তু খুব কম নয়, এটুকু বলা যায়। আমরা আগেই বলেছি যে, কিভাবে বিপ্লবী সংগঠনে দলীয় সদস্যদের কংগ্রেস দলে অনুপ্রবেশ করে তাদের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল; বিশেষ করে বাংলা ও উত্তর প্রদেশে। বিপ্লবীরা অনেকেই কংগ্রেসে এন্ট্রি নিয়ে তাদের বিপ্লবী চিন্তাধারা দলের ভেতরে ঢোকাতে সক্ষম হয়েছিল। চার্লস টেগার্ট তার ভাষণে এটাই বলেছেন — “মিস্টার চিত্তরঞ্জন দাস কলকাতার কর্পোরেশনের মেয়র হবার পরেই প্রথমে চাকরীর জন্য দরখাস্ত করার আহ্বান জানান, যারা দেশের জন্য দুঃখকষ্ট ভোগ করেছে। এর ফলে কলকাতা কর্পোরেশন শিক্ষক হিসাবে স্থান দিয়েছে সন্ত্রাসবাদী ও তার সমর্থকদের।

সারা রাজ্যে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে প্রথম অভিযানের সময় থেকে এখন আরও বেশি গভীরভাবে সন্ত্রাসবাদীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমি মনে করি না যে, আমি অতিরঞ্জিত করছি — যদি বলি এমন কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে একটা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী নেই প্রধান নেতাদের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং যার ফলে পুলিসের অজান্তে যুবকেরা হত্যা করে চলেছে। এই নেতাদের অনেকেই গ্রেফতার এড়িয়ে চলছে এবং এদের ধরিয়ে দিতে জনসাধারণ ভয় পায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এরা বছর পর বছর তাদের শক্তি ব্যয় করেছে হত্যাকাণ্ডে প্ররোচনা দিয়ে। তাদের অনুচররা, তাদের কয়েকশজনকে আমি চিনি, করুণার উদ্রেক করে। সরকারের প্রতি ঘৃণায় তাদের অপরিণত মন পরিপূর্ণ এবং তাদের সৎ গুণকে বিকৃত করে এবং দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের অপরাধমূলক কাজে প্ররোচিত করা হচ্ছে” পৃষ্ঠা 17 [2]।

আগেই আমরা দেখিয়েছি কিভাবে যেসব বিপ্লবীরা কংগ্রেসে ঢুকেছিল, তারা বিপ্লবীদের জন্য কংগ্রেসকে শোকপ্রকাশ ও সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করতে বাধ্য করেছিল। 1 নভেম্বর 1932 সালে টেগার্ট এই প্রসঙ্গে বলেছেন — “কলকাতার পৌরপ্রতিষ্ঠান স্বায়ত্ত্বশাসন লাভ করার পর কংগ্রেসই আধিপত্য করেছে। ফলে এখানেও সন্ত্রাসবাদীদের প্রভাব মারাত্মক। এই পৌরপ্রতিষ্ঠানও একজন হত্যাকারীর প্রশংসা করে একইভাবে প্রশংসাসূচক গণপ্রস্তাব পাশ করিয়েছে। ঘটনাগুলো এরকম — 1930 সালে ডিসেম্বর মাসে দীনেশ গুপ্ত 6 জন সন্ত্রাসবাদী সহ চূড়ান্ত নিষ্ঠুর ও কাপুরুষোচিত ভাবে নিরস্ত্র অবস্থায় কর্মরত কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করে। এরপর এলোমেলো ভাবে অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের অফিসে গুলি চালায় যার ফলে দুজন আহত হন। দীনেশকে গ্রেফতার করা হয় এবং এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জুলাই মাসে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। এর পাঁচদিন বাদে কলকাতা পৌরপ্রতিষ্ঠান এই কাপুরুষ হত্যাকারীর প্রাণদণ্ডে দুঃখপ্রকাশ করে এবং সদস্যরা উঠে দাঁড়িয়ে যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তাতে বলা হয় “সে তার আদর্শের জন্য আত্মোৎসর্গ করেছে।” এর তিন দিন বাদে কলকাতা পৌরসভার গেজেটে প্রথম পাতায় দীনেশের ছবি ছাপা হয় এবং সভায় কার্য-বিবরণী ও মূল প্রস্তাব পাশ হয়। ষোল দিন পর যে ট্রাইব্যুনাল দীনেশকে প্রাণদণ্ড দেয়, তার প্রেসিডেন্ট মিস্টার গারলিককে তার আদালতে গুলি করে যে সন্ত্রাসবাদী, তার কাছে এক টুকরো কাগজ পাওয়া যায় যাতে লেখা ছিল “সেই আদালতকে অভিসম্পাত দিই যার অবিচারের ফলে দীনেশকে মরতে হয়েছে।” যখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস এবং কলকাতার পৌরপ্রতিষ্ঠানের মত গণপ্রতিষ্ঠানে এই ধরণের অপরাধীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় তখন যে ভাবপ্রবণ বাঙালি যুবকদের কথা আমি বলেছি, যাদের মনকে বিদ্যালয় জীবন থেকেই বিষাক্ত করা হচ্ছে। তারাও যদি হত্যা ও ধ্বংসের পথ বেছে নেয়, তাতে বিস্ময়ের কিছু বাকি আছে কি?” পৃষ্ঠা 17 [2]।

ঠিক একইভাবে বিপ্লবীর ভগত সিংহের ফাঁসির পর যিনি বরাবরই সশস্ত্র সংগ্রামের বিরোধিতা করে এসেছেন, সে গান্ধীকেও 1931 সালে করাচী কংগ্রেস অধিবেশনে ভগত সিংহকে ‘অন্যায় ভাবে’ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিরুদ্ধে জনমতের চাপে বিরোধিতা করে গণপ্রস্তাব পাশ করাতে হয়েছিল। সেখানে গান্ধী ভগতের সাহস ও আত্মত্যাগের প্রশংসা করেন। তখন কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল। সুভাষ চন্দ্র বসু লিখেছেন — “ভগত সিংহের মৃত্যুতে করাচীতে জনগণের মধ্যে এতটাই অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও গান্ধীকে এই গণপ্রস্তাব পাশ করাতে হয়েছিল। তিনি বুঝেছিলেন বিলম্ব করলে পরিস্থিতি এতটাই বিগড়ে যাবে, ফলে কংগ্রেস জনপ্রিয়তা হারাবে। সবচেয়ে বড় কথা করাচীর মানুষ এতটাই ক্রুদ্ধ ছিল যে, তারা সর্বত্র গান্ধীকে কালো পতাকা দেখিয়েছিল।” পৃষ্ঠা 229 [14]।

বিপ্লবীদের চাপে পড়েই জাতীয় কংগ্রেস 1929 সালে গণপ্রস্তাব পাশ করতে বাধ্য হয় — সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করে। বলা বাহুল্য কংগ্রেসের মধ্যে যেসব বিপ্লবীরা ঢুকে পড়েছিলেন, তাদেরই দাবি ছিল ব্রিটিশদের অধীনতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি। কিন্তু গান্ধী ও তার অনুগামীরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নয় — ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস চেয়েছিলেন। গান্ধী স্বরাজের নানান রকম সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, এক এক দিনে এক এক রকম; যার ফলে কংগ্রেসের সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল। গান্ধী সারা জীবন ধরে শুধু 1942 সালের কয়েক মাস বাদ দিলে, বরাবরই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিকে অমান্য করে গিয়েছেন এবং সামান্য স্বায়ত্ত্বশাসন চেয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন — পৃষ্ঠা 19 [20]। কিন্তু কংগ্রেসের ভেতরে থাকা বিপ্লবীরা গান্ধীকে সেভাবে মানতেন না, তারা কংগ্রেস ও গান্ধীকে চাপ দিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা আদায় করতে বাধ্য করেন। 1926 সালে গুয়াহাটি অধিবেশনের শেষে গান্ধী ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় লেখেন — “বছর পর বছর ধরে কংগ্রেসে যে গণপ্রস্তাব পাশ হয়েছে যে স্বরাজই স্বাধীনতা এবং তা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে এসেছে। কিন্তু আজকাল পূর্ণ স্বাধীনতার নামে যে দাবিটা উঠছে, তার পেছনে আছে বহু বছরের সঞ্চিত অধৈর্যতা। আমি বুঝি বহু কংগ্রেসের নেতা ইদানীংকালে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠছে এবং মনে করছে যে, ব্রিটিশ সরকার কোনওদিনই আমাদের ন্যায় বিচার দেবে না। যারা স্বাধীনতার দাবি তুলছেন তারা ভুলে যাচ্ছেন যে, তারা এইভাবে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছেন। তারা কেনই বা মনে করছেন যে, তারা কোনওদিনই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হৃদয় পরিবর্তন করতে পারবেন না?” পৃষ্ঠা 52 [18]; 200 [17]।

ডিসেম্বর 1928 সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনে নেতৃবৃন্দ বারংবার স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে বসায় হতাশ ও ক্রুদ্ধ গান্ধী একটি গণপ্রস্তাব পাশ করান, যাতে পরিষ্কার বলা হয়েছিল; ব্রিটিশ সরকারকে এ বছরের মধ্যে ভারতকে স্বায়ত্ত্বশাসন দিতে হবে, আর না দিলে, তখন বাধ্য হয়েই কংগ্রেস অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবে, জনগণের কাছে ব্রিটিশ সরকারকে কর না দিতে অনুরোধ জানাবে। কিন্তু সুভাষ চন্দ্র বসু কংগ্রেসে প্রস্তাব আনলেন যে কংগ্রেস স্বাধীনতা দাবি করুক আর ব্রিটিশের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করুক। বসু লিখেছিলেন তিনি কেন এমন গণপ্রস্তাব পাশ করতে অনুরোধ করেছিলেন — “কিছু বন্ধুর কাছে আমি এই জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হয়েছিলাম যে, কেন আমি নেহেরু রিপোর্টে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হয়েছিলাম। আপনারা জানেন যে, আমি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আর অন্যত্র বলেছিলাম যে আমি বিরোধিতা করতে চাই না । তার কারণ সেই সময় আমি আমার সংশোধনী গৃহীত হলেও মতবিরোধের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু আজ আমি পারিণামের জন্য প্রস্তুত আর আমার সংশোধনী গৃহীত হলে আমি শেষ পর্যন্ত যাবো। বিগত কয়েক মাস ধরে এমন কিছু ঘটেছে; যার ফলে আমি বাধ্য হয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছি। আপনারা জানেন যে, কংগ্রেস দলে যেসব বাঙালি প্রতিনিধি আছেন, তারা প্রত্যেকেই পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছেন এবং সাফ সাফ জানিয়েছেন এরপর যা ঘটবে তা মানতে রাজি আছেন। এমনকি যদি আমিও না এই প্রস্তাবের পক্ষে না দাঁড়াই, অন্য প্রতিনিধিরা ঠিকই দাঁড়াবেন।” পৃষ্ঠা 275 [21]। এরপর সুভাষ চন্দ্র বসু ভাষণে বলেন — “বাংলার কথা যদি বলেন, আপনারা জানেন যে বাংলায় যেদিন থেকে জাতীয়তাবাদ শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই এই দেশ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছে। আমরা কোনওদিনই স্বরাজ বলতে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস বুঝিনি। মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশে বহু মানুষ আত্মবলিদান করেছেন, আমাদের কবিরা স্বাধীনতার বাণী শুনিয়েছেন, আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কিছু ভাবিনি। স্বায়ত্ত্বশাসনে আমাদের দেশবাসীর কিছুমাত্র উৎসাহ নেই, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম যারা এখন বড় হচ্ছে, আমাদের উচিৎ এটা মনে রাখা যে নতুন প্রজন্মই আমাদের ভবিষ্যতের উত্তরাধিকারী।” পৃষ্ঠা 278 [21]। চার্লস টেগার্ট তার ভাষণে ঠিক এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন — কংগ্রেস নেতৃত্ব এই মুহূর্তে বিপ্লবীদের কথায় চলছে।

গান্ধী সুভাষ চন্দ্র বসুর মন্তব্যের বিরোধিতা করেছিলেন — “বাংলার তরুণ তুর্কিরা একটা বড় মাপের ভুল করছে। তারা যে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করছে সেটা আমার কাছে ফাঁকা কলসির আওয়াজ বেশি মনে হচ্ছে” পৃষ্ঠা 478 [22]। এই ‘বাংলার তরুণ তুর্কি’ বলতে গান্ধী যে বিপ্লবীদের কথা বুঝিয়েছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য, গান্ধীর জন্যই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি পরাজিত হয় 1350-973 ভোটে। কিন্তু তাতে বাঙালি কংগ্রেস নেতারা পিছিয়ে যান নি। 1928 সালে বসুর সংশোধিত দাবির পক্ষে বাংলা থেকে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েছিল — পৃষ্ঠা 192 [3]। গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন বসুর পক্ষে যে 935 ভোট পড়েছে, তা শুধুমাত্র বাংলার ভোটে সম্ভব নয়; তাতে অন্য রাজ্যেরও মদত আছে। ফলে ডিসেম্বর 1929 সালের লাহোর অধিবেশনে 1928 সালে যে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উঠেছিল, তার বিরোধিতা থেকে সরে এসে সমর্থন জানাতে বাধ্য হন। সুভাষ চন্দ্র বসু লেখেন — “1920 সালে গান্ধী কংগ্রেসের প্রধান নেতায় পরিণত হন, তিনি পরবর্তী দুই দশক পর্যন্ত কংগ্রেসের একচ্ছত্র অধিপতিই ছিলেন। এটা সম্ভব হয়ে শুধুমাত্র গান্ধীর ব্যক্তিত্বের কারণে নয়, জনগণের ওপর তার আদর্শ ও নীতি চাপানোর দক্ষতার জন্যও। কিন্তু 1930 দশক থেকে কংগ্রেসের ওপর গান্ধীর সেই প্রভাব আর ছিল না। শেষ দুই বছরে কংগ্রেসের নিচুতলার সদস্যরা গান্ধীর অহিংসা নীতির বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন। ডিসেম্বর 1928 সালে গুয়াহাটি অধিবেশনে কংগ্রেসের একাংশ গান্ধীর নীতির বিরুদ্ধে খোলাখুলিই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, বিশেষ করে স্বাধীনতার ইস্যুতে। তখন গান্ধী ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে সওয়াল করেন এবং আমাদের স্বাধীনতার গণপ্রস্তাবকে একরকম ‘ব্ল্যাকমেইল পলিটিক্সের মাধ্যমে’ পরাজিত করেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই যখন কংগ্রেস আবার পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে গণপ্রস্তাব আনল; তখন গান্ধী জনগণের মানসিকতা বুঝে উপায়ান্তর না দেখে পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপক্ষে ভোট দিতে বাধ্য হন।” পৃষ্ঠা 14-15 [23]। যখন পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন করতে হচ্ছিল, তখন গান্ধীর তরফ থেকে আসা বাক্য ছিল বেশ কৌতূহলোদ্দীপক — “এই মুহূর্তে দেশের মানসিকতা বুঝে আমরা পূর্ণ স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রস্তাব পাশ করছি; ইহাই আমার কাছে স্বরাজের পূর্ণ অর্থ।” পৃষ্ঠা 142 [24]; 201 [17]।

এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলা সহ সমগ্র ভারতে একের পর এক ‘সন্ত্রাসবাদী হামলা’র শিকার হয়ে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়েই আগের অবস্থান পালটে কংগ্রেসকে কিছু বিশেষাধিকার দেবার কথা ভাবতে শুরু করে। বিখ্যাত বিপ্লবী যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী বলেছেন — “এপ্রিল 1930 সালের চট্টগ্রামের বিখ্যাত অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ছিল একটি সুসংগঠিত বিপ্লবী কার্যকলাপ, যা সারা ভারত জুড়ে প্রায় তিন বছর ধরে বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে জড়িত থাকতে প্ররোচিত করেছিল। সত্যি বলতে কি, ব্রিটিশ সরকার 10 বছর ধরে চলা অহিংসা আন্দোলনের ব্যাপারে বিশেষ মাথা ঘামায় নি। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ভারত নীতির ওপর অহিংসা আন্দোলনের প্রভাব অতি সামান্য, উপেক্ষণীয়ও বলা চলে। কিন্তু যখন বাংলা ও অন্যান্য জায়গায় একের পর এক সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হল, তখন ব্রিটিশ সরকার অনুভব করল, তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। শুধু মেদিনীপুরেই তিন তিনজন ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বিপ্লবীদের হাতে নিহত হবার পর তারা বাধ্য হয়ে একজন বাঙালিকে ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট করে পাঠিয়েছিল।” পৃষ্ঠা LXXIi [11]।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের 8 মাস বাদে এবং আইন অমান্য আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়েছিল কংগ্রেসের সাথে গোলটেবিল বৈঠকে বসতে, উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসের দাবিদাওয়া মেনে নিয়ে বিপ্লবীদের অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া। মার্চ 1931 সালে গান্ধী আরউইন সন্ধিতে গান্ধী স্বাক্ষর করেন। এর পেছনে কংগ্রেস কার্যকারিণী সমিতির সমর্থন ছিল, গান্ধীর সাথ দিয়েছিলেন তার দুই প্রিয় শিষ্য নেহেরু ও প্যাটেল। এই চুক্তি আসলে ছিল গান্ধীর সবচেয়ে বড় পরাজয়, এর ফলে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে নতিস্বীকার করেছিলেন। উক্ত চুক্তির ফলে কংগ্রেসের প্রায় কোনও লাভ হয় নি — কেবল ব্রিটিশ সরকার দয়াবশত কয়েকজন কংগ্রেসী নেতা ও সমর্থকদের রাজনৈতিক বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেয়। কিন্তু কোনও বিপ্লবীকে এই সুযোগ দেওয়া হয় নি। সুভাষ চন্দ্র বসু গান্ধী-আরউইন চুক্তি সম্বন্ধে লিখেছেন — “গান্ধী-আরউইন চুক্তিতে উল্লেখিত রাজক্ষমার বিষয়টা কারুর মনঃপুত হয় নি। নিচে নিম্নলিখিত শ্রেণীভুক্ত রাজনৈতিক বন্দীদের রেহাই দেওয়ার কথা বাদ গিয়েছিল।

  • যারা বাংলার বিভিন্ন জেলে বিনা বিচারে এক বছর বা তার বেশিদিন ধরে জেলে পচছে, বাংলায় সে সময়ে 1000 বা তার বেশি এমন বন্দি ছিল।
  • বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে জড়িত দোষী সাব্যস্ত বন্দী।
  • বিপ্লবাত্মক কার্যকলাপে জড়িত বিচারাধীন বন্দী।
  • মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় যারা বিচারাধীন ছিল।
  • শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে জড়িত বিচারাধীন বন্দী।
  • যেসব গাড়োয়ালি সৈনিকরা সাধারণ মানুষের ওপর ব্রিটিশদের তরফে গুলিচালনার আদেশ অমান্য করেছিল, তাদের কোর্টমার্শালের সিদ্ধান্ত রদ না করা।
  • যেসব বন্দীরা অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের সময়ে সামান্য হিংসার আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের রেহাই দেবার প্রস্তাব খারিজ করা হয়েছিল।” পৃষ্ঠা 231 [14]।

এখানে বলে রাখা দরকার গান্ধীর দূত হিসাবে যিনি ব্রিটিশদের সাথে দেখা করেছিলেন সেই মাড়োয়ারি বণিক জি ডি বিড়লা এই গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর্যালোচনা করে বলেন, “এর ফলে অশান্তির সম্ভাবনা ভবিষ্যতে আর থাকবে না।” এতেই না থেমে আরও বলেন — “যেভাবে মৌখিক সম্মতির ভিত্তিতে আলোচনা হয়েছে, তা মনোবল বাড়াবে ।” পৃষ্ঠা 161 [23]। এখানে বিড়লা বুঝিয়েছিলেন তিনি গান্ধীর তরফে বিপ্লবীদের দমন করতেই এসেছিলেন এবং গান্ধীবাদী অহিংসা আন্দোলনের সাফল্য চেয়েছিলেন।

কংগ্রেসের মধ্যে থাকা বিপ্লবীরা গান্ধী-আরউইন চুক্তিকে আটকাতে সফল হন নি। সুভাষ চন্দ্র বসুর ভাইপো অশোক বসু গান্ধী-আরউইন চুক্তি ফলাফল সম্বন্ধে লিখেছেন — “সেখানে কাকা ও গান্ধী ও তার সমর্থকদের সাথে অসংখ্যবার বৈঠক বসেছিল উডবার্ন পার্কে; প্রতিবার এক ঘণ্টা কি তারও বেশি সময় জুড়ে বৈঠক চলেছিল। কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্য, বিশেষ করে প্রাক্তন বিপ্লবীরা এই চুক্তি সম্বন্ধে অত্যন্ত বিরূপ মনোভাব নিয়েছিলেন। তারা কোনও প্রকার সমঝোতার বিরুদ্ধে ছিলেন। ঐ মাসের শেষ দিকে করাচীতে গান্ধী যে সিদ্ধান্ত নেন, তাই কার্যকর হয়।” পৃষ্ঠা 53 [27]। করাচীতে কংগ্রেস অধিবেশনে এই চুক্তি পাশ হয়। এই চুক্তির বিরুদ্ধে থাকলেও উপায়ান্তর না দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সুভাষ চন্দ্র বসু গান্ধী-আরউইন চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।

বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলন আর আজাদ হিন্দ ফৌজের মরণপন সংগ্রামের মাধ্যমে। আজাদ হিন্দ ফৌজের মারাত্মক প্রভাব পড়ে ভারতে, তাদের অনুপ্রেরণায় ব্রিটিশ সরকারের অধীনে থাকা অনেক ভারতীয় সৈনিক বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। জল, স্থল ও বায়ু সেনা — সর্বত্র বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। এতে বিব্রত হয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান অনস্বীকার্য । এইভাবে বিংশ শতকের শুরুতে অরবিন্দ ঘোষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ করেন সুভাষ চন্দ্র বসু স্বয়ং। এইভাবে বাঙালি হিন্দুদের হাতেই ভারত স্বাধীন হয়।

[1] `The Alternative Leadership, Speeches, Articles, Statements and Letters’, June 1939-1941 Subhas Chandra Bose, Netaji Collected Works, Volume 10

[2] Sir Charles Tegart, “Terrorism in India’’

[3] Leonard Gordon, Brothers against the Raj

[4] Srikrishnan Saral, Indian Revolutionaries, 1757-1961, Vol 1

[5] Srikrishnan Saral, Indian Revolutionaries, 1757-1961, Vol 2

[6] Srikrishnan Saral, Indian Revolutionaries, 1757-1961, Vol 3

[7] Srikrishnan Saral, Indian Revolutionaries, 1757-1961, Vol 4

[8] Srikrishnan Saral, Indian Revolutionaries, 1757-1961, Vol 5

[9] Directorate of Education and Culture, Andaman and Nicober Administration, Port Blair, “Unsung Heroes of Freedom Struggle in Andamans Who’s Who’’

[10] Niranjan Sen, Banglar Bismrito Bandira, reproduced in Bharoter Swadhinota Sangram, Chattogram Bidroha o Biplabi Mahanayak Surjo Sen – Edited by Sharif Shamshir

[11] Jogesh Chandra Chatterji, “In Search of Freedom’’

[12] List of Indian Freedom Fighters who perished in struggle against British Colonialism Between 1883-1943 https://hinduperspective.com/2013/08/21/list-of-indian-freedom-fighters-who-perished-in-struggle-against-british-colonialism-between-1883-1943/

[13] RC Majumdar, “History and Culture of the Indian People’’, Vol. 11

[14] Subhas Chandra Bose, “Indian Struggle’’

 [15] Bharoter Swadhinota Sangram, Chattogram Bidroha o Biplabi Mahanayak Surjo Sen – Edited by Sharif Shamshir

[16] Subhas Chandra Bose, “Indian Pilgrim’’, reproduced in Netaji Collected Works, Volume I

[17] Suniti Kumar Ghosh, “The Tragic Partition of Bengal’’

[18] Collected Works of Mahatma Gandhi, Independence, Article in Young India, 13/01/1927 “http://www.gandhiserve.org/cwmg/vol038.pdf”http://www.gandhiserve.org/cwmg/VOL038.PDF

[19] Saswati Sarkar, Shanmukh, Dikgaj, “ My Experiments with Swaraj – Dissecting Mohandas Gandhi’’ https://www.myind.net/my-experiments-swaraj-mohandas-gandhi

[20] Saswati Sarkar, Shanmukh, Dikgaj, “ Two Revolutionaries, Rashbehari and Subhas – A Meeting of Minds Part 1’’ https://www.pgurus.com/two-revolutionaries-rashbehari-and-subhas-a-meeting-of-minds/

[21] Netaji Collected Works, Volume V

[22] Collected works of Mahatma Gandhi, Speech on Resolution on Nehru Report, Calcutta Congress III, 31/12/1928, “http://www.gandhiserve.org/cwmg/vol043.pdf”http://www.gandhiserve.org/cwmg/VOL043.PDF

[23] Subhas Chandra Bose, Azad Hind, Writings and Speeches, 1941-May 1943, Netaji Collected Works, Vol. 11

[24] SPEECH AT SUBJECTS COMMITTEE, A.I.C.C. LAHORE, December 27, 1929, HYPERLINK “http://www.gandhiserve.org/cwmg/VOL048.PDF”http://www.gandhiserve.org/cwmg/VOL048.PDF

[25] http://motherandsriaurobindo.in/_StaticContent/SriAurobindoAshram/-03%20The%20Ashram/Inspiring%20Connections/Sakharam%20Ganesh%20Deuskar.htm

[26] Emily Brown, “Har Dayal: Hindu revolutionary and Rationalist ‘’

[27] Asoke Bose, “ My Uncle, Netaji’’

[28] Ram Singh, Encyclopaedia Brittanica.

[29] Lord Hardinge, “India as I knew It’’

[30] Lord Rowlatt, “Seditions Report’’

[31] Harjot Oberoi, “Ghadar Movement and its Anarchist Genealogy’’, Economic and Political Weekly, Vol. 44, No. 50 (December 12-18, 2009), pp. 40-46

[32] S. K. Mittal and Irfan habib, The Congress and the Revolutionaries in the 1920s, Social Scientist, Vol. 10, No. 6 (June 1982), pp. 20-37

[33] Chitra Gupta, “The Life of Barrister Savarkar’’

[34] Arun Kumar Bose, “Indian Revolutionaries Abroad’’

[35] “Biography of Swadeshi Nationalists of Tamizh Nadu’’

[36] Shanmukh, Saswati Sarkar, Dikgaj, “The Citizenship Amendment Bill – A civilizational, historical and demographic necessity’’ https://sringeribelur.wordpress.com/the-citizenship-amendment-bill-a-civilizational-historical-and-demographic-necessity/

[37] Amit Shah pledges to add Citizenship (Amendment) Bill 2019 in BJP’s manifesto
https://m.dailyhunt.in/news/bangladesh/english/zee+news+english-epaper-zeeeng/amit+shah+pledges+to+add+citizenship+amendment+bill+2019+in+bjp+s+manifesto-newsid-109043867

[38] Abhas Chatterjee “The Concept of Hindu Nation’’ Voice of India, 1995

[39] Rashbeharir Atma-katha O dushprapya Rachana, edited by Amal Kumar Mitra

[40] Uma Mukherjee, “Two Great Indian Revolutionaries – Rash Behari Bose and Jyotindra Nath Mukherjee’’

[41] Lord Hardinge “My Indian Years: 1910-1916, ‘’ London, 1948

[42] Kalipada Chakrabarti, “The Chattogram of Agnijug and Andaman Memoirs’’

[43] John Hunt, “Life is a Meeting’’

[44] A revolutionary’s defence, Young India, February 12, 1925 http://www.gandhiserve.org/cwmg/VOL030.PDF

[45] Abid Hasan Safrani, “The men from Imphal’’

[46] G D Birla, “ In the Shadow of the Mahatma’’

[47] GS Sardesai, “ऐतिहासिक पत्रें यादि वगैरे‘’, 1889

[48] P Leela Moni, “EMS Namboodiripad and the Social Changes in Kerala’’, PhD Thesis.

[49] Malwinderjit S. Waraich and Gurdev S. Sidhu “The Hanging of Bhagat Singh: Complete Judgment and Other Documents’’

[50] Family Continues to Boycott Madan Lal Dhingra even as Country Celebrates his Martyrdom. https://indianexpress.com/article/india/punjab-and-haryana/family-continues-to-boycott-madan-lal-dhingra-even-as-country-celebrates-his-martyrdom/

[51] Ananta Singha, “Agnigarbha Chattogram”

[52] BN Mukherjee, “Nationhood and Statehood in India: A Historical Survey’’al Survey’’